হঠাৎ যেন আমার হৃদয়ের একেবারে শেষে শব্দ ও স্পন্দনের অনুভব ফিরে এলো–এই স্পন্দন হলো আসলে হৃৎপিণ্ডের ঝড় ওঠা। পরক্ষণেই শুধু নিস্তব্ধতা আর শূন্যতা। কিন্তু আবার ফিরে এলো শব্দ আর স্পন্দন সাথে সাথে স্পর্শও। এক অদ্ভুত ধরনের শিহরণ সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়লো। চিন্তাশক্তি বিলোপ ঘটেছে শুধু অস্তিত্বের অনুভূতি পাচ্ছি। এধরনের অবস্থা বেশ অনেকক্ষণ ধরে রইলো। কিছুক্ষণ বাদেই হঠাৎ করেই মস্তিষ্কের কার্য শুরু হলো, চিন্তাশক্তিও পুনরায় ফিরে এলো। সাথে সাথে ভীষণ ভয়ে মন ভরপুর হয়ে গেল, বাস্তব অবস্থা উপভোগ করার চেষ্টা মনে জেগে উঠলো। পরক্ষণেই ভীষণ ইচ্ছে করল আবার অজ্ঞান হয়ে যেতে। কিন্তু তবুও পুনরায় সমস্ত অনুভব মনে জাগল,–বিচারসভা, বিচারকগণ, বিচারকক্ষ, বিচারক, দণ্ডাদেশ, অসুস্থ ও অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, সবকিছুই মনে পড়ে গেলো। তবে তার পরেই যা ঘটেছিল তা পুরোপুরি বিস্মৃতির আড়ালে থেকে গেল,অনেক পরে তা ফিরে এসেছে অনেক চেষ্টার পরে কিন্তু তা অস্পষ্ট ভাবে।
আমি চোখ বুজেছিলাম এতক্ষণ। আমি চিৎ হয়ে শুয়ে আছি বুঝতে পারলাম, শরীরে কোনো বন্ধন নেই। হাত বাড়িয়ে দিতে সেই হাত খুব ভারী হয়ে একটা ভেজা, কঠিন জিনিষের উপর পড়ে গেল। অনেকক্ষণ হাতটাকে একই ভাবে রেখে আমি মনে করার চেষ্টা করলাম আমি কোথায়, আমি কী? চোখ মেলে দেখার ইচ্ছে হলো তবে ভরসা হলো না, চারপাশে প্রথমেই যে-সব জিনিষ চোখে পড়বে সেই সবকিছুকেই ভয়। কিন্তু এর মানে তা নয় যে ভয়ার্ত কিছুর সামনাসামনি হতে আমি ভয় পাই, ভয় হচ্ছে যদি আমি কোনো কিছু দেখতে না পাই। অবশেষে আমি খুব ভয়ে ভয়ে চোখ মেলোম। ঠিক ঐ মুহূর্তে যে ভয় আমার মনের মধ্যে ছিল তা সত্যি প্রমাণিত হলো। অনন্ত রাত্রির শূন্যতা আমায় আবিষ্ট করে রেখেছে, কষ্ট করে আমায় শ্বাস নিতে হচ্ছে, আমাকে চেপে ধরে আমায় মৃত্যুমুখে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে অন্ধকার যেন গুরুভার হয়ে। নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে থেকে আমি যুক্তি দাঁড় করাবার চেষ্টা করলাম। তদন্তের কথা স্মরণে এলো এবং তার থেকে সঠিক পরিস্থিতি উপভোগ করার জন্য সচেষ্ট হলাম। উচ্চারিত হলো দণ্ডাদেশ, আর তখন মনে হলো অনেকটা সময় চলে গেছে, তবু তা সত্ত্বেও এক সেকেণ্ডের জন্যও মনে আসেনি যে আমার মৃত্যু হয়েছে। উপন্যাস গল্পে যাই পড়ি না কেন এ ধরনের ধারণার সাথে বাস্তবের কোনো সম্বন্ধ নেই। কিন্তু আমি কোথায়, এবং কী অবস্থায় আছি? আমাকে কি তবে আবার বন্দীশালায় নিয়ে আসা হয়েছে? তবে এটা তো তা নয়, আমার খুবই পরিচিত সেই বন্দীশালা।
ঠিক সেইসময় আচমকা এক ভীষণ আতঙ্কে আমার রক্তস্রোত উন্মত্ততায় নেচে উঠলো আবার অজ্ঞান হয়ে গেলাম। পরক্ষণে কিছুটা সামলে নিয়ে আমি উঠে দাঁড়ালাম, সমস্ত শরীরে খুব ঝাঁকুনি লেগেছে। চারদিকে পাগলের মতো হাত ছোঁড়াছুঁড়ি করতে লাগলাম। কোনো কিছুই হাতে লাগলো না তবুও একটা পা-ও এগিয়ে যেতে সাহস পেলাম না, যদি কোনো স্মৃতিস্তম্ভের দেওয়ালে ধাক্কা খাই। দেহের প্রতিটা লোমকূপ দিয়ে ঘাম ঝরছে, বড় বড় বিন্দুতে তা কপালে জমছে, উৎকণ্ঠিত সেই যন্ত্রণা অবশেষে সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল,দুহাত বাড়িয়ে আমি সামনে এগিয়ে যেতে লাগলাম। যতটা সম্ভব চোখের দৃষ্টিকে তীক্ষ্ণ করলাম, আলো যদি কিছুটা দেখতে পাই। অনেক পা-ই এগোলাম, কিন্তু সেই অন্ধকার, সেই সীমাহীন শূন্যতাও। নিশ্বাস প্রশ্বাস একটু সহজ হলো, মনে হলো, তবে হয়তো সীমাহীন কঠিন অবস্থায় পড়তে হবে না।
ঠিক একইরকম আস্তে আস্তে আমি এগোচ্ছি, টোলেডোর ধর্মোন্মাদদের আতঙ্ক সম্পর্কে যে সব গুজব অনেক শোনা গিয়েছিল তা সবকিছুই স্মরণে এলো। জেলখানার অত্যাচার সম্পর্কে অনেক ভয়ার্ত গল্প শুনেছিলাম, মনে করেছিলাম সেগুলো নিছকই গল্প,–অবিশ্বাস্য, অতিরঞ্জিত।
আমার ভাগ্যে কি তবে এই ভূগর্ভস্থ অন্ধকারের রাজ্যে অনাহারে মৃত্যু রয়েছে, তা না হলে কি এর থেকেও ভয়ঙ্কর কিছু আমার জন্যে অপেক্ষা করছে? মৃত্যুই যে আমার শেষ পরিণতি সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ, আর সেই মৃত্যু যে অত্যন্ত যন্ত্রণাকাতর হবে তা বিচারকদের দেখেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম। সেই যন্ত্রণা কোন সময়ে আসবে আর তাকে দেখতেই বা কেমন হবে সেই ভেবেই আমি পাগলের মতো হয়ে উঠি।
অবশেষে আমার হাত একটা কঠিন কিছু স্পর্শ করলো। মনে হয় একটা দেয়াল যা পাথরের গাঁথনিতে তৈরি। মোলায়েম দেওয়ালটা খুব চটচটে আর কনকনে ঠান্ডা। সন্দিহানভাবে প্রতিটি পা ফেলে অত্যন্ত সন্তর্পণে সেই দেওয়াল ধরে এগোলাম। বুঝতে পারলাম না তবুও যে, আমার এই জেলখানার বিস্তৃতি কতটা? কারণ যেখান থেকে হাঁটা শুরু করেছিলাম দেওয়ালের চারপাশটা ঘুরে সেখানেই পৌঁছেছি কি না তা বুঝতে পারলাম না। পকেটে একটা ছুরি ছিল সেটার সন্ধান করলাম, কিন্তু সেটা কোথায়? আমার সমস্ত পোষাক খুলে নিয়ে মোটা ধরনের সার্জের পোশাক পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ছুরিটা যদি থাকতো তাহলে তার বাঁধানো ফলা দিয়ে দেওয়ালের কোথাও সঠিক জায়গায় বসিয়ে দিয়ে চিহ্ন রাখতে পারলাম। তবে এই সমস্যার সমাধান খুব একটা কঠিন ছিল না।
কিন্তু সেই সময়ের বিকৃত কল্পনায় তা একেবারেই সম্ভব ছিল না। একটুখানি জামার কাপড় থেকে ছিঁড়ে সেটা লম্বালম্বি করে দেওয়ালের সঙ্গে সমকোণে রেখে পুনরায় দেওয়াল ধরে এগোতে থাকলাম, অবশেষে সেটা যখন ছুঁয়ে দেখলাম তখন মনে হলো একপাক ঘঘারা হয়ে গেছে। সেই সময়ে আমার এই ধারণাই হয়েছিল। তা সত্ত্বেও কয়েদখানার আয়তন এবং আমার দুর্বলতা কোনোটাই গণনায় নিইনি। কয়েদখানার মেঝেটা ভেজা, পিছল। কিছুটা টলতে টলতে এগোবার পর আমি হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম, ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম, সেইজন্য ঠিক ঐভাবেই খানিকক্ষণ রইলাম। আর পরক্ষণেই ঘুমিয়ে পড়লাম।