হিলারীর নিজের ক্ষেত্রে এটা বর্ণে বর্ণে সত্যি। যে হিলারী ক্র্যাভেন ইংল্যান্ড থেকে এসেছিলো সে এখন অলিভ বেটারটনে পরিণত হয়েছে। এইসব রাজনৈতিক আলোচনা সে এখন কত সহজে করতে পারে। প্রতিদিনই সে যেন আরও বেশি করে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে–নবরূপে নতুন মানুষে পরিণত হয়েছে।
মাঝে মাঝে এই লোকগুলোকে ভয়ও করে। প্রতিভাবান লোকদের সঙ্গে এক ঘনিষ্ঠভাবে আর কখনও সে মেশেনি। এরা যেন সাধারণ মানুষের মতো নয়, অনেক উপরে। এই পাঁচজন–প্রত্যেকে প্রত্যেকের থেকে আলাদা। হিলারীর মনে হয়েছে–এরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ আবেগপ্রবণ আদর্শবাদের শিকার।
ডাঃ ব্যারন একদিন বলেছিলো–একটা ছোট্ট শিশির মধ্যে এমন বিধ্বংসী শক্তি ধরে রাখা যায়, যা একটা বিশাল মহাদেশকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে।
হিলারী তাকে জ্ঞিজ্ঞেস করেছিলো, এমন কাজকে কি আপনি সমর্থন করেন? সত্যিই কি একাজ করতে পারেন আপনি?
কেমন যেন অবাক হয়ে তাকিয়ে তিনি বলেছিলেন, অবশ্যই পারি–যদি প্রয়োজন হয় হাজারবার করতে প্রস্তুত আমি। কত কী জানার আছে ও কত কীই আবিষ্কার করার রয়েছে…
হেলগা নীডহেইমের প্রতি তার বিতৃষ্ণা আরও প্রকট। মেয়েটার এই প্রচণ্ড ঔদ্ধত্য তাকে আরও বেশি করে জ্বালা ধরিয়েছে। আর পিটার্সকে তার ভালো লাগলেও মাঝে মাঝে তার চোখে ভয়ঙ্করের আগুন দেখে সে ভয় পেয়েছে, গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে।
কোথায় যাচ্ছি আমরা? বারবার এই কথাটা ভাবছিলো হিলারী। এসবের শেষ কোথায়? এই লোকগুলো পাগল, এদের মাথামুণ্ডু নেই। প্রত্যেকেই যেন এক-একটা মরীচিৎকার পেছনে ছুটছে।
তৃতীয় দিনটাও শেষ হয়ে গেলো। ছোট্ট একটা শহরের গ্রাম্য হোটেলে এসে উঠেছে ওরা। এখানে এসে তারা আবার পাশ্চাত্যের আধুনিক পোশাক পরলো। ছোট্ট একটা ফাঁকা ঘরে সে-রাতটা ঘুমালো হিলারী। খুব ভোরে মিসেস পেকার তাকে ডেকে তুললেন। উঠে পড়ুন এক্ষুণি আমাদের বেরোতে হবে। প্লেন অপেক্ষা করছে।
-প্লেন?
–হ্যাঁ-প্লেন। বাব্বাঃ! এতদিন পর এবার একটু ভদ্রভাবে ঘোরা যাবে।
ঘন্টাখানেক গাড়ি পথে এসে বিমানবন্দরে পৌঁছলো ওরা। দেখে মনে হয়–সেনাবাহিনীর পরিত্যক্ত একটা বিমানঘাঁটি।
প্রায় সন্ধ্যে নাগাদ ওরা নামলো। চারিদিকে পাহাড়ঘেরা সমতল জায়গা। আগে যে একটা কর্মব্যস্ত বিমানবন্দর ছিলো তা স্পষ্ট। পাশে একটা বেশ বড়সড় সাদা বাড়ি।
মিসেস বেকার তাদের সেই বাড়িতেই এনে তুললেন। এটা যে সম্পূর্ণ কারো ব্যক্তিগত বিমানবন্দর সেটা বোঝা যায়, কারণ কোনরকম সরকারী অভ্যর্থনা পেলো না যাত্রীরা।
এতদিনে যাত্রা শেষ হলো, দারুণ খুশির মেজাজে আচমকা বলে উঠলেন মিসেস বেকার, এখন ভেতরে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে নেওয়া যাক। তার মধ্যে গাড়ি তৈরি হয়ে থাকবে।
–যাত্রা শেষ?–হিলারী হা করে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু এখনও তো আমরা সাগর পার হইনি।
আপনি তাই আশা করেছিলেন নাকি? মিসেস বেকার কৌতুকের স্বরে বললেন।
অবাক হয়ে হিলারী বললো, হ্যাঁ–মানে সত্যিই তাই আশা করেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম… থেমে গেলো সে।
-সব লোকেই তাই ভাবে। বোকা লোকগুলো লৌহ যবনিকা নিয়ে কত কী-ই না কল্পনা করে কিন্তু আমি বলি, পৃথিবীর যে-কোনো জায়গাতেই লৌহ যবনিকার অন্তরাল সৃষ্টি হতে পারে।
দুজন ভৃত্য আবার এসে তাদের অভ্যর্থনা জানালো। হাত-মুখ পরিষ্কার করে কফি, স্যান্ডউইচ, বিস্কুট–জলযোগ। খাওয়া শেষ হতে মিসেস বেকার ঘড়ি দেখলেন। আচ্ছা, এবার আমি উঠি, ভাই। আমি এখান থেকেই ফিরে যাবো।
হিলারী অবাক হয়ে বললেন, আপনি আবার মরক্কোয় ফিরে যাবেন?
ওটা ঠিক হবে না, কারণ ঐরকম একটা প্লেন দুর্ঘটনার পর আর কি সেখানে ফেরা উচিত। না, এবার আমাকে অন্য শিকারের পেছনে ছুটতে হবে।
কিন্তু কেউ তো আপনাকে চিনে ফেলতে পারে। ক্যাসাব্লাঙ্কা বা ফেজ-এর হোটেলের পরিচিত কেউ।
হ্যাঁ পারে, বললেন মিসেস বেকার। কিন্তু তারা ভুল লোককে চিনবে। আমার এক বোন, মানে আরেক মিসেস কেলভিন বেকার প্লেন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে। আর আমার বোনের সঙ্গে আমার মিল থাকাটাই স্বাভাবিক।
হ্যাঁ, একথা খুবই সত্যি, মনে মনে ভাবলো হিলারী। সমস্ত কর্মের বাহ্যিক গুণগুলোই মিসেস বেকারের মধ্যে বর্তমান। সারা দুনিয়ার সামনে, পরিচিত লোকজনের সামনে মিসেস কেলভিন বেকার নিজেকে এমন স্বতন্ত্রভাবে প্রকাশ করেছে যে, তার সেই বিশালত্বের পেছনে কী আছে জানা কঠিন।
বেকার বললেন, আচ্ছা চলি মিসেস বেটারটন। আপনার স্বামীর সঙ্গে পুনর্মিলন সুখের হোক এই কামনা করি।
সম্পূর্ণ অসহায়ভাবে হিলারী বললো, আমি যে কোথায় আছি তাও জানি না–পৃথিবীর ঠিক কোন্ জায়গায়?
এই কথা! এতো খুব সোজা না, এখন আর লুকোছাপার কোনো প্রয়োজন নেই। এটা সুউচ্চ অ্যাটলাসের দুর্গম স্থান একটা, এর খুব কাছেই–কথাটা শেষ না করেই মিসেস বেকার একে একে সকলের কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। সেই প্লেনটা তারই জন্যে অপেক্ষা করছিলো। কেমন যেন একটা ঠান্ডা শিরশিরানী অনুভব করছিলো হিলারী। মনে হলো, বহির্জগতের সঙ্গে শেষ যোগসূত্রটুকু এখানে ছিন্ন হয়ে গেলো।
পিটার্স হিলারীর মনের কথা বুঝেই বোধহয় এগিয়ে এসে মৃদুস্বরে বললো, এমন জায়গা যেখান থেকে ফেরার কোনো পথ নেই। হ্যাঁ, আমাদের কথাই বলছি।