- বইয়ের নামঃ ডেসটিনেশন আননোন
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- প্রকাশনাঃ সমতট
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, ভূতের গল্প, গোয়েন্দা কাহিনী
ডেসটিনেশন আননোন
০১. কর্নেল হোয়ারটন
ডেসটিনেশন আননোন
০১.
কর্নেল হোয়ারটন খবর আর কাজের ফিরিস্তি দেখে রাগে ঘরময় দাপাদাপি শুরু করে দিলেন।
কর্নেলের বয়সও বেশ, গায়ের রঙ কালো, মুখে একজোড়া বিরাট গোফ, সারাক্ষণ চিন্তিত এবং বেশ রাশভারী।
ডেস্কের ওপাশে দ্বিতীয় ভদ্রলোকটি সরকারী কাগজপত্রগুলোর উপর চোখ বুলোতে লাগলেন।
সব ওপরের কাগজে লেখা–টমাস চার্লস বেটারটন-পাশে জিজ্ঞাসাচিহ্ন। ভদ্রলোক চিন্তিতভাবে মাথা নেড়ে, বিবরণগুলো পড়ে দরকারী কথা খুঁজে পেলেন না।
বিরক্তভাবে কাঁধ ঝাঁকালেন হোয়ারটন, কার সাধ্য বোঝে?
ভদ্রলোকটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–ই। সত্যিই কার সাধ্য বোঝে! সে খুব চিন্তিতও নয় নির্বিকারও নয়। তার ক্লান্তিময় চোখ এবং চকচকে নিজ মুখ।
ভদ্রলোকের বয়সটা অনুমেয় নয়। বুড়োও নয় ছোকরাও নয়। মাটির তলার কৃত্রিম আলোয় থাকার জন্য গায়ের রঙ কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
এদিকে হোয়ারটন রাগে ফেটে পড়েছেন। কত্তো খবর! রোম থেকে, টুরেনের থেকে খবর, আজ রিভিয়েরায় দেখেছি; অ্যান্টওয়ার্পে চোখে পড়েছে; অসলোয় তো একেবারে সামনাসামনি, বিয়ারীজে চিনতে একটুও ভুল হয়নি; স্ট্যাটসবুর্গ-এ সন্দেহজনক অস্ট্যাণ্ডের সমুদ্রতীরে এক সুন্দরী লালচুলওলা মেয়ের সঙ্গে ঘুরতে দেখা গেছে। ব্রাসেলস-এর রাস্তায় গ্রে-হাউন্ড কুকুর নিয়ে বেড়াতে দেখেছি। এই তো তোমাদের খবর! তবু ভালো যে কেউ লেখেনি, চিড়িয়াখানায় জেব্রার গলা জড়িয়ে প্রেম করতে দেখেছি। বিশ্বাস নেই, তাও হয়তো লিখবে।
আহ, অতো চটছো কেন হোয়ারটন? এ বিষয়ে তোমার নিজস্ব অভিমত থাকলে বলল। আমার কিন্তু এই রিপোর্টে কিছুটা আশা জেগেছে। অবশ্য ইতিমধ্যে যদি না–ভদ্রলোক হঠাৎ থেমে গেলেন, যেন ঘুমিয়ে পড়েছেন। একটু পরেই আবার বলতে শুরু করলেন, ই, সম্ভবত তাই। কিন্তু তবুও…আমি ভাবছি?
কর্নেল হোয়ারটন ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ে বললেন, কিন্তু জেসপ, এই সমস্ত প্রশ্ন কোথায়-কেন-কেমন করে উত্তর খুঁজে বের করতেই হবে। প্রতিমাসে এইরকম একজন কৃতী বিজ্ঞানী উধাও হয়ে যাবে আর আমরা কোথায়-কেন-কেমন করে এসবের কিছু না জেনে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাবো এটা তো হতে পারে না। আমাদের দেখতে হবে যেখানে আমরা সন্দেহ করছি সেটাই ঠিক না অন্য কোথাও! প্রথম থেকেই আমরা যেটাকে সঠিক বলে জায়গা ভেবেছি কিন্তু এখন আর সেটাকে সঠিক জায়গা বলে ভাবতে পারছি না।…ভালো কথা, সবশেষে খবর আমেরিকা থেকে এসেছে বেটারটন সম্বন্ধে সেটা দেখেছো তো?
হুঁ! একটা বয়সে স্বাভাবিক বিপ্লবী হবার ঝোঁক থাকে। তবে বেশিদিন এই ঝোঁক ছিল না। পাকা বিপ্লবী হবারও কোনো খবর পাওয়া যায়নি। যুদ্ধের আগে উনি ভালো কাজ করেছেন। ম্যানহেইম যখন জার্মানি থেকে পালিয়ে যান বেটারটন তার সহকারী হিসেবে কাজ করেন এবং তার মেয়েকে বিয়ে করেন। ম্যানহেইমের মৃত্যুর পর তার কাজকর্ম বেটারটনই দেখাশুনা করেন। কিছুদিনের মধ্যে শূন্য শক্তির পরমাণু বিভাজন আবিষ্কার করে সারা দুনিয়ায় চমক লাগিয়ে দেন। তাকে সবাই সম্মানে ভূষিত করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই তার স্ত্রী মারা যান। তিনি সোকে আমেরিকা ছেড়ে ইংল্যান্ডে চলে আসেন। এই দেড় বছর ধরে হারওয়েলে বসবাস করেন এবং ছমাস আগে বিয়ে করেন।
হোয়ারটন প্রশ্ন করেন, ওর বর্তমান স্ত্রী সম্পর্কে কোনো খবর পাওয়া গেছে?
জেসপ মাথা নেড়ে বলেন, খোঁজ নিয়েছি, মেয়েটি এক ব্যবহারজীবীর মেয়ে। বিয়ের আগে একটি বীমাসংস্থায় কাজ করতো। এবং তার রাজনীতির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না।
‘শূন্যশক্তি বিভাজন? গলায় বিতৃষ্ণা ফুটে উঠলো হোয়ারটনের। তিনি বললেন–কথাটার মানে কি ভাবছি! আমি সেকেলে লোক এত বয়সেও একটু পরমাণু চোখে দেখলাম না। অথচ শুনছি এই পরমাণুই দুনিয়াটাকে টুকরো করে দিচ্ছে, পরমাণু দিয়ে বোমা তৈরি হচ্ছে, শূন্যশক্তি বিভাজন হচ্ছে।…কালে কালে কত কী হবে! বেটারটন আবার ভাঙাভাঙির পয়লা নম্বর পাণ্ডা। আচ্ছা, হারওয়েলের লোকেদের ওর সম্পর্কে কী মতামত?
হারওয়েলের লোকেরা বলে উনি মাটির মানুষ। বেটারটনের কাজ সম্পর্কে তাদের ধারণা –অনেক কাজই করেন তবে তার লাগাবার মতো তেমন কিছু নয়। শূন্যশক্তির বিভাজনকে কার্যক্ষেত্রে এদিক-ওদিক প্রয়োগ করেন।
দুজনেই খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। তথ্যসংবাদীয় আলোচনা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে ব্যক্তিগত আলোচনায় চলে গেছেন দুজনে।
হোয়ারটন স্তব্ধতা ভেঙে বললেন, ইংল্যান্ডে আসার পর তাকে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছিল?
হা। সবকিছুই সন্তোষজনক ছিলো।
আঠারো মাস আগেকার কথা, হোয়ারটন চিন্তিতভাবে বললেন, তুমি নিশ্চয়ই জানো এই সমস্ত মানুষগুলো দিনরাত অন্ধকার ঘরে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে চোখ রেখে অস্বাভাবিক ভাবে বন্দী জীবন যাপন করে। এরা আদর্শ দুনিয়া গড়ার কথা এবং মানবজাতির কল্যাণের কথা চিন্তা করে এবং ঠিক সেই সময় এক শ্রেণীর মানুষ সুযোগ বুঝে এদের হাতের মুঠোয় নিয়ে আসে। তিনি আবার বললেন, বিজ্ঞানীদের মতো এত প্রতারিত আর কেউ হয় না, তা অবশ্য আমি বলতে পারবো না।
জেসপ ক্লান্তির হাসি হেসে বললেন, হ্যাঁ, তাই হবে হয়তো, সবচেয়ে বড় কথা–এরা মনে করে যে, এরা অনেক কিছু জানে। কিন্তু আমাদের ধাঁচটাই আলাদা। সারা দুনিয়ার রক্ষার কথা চিন্তা করি না। শুধু দু-একটা টুকরো নিয়ে, কোনো কাজকর্ম আটকে গেলে তার কলকজাগুলোকে ঢিলে করে দিলেই আমাদের কর্তব্য শেষ। তিনি চিন্তিতভাবে বললেন, শুধু বেটারটন সম্পর্কে যদি বিশদ জানতে পারতাম। তার জীবন সম্পর্কে জানতে চাই না, তার কাজকর্মের কথাও না–কয়েকটা খুঁটিনাটি কথা। কী ধরনের রসিকতা তার ভালো লাগতো, কোন্ কোন্ কথা তিনি হলফ করে বলতে পারতেন, কার প্রশংসা করতেন এবং কে তাঁকে পাগল করে তুলেছিলো ব্যাস।
হোয়ারটন অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ওর স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছ?
-অজস্রবার।
–তিনি কোনো সাহায্য করতে পারেন না?
জেসপ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, এখনো তো পারেননি।
-তোমার কি ধারণা–উনি কিছু জানেন?
-কিছু জানেন এটা অবশ্য তিনি স্বীকার করেননি। স্রেফ প্রতিক্রিয়াগুলো প্রকাশ পেয়েছে –চিন্তা, দুঃখ আর আকুল উদ্বেগ। স্বামীর জীবনযাত্রা ছিল স্বাভাবিক, মানসিকতার লক্ষণ ছিল না, এছাড়া কোনো সূত্র বা সন্দেহের কথা বলতে পারেন না। তবে তার নিজস্ব মতামত তার স্বামীকে গুম করা হয়েছে।
–আর তোমার সেটা বিশ্বাস হয় না–এই তো?
–আমি কখনো কাউকে বিশ্বাস করি না–এ বিষয়ে আমার অক্ষমতার কথা স্বীকার করছি।
হোয়ারটন বলতে লাগলেন-ও আচ্ছা! আমার মনে হয় সবকিছু ভোলামেলা আলোচনা করাই ভালো। মহিলাটি কেমন?
–একদম সাধারণ মহিলা, যে-কোনো দিন দেখা যাবে তাসের আড্ডায় ব্রিজ খেলছেন।
কিছু যেন বুঝতে পেরেছেন এমনভাবে মাথা নাড়লেন হোয়ারটন। তার মানে ব্যাপারটা আরো জটিল হয়ে পড়লো।
ভদ্রমহিলা এখনই আমার কাছে আসবেন। দেখি, আর একবার পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটা যাক।
–হ্যাঁ, এটাই একমাত্র উপায়। এসব কাজ আমার দ্বারা হয় না কারণ আমার ধৈর্য কম। হোয়ারটন উঠে পড়লো। ঠিক আছে, তোমাকে আটকাবো না। আমার তো মনে হয় বেশিদূর এগোইনি, কি বলো?
–দুভাগের বিষয় না–তুমি অসলো থেকে পাঠানো খবরটা ভালো করে দেখো। এটাই সম্ভাব্য জায়গা।
হোয়ারটন বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার পর জেসপ ফোন তুলে মিসেস বেটারটনকে ওঁর ঘরে পাঠিয়ে দেবার কথা বললেন।
জেসপ ছাদের দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন। দরজায় মৃদু টোকা দিয়ে মিসেস বেটারটন ঘরে ঢুকলেন। সাতাশ বছর বয়স, দীর্ঘাঙ্গী মহিলা। মাথায় সোনালি চুল দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সোনালি চুলের সৌন্দর্যে মুখখানা দেখার যেন প্রয়োজনই হয় না। মুখের উপর লালচে একখানা –এবং তার নিচে সবুজ একজোড়া চোখ। জেসপ লক্ষ্য করলেন–ভদ্রমহিলা কোন প্রসাধন ব্যবহার করেননি। ভদ্রমহিলাকে বসতে বলেজেসপের মনে ক্ষীণ একটা আশার আলো দেখা দিল। মনে হলো মিসেস বেটারটন আরো কিছু বেশি জানেন।
তিনি নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন, দুঃখে কাতর কোনো মহিলা প্রসাধন করতে ভোলে না। বেদনার ক্ষতগুলো ভেসে উঠলে সেগুলিকে প্রলেপ দিয়ে আড়াল করতে চায়। অথচ মিসেস বেটারটনের ক্ষেত্রে সেটা হলো না কেন? মিসেস বেটারটন কি ইচ্ছে করেই প্রসাধন ব্যবহার করেননি যাতে একজন বিরহিণী স্ত্রীর ব্যথাতুর মুখটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
মিসেস বেটারটন জেসপকে জিজ্ঞেস করলেন, অনেক আশা নিয়ে এসেছি আমি কোনো খবর আছে?
জেসপ নম্রস্বরে ঘাড় নেড়ে সান্ত্বনা দিলেন। আপনাকে আরেকবার ডেকে আনার জন্য খুব দুঃখিত, আপনাকে নিশ্চিত কোনো খবর দেবার নেই বলে আমার লজ্জা করছে।
অলিভ বেটারটন বললেন, আমি জানি। আপনি এই কথা আমাকে চিঠিতে লিখেও জানিয়েছেন। তবু একবার এলাম, এতদিন হলো যদি কোনো খবর থাকে। সারাদিন বাড়িতে বসে চিন্তা করা–সে যে কী ভয়ঙ্কর। এ ব্যাপারে কারো কিছু করার নেই–এটা ভেবে আরো খারাপ লাগে।
জেসপ নম্রস্বরে বললেন, মিসেস বেটারটন, আশা করি, আমি যদি আপনাকে একই কথা একই প্রশ্ন কিংবা একই বিষয়ের উপর জোর দেই তাতে আপনি কিছু মনে করবেন না। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে এর মধ্যে থেকে একটা মূল্যবান কথা যা আপনার মনে পড়েনি বা উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করেননি, সেই কথাটা বেরিলয়ে আসতে পারে।
-হ্যাঁ, আমি বুঝতে পেরেছি। আপনি আবার প্রথম থেকে জিজ্ঞেস করুন।
–আচ্ছা, আপনি আপনার স্বামীকে শেষ দেখেন–গত ২৩শে আগস্ট, তাই তো?
–হ্যাঁ।
তার মানে–প্যারিসে এক সম্মেলনে যোগ দেবার জন্য যেদিন তিনি ইংল্যান্ড ত্যাগ করেন, সেইদিন।
–হ্যাঁ।
জেসপ এবার দ্রুত বলতে লাগলেন, সম্মেলনে প্রথম দুদিন উপস্থিত ছিলেন, তৃতীয় দিন অনুপস্থিত ছিলেন। তিনি তার এক সহকর্মীকে সম্মেলনে না গিয়ে ব্যাটো ম্যাস-এ চড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন।
-ব্যাটো ম্যাস? ব্যাটো ম্যাসটা কী জিনিস?
জেসপ হেসে বললেন, যেমন নদীতে ছোট ছোট নৌকো তির তির করে ঘুরে বেড়ায়। ভ্রমণার্থীদের বিশেষ আকর্ষণের জন্য এই ব্যাপারটা আপনার স্বামীর পক্ষে অস্বাভাবিক বলে মনে হয় না।
অলিভ দ্বিধা করলেন, হুঁ, তাই আমার ধারণা ছিল, সম্মেলনের আলোচনা নিয়ে তিনি একাগ্র হয়ে থাকবেন।
–হয়তো তাই, তবু ধরে নেওয়া যেতে পারে সেদিনের আলোচ্য বিষয়ের তেমন কোনো গুরুত্ব ছিলো না দেখে, তিনি সেদিনের জন্য অবসর নিয়েছিলেন। তবুও এটা আপনার স্বামীর উপযুক্ত কাজ বলে মনে হচ্ছে না।
অলিভ মাথা নাড়লেন।
–সেদিন রাত্রে তিনি আর হোটেলে ফেরেননি। যতদূর খোঁজ পাওয়া যায় তাতে জানা গেছে তিনি নিজের ছাড়পত্র দেখিয়ে কোনো সীমান্ত অতিক্রম করেননি। আপনার কি মনে হয় অন্য কারো নামে তার কাছে দ্বিতীয় ছাড়পত্র ছিল?
-না তা কেন থাকবে?
জেসপ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, একরকম কোনো জিনিষ তার কাছে আছে। কি না লক্ষ্য করেননি?
অলিভ মাথা নেড়ে বললেন, না, আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি না টম স্বেচ্ছায় কোথাও পালিয়েছে। যেটা আপনারা প্রতিপন্ন করতে চাইছেন। আমার বিশ্বাস তার কিছু একটা হয়েছে কিংবা স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে।
-তার স্বাস্থ্য তো বেশ ভালো ছিলো, তাই না?
হা! খুব বেশি প্রশ্ন করতেন দেখে একটু ক্লান্তি বোধ করতেন, এছাড়া আর কিছু না।
–তাকে দেখে কখনো চিন্তিত বা মনমরা মনে হতো?
-কোনো ব্যাপারে তিনি মনমরা থাকতেন না। অলিভ কাঁপা হাতে ব্যাগ খুলে রুমাল বের করলেন। বিশ্রী ব্যাপার সব, তার গলা কাঁপছে। অসম্ভব, আমাকে না বলে উনি কোথাও যেতেন না। নিশ্চয়ই ওকে কেউ গুম করেছে। এরকম ভাবতেও আমার গা শিউরে ওঠে। হয়তো বা উনি মারাও যেতে পারেন।
–আহা, দয়া করে শুনুন মিসেস বেটারটন, এতখানি খারাপ চিন্তা করবেন না, তিনি যদি মারা যেতেন তাহলে তার মৃতদেহ পাওয়া যেত।
–নাও হতে পারে। প্যারিসে সবকিছুই সম্ভব, হয়তো তাকে মেরে নর্দমায় খুঁজে দিয়েছে।
–আমি আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি, প্যারিসে পুলিশী ব্যবস্থা অত্যন্ত সুষ্ঠু।
রুমালটা সরিয়ে নিয়ে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন অলিভ। আপনি কী ভাবছেন আমি জানি, কিন্তু সেটা সঠিক নয়। টম কখনোই গোপনীয়তাকে নিয়ে বিক্রি বা বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। টম কমিউনিস্ট নয়। তাঁর সারা জীবনের ইতিহাস একটা ভোলা বইয়ের পাতার মতো উন্মুক্ত।
-তার রাজনৈতিক বিশ্বাস কি ছিলো, মিসেস বেটারটন?
আমার ধারণা অ্যামেরিকায় ডেমেক্র্যাট ছিলেন কিন্তু এখানে শ্রমিক দলকে ভোট দিয়েছেন। রাজনীতিতে কোনোদিনই স্পৃহা ছিল না। তিনি শুধু বিজ্ঞানী–প্রতিভাবান বিজ্ঞানী; ব্যাস।
হ্যাঁ, জেসপ বললেন, উনি প্রতিভাবান বিজ্ঞানী ছিলেন আর সেটাই ঘটনার মূলবস্তু। হয়তো এরজন্যই তাকে অনেক কিছুর লোভ দেখিয়ে এই দেশ থেকে অন্যদেশে নিয়ে যায়।
-না, এ ঠিক নয়। অলিভের চোখে ক্রোধের ঝিলিক খেললো। খবরের কাগজ প্রমাণ করতে চেষ্টা করছে এবং আপনারাও একই প্রশ্ন করছেন। অথচ এ সত্যি নয়। আমাকে আভাস না দিয়ে উনি কোথাও যেতে পারেন না।
–তিনি আপনাকে কিছুই বলে যাননি, তাই তো? জেসপ একথা বলে ওঁকে লক্ষ্য করতে লাগলেন।
কিছুই বলেননি। উনি কোথায় আছেন, না আছেন আমি কিছুই জানি না। ওকে গুম করা হয়েছে হয়তো বা মেরেও ফেলা হয়েছে। বিশ্বাস করুন, এভাবে আর আমি চলতে পারছি না। খেতে পারি না, ঘুমোতে পারি না, অসহ্য, আপনি আমাকে সাহায্য করতে পারেন না?
জেসপ চেয়ার ছেড়ে এসে বলতে লাগলেন, মিসেস বেটারটন, আমি দুঃখিত। আপনার স্বামীর খোঁজ পাবার জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। দেশবিদেশের প্রান্ত থেকে রোজই কিছু-না-কিছু খবর আসছে।
অলিভ তীক্ষ্ণ স্বর করে বললো, কোথাকার খবর, কী খবর আসছে?
–অনেকের খবর। খবরগুলো বাছাই করে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। জানেনই তো, . এসবের ক্ষেত্রে দেখা যায় শেষ পর্যন্ত সবকিছুই ফক্কা।
-কিন্তু আমাকে সবকিছু জানতে হবে, অলিভ বলতে লাগলেন। এভাবে চলা অসম্ভব।
–স্বামীর জন্য খুব চিন্তা করেন, মিসেস বেটারটন?
–অবশ্যই চিন্তা করি। চিন্তা করাই স্বাভাবিক, মাত্র ছমাস হলো আমাদের বিয়ে হয়েছে।
-আমি জানি, তবু একটা কথা জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হচ্ছি বলে মাফ করবেন–আপনাদের মধ্যে কোনো ঝগড়াঝাটি বা অন্য কোনো মহিলাকে নিয়ে মন কষাকষি হয়েছিল?
-মোটেই না–একথা আপনাকে আগেও বলেছি। গত এপ্রিল মাসে মাত্র আমাদের বিয়ে হয়েছে।
–আপনি বিশ্বাস করুন একথা আমি মোটেই বোঝাতে চাইছি না যে, এমন কোন ঘটনা ঘটেছে–কিন্তু একজন মানুষ হঠাৎ উবে গেলে তার সবদিক খুঁটিয়ে দেখা একান্ত প্রয়োজন। তাহলে আপনি বলছেন–বর্তমানে আপনার স্বামীকে এখনও উদ্বিগ্ন বা চিন্তিত বা কোনো বিষয়ে চঞ্চল বলে মনে হয়নি?
আপনি হয়তো জানেন মিসেস বেটারটন, আপনার স্বামী যে ধরনের কাজ করেন বা পরমাণুসংক্রান্ত কাজ, এটাতে কঠোর নিরাপত্তা মেনে চলতে হয়। এই অবস্থায় মাথা খারাপ হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
অলিভ না হেসে বললেন, উনি অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিলেন।
–নিজের কাজকর্ম সম্পর্কে উনি কি খুব খুশী ছিলেন? আপনার সঙ্গে কাজকর্ম সম্বন্ধে আলোচনা করতেন?
-না, ওসব বড়ই কুটচালের ব্যাপার।
–তিনি যে এই আণবিক বোমার বিধ্বংসী সম্ভাবনা সম্পর্কে বিবেকের তাড়নায় অস্থির হয়ে উঠেছিলেন একথা আপনি মনে করেন না, তাই তো? বিজ্ঞানীরা কিন্তু এক-একসময় এই কথাটা খুব বেশি করে অনুভব করেন।
না–তাকে এ ধরনের কথা কখনো বলতে শুনিনি।
জেসপ বললেন, দেখুন মিসেস বেটারটন, আমি যা বলতে চাইছি তা হলো আপনার স্বামীর সম্পূর্ণ ছবি। তিনি কী ধরনের লোক ছিলেন সেটাই জানতে চেষ্টা করছি। কিন্তু আপনি আমাকে সাহায্য করছেন না।
-আপনার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর আমি দিয়েছি-এর থেকে বেশি আমি কী বলতে পারি?
-হ্যাঁ, আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, তবে সেগুলি নেতিবাচক, ইতিবাচক উত্তর আপনি দেননি? একজন লোকের সম্পর্কে সব কিছু জানা থাকলে তবে কাজের সুবিধা হয়, লোকটিকে খুঁজে পাওয়া যায়।
একটু চিন্তা করে অলিভ বললেন, বুঝলাম, হ্যাঁ, টম সবসময়ই হাসিখুশী, নম্র স্বভাবের মানুষ ছিলেন। এবং বুদ্ধিমানও।
জেসপ হেসে বললেন, এটা তো একজন লোকের গুণের কথা, আমরা এবার ব্যক্তিগত ব্যাপারে আলোচনা করি। আচ্ছা তিনি কি খুব বেশি পড়াশুনা করতেন?
-হ্যাঁ, একটু বেশিই পড়তেন।
–কী ধরনের বই পড়তেন?
–এই জীবনী। মাঝেমধ্যে বুক সোসাইটির সুপারিশ এবং ক্লান্ত থাকলে রহস্যকাহিনী পড়তেন।
–একেবারে রীতিনিষ্ঠ পড়ুয়া, বিশেষ করে কোনো ধরনের বইয়ে আগ্রহ ছিলো না, আচ্ছা উনি কি তাস বা দাবা খেলতেন?
ভালো ব্রিজ খেলতো ও, প্রতি সপ্তাহে একদিন বা দুদিন আমরা ডাঃ ইভান্স আর তার স্ত্রীর সঙ্গে তাস খেলতাম।
-আপনার স্বামীর কি অনেক বন্ধুবান্ধব ছিলো?
–হা, ও খুব মিশুকে।
-না, ঠিক তা বলছি না আমি। আমি বলতে চাইছি তিনি কি এমন ধরনের লোক ছিলেন, যিনি বন্ধুদের জন্য চিন্তা করেন?
–আমাদের দু-এজন প্রতিবেশীর সঙ্গে ও গলফ খেলতো।
–তার নিজের কোনো বিশেষ বা অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলো না?
না আপনি তো জানেনই তার জন্ম কানাডায়, এবং জীবনের অনেকগুলো বছরই কেটেছে যুক্তরাষ্ট্রে। এখানে বেশি লোকের সঙ্গে ওর পরিচয় ছিলো না।
জেসপ টেবিলের কাগজপত্রগুলোয় একবার চোখ বুলিয়ে দেখে বললেন, দেখতে পাচ্ছি যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে তিনজন লোক টমের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন তাদের নামও রয়েছে এখানে। এর থেকে এটুকু বুঝতে পারছি যে বাইরের দুনিয়ার মাত্র এই তিনজনের সঙ্গেই তার যোগাযোগ ছিল। এঁদের উপর আমরা নজর রাখছি। প্রথম জন হচ্ছে ওয়াল্টার গ্রিফিথ। ইনি হারওয়েলে আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন।
-হ্যাঁ, উনি ইংলন্ডে বেড়াতে এসে টমের সাথে দেখা করে যান।
–তাতে আপনার স্বামীর প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিলো?
–আমেরিকায় থাকতে ওদের বন্ধুত্ব ছিল, টম ওকে দেখে আশ্চর্য এবং খুশীও হয়েছিলো।
–গ্রিফিথকে দেখে আপনার কেমন মনে হয়েছিল, একটু বর্ণনা দিন তো?
–কিন্তু তার সম্পর্কে আপনার সব কিছুই জানা।
–তার সম্পর্কে আমরা সব জানলেও আপনি তাকে কী ভেবেছেন সেটা জানতে চেয়েছি। মার্জিত ব্যবহার করেছিলেন, এবং মনে হয়েছিল..টমকে উনি খুব ভালোবাসেন। টম ইংল্যান্ড থেকে চলে আসার পর সেখানে কী ঘটেছে সেসব কথা বলার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন, সাধারণ প্রতিবেশীদের গল্প বলে মনে হয়েছিলো। আমি তাদের কাউকে দেখিনি, চিনিও না, এ আলোচনা আমি শুনিওনি। ওরা যখন স্মৃতিচারণে মশগুল, তখন আমি রাতে খাবার তৈরিতে ব্যস্ত ছিলাম।
রাজনৈতিক কোনো আলোচনা এসে পড়েনি?
–আপনি কি আবার বলতে চাইছেন তিনি কমিউনিস্ট। অলিভ বেটারটনের মুখটা আরক্ত হয়ে উঠলো। আমি নিশ্চিত যে তিনি এরকম ব্যাপারের সঙ্গে জড়িত নন। যতদূর জানি সরকারী কাজে জিলা-এ্যাটর্নী অফিসে এসেছিলেন তিনি। টম একবার তাকে আমেরিকায় ‘ডাইনী ধরার ব্যাপারে কী যেন একটা রসিকতা করেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে উনি গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন, আমেরিকায় ওটার প্রয়োজন আছে, আমরা এখানে বসে সেটা বুঝতে পারবো না। এর থেকেই বোঝা যায় উনি কমিউনিস্ট নন।
মিসেস বেটারটন, অত উত্তেজিত হবেন না।
–আমি হাজারবার বলছি টম কমিউনিস্ট ছিলেন না। আর আপনি আমাকে বিশ্বাস করছেন না।
–হ্যাঁ এবার বাইরের দুনিয়া থেকে আসা দ্বিতীয় ব্যক্তি ডঃ মার্ক লুকাস, লন্ডনের ডরসেটে তার সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয় আপনাদের।
-হ্যাঁ, আমরা ডরসেটে নৈশাহার করছিলাম। রসায়ণশাস্ত্রের গবেষক, নাম লুকাস, এগিয়ে এসে টমকে জড়িয়ে ধরলেন। টম যখন আমেরিকায় থাকতো তখনই তার সাথে শেষ দেখা। পরে ভদ্রলোক আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। এসব তো…
-হ্যাঁ, এসব আমি জানি। ভদ্রলোককে দেখে আপনার স্বামী কি খুব খুশী এবং অবাক হয়েছিলেন?
–হ্যাঁ, ভীষণ খুশী এবং ভীষণই অবাক হয়েছিলেন।
–আপনি নিশ্চিৎ নন? জেসপ বললেন।
–টম যে তাকে খুব একটা পাত্তা দেয়নি সেটা পরে ও আমাকে বলেছিল।
–এটা কি নিছকই সাক্ষাৎকার আপনার মনে হয়? পরে কি আবার দেখা-সাক্ষাৎ করার দিন ধার্য হয়নি?
-না, এটা নিছকই হঠাৎ দেখা।
-এবার বাইরে থেকে আসা তৃতীয় ব্যক্তি হলেন একজন মহিলা, নাম–ক্যারল স্পীডার। এঁকে আপনার কেমন মনে হয়েছে?
-ভদ্রমহিলার জাতিসঙ্ঘে কোনো কাজ ছিলো। একদিন টমকে জিজ্ঞেস করেন মধ্যাহ্নভোজে আসতে পারবেন কিনা?
–আপনারা গিয়েছিলেন?
–না।
–আপনি যাননি, কিন্তু আপনার স্বামী গিয়েছিলেন।
–কি বললেন? অলিভ বললেন।
–যেন আপনাকে উনি কিছু বলেননি?
–না।
অলিভ বেটারটন কেমন যেন হতচকিত হয়ে গেলেন। জেসপ আশার আলো খুঁজে পেলেন। মিসেস বেটারটন বললেন, আমি বুঝতে পারছি না টম এ ব্যাপারে আমাকে কিছু বলেনি কেন?
–হ্যাঁ, ১২ই আগস্ট বুধবার মিসেস স্পীডার যেখানে থাকতেন সেখানেই মধ্যাহ্নভোজ সারেন।
–বারোই আগস্ট?
হা। হা…ঐ সময়ে ও লন্ডন গিয়েছিল বটে কিন্তু আমাকে কিছুই বলেনি। হঠাৎ একটা প্রশ্ন করে বসলেন, ভদ্রমহিলাকে কেমন দেখতে বলুন তো?
জেসপ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, বয়স তিরিশের কাছাকাছি, উদ্ভিন্নযৌবনা নন, কর্মদক্ষ এবং চটপটে। সুন্দরী নন, আপনার স্বামীর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা ছিলো এরকম খবরও নেই। তাই অদ্ভুত লাগছে এই সাক্ষাৎকার কেন তিনি গোপন করলেন?
–হ্যাঁ, আমিও তাই ভাবছি।
এবার একটু ভালো করে চিন্তা করে বলুন, প্যারিস সম্মেলনের আগে আপনার স্বামীর মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখেছিলেন কি?
না, আমি কিছু লক্ষ্য করিনি।
জেসপ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই টেলিফোন বেজে উঠল এবং তিনি কথা বললেন।
অন্যপ্রান্ত থেকে কেউ একজন বললো, বেটারটন সংক্রান্ত তদন্তের ব্যাপারে উচ্চপদস্থ কারো সঙ্গে এক ভদ্রলোক দেখা করতে চান। কী নাম?–অন্যপ্রান্ত থেকে বললো, স্যার নামটা বুঝতে পারছি না, বানানটা বলছি।
ঠিক আছে বলো। ফোনের ওপাশ থেকে যে কথাগুলো হলো তা তিনি কাগজে লিখে জিজ্ঞেস করলেন উনি কি পোল্যান্ডের লোক?
–কিছু বলেননি স্যার।
আচ্ছা ওকে বসতে বলল।
এবার জেসপ অলিভকে দেখলেন, বিধ্বস্ত, নিঃস্ব, স্থিরমূর্তির মতো বসে আছেন। জেসপ সদ্যলেখা অংশটুকু অলিভকে দেখালেন। এ নামে কাউকে চেনেন?
নামটা দেখার সাথে সাথে অলিভ ভয় পেয়ে চোখ দুটো বড় বড় করলেন। তারপরেই বললেন, উনি আমার কাছে একটা চিঠি লিখেছিলেন।
কবে?
গতকাল, উনি টমের প্রথমা স্ত্রীর পিসতুতো ভাই, টমের অন্তর্ধান সম্পর্কে খুবই চিন্তিত। আমাকে সমবেদনা জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন।
-এঁর কথা আগে শুনেছেন বা আপনার স্বামী ওঁর কথা কখনো বলেছেন?
–না।
–উনি আপনার সতীনের পিসতুতো ভাই নাও হতে পারেন।
অলিভ বললেন, একথা মনে হয় না আমার। টমের প্রথমা স্ত্রী প্রফেসর ম্যানহেইমের মেয়ে। ওঁর চিঠি পড়ে মনে হয় টম এবং টমের প্রথমা স্ত্রীর সম্পর্কে উনি সব জানেন। কিন্তু যদি লোকটা আসল না হয় তাহলে কে হতে পারে আপনি মনে করছেন?
–এখানে আমরা এত অজস্র জিনিষ নিয়ে আলোচনা করি, যে কোনো বিষয়ের ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র অংশের সামান্য এদিক-ওদিক হলেও আমাদের সন্দেহ হয়।
জেসপ বললেন, বদ্ধ ঘরের একটা আতঙ্কজনক প্রতিক্রিয়া আছে।
অলিভ বেটারটন বললেন, চুপচাপ বসে অপেক্ষা করা–এ আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আমি কোথাও চলে যেতে চাই। যেখানে সাংবাদিকরা টেলিফোন করে বিরক্ত করবে না। বন্ধু-বান্ধব কোনো রকম বিরক্ত করবে না। ডাক্তার দেখিয়েছি। উনি আমাকে বাইরে থেকে ঘুরে আসতে বলেছেন।
ব্যাগ হাতড়ে একটা খাম বের করে তিনি জেসপকে দেখালেন, দেখুন ডাক্তার কী লিখেছেন?
চিঠি পড়ে জেসপ বললেন, নিশ্চয়ই যাবেন।
-না–আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো আপত্তি করবেন।
–আপত্তি করবার কিছু নেই। কোনো খবর পেলে যোগাযোগ করতে পারি এরকম ব্যবস্থা করবেন।
নিশ্চয়ই।
–কোথায় যাবার কথা ভাবছেন?
–এমন কোথাও যেখানে সূর্যের আলো আছে এবং বেশি ইংরেজ নেই। যেমন ধরুন-স্পেন, বা মরক্কো।
ভারি সুন্দর জায়গা আপনার ভালো লাগবে।
অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে জেসপকে করমর্দন করে অলিভ চলে গেলেন। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে বসে জেসপ ফোন করে বললেন, মেজর গ্লাইদরকে পাঠিয়ে দিতে।
.
০২.
মেজর গ্লাইদর? জেসপ নামটা উচ্চারণ করে একটু থামলেন। ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে বললেন, নামটা একটু বেয়াড়া ধরনের। যুদ্ধের সময় সহযোদ্ধারা আমাকে গ্লাইডার বলে ডাকতেন।
-আপনি কি এখন আমেরিকা থেকেই আসছেন?
–হ্যাঁ, আমি এক সপ্তাহ আগে এখানে পৌঁছেছি। আচ্ছা আপনি মিঃ জেসপ?
–হ্যাঁ, আমি জেসপ।
আগন্তুক বললো, আপনার নাম আগেও শুনেছি।
-সত্যি, কার কাছে শুনেছেন?
আগন্তুক মুচকি হেসে বললো, আপনার অনুমতি নিয়ে আমি কয়েকটা প্রশ্ন করবো এবং আপনাকে একটা চিঠি দেখাবো। তারপর সে চিঠিটা দিল।
সামান্য কয়েকটা লাইনের চিঠি। জেসপ ভদ্রলোকের দিকে তাকালেন। বয়স তিরিশের কাছাকাছি। চুলগুলো ছোটছোট করে কাটা। কথা বলেন খুব ধীরে ধীরে। ভদ্রলোককে দেখে মনে হল তার নিজের প্রতি খুবই আস্থা। এটাই জেসপের কাছে অস্বাভাবিক মনে হলো।
ভদ্রলোককে দেখে নিক্কিার মনে হলো। তার সাথে চালাকি করা বা বিশ্বাসঘাতকতা করা সহজসাধ্য নয়। তাঁর গুণগুলোকে বিচার করে জেসপ খুশি মনেই বললেন, এবার বলুন, আপনার জন্য আমরা কী করতে পারি?
–আমি এসেছিলাম টম বেটারটন সম্পর্কে খবর জানতে! আমি একজনের সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম যাঁর কথায় আস্থা রাখা যায়। তারা আপনার কথা বললেন।
-কিন্তু বেটারটন সম্পর্কে কোনো খবরই আমার কাছে নেই।
আগন্তুক বললেন, বাজারে কীরকম গুজব চলছে জানেন তো? আমার ধারণা ছিল যে, বিশেষ কোনো কার্যসিদ্ধির জন্য তাঁকে বিশেষ কোনো জায়গায় পাঠানো হয়েছে।
জেসপ একটু আহত হলেন। বললেন, বেটারটন একজন বিজ্ঞানী। তিনি কূটনীতিক বা গুপ্তচর নন।
–আপনি হয়তো ভাবছেন আমার এত মাথাব্যথা কেন? টমের সাথে বৈবাহিকসূত্রে আমার একটা আত্মীয়তা আছে।
–হ্যাঁ! আমার ধারণা আপনি স্বৰ্গত ম্যানহেইমের ভাগ্নে।
–বা! ইতিমধ্যেই সব জেনে ফেলেছেন! আপনাদের এখানে সবই নখদর্পণে থাকে দেখছি।
-কতলোক এখানে আসে। বেটারটনের স্ত্রী একটু আগে এসেছিলেন। আপনার লেখা একটা চিঠিও দেখালেন।
–আমার মা ছিলেন ম্যানহেইমের একমাত্র বোন। দুজনেই দুজনকে ভালোবাসতেন। ছোটবেলায় ওয়ারশয় থাকতাম বটে কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই মামারবাড়িতে কাটতো। তার মেয়ে এলসা আমার নিজের বোন ছিল। আমার মা, বাবা মারা যাওয়ার পর আমি মামা, এলসার কাছে এসে উঠলাম। সুখেই কাটছিলো দিনগুলো। তারপর এল যুদ্ধ। যুদ্ধের পরিস্থিতি আপনাকে বলে দিতে হবে না নিশ্চয়ই। তখনই মামা আর এলসা পালিয়ে এলেন আমেরিকায়। যুদ্ধ শেষ হবার পর গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব পড়লো আমার ওপর। ইউরোপের প্রতি দায়িত্বের মেয়াদ ফুরিয়ে যাবার পর ঠিক করলাম স্থায়ীভাবে মামা এবং বোনের সাথে আমেরিকায় থাকবো। দুঃখের বিষয় এসে শুনলাম মামা ও বোন দুজনেই মারা গেছে। এলসার স্বামী আবার বিয়ে করেছে। এরপরেই কাগজে দেখলাম টম বেটারটনের অন্তর্ধানের খবর, খবর পেয়ে এখানে এসেছি।
–ভদ্রলোক, জেসপের কাছ থেকে কিছু শোনার আশায় উদগ্রীব চোখে তাকিয়ে থাকলেন।
জেসপ ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। উনি জিজ্ঞেস করলেন–টম কেন উধাও হলেন, সম্ভবতঃ আপনি কিছু জানেন, তাই না?
জেসপ তারিফ না করে পারলেন না যে ভদ্রলোক জেসপকে প্রশ্ন করছেন। জেসপ হেসে উত্তর দিলেন, সত্যই আমরা কিছু জানি না, এ বিশ্বাস রাখতে পারেন।
-কিন্তু কিছু একটা সন্দেহ তো করছেন?
জেসপ বললেন, তা অবশ্য ঠিক। একটার পর একটা ঘটনা যেভাবে ঘটছে..
–আমি জানি। এক নিশ্বাসে অনেক ঘটনার উল্লেখ করলো ভদ্রলোক। এবং তারপর বললো, এঁরা সবাই বিজ্ঞানী। হ্যাঁ এঁরা কি লৌহযবনিকার অন্তরালে সবাই স্বেচ্ছায় চলে গিয়েছেন?
আমার এ ব্যাপারে নাক গলানো উচিত নয়। আমার মাথাব্যথা শুধু বেটারটনের জন্য। আপনার দুশ্চিন্তার কারণটা আমি ঠিক বুঝতে পারিনি এজন্য আমি দুঃখিত। আমি ভেবেছি বেটারটনের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক অনেক দূরের। তাকে কোনোদিন চোখেও দেখেননি আপনি।
আসলে কি জানেন, পোল্যান্ডের লোকেরা সংসারটাকে খুব বেশি ভালোবাসে। সংসারের প্রতি দায়ও অনেক। উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানালো। আপনার সময় নষ্ট করার জন্য দুঃখিত।
জেসপও উঠে দাঁড়ালেন। আপনাকে কোনো কিছু সাহায্য করতে পারলাম না বলে দুঃখিত। যদি কোনো খবর পাই আপনাকে কোথায় জানাবো?
-মার্কিন দূতাবাসের ঠিকানায় দিলেই আমি পাবো। ধন্যবাদ বলে উনি বেরিলয়ে গেলেন।
ভদ্রলোক বেরিলয়ে যেতে কর্নেল হোয়ারটনকে ঘরে আসতে বললেন।
হোয়ারটন ঘরে ঢুকতে জেসপ বললেন, শেষপর্যন্ত ব্যাপারটা একটু এগোচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
কিরকম?
–মিসেস বেটারটন বাইরে যেতে চান।
হোয়ারটন বললেন, কর্তার সাথে দেখা করতে?
–তাই তো মনে হচ্ছে। সঙ্গে ডাক্তারের একটা চিঠিও এনেছিলেন, বেশ জমেছে। আমরা সত্যি ঘটনাকে কখনও গুরুত্ব দিই না। ভদ্রমহিলা চোখে ধুলো দিতে ওস্তাদ।
ওর কাছ থেকে আর কোনো কথা বার করতে পারোনি।
–খুবই সামান্য। হা–কী হয়েছে?
–বেটারটন এই মধ্যাহ্নভোজনের কথা বলেনি।
এই ক্যারল স্পীডার একবার নাজেহাল হয়েছিল। বেটারটনের উধাও হওয়ার ব্যাপারে আমরা এই একজনকে পেলাম।
মিসেস বেটারটনকে বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে প্ররোচিত করতে পারে এমন কারোর সাথে যোগাযোগ আছে কি?
-ব্যক্তিগত যোগাযোগ নেই। বেটারটনের প্রথম পক্ষের বউয়ের পিসতুতো ভাই যে পোল্যান্ডে থাকে সেই ভদ্রলোক এসেছিলেন। অনেক কথা খুঁটিয়ে জানতে চেয়েছিলো।
–কিরকম মনে হলো তাকে?
জেসপ বললেন, আসল লোক বলে মনে হলো না। তার হাবভাব দেখে কেমন যেন মেকী মেকী মনে হলো।
-মিসেস বেটারটনকে বাইরে পাঠাবার মূলে এই লোকটা থাকতে পারে বলে মনে হচ্ছে?
হতেও পারে, লোকটা আমায় যেন কেমন হতভম্ব করে দিয়েছে।
ওর পেছনে টিকটিটি লাগাবার কথা ভেবেছ কি?
–তাই তো মনে হচ্ছে। হোয়ারটন বলে উঠলেন, বেশ, এবার কিভাবে এগোবে?
প্রথমে জানেত-এর কথাই ভাবছি, তারপর স্পেন অথবা মরক্কো।
হোয়ারটন ফাইলের পাতা ওল্টাতে লাগলেন। এবারেও যদি কিছু না করতে পারি
জেসপ চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বললেন, আমিও কদিন একটু ঘুরে আসি।
.
০৩.
হিথরো বিমানবন্দরের লাউঞ্জে বসে থাকা যাত্রীরা সব উঠে দাঁড়ালেন।
হিলারীও কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে চললো। তাহলে সে পালাতে পারছে। এক অজানা যুগের গুঞ্জরণ নিয়ে নির্দষ্ট আসনে গিয়ে বসলো হিলারী। মানসিক যন্ত্রণা–এই প্রথম মুক্তির এক রিনরিনে আবেশ সে অনুভব করতে পারলো।
বিমানের ছোট চাকায় তখন গতি এসেছে। বিমানটা যখন শেষ সঙ্কেতের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকলো তখন হিলারীর মনে হলো, প্লেনটা যদি মাটি ছেড়ে আর কোনোদিনও না ওড়ে, যদি আচমকা ধাক্কা খেয়ে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়–তাহলে সবকিছু শেষ হয়ে যায়, নিমেষে সব দুঃখ-যন্ত্রণা সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। ইঞ্জিনটা গর্জন করে উঠলো তারপর তাকে নিয়ে প্লেনটা দ্রুত, আরো দ্রুত ছুটতে শুরু করলো।
ওরা অনেক উঁচুতে উঠতে লাগলো। হিলারীর মনে হতে লাগলো নিচে সবকিছুই খেলনার মতো দেখাচ্ছিল। অনেকটা যাওয়ার পর হিলারী চোখ বুজলো। সে ইংল্যান্ড ছেড়েছে, নাইজেলকে ছেড়েছে। ব্রেন্দার কবরকেও ছেড়ে এসেছে। সবকিছুকে পেছনে ফেলে এসেছে। সে এসব চিন্তা করে ঘুমিয়ে পড়লো।
হঠাৎ ঘুম ভাঙলে হিলারীর খেয়াল হলো, প্লেনটা নিচের দিকে নামছে, প্যারিস। সোজা হয়ে বসে সে হাতব্যাগটা টেনে নিল, কিন্তু বিমানসেবিকা বললো কুয়াশা থাকার জন্য তারা ব্যুভেতে অবতরণ করছে।
কুয়াশার মধ্যে যাত্রীদের একটা পুরোনো কাঠের বাড়িতে এনে তোলা হল। একজন বললো, যুদ্ধের সময়কার পুরোনো বিমানঘাঁটি এটা। ঘর গরম করার বা একটু আরামের কোনো ব্যবস্থা নেই। তবু বাঁচোয়া, এরা ফরাসি, অতিথিদের জন্য কিছু একটা পানীয়ের ব্যবস্থা করবে। সত্যিই দেখা গেল, যাত্রীদের নানারকম পানীয় পরিবেশন করতে লাগলো।
কয়েকঘন্টা কেটে যাওয়ার পর দেখা গেল আরো একটা প্লেন কুয়াশার জন্য এখানেই নেমেছে।
হিলারীর কাছে সবকিছুই যেন অবাস্তব মনে হচ্ছিল। অবশেষে একটা ঘোষণা শোনা গেল। যাত্রীদের বাসে করে প্যারিসে পৌঁছে দেওয়া হবে। যাত্রীরা লটবহর নিয়ে বাসের দিকে ছুটলো।
মাঝরাতে হিলারী প্যারিসে পৌঁছালো। একটা হোটেলে সে উঠলো।
ক্যাসাব্লাঙ্কা যাওয়ার বিমান পরের দিন সকালে ওরলি বিমানবন্দর থেকে ছাড়ার কথা। কিন্তু সেখানে পৌঁছে দেখলো সবকিছুই যেন ওলটপালট হয়ে গেছে। তার প্লেনে আসন সংরক্ষিত আছে জেনেও সে ঐ প্লেনে যেতে পারছে না। কিছুক্ষণ পরে তাকে জানানো হলো, দাকারগামী একটা প্লেন আজকের জন্য ক্যাসাব্লাঙ্কা হয়ে যাবে। হিলারী কোনোরকম প্রতিবাদ না করে রাজী হয়ে গেলো। হিলারী বেরিলয়ে এলো, তার পাশাপাশি একজন কুলী বললো, খুব জোর বেঁচে গিয়েছেন আপনি মাদাম।
–কেন কী হয়েছে? হিলারী জিজ্ঞেস করলো।
সে বললো, প্লেনটা নামার সময় হুমড়ি খেয়ে পড়ে চুরমার হয়ে গেছে। প্রায় সবাই মারা গেছে। চার-পাঁচজন যারা বেঁচে আছেন তাদের সবাই হাসপাতালে আছে, তাদের অবস্থা খুব খারাপ।
হিলারী চিন্তা করতে শুরু করলো, কেন আমি ঐ প্লেনে গেলাম না? গেলে–এতক্ষণে সব শেষ হয়ে যেতো–নিশ্চয়ই আমি মারা যেতাম, সব যন্ত্রণার সমাপ্তি ঘটতে। কেন-কেন গেলাম না আমি?
ক্যাসাব্লাঙ্কায় নেমে সে হোটেলে এলো। সে যেমনটি কল্পনা করেছিলো সেইরকমই হলো।
শোবার ঘরের জানালাটা হাট করে দিয়ে সে রাস্তা দেখাতে লাগলো। হ্যাঁ, এমনটাই সে কল্পনা করেছিলো। মুক্তি, মুক্তি ইংল্যান্ড ছেড়ে আসার পর থেকে মনের মধ্যে এই সুরেরই গুঞ্জরণ চলছিলো। কিন্তু ঠিক তার পরমুহূর্তেই মনে হল মুক্তি মুক্তির কোনো পথই নেই তার। সত্যিই তো, ইংল্যান্ডের মতো এখানেও সবকিছুই রয়েছে। সে নিজে হিলারী ক্র্যাভেনই রয়েছে। কী করে ভাবলাম ইংল্যান্ড থেকে দূরে কোথাও গেলেই আমার মন, আমার চিন্তা, আমার অনুভূতি–সব বদলে যাবে।
সেই ছোট্ট ঢিবিটা ব্রেন্দার কবর–সেটা ইংল্যান্ডেই রয়েছে। আর নাইজেল তার স্ত্রীকে বিয়ে করবে–ইংল্যান্ডেই। সে জীবনে অনেক কিছুই সহ্য করেছে কারণ তখনও ব্রেন্দা বেঁচেছিলো। ব্রেন্দার জন্যই সে সবকিছু সহ্য করেছে। অতীতকে ভুলে গিয়ে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎকে নিয়ে থাকবে বলে আশা করে এতদূর মরক্কোতে এসেছে। অতীত যেন তার পেছনে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার থেকে মুক্তির আর কোনো পথ নেই।
যদি ঘনকুয়াশা পথ আড়াল করে না দাঁড়াত, যদি তার নির্দিষ্ট বিমান না আসতো, এতক্ষণে তাহলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো৷ এতক্ষণে সে হয়তো সরকারী মর্গে শায়িত থাকতো। একই পরিণতি সে নিজেও ঘটাতে পারে, শুধু একটু কষ্ট করতে হবে এই যা। শুধু একটু ঘুমের বড়ি থাকলে কাজটা অনেক সহজ হতে পারতো। এক্ষুনি সে যাবে ওষুধের দোকান খুঁজে বের করবে। চারটে দোকান ঘুরে ঘুরে ঘুমের বড়ি নিয়ে সে হোটেলে ফিরে এলো।
হোটেলে ফিরে পোশাক পালটে নৈশাহারে যাবার সময় হিলারীর নিজেকে বেশ হাল্কা মনে হচ্ছিল।
হিলারী একরাশ দামি খাবার আর আধবোতল মদ আনতে বলে চুপ করে বসে রইলো। কেমন যেন এক অদ্ভুত উত্তেজনা অনুভব করছিলো সে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিচারক জলের বোতল এনে শুভরাত্রি জানিয়ে চলে গেলো। দরজায় চাবি লাগিয়ে দেরাজ খুলে ঔষধের বড়িগুলো নিল এবং গ্লাসে জল ভরে নিল। এবার যেন তার একটু ভয় ভয় লাগছিল কিন্তু ভয়টাও সুখের। এতদিনে সে মুক্তির স্বাদ পেতে চলেছে।
হাত বাড়িয়ে সে যখন প্রথম বড়িটা খেতে যাবে তখনই দরজায় টোকা পড়লো। সে বসে রইলো। দ্বিতীয়বার টোকা দেবার পরও হিলারী বসে রইল। তারপর সে দেখলো দরজার চাবিটা উল্টো দিক থেকে ঘুরছে। দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে যেতে লাগলো। তারপর দেখলো সে, ও যখন দোকানে ঔষধ কিনতে গিয়েছিল তখন সে একজন পেঁচামুখো লোককে দেখেছিল। এখন সেই ভদ্রলোকটিই ঘরে ঢুকলেন। এগিয়ে এসে হিলারীর সামনে এসে বললেন, আমার নাম জেসপ।
হিলারী রেগে জিজ্ঞেস করলেন, এখানে আপনার কী প্রয়োজন, জিজ্ঞেস করতে পারি?
জেসপ বললেন, ভারি মজার কথা, আমিও আপনাকে ঠিক ঐ প্রশ্নটা করতে এসেছিলাম। ইঙ্গিতে তিনি ঔষধগুলোকে দেখালেন।
হিলারী চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো। চোখ দুটো সরু করে, জোর করে একটু হাসি টেনে আনলো মুখে। কী অদ্ভুত লোক আপনি–ভাবছেন, আমি আত্মহত্যা-টত্যা করতে যাচ্ছিলাম।
-শুধু ভাবছি না, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
-আপনি আমাকে আত্মহত্যা থেকে আটকাতে পারেন কিন্তু আগামীকাল বা পরশু যদি আমি কিছু করতে চাই তবে কি আপনি আমাকে আটকাতে পারবেন? আমার বাঁচার কোনো আকষণই নেই।
জেসপ বললেন, বেশ মজার ব্যাপার।
হিলারী বলেন, মোটেই মজার নয়। আমার স্বামী, যাকে আমি ভালোবাসতাম, সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমার একমাত্র সন্তান-ম্যানেনজাইটিসে ভুগে মারা গেলো। আমার কেউ নেই। আমি কার জন্য বেঁচে থাকবো। আত্মহত্যা সম্পর্কিত অনেক কথা হওয়ার পর জেসপ আসল কথায় আসলেন। জেসপ বলতে শুরু করলেন হিলারীকে, আপনি নিশ্চয় দৈনিক সংবাদপত্র পড়েন। মাঝে মাঝেই হয়তো বিভিন্ন বিজ্ঞানীর উধাও হওয়ার খবর পড়ে থাকবেন। মাস ছয়েক আগে টমাস বেটারটন নামে এক বিজ্ঞানী উধাও হন।
হিলারী বললো, হ্যাঁ, খবরটা কাগজে পড়েছিলাম।
জেসপ বলতে লাগলো, খবরের কাগজের চেয়ে অনেক বেশি খবর আমাদের কাছে আছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ রসায়নশাস্ত্রের গবেষক, কেউ হয়তো পদার্থবিজ্ঞানী। কিন্তু একটার পর একটা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে–তখন কেন এই লোকগুলো চলে যাচ্ছে।
হিলারী হাঁ করে চেয়ে রইল।
টমাস বেটারটন দুমাস আগে প্যারিস থেকে উধাও হন।
হিলারী একটু নড়ে চড়ে বসলো। জেসপ বলে চললেন–মিসেস বেটারটন আমাকে এসে বললেন, তার পারিবারিক ডাক্তার তাকে বাইরে গিয়ে কিছুদিনের জন্য বিশ্রাম নিতে বলেছেন।
-হ্যাঁ, এটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না আমার, শুকনো গলায় বললো হিলারী।
–হ্যাঁ, এই অবস্থা থেকে কিছুদিনের জন্য তিনি মুক্তি চান।
–আমারও তাই মনে হয়।
মিসেস বেটারটনের পেছনে ফেউ লাগাবার ব্যবস্থা করলাম আমরা। গতকাল তিনি ক্যাসাব্লাঙ্কার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ড ত্যাগ করলেন।
হ্যাঁ, মরক্কোর অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলোও ঘুরে নেবেন।
সমস্ত জায়গাতেই তিনি প্লেনে যাবেন। কিন্তু মিসেস বেটারটনকে সম্পূর্ণ এক অজানা জগতের পথে পা বাড়াতে হবে।
–হিলারী বললো, এ সবের মধ্যে আমি কিভাবে আসছি তা আমার মাথায় ঢুকছে না।
জেসপ হাসলেন। এ ব্যাপারে আপনি আসছেন, কারণ আপনার মাথায় একরাশ সুন্দর সোনালি চুল আছে বলে। হ্যাঁ, চুল। মিসেস বেটারটনের মাথায় সোনালি চুল প্রত্যেকটি লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। আপনি হয়তো শুনেছেন–আপনি যে প্লেনে এসেছেন ঠিক তার আগের প্লেনটা নামার সময় দুর্ঘটনায় পড়ে চুরমার হয়ে গেছে।
জানি, আমার ঐ প্লেনে আসার কথা ছিলো।
–যাক, মিসেস বেটারটনও ঐ প্লেনে ছিলো। মারা যাননি। সাংঘাতিক আহত অবস্থায় তিনি হাসপাতালে ভর্তি আছেন। ডাক্তাররা বললেন, কাল সকাল পর্যন্ত তিনি বাঁচবেন না।
হিলারী জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন।
এবার আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, জেসপ বললেন, এবার প্রস্তাব করছি, আপনি মিসেস বেটারটনে রূপান্তরিত হোন।
–কিন্তু সেটা কী করে সম্ভব। ওরা তো জেনেই ফেলবে আমি মিসেস বেটারটন নই।
–সেটা অবশ্য সম্পূর্ণ নির্ভর করে আপনি যাদের ‘ওরা বললেন, তাদের ওপর। আসলে ওরা কথাটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। সত্যিই কি এমন কেউ আছে যাদের আমরা ওরা বলে ধরে নিতে পারি? লোকগুলোর নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই তাদের ব্যবস্থার প্রয়োজন। সুতরাং এক্ষেত্রে মিসেস বেটারটনের এই বেড়াতে বেরোনোর যদি বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য থাকে, এবং তা পূর্বপরিকল্পিত হয় তাহলে জানার কথা নয়। তারা শুধু কোনো এক নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট এক মহিলার সঙ্গে যোগাযোগ করবে এবং সেখান থেকে তাঁকে নিয়ে নিজেদের আড্ডায় ফিরে যাবে। মিসেস বেটারটনের দেশভ্রমণের ছাড়পত্রে যেরকম বর্ণনা আছে–সেটাই ওদের যথেষ্ট।
-কিন্তু এখানকার পুলিস মহল? তারা নিশ্চয়ই
জেসপ হেসে বললেন, এদিকটা সম্পর্কে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন। ফ্রান্স নিজেও তার অনেকগুলি কৃতী বিজ্ঞানী ও রসায়নবিদকে হারিয়েছে। সুতরাং এঁরা আমাদেরকে সহযোগিতাই করবে। ব্যাপারটা এরকম হবে–মস্তিষ্কে প্রচণ্ড আঘাত লাগায় মিসেস বেটারটনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ঐ প্লেনের আরেকজন যাত্রী, ক্র্যাভেনকে ঐ হাসপাতালেই ভর্তি করা হবে। দু-একদিনের মধ্যেই মিসেস ক্র্যাভেন হাসপাতালেই মারা যাবেন এবং মিসেস বেটারটনকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে। যদিও মিসেস বেটারটন তখনও সামান্য স্মৃতিবিভ্রমে ভুগবেন, কিন্তু তার ভ্রমণসূচী অনুযায়ী চলার কোনো অসুবিধে হবে না। মাথায় আঘাত লাগলে স্মৃতি লোপ পেতে, চালচলনে, কথাবার্তায় অনেক পরিবর্তন দেখা দিতে পারে।
তার মানে–পাগলামি।
-তা তো বটেই। এটাই আপনার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। আমাদের সন্দেহ যদি সত্যি হয় আর আপনি যদি এই কঠিন দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ঠিকমতো এগোতে পারেন, তাহলে আপনি বাজিমাত করতে পারবেন। এবার আপনার ওপর নির্ভর করছে। একাজ করতে আপনি ইচ্ছুক কিনা।
আচমকা হিলারী হেসে উঠলো।
–তাহলে রাজী?
নিশ্চয়ই।
.
০৪.
হিলারীর হাসপাতালের ভেতরটায় শীত শীত করছিলো। একটা শয্যার পাশে লোহার চেয়ারে সে স্থির হয়ে বসেছিল।
মাথায় পট্টিবাঁধা অচেতন অবস্থায় অলিভ বেটারটন শুয়ে আছেন। শয্যার পাশে সেবিকা এবং ডাক্তার দাঁড়িয়ে আছে। ডাক্তারবাবু জেসপের দিকে তাকিয়ে বললেন, আর বেশিক্ষণ বাঁচানো যাবে না। নারী ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে।
–আর একবারের জন্যও কি জ্ঞান ফিরবে না?
ডাক্তার বললেন, ঠিক বলা যাচ্ছে না। শেষ মুহূর্তে একবার ফিরলেও ফিরতে পারে।
–আর কিছুই আপনাদের করার নেই–মানে কোনো উত্তেজক ওষুধ?
মাথা নেড়ে অক্ষমতা জানিয়ে বেরিলয়ে গেলেন ডাক্তার। জেসপ হিলারীকে ইশারায় ডেকে বললেন, ডাক্তার যা বলে গেলেন, শুনেছেন তো?
-হ্যাঁ, কিন্তু কি জিজ্ঞেস করবো?
-যদি জ্ঞান ফেরে যে-কোনো রকম খবর যদি আপনি নিতে পারেন–যেমন, কোনো টুকরো কথা, কিংবা ভুল বলতে বলতে কোনোরকম সঙ্কেত বা কোনোরকম খবর পাঠাতে চায়–যাহোক বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই?
হিলারী হঠাৎ আবেগপ্রবণ হয়ে বললো–একজন মৃত্যুপথযাত্রীর শেষ ইচ্ছাটাকে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করবো, তাই চাইছেন আপনি?
বেশ, তাই যদি আপনার মনে হয় তবে আপনি আপনার খুশিমত নিশ্চয় প্রশ্ন করতে পারেন। হিলারী শয্যার পাশে ফিরে এলো। এ নারী তার প্রিয় মানুষটার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলো আর…। ভাবতে ভাবতে সময় কেটে গেলো। নার্স ঘড়ি দেখে বললো মনে হচ্ছে শেষ সময় হয়ে আসছে। আমি ডাক্তারকে ডেকে আনছি।
মিসেস বেটারটনের জ্ঞান ফিরবার পর তার চোখ পড়লো হিলারীর দিকে। উনি জিজ্ঞাসা করলেন–কোথায়…? ডাক্তার রোগীকে দেখতে দেখতে বললেন, আপনি হাসপাতালে আছেন মাদাম। ঐ প্লেনে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিলো।
–ওই প্লেনে?…ওই প্লেনে? ফিসফিস করে বারবার বলতে লাগলেন।
–ক্যাসাব্লাঙ্কায় কারো সঙ্গে কি আপনি দেখা করতে চান, মাদাম! কোনো খবর দেবার আছে?
চোখ তুলে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললেন, না। চোখ সরিয়ে আনতে হঠাৎ হিলারীর দিকে তাকিয়ে বললেন-কে-কে?
ওর মুখের ওপর ঝুঁকে পড়লো হিলারী। নম্রস্বরে বললো, আমিও ইংল্যান্ড থেকে প্লেনে এসেছি। যদি কোনোরকম আপনাকে সাহায্য করতে পারি–আমাকে বলুন।
-না-কিছু নেই–কিছুই বলার নেই–যদি না—
বলুন?
–না, কিছু না। চোখ দুটো আবার বুজে এলো।
জেসপ এসে দাঁড়ালেন, মৃত্যুপথযাত্রী হঠাৎ পরিচিত কাউকে দেখে অস্ফুটস্বরে বললেন, আপনাকে আমি চিনি।
-হ্যাঁ, মিসেস বেটারটন, আপনি আমাকে চেনেন। আপনার স্বামীর সম্পর্কে কিছু বলার থাকলে আমাকে বলুন।
-না। চোখদুটো আবার বুজে এলো। জেসপ ঘর থেকে বেরিলয়ে গেলেন।
ডাক্তার হিলারীকে বললেন, আর বেশিক্ষণ নেই। মিসেস বেটারটন আবার চোখ মেলে তাকালেন। ঘরের মধ্যে দুটি নারী এখন একা–দুটি বেদনার মূর্তি যেন মুখোমুখি। অলিভ বেটারটন শ্বাস টেনে বলার চেষ্টা করছিলেন, আমাকে–আমাকে বলুন–আমি কি
ও কি জানতে চাইছে হিলারী বুঝতে পেরে আধশোয়া দেহটার ওপর ঝুঁকে পড়লো।
হ্যাঁ, পূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে সে বললো, আপনি মারা যাচ্ছেন। এই কথাটাই আপনি জানতে চাইছেন, তাই না? এবার আমার কথাটা শুনুন। আমি আপনার স্বামীর কাছে যাবার চেষ্টা করবো। যদি কোনো খবর থাকে বলুন।
–ওকে বলো–ওকে বলো–সাবধান। বোরিস–বোরিস–সাংঘাতিক…আর বলতে পারলো না, শ্বাস কষ্ট দেখা দিলো।
হিলারী কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন–আমাকে সাহায্য করার মতো–মানে–আপনার স্বামীর কাছে পৌঁছতে সাহায্য করবে এমন কোনো খবর দিতে পারেন না?
-তুষার।
অস্ফুট টুকরো কথাটা হিলারীর বুকের মধ্যে তোলপাড় করতে লাগলো। তুষার! বরফ! অলিভ বেটারটন ভাঙাভাঙা কথায় আবার বললেন
তুষার, শুধু তুষার, শুভ্র তুষার
তুষার-সে মৃত্যুগহ্বর।
শেষ কথাটা বারবার উচ্চারণ করতে লাগলেন। যাও…যাও…। গিয়ে ওকে বোরিসের কথাটা বললা…আমি বিশ্বাস করিনি। কখনোই বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু…কিন্তু বোধহয় সত্যি… তা যদি হয়, তা যদি হয়…কী এক নীরব আর্ত প্রশ্নে ছটফট করতে করতে চোখ দুটো স্থির হলো হিলারীর ওপর। সাবধান…সাবধান…
গলা থেকে বিশ্রী ঘড়ঘড় একটা শব্দ বেরিলয়ে এসে ঠোঁট দুটো একবার থরথর করে কেঁপে স্তব্ধ হয়ে গেলো।
অলিভ বেটারটন মারা গেলেন।
পরের পাঁচটা দিন প্রচণ্ড মানসিক পরিশ্রম গেলো হিলারীর, যদিও শারীরিক কোনো পরিশ্রমই করতে হয়নি। অলিভ বেটারটনের জীবনযাত্রা সম্পর্কে যতটুকু খোঁজখবর পাওয়া গেছে সেগুলো লিখে হিলারীকে পড়তে দেওয়া হয়েছে। অলিভ যে বাড়িতে বাস করতো সেটা কেমন, আত্মীয়স্বজন কে কে আছে, তার পোষা কুকুর আর পাখিদের নাম–টমাস বেটারটনের সঙ্গে বিয়ে হবার পর থেকে ছটা মাসের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয় তাকে জানতে হবে। একবার সে জেসপকে জিজ্ঞেস করলো, এসবের কি কিছু দরকার আছে?
জেসপ বলেছিলেন, হয়তো নেই। কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটাই তোমাকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রকাশ করতে হবে। তুমি একজন কাহিনীকার, একটি নারীর জীবনী লিখছো তুমি, সেই নারী-অলিভ।
যতক্ষণ না তুমি অলিভ বেটারটনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত নিজেকে অলিভ বেটারটন হিসাবে চিন্তাই করতে পারো না।
ছাড়পত্রে যে বর্ণনা আছে, তাতে অলিভ বেটারটন আর হিলারী ক্র্যাভেনের মধ্যে যথেষ্ট মিল।
হিলারী জেসপকে জিজ্ঞেস করলো, আপনি বলছেন, অলিভ বেটারটন বলে পরিচয় দিলে আমাকে কেউ অবিশ্বাস করবে না। কিন্তু এ বিষয়ে আপনি এত নিশ্চিন্ত হচ্ছেন কেমন করে?
জেসপ বললেন, কোনো বিষয়েই কেউ সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারে না। কিন্তু এ ব্যাপারটা যারা চালাচ্ছে তাদের কাজকর্মের আমরা একটা ধারণা করে নিতে পারি। আমি হলফ করেই বলতে পারি, এখানে ওদের যে ভগ্নাংশটা কাজ করছে তারা শুধু জানে–অমুক দিন অমুক সময় অলিভ বেটারটন প্লেনে করে এখানে আসবে এবং তাকে অমুক অমুক নির্দেশ দিয়ে দিতে হবে–ব্যাস। ওরা চাইছে অলিভ বেটারটনকে যদি তার স্বামীর কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় তবে টমাস বেটারটনকে দিয়ে আরো ভালো কাজ করাতে পারবে। আরো একটা কথা মনে রাখতে হবে, নকল একজন অলিভ বেটারটন সৃষ্টি করার চিন্তা সম্পূর্ণ আকস্মিক। প্লেনে দুর্ঘটনা এবং তোমার মাথার চুলের রঙ থেকেই তার উৎপত্তি। আমাদের পরিকল্পনা ছিলো অলিভ বেটারটনের গতিবিধির ওপর নজর রাখা আর আমাদের প্রতিপক্ষও তাই জানে। অতএব সেটা দেখার জন্যই তারা বেশি মাথা ঘামাবে।
–এ সমস্ত আগে চেষ্টা করেননি?
-করেছি, সুইজারল্যান্ডে। খুব বোকার মতো–তাতে আমাদের আসল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়েছে। আগের চেয়ে অনেক সূক্ষ্ম অথচ ব্যাপকভাবে করতে হবে। প্রতিপক্ষের চেয়ে অনেক বেশি চালাকির পরিচয় দিতে হবে আমাদের।
তার মানে আমার পেছনে আপনারা লোক লাগাবেন?
–অবশ্যই।
–কী ভাবে?
জেসপ মাথা নাড়লেন, সেটা তোমাকে জানানো হবে না।
হিলারী বললো, বুঝেছি, প্রতি পদে, প্রতি মুহূর্তে আপনাদের সতর্ক দৃষ্টির মধ্যে আমাকে কাজ করতে হবে।
-এবার তোমার অন্য কাজ। অলিভ বেটারটন সম্বন্ধে সবকিছু জেনে তাকে পুরোপুরি নকল করা।
ঠিক পারবে তুমি। সপ্রশংসভাবে তিনি তার কাঁধ চাপড়ালেন। একটা কথা শুধু মনে রেখো হয়তো তোমার কোনো সময় মনে হবে তুমি নিঃসঙ্গ কিন্তু আসলে তা নয়।
হিলারীর প্রশ্ন, যদি আমি লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে পারি, তখন কী ঘটবে?
–তার মানে?
আমি বলতে চাইছি–শেষ পর্যন্ত যদি আমি টম বেটারটনের সামনে পৌঁছই তখন কী ঘটবে?
জেসপ গম্ভীর হয়ে বললেন, তখনই সবচেয়ে বিপজ্জনক মুহূর্ত। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি-যদি সবকিছু ভালোয় ভালোয় হয় তাহলে ঠিক ওই মুহূর্তের জন্যই তোমার নিরাপত্তা থাকবে। নিশ্চয়ই তোমার মনে আছে–এই অভিযানের মূল কথা হচ্ছে, এ যাত্রা থেকে বেঁচে ফিরে আসার সম্ভাবনা কম।
–আপনি কি আমার জন্য একটুও দুঃখ করবেন না?
–দুঃখ করবো, তোমার জন্য? একটুও না। বরং ভয়ঙ্কর বিপদ জেনেও এমন একটা কাজের দায়িত্ব নিতে পারে এমন একজনকে হারাতে হচ্ছে বলে মনে মনে অজস্র অভিসম্পাত দেবো।
এবার হিলারী জেসপকে বললো, আমার আরেকটা কথা মনে হচ্ছে, অলিভ বেটারটনকে দেখতে কেমন ছিলো সেটা ওদের না জানারই কথা, কিন্তু আমাকে যদি কেউ হিলারী ক্র্যাভেন হিসাবে চিনে ফেলে। বিশেষ করে প্লেনের যাত্রীরা।
প্লেনের যাত্রীদের নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। তারা সোজা চলে গেছে। যা মিসেস বেটারটনের পোশাকগুলো তুমি পরবে, তার মতো করে চুল বাঁধবে আর মুখের একপাশে একটু পুলটিশ এঁকে নিলে তুমি একেবারে অন্য মেয়ে বনে যাবে। আর একজন ডাক্তার আসবেন তোমার গালে একটা আঁচড় কেটে দিতে। ওষুধ দিয়ে জায়গাটা আগেই অসাড় করে নেবেন। দুর্ঘটনার কয়েকটা সত্যিকারের চিহ্ন তোমার মুখে থাকতেই হবে।
–আপনার সবদিকেই দৃষ্টি আছে দেখছি!
–থাকতেই হবে।
হিলারী বললো, আপনি তো আমাকে একবারও জিজ্ঞেস করেননি, অলিভ বেটারটন মারা যাবার আগে আমাকে কিছু বলে গেছে কিনা।
আমি বুঝেছি, বলতে তোমার সঙ্কোচবোধ হয়েছে। সেজন্য আমি দুঃখিত।
দুঃখিত হবার কোনো কারণ নেই। এরজন্য তোমাকে আমি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। আমি নিজে হলেও তাই করতাম।
–তার কথাটা আপনাকে জানোননা দরকার সে বলেছিলো, ওকে বোলো-মানে বেটারটনকে বোলো, সাবধান–বোরিস-সাংঘাতিক
বোরিস নামটা বারবার উচ্চারণ করতে লাগলেন জেসপ। ওহহ! আমাদের বিদেশী মেজর বোরিস গ্লাইদার!
–আপনি তাকে চেনেন–কে সে?
পোল্যান্ডের লোক। লন্ডনে একবার আমার সাথে দেখা করতে এসে বলেছিল ও নাকি অলিভ বেটারটনের পিসতুতো ভাই।
ভদ্রলোকের একটা বর্ণনা দিতে পারেন, তাহলে আমার পক্ষে তাকে চেনা সহজ হবে।
-হ্যাঁ, বলছি, ছফুট লম্বা। ওজন প্রায় ১৬০ পাউন্ড হবে। বেশ সুন্দর দেখতে। মুখটা একটু কাঠ কাঠ–ভাসা ভাসা চোখ, আচার-ব্যবহার একদম বিদেশী। হা-অলিভ বেটারটন যদি বলে থাকে যে ওই বোরিস গ্লাইদার সাংঘাতিক লোক–আমি বলবো সম্ভবত সে ঠিকই বলেছে।
.
০৫.
সেন্ট লুই হোটেলের বৈঠকখানা ঘরে বসে তিনজন মহিলা যে যার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। মিসেস কেলভিন বেকার, খাটো করে গোলগাল দেখতে, তার প্রতিটি কাজে দুরন্ত উৎসাহ, তিনি ঘরে বসে চিঠি লিখছিলেন। তাকে দেখে বোঝাই যায় তিনি পাকা একজন আমেরিকান গিন্নী।
ওদিকে একটা বাদশাহী চেয়ারে বসে বেশ অস্বস্তিতে পড়েছেন মিস হেদারিংটন। মিস হেদারিংটন বেশ লম্বা, রোগা চেহারার ওপর লিকলিকে ঘাড়, চুলগুলোও অবিন্যস্ত আর মুখে সারা দুনিয়ার একটা বিতৃষ্ণার ছাপ। এঁকে দেখে বোঝা যায় ভ্রমণ-পিয়াসী ইংরেজ মহিলা। তিনি বসে বসে উল বুনছিলেন।
মাদমোয়াজেল জীন ম্যারিকট হলেন আরেকজন মহিলা যিনি ঘরের জানালার পাশে বসে হাই তুলছিলেন এবং বাইরেটা দেখছিলেন। মাদামোয়াজেল ম্যারিকট দেখতে শ্যামাঙ্গী, মাথায় লালচে চুল, সাধারণ অথচ উগ্র প্রসাধনে মুখটা জ্বলজ্বলে। ঘরের কেকী করছে তাতে কোনো উৎসাহ নেই।
মিস হেদারিংটন এবং মিসেস কেলভিন বেকার দুটো রাত কাটিয়েছেন এই হোটেলে। সুতরাং তাদের মধ্যে আলাপ পরিচয়ও একটু আধটু হয়ে গেছে। মিসেস কেলভিন বেকার তার মার্কিনী বন্ধুসুলভ ব্যবহারে প্রায় সকলের সঙ্গেই আলাপ জমিয়ে ফেলেছেন। মিস হেদারিংটনের খুব ইচ্ছে সকলের সঙ্গে আলাপ করেন, কিন্তু তিনি উঁচু বংশ না পাওয়া পর্যন্ত কারো কাছে ঘেঁষেন না।
এক ফরাসি ভদ্রলোক, ঘরে একবার উঁকি মেরে বেরিলয়ে গেলেন। যাবার সময় জীন ম্যারিকটের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন।
মিস হেদারিংটন মুখে শব্দ করে বোনের ঘর গুনতে লাগলেন, আটাশ, উনত্রিশ…।
লম্বা মতো একজন মহিলা এই ঘরের দিকে তাকিয়ে আবার খাবার ঘরের দিকে চলে গেলেন।
মিসেস কেলভিন বেকার এবং মিস হেদারিংটন দুজনেই সঙ্গে সঙ্গে সচকিত হয়ে উঠলেন।
মিসেস বেকার ফিসফিস করে বললেন, এই যে লালচুলো মহিলাটি ঘরের দিকে দেখছিলো, ওকে দেখলেন নাকি মিস হেদারিংটন? গত সপ্তায় যে সাংঘাতিক প্লেন দুর্ঘটনা হলো। তার একমাত্র জীবিত যাত্রী নাকি ও-ই।
মিস হেদারিংটন বললেন, বিকেলে আসতে দেখেছি ওঁকে। একটা অ্যাম্বুলেন্স ওঁকে দিয়ে গেছে এখানে। ওঁকে হাসপাতাল থেকে এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেওয়া উচিত হয়নি। মাথায় নিশ্চয়ই জোর চোট লেগেছিলো–
–মুখে তো এখনও পট্টি লাগানো রয়েছে কাঁচে কেটেছিলো বোধহয়। কী ভাগ্য যে পুড়ে যায়নি, এইসব প্লেন দুর্ঘটনায় পুড়েই তো অর্ধেক লোক অকর্মণ্য হয়ে পড়ে।
-ওঃ! ভাবতেও ভয় করে। বেচারা কতই বা বয়েস।
কাগজে লিখেছিলো একজন মহিলাযাত্রী। হ্যাঁ, তাই বটে। নামটাও দিয়েছিলো–মিসেস বেভারলি না বেটারটন।
মাদমোয়াজেল ঘর থেকে বেরিলয়ে গেলেন, তার এইসব গালগল্প ভালো লাগছিলো না।
দুর্ঘটনার পাঁচদিনের দিন বিকেলবেলাই মিসেস অলিভ বেটারটন হাসপাতাল থেকে চলে গেলেন। অ্যাম্বুলেন্স তাঁকে সেন্ট লুই হোটেলে পৌঁছে দিয়ে গেলো।
অসুস্থ বেটারটনের বিবর্ণ মুখে এখানে-ওখানে পট্টি লাগানো, মাথায় ব্যান্ডেজ। হোটেলের ম্যানেজার সহানুভূতির সঙ্গে তাড়াতাড়ি তাঁকে সংরক্ষিত ঘরে পৌঁছে দিলো। খুব কষ্ট পেয়েছেন তাই না মাদাম?
ক্লান্তিভরে একটা চেয়ারে বসে পড়লো হিলারী। বিড় বিড় করে বললো, হ্যাঁ আমার নিজেরই মাঝে মাঝে বিশ্বাস হয় না। দুর্ঘটনার আগের চব্বিশটা ঘণ্টা এখনো আমার কাছে সম্পূর্ণ অন্ধকার।
তা তো হবেই, ম্যানেজার বললো। ম্যানেজার নিচু হয়ে অভিবাদন জানিয়ে বিদায় নিয়ে চলে যাবার পর হিলারী নিজেকে আয়নায় দেখে নিল।
ইতিমধ্যেই সে খোঁজ নিয়েছে তার নামে কোনো চিঠিপত্র এসেছে কিনা। ওঁর হাতে এখন কোনো সূত্রই নেই। শুধুমাত্র অলিভ বেটারটনের ছাড়পত্র, হুণ্ডি আর কুক-এর কাটা টিকিট আর আসন সংরক্ষণের চিঠিই তার সম্বল। ওর কাজ শুধু অলিভ বেটারটনের ভূমিকায় ঠিকমতো কাজ করা। প্লেন দুর্ঘটনা আর তার ফলস্বরূপ স্মৃতিলোপ এবং সাধারণ একটা অস্বচ্ছতাই তার হাতে তুরুপের তাস।
দুর্ঘটনা যেমন সত্যি, তেমনি অলিভ বেটারটনও যে সেই প্লেনে ছিলো সেটাও সত্যি। তার প্রতি যা যা নির্দেশ ছিলো, সেগুলো সে যদি পালন করতে না পারে, স্মৃতিভ্রষ্টতাই তার জন্য দায়ী।
এখন চুপচাপ শুয়ে বসে বিশ্রাম নেওয়াই তার পক্ষে সবচেয়ে স্বাভাবিক কাজ হবে। অলিভের মালপত্র সব প্লেনের মধ্যে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। মাত্র কয়েকটা জিনিষ ওরা হিলারীকে হাসপাতালে দিয়ে গিয়েছিলো। আস্তে আস্তে সে চুল আঁচড়ে খাবার ঘরে নেমে এলো।
অনেকগুলো চোখ যে তাকে লক্ষ্য করছে এটা বুঝতে ওর দেরি হলো না। তাদের সবার কথাবার্তা কানে আসতেই সচেতন হয়ে উঠলো হিলারী।
নৈশাহার শেষ করেও হিলারী কিছুক্ষণ বসে রইল। যদি কেউ যেচে আলাপ করতে আসে। ঘরে দুটি মহিলা ছাড়া আর কেউ নেই। তাদের মধ্যে একজন আমেরিকান কায়দায় আলাপ শুরু করলেন।
-কিছু মনে করবেন না, একটু আলাপ করতে এলাম। আপনি তো সেই প্লেন দুর্ঘটনা থেকে আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে ফিরেছেন, তাই না?
হিলারী বললেন–হ্যাঁ।
–মাত্র তিনজন বেঁচেছেন বলে শুনেছি, সত্যি?
দুজন, তিনজনের একজন হাসপাতালে মারা গেছে।
–কিছু যদি মনে করেন তাহলে একটা কথা জিজ্ঞেস করি। মিসেস বেটারটন, আপনি প্লেনের ঠিক কোন জায়গাটায় বসেছিলেন? একেবারে সামনে, না পেছনের দিকে?
হিলারীর উত্তরটা জানা ছিল সে বললো, পেছন দিকে।
ঐ ভদ্রমহিলা আরেকজন ভদ্রমহিলাকে ডেকে বললেন, শুনলেন তো মিস হেদারিংটন? যখন প্লেনে চড়বেন কক্ষনো সামনের দিকে বসবেন না।
ভদ্রমহিলা বললেন, আমার নাম কেলভিন বেকার। আমি মোগাডোর থেকে এখানে এসেছি আর হেদারিংটন এসেছেন তাঞ্জিয়ের থেকে। যা বেড়াতে এসেছেন ম্যারাকেশটা একবার ঘুরে আসবেন মিসেস বেটারটন।
সেইরকমই ব্যবস্থা ছিলো, হিলারী বললো, কিন্তু মাঝপথে সব ওলোট-পালট হয়ে গেলো প্লেন দুর্ঘটনার জন্য।
–তা ঠিক। কিন্তু ম্যারাকেশ যাওয়া বাতিল করবেন না যেন, আপনি কি বলেন, মিস হেদারিংটন?
–আর কোথায় কোথায় যাবেন, মিসেস বেটারটন? কেলভিন বেকার জিজ্ঞাসা করলেন।
-ফেজটা ঘুরে আসার খুব ইচ্ছে; বললো হিলারী, অবশ্য আবার নতুন করে ব্যবস্থাপত্র করতে হবে–
-হ্যাঁ, তাই করুন। ফেজ বা রাবাত কোনোটাই দেখতে ভুলবেন না।
আপনি বুঝি গিয়েছিলেন?
–না এখনও যাইনি। তবে শীগগিরই যাবো ভাবছি। হিলারী মনে মনে ঠিক করলো আগামীকাল সে যদি কোনো খবরাখবর বা কোনো নির্দেশ না পায় তাহলে কুক-এর ওখানে গিয়ে ফেজ বা ম্যারাকেশ যাবার নতুন বন্দোবস্ত করা যায় কি না সে সম্পর্কে খোঁজখবর নেবে।
পরের দিন সকালে কোনো খবর বা টেলিফোন এলো না। সে ভ্রমণসংস্থা কুক-এর অফিসে চলে এলো। টিকিট ঘরের সামনে আসতেই একজন বয়স্ক কেরানী বললো, আপনি তো মাদাম বেটারটন, তাই না? আমি আপনার সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।
–কিন্তু ওগুলোর তো সবদিন পার হয়ে গেছে, হিলারী বললো। আমি কদিন হাসপাতালে ছিলাম আর…
-হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেসব আমি জানি। আপনার এই পুনর্জন্মের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। নতুন করে যাত্রার ব্যবস্থা করার জন্য আপনার ফোন পেয়ে আমরা সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।
বুকের হৃদস্পন্দন দ্রুততর হয়ে উঠলো হিলারীর। যতদূর জানে সে টিকিটের জন্য এদের কাছে কারোও টেলিফোন করার কোনো কথা নেই। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে অলিভ বেটারটনের ভ্রমণসূচীর ওপর কারো তীক্ষ্ণদৃষ্টি রয়েছে। বললো, ও ওরা টেলিফোন করেছে কিনা ঠিক জানতাম না আমি।
-নিশ্চয়ই করেছে, মাদাম। এই যে রেলের টিকিট, হোটেলের ব্যবস্থাপত্র সব।
হিলারী হোটেলে ফিরে এলো। পরদিন হিলারী ফেজ-এর ট্রেনে রওয়ানা হলো।
সেদিনই বিকেলে মিসেস কেলভিন বেকারকে দেখে মিস হেদারিংটন এগিয়ে এসে বললেন, জানেন ভাই, সেই নামটা মনে পড়েছে–বেটারটন–আর সেই যে একজন বিজ্ঞানী হঠাৎ উধাও হয়ে গেলো। আমি কিন্তু ভাবছি–ওই ভদ্রমহিলাই ওঁর স্ত্রী কিনা–আপনার কী মনে হয়?
০৬. ক্যাসাব্লাঙ্কা হিলারী
০৬.
ক্যাসাব্লাঙ্কা হিলারীকে খুবই হতাশ করেছে। কোথায় সেই প্রাচ্যের ছাপ, কোথায়ই বা তার সেই বহুশ্রুত অলৌকিক মায়া! সবকিছুই যেন জমজমাট একটা ফরাসি শহরের মতো–তফাত শুধু রাস্তার মানুষগুলো।
এক ফরাসি লোকের সঙ্গে তার আলাপ হলো। সে হিলারীকে বললো, রাবাতটা একবার ঘুরে আসবেন, মাদাম, চমৎকার জায়গা। রাবাত না যাওয়া মানে মস্ত ভুল করা।
হিলারী হাসলো। বললো, যাবার তো ইচ্ছে, কিন্তু আমার হাতে আর সময় নেই বেশি। তাছাড়া টাকাপয়সাও খুব কম। জানেনই তো, বিদেশে আসার সময় কত অল্প টাকা আনতে দেয়।
-এরজন্য আর ভাবনা কী! খুব সোজা ব্যাপার। এখানে একজন বন্ধুর সঙ্গে ব্যবস্থা করে নিলেই হলো।
ইংল্যান্ড থেকে এখানে আপনার একটু হাওয়া বদল হবে, মাদাম, যেমন ঠান্ডা, তেমনি কুয়াশা-কী বিশ্রী আবহাওয়া আপনাদের ওখানে।
–যা বলেছেন-সত্যি চমৎকার হাওয়া বদল হয়ে এলো। ওরা সন্ধ্যে নাগাদ ফেজ-এ পৌঁছলো।
আপনার কোনো সাহায্যে লাগতে পারি, মাদাম?
স্টেশনে হৈ-হট্টগোল আর হুটোপাটির মধ্যে কেমন দিশাহারা হয়ে দাঁড়িয়েছিল হিলারী। কৃতজ্ঞ চোখে সদ্যপরিচিত বন্ধুটির দিকে তাকালো।
–আপনি তো জামা প্যালেসে উঠবেন তাই না? ঠিক আছে। ওটা কিন্তু এখান থেকে আট কিলোমিটার দূরে, জানেন তো?
–আট কিলোমিটার! হিলারী যেন আঁতকে উঠলো। হোটেলটা শহরের মধ্যে নয়?
যদি বলেন, একটা ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
খুব মহানুভব আপনি, কিন্তু…।
ফরাসি বন্ধুটি দ্রুত আরবিভাষায় কুলিদের কী সব যেন বললো আর মুহূর্তে হিলারী একটা ট্যাক্সিতে চড়ে বসলো। সে হিলারীকে একটা কার্ড দিয়ে বললো, আমার কার্ড, মাদাম, যদি কখনো আপনার কোনো উপকারে লাগতে পারি, আমাকে জানাবেন। আরও চারদিন আমি এখানে গ্র্যান্ড হোটেলে থাকবো।
হিলারী কার্ডটা একবার চোখের সামনে মেলে ধরলো, মসিয় হেনরি লরেল।
শহর ছাড়িয়ে, গ্রামের মধ্য দিয়ে একটা পাহাড়ের দিকে দ্রুতবেগে চলতে লাগলো ট্যাক্সিটা। ট্যাক্সিটা তাকে জামা প্যালেসের সামনে নামিয়ে দিলো। বিশাল তোরণের উঁচু খিলানের নিচ দিয়ে ভেতরে ঢুকে প্রাচ্যের হাতছানি দেখে মনটা খুশী খুশী হয়ে উঠলো হিলারীর। অনেকগুলো ঘর পেরিয়ে তাকে একটা চত্বরে নিয়ে এলো একজন কুলি এবং সেখান থেকে ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে চমৎকার একটা শোবার ঘরে। কুলিটি জানালো সাড়ে সাতটার সময় নৈশাহার। বাক্সপ্যাটরা খুলে, হাতমুখ পরিষ্কার করে, চুলটা একটু আঁচড়ে সে নিচে খাবার ঘরে এলো। চমৎকার খাবার। খেতে খেতে হিলারী অনেককেই যেতে আসতে দেখলো। নিজেকে এত ক্লান্ত বোধ হচ্ছিল যে খাবার ঘরের লোকগুলো সম্পর্কে বিচার-বিবেচনা করার কোনো চেষ্টা করলো না সে। নৈশাহার শেষ করে চত্বরে এসে কফি নিয়ে বসলো হিলারী। একটু ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব, কিন্তু বাতাসে শীতের কামড় নেই। চমৎকার ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। কফি শেষ করে সে ঘরে গিয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লো।
পরদিন সকালে, চত্বরে একটা বিরাট ছাতার তলায় বসে হিলারী ভাবছিলোআগাগোড়া সমস্ত ঘটনাগুলোই কেমন অবান্তর। এখানে একজন মৃতা মহিলার নাম নিয়ে তার ভূমিকায় সে অভিনয় করছে। বেচারী অলিভ বেটারটনের জন্য খুবই দুঃখ হচ্ছে হিলারীর।
এখানেও কোনো অপরাধের গন্ধ বা কার্যকরী কোনো সূত্র পেলো না হিলারী। নিচের বাগানের দিকে তাকালো, দেখলো চমৎকার শান্ত বাগানটা। একজন সুন্দরী সুইডিস মহিলাও বাগানে বসেছিলেন। তার স্বামী না অন্য কেউ একজন ভদ্রলোক এসে মেয়েটির পাশে বসলো এবং কিছু একটা বিষয় নিয়ে তর্ক জুড়ে দিল। ভদ্রলোক প্রতিবাদ করলো আবার ক্ষমাও চাইলো।
হিলারী মার্টিনী নিয়ে আসতে বললো পরিচারকটিকে। তারপর পরিচারকটির সাথে হিলারীর অনেকক্ষণ গল্পগুজব হলো। সবাই খেতে চলে গেছে কিন্তু হিলারী বাগানে বসেছিল। হঠাৎ পানশালা থেকে একজন ফরাসি যুবক বেরিলয়ে এলো। হিলারীর পাশ দিয়ে যাবার সময় একবার সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে নিলো। তারপর সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে একটা ফরাসি ছবির গান গাইতে গাইতে নামলো
লরেলের গোলাপবাগের ছায়াতলে।
মিষ্টি ছায়া মধুর লাগে।
গানের কথাগুলো হিলারীর মাথায় আস্তে আস্তে যেন গেঁথে বসতে লাগলো। লরেলের গোলাপবাগের ছায়াতলে। লরেল। ট্রেনে আলাপ হয়েছিলো ঐ ফরাসি ছেলেটির নামও লরেল। এরসঙ্গে কি তার কোনো যোগসূত্র আছে? ব্যাগ খুলে কার্ডটা বের করে দেখলো লেখা আছে–হেনরি লরেল। কার্ডটা উল্টে দেখলো-পেছনে অস্পষ্ট পেনসিলের লেখা। মনে হয় আগে কিছু লেখা হয়েছিলো, পরে ঘষে তুলে দেওয়া হয়েছে। ওখানে, সঙ্কেতলিপিটা এই কথা দিয়ে শুরু হয়েছে। মাঝখানের শব্দগুলোর পাঠোদ্ধার করা গেলো না। শেষদিকে আর একটা শব্দ পরক্ষণেই মনে হলো এটা কোনো গল্প বা প্রবন্ধের উদ্ধৃতিও তো হতে পারে। কার্ডটা ব্যাগে রেখে দিলো।
হঠাৎ চোখের ওপর একটা ছায়া পড়তে সে আঁতকে উঠে চোখ তুললো। একটু দূরে সূর্য আড়াল করে মিঃ অ্যারিস্টাইডস দাঁড়িয়ে রয়েছেন। নিচের বাগান ছাড়িয়ে দুরের আবছা পাহাড়ের শোভায় দৃষ্টি নিমগ্ন।
খাবার ঘরে এসে দেখলো হিলারী মিঃ অ্যারিস্টাইড আজও সেই একই টেবিলে বসে খাচ্ছেন।
বিকেলটা সাদামাটাভাবে কেটে গেলো। বাগান থেকে চত্বরে আবার বাগানে ঘুরে ঘুরে বেড়ালো হিলারী।
জামা প্যালেসের বাগানের সৌন্দর্য, হিলারীর মনের এই একাকিত্বে হাজার গুণ সুন্দর হয়ে ফুটে উঠল। যখন শান্তির শেষ অংশটুকুও সে ত্যাগ করেছে, তখনই শান্তির দেখা পেলো। মনের শান্তিটাও তখনই এলো, যখন সে মরণখেলায় ঝাঁপিয়ে পড়তে অঙ্গীকারবদ্ধ। একঝলক ঠান্ডা হাওয়া এসে হিলারীকে একটু ঝাঁপিয়ে দিয়ে গেলো। তারপর হয়তো এই সুন্দর বাগানে কটা দিন নিশ্চন্তে কাটবে।
বিকেল যখন ফুরিয়ে এলো চত্বরের পর চত্বর পেরিয়ে হিলারী হোটেলে ফিরে এলো।
হিলারী হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দেখলো লাউঞ্জে একজন ভদ্রমহিলা বসে আছেন যাকে হিলারী চেনে। তিনি কেলভিন বেকার। আসুন ভাই, আসুন, বেকার সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। আমিও চলে এলাম। এইমাত্র প্লেন থেকে নামছি।
যাক, বলুন কেমন বেড়াচ্ছেন? পুরোনো শহর দেখে ফিরলেন মনে হচ্ছে।
-না–কই আর গেলাম, কিছুই দেখা হয়নি এখনও, হেসে হিলারী বললো। একটা রোদ্দুর পুইয়ে এলাম শুধু।
-ও, হা হা-সবেমাত্র হাসপাতাল থেকে বেরিলয়েছেন আপনি। ভুলেই গিয়েছিলাম। যাক,
আমরা দুজন একসঙ্গে বেরোবোখন। বেরোবার মতো মনের অবস্থা না থাকলেও বেকারের উৎসাহকে তারিফ না করে পারলো না।
মিসেস বেকার আবার বললেন, ক্যাসাব্লাঙ্কার সেই মিস হেদারিংটনের কথা মনে আছে? উনি ট্রেনে করে এখানে আসবেন।
রাতে খাবার ঘরে ঢুকেই হিলারী দেখলেন দেওয়ালের ধারে একটা টেবিলে মিস হেদারিংটন খাচ্ছেন। আহারের পর তিন মহিলা একসাথে বসে কফি খেলেন।
মিসেস কেলভিন বেকার পরের দিন কোথায় কোথায় বেড়াতে যাবেন তার পরিকল্পনা শুরু করে দিলেন। এবার আর পুরোনো শহরে যাবার ইচ্ছে নেই। গতবারই সব খুঁটিয়ে দেখে নিয়েছি। খুব মজার জায়গা। যেন একটা গোলকধাঁধা। আমার সঙ্গে যদি একজন পথপ্রদর্শক না থাকতো, রাস্তা চিনে হোটেলে ফিরতে পারতাম না। আমাকে যে লোকটা নিয়ে গিয়েছিলো সে খুব ভালো লোক। সে একটা চায়ের দোকানে নিয়ে গেলো–শহরের ঠিক মাথার ওপরে পাহাড়ের দিকটায় চমৎকার জায়গাটা।
.
০৭.
মিসেস বেকার, মিস হেদারিংটনকে নিয়ে ফেজ-এর পুরোনো শহর দেখতে গেলেন আর হিলারীকে হোটেল থেকে একজন পথপ্রদর্শক ঠিক করে দিলো, হিলারী তাকে নিয়ে ফেজ শহর ঘুরতে বেরিলয়ে পড়লো।
চত্বর থেকে চত্বর আর বাগান পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত তারা ধনুকের খিলান যুক্ত এক বিশাল ফটকের সামনে এসে দাঁড়ালো। পথপ্রদর্শক চাবি দিয়ে দরজা খুলে হিলারীকে ভেতরে যেতে ডাকলো।
যেন এক নতুন জগতে পা রাখলো হিলারী, তার চারপাশে এখন শুধু ফেজ শহরের টানা পাঁচিল। আঁকাবাঁকা সরু পথ, দুধারে উঁচু দেওয়াল। মাঝে মাঝে একটা দরজা, এক চিলতে উঠোন–সরু সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সবকিছু ভুলে গেলো হিলারী। তার গুপ্তচর বৃত্তির কথা, অতীত দিনের দুঃখ-যন্ত্রণা, এমনকি নিজেকেও সে যেন হারিয়ে ফেললো। তার মনে হচ্ছে সে যেন স্বপ্নপুরীতে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে। একমাত্র তার পথপ্রদর্শকই এটা ওটা কেনার জন্য বিরক্ত করছিলো।
এই পাঁচিল ঘেরা শহরের কোথায় কোন দিকে চলেছে, উত্তর না দক্ষিণে, নাকি একই রাস্তায় বারবার ঘুরছে সে। অসীম ক্লান্তিতে পা দুটো যখন আর চলতে চাইছে না, ঠিক তখনই তার পথপ্রদর্শক বেড়ানোর শেষ অংশটুকু উপভোগ করার প্রস্তাব রাখলো। এবার আপনাকে একটা চমৎকার বাড়িতে নিয়ে যাবো। খুব সুন্দর বাড়ি। সব্বাই আমার চেনাজানা ওখানে। বসে বসে চা খাবেন, আর হরেকরকম সুন্দর সুন্দর জিনিষ দেখাবে ওরা।
হিলারীর বুঝতে অসুবিধে হলো না, মিসেস কেলভিন বেকার এই গলাকাটা দোকানটার কথাই বলেছিলেন। তবুও তার ইচ্ছে হলো, ওরা যা দেখতে চায় তা দেখাতে। মনে মনে হিলারী ঠিক করলো আগামীকাল আবার তিনি এখানে আসবেন। হিলারী লোকটার পেছন পেছন পথ বেয়ে উঠে এলো। জায়গাটা শহরের প্রাচীরের প্রায় বাইরে। অনেকখানি উঠে বাগানঘেরা একটা চমৎকার এদেশী ধাঁচের হাঁড়ির সামনে হাজির হলো। একটা বড়সড় ঘরের একটা কফির টেবিলে বসতে অনুরোধ করা হলো তাকে। ঘর থেকে বাইরের শহরটাকে মনোরম দেখায়। সেই পুদিনাপাতার গন্ধে ভরপুর চা এলো একসময়। তারপর নানাধরনের জিনিষ দেখানো হলো-কম্বল, পোশাক-পরিচ্ছদ, মুক্তো, আরও নানা জিনিষ। ভদ্রতার খাতিরে দু-একটা কমদামী জিনিষ কিনলো সে।
সব সারা হলে পথপ্রদর্শক বললো, একটা গাড়ির ব্যবস্থা করেছি, ঘণ্টাখানেক ঘুরে হোটেলে ফিরবো আমরা। একটু থেকে কী যেন আঁচ করে সে আবার বললো, তার আগে–এই মেয়েটি আপনাকে মহিলাদের প্রসাধন ঘরে নিয়ে যেতে পারে।
পাশেই একটা মেয়ে চা পরিবেশন করছিলো, হাসিমুখে এগিয়ে এলো। বললো, হা হা, মাদাম। আসুন আমার সঙ্গে। চমৎকার পরিচ্ছন্ন প্রসাধন ঘর আছে আমাদের।
মুচকি হেসে হিলারী মেয়েটিকে অনুসরণ করলো। প্রসাধন ঘরের উচ্চতা হাত দিলে ছোঁয়া যায়। তা হোক, বেশ পরিষ্কার। সর্বক্ষণ জল পড়ছে, দুর্গন্ধও নেই। হাতমুখ ধুয়ে নিজের রুমালে মুখ মুছে বেরোবার জন্য সে দরজার সামনে এলো। হঠাৎ তার মনে হলো, দরজাটা বাইরে থেকে কে যেন আটকে দিলো। প্রসাধন ঘরে তাকে আটকে রাখার কী কারণ থাকতে পারে। হঠাৎ তার চোখে পড়লো, ঘরের এককোণে আরেকটা দরজা রয়েছে। এগিয়ে গিয়ে দরজার হাতল ধরে টানতেই দরজাটা সহজেই খুলে গেলো।
দরজা দিয়ে বেরিলয়ে সে একটা অন্ধকার ঘরে এসে পড়লো, সামান্য আলো আসছে দেওয়ালের ওপর দিকের ছোট্ট ঘুলঘুলি দিয়ে। ঘরের একধারে বসে এক ফরাসি ভদ্রলোক সিগারেট টানছে, ভদ্রলোক আর কেউ নন, সেই ট্রেনে আলাপ–মঁসিয়ে হেনরি লরেল।
লরেল তাকে অভ্যর্থনা না জানিয়ে একটু মেকি গলায় শুধু বললো, শুভ সন্ধ্যা, মিসেস বেটারটন।
মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো হিলারী। সমস্ত ব্যাপারটা বুঝে নিজেকে সংযত করে নিল হিলারী। সাহসী মনটা বললো–যাও, এগিয়ে যাও। অলিভ যা করতে বলে তোমার মনে হয়, ঠিক তেমন অভিনয় করো। আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে উদ্বিগ্ন স্বরে সে জিজ্ঞেস করলো আমার জন্য কোনো খবর আছে? আপনি আমায় কোনো সাহায্য করতে পারেন?
লরেল মাথা নাড়লো, তারপর যেন একটু ভৎর্সনার সুরে বললো, ট্রেনে আপনাকে দেখে কেমন অদ্ভুত মনে হয়েছিলো আমার, সারাক্ষণ শুধু আবহাওয়ার কথাই বলে গেলেন।
–আবহাওয়া! চোখ বড়বড় করে হিলারী তার দিকে তাকিয়ে রইলো।
ট্রেনে এই লোকটা আবহাওয়া সম্পর্কে কী বলেছিলো যেন? ঠান্ডা? কুয়াশা? না–বরফ?
বরফ। হা-তুষার। মৃত্যুকালে অলিভ বেটারটনও ফিসফিস করে এই কথাটাই বলেছিলো-বারবার। গুনগুন করে সেই ছোট্ট ছড়াটাই সে মনে করার চেষ্টা করলোকী যেন ছড়াটা…? হ্যাঁ
তুষার, শুধু তুষার শুভ্র সুন্দর
তুষার-সে মৃত্যুগহ্বর!
বারবার আউড়ে ছড়াটা মনে গেঁথে নিল।
-হা,–আবহাওয়া–আপনার প্রতি যেমন নির্দেশ ছিলো, সেইমতো উত্তর দেননি কেন? লরেল এবার সরাসরি ধমক দিলো।
–আপনি হয়তো বুঝতে পারছেন না–আমি ভীষণ অসুস্থ হয়েছিলাম। প্লেন দুর্ঘটনায় সাংঘাতিক আহত হই আমি। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। ফলে আমার স্মৃতিশক্তি প্রায় লোপ পায়। অনেকদিন আগের কথাবার্তা সব মনে পড়ে, কিন্তু তারপর–তারপর সব যেন ফাঁকা-বিরাট শূন্যতা। আপনি হয়তো বুঝতে পারবেন না কী ভয়ঙ্কর সেই অবস্থা।
-হঁ, লরেল বললো, প্লেন দুর্ঘটনাটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। একেবারে সাদামাটা ব্যবসায়ীর গলা–সহানুভূতির চিহ্নমাত্র নেই। এর পরেও–ভ্রমণসূচী অনুযায়ী চলার মতো মনের জোর আর সাহস আপনার থাকবে কিনা সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
–অবশ্যই আমি যাবো–চুপ করে বসে থাকতে পারি না আমি। আমার স্বামী-বলতে বলতে কান্নায় তার গলা বুজে এলো।
লরেল শৃগালের মতো ধূর্ত হাসি হেসে বললো–আপনার স্বামীহা, যতদূর জানি, আপনার জন্য তিনি অধীর অপেক্ষায় রয়েছেন।
হিলারী ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো, আপনি বুঝতে পারবেন না, ও চলে আসার পর এই কটা মাস আমার কীভাবে কেটেছে
–আপনি এ ব্যাপারে কতটুকু জানেন না জানেন, সে সম্পর্কে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ কি সঠিক কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে বলে আপনার মনে হয়?
হাতদুটো দুপাশে ছড়িয়ে অদ্ভুত ভঙ্গি করলো হিলারী, তা আমি কি করে জানবো…? তবে মনে হয়, ওরা বেশ সন্তুষ্ট।
–তার মানেই, হঠাৎ সে চুপ করে গেলো।
-আমার মনে হয় এটার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে, আস্তে আস্তে বলতে লাগলো হিলারী, ওরা হয়তো আমার পিছু নিয়ে এখানে এসেছে। স্পষ্ট করে কাউকে চিনতে পারিনি বটে, কিন্তু ইংল্যান্ড ছাড়ার পর থেকেই আমার যেন মনে হয়েছে, কেউ আমাকে অনুসরণ করছে।
-খুবই স্বাভাবিক, আমরাও এটাই আশা করেছিলাম, লরেল বললো।
–আমার মনে হয়েছে আপনাদের সাবধান করে দেওয়া দরকার।
মিসেস বেটারটন, আমরা কচি খোকা নই, আমরা যা করি বুঝে শুনেই করি।
হিলারী বললো, আমি দুঃখিত। আমি খুব বোকা, তাই না?
–আমাদের কথামতো যদি চলেন তাহলে আপনি বোকা হলেও কিছু যায় আসে না।
আপনার স্বামী চলে যাবার পর থেকেই যে ইংল্যান্ডে আপনার গতিবিধির ওপর কড়া নজর রাখা হয়েছে, এ বিষয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই, তাছাড়া–খবরটা আপনার কাছেই এসেছিল, তাই না?
-হ্যাঁ।
লরেল এবার সরাসরি কাজের কথা বললো, আপনার প্রতি যে নির্দেশ আছে তা আপনাকে জানাচ্ছি। আগামী পরশু এখান থেকে আপনি ম্যারাকেশের পথে রওয়ানা হবেন, সেইমত সব ব্যবস্থাপত্র করা আছে।
-বেশ।
ম্যারাকেশ পৌঁছাবার পরদিন ইংল্যান্ড থেকে একটা তারবার্তা পাবেন। তাতে কী-লেখা থাকবে তা আমি জানি না, কিন্তু তক্ষুনি ইংল্যান্ড ফিরে যাবার ব্যবস্থা করার মতো যথেষ্ট যুক্তি তাতে থাকবে।
আমাকে আবার ইংল্যান্ড ফিরে যেতে হবে!
–আহা–আগে শুনুন। পরদিন ক্যাসাব্লাঙ্কা থেকে ইংল্যান্ডের টিকিট কাটবেন।
–যদি টিকিট না পাই–ধরুন সব আসনই ভর্তি থাকে?
-না–সব আসন ভর্তি থাকবে না। তার জন্যও সব ব্যবস্থা করা থাকবে, এখন কী কী আপনাকে করতে হবে-বুঝলেন তো?
বুঝেছি।
তাহলে এবার দয়া করে আপনার পথপ্রদর্শক যেখানে অপেক্ষা করছে সেখানে ফিরে যান। অনেকক্ষণ হলো আপনি প্রসাধন ঘরে ঢুকেছেন। হ্যাঁ ভালো কথা–জামা প্যালেসের যে একজন আমেরিকান এবং একজন ইংরেজ মহিলার সঙ্গে আপনার পরিচয় হয়েছে তাদের একজনকে যদি আপনার সাথে ম্যারাকেশ যেতে রাজি করাতে পারেন, খুব ভালো হয়। আচ্ছা বিদায়, মাদাম।
–বিদায়, মঁসিয়ে।
-আপনার সঙ্গে আর আমার দেখা হবার সম্ভাবনা নেই-লরেল বললো।
হিলারী এবার প্রসাধন ঘরে ফিরে এলো। দরজা ঠেলতেই দরজা খুলে গেলো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে প্রথপ্রদর্শকের সঙ্গে মিলিত হলো।
পরিকল্পনা মতো অভিযানের পথে এগিয়ে চললো হিলারী।
মিস হেদারিংটন বললেন, তাহলে কাল আপনি ম্যারাকেশ চললেন? ফেজ-এ বেশিদিন থাকলেন না, তাই না? তার চেয়ে প্রথমে ম্যারাকেশ হয়ে ক্যাসাব্লাঙ্কা ফেরার পথে ফেজ ঘুরে গেলেই পারতেন।
–তা করলেই ভালো হতো, হিলারী বললো, কিন্তু টিকিট পাওয়া মুশকিল। যা ভিড় এখানে।
–ইংরেজদের ভিড় নয় কিন্তু, মিস হেদারিংটন দুঃখের সঙ্গে বললো। নিজের দেশের লোক দেখতে পাওয়া যায় না। চারিদিকে দেখুন, কেবল ফরাসিদের ভিড়।
মুচকি হাসলেন হিলারী, মরক্কো যে একসময় ফরাসি উপনিবেশ ছিলো একথা মিস হেদারিংটন বোধহয় ভুলেই গেছেন।
এবার হিলারী বললেন, আপনারা যদি আমার সঙ্গে ম্যারাকেশ যান খুব খুশি হবো আমি। এখানে আপনাদের সঙ্গে আলাপ করে যথেষ্ট আনন্দ পেয়েছি, সত্যি একা একা বেড়ানো খুবই বিরক্তিকর।
-ম্যারাকেশ আমার ঘোরা, মিস হেদারিংটন বললেন, কিন্তু মিসেস বেকার এই প্রস্তাবে লাফিয়ে উঠলেন। বেকার বললেন, আমি বরং একবার অফিসঘর ঘুরে দেখি আপনার সঙ্গে যাওয়ার কী বন্দোবস্ত করা যায়।
মিস হেদারিংটন উল কাটার ব্যাগ গুছিয়ে বেরিলয়ে গেলেন। হিলারী তার ঘড়ির টাইম দেখছিলেন–নৈশাহারে যাবার আগে সে আর পোশাক পাল্টাবেন না। সে ডিভানে গা এলিয়ে ভবিষ্যৎ দিনগুলোর কথা ভাবছে।
গতকাল তার মনে হয়েছিল যে কাজে সে নিজেকে উৎসর্গ করেছে তার সবটাই মিথ্যে। কিন্তু এখন তা মনে হচ্ছে না। এখন সে আসল অভিযানের জন্য পা বাড়াতে প্রস্তুত। তাকে সাবধান হতে হবে। তাকে পুরোপুরি অলিভ বেটারটনে রূপান্তরিত হতে হবে।
না, কোনোরকম ভুল করবো না আমি, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে শপথ নিলো হিলারী।
মরক্কোর এক নির্জন, আধো অন্ধকার ঘরে সম্পূর্ণ একা বসে থাকা কী অদ্ভুত! তার পাশেই একটা পেতলের প্রদীপ। আচ্ছা–সে যদি ওই পেতলের প্রদীপটা হাতে নিয়ে ঘষে তার থেকে সেই জীনটা বেরিলয়ে আসবে না তো! চিন্তাটা মাথায় আসতেই বুকের মধ্যে গুরগুর করে উঠলো আর তখনই প্রদীপের পেছন থেকে একটা বলিরেখা চিহ্নিত ছাগলদাড়িওলা মুখ দেখা দিল, মিঃ অ্যারিস্টাইডস! এগিয়ে এসে বসার অনুমতি চাইলেন। হিলারী সম্মতি জানালো।
সিগারেটের কেস থেকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিলেন, হিলারী নিলো, নিজেও একটা ধরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এ দেশটা আপনার ভালো লাগছে তো, মাদাম?
-খুব অল্প সময় এসেছি আমি, তবুও কিন্তু খুব সুন্দর লাগছে।
–বা! পুরোনো শহর দেখেছেন? ভালো লাগেনি?
–অপূর্ব-অপূর্ব লেগেছে।
-হ্যাঁ, সত্যিই অপূর্ব। অতীতের অনেক কিছুই ওখানে রয়েছে। ফেজ-এর রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমার লন্ডনের গ্রেট ওয়েস্ট রোডের কথা মনে পড়ে যায়। সেই রাস্তার দুধারে বড় বড় কারখানা বড় বড় বাড়িতে ঝলমলে আলো জ্বলছে। কিছু লুকোনো নেই সেখানে, কোনোকিছুই রহস্যময় নয়।
হিলারী বললো, আপনি বলতে চাইছেন, এই বৈসাদৃশ্যটাই আপনাকে আকৃষ্ট করে?
মিঃ অ্যারিস্টাইডস ঘাড় নাড়লেন, হ্যাঁ, ওখানে সবকিছু উন্মুক্ত আর ফেজ-এর পুরানো রাস্তায় কোনো কিছুই প্রকাশ্য নয়। সবকিছু লুকোনো, অন্ধকার…, কিন্তু কিন্তু সবকিছুই আগের মতো চলছে। সেই নৃশংসতা, সেই নির্মম অত্যাচার, সেই ক্ষমতার আসনে বসার লোভ, সেই দরকষাকষি, ঝগড়া বিবাদ।
–আপনি বলছেন, সর্বকালে সর্বদেশে মানবপ্রকৃতি একই রকম?
-হ্যাঁ, ঠিক তাই। সবদেশে এই হয়। আগে যেমন হতো, এখনও ঠিক তাই–দুটো জিনিষ নিয়ে শাসনকার্য চলে। এক–নৃশংসতা এবং দুই-মহানুভবতা। একটু থেমে তিনি বললেন, আমি শুনেছি মাদাম, কদিন আগে আপনি ক্যাসাব্লাঙ্কায় এক ভয়ঙ্কর প্লেন দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন?
-হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন।
–আপনাকে দেখে আমার ভীষণ হিংসে হচ্ছে। অবাক চোখে তাকালো হিলারী। মিঃ অ্যারিস্টাইডস আবার বললেন, হ্যাঁ আপনাকে হিংসা করা উচিত। কারণ আমি একটা অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। মৃত্যুর এত কাছাকাছি পৌঁছবার এমন অভিজ্ঞতা পেতে ভীষণ ইচ্ছে করে আমার। আচ্ছা, সেই থেকে আপনার চিন্তাভাবনার কোনো পরিবর্তন হয়নি, মাদাম?
হয়েছে, তবে সেটা খুব সুখকর নয়, হিলারী বললো। মাথায় খুব জোর চোট লেগেছিলো আমার। সেই থেকে সাংঘাতিক মাথার যন্ত্রণা শুরু হলো, আর স্মরণশক্তিও কেমন যেন গুলিয়ে গেলো।
মিঃ অ্যারিস্টাইডস হাত নেড়ে বললেন, এগুলো তো সাধারণ কথা কিন্তু আপনার আত্মা যে একটা ভয়ঙ্কর রোমাঞ্চকর অভিযান সেরে এসেছে, এটা তো স্বীকার করবেন?
তা সত্যি। সত্যিই এক ভয়ঙ্কর রোমাঞ্চকর অভিযান সেরে এসেছি আমি। সেই ঘুমের ওষুধের মোড়ক আর জলের গ্লাসের কথা হিলারীর চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
-কত কী-ই হলো, কিন্তু এ অভিজ্ঞতা আমার কপালে জুটলো না। মিঃ অ্যারিস্টাইডস বললেন।
তিনি উঠে পড়লেন। আনত অভিবাদন করে, আমার সশ্রদ্ধ অভিনন্দন জানাচ্ছি, মাদাম, বলে ঘর থেকে বেরিলয়ে গেলেন।
.
০৮.
সব বিমানবন্দরগুলোর মধ্যেই কী অদ্ভুত সাদৃশ্য, ভাবছিলো হিলারী। প্রত্যেকটাকে ঘিরেই কেমন যেন অদ্ভুত এক অজানার হাতছানি। সবগুলোই শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে, যেখানে গেলে অদ্ভুত একটা কথা বারবার মনে হয়-মনে হয় যেন সমাজ, রাষ্ট্র থেকে বহুদূরে এক শূন্যতার মাঝে এসে পড়েছি।
বিমানবন্দরের বিশ্রামঘরে প্রায় আধঘণ্টা আগে এসেছে ওরা। মিসেস কেলভিন বেকার শেষপর্যন্ত হিলারীর সঙ্গে ম্যারাকেশ যাওয়া ঠিক করলেন। এখানে এসে কেলভিন বেকার আরো দুজন ভদ্রলোকের সাথে বন্ধুত্ব করেছেন। একজন আমেরিকান অন্যজন ডেনিস বা নরওয়ের নোক।
মিসেস বেকার হিলারীকে দেখে তাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন, আমার বন্ধু, ইনি মিসেস বেটারটন।
একজন বললো, আমার নাম ‘অ্যান্ড্রু পিটার্স, আরেকজন বললো আমার নাম ‘টরকুইল এরিকসন।
তাহলে আমাদের সকলের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেলো, মিসেস বেকার বললেন, আপনারাও ম্যারাকেশ যাচ্ছেন? আমার বন্ধুও এই প্রথম ওখানে যাচ্ছেন
হঠাৎ ঘোষণা শোনা গেল প্লেন ওঠার সময় হয়ে এসেছে। মোট ছজন যাত্রী। হিলারী, মিসেস বেকার, পিটার্স আর এরিকসন ছাড়া একজন লম্বা মতো রোগাটে ফরাসি ভদ্রলোক, আর একজন কদাকার সন্ন্যাসিনী।
বেশ সুন্দর ঝকঝকে সকাল, প্লেন ওড়ার আদর্শ আবহাওয়া। নিজের আসনে গা এলিয়ে দিয়ে আধবোজা চোখে হিলারী তার সহযাত্রীদের লক্ষ্য করছিলো, আর নিজের মনের দুশ্চিন্তা দূর করছিলো। মিসেস কেলভিন বেকার মাঝের চলাচলের পথের ওপাশে একটা আসনে রয়েছেন। ঠিক সামনে বসেছেন এরিকসন এবং তার পেছনে বসেছেন কদাকার সেই সন্ন্যাসিনী।
ছয়জন লোক মাত্র কঘন্টার জন্য একসঙ্গে চলেছে, ভাবছিলো হিলারী। ছজন বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় চলেছে।
চোখ বন্ধ করে হিলারী সহযাত্রীদের কথা ভুলে গিয়ে গতকাল সারারাত ধরে তাকে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাই নিয়ে চিন্তা করেছে সে–আজও সেই ধাঁধার উত্তর খুঁজতে লাগলো। তাকে ইংল্যান্ড ফিরে যেতে হবে। পাগল! নাকি সেই কোথাও ভুল করলো। ওরা হয়তো তাকে বিশ্বাস করেনি! দুশ্চিন্তায় নড়েচড়ে বসলো হিলারী। মনে মনে বললো, মরুকগে, যা করছি তার বেশি আর কিছু করতে পারব না আমি। তাতে যদি ব্যর্থ হয়ে থাকি হয়েছি।
সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুতের মত আর একটা চিন্তা মাথায় খেলে গেলো। মরক্কোয় যে হিলারীর ওপর নজর রাখা হয়েছে এটা খুবই স্বাভাবিক বলে বিশ্বাস করেছে লরেল। তবে কি পুলিসের সন্দেহ মিথ্যে এটাই প্রমাণ করার জন্যই তাকে ইংল্যান্ড ফেরত পাঠাতে চায় ওরা! মিসেস বেটারটন হঠাৎই ইংল্যান্ড ফিরে গেলে তার ওপর থেকে সব সন্দেহ দূর হয়ে যাবে-তাকে একজন সত্যিকারের ভ্রমণার্থী বলেই মেনে নেবে ওরা।
এয়ার ফ্রান্সের বিমানে প্যারিস হয়ে ইংল্যান্ড ফিরতে হবে–আর সম্ভবতঃ প্যারিসেই টম বেটারটন উধাও হয়েছিল। এখান থেকে কাউকে উধাও করে দেওয়া নিশ্চয়ই খুব সহজ। টম বেটারটন নিশ্চয়ই কখনোই প্যারিস ত্যাগ করেননি। এসব আজগুবি চিন্তায় মাথা ভরে এলো হিলারীর। কখন যেন গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলো সে, হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেতে মনে হলো প্লেনটা দ্রুতগতিতে নিচে নামছে আর চক্কর দিচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো এখনও তো পৌঁছবার সময় হয়নি। তাছাড়া, বাইরে তাকিয়ে নিচে কোনো বিমানবন্দরের চিহ্ন চোখে পড়ল না।
মুহূর্তের জন্য অজানা ভয় তাকে জড়িয়ে ধরলো। মিসেস কেলভিন বেকার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে হিলারী বললো, আমরা পৌঁছে গেছি বোধহয়।
প্লেনটা নিচে নেমে চক্কর দিচ্ছে–জনহীন মরুভূমির মতো জায়গা। অনেক দূর পর্যন্ত কোনো গ্রাম বা বাড়ির চিহ্নমাত্র পড়লো না। ইঞ্জিনের কোনো গোলমাল হলো না তো! ভাবছিলো হিলারী। সামনের দরজা দিয়ে কালো চামড়ার এক যুবক নিঃসন্দেহে প্লেনের চালক, বেরিলয়ে এসে বললো, দয়া করে আপনারা নেমে পড়ুন। পেছনের দরজা খুলে একটা সিঁড়ি নামিয়ে দিয়ে সে সকলের নেমে যাওয়ার অপেক্ষায় রইলো, চালক নিজেও নেমে এসে ফরাসী ভাষায় বললো : আপনারা সবাই এখানে আছেন?! আপনাদের কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে এখানে, সেজন্য মাফ করবেন।-ওই তো এসে গেছে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সবাই দেখলো, দিগন্তের গায়ে একটা বিন্দু ক্রমশঃ তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। হিলারী হতচকিত ভাবে জিজ্ঞেস করলো, কিন্তু এখানে আমাদের নামার কারণ কী? এতক্ষণ এখানে আটকে থাকতে হবে আমাদের?
ফরাসি ভদ্রলোক বললো, মনে হচ্ছে একটা মালগাড়ি আসছে এদিকে, আমাদের কি ওতে চেপে যেতে হবে?
-ইঞ্জিন খারাপ হয়েছে নাকি? হিলারী জিজ্ঞেস করলো।
অ্যান্ড্রু পিটার্স সকৌতুকে বললো, মোটেই না, ইঞ্জিন তো বেশ ভালোই চলছিলো। যাইহোক, মনে হচ্ছে এরা আমাদের যাত্রার এইরকম ব্যবস্থা করেছে।
হিলারী হাঁ করে তাকিয়ে রইলো। মিসেস কেলভিন বেকার গজগজ করতে লাগলেন, উঃ কী ঠান্ডা! এখানে দাঁড়িয়ে থাকা যায়!
বিমান চালক মনে মনে অভিশাপ দিচ্ছিলো। হিলারীর মনে হলো সে যেন বলছে রোজ রোজ এই দেরি–সহ্য হয় না আর!
মালগাড়িটা দূরন্ত গতিতে এসে থামলো। দেহাতী চালকের সাথে বিমানচালকের তর্কাতর্কি শুরু হয়ে গেলো। ওদের মাঝে মিসেস বেকারকে মধ্যস্থতা করতে দেখে হিলারী আশ্চর্য হলো। ওদের প্রায় ধমক দিয়ে ফরাসিতে বলছেন, সময় নষ্ট কোরো না। তর্ক করে লাভ নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা এখান থেকে বেরিলয়ে যেতে চাই।
মালগাড়ির চালক হতাশভঙ্গি করে গাড়ির কাছে ফিরে এলো। পেছনের দরজাটা খুলে ফেলে, বিমানচালক, এরিকসন আর পিটার্সের সাহায্যে একটা বিরাট বাক্স বাইরে বের করে আনলো। দেখে মনে হলো দারুণ ভারি। দেহাতী লোকটা যখন বাক্সের ডালা খুলছে, কেলভিন বেকার হিলারীর একটা হাত আঁকড়ে ধরলেন। বললেন, আমি দেখতে পারবো না ভাই। দৃশ্যটা নিশ্চয়ই খুব সুখকর হবে না।
হিলারীকে ধরে তিনি মালগাড়ির উল্টোদিকে চলে গেলেন। সেই ফরাসি ভদ্রলোক আর পিটার্সও তাদের সঙ্গে এলো। ফরাসি লোকটি তার দেশীয় ভাষায় বলছিলেন, এতে কী এমন আছে, যা নিয়ে ওরা এত কসরৎ করছে?
মিসেস বেকার বললেন, আপনি তো ডাঃ ব্যারন, তাই না? আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, বলে মিসেস বেকার আপ্যায়নের ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে করমর্দন করলেন।
হিলারী জিজ্ঞেস করলো, মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। ওই বাক্সে কী আছে? ওটা না দেখাই ভালো কেন?
অ্যান্ড্রু পিটার্স বললো, ওতে কী আছে আমি বলতে পারি, প্লেনের চালক আমাকে বলেছে মনোরম কিছু নয়, তবে খুব প্রয়োজনীয় জিনিষ বোধহয়। একটু হেসে শান্ত গলায় বললো, ওর মধ্যে কটা মানুষের দেহ আছে।
–মানুষের দেহ! অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো হিলারী। না না, এখনও ওদের মারা হয়নি। সান্ত্বনার হাসি হাসলো সে, অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই ওদের আনা হয়েছিলোগবেষণা, মানে শারীরবিদ্যা গবেষণার জন্য।
হিলারী হা করে তাকিয়ে রইল–আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
-ও! দেখুন মিসেস বেটারটন আমাদের যাত্রা এখানেই শেষ হলো। মানে–একপ্রস্থ যাত্রা।
শেষ হলো? মানে?
–হ্যাঁ। ওরা এবার ওই দেহগুলোকে আমাদের প্লেনে ঠিকঠাক করে বসিয়ে দেবে। তারপর এই বিমানচালক কী সব কলকাঠি নেড়ে দেবে আর আমরা যখন এই মালগাড়িতে চেপে অনেকদূর এগিয়ে যাবো, দেখবো দূর আকাশে আগুনের লেলিহান শিখা। যেন একটা প্লেন দুর্ঘটনায় পড়ে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে–তার কেউ বাঁচেনি।
–কিন্তু কেন? কী সাংঘাতিক কথা!
–কিন্তু–এবার ডাঃ ব্যারন তাকে বললেন, আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমরা কোথায় যাচ্ছি?
মিসেস বেকার কাছে এসে আগ বাড়িয়ে বললেন, জানেন বৈকি। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি–এটা হয়তো উনি আশা করেননি।
হিলারী এবার ঘুরে ঘুরে সবাইকে দেখে বললো, আমরা সবাই সেখানে যাচ্ছি?
পিটার্স বললো, আমরা সবাই সহযাত্রী যে। এরিকসন সোৎসাহে সমর্থন করলো, হ্যাঁ আমরা সব্বাই এক পথের পথিক।
.
০৯.
বিমানচালক এগিয়ে এসে বললো, আপনারা এবার এগোন, দেরি করবেন না, অনেক কাজ এখনও বাকি, তাছাড়া আমাদের নির্দিষ্ট সময়ও পার হয়ে গেছে।
মুহূর্তের জন্য চমকে এক পা পিছিয়ে এল হিলারী। ভয়ে, উত্তেজনায় একটা হাত আপনা থেকেই তার গলার কাছে চলে এলো। সবাই সেই গাড়িতে উঠলো। হিলারী একটা লম্বা বেঞ্চে বসেছে, একপাশে পিটার্স, অন্যপাশে মিসেস বেকার। আমেরিকান মহিলার দিকে ফিরে হিলারী বললো, তাহলে–আপনি-মানে আপনাকে যোগাযোগকারী অফিসার বলেই ডাকবো। কী বলুন, মিসেস বেকার?
–এক্কেবারে ঠিক জিনিষটি আপনি ধরে ফেলেছেন। আর নিজের মুখে বলা ঠিক নয়, তবুও বলছি এ কাজে আমি বেশ পটু। একজন আমেরিকান মহিলাকে, ঘুরে ঘুরে বেড়াতে দেখলে কারো সন্দেহ হবে না।
সহসা এদের পরিকল্পনার চাতুরী ধরে ফেললো হিলারী। বিড়বিড় করে বললো, আর এরা? এরা নিজের নিজের যা পরিচয় দিয়েছেন সত্যিই কি এঁরা তাই?
নিশ্চয়ই, ডাঃ ব্যারন একজন রোগজীবাণুবিদ বলে আমি জানি। মিঃ এরিকসন একজন প্রতিভাবান তরুণ পদার্থবিজ্ঞানী, মিঃ পিটার্স একজন ফলিত রসায়নের গবেষক, মিস নীডহেইস না উনি সন্ন্যাসিনী নন, উনি একজন স্ত্রীরোগ-বিশেষজ্ঞ। আর আমি-আপনি ঠিকই বলেছেন, কেবল যোগাযোগকারী অফিসার। খানিক হেসে বললেন, বেচারা হেদারিংটন, একটুও সুযোগ পেলো না।
মিস হেদারিংটন–তিনি কি
মিসেস বেকার বললেন, ও আপনাকে অনুসরণ করছিলো। ক্যাসাব্লাঙ্কা থেকেই ও আগের লোকের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেয়।
আপনি যখন ম্যারাকেশে পৌঁছবেন। দারুণ মজার ব্যাপার, তাই না? আর দেখুন দেখুন। ওই যে আমাদের প্লেনটা যাচ্ছে।
মরুভূমির মধ্য দিয়ে তাদের গাড়িটা ছুটে চলছিলো। হিলারী ঘাড় ফিরিয়ে জানালা দিয়ে তাকালো। পেছনের আকাশে অনেকখানি যেন দাউদাউ করে জ্বলছে। বিস্ফোরণের মতো একটা আওয়াজও তার কানে এলো–অনেক দূর থেকে। পিটার্স হো হো করে হেসে গড়িয়ে পড়লো। বললো–ম্যারাকেশগামী একটা প্লেন দুর্ঘটনায় ছজন যাত্রী নিহত হয়েছেন।
হিলারী শিউরে উঠে বললো, উঃ! কী ভয়ঙ্কর!
-কোনটা–অজানার পথে পা বাড়ানো? পিটার্সই বললো। এখন তাকে বেশ গম্ভীর মনে হচ্ছে। হ্যাঁ, খুবই ভয়ঙ্কর, কিন্তু এটাই একমাত্র পথ। অতীতকে ছেড়ে ভবিষ্যতের পথে আমরা পা বাড়াচ্ছি। সহসা দারুণ আগ্রহে তার চোখ দুটো দপ করে জ্বলে উঠলো। যত কিছু পুরোনো, খারাপ জিনিষ আমাদের ত্যাগ করতেই হবে। দুর্নীতিপরায়ণ সরকার আর যুদ্ধবাজদের শেষ করতে হবে। নতুন জগতে প্রবেশ করতে হবে আমাদের–সে জগৎ বিজ্ঞানের জগৎ, যা সব কিছু মালিনা থেকে মুক্ত।
একটা লম্বা শ্বাস টানলো হিলারী। আমার স্বামীও ঠিক এই ধরনের কথা বলতেন, ইচ্ছে করেই সে কথাটা বললো।
-আপনার স্বামী? তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো পিটার্স। আপনার স্বামী কি টম বেটারটন? হিলারী সম্মতি জানালো।
-আচ্ছা!–তিনি তত বিরাট লোক। শূন্যশক্তি পরমাণু বিভাজন–এ যুগের এক চাঞ্চল্যকর আবিষ্কার-হ্যাঁ, অজস্র প্রণাম জানাই তাঁকে। বৃদ্ধ ম্যানহেইমের সঙ্গে কাজ করতেন তাই না?
-হ্যাঁ।
–আমি যে শুনেছিলাম উনি ম্যানহেইমের মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন কিন্তু আপনি নিশ্চয়
–আমি তার দ্বিতীয় স্ত্রী, লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো হিলারী। সে-মানে-ওর স্ত্রী এলসা আমেরিকাতেই মারা যায়।
-হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে। এরপরই উনি কাজকর্ম চালিয়ে যাবার জন্য ব্রিটেনে চলে আসেন। তারপরই হঠাৎ উধাও হয়ে গিয়ে ফাঁপরে ফেলে দেন। হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলো, প্যারিসের এক সম্মেলন থেকে হঠাৎ নিরুদ্দেশ, ওঃ! যাই বলুন, এদের ব্যবস্থাপত্তর কিছু বেশ সুষ্ঠু স্বীকার করতেই হবে।
হিলারীও স্বীকার করলো, এদের সংস্থার নিখুঁত কাজের কথা ভেবে বুকের মধ্যেটা একেবারে ঠান্ডায় হিম হয়ে উঠলো। যতকিছু পরিকল্পনা, সঙ্কেতা, চিহ্ন রেখে যাওয়া, যা কিছু সে শিখেছে, সবকিছু একেবারে অকেজো মনে হলো, কারণ এখন আর খুঁজে পাবার মতো কোনো চিহ্নই ওরা পাবে না। সমস্ত ব্যবস্থাটা এমনই নিখুঁত যে, শেষপর্যন্ত দেখা গেল, ওই প্লেনের প্রতিটি যাত্রীই অজানা ঠিকানার যাত্রী, যে পথে টমাস বেটারটন অনেক আগেই পাড়ি দিয়েছে। ওই পোড়া প্লেনটা ছাড়া কোনো চিহ্নই পড়ে থাকবে না। প্লেনের মধ্যে কটা ঝলসানো মৃতদেহও থাকবে। জেসপ আর তার লোকজনেরা কি এটা বুঝতে পারবে যে–ঐ ঝলসানো মৃতদেহগুলোর মধ্যে হিলারী নেই? যথেষ্ট সন্দেহ আছে। দুর্ঘটনাটা এক চতুরভাবে–এত বিশ্বাসযোগ্য ভাবে ঘটানো হয়েছে
পিটার্স বলছিলো, ভাবছি-এখান থেকে আমরা কোথায় যাবো? অদ্ভুত শান্ত তার গলা, এতটুকু ভয় নেই, পিছু তাকানো নেই, শুধু সামনে এগিয়ে যাওয়া।
হিলারীও ঠিক এই কথাই ভাবছিলো। ও মিসেস বেকারকে জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাচ্ছি আমরা? এরপর কী হবে?
দেখতেই পাবেন, মিষ্টি হেসে বললেও বেকারের কথাগুলোরমধ্যে কেমন যেন আতঙ্কের আভাস ছিলো। রাত্রি নামলো, ওরা প্রধান সড়ক দিয়ে না গিয়ে মেঠোপথ, কখনো কাঁচা রাস্তা ধরে এগোচ্ছে।
অনেকক্ষণ জেগে থাকায় অজস্ব চিন্তা আর দুর্ভাবনায় মাথার মধ্যেটা ঝিমঝিম করছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঘুমিয়ে পড়লো।
গাড়িটা হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে যেতে ওর ঘুম ভেঙে গেলো। দেখলো, পিটার্স আস্তে আস্তে ওর হাত ধরে নাড়া দিচ্ছে, উঠে পড়ুন। আমরা মনে হচ্ছে কোনো একটা আস্তানায় পৌঁছে গেছি।
সবাই নেমে পড়লো। অন্ধকারে মনে হলো পামগাছে ঘেরা একটা বাড়ির সামনে নিয়ে এলো। দুটি দেহাতী মেয়ে খিলখিল করে বেকারের দিকে তাকিয়ে হাসছিলো। তিনজন মহিলাকে ওপরের একটা ঘরে নিয়ে আসা হলো। ঘরের মেঝেয় তিনটে মাদুর পাতা আর কম্বল চাদরের একটা গাদা।
মিসেস বেকার হিলারীকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কেমন বোধ করছেন মিসেস বেটারটন? গাড়ির ঝাঁকুনিতে আপনার মাথার ব্যথাটা নিশ্চয়ই বেড়ে গেছে?
-হ্যাঁ, তাই মনে হচ্ছে, হিলারী বললো।
-এক্ষুনি আমাদের খাবার এসে পড়বে, খেয়ে নিয়ে কটা অ্যাসপিরিনের ব্যবস্থা করে দেবো-চটপট শুয়ে পড়বেন।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ এবং নারীকন্ঠের খিলখিল হাসি শোনা গেল। দেহাতী মেয়ে দুটো খাবারের থালা নিয়ে ঘরে ঢুকলো। একজন হিলারীর পশমের কোটটায় হাত বুলোতে লাগলো।
–এই, যা–ভাগ, ভাগ এখন, মিসেস বেকার তাদের তাড়া করলেন। মিসেস বেকার বললেন, খুব নিরীহ ওরা। মাঝে মাঝে ওদের জ্বালায় অস্থির হয়ে উঠতে হয়।
যাক এখন যতটা সম্ভব বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন আমাদের।
চা এলো সেই পুদিনাপাতার গন্ধ। হিলারী চা দিয়ে কটা অ্যাসপিরিন খেয়ে নিলো। তারপর চা খেয়ে শুয়ে পড়লো।
পরদিন অনেক বেলা করে উঠলো ওরা। মিসেস বেকার আগেই বলে দিয়েছিল সেদিন সন্ধ্যার আগে আর কোথাও যাওয়া যাবে না।
ঘুম থেকে উঠে মিসেস বেকার দরজার কাছে জড়ো করা একরাশ পোশাক দেখিয়ে বলেছিলেন, এখন থেকে আমরা এই দেহাতী পোশাক পরবো। আমাদের জামাকাপড় এখানেই ছেড়ে দিতে হবে।
তিনজন আধুনিক মহিলা এখন দেহাতীদের পোশাক পরে মরোক্কোবাসিনী হয়ে ছাদে গল্প করছেন।
আগাগোড়া সমস্ত ঘটনাগুলোই কেমন অস্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছিল হিলারীর। মিস নীডহেইমকে সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলো। তার চেয়ে বয়েসে ছোট হবে। গায়ের চামড়া বিবর্ণ, ক্ষুদে ক্ষুদে আঙুল। আকর্ষণীয় চেহারা নয়।
মিসেস বেকারকে বিচার করতে গিয়ে, তাকে আরও জটিল প্রকৃতির মনে হলো হিলারীর।
সন্ধ্যে পেরিয়ে আবার যাত্রা শুরু হলো, এবার আর মালগাড়িতে নয়। মাথাখোলা একটা বড় গাড়িতে, প্রত্যেকের পরনে দেহাতী পোশাক, পুরুষদের গায়ে জড়ানো আলখাল্লা, মেয়েদের মুখটাকা বোরখা। ছজন যাত্রী নিয়ে অন্ধকারের বুক চিরে গাড়ি চলছিল।
-এখন কেমন বোধ করছেন, মিসেস বেটারটন? অ্যান্ড্রু পিটার্সের দিকে চেয়ে মৃদু হাসলো হিলারী। তখন সবে সূর্য উঠেছে। প্রাতরাশের জন্য থামলো ওরা।
-মনে হচ্ছিলো যেন একটা স্বপ্নের নাটকের পাত্রপাত্রী আমরা, হিলারী বললো।
–হ্যাঁ, ব্যাপারটা সেইরকমই মনে হচ্ছে।
—এখন আমরা কোথায় আছি?
কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন পিটার্স, কী জানি? একমাত্র মিসেস কেলভিন বেকারই জানেন, আর কেউ না।
–এ দেশটা বড় ফাঁকা ফাঁকা।
–হ্যাঁ, প্রায় মরুভূমি বলা যায়। সে তো হতেই হবে, তাই নয় কি?
তার মানে আপনি বলতে চাইছেন যাতে কোনোরকম সূত্র পড়ে না থাকে সেই জন্যে?
-হ্যাঁ। সমস্ত ব্যবস্থাটা যে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে করা হবে এটাই কি ভাবা ঠিক নয়। আমাদের যাত্রাপথে একটার সঙ্গে একটার কোনোও মিল নেই। প্রথমে একটা প্লেন–সেটা পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। দ্বিতীয়ত, একটা পুরোনো মালগাড়িতে সে রাত্রির যাত্রা। গাড়িটা যদি কেউ লক্ষ্যও করে থাকে দেখবে, এই অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খোঁড়াখুঁড়ির কাজে ব্যস্ত রয়েছে গাড়িটা। তারপর এই ভোলা গাড়িতে দেহাতী লোক এ অঞ্চলের রাস্তার অতি স্বাভাবিক দৃশ্য। এরপর হয়তো–কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো সে, কী জানি!
–কিন্তু আমরা যাচ্ছিটা কোথায়?
অ্যান্ড্রু পিটার্স মাথা নেড়ে বললো, জিজ্ঞাসা করে কোনো লাভ নেই। এক সময় নিজেরাই দেখতে পাবো।
ডাঃ ব্যারন এসে তাদের আলোচনায় যোগ দিলেন। বললেন, হ্যাঁ, আমরা দেখতে পাবো বৈকি। কিন্তু কী আশ্চর্য, আমরা জিজ্ঞেস করতেও পারছি না? সবসময় আগামীকাল কী হবে, আগামীকাল কোথায় থাকবে এই নিয়েই আমাদের মাথাব্যথা।
পৃথিবীটাকে খুব তাড়াতাড়ি বদলে ফেলতে চান আপনি, তাই না ডাক্তার? পিটার্স জিজ্ঞেস করলো।
–কত কী পাবার রয়েছে, ডাঃ ব্যারন বলতে লাগলেন, অথচ জীবনটা কত ছোট্ট। জীবনটা আরও দীর্ঘ হওয়া উচিত ছিলো–আরও অনেকদিন যদি বাঁচতে পারতাম–
হিলারীর দিকে তাকিয়ে পিটার্স বললো, আপনাদের দেশে চার রকমের কী স্বাধীনতার কথা আপনারা বলেন যেন? অভাব থেকে মুক্তি, ভয় থেকে মুক্তি…
–আপনি তো একজন রোগজীবাণুবিদ, তাই না ডাঃ ব্যারন?
–হ্যাঁ, আমি একজন রোগজীবাণুবিদ। এই পাঠক্রম যে কত মনোগ্রাহী সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই আপনাদের নেই।
ব্যক্তির সুখে কিছু যায় আসে না, পিটার্স গভীর আলোচনার সূত্রপাত করলো। সমষ্টির সুখই হচ্ছে আসল মুখ, সেখানেই ভ্রাতৃত্ববোধ। যখন মজুররা স্বাধীন এবং সংঘবদ্ধ, যখন উৎপাদন যন্ত্রের মালিক তারাই, যখন যুদ্ধবাজ লোভী শোষকদের মুঠো থেকে তারা ছিনিয়ে আনে মুক্তি–তখনই আসে আসল সুখ।
–সুতরাং! তারিফ করে সমর্থন জানালো এরিকসন। ঠিক বলেছেন আপনি, বিজ্ঞানীরাই হবে আসল মালিক। তারা শুধু হবে সর্বোচ্চ শক্তি।
হিলারী এই আলোচনার মাঝ থেকে উঠে কয়েক পা এগিয়ে এলো। একটু পরে দেখলো পিটার্সও চলে এসেছে। মজা করার জন্য পিটার্স বললো, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে, খুব ভয় পেয়েছেন?
তা পেয়েছি, নিঃশব্দে হাসলো হিলারী। ডাক্তার ব্যারন যা বলেছে খুব সত্যি। আমি বিজ্ঞানী নই, আমি সামান্য একজন নারী। গবেষণা করি না কিংবা রোগজীবাণু নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করি না। আমার বোধহয় অতখানি মানসিকতা নেই। ডাঃ ব্যারন যেমন বলেছেন, আমি সেই সুখ খুঁজে বেড়াচ্ছি–ঠিক আর পাঁচটা বোকা মেয়ের মতো।
–তাতে অন্যায়টা কী হলো? পিটার্স জিজ্ঞেস করলো।
-কী জানি, আমি হয়তো এই দলের গুরুত্ব ঠিক উপলব্ধি করতে পারছি না! বুঝতেই পারছেন–একজন সাধারণ নারী আমি, স্বামীর সঙ্গে দেখা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি।
-এটা কিছু অন্যায় আপনি করেননি।
–আপনি আমার মনের কথা বুঝেছেন বলে খুব ভালো লাগছে।
–বোঝার কিছু নেই, এটাই তো সত্যি। পিটার্স একটু গলা নামিয়ে বললো, স্বামীর জন্য আপনি খুব চিন্তিত, তাই না?
–না হলে কি আজ আমি এখানে থাকতাম?
–হয়তো থাকতেন না। আচ্ছা, আপনি আপনার স্বামীর রাজনৈতিক মতামত সমর্থন করেন? আমি ধরে নিচ্ছি তিনি নিশ্চয়ই কমিউনিস্ট।
সরাসরি উত্তরটা এড়িয়ে গেলো হিলারী। বললো, কমিউনিস্ট হওয়ার কথা যদি বলেন আমি জিজ্ঞেস করবো, আমাদের এই ছোট্ট দলটার কোনোকিছু কি আপনার কাছে অদ্ভুত বলে মনে হয়েছে।
তার মানে?
–মানে–আমি বলছি যদিও আমরা সবাই এক পথের যাত্রী কিন্তু সকলের দৃষ্টিভঙ্গি এক নয়।
পিটার্স কী যেন চিন্তা করে বললো, নয় কেন বলছেন? নিশ্চয়ই আপনি কোনো কারণ খুঁজে পেয়েছেন?
হিলারী বললো, ডাঃ ব্যারনকে আমি ঠিক রাজনৈতিক মতাবলম্বী বলে আদৌ মনে করিনি। উনি ওঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য অর্থ চান শুধু।
হেলগা নীডহেইমের কথাবার্তা ঠিক স্বৈরাচারীর মতো, মোটেই কমিউনিস্টের মতো নয়। আর এরিকসন?-ওঁকে আমার কেন ভীতিকর মনে হচ্ছিলো–মানে ভয়ঙ্কর রকমের স্বাতন্ত্রে বিশ্বাসী উনি।
-আমি কিন্তু মানবজাতির ভ্রাতৃত্ববোধে বিশ্বাসী। আর আপনি একজন পতিপ্রাণা স্ত্রী। আর মিসেস কেলভিন বেকার?–অন্যদের তুলনায় ওকে বিচার করা খুব কঠিন।
হিলারী বললো, বেকার কিন্তু আমাকে খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছেন। উনি এত সাধারণ বলেই ওঁকে আমার ভয়, অথচ এইসব কিছুর সঙ্গে উনি জড়িত।
পিটার্সের গলার স্বর এবার কঠিন হলো। বললো, আপনি হয়তো জানেন, পার্টি সম্পূর্ণ বাস্তববাদী। পার্টির কাজের জন্য সবসময় বাছাবাছা লোকই কেবল নিয়োগ করা হয়।
হঠাৎ শীত করছে বলে কেঁপে উঠলো হিলারী। চলুন একটু পায়চারি করে আসি। দুজনে অনেকক্ষণ পায়চারি করলো। ঘুরতে ঘুরতে পিটার্স উবু হয়ে বসে কী যেন কুড়িয়ে নিলো, হিলারীকে দেখিয়ে বললো, দেখুন তো আপনার কিছু বোধহয় পড়ে গেছে।
হিলারী হাতে নিয়ে বললো, আমারই মুক্তোর হারটা সেদিন ছিঁড়ে গিয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে একটা।
–আসল মুক্তো নয় আশাকরি।
হাসলো হিলারী, বললো সব ঝুটো পোশাকী গয়না। টুকটাক অনেক কথা বলার পর হিলারী জিজ্ঞেস করলো, ঠিক কোথায় যাচ্ছি আমরা বলুন তো? কেউ কিছু বলেনি আমাকে। আমরা কি
পিটার্স তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, আন্দাজে কিছু ধরে না নেওয়াই ভালো, যেখানে আপনাকে যেতে বলা হবে যান, যা করতে বলা হবে করে যান–ব্যস।
হিলারী হঠাৎ আবেগপ্রবণ হয়ে উঠে বললো, আপনাকে কেউ কঠিন বর্মের আড়ালে লুকিয়ে রাখুক বা কেউ হুকুম তামিল করতে বাধ্য করুক, নিজের সম্পর্কে কিছু বলতে নিষেধ করুক এটা কি আপনার ভালো লাগবে?
-বিশ্বশান্তি, বিশ্বশৃঙ্খলা এবং বিশ্বের পুনর্বিন্যাসের জন্য সবকিছু করতে আমি প্রস্তুত।
–তা কি সম্ভব? তা কি পাওয়া যায়? এই পঙ্কিল জীবনের চেয়ে যে-কোনো জিনিষই ভালো। একথা মানেন তো?
এক মুহূর্তের জন্য যেন পারিপার্শ্বিক নির্জনতা আর ভোগের নরম আলোয় মানসিক জড়তা কাটিয়ে উঠলো হিলারী। না-না-না বলে চিৎকার করে ফেটে পড়তে চাইলো। বলতে চাইলো, যে পৃথিবী আমাদের আশ্রয় দিয়েছে, তাকে কেন নিন্দে করছো তুমি? আমার এই বিশ্ব থাক, যেখানে স্নেহ মমতা আর ভুলভ্রান্তিতে ভরা মানুষ আছে। দয়াহীন মায়াহীন যন্ত্রমানবে ভরা সুন্দর বিশ্ব আমার চাই না–চাই না।
নিজেকে সংযত করে নিয়ে বললো, আপনার কথাগুলো বর্ণে বর্ণে সত্যি। আমিও হাঁপিয়ে উঠেছি। হ্যাঁ, ওদের কথা শুনে এগিয়েই যেতে হবে আমাদের।
পিটার্স হেসে বললো, হ্যাঁ সেটাই ভালো।
.
১০.
এ যেন স্বপ্নিল পথে যাত্রা, মাঝে মাঝে হিলারীর মনে হচ্ছিল, সে যেন সারাজীবন ধরে বাছা বাছা পাঁচজন সহযাত্রীর সঙ্গে চলেছে। রাস্তা ছেড়ে গাড়ি এখন চলেছে প্রায় শূন্য প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে। মাঝে মাঝে মনে হতো–এক অদ্ভুত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারা সব্বাই অন্য মানুষে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।
হিলারীর নিজের ক্ষেত্রে এটা বর্ণে বর্ণে সত্যি। যে হিলারী ক্র্যাভেন ইংল্যান্ড থেকে এসেছিলো সে এখন অলিভ বেটারটনে পরিণত হয়েছে। এইসব রাজনৈতিক আলোচনা সে এখন কত সহজে করতে পারে। প্রতিদিনই সে যেন আরও বেশি করে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে–নবরূপে নতুন মানুষে পরিণত হয়েছে।
মাঝে মাঝে এই লোকগুলোকে ভয়ও করে। প্রতিভাবান লোকদের সঙ্গে এক ঘনিষ্ঠভাবে আর কখনও সে মেশেনি। এরা যেন সাধারণ মানুষের মতো নয়, অনেক উপরে। এই পাঁচজন–প্রত্যেকে প্রত্যেকের থেকে আলাদা। হিলারীর মনে হয়েছে–এরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ আবেগপ্রবণ আদর্শবাদের শিকার।
ডাঃ ব্যারন একদিন বলেছিলো–একটা ছোট্ট শিশির মধ্যে এমন বিধ্বংসী শক্তি ধরে রাখা যায়, যা একটা বিশাল মহাদেশকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে।
হিলারী তাকে জ্ঞিজ্ঞেস করেছিলো, এমন কাজকে কি আপনি সমর্থন করেন? সত্যিই কি একাজ করতে পারেন আপনি?
কেমন যেন অবাক হয়ে তাকিয়ে তিনি বলেছিলেন, অবশ্যই পারি–যদি প্রয়োজন হয় হাজারবার করতে প্রস্তুত আমি। কত কী জানার আছে ও কত কীই আবিষ্কার করার রয়েছে…
হেলগা নীডহেইমের প্রতি তার বিতৃষ্ণা আরও প্রকট। মেয়েটার এই প্রচণ্ড ঔদ্ধত্য তাকে আরও বেশি করে জ্বালা ধরিয়েছে। আর পিটার্সকে তার ভালো লাগলেও মাঝে মাঝে তার চোখে ভয়ঙ্করের আগুন দেখে সে ভয় পেয়েছে, গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে।
কোথায় যাচ্ছি আমরা? বারবার এই কথাটা ভাবছিলো হিলারী। এসবের শেষ কোথায়? এই লোকগুলো পাগল, এদের মাথামুণ্ডু নেই। প্রত্যেকেই যেন এক-একটা মরীচিৎকার পেছনে ছুটছে।
তৃতীয় দিনটাও শেষ হয়ে গেলো। ছোট্ট একটা শহরের গ্রাম্য হোটেলে এসে উঠেছে ওরা। এখানে এসে তারা আবার পাশ্চাত্যের আধুনিক পোশাক পরলো। ছোট্ট একটা ফাঁকা ঘরে সে-রাতটা ঘুমালো হিলারী। খুব ভোরে মিসেস পেকার তাকে ডেকে তুললেন। উঠে পড়ুন এক্ষুণি আমাদের বেরোতে হবে। প্লেন অপেক্ষা করছে।
-প্লেন?
–হ্যাঁ-প্লেন। বাব্বাঃ! এতদিন পর এবার একটু ভদ্রভাবে ঘোরা যাবে।
ঘন্টাখানেক গাড়ি পথে এসে বিমানবন্দরে পৌঁছলো ওরা। দেখে মনে হয়–সেনাবাহিনীর পরিত্যক্ত একটা বিমানঘাঁটি।
প্রায় সন্ধ্যে নাগাদ ওরা নামলো। চারিদিকে পাহাড়ঘেরা সমতল জায়গা। আগে যে একটা কর্মব্যস্ত বিমানবন্দর ছিলো তা স্পষ্ট। পাশে একটা বেশ বড়সড় সাদা বাড়ি।
মিসেস বেকার তাদের সেই বাড়িতেই এনে তুললেন। এটা যে সম্পূর্ণ কারো ব্যক্তিগত বিমানবন্দর সেটা বোঝা যায়, কারণ কোনরকম সরকারী অভ্যর্থনা পেলো না যাত্রীরা।
এতদিনে যাত্রা শেষ হলো, দারুণ খুশির মেজাজে আচমকা বলে উঠলেন মিসেস বেকার, এখন ভেতরে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে নেওয়া যাক। তার মধ্যে গাড়ি তৈরি হয়ে থাকবে।
–যাত্রা শেষ?–হিলারী হা করে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু এখনও তো আমরা সাগর পার হইনি।
আপনি তাই আশা করেছিলেন নাকি? মিসেস বেকার কৌতুকের স্বরে বললেন।
অবাক হয়ে হিলারী বললো, হ্যাঁ–মানে সত্যিই তাই আশা করেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম… থেমে গেলো সে।
-সব লোকেই তাই ভাবে। বোকা লোকগুলো লৌহ যবনিকা নিয়ে কত কী-ই না কল্পনা করে কিন্তু আমি বলি, পৃথিবীর যে-কোনো জায়গাতেই লৌহ যবনিকার অন্তরাল সৃষ্টি হতে পারে।
দুজন ভৃত্য আবার এসে তাদের অভ্যর্থনা জানালো। হাত-মুখ পরিষ্কার করে কফি, স্যান্ডউইচ, বিস্কুট–জলযোগ। খাওয়া শেষ হতে মিসেস বেকার ঘড়ি দেখলেন। আচ্ছা, এবার আমি উঠি, ভাই। আমি এখান থেকেই ফিরে যাবো।
হিলারী অবাক হয়ে বললেন, আপনি আবার মরক্কোয় ফিরে যাবেন?
ওটা ঠিক হবে না, কারণ ঐরকম একটা প্লেন দুর্ঘটনার পর আর কি সেখানে ফেরা উচিত। না, এবার আমাকে অন্য শিকারের পেছনে ছুটতে হবে।
কিন্তু কেউ তো আপনাকে চিনে ফেলতে পারে। ক্যাসাব্লাঙ্কা বা ফেজ-এর হোটেলের পরিচিত কেউ।
হ্যাঁ পারে, বললেন মিসেস বেকার। কিন্তু তারা ভুল লোককে চিনবে। আমার এক বোন, মানে আরেক মিসেস কেলভিন বেকার প্লেন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে। আর আমার বোনের সঙ্গে আমার মিল থাকাটাই স্বাভাবিক।
হ্যাঁ, একথা খুবই সত্যি, মনে মনে ভাবলো হিলারী। সমস্ত কর্মের বাহ্যিক গুণগুলোই মিসেস বেকারের মধ্যে বর্তমান। সারা দুনিয়ার সামনে, পরিচিত লোকজনের সামনে মিসেস কেলভিন বেকার নিজেকে এমন স্বতন্ত্রভাবে প্রকাশ করেছে যে, তার সেই বিশালত্বের পেছনে কী আছে জানা কঠিন।
বেকার বললেন, আচ্ছা চলি মিসেস বেটারটন। আপনার স্বামীর সঙ্গে পুনর্মিলন সুখের হোক এই কামনা করি।
সম্পূর্ণ অসহায়ভাবে হিলারী বললো, আমি যে কোথায় আছি তাও জানি না–পৃথিবীর ঠিক কোন্ জায়গায়?
এই কথা! এতো খুব সোজা না, এখন আর লুকোছাপার কোনো প্রয়োজন নেই। এটা সুউচ্চ অ্যাটলাসের দুর্গম স্থান একটা, এর খুব কাছেই–কথাটা শেষ না করেই মিসেস বেকার একে একে সকলের কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। সেই প্লেনটা তারই জন্যে অপেক্ষা করছিলো। কেমন যেন একটা ঠান্ডা শিরশিরানী অনুভব করছিলো হিলারী। মনে হলো, বহির্জগতের সঙ্গে শেষ যোগসূত্রটুকু এখানে ছিন্ন হয়ে গেলো।
পিটার্স হিলারীর মনের কথা বুঝেই বোধহয় এগিয়ে এসে মৃদুস্বরে বললো, এমন জায়গা যেখান থেকে ফেরার কোনো পথ নেই। হ্যাঁ, আমাদের কথাই বলছি।
ডাঃ ব্যারনও এগিয়ে এসে বললেন, এখনও আপনাদের মনের জোর আছে তো? নাকি আপনারা ওই মার্কিনী বন্ধুটির সঙ্গে প্লেনে উঠে নিজের চেনা জগতে ফিরে যেতে চাইছেন?
-ইচ্ছে করলেই কি যেতে পারবো? হিলারী বললো।
–কাঁধ ঝাঁকিয়ে ফরাসি ভদ্রলোক বললেন, কী জানি!
–ওঁকে ডাকবো? অ্যান্ড্রু পিটার্স জিজ্ঞেস করলো।
হিলারী উত্তর দিলো, কক্ষনো না।
হেলগা নীডহেইম ব্যাঙ্গ করে বললো, দুর্বলচিত্ত মেয়েদের এখানে আসা কেন?
–মোটেই উনি দুর্বলচিত্ত মেয়ে নন, ডাঃ ব্যারন জবাব দিলেন। উনি নিজের কাছেই কিছু জবাব চেয়েছেন, যা যে-কোনো বুদ্ধিমতী মেয়েই করে।
এরিকসন তখন বলেছেন, হুঃ, স্বাধীনতার দোরগোড়ায় এসে লোকে ফিরে যাবার কথা ভাবে কী করে!
হিলারী এবার না বলে পারলো না, যদি ফিরে যাবার উপায় না থাকে অথবা ফিরে যাবার চিন্তা করার স্বাধীনতা না থাকে, তবে এ স্বাধীনতা স্বাধীনতাই নয়।
এই সময়ে ভৃত্য এসে জানালো গাড়ি তৈরি।
বাইরে এসে ওরা দেখলো, দুটো ক্যাডিলাক গাড়ি, পাশে দাঁড়িয়ে দুজন ধোপদুরস্ত চালক। হিলারী চালকের পাশে সামনের আসনে বসতে চাইলো। বড় গাড়ির পেছনের ঝাঁকুনিতে গা গুলোয় তার। গাড়িতে বসে টুকিটাকি কথা বললো হিলারী, কী চমৎকার আবহাওয়া–সুন্দর গাড়িটা–স্বচ্ছন্দ ফরাসিতে সে বলছিলো, ড্রাইভার খুশি হয়ে জবাব দিচ্ছিলো। এবার সে জিজ্ঞেস করলো, আর কতক্ষণ লাগবে যেতে?
বিমানবন্দর থেকে হাসপাতাল? তা–প্রায় ঘন্টাদুয়েকের রাস্তা মাদাম।
হিলারী চমকে উঠলো, হাসপাতাল! তাই হবে বোধহয়। এখন মনে হচ্ছে হেলগা নীডহেইম আগেই নার্সের পোশাক পরে নিয়েছে সম্ভবতঃ এই জন্যই। ড্রাইভারকে বললো, হাসপাতালটা কেমন আমাকে একটু বলো।
–সে মাদাম–চমৎকার। পৃথিবীর আধুনিকতম যন্ত্রপাতি, সাজসরঞ্জাম রয়েছে এখানে। কত বড়বড় ডাক্তার আসেন এই হাসপাতাল দেখতে আর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ফিরে যান। মানবজাতির কল্যাণের জন্য এখানে যা করা হচ্ছে-অতুলনীয়।
-তা তো হতেই হবে-হা হা তাই তো হওয়া উচিত।
–কী যন্ত্রণাময় জীবন এদের-ড্রাইভার বললো। আগেকার দিনে নির্জন দ্বীপে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে মরার জন্য পাঠানো হতো এদের। কিন্তু এখানে, ডাঃ কোলিনির চিকিৎসায় প্রায় সবাই রোগমুক্ত হচ্ছে। এমনকি শেষ অবস্থা থেকেও অনেকে সেরে উঠেছে।
হিলারী বললো, হাসপাতালের পক্ষে জায়গাটা খুবই নির্জন বলে মনে হচ্ছে।
–হ্যাঁ, মাদাম, কিন্তু এইরকম পরিস্থিতিতে নির্জন জায়গাই তো বেছে নিতে হবে। ওপরওয়ালারাই এই বন্দোবস্ত করেছেন। কিন্তু জল হাওয়া খুব ভালো এখানে, চমৎকার বাতাস। ওই যে, এইবার দেখুন মাদাম, আমরা কোথায় যাচ্ছি।
তার দৃষ্টি অনুসরণ করে হিলারী দেখলো, অদূরে পর্বতমালা, সেইদিকেই দ্রুত চলেছে ওরা। পাহাড়ের ওপাশে একটা বিরাট সাদা ঝকঝকে অট্টালিকা।
-ওঃ, এখানে এমন একটি বাড়ি তৈরি করা কি চাট্টিখানি ব্যাপার, ড্রাইভার বলতে লাগলো। কতকত্তো টাকা যে খরচ করা হয়েছে। সরকারী কাজের মতো সস্তা কাজ নয়। জলের মতো টাকা ঢেলেছে। ওরাও বলেন–আমাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী লোকেদের একজন। ঠিকই বলেন, নিজের চোখেই দেখুন–মানবজীবনের দুঃখমোচনের জন্য কী বিরাট প্রতিষ্ঠান গড়েছেন।
আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে গাড়ি উঠে একটা বিরাট উঁচু লোহার ফটকের সামনে এসে দাঁড়ালো।
এখানেই আপনাদের নেমে যেতে হবে, মাদাম। ভেতরে গাড়ি নিয়ে যাবার হুকুম নেই।
নেমে পড়লো ওরা। ফটকের গায়ে ঘন্টা বাজাবার দড়ি ঝুলছে। কিন্তু দড়িটা ছোঁয়ার আগেই দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে গেলো। সাদা পোশাক পরা একজন লোক হাসিমুখে তাদের ভেতরে যেতে ইঙ্গিত করলো। দরজা দিয়ে ঢুকে, একপাশে উঁচু তারের জাল দিয়ে ঘেরা একটা বাগান। সেখানে কয়েকজন পায়চারি করছে। আগন্তুকদের দেখার জন্য তারা মুখ ফেরাতেই, হিলারীর গলা দিয়ে চাপা আতঙ্কের একটা চিৎকার ফেটে পড়তে চাইলো, ওকি! ওরা যে কুষ্ঠরোগী! কুষ্ঠরোগী!
আতঙ্কে থরথর করে কেঁপে উঠলো হিলারী।
১১. কুষ্ঠরোগীদের আশ্রয়
১১.
কুষ্ঠরোগীদের আশ্রয়-শিবিরের বিরাট ফটকটা অভিযাত্রীদের পেছনে যান্ত্রিক শব্দ তুলে আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেলো। শব্দটা হিলারীর হতচেতন স্থাণু মনের ওপর যেন কেটে কেটে বসলো। শব্দটা যেন এই কথাই বলে গেলো, আশা ত্যাগ করো-তোমরা যারা ভেতরে এসেছে–ফেরার আশা ত্যাগ করো…এইবার সব শেষ, ভাবলো হিলারী…সত্যিই এবার সব শেষ, ফিরে যাবার শেষ পথটুকুও রুদ্ধ হয়ে গেলো।
শত্রুদের মাঝে সে এখন সম্পূর্ণ একা। কিছুক্ষণ পরই আবিষ্কার আর ব্যর্থতার মুখোমুখি হতে হবে তাকে। অবচেতন মনে এই কথাটাই তার বারবার মনে হয়েছে। তবুও মানুষের আশা আর মনের জোর দিয়ে সে বারবার চিন্তাটাকে ঠেকিয়ে রেখেছে। ক্যাসাব্লাঙ্কায় সে একবার জেসপকে জিজ্ঞেস করেছিলো, টম বেটারটনের সামনে যখন হাজির হবো, তখন কী ঘটবে?
জেসপ বলেছিলেন, সেটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক মুহূর্ত। তিনি আশা করেন, তার মধ্যেই তাকে রক্ষা করার মতো অবস্থা হয়তো তিনি সৃষ্টি করবেন, কিন্তু সেই আশা করেন, তার মধ্যেই তাকে রক্ষা করার মতো অবস্থা হয়তো তিনি সৃষ্টি করবেন, কিন্তু সেই আশা আশাই রয়ে গেলো। বুঝতে অসুবিধা হলো না হিলারীর, সেই আশা ব্যর্থ হয়ে গেছে।
মিস হেদারিংটন যদি জেসপের পাঠানো গুপ্তচর হয়, তাহলে মিস হেদারিংটনও ম্যারাকেশে এদের কাছে বুদ্ধ বনে ফিরে গেছে। কী-ই বা করতে পারতো।
ভ্রমণার্থীদের দলটা এমন এক জায়গায় এসে পড়েছে যেখান থেকে ফেরার কোনো পথ নেই। হিলারী নিজের জীবন নিয়ে জুয়া খেলছিলো, হেরে গেছে। সে এখন আর কিছুতেই মরতে চায় না। সে মনে মনে ভাবছিলো, আমি আবার বেঁচে উঠবো, সম্পূর্ণ সুস্থ, পুরোপুরি একজন নারী..কিন্তু এখন–ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতো ছটফট করছি আমি, পালাবার মতো একটা পথও যদি ভোলা থাকতো।…
নিজের চিন্তায় মগ্ন থাকলেও আসল সমস্যার কথা মোটেও ভোলেনি। কিন্তু বারবার মনে হয়েছে যখনই তার বেটারটনের সঙ্গে দেখা হবে তখনই সব শেষ হয়ে যাবে…বেটারটন হয়তো বলবে এ তো আমার স্ত্রী নয়–আর একথা বলা মানেই ব্যস। সবকিছুই পরিষ্কার হয়ে যাবে।
বাইরে থেকে আসা ছোট দলটিকে একজন বিশালদেহী পুরুষ অভ্যর্থনা জানালেন। তাকে দেখে দোভাষী মনে হলো কেননা সবার সাথেই তিনি দু-একটা কথা বললেন, তাদেরই ভাষায়। ডাঃ ব্যারনকে দেখে বললেন, ডাক্তার আপনার জ্ঞানের কথা অনেক শুনেছি। আপনাকে আমাদের মধ্যে পেয়ে আমরা কৃতার্থ। তারপরেই হিলারীর দিকে ফিরে বললো, আরে মিসেস বেটারটন! আপনাকে এখানে পেয়ে আমরা ভীষণ আনন্দিত। পথের ধকলে খুব কষ্ট পেয়েছেন? আপনার স্বামী খুব ভালো আছেন আর স্বভাবতই আপনার আসার জন্য উৎকণ্ঠায় প্রহর গুনছেন।
অদ্ভুত হাসি হেসে বললো, আপনিও নিশ্চয়ই তার সঙ্গে দেখা করার জন্য খুবই উদ্বিগ্ন।
মনের অস্থিরতা ক্রমেই বাড়ছে। পাশ থেকে অ্যান্ড্রু পিটার্স তার কাঁধে হাত রেখে যেন সাহস জোগালো। ভদ্রলোককে বললো, আমার মনে হচ্ছে মিসেস বেটারটন যে ক্যাসাব্লাঙ্কায় প্লেন দুর্ঘটনায় পড়ে মাথায় চোট পেয়েছিলেন, সেটা আপনি শোনেননি! অচিরেই স্বামীকে দেখার উত্তেজনাটাও ওঁর পক্ষে বোধহয় ভালো হবে না। আমি বলবো, এই মুহূর্তে একটা অন্ধকার ঘরে গিয়ে ওঁর শুয়ে পড়া উচিত। পিটার্সের গলায় আর হাতের চাপে স্পষ্ট সহানুভূতির ছোঁয়া পেলো হিলারী। মনটা আবারও যেন একটু দুলে উঠলো। এই মুহূর্তে এদের চোখের সামনে–সারাদেহ অবশ করে ধীরে ধীরে ঢলে পড়া কত সহজ..আস্তে আস্তে হাঁটু দুমড়ে পড়বে…অজ্ঞানের ভান করতে পারবে সে।
সাহস ফিরে পেলো হিলারী, পা-দুটোকে সোজা করে দাঁড় করালো, ফ্যাকাসে মুখে তাবার রক্ত চলাচল শুরু হলো, সে নিজেই বেটারটনের কাছে যাবে, আর সে যখন তাকে নিজের স্ত্রী বলে মানতে অস্বীকার করবে তখন সে তার শেষ মিথ্যে কথাটা ছুঁড়ে দেবে–অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে নির্ভয়ে জবাব দেবে সে। না, নিশ্চয়ই আমি আপনার স্ত্রী নই, আপনাকে দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি আপনার স্ত্রী মারা গেছেন। তার মৃত্যুর সময় আমিও সেই হাসপাতালে ছিলাম। আমি তাকে কথা দিয়েছিলাম যে-করেই হোক আমি আপনার কাছে তার শেষ কথাগুলো পৌঁছে দেবো। তাই করছিলাম আমি।
গা-ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো হিলারী। এখন আর পিটার্সের আশ্বাসের প্রয়োজন নেই তার। বললো, না-না, আমি টমের সঙ্গে দেখা করবো। এক্ষুনি তার কাছে আমায় নিয়ে চলুন–প্লিজ–এক্ষুনি।
ভদ্রলোক হিলারীর মনের কথা বুঝে বললেন, নিশ্চয়, নিশ্চয়ই মিসেস বেটারটন, আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি আমি। এই যে মিস জেনসেন এসে গেছেন।
চশমা পরা রোগামতন একটি মেয়ে এসে ওঁদের সঙ্গে যোগ দিল। ভদ্রলোক আমাদের সবার সাথে মেয়েটিকে আলাপ করিয়ে দিলেন। মেয়েটিকে বললেন, আপনি এদের রেজিষ্ট্রি ঘরে নিয়ে যান আমি মিসেস বেটারটনকে নিয়ে ওঁর স্বামীর কাছে পৌঁছে দিয়ে চলে আসবো।
ভদ্রলোকের পিছু পিছু চললো হিলারী। বারান্দার বাঁকের মুখে একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো অ্যান্ড্রু পিটার্স তখনও তাকে লক্ষ্য করছে। হিলারীর মনে হলো, ও হয়তো কিছু একটা সন্দেহ করেছে, হয়তো তার ব্যবহারে এমন কিছু বুঝেছে যাতে কোনো অশুভ চিন্তা করেছে–অথচ কী যে অশুভ চিন্তা তা বুঝতে পারছে না। বাঁকের মুখে অদৃশ্য হবার আগে হিলারী হাত নেড়ে তাকে বিদায় জানালো।
ভদ্রলোক হিলারীকে ডাকলেন, এইদিকে আসুন মিসেস বেটারটন। প্রথম প্রথম এই বাড়িটাকে আপনার গোলকধাঁধার মতো মনে হবে। অজস্র বারান্দা, সবগুলো প্রায় একইরকম।
স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিলো হিলারীর। ঝকঝকে সাদা বারান্দা এখান দিয়ে স্বপ্নের ঘোরে ঘুরে বেড়াও কিন্তু বেরোবার পথ কোনোদিনই খুঁজে পাবে না…। বললো, এটা যে একটা হাসপাতাল আমি ভাবতেও পারিনি।
-না না, বটেই তো, কিছুই বোঝার কথা নয় আপনার, তাই না? গলায় প্রচ্ছন্ন কৌতুক। চোখ ধাঁধিয়ে যায় এখানে। হ্যাঁ, ভালো কথা, আমার নাম ভ্যান হিদেম। পল ভ্যান হিদেম।
–সবকিছুই যেন কেমন এখানে–ভীতিকরও বটে। ওই কুষ্ঠরোগীরা
-হা, ঠিকই বলেছেন, এখানে সবকিছুই যেন ছবির মতো। নতুন কেউ এলে ঘাবড়ে যেতে বাধ্য। কিন্তু এও আপনার অভ্যাস হয়ে যাবে। ভ্যান হিদেম হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, আসুন, এই সিঁড়িটা উঠলেই–উঁহু ব্যস্ত হবেন না। স্থির হোন এই তো পৌঁছে গেছি আমরা।
হ্যাঁ, এই তো পৌঁছে গেছি–পৌঁছে গেছি মৃত্যুর ঠিকানায়…আর মাত্র একটা ধাপ…ওপরে… ওপরে…গভীর…খাড়াই সিঁড়ি…ইউরোপীয় সিঁড়ির চেয়ে অনেক বেশি খাড়াই সিঁড়ি…পৌঁছে, গেছি। আর ওই তো। আরেকটা বারান্দা পেরিয়ে একটা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ভ্যান হিদেম। দরজায় টোকা দিয়ে একটু অপেক্ষা করলো-তারপর দরজা খুলে ফেললো।
-এই যে বেটারটন-শেষ পর্যন্ত সত্যিই আমরা এসে পড়লাম। তোমার স্ত্রী-বলে হিলারীকে ভেতরে যাবার পথ করে দিয়ে একপাশে সরে দাঁড়ালেন ভ্যান হিদেম।
ঘরে ঢুকলো হিলারী। না–ভয় করছে না আর। হাতে-পায়ে খিলও ধরছে না আর। থুতনি উঁচু করে সে এগিয়ে চললো অন্ধকার গহ্বরের দিকে।
অপূর্ব সুন্দর একজন জানালার কাছে ঘাড় ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একনজর পুরুষের রূপে মুহূর্তের জন্য মুগ্ধ গয়ে গেলো হিলারী। কিন্তু টম বেটারটনকে যেমন দেখতে ভেবেছিলো এ যেন তেমন দেখতে নয়। না–অন্তত তাকে যে ছবি দেখানো হয়েছিলো, সেরকম তো নিশ্চয়ই নয় তবে?
এই বিভ্রান্তিকর চমকই তাকে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিলো। এবার সে সর্বশক্তি দিয়ে, সাংঘাতিক কৌশলটাকে কাজে লাগাবে।
হঠাৎ সে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে আবার পিছিয়ে এসে চিৎকার করে বললো, না–এ টম নয়। এ আমার স্বামী নয়…।
অভিনয়টা এমন চমৎকার হয়েছে সে মনে মনে নিজেকে তারিফ করলো।
টম বেটারটন হো হো করে হেসে উঠলো। চমৎকার! চমৎকার-তাই না ভ্যান হিদেম। এত চমৎকার যে আমার নিজের স্ত্রীও আমাকে চিনতে পারছে না। দ্রুত কয়েক-পা এগিয়ে এসে সে হিলারীকে জড়িয়ে ধরে বললো–অলিভ, আমার অলিভ। তুমিও আমাকে চিনতে পারছো না? আমি টম–সত্যিই টম–যদিও আমার মুখটা এখন আর আগের মতো নেই, তবুও সত্যিই আমি টম। আবেগে তার গলা জড়িয়ে এলো। হিলারীকে খুব আদর করতে লাগলো এবং ফিসফিস করে বললো, অভিনয় করে যাও। দোহাই তোমার! সাংঘাতিক বিপদ!
গলার পাশে টমের আঙুলের চাপে বিপদবার্তা শুনতে পেলো হিলারী। যেন তাকে সতর্ক করে দিচ্ছে, অত্যন্ত জরুরী বার্তায় তাকে সাবধান হতে বলছে।
কিছুক্ষণ পরেই টম তাকে ছেড়ে দিলো। একটু পিছিয়ে এসে সোজা তার মুখের দিকে তাকালো। এ আমি–এখনও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না, অলিভ। সত্যিই তুমি এলে? এবার বলল আমাকে চিনতে পারছো তোতা?
কিছু বুঝতে পারছে না হিলারী কিছু বুঝতে পারছে না, কিন্তু তবুও যেন কোন্ অলৌকিক শক্তিবলে সে সত্যিকারের অলিভ বনে গিয়ে বললো-ওঃ টম্! এই ডাকটুকুর মধ্যেই সে যেন মনের সবটুকু আবেগ ঝরিয়ে ফেললো। টম, ওঃ!–কিন্তু তোমার মুখ
অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। ভিয়েনার হার্জ স্বয়ং এখানে আছেন। আরো জানাই তো, তিনি একজন জীবন্ত বিস্ময়! এবার অনেক সহজভাবে আলতো করে সে চুম্বন করলো। তারপর মুখ ঘুরিয়ে ভ্যান হিদেমের দিকে তাকিয়ে বললো, একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম, ক্ষমা করো ভ্যান।
-আরে না না, এ তো খুব স্বাভাবিক।
কত-কত দিন পর, ওঃ। হিলারী বললো, আর আমি একটু যেন টলে উঠলো সে, আমি একটু বসতে পারি!
টম বেটারটন তাড়াতাড়ি তাকে ধরে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলো, আরে ছি ছি, বসো। আমার খেয়ালই ছিলো না। এই কদিনের গাড়ির ধকল আর সেই প্লেন দুর্ঘটনা–খুব কষ্ট গেছে তোমার। ঈশ্বর করুণাময়, তাই তোমাকে ফিরে পেয়েছি।
আচ্ছা–তাহলে সব খবরাখবরই এখানে পৌঁছে গেছে। প্লেন দুর্ঘটনার কথাও এরা জানে। হিলারী বললো, হ্যাঁ, পেন দুর্ঘটনা আমাকে বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দিয়েছে। মাঝে মাঝে অনেক কথা মনে করতে পারি না। সব যেন গুলিয়ে যায় তার ওপর আবার মাথায় যন্ত্রণা। তোমাকে দেখে তাই প্রথমে সম্পূর্ণ অপরিচিত লোক মনে হয়েছিলো, কেমন যেন সব তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিলো। আমাকে নিয়ে তুমি অস্বস্তিতে পড়বে না তো?
তোমাকে নিয়ে অস্বস্তিতে পড়বো? কি বলছো তুমি! কক্ষনো না, তুমি শুধু ব্যাপারটাকে একটু সহজভাবে নেবার চেষ্টা করো তাহলেই হবে।
ভ্যান হিদেম দরজার দিকে এগোলেন। আমি এবার যাই, বেটারটন, একটু পরে তুমি তোমার স্ত্রীকে নিয়ে রেজিষ্ট্রি ঘরে আসতে পারবে তো? এখন কিছুক্ষণ তোমাদের একা থাকা উচিত-দরজাটা টেনে দিয়ে তিনি বেরিলয়ে গেলেন।
সঙ্গে সঙ্গে বেটারটন হিলারীর পাশে হাঁটু গেড়ে বসলো। তার কাঁধে মুখ ডুবিয়ে বলতে লাগলো, সোনা, সোনা আমার
আবার হিলারী তার আঙুলের চাপে বিপদ সংকেত অনুভব করলো। আবার ফিসফিস করে বললো, অভিনয় করে যান। ঘরের মধ্যে কোথাও লুকানো মাইক্রোফোন বা অদৃশ্য চোখ থাকতে পারে।
সত্যিই–থাকাটা স্বাভাবিক। আছে কিনা কে বলতে পারে…। ভয়–অস্বস্তি–অনিশ্চয়তা প্রতি মুহূর্তে বিপদ, ঘরের আবহাওয়ায় এগুলো যেন স্পষ্ট অনুভব করলো হিলারী।
টম বেটারটনও কোলে মাথা রেখে মুখের দিকে তাকালো। তোমাকে দেখতে কী ভালোই না লাগছে। মনে হচ্ছে যেন স্বপ্ন সত্যি নয়। তোমারও কি তাই মনে হচ্ছে?
–হ্যাঁ, ঠিক এই কথাই মনে হচ্ছে। এখানে আসা শেষপর্যন্ত তোমার পাশে। সবটাই যেন স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে আমার। এটাকে সত্যি বলে বিশ্বাসই করতে পারছি না টম। টমের দুকাঁধে আলতো হাত রেখে সে তার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি হাসলো। কে জানে-মাইক্রোফোনের মতো হয়তো অলেক্ষ্য কেউ তাদের লক্ষ্যও করছে।
টম বেটারটনের দিকে তাকিয়ে সে স্বস্তি বোধ করলো। তিরিশের ওপর বয়স–অপূর্ব সুন্দর চেহারার মানুষটার মধ্যে কেমন যেন একটা বোকা বোকা ভীতচকিত ভাব।
প্রথম বাধাটা সে অতিক্রম করেছে নিজের অভিনয় ক্ষমতায় অদ্ভুত আনন্দে ভরে উঠলো হিলারীর বুক। হ্যাঁ, তাকে অলিভ বেটারটন হতেই হবে। অলিভের মতো চিন্তা করলে, অলিভের মতো কাজ করলে তবেই না অলিভ বেটারটন হতে পারবে।
তুমি–এখানে সুখে আছো তো? কোনো অসুবিধে হচ্ছে না? চিরন্তনী নারীর অত্যন্ত স্বাভাবিক প্রশ্ন।
চমৎকার আছি। ভীতসন্ত্রস্ত, অসুখী মুখটাকে আড়াল করে টম বেটারটন মুখে দৃঢ় হাসির রেখা ফোঁটালো। সবরকমের সুবিধে রয়েছে এখানে। একটা পয়সাও খরচ করতে হবে না। নিজের কাজে ডুবে থাকার আদর্শ পরিবেশ। আর এই প্রতিষ্ঠান? অবিশ্বাস্য!
-হ্যাঁ, সে বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই, যেভাবে আমাকে আনা হয়েছে–আচ্ছা, তুমিও কি ওই পথেই এসেছ?
–তা তো জানি না, আমাকে কেউ বলেনি।
–কিন্তু ওই কুষ্ঠরোগী? এটা কি সত্যিই একটা কুষ্ঠোরোগীদের আশ্রম?
–হ্যাঁ, একদল ডাক্তার এদের নিয়ে মূল্যবান গবেষণা চালাচ্ছেন এখানে। কিন্তু ওদিকটা সম্পূর্ণ আলাদা। আসলে এটা একটা সুচতুর আবরণ–বাইরে থেকে যাতে কেউ এখানকার কাজকর্ম সম্বন্ধে একটুকুও সন্দেহ করতে না পারে।
–ও! ঘরের চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো হিলারী। এটাই কি আমাদের বাসস্থান?
-হ্যাঁ, এটা বসবার ঘর। ওদিকে স্নানঘর আর ওপাশে শোবার ঘর। এসো তোমাকে দেখাই ঘরখানা। একপাশে দুটো বড় খাট, তার পাশেই বইয়ের আলমারি। ওপাশে পোশাক রাখার দেওয়াল-আলমারি। একটা ড্রেসিং টেবিল। পোশাকের আলমারিটা খুলে তার বিশাল গহ্বরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো হিলারী। এতে কি রাখবো তাই ভেবে পাচ্ছি না। জামাকাপড় বলতে তো এই যা পরে আছি, তাই সব।
সেজন্য ভেবো না, যেমন খুশি পোশাকে ভরিয়ে ফেলতে পারো আলমারি। এখানে বিরাট একটা সাজসজ্জার বিভাগ আছে। জামাকাপড়, প্রসাধনসামগ্রী, সবকিছু পাবে সেখানে। দামীদামী জিনিষ সব। এখানকার এই সংস্থা সম্পূর্ণ আত্মনির্ভরশীল। যা কিছু প্রয়োজন সব পাবে এখানে –কোনোদিনের জন্য একবারও বাইরে যাবার দরকার হবে না। টম বেটারটন খুব সহজভাবে বললেও হিলারী কথাটাকে এত সহজভাবে নিলো না।
কোনোদিনের জন্য বাইরে যাবার দরকার হবে না, আসলে কোনোদিনও বাইরে যাবার উপায় নেই। তোমরা যারা ভেতরে এসেছ ফেরার আশা ত্যাগ করো। শুধু কি এরই জন্য এত গুণী জ্ঞানী লোকগুলো তাদের দেশ, ঘর, সংসার সব ছেড়ে চলে এসেছে। ভেবে কূল পেলো না হিলারী! এই যে ডাঃ ব্যারন, অ্যান্ড্রু পিটার্স, স্বপ্নিল মুখ এরিকসন, হেলগা নীডহেইম এরা কি জানে কী জন্য তারা এখানে এসেছে? ওরা কি সন্তুষ্ট হবে এসব দেখে? এটাই কি ওরা চেয়েছিলো?
মনে মনে সে ভাবলোনা, বেশি প্রশ্ন না করাই ভালো…হয়তো কেউ অলক্ষে তাদের কথাবার্তা শুনছে!
সত্যিই কি কেউ শুনছে? সত্যিই কি কেউ ওদের ওপর কড়া নজর রাখছে?
টম বেটারটন বললো, তুমি কি বিশ্রাম নিতে চাও?
–না, মানে, হিলারী বললো, তার দরকার নেই।
–তাহলে বরং চলো, রেজিস্ট্রি ঘর থেকে ঘুরে আসি।
–রেজিস্ট্রি ঘর কি জিনিষ?
–এখানে যারা আসে তাদের প্রত্যেককেই এই রেজিস্ট্রি ঘর হয়ে আসতে হয়। ওরা তোমার সবকিছু ওখানে নথিভুক্ত করে রাখবে।
-ও বাবা! এ যে মিলিটারি আদব-কায়দা–নাকি ডাক্তারি ব্যাপার?
–দুই-ই–টম বেটারটন বললো।
হিলারী বললো, লোকমুখে তাই শোনা যায় বটে; মানে আমি বলতে চাইছি, লৌহ যবনিকার অন্তরালে সত্যিই সবকিছু একেবারে ছক বেঁধে পাকাঁপোক্ত ভাবে তৈরি। কে বলতে পারে, হয়তো অলিভ বেটারটনের কিছুটা সহানুভূতি ছিলো এই দল সম্পর্কে; যদিও সে এই দলের সদস্য নয় বলেই জানা গেছে।
বেটারটন বললো, এখানে অনেক কিছু জানার আছে তোমার। এখুনি সবকিছু জানার চেষ্টা না করাই ভালো। কানের কাছে বেটারটন হিলারীকে ফিসফিস করে বললো, এসব আলোচনা করো না, তারপর গলা চড়িয়ে বললো, এবার তাহলে চলো, রেজিস্ট্রি ঘর থেকে ঘুরে আসি।
.
১২.
রেজেস্ট্রি ঘরের অধ্যক্ষ একজন মহিলা। দেখে বেশ কড়া স্কুল মাস্টারনী মনে হয়। চুলগুলো গুটিয়ে মাথার পেছনে খোঁপা করা। নাকের ওপর একটা চশমা। বেটারটনকে ঘরে ঢুকতেই বললেন, মিসেস বেটারটনকে একেবারে সঙ্গে নিয়ে এলেন? তা ভালোই করেছেন।
বিশুদ্ধ ইংরেজি উচ্চারণ, কিন্তু তবুও যেন হিলারীর মনে হলো উনি ইংরেজ নন। সত্যিই উনি সুইজারল্যান্ডের মেয়ে। ভদ্রমহিলা হিলারীকে বসতে ইঙ্গিত করে, কতকগুলো কাগজে কী সব লিখতে লাগলেন। টম বেটারটন উসখুস করে বললো, তাহলে অলিভ–আমি এখন যাই।
–কিছু যদি না মনে করেন, সেটাই ভালো হবে, মিঃ বেটারটন, ভদ্রমহিলা বললেন।
দরজাটা টেনে নিয়ে টম বেটারটন বেরিলয়ে গেলো। ভদ্রমহিলা যন্ত্রের মতো ঘাড় হেঁট করে লিখেই চললেন। লেখা শেষ করে বললেন–বেশ, এবার বলুন, আপনার পুরো নাম, বয়েস, কোথায় জন্ম, বাবা, মায়ের নাম, বড় রকমের কোনো অসুখ আছে কিনা, রুচি, শখ, কোথাও চাকুরি করে থাকলে তার বর্ণনা, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো উপাধি আছে কিনা। খাদ্য এবং পানীয়ের মধ্যে কোন্ কোন জিনিষ পছন্দ।
হাজারো প্রশ্ন। হিলারী ভাসাভাসা জবাব দিয়ে চললো। জেসপের কাছ থেকে শিক্ষাগুলো সযত্নে কাজে লাগাতে পেরে খুশি হলো হিলারী।
ভদ্রমহিলা কাগজে লিখে মাথা তুললেন। বেশ, এই দপ্তরের সব কাজ মিটলো মনে হচ্ছে। এবার আপনাকে ডাক্তার স্কুয়াংজের কাছে যেতে হবে–শারীরিক পরীক্ষার জন্য।
হিলারী বললো, সত্যিই এসবের দরকার আছে? কেমন যেন অদ্ভুত মনে হচ্ছে আমার।
সবকিছু খুঁটিয়ে যাচাই করাই আমাদের পছন্দ, মিসেস বেটারটন। সবকিছু পাকাপাকি নথিভুক্ত করাই অভ্যাস আমাদের। চলুন–ডাক্তার স্কুয়ার্জকে আপনার বেশ ভালোই লাগবে। ওখান থেকে ডাঃ রুবেকের কাছে চলে যাবেন।
ডাঃ স্কুয়ার্জও একজন মহিলা। চেহারা এবং ব্যবহার দুই-ই চমৎকার। হিলারীর স্বাস্থ্য খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে বললেন, ঠিক আছে। এবার ডাঃ রুবেকের কাছে চলুন।
–ডাঃ রুবেক কে? হিলারী জিজ্ঞেস করলো। আরেকজন ডাক্তার?
–ডাঃ রুবেক মনোবিজ্ঞানী।
–মনোবিজ্ঞানীতে আমার কাজ নেই। মনোবিদদের একটুও ভালো লাগে না আমার।
আহা-হা, এখুনি অত ঘাবড়াবেন না, মিসেস বেটারটন। আপনাকে তো এখুনি চিকিৎসার জন্য পাঠানো হচ্ছে না। শুধু কটা বুদ্ধির প্রশ্ন করবেন উনি আর তার থেকেই আপনার ব্যক্তিত্বের শ্রেণীবিভাগ করে নেবেন ব্যস।
ডাঃ রুবেকও সুইজ্যারল্যান্ডের লোক। বেশ লম্বা, আমুদে মানুষ। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। হিলারীকে অভ্যর্থনা জানিয়ে, ডাঃ স্কুয়াংজের হাত থেকে মিসেস বেটারটন সংক্রান্ত কাগজপত্রগুলো নিয়ে চোখ বোলালেন। বললেন, আপনার শরীর বেশ সুস্থ দেখে আনন্দিত হলাম। আচ্ছা আপনি তো সম্প্রতি প্লেন দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন, তাই না?
-হ্যাঁ, হিলারী বললো, ক্যাসাব্লাঙ্কায়–চার-পাঁচদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিলো।
মাত্র চার-পাঁচদিন। না-না, এ ঠিক করেননি। আরও বেশ কিছুদিন থাকা উচিত ছিলো আপনার।
–আর বেশিদিন থাকতে চাইনি আমি। এখানে আমার স্বামীর কাছে পৌঁছবার জন্য খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম।
– অবশ্য ঠিক। মাথায় অমন চোট লাগলে যথেষ্ট বিশ্রামের প্রয়োজন। মাথার যন্ত্রণা হয়।
-হ্যাঁ। আর তাছাড়া মাঝে মাঝে সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যায় অনেক কথাই যেন মনে করতে পারি না।
ডাঃ রুবেক বললেন, খুব স্বাভাবিক, এ নিয়ে চিন্তা করবেন না। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন আপনার মানসিকতা পরীক্ষা করার জন্য আমি কটা প্রশ্ন করবো-অনুষঙ্গ পরীক্ষা
হিলারী মনে মনে একটু দুর্বল হয়ে পড়লো, কিন্তু ভালোয় ভালোয় সব শেষ হলো। সাধারণ ছকবাঁধা পরীক্ষা-প্রশ্ন আর উত্তর।
ডাঃ রুবেক বলতে লাগলেন, মানবিক অনুভূতির প্রশ্নে একজন প্রথম শ্রেণীর টেনিস খেলোয়াড় বা মঞ্চের একজন প্রধানা গায়িকা বা একজন আণবি পদার্থবিজ্ঞানীর মধ্যে তফাত সামান্যই।
-আপনার কথাই বোধহয় ঠিক। সে যে একজন বিজ্ঞানীর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে কাটিয়েছে একথা প্রমাণ করার জন্য হিলারী বললো। এরা অদ্ভুত মেজাজী মাঝে মাঝে মনে হয়, এরা যেন ঠিক মানুষ নয় এরা অন্য কিছু।
–আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না, কী ধরনের মানসিক ঝড় চলছে এখানে। ঝগড়াঝাটি, হিংসে আর মান-অভিমান! কিন্তু আপনি মাদাম সংখ্যালঘুদের দলে। মানে আমার মনের কথা যদি বলতে পারেন তবে আপনি ভাগ্যবানদের দলে।
-আপনার কথা কিছু বুঝতে পারলাম না। সংখ্যালঘু বলতে?
এখানে খুব বেশি কারো স্ত্রী নেই। খুব অল্প কয়েকজন স্ত্রীকেই আসার অনুমতি দেওয়া হয়। স্বামী আর তাদের সহকর্মীদের বুদ্ধির ঝড়ে এদের গায়ে এতটুকুও আঁচ লাগে না। দিব্যি ঘুরে ফিরে বেড়ান
স্ত্রীরা তাহলে কী করে এখানে, হিলারী জিজ্ঞেস করলো।
–এখানে নানারকম খেলাধূলা, আনন্দ উৎসব আর শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপক সুযোগসুবিধে আছে। আশা করি এখানকার জীবনযাত্রায় সুখেই থাকবেন আপনি।
আপনার মতো?
এ প্রশ্ন করা উচিত হলো কিনা কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করলো হিলারী। ডাঃ রুবেককে দেখে কিন্তু মনে হলো বেশ মজাই পেয়েছেন। বললেন, হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন, শেষপর্যন্ত এখানকার জীবন শান্তিপূর্ণ এবং আনন্দময় হয়ে উঠবে বলেই আমার বিশ্বাস।
যাক এরপর আমাকে কার কাছে যেতে হবে? হিলারী উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো।
মাদমোয়াজেল লা রোজ আপনাকে পোশাক বিভাগে নিয়ে যাবেন। জায়গাটা যে খুব পছন্দ হবে আপনার সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
.
লা রোজ প্যারিসে থাকত, এক দর্জির দোকানে পোশাক বিক্রি করতো। চমৎকার মেয়েলী আপ্যায়নে অভিভূত করলো হিলারীকে। আজ আপনি খুব ক্লান্ত, সেইজন্যই আমি বলি কি, আপনি শুধু কয়েকটা একান্ত প্রয়োজনীয় পোশাক বেছে নিন এখন। পরে সময়মতো ভালো করে দেখেশুনে বাকি পোশাকগুলো নিয়ে যাবেন।
মিষ্টি হেসে চটপট মাপজোক নিয়ে হিলারীকে একটা বিরাট দেওয়াল আলমারির সামনে নিয়ে এসে কয়েকটা প্রয়োজনীয় পোশাক বেছে নেবার পর হিলারীকে প্রসাধনবিভাগে নিয়ে গেলো লা রোজ। টুকিটাকি কয়েকটা পাউডার, লিপস্টিক আর ক্রিম বেছে নিলো হিলারী। সমস্ত জিনিষ গুছিয়ে একটা স্থানীয় মেয়ের হাত দিয়ে হিলারীর ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। সবকিছু যেন কেমন একের পর এক স্বপ্নের মতো মনে হতে লাগলো হিলারীর।
আশাকরি শীঘ্রই আপনার সাথে দেখা হবে। লা রোজ খুশিতে বললেন।
মিস জেনসেনকে আসতে দেখা গেলো, এখানে আসার পরই যাকে দেখা গিয়েছিলো, তাকে আসতে দেখা গেলো। ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলো, আপনার এখানে কাজ শেষ হয়েছে তো মিসেস বেটারটন?
-হা ধন্যবাদ।
–তাহলে আসুন, সহকারী পরিচালকের সঙ্গে দেখা করে আসবেন।
–সহকারী পরিচালক কে? হিলারী জিজ্ঞেস করলো।
–ডক্টর নিয়েলসন।
এখানে প্রত্যেকটি লোকই কি কোনো-না-কোনো বিষয়ের ডক্টরেট!–হিলারী ভাবলো, মুখে বললো, ঠিক কোন বিষয়ের ডক্টর উনি? চিকিৎশাস্ত্রের, বিজ্ঞানের না কোন্ বিষয়ের?
উনি চিকিৎসাশাস্ত্রের ডক্টর মিসেস বেটারটন। উনিই এখানকার প্রশাসনিক অধিকর্তা। যে কোনো রকমের অভিযোগ করতে হলে ওঁর কাছে যেতে হবে। দলের প্রশাসনিক দায়িত্বও ওঁর হাতে। নতুন কেউ এলে প্রত্যেকের সাথে উনি দেখা করেন। তারপর আর এঁকে-কোনোদিন দেখতে পাবেন না, যদি না গুরুতর কিছু ঘটে।
ও আচ্ছা! গলায় শ্রদ্ধা ফোঁটালো হিলারী।
মিস জেনসেন হিলারীকে নিয়ে ভেতরের ঘরে ঢুকলো। বিশাল ডেস্কের ওপাশ থেকে ডাঃ নিয়েলসন উঠে দাঁড়ালেন। বিশাল দেহ, ধবধবে ফর্সা ভদ্রলোক, হাবভাব অনেকটা গ্রাম্য লোকের মতো।
এগিয়ে এসে করমর্দন করে বললেন, এই তো হা, আপনিই তো মিসেস বেটারটন? আপনাকে আমাদের মধ্যে পেয়ে খুব আনন্দ পেলাম মিসেস বেটারটন। আপনার স্বামী আপনার জন্য দারুণ উৎকণ্ঠায় ছিলেন। এবার এসে পড়েছেন, গুছিয়ে গাছিয়ে নিন।
ধন্যবাদ, ডাঃ নিয়েলসন, হিলারী একটা চেয়ার টেনে বসলো।
ডাঃ নিয়েলসনও তাঁর চেয়ারে বসে একটু ঝুঁকে এলেন। আমাকে কোনো প্রশ্ন করার আছে আপনার? সৌহার্দ্যপূর্ণ প্রশ্ন।
হিলারী হেসে বললো, এটার উত্তর দেওয়াই সবচেয়ে কঠিন। অবশ্য ঠিক উত্তর যদি চান বলবো–এত অজস্ব প্রশ্ন করার রয়েছে যে, কোষ্টা দিয়ে শুরু করবো সেটাই বুঝতে পারছি না।
ঠিক ঠিক, বুঝতে পারছি আমি। আমার উপদেশ যদি শোনেন তাহলে বলবো–স্রেফ নিজের খেয়ালে থাকুন আর যা ঘটছে দেখে যান। এটাই সবচেয়ে ভালো পথ।
এখানকার সম্পর্কে কিছুই জানি না আমি। মাঝে মাঝে মনে হয়–মনে হয় যেন অবাস্তব কিছু
বেশিরভাগ লোকই তাই ভাবে। সাধারণত এখানে আসার আগে একজন হয়তো ভাবে তাকে মস্কোয় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। হো হো করে হেসে উঠলেন তিনি। আমাদের এই মরুগৃহ যে-কোনো লোককেই চমকে দেবে।
-আমার কাছে তো এটা একটা দারুণ চমক।
-হতেই পারে, কারণ আগে থেকে কাউকে আমরা কিছু জানাই না। বুঝতেই পারছেন, খোলাখুলি সবকিছু বলে দেওয়া বিচক্ষণতার পরিচায়ক নয়। আসল প্রয়োজন শুধু নির্দেশের। সেইটুকু আমরা শুধু দিয়ে দিই। এখানে কিন্তু আপনি বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই থাকতে পারবেন, যা কিছু আপনার অপছন্দ হবে কিংবা বিশেষ কোনো জিনিষের যদি প্রয়োজন হয়–শুধু একবার আমাদের জানাবেন, আমরা তার ব্যবস্থা করার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। যেমন ধরুন যদি আপনি শিল্পচর্চা, ছবি আঁকা এগুলোর প্রয়োজন মনে করেন তবে সবকিছুরই আলাদা আলাদা বিভাগ আছে আমাদের।
-না না, আমি ওসব বিষয়ে মোটেই পারদর্শী নয়।
–বেশ, এছাড়াও সামাজিক জীবনযাপনের অনেক উপায় রয়েছে। খেলাধুলা নিশ্চয়ই জানেন। এখানে টেনিস কোর্ট, স্কোয়াস কোর্ট সবই রয়েছে। এখানে আসার পর নিজের রাস্তা খুঁজে নিতে কারো দুসপ্তাহ লাগে না বিশেষত স্ত্রীদের। আপনার স্বামীর কাজ রয়েছে, তাই নিয়েই তিনি ব্যস্ত। সুতরাং এক্ষেত্রে অন্যান্য স্ত্রীরা নিজেদের সময় কাটাবার রাস্তা নিজেরাই খুঁজে নেন। আমার কথা বুঝতে পেরেছেন আশাকরি।
-কিন্তু এখানে কি কেউ থাকে?
–এখানে থাকে মানে। আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না, মিসেস বেটারটন।
থাকে মানে–আমি বলতে চাইছি, সবাই কি এখানেই থাকে, নাকি অন্য কোথাও চলে যায়?
ডাঃ নিয়েলসন কেমন যেন উদাস হয়ে গেলেন। বললেন, হুঁ, সেটা নির্ভর করছে আপনার স্বামীর ওপর। হ্যাঁ, এটা অনেকখানি নির্ভর করে তার ওপর। আমি বরং আপনাকে পরামর্শ দিচ্ছি তিন সপ্তাহ পরে আমার সঙ্গে একবার দেখা করে বলে যাবেন–এখানে কেমন লাগছে?
-আচ্ছা এখান থেকে কেউ কোনোদিন বাইরে যেতে পারে? মানে এই চার দেওয়ালের বাইরে?
খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন। এখানে এসে প্রায় সবাই এই প্রশ্নই করে। কিন্তু আমাদের এই প্রতিষ্ঠান নিজেই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ জগৎ। এইটাই হচ্ছে আপনার পুরোনো জগৎ যাকে আপনি ফেলে এসেছেন। হ্যাঁ এটা একটা পার্থিব স্বর্গ।
.
১৩.
ঠিক যেন একটা স্কুলের মতো, তাই না? হিলারী বললো, নিজের ঘরে সে আবার ফিরে এসেছে। তার পছন্দ করা জামাকাপড় আর প্রসাধন সামগ্রীগুলো ইতিমধ্যেই বিছানার ওপর, তার অপেক্ষায়। আলমারির মধ্যে জামাকাপড়গুলো ঝুলিয়ে, অন্য জিনিষগুলো সে গুছিয়ে রাখলো।
–আমারও প্রথম প্রথম ঠিক এই কথাই মনে হতো, বেটারটন বললো।
দুজনের কথাবার্তা কেমন যেন ছাড়া ছাড়া ক্লান্তিমাখা। লুকোনো একটা মাইক্রোফোনের সম্ভাবনা তখনও বোঝার মতো তাদের মনে চেপে রয়েছে। কেমন যেন রহস্য ভরা কথা বলছিলো বেটারটন। দেখতেই পাচ্ছো–বেশ আছি, আমি। মাঝে মাঝে মনে হয় স্বপ্ন দেখছি আমি। কিন্তু…
কথাটা সে শেষ করলো না। হিলারী কিন্তু তার না বলা কথাটা বুঝতে পারলো,–কিন্তু আমাদের আরও সাবধান হওয়া উচিত। সমস্ত জিনিষটাই যেন এক অবাস্তব দুঃস্বপ্ন, তাই মনে হচ্ছিলো, হিলারীর। সে এক সম্পূর্ণ অচেনা লোকের সঙ্গে একই শয়নঘরে বাস করছে। কিন্তু তবুও অনিশ্চিত কোনোও বিপদের তীব্র তানভূতির ফলে এই অন্তরঙ্গতাটুকুকে দুজনের কেউই যেন এতটুকুও অশালীন মনে করতে পারেনি।
মিনিট দুয়েকের অস্বস্তিকর স্তব্ধতা ভেঙে, গলাটাকে একেবারে খাদে নামিয়ে বেটারটন বললো, অভ্যস্থ হয়ে নিতে একটু সময় লাগবে, কিন্তু আমাদের খুব স্বাভাবিক ব্যবহার করতে হবে। অত্যন্ত সাধারণ স্বাভাবিক ব্যবহার–যেন এখনও আমরা আমাদের দেশের বাড়িতেই রয়েছি।
কথাগুলোর গভীর তাৎপর্য উপলব্ধি করলো হিলারী। সে ধরেই নিলো, যে অনিশ্চয়তাটুকু অনড় হয়ে রয়েছে তা আরও কিছুক্ষণ থাকবে। বেটারটনের ইংল্যান্ড ত্যাগের কারণ, তার আশা, তার স্বপ্নভঙ্গ এই সমস্ত এই মুহূর্তে আলোচনার প্রয়োজন নেই। এই মুহূর্তে তারা দুজন মাথার ওপর যে অনিশ্চয়তার খঙ্গ ঝুলছে সেই বিপদের বিরুদ্ধে লড়াই করার একই ব্রতে ব্রতী। হিলারী বললো, আমাকে নিয়ে গিয়ে ওরা কত কাণ্ডই না করলো। শারীরিক, মানসিক সব পরীক্ষাই হয়ে গেলো।
–হু, সবার বেলাই এগুলো করা হয়। এটাই স্বাভাবিক বলে মনে হয়।
তোমার বেলাও এসব হয়েছিলো?
–হ্যাঁ, তা প্রায় সবই হয়েছিলো।
তারপর আমাকে দেখা করতে নিয়ে গেলো ওই যে সহকারী পরিচালক না কী বলে যেন, তার সঙ্গে।
হ্যাঁ, উনিই এই অঞ্চলটা পরিচালনা করেন। অত্যন্ত যোগ্য ব্যক্তি এবং সত্যিকারের ভালো প্রশাসক একজন।
-উনি তাহলে সংস্থার কর্তা নন?
–নানা সংস্থার মাথা হচ্ছেন খোদ পরিচালক নিজে।
–আমি তাকে দেখতে পাবো?
আশাকরি পাবে। তবে তিনি বড় একটা দেখা দেন না। মাঝে মাঝে এসে আমাদের সামনে বক্তৃতা করেন–চমৎকার ব্যক্তিত্বপূর্ণ মানুষ।
বেটারটনের ভুরুর উপর ক্ষীণ একটা ভাজ পড়লো। হিলারীর বুঝতে অসুবিধে হলো না এ আলোচনা এখন বন্ধ করা উচিত, এ তারই ইঙ্গিত। বেটারটন ঘড়ি দেখে বললো, আটটায় নৈশভোজ। আটটা থেকে সাড়ে আটটা। তুমি তৈরি হলে, চলো নিচে নামি। এমনভাবে বললো, হিলারীর মনে হলো ঠিক যেন তারা কোনো একটা হোটেলে রয়েছে।
হিলারী তৈরি হয়ে নিচে নেমে, লম্বা বারান্দা পেরিয়ে বিরাট খাবার ঘরে ঢুকতেই মিস জেনসেন এগিয়ে এলো। আজ তোমাদের জন্য একটা বড় টেবিলের ব্যবস্থা করেছি টম, বেটারটনকে বললো সে। তোমার স্ত্রীর সহযাত্রী তোমাদের সঙ্গে বসবেন, আর–মার্চিসনরা তো আছেই।
নির্দিষ্ট টেবিলে তারা বসলো। অ্যান্ড্রু পিটার্স আর এরিকসন আগে থেকেই তাদের টেবিলে বসেছিলো। হিলারী তার স্বামীর সঙ্গে দুজনের পরিচয় করিয়ে দিলো। একটু পরেই বাকি দুজন এসে পড়লো। বেটারটন পরিচয় করিয়ে দিলো, ডক্টর এবং মিসেস মার্চিসন। সাইমন আর আমি একই গবেষণা ঘরে কাজ করি, বুঝলে
সাইমন মার্চিসনের বয়স বেশি নয়। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের রোগা যুবকটি এত ফর্সা, মনে হয় রক্তহীনতায় ভুগছে। তার স্ত্রী মোটাসোটা কালো। হিলারীর মনে হলো ভদ্রমহিলা ইতালিয়ান। নাম বিয়াঙ্কা। বিয়াঙ্কা বললো, কালকে আপনাকে জায়গাটা ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেবো। আপনি তো বিজ্ঞানবিশারদ নন, তাই না?
-না, বিজ্ঞানের কোনো বিশেষ শিক্ষা আমি পাইনি বলেই আমার আশঙ্কা, হিলারী হাসলো।
বিয়াঙ্কার কিছু আইনসম্পর্কিত শিক্ষা আছে, সাইমন জানালো। অর্থনীতি আর বাণিজ্যিক আইন নিয়ে ও পড়াশুনা করেছে। মাঝেমধ্যে ও বক্তৃতা দেয়। কিন্তু বড় একটা কেউ মন দিয়ে শোনে না।
বিয়াঙ্কা কাঁধ ঝাঁকালো। ওসব আমি ঠিক করে নেবো। আমি তো এখানে এসেছিলাম শুধু তোমার সঙ্গে থাকব বলে। কিন্তু এখানে দেখছি অনেক কিছুই করার আছে। আর মিসেস বেটারটন, উনিও হয়তো একাজে আমাকে সাহায্য করতে পারবেন।
হিলারী এককথাতেই রাজি হয়ে গেলো।
অ্যান্ড্রু পিটার্স জিজ্ঞাসা করলো, আপনার গবেষণার বিষয় কোন্টা? পুরুষ তিনজনের আলোচনা হিলারী কিছুই বুঝতে পারছিলো না। এরিকসনের দিকে ফিরে দেখলো, চেয়ারে গা এলিয়ে উদাস চোখে সে তাকিয়ে রয়েছে। হেসে সে জিজ্ঞেস করলো, কি হলো, আপনারও কি ঘরকুনো কচি ছেলের মতো বাড়ির জন্য মন কেমন করছে নাকি?
যেন অনেক দূর থেকে দৃষ্টিটা ফিরিয়ে এনে এরিকসন তার দিকে তাকালো। বললো, না ঘরের প্রয়োজন নেই। এইসব-স্নেহের বন্ধন, বাবা, মা, ছেলেপুলে–এসব হচ্ছে বিরাট বাধা। কাজ করতে হলে সম্পূর্ণ মুক্ত পুরুষ হতে হবে।
-এখানে আপনি সেই মুক্তি পাবেন, মনে করছেন?
–এখুনি তা বলতে পারবো না, কিন্তু তাই আশা করছি।
বিয়াঙ্কা হিলারীকে বললো নৈশভোজের পর সময় কাটাবার জন্য অনেক রকমের ব্যবস্থা আছে এখানে। তাস খেলার ঘরে গিয়ে ব্রিজ খেলতে পারেন বা সিনেমা দেখতে পারেন, কিংবা সপ্তায় তিনদিন করে যে নাটক হয় তাও দেখতে পারেন।
এরিকসন বিরক্তিভরে ভুরু কোচকালো। এসব একেবারেই অপ্রয়োজনীয় জিনিষ। এতে কর্মশক্তির অপচয় হয়।
–আমাদের মানে মেয়েদের ক্ষেত্রে নয়, বিয়াঙ্কা জবাব দিলো। মেয়েদের ক্ষেত্রে এগুলো প্রয়োজনীয় জিনিষ।
হিলারী চেষ্টা করে একটা হাই তুললো। বললো, একটু সকাল সকাল শুয়ে পড়বো ভাবছি। আজ আর তাস খেলতে বা সিনেমা দেখতে ইচ্ছে করছে না।
তার কথাটা লুফে নিয়ে টম বেটারটন তাড়াতাড়ি বলে উঠলো, আজ সকাল সকাল শুয়ে পড়ে একটা লম্বা ঘুম দিয়ে শরীরটা ঠিক করে নেওয়াই সবচেয়ে ভালো। রাস্তায় তো কম ধকল যায়নি
খাওয়া শেষ করে সবাই উঠে পড়লো। বেটারটন বললো, রাত্রের খাওয়াটা এখানে সত্যিই চমৎকার। রাত্রে পড়ার ঘরে ঢোকার আগে বা সিনেমা ক্লাবে যাওয়ার আগে সাধারণ আমরা ছাদের বাগানে একটু পায়চারি করে নিই। প্রথমে একটু বাগান থেকে ঘুরে আসি চলো তারপর বরং তুমি ঘুমোতে যেও।
লিফটে চড়ে ওরা ছাতে উঠলো। ওপরে উঠে বাগানের আশাতীত শোভায় হিলারীর চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। একি সম্ভব! কত অজস্র অর্থ ব্যয় হয়েছে বাগানটা গড়তে, চিন্তাও করতে পারলো না সে। ঠিক যেন সেই আরব্য উপন্যাসের পরীর দেশ।
–এ যেন বিশ্বাসই করা যায় না, বললো হিলারী। এই দিগন্তবিস্তারী মরুভূমির মাঝখানে–এ যেন সেই আরব্য উপন্যাসের পরীর দেশ।
মার্চিসন বললো, আমিও আপনার সাথে একমত মিসেস বেটারটন, দেখলে মনে হয় সত্যিই যেন যাদুমন্ত্রে কেউ জীনকে দিয়ে একটা গড়িয়ে নিয়েছে। অবশ্য–আমার ধারণা, টাকা এবং জল এ দুটো জিনিষ প্রচুর পরিমাণে থাকলে, মরুভূমির বুকেও যা খুশি গড়ে তুলতে পারবেন।
এই এত জল কোথা থেকে আসে?
ওই পাহাড়ের তলায় গভীর প্রস্রবণ খোঁড়া হয়েছে।ওটা আমাদের এই সংস্থার প্রাণ।
ছাদবাগানের এখানে-ওখানে কিছু লোক ছড়িয়ে রয়েছে। ক্রমে ক্রমে তারা এদিক-ওদিক চলে গেলো। মার্চিসনরাও ব্যালে দেখতে যাবে বলে বিদায় নিলো। হিলারীর হাত ধরে বেটারটন তাকে আলসের ধারে একটা ফাঁকা জায়গায় নিয়ে এলো।
মাথার ওপর অজস্র তারা জ্বলজ্বল করছে। মৃদু শীতল বাতাসে শরীর জুড়িয়ে গেলো। দুজনে এখন সম্পূর্ণ একা। দুজন দুজনের মুখোমুখি দাঁড়ালো। একটু যেন সন্ত্রস্ত নিচু গলায় টম বেটারটন জিজ্ঞেস করলো, এবার বলুন, কে আপনি?
হিলারী তার চোখে চোখ রেখে একটু নীরব হয়ে ওর প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে জিজ্ঞেস করলো, আগে আপনি বলুন, কেন আমাকে আপনার স্ত্রী বলে স্বীকার করে নিয়েছিলেন?
দুজনেই দুজনের দিকে তাকাচ্ছে। হিলারী জানে ইংল্যান্ড থাকতে টম বেটারটনের যত শক্তিই থাক-না-কেন এখানে এই অবস্থায় তার মনের জোর হিলারীর চেয়ে অনেক দুর্বল।
অবশেষে টম বেটারটন হার মানলো। সে নিজের মনে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো, তখন মানে সেই মুহূর্তে যেন আমার এটাই সঠিক মনে হয়েছিল। হয়তো ভীষণ বোকামি করেছি আমি, আমার যেন একবার আশা হয়েছিলো, আমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাবার জন্য আপনাকে এখানে পাঠানো হয়েছে।
–তাহলে আপনি এখান থেকে বের হতে চান?
–হায় ভগবান, আপনি একথা জিজ্ঞেস করতে পারলেন?
–প্যারিস থেকে আপনি কিভাবে এখানে এলেন?
টম বেটারটন একটু হাসলো। আমাকে কেউ জোর করে এখানে আনেনি–অবশ্য জানি না, এই কথাই আপনি জানতে চাইছেন কিনা। আমি এসেছি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়।
–আপনি যে এখানেই আসছেন, সেটা আগে থেকেই জানতেন?
-না, আমি যে আফ্রিকায় আসছি সে সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিলো না আমার। অত্যন্ত সহজ স্বাভাবিক প্রলোভনেই আমি ভুলেছিলাম। আপনার সঙ্গে এলো, ঐ যে পিটার্স, ও বেচারাও ঠিক আমার মতোই ভুল করেছে।
–আর এখানে এসে দেখলেন যা ভেবেছিলেন, তা নয়?
আবার একটু হাসল টম। নিজের চোখেই দেখবেন। ঠিক যেমনটি হওয়া উচিত ছিল তা যেন নয়। এ–একে স্বাধীনতা বলে না।
হিলারীর পাশে বসে সে বলল, ইংল্যান্ডে থাকতে যে জ্বালায় ছটফট করতাম, এখানেও তাই। সবসময় মনে হচ্ছে কেউ যেন আমার ওপর নজর রাখছে। এতরকমের সব নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্যই হয়তো একথা মনে হতো। একজনের চলাফেরা, কাজকর্ম, বন্ধুবান্ধব সম্পর্কে একরকম গুপ্তচরবৃত্তি হয়তো দরকারও আছে, কিন্তু আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি এতে মানুষ পাগল হয়ে উঠতে বাধ্য।
হিলারী স্পষ্ট সুরে বললো, আপনি বলতে চাইছেন–যে পারিপার্শ্বিকতা থেকে আপনি মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন, এখানে এসে আপনাকে ঠিক সেই অবস্থাতেই পড়তে হয়েছে? এখানেও সেই একইভাবে আপনার ওপর নজর রাখা হচ্ছে, গুপ্তচরবৃত্তি চলছে?
একটু বিব্রতবোধ করে বেটারটন বললো, এ বিষয়ে আমি ঠিক জানি না। আসলে আদৌ আমার ওপর নজর রাখা হচ্ছে কিনা তাও জানি না। কেনই বা আমার ওপর নজর রাখবে? কেনই বা এত মাথা ঘামাবে? এরা তো আমাকে এখানে এই জেলখানায় এনে রেখেছে?
–তার মানে–আপনি যা কল্পনা করেছিলেন, তার বিন্দুমাত্রও দেখতে পাননি?
-না, সেইটেই সবচেয়ে আশ্চর্য। একদিক থেকে দেখলে কিন্তু এটা ভালোই লাগবে। কাজ করার আদর্শ পরিবেশ রয়েছে এখানে। সবরকমের সুযোগ সুবিধে যন্ত্রপাতি। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও আপনি ভুলতে পারবেন না যে আপনি বন্দী।
-জানি আমি। আমরা ভেতরে ঢোকার পর যখন বাইরের ফটকটা শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেলোতখনই কেমন যেন ভয়ে গা শিরশির করে উঠেছিলো। হিলারী একটু কেঁপে উঠলো।
–বেশ। বেটারটন যেন অনেকটা আত্মস্থ হয়েছে মনে হলো। আপনার প্রশ্নের উত্তর আমি দিয়েছি। এবার আমার প্রশ্নের জবাব দিন। অলিভের ছদ্মবেশে আপনি এখানে কী করতে এসেছেন?
-অলিভ বলেই সে থেমে গেল। কোন্ কথাটা বলা যায় চিন্তা করতে লাগলো।
–হ্যাঁ, বলুন? অলিভের কী হয়েছে? বলুন? কী বলতে যাচ্ছিলেন বলুন?
বেটারটনের করুণ ত্রস্ত মুখটা দেখে তার বেশ মায়া হলো। বললো, আপনাকে জানাতে ঠিক ভরসা পাচ্ছি না।
তার মানে? আপনি বলতে চাইছেন–তার কোনো বিপদ ঘটেছে?
-হ্যাঁ, আমি দুঃখিত, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি…আপনার স্ত্রী…মারা গেলেন।…আপনার সাথে দেখা করতে আসছিলেন তিনি। পথে প্লেন দুর্ঘটনায় পড়ে, তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানেই তিনি মারা যান।
এবার স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বেটারটন। শান্ত স্বরে শুধু বললো, অলিভ তাহলে মারা গেছে। এবার বুঝতে পারছি…অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে সে হিলারীর দিকে মুখ ফেরালো। ঠিক আছে, বাকিটা একটা নিজেই আন্দাজ করে নিতে পারছি। আপনি তার স্থান দখল করে এখানে এসেছেন, কিন্তু কেন?
এবার কিন্তু হিলারীর জবাব তৈরি। টম বেটারটন বিশ্বাস করেছে যে, তাকে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবার জন্যই ওকে পাঠানো হয়েছে–অবশ্য ওর কথা যদি সত্যি হয়।
হিলারীর মন বললো, ওর ওপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা বিপজ্জনক হতে পারে। হিলারী বললো, আপনার স্ত্রী যখন মারা যান তখন আমি হাসপাতালে তার পাশে ছিলাম। আমি তাকে বলেছিলাম, আমি আপনার কাছে আসার চেষ্টা করতে পারি। তিনি আপনার একটা খবর পৌঁছে দেবার জন্য খুব উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন।
ভুরু কুঁচকে বেটারটন বললো, কিন্তু এ কথা নিশ্চয়ই
তাড়াতাড়ি তাকে থামিয়ে দিয়ে হিলারী বললো, শুনতে যতটা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে আসলে তা নয়। আপনি হয়তো বুঝতে পেরেছেন এই সমস্ত ধ্যানধারণার প্রতি আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে। সবদেশের মধ্যে বৈজ্ঞানিক গোপনীয়তার আদান-প্রদান, একটা নতুন জগৎ-এসব সম্পর্কেই আমার অসীম উৎসাহ। আর তার উপর আমার এই চুল–ওরা যদি প্রায় একই বয়সের একটি লাল চুলওলা মেয়েকেই শুধু আপনার স্ত্রী বলে আশা করে থাকে তাহলে আমার ধারণা সার্থক।
-হ্যাঁ, বেটারটন হিলারীর মাথাটার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো, আপনার চুলগুলো ঠিক অলিভের মতো।
-তারপর আপনার স্ত্রীও বার বার অনুরোধ করতে লাগলেন–আপনাকে যে খবরটা পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন তা নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন।
-ও হ্যাঁ, খবর। কী খবর বলুন তো?
-আমাকে বলতে বলেছিলেন, সাবধান থাকতে–খুব সাবধান থাকতে–খুব বিপদ আপনার সামনে কোনো একজনের সম্পর্কে সাবধান থাকতে–তার নাম বোরিস।
-বোরিস? মানে বোরিস গ্লাইদরের কথা বলছেন?
–হুঁ, তাকে আপনি চেনেন?
মাথা নাড়ল বেটারটন। কোনোদিন চোখে দেখিনি তবে নাম শুনেছি। সে আমার প্রথমা স্ত্রীর আত্মীয়। ভালোভাবেই চিনি তাকে।
-তাহলে সে কেন আপনার পক্ষে বিপজ্জনক হবে?
–কী বললেন? কেমন যেন আনমনা হয়ে গেলো বেটারটন।
হিলারীর কথাটা শুনে বেটারটন বাস্তবে ফিরে এসে বললো, তা আমি জানি না, কিন্তু একথা সত্যি যে সব দিক দিয়েই সে অতি সাংঘাতিক লোক।
–কোন্ দিক দিয়ে?
মানে–সে এমন এক ধরনের আদর্শবাদে বিশ্বাসী যদি মনে করে যে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষকে মেরে ফেললে হয়তো কোনো ভালো হবে, তাহলে হাসতে হাসতে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষকেই খুন করে ফেলতে পারে।
হ্যাঁ, এ ধরনের লোকদের আমি চিনি, হিলারীর মনে হলো, সত্যিই সে এদের চেনে–খুব ভালোভাবে চেনে। কিন্তু কেন মনে হলো?
–অলিভের সঙ্গে কি তার দেখা হয়েছিলো? অলিভকে সে বলেছিলো?
–তা তো আমি জানি না, শুধু–এইটুকুই তিনি আমাকে বলেছিলেন। বিপদের কথা–আর হ্যাঁ, বলেছিলেন একথা তিনি বিশ্বাস করেন না।
বিশ্বাস করে না। কোন কথা বিশ্বাস করে না?
—তাও তো আমি জানি না। একটু দ্বিধা করে সে আবার বললো, বুঝতেই পারছেন–তিনি তখন মৃত্যুর পথে…।
বেটারটনের মুখে তীব্র যন্ত্রণার ছাপ পড়লো। বুঝতে পেরেছি..আমি বুঝতে পেরেছি…সময়ে এসবই হয়ে যাবে। কিন্তু বোরিসের কথাটা নিয়ে কেমন যেন ধাঁধায় পড়ে গেছি। এখানে সে আমার পক্ষে কী করে বিপজ্জনক হতে পারে। সে নিশ্চয়ই লন্ডনে গিয়েছিলো, তার অলিভের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো।
-হ্যাঁ, সে লন্ডনে ছিলো।
তাহলে, স্রেফ এটা আমার বুদ্ধির অগম্য…। আর তাতে কীই বা এসে যায়? আমরা এখানে এমনিতেই বন্দী..
-আশ্চর্য আমারও ঠিক এইকথাই মনে হচ্ছে।
–আমরা এখান থেকে আর বেরোতে পারবো না, সজোরে সে আলসের ওপর একটা ঘুসি মারলো।
হিলারী বললো, একশোবার পিরবো। চকিত বিস্ময়ে সে হাঁ করে তাকিয়ে রইলো হিলারীর দিকে। কী বলছেন আপনি?
কেন, একটা পথ বের করবো আমরা।
পাগলী মেয়ে, বেদনার হাসিতে ভরে উঠলো তার মুখ। এখানে এই জায়গায় কাদের বিরুদ্ধে আপনাকে দাঁড়াতে হবে, সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্রও ধারণা নেই আপনার।
-যুদ্ধের সময় তো কত লোক, কত অসম্ভব জায়গা থেকে পালিয়ে আসে, বললো হিলারী। তারা তো সুড়ঙ্গ কেটে, বা যা হয় কিছু একটা উপায় করে পালায়।
-কঠিন পাথরের মধ্যে দিয়ে কী করে সুড়ঙ্গ কাটবেন? তাছাড়া সুড়ঙ্গ করে যাবেনই বা কোথায়? চারিদিকে তো শুধু ধূ ধূ মরুভূমি।
–প্রত্যেক ক্ষেত্রেই একটা-না-একটা পথ থাকেই। হয়তো তার জন্য সময় লাগবে, অনেক পরিকল্পনা করতে হবে,
আবার বেটারটনের মুখখানা থমথমে হয়ে উঠলো। সময়…এই সময় যে আমি দিতে পারছি না।
-কেন?
-জানি না আপনি বুঝবেন কিনা…আমি সত্যিই বলেছি। এখানে–একটুও কাজ করতে পারছি না আমি, সত্যি!
-কী বলছেন আপনি?
কী করে বোঝাই আপনাকে? আমি কাজ করতে পারছি না, চিন্তা করতে পারছি না। আমার যা কাজ তাতে অত্যন্ত মনঃসংযোগ দরকার। আমার কাজের অনেকটাই–প্রায় সবটাই সৃষ্টির কাজ। এখানে আসা থেকে সারা দিনরাত ধরে বাজে কাজের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে সময় কাটাই, যে কাজ অতি সাধারণ বিজ্ঞানীও করতে পারে। কিন্তু এরজন্য তো ওরা আমাকে নিয়ে আসেনি। ওরা চায় আসল সৃষ্টি-নতুন কিছু সৃষ্টি…আর আমি সেই সৃষ্টি করতে পারছি না।
বেটারটন বললো, আমি যদি কিছু সৃষ্টি করে ওদের হাতে তুলেই না দিতে পারি, তাহলে এত কাণ্ড, এমন এলাহী কাণ্ডকারখানায় ওদের দরকার কী? ওরা তো আমাকে রাস্তায় ফেলে দেবে।
-না না।
-হ্যাঁ–দেখেই। এখানে ওরা ভাবপ্রবণতায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে না। এই প্লাস্টিক সার্জারির ব্যাপারটা যা একটু বাঁচিয়েছে আমাকে। জানেন বোধহয়, একবারে এই অস্ত্রোপচার হয় না–একটু একটু করে করা হয়। আর স্বাভাবিকভাবেই যে লোকের ওপর দিনের পর দিন একটানা ছোটখাটো অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে, সে কোনো কাজে মনঃসংযোগ করতে পারে না।
–কিন্তু এই অস্ত্রোপচারের কী দরকার ছিলো? কী জন্য করা হলো এটা?
–এটা? ওই–স্রেফ সাবধানতার জন্য। মানে–আমার সাবধানতার জন্য। এটা করা হয়–যদি আপনি পুলিসের প্রার্থিত লোক হন তখনই।
–আপনি কি তাহলে পুলিসের প্রার্থিত ব্যক্তি?
-হ্যাঁ, কেন আপনি জানেন না? ও আচ্ছা, ওরা বোধহয় ব্যাপারটা তেমন প্রচার করেনি। হয়তো অলিভও জানতো না। কিন্তু সত্যিই আমি ফেরারী।
–আপনি কি–মানে বিশ্বাসঘাতকতার কথা বলতে চাইছেন? মানে–আপনি এদের কাছে পারমাণবিক গোপনীয়তা বিক্রি করে দিয়েছেন?
বেটারটন ওর চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। কিছুই আমি বিক্রি করিনি। আমি শুধু আমাদের কাজের পদ্ধতিগুলো ওদের বলে দিয়েছি–সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়, নিঃস্বার্থভাবে দিয়েছি। যদি বিশ্বাস করেন বলবো আসলে আমিই ওগুলো ওদের দিতে চেয়েছিলাম। এটা সমগ্র গঠনব্যবস্থার একটা অংশ–বিজ্ঞানে সমস্ত জ্ঞানের একত্রীভবন। আপনি হয়তো বুঝতে পারছেন না।
ঠিকই বুঝতে পারছিলো হিলারী, এও সে বুঝতে পারছে যে, অ্যান্ড্রু পিটার্সও ঠিক এই কাজই করছে। এই একই উন্মাদনায় পাগল।
হিলারীর মনে হলো, টম বেটারটন যে এই কাজে ব্রতী, এ যেন সে চিন্তা করতে পারছে না। বেটারটন মাত্র কমাস আগে প্রবল উৎসাহ আর আগ্রহ নিয়ে এখানে এসেছিলো, সেই বেটারটন এখন পরাজিত, বিধ্বস্ত–স্বপ্নের জগৎ থেকে আবার বাস্তব জগতে আছড়ে পড়া একটা সাধারণ মানুষের মতো ভীত-সন্ত্রস্ত।
কথাটা কতখানি ঠিক তা যাচাই করার সময় পেলো না সে। চারদিকে তাকিয়ে বেটারটন বললো, সবাই নেমে গেছে, আমরাও বরং
উঠে দাঁড়ালো হিলারী। হ্যাঁ চলুন। কিন্তু অত ঘাবড়াবার কী আছে? এটাই তো অস্বাভাবিক। ওরাও তাই ভাববে–এটাই স্বাভাবিক–অন্তত এই পরিস্থিতিতে।
বেটারটন কেমন যেন অদ্ভুতভাবে বললো, এইভাবেই আমাদেরকে থাকতে হবে, মানে আপনাকে আমার স্ত্রী হিসেবে থাকতে হবে।
–তা তো বটেই।
একই ঘরে থাকতে হবে–এইসব আর কি। তবে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন মানে আমাকে ভয় পাবার কোনো কারণ নেই।
হিলারী বলে উঠলো, এসব ব্যাপার নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ আছে বলে আমার মনে হয় না। আমাদের আসল কাজ হচ্ছে, এখান থেকে জীবন্ত অবস্থায় পালানো।
.
১৪.
ম্যারাকেশের হোটেলে ম্যামাউনিয়ার একটা ঘরে জেসপ নামে সেই ভদ্রলোক মিস হেদারিংটনের সঙ্গে কথা বলছিলেন। ক্যাসাব্লাঙ্কা আর ফেজ-এ হিলারীর সঙ্গে যে হেদারিংটনের আলাপ হয়েছিলো, এ যেন সে হেদারিংটন নয়। একই রকম দেখতে, ঠিক যেন যমজ বোন, সেই একই রকম চুলবাঁধা, কিন্তু হাবভাব যেন সম্পূর্ণ আলাদা। এই মহিলা যেন অনেক চটপটে, কর্মদক্ষ, বয়েসও যেন অনেক কমে গেছে।
ঘরে তৃতীয় ব্যক্তিটি টেবিল চাপড়ে গুনগুন করে ফরাসি গানের কলি ভাঁজছিলো। লোকটির গায়ের রঙ কালো, বেশ শক্তসমর্থ চেহারা, চোখদুটো বুদ্ধির ছটায় উদ্ভাসিত।
তাহলে যতদূর আপনি জানেন, জেসপ বলছিলেন, কেবলমাত্র এই কটি লোকের সঙ্গে সে ফেজ-এ কথাবার্তা বলেছিলো?
জানেত হেদারিংটন ঘাড় নাড়লেন। কেলভিন বেকার নামে মহিলাটিও ওখানে ছিলো, যার সঙ্গে আগেই ক্যাসাব্লাঙ্কায় আমাদের আলাপ হয়েছিলো। তবে নির্দ্বিধায় আমি স্বীকার করছি, ভদ্রমহিলাকে এখনও আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। স্রেফ বন্ধুত্ব করার জন্যই সে আগ বাড়িয়ে অলিভ বেটারটনের সঙ্গে আলপ করেছিলো, আমার সঙ্গেও তাই। আমেরিকানদের স্বভাবই তাই। হোটেলে, গাড়িতে গায়ে পড়ে আলাপ করে, তাদের সঙ্গে বেড়াবার ছক তৈরি করে ফেলে।
–হুঁ! জেসপ বললেন, আমরা যা খুঁজছি তার পক্ষে এগুলো এতই অস্পষ্ট…
–আর তাছাড়া, হেদারিংটন বললেন, ভদ্রমহিলা ওই প্লেনেই ছিলেন।
–আপনার কী ধারণা–এই দুর্ঘটনাটা পূর্বপরিকল্পিত? জেসপ এবার ঘাড় ফিরিয়ে কালো মতন লোকটির দিকে তাকালেন, তোমার কী মনে হয়, লেবল্যাঙ্ক?
লেবল্যাঙ্ক বললো, অনেক কিছুই হতে পারে। হয়তো কেউ প্লেনের যন্ত্রপাতি বিগড়ে রেখেছিলো। যার ফলে এই দুর্ঘটনা। সেকথা তো আমরা কোনোদিনই জানতে পারবো না। প্লেনটা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে–সাক্ষ্য দেবার মতো একজনও বেঁচে নেই।
-প্লেনের চালক সম্পর্কে তোমার কিছু জানা আছে?
–আলকাডি? হা জোয়ান ছোকরা, মোটামুটি দক্ষ, ব্যস ওই পর্যন্ত।
লেবল্যাঙ্ক বললো, সাতটা মৃতদেহ পাওয়া গেছে। সবকটাই বিশ্রীভাবে পোড়া, সনাক্ত করা সম্ভব নয়, কিন্তু পুরো সাতটা মৃতদেহ। তার মানে–একজনও রেহাই পায়নি।
জেসপ হেদারিংটনের দিকে ফিরলেন, আপনি যেন কী বলছিলেন?
–ফেজ-এ একটি ফরাসি পরিবারের সঙ্গে মিসেস বেটারটনের দু-একটা কথাবার্তা হয়েছিলো। ওখানে আর ছিলো একজন সুইডিস ব্যবসাদার আর তার সুন্দর প্রেয়সী। আর ছিলেন, ব্যবসায়ী জগতের চূড়ামণি, কোটিপতি বৃদ্ধ : মিঃ অ্যারিস্টাইডস।
ও, সেই টাকার খনিটা ওখানে ছিলো?
লেবল্যাঙ্ক বললল, লোকে বলে বুড়োর নাকি সাঙ আমলের সব চীনা মৃৎ-শিল্প সংগ্রহের বাতিক আছে।
চীনারা নিজেরাই কিন্তু বলে, ষাট থেকে সত্তর বছর বয়সটাই জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়। জীবনের এই সময়টাতেই সে জীবনের মাধুর্য ও সৌন্দর্য সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি মুখর হয়ে ওঠে।
আমি ওদের দলে নেই, বললো লেবল্যাঙ্ক।
–কজন জার্মানও ছিলো ফেজ-এ, জানতে হেদারিংটন বলে চললেন, কিন্তু যতদূর জানি, অলিভ বেটারটনের সঙ্গে তাদের কোনো কথাবার্তা হয়নি।
–কোনো পরিচারক বা ভৃত্যের সঙ্গে সম্ভবত কথা বলেছিলেন?
–সে তো সবসময়ই হতে পারে।
–আর–আপনি বলছেন, পুরোনো শহর দেখতে একাই বেরিলয়েছিলেন?
-না, একজন পাকা পথপ্রদর্শক সঙ্গে ছিলেন। পুরোনো শহরেই হয়তো কেউ তার সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকবে।
–যে কারণেই হোক, তিনি একেবারে হঠাৎ ম্যারাকেশ যাওয়া ঠিক করে ফেলেন।
–হেদারিংটন বললেন, একেবারে নয়, আগে থেকেই ওঁর জন্য আসন সংরক্ষিত ছিলো।
-ও হ্যাঁ, আমি ভুল করেছি–জেসপ বললেন, আমি বলতে চেয়েছিলাম, মিসেস কেলভিন বেকারই একেবারে হঠাৎ তার সঙ্গে যাওয়া ঠিক করে ফেললেন, উঠে পড়ে তিনি অস্থির ভাবে পায়চারি করতে লাগলেন। উনি ম্যারাকেশের পথে পাড়ি দিলেন…আর প্লেনটা ধাক্কা খেয়ে জ্বলতে জ্বলতে আছড়ে পড়লো। কেমন যেন দুর্ভাগ্যের পূর্ব লক্ষণ–যেন অলিভ বেটারটন নামে কেউ প্লেনে চড়লেই তা ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রথমে ক্যাসাব্ল্যাঙ্কার কাছে দুর্ঘটনা ঘটলো, তারপর এইটা। এটা কি সত্যিই দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পনা করে ঘটানো? যদি এমন কেউ থাকে, যে বা যারা অলিভ বেটারটনের হাত থেকে রেহাই পেতে চায়। তারা তো-আমি বলবো, একটা প্লেন ধ্বংস করার চেয়ে অনেক সহজ উপায়ে এটা করতে পারতো।
-কে বলতে পারে বলুন, লেবল্যাঙ্ক বললো, আমাকে ভুল বুঝবেন না,-একবার যদি মনের এই অবস্থায় পৌঁছতে পারেন, যেখানে মানুষের জীবন নেওয়াটাই তুচ্ছ ব্যাপার, তখন কাউকে মারার জন্য অন্ধকার গলিখুঁজিতে ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে প্লেনের একটা আসনের তলায় কিছুটা বিস্ফোরক পদার্থ রেখে দেওয়া অনেক সহজ। তাতে করে আরো ছটা লোক যদি মারা যায় তত ভারি বয়েই গেলো।
-তা ঠিক, জেসপ বললেন, আমি জানি, আমার সঙ্গে কেউ একমত হবে না, কিন্তু তবুও আমার দৃঢ় ধারণা এর একটা তৃতীয় সমাধান নিশ্চয় আছে। আমার ধারণা–এই দুর্ঘটনা সাজানো ব্যাপার।
উদগ্রীব চোখে তাকালো লেবব্যাঙ্ক, হ্যাঁ, এটা হতেই পারে। প্লেনটাকে নামিয়ে এনে হয়তো আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু একটা ঘটনা আপনি উড়িয়ে দিতে পারেন না, মিঃ জেসপ–প্লেনের মধ্যে সত্যিকারের মানুষ ছিলো। হ্যাঁ, সত্যিকারের কটা ঝলসানো দেহ।
–জানি, আর এইটাই যা কিছু বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। না, না আমার এই কল্পনা যে সম্পূর্ণ অবাস্তব এ বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই। কিন্তু এ যেন আমাদের এই অভিযানের এক চমৎকার পরিসমাপ্তি। আমাদের এগোবার মতো আর কোনো সূত্রই নেই। একটু থেমে আবার লেবল্যাঙ্ককে জিজ্ঞেস করলেন, ওদিকে যে অনুসন্ধান নিতে বলেছিলাম সেটা কদ্দূর এগোল?
–দুদিন ধরে খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে। লোকজনও অনেক লাগানো হয়েছে। প্লেনটা যেখানে পড়েছে, জায়গাটা একেবারেই নির্জন, হ্যাঁ, প্লেনটা কিন্তু পথভ্রষ্ট হয়ে পড়েছিলো।
-যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, জেসপ বললেন।
–ওখান থেকে সবচেয়ে কাছের গ্রাম, সব থেকে কাছে জনবসতি এবং সবচেয়ে কাছের গাড়ির চাকার দাগ সবকিছু তন্ন তন্ন করে খুঁজে পরীক্ষা করা হয়েছে। আপনার মতো আমাদের দেশেও এই অনুসন্ধানের গুরুত্ব কম নয়। ফ্রান্সে আমরাও আমাদের কজন অল্পবয়সী কৃতী বিজ্ঞানীকে হারিয়েছি। কী যে এদের মতিগতি, কে জানে!
–যাত্রী তালিকাটা আর-একবার পরীক্ষা করা যাক, কি বলল?
লেবল্যাঙ্ক তালিকাটা টেবিলের ওপর মেলে ধরতে দুজনেই ঝুঁকে পড়লো। মিসেস কেলভিন বেকার–আমেরিকান। মিসেস বেটারটন-ইংরেজ। টরকুইল এরিকসন, নরওয়েবাসী–এর সম্পর্কে কিছু জানা আছে?
যতদূর জেনেছি, সেটা কিছুই নয়, লেবল্যাঙ্ক জানালো সাতাশ-আঠাশ বছরের যুবক একজন।
জেসপ বললো, নামটা আমার যেন কেমন চেনা চেনা ঠেকছে, মনে হচ্ছে–হ্যাঁ ঠিক, রয়্যাল সোসাইটিতে উনি একবার ওঁর গবেষণাপত্র
–আর একজন সন্ন্যাসিনী দিদিমণি, লেবল্যাঙ্ক আবার তালিকায় মন দিলো। মিস্টার মেরী না কি যেন নাম। অ্যান্ড্রু পিটার্স, ইনিও আমেরিকান।
–ডাঃ ব্যারন–হ্যাঁ একটা প্রতিষ্ঠিত নাম–মাননীয় ডাক্তার ব্যারন। বিরাট প্রতিভাবান লোক। সংক্রামক ব্যাধির ডাক্তার হিসেবে ওঁর জুড়ি নেই।
-হুঁ, জীবাণুযুদ্ধে এঁদের খুব প্রয়োজন, বেশ মিলে যাচ্ছে।
টেলিফোনটা বেজে উঠলো। লেবল্যাঙ্ক ফোনটা তুলে নিলো, হ্যালো, কে বলছেন? আঁ? ও আচ্ছা, হ্যাঁ ওপরে পাঠিয়ে দাও। জেসপের দিকে তাকিয়ে বললো, আমার একজন তোক এইমাত্র খবর দিলো, মিঃ জেসপ, ওরা একটা কিছু খোঁজ পেয়েছে। হা, এটা সম্ভব, আমি স্বীকার করছি আপনার অবাস্তব কল্পনা অত্যন্ত সঠিক।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজন লোক ঘরে ঢুকলো। প্রথম জনের সঙ্গে লেবল্যাঙ্কের যথেষ্ট মিল আছে। কালো গাট্টাগোট্টা, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। ভদ্রলোকের সঙ্গে একজন স্থানীয় গ্রাম্যলো, দেহাতী সাদা পোশাক গায়ে। অবাক দৃষ্টিতে সে ঘরের চারদিকে দেখছিলো, আর সেই সময়ে অন্য লোকটি দ্রুত ফরাসি ভাষায় বলছিলো
পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিলো এবং ভালোভাবে প্রচারও করা হয়। এ লোকটি এবং এর পরিবারের আর সবাই বিপুল উদ্যমে খোঁজ শুরু করে। ও যেটা খুঁজে পেয়েছে সেটা ওকে নিজে হাতে পৌঁছে দেবার জন্য এবং আপনার যদি ওকে জিজ্ঞাসা থাকে সেই জন্যই ওকে নিয়ে এসেছি।
স্থানীয় লোকটির দিকে তাকিয়ে লেবল্যাঙ্ক বললো, চমৎকার কাজ করেছো তুমি। কই দেখি, কী তুমি আবিষ্কার করেছ দেখাও।
কোচার ভাজ খুলে লোকটা একটা বস্তু বের করলো। এগিয়ে এসে টেবিলের ওপর রাখলো। বেশ বড়মাপের ধূসর লাল রঙের একটা মুক্তো।
লোকটি বললো, আমাদের যে জিনিসটা দেখানো হয়েছিলো, এটা প্রায় সেইরকম দেখতে। দামি জিনিষ ভেবে এটা কুড়িয়ে নিয়েছিলাম।
জেসপ প্রায় ছোঁ মেরে মুক্তোটা তুলে নিলেন। পকেট থেকে ঠিক ওই রকম আর একটা মুক্তো বের করে দুটোকে পরীক্ষা করতে লাগলেন।
এই তো, হ্যাঁ ঠিক সেই দাগটা রয়েছে, গলায় তার খুশি উপচে পড়লো। টেবিলের কাছে ফিরে এসে বললেন, লক্ষ্মী মেয়ে, সত্যিই লক্ষ্মী মেয়ে সোনা মেয়ে। কাজটা তাহলে করতে পেরেছে।
লেবল্যাঙ্ক তখন লোকটিকে আরবি ভাষায় কী সব যেন জিজ্ঞেস করে জেনে নিচ্ছিলো। জেসপকে বললো, আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, মিঃ জেসপ। এই লোকটা বলছে, মুক্তোটা সে নাকি ওই জলন্ত প্লেনটা থেকে প্রায় আধমাইল দূরে পেয়েছে।
জেসপ বলতে লাগল, যা থেকে এটাই প্রমাণ হচ্ছে যে, অলিভ বেটারটন মারা যায়নি। যদিও বলা হয় ফেজ থেকে প্লেনটা সাতজন যাত্রী নিয়ে রওনা হয়েছিলো এবং তাতে সাতটা ঝলসানো দেহই পাওয়া গিয়েছিলো, তবু বলা যেতে পারে সাতটা মৃতদেহের মধ্যে একটা অন্তত অলিভ বেটারটনের নয়।
এবার তাহলে আমরা জোর তল্লাশী করতে পারি, বলে লেবল্যাঙ্ক লোকটির সঙ্গে আরো কি যেন কথা বললো। লোকটি খুশি হয়ে অন্য লোকটির সঙ্গে বেরিলয়ে গেলো। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ওকে ভালো পুরস্কারই দিতে হবে-জেসপকে সে বললো। আর এবার ওই মুক্তোগুলোর খোঁজ নিতে আশপাশের গ্রামগুলোয় ব্যাপক তল্লাশী করবো। আমি ভাবছি, মিঃ জেসপ, এবার আমরা সুফল পাবোই-শুধু বেটারা যদি মিসেস বেটারটনের ফেলে যাওয়া সূত্রগুলো ওলটপালট না করে ফেলে।
জেসপ আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়ল। অথচ কত স্বাভাবিক ব্যাপার এটা। কত মেয়েই তো গলায় অমন মুক্তোর আঁটো হার পরে। আর তা যে-কোনো সময়ে ছিঁড়ে-যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। এরপর শুধু পকেটে একটা ছোট্ট ফুটো থাকলেই হলো। যেখানে যেমন দরকার একটি করে মুক্তো সেই ফুটো দিয়ে ঠেলে গলিয়ে ফেলে দেওয়া, ব্যস। তাছাড়া ওকে তারা সন্দেহই বা করে কেন? সে অলিভ বেটারটন স্বামীর সঙ্গে দেখা করার জন্য আকুল হয়ে চলেছে।
লেবল্যাঙ্ক বললো, ব্যাপারটা আমাদের পর্যালোচনা করতে হবে। অলিভ বেটারটন, ডাক্তার ব্যারন, নাম দুটোর নীচে তালিকায় দাগ দিলো। অতন্ত এই দুজনে যে সেখানে যাচ্ছিল এটা নিশ্চত, এদের গন্তব্যস্থল এক। ঐ বিমানের যাত্রীদের একই দিনে, একই প্লেনে নিয়ে যাবার জন্য বিভিন্ন স্থান থেকে অত্যন্ত সুচতুরভাবে সংগ্রহ করা হয়েছিলো। তারপর জ্বলন্ত প্লেনটা আবিষ্কার করা হলো–ভেতরে সমসংখ্যক মৃতদেহ। কিন্তু কী করে এটা সম্ভব করলো সেটাই আশ্চর্য।
-হ্যাঁ, বিশ্বাস করানোর মতো সূক্ষ্ম নিখুঁত কাজ। আমরা কিন্তু এখন জেনে ফেলেছি, ওই ছ-সাতটা নোক আবার নতুন করে যাত্রা শুরু করেছিলো। কোথা থেকে তারা তাদের নতুন যাত্রা আরম্ভ করেছে সেটাও আমরা জানতে পেরেছি। এরপর আমাদের জায়গাটা দেখে আসা উচিত নয় কি?
–সে তো একশোবার, অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে গিয়ে বসবো আমরা। আর আমার ধারণা যদি ভুল হয় তাহলে, একবার এই সূত্র ধরে এগোতে শুরু করলে অন্যান্য প্রমাণগুলো পেয়ে যাবো।
একদিন লেবল্যাঙ্ক লাফিয়ে উঠে বললো, আব্দুল মহম্মদ নামে একজনের বাড়ির পায়খানার এক অন্ধকার কোণে চেবানো চুইংগামে আটকানো একটা মুক্তো পেয়েছি। আব্দুল এবং তার ছেলেকে জিজ্ঞাসা করা হলো, কিন্তু প্রথমে তারা বলতে চাইছিলো না। তারপর ভয় দেখানোর পর বললো, একটা মোটরগাড়িতে ছজন লোক একদিন এসে তাদের বাড়িতে রাত্রিবাস করেছিলো। বলেছিলো তারা নাকি জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ। অনেক টাকা ওদেরকে দিয়ে বলেছিলো কাউকে যেন কিছু না বলে। কারণ তারা নাকি এক অভূতপূর্ব বিস্ময়র খননকার্যে যাচ্ছে, যা কাউকে জানাতে চায় না। এ কেইফ গ্রামের কটা বাচ্চা ছেলে দুটো মুক্তো কুড়িয়ে পেয়েছে। আপনার ভবিষ্যৎবাণী অনুসারে, ওই যে ওকে ধরে এনেছি ও আপনাকে এ ব্যাপারে সবকিছু বলতে পারবে।
ওই যে–বলে যাকে দেখালো সে একজন স্থানীয় লোক, বিকট দেখতে। বললো, সেদিন রাত্তিরে আমি আমার দলবল নিয়ে ফিরছিলুম, হঠাৎ একটা মোটরগাড়ির আওয়াজ কানে এলো। গাড়িটা সাঁ করে পাশ দিয়ে বেরিলয়ে গেলো–আর স্পষ্ট দেখলুম, গাড়ির একপাশে ফতিমার হাত। হ্যাঁ বাবু, বিশ্বাস করুন, ওই অন্ধকারেও হাতটা জ্বলজ্বল করে জ্বলছিলো।
দস্তানার গায়ে ফসফরাস মাখিয়ে দিলে চমৎকার ফল পাওয়া যায়, প্রায় ফিসফিস করে জেসপের কানে কানে বললো লেবল্যাঙ্ক। আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেবো স্যার–এরকম একটা চিন্তা মাথায় আসা
-এটা খুব কার্যকরী হয়, জেসপ বললেন, কিন্তু ভীষণ বিপজ্জনক কাজ! মানে-একটা সাংঘাতিক কাজ করে পালাবার সময় অপরাধীরা এত সজাগ হয়ে থাকে যে, যে-কোনো সময়েই তারা এটা দেখে ফেলতে পারে।
দিনের বেলা এটা তো আর দেখা যায় না।
–না। কিন্তু অন্ধকারে যদি কোনো কারণে তারা গাড়ি থেকে নামে তো
-তখন ওরা কিছু ভাববে না। এটা আরবদেশের এত প্রচলিত কুসংস্কার যে কিছু সন্দেহই করতে পারবে না ওরা। কত গাড়িতেই ওই হাত এঁকে দেওয়া হয়। বড়জোর ওরা ভাববে, কোনো ধার্মিক মুসলমান বেশি করে চোখে পড়ার জন্য–কোনো জ্বলজ্বলে রঙ দিয়ে তাদের গাড়িতে ওঠার ছাড় দিয়েছে।
তা সত্যি। কিন্তু আমাদের সতর্কতাটুকু আমাদের বজায় রাখতে হবে। কোনোক্রমে আমাদের শত্রুরা যদি এটা বুঝতে পেরে যায়, তাহলে আমাদের জন্য তারা ভুল পথের নিশানা রেখে যাবে। চারদিকে তখন হয়তো দেখবো, অজস্র গাড়িতে ফতিমার হাতের ছাপ।
পরদিন সকালে লেবল্যাঙ্ক আরেকটা জিনিষ এনে হাজির করলো। চেবানো চুইংগামের ওপর তিনটি ঝুটো মুক্তো ত্রিকোণাকারে সাজানো।
–এর মানে হচ্ছে, দেখে জেসপ বললেন, এরপর থেকে ওরা প্লেনে রওয়ানা হয়েছে। তিনি লেবল্যাকের দিকে তাকালেন।
–আপনি এক্কেবারে ঠিক বলেছেন, লেবল্যাঙ্ক বললো, একটা পরিত্যক্ত বিমানঘাঁটিতে এটা পাওয়া গেছে। একেবারে নির্জন, দুর্গম জায়গা সেটা–অনেকদূর এখান থেকে। একটা প্লেন যে খুব শীঘ্রই সেখানে নেমেছিলো এবং আবার উড়ে গিয়েছিলো তার স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। এখানে এসে আবার থমকে দাঁড়াতে হচ্ছে–জানি না এরপর আবার কোথায় ওদের সন্ধান করার মতো সূত্র খুঁজে পাবো।
.
১৫.
এ অসম্ভব, নিজের মনেই ভাবছিলো হিলারী। দশ-দশটা দিন আমি এখানে রয়েছি, এ যেন ভাবাই যায় না। জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতাটাও আমি কত সহজে মেনে নিয়েছি।
প্রথম এখানে এসে, ভয়ঙ্কর আতঙ্কে সে কাঠ হয়ে গিয়েছিলো, বন্দিত্ব আর হতাশার এক ভয়ঙ্কর অনুভূতি–সেই বন্দিত্ব আবার যখন নানারকম বিলাস উপকরণের প্রলেপে মুক্তির মুখোশ ধরে আসে, সে যেন আরও ভয়ঙ্কর। কিন্তু তবুও এখন, একটা সপ্তাহ কাটতেই, মনের অগোচরে কখন যেন সে এই জীবনটাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছে! সত্যিই অদ্ভুত! স্বপ্নের ঘোরে বাস যেন।
এই ভয়াবহ পরিবেশকেও মেনে নিতে পেরেছে, তার একটা কারণ সম্ভবত–সে নারী। মেয়েরা প্রকৃতির বশ। তারা পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিচার করে। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছে সে, তার সঙ্গে যারা এখানে এসেছে তাদের হাবভাব দেখে। হেলগা নীডহেইমকে তো খাবার সময় ছাড়া দেখাই যায় না। চোখাচোখি হয়ে গেলে জার্মান মহিলাটি একটু সেঁতো হাসি হেসে তাকে এড়িয়ে যায়। যতদূর সে বুঝেছে, তাতে হেলগা নীডহেইমকে বেশ সুখী সন্তুষ্ট বলে মনে হয়েছে। তার কল্পনার সঙ্গে এই সংস্থার জীবনযাত্রা নিশ্চয়ই মিলে গেছে। নিজের এবং তার সহকর্মী বিজ্ঞানীদের মর্যাদার আসন যে সবার উপরে একথা প্রমাণ করাই যেন তার প্রধান কাজ। মানবজাতির মুক্তি, বিশ্বশান্তি বা বিশ্বভ্রাতৃত্ব সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই।
ডাঃ ব্যারন কিন্তু হেলগা নীডহেইমের চেয়ে অনেক বুদ্ধিমান। মাঝেমধ্যে হিলারীর সঙ্গে তার কিছু কথাবার্তাও হয়েছে। বেশ লোক। নিজের কাজে ডুবে আছেন। কাজ করার যে সুযোগ-সুবিধা তাকে দেওয়া হয়েছে তাতে একেবারে মুগ্ধ।
একদিন তিনি বলেছিলেন, এটা–ঠিক যেমনটা আমি আশা করে এসেছিলাম তেমন নয়। খোলাখুলি বলছি আপনাকে–একদম নয়। আরও একটা কথা চুপিচুপি বলে রাখি, মিসেস বেটারটন-বন্দীদশা আমার মনে কোনো রেখাপাত করে না। আর এখানকার জীবন–আমি মনে করি বন্দীজীবন।
-মানে–আপনি বলতে চাইছেন, যে স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে এখানে এসেছিলেন তার কিছুই খুঁজে পাচ্ছেন না? হিলারী জিজ্ঞেস করেছিলো।
হেসেছিলেন ডাক্তার, ক্ষীণ, বেদনাঝরা হাসি। বলেছিলেন, না না, আপনি ভুল করছেন। আসলে মুক্তির স্বাদ নিতে আমি আসিনি এখানে। আমি আপনাকে বলেছি, আমি এখানে এসেছি স্রেফ টাকার জন্য।
হিলারী তাকে জিজ্ঞেস করলো, এখানে টাকা নিয়ে আপনি কী করবেন?
-না–আসলে, গবেষণাগারের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এরা কিনে দেয়, ডাঃ ব্যারন বলেছিলেন। আমি স্রেফ বিজ্ঞানের নবতম আবিষ্কারের আনন্দে ডুবে থাকতে চাই। এছাড়া–ফ্রান্স ছাড়ার আগে ওরা আমাকে প্রচুর টাকা দিয়েছিলো। অন্য একটা নামে ব্যাঙ্কে সেগুলো নিরাপদে বেড়ে চলেছে। যথাসময়ে যখন এসব শেষ হবে তখন যেমন খুশী সেগুলো খরচ করতে পারবো।
–যখন এসব শেষ হবে? অবাক চোখে তাকিয়ে হিলারী কথাটা আওড়ালো।
ডাঃ ব্যারন হাসলেন। একটু বুদ্ধি থাকলেই বোঝা যায়, কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়। আমার বিশ্বাস, কোনো কমিউনিস্ট শক্তি এ জায়গাটাকে চালাচ্ছে না। স্রেফ একজন পাগল-বদ্ধ পাগল এটাকে চালাচ্ছে।
এরিকসন, সে এই সংস্থার আবহাওয়ায় বেশ মানিয়ে নিয়েছে। ডাঃ ব্যারনের মতো বাস্তববাদী নয় সে, আত্মচিন্তায় বিভোর।
আমেরিকান যুবক অ্যান্ড্রু পিটার্সকে কিন্তু হিলারীর ভালো মনে হয়। পিটার্স একদিন বলেছিলো, আমি যে ঠিক কোথায় যাচ্ছি তাই অমি জানি না। এই জায়গার সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির কোনো যোগসূত্র থাকতেই পারে না। মস্কোর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্কই নেই।
হিলারী বলেছিলো, এ জায়গার আসল মালিক কে তা জানার জন্য আপনি একটু বেশি মাথা ঘামাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে না?
–তা হয়তো সত্যি, বলেছিলো পিটার্স। আশেপাশে আমাদের কথা শোনার মতো কেউ নেই যখন তখন বলেই ফেলি। আমি এখান থেকে পালাতে চাই, সত্যি পালাতে চাই।
–খুব সোজা কাজ হবে না সেটা, গলা নামিয়ে বলেছিলো হিলারী।
ছাদবাগানে হাঁটছিলো তখন ওরা। নৈশভোজ শেষ হয়ে গেছে। পিটার্স বললো, মোটেই সহজ হবে না, কিন্তু কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।
হিলারী বললো, আপনার মুখ থেকে একথা শুনতেও ভালো লাগছে না।
সহানুভূতির চোখে তাকাল পিটার্স। আপনি কি ভেঙে পড়েছেন?
–অনেকটাই তাই। তবে ঠিক তার জন্য আমি আতঙ্কিত নই।
–তার জন্য নয়? তবে কিসের জন্য?
-না মানে–এই পরিবেশের সঙ্গে পাছে আমি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাই, ভয় আমার সেই জন্য।
মাঝে মাঝে আমার মনে হচ্ছে এখানে কোনোরকম ভোজবাজি চলছে না তো?
–ভোজবাজি? ভোজবাজি বলতে কী বোঝাতে চাইছেন?
-স্রেফ ভোজবাজি মানে ধোকা। সহজ ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, কোনোরকম আফিম টাফিম খাওয়াচ্ছে না তো?
-মানে–ওই ধরনের কোনো ওষুধ-টষুধ বলতে চাইছেন?
হ্যাঁ, ওই ধরুন, খাবার বা মদের সঙ্গে এমন কিছু মিশিয়ে দেওয়া হলো–যার ফলে আপনি কুঁদ হয়ে রইলেন যে আপনাকে দিয়ে যা খুশি করিয়ে নেওয়া চলে–মানে একেবারে বশ করা যাকে বলে।
-কিন্তু এমন কোনো ওষুধ আছে কি?
-না–মানে এমন ওষুধ আছে যাতে রোগীরা আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ে, অস্ত্রোপচারের আগে তাদের অচেতন করে দেয়। কিন্তু বহুকাল ধরে নেশায় বুঁদ করে রেখে কাউকে বশ করে রাখা এবং একই সঙ্গে সেই লোককে দিয়ে বড় বড় কাজ করানোর দক্ষতা অর্জন করানোর মতো কোনো ওষুধ বেরিলয়েছে কিনা আমার জানা নেই। কিন্তু আমার বিশ্বাস, এখানে এরা যে কোনো উপায়েই থোক প্রচণ্ড মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। সোজা ভাষায় বলতে গেলে বলবো, আমার ধারণা এখানকার প্রশাসক এবং উদ্যোক্তরা নিশ্চয়ই সম্মোহনী বিদ্যায় খুব পোক্ত। একথা স্বীকার করতেই হবে। যে লোক নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য নিয়ে স্বেচ্ছায় কোনো কাজ করতে আসে তাকে দিয়ে অনেক কাজ করানো যায়।
–কিন্তু তা বলে তো এ অবস্থা আমরা মুখ বুজে মেনে নিতে পারি না, রাগে প্রায় কুঁসিয়ে উঠলো হিলারী। এক মুহূর্তের জন্যও আমরা যেন না ভাবি, এখানে যা চলছে তা ভালো।
পিটার্স জিজ্ঞেস করলো, আপনার স্বামী কী বলেন?
–টম? সে-মানে, তার কথা আমি ঠিক জানি না। জানা সহজও নয়। আমি–কথা শেষ না করে সে চুপ করে গিয়েছিলো।
এমন একজন দরদী শ্রোতাকেও সে তার অদ্ভুত জীবনের কাহিনী শোনাতে পারলো না। গত দশদিন ধরে সে সম্পূর্ণ এক অচেনা লোকের সঙ্গে বাস করছে। একই শয়নঘরে কত বিনিদ্র রাতে পাশের বিছানা থেকে একজন অপরিচিত পুরুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনেছে। দুজনেই এ অবস্থাটাকে অবশ্যম্ভাবী বলে মেনে নিয়েছে। নেবেই বা না কেন? সে তো একজন ছদ্মবেশী গুপ্তচর। যে-কোনো পরিবেশ, যে-কোনো ব্যবস্থাই তাকে মেনে নিতে হবে। সত্যি বলতে কি, টম বেটারটনকে সে এতটুকুও বুঝতে পারে না। শুধু এই সংস্থায় এসে কয়েক মাসে একজন প্রতিভাবান বিজ্ঞানীর তাজা মনের যে কী হাল হয়, ও যেন তার জ্বলন্ত উদাহরণ। যে কারণেই হোক, ও যেন তার অদৃষ্টকে অত্যন্ত সহজ শান্তভাবে মেনে নিয়েছে মনে হয়। কাজের আনন্দে ডুবে থাকা তো দূরের কথা, কাজে মন বসানোর অক্ষমতাই যেন ওকে আরো চিন্তিত করে তুলছে বলে মনে হয় হিলারীর। প্রথম দিন সন্ধ্যায় যা বলেছিলো, পরে আরও দু-একবার সেই কথাই বলেছে টম।
নাঃ! আর আমি ভাবতে পারছি না। মনে হচ্ছে–আমার মনের মধ্যেটা যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
সত্যি বলেই বিশ্বাস করেছে হিলারী। টম বেটারটন একজন সত্যিকারের প্রতিভাধর। তার বিকাশের জন্য সবচেয়ে আগে দরকার–স্বাধীনতা। স্বাধীনতা হারিয়ে ওর মনের বিকাশ স্তব্ধ হয়ে গেছে। একমাত্র সত্যিকারের মুক্ত পরিবেশই ওর পক্ষে কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব।
হিলারী বুঝেছে টম মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। হিলারীকেও সে পরম উদাসীনতায় উপেক্ষা করে চলেছে। ওর কাছে হিলারী যেন রক্তমাংসের নারী নয়, বন্ধুও নয়। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় হিলারীর, নিজের স্ত্রীর মৃত্যুও ওকে নাড়া দিতে পেরেছে কিনা। একটি মাত্র চিন্তাই যেন ওকে দগ্ধ করে তুলেছে–তা বন্দী জীবনের চিন্তা। বার বার ও বলেছে, আমি জানি না, আমি জানি না। কোথায় যে এর শেষ কোনো ধারণাই নেই আমার। এখান থেকে কী করে আমি মুক্তি পাবো? কী করে? জানি না কিন্তু আমি মুক্তি পেতে চাই।
পিটার্সের কথাগুলো ছিল দৃপ্ত। মোহভঙ্গের ক্রোধে জ্বলে ওঠা গভীর প্রত্যয় ছিলো তাতে। যে জায়গায় সে এসে পড়েছে, তার পরিচালকদের বুদ্ধিমত্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কিন্তু হিলারীর মনে হলো, হয়তো ছমাস এখানে থাকলে পিটার্স আর সেও টম বেটারটনের মতো দুর্বল হয়ে পড়বে।
পাশের এই দরদী মানুষটার কাছে মনের কথা সব উজাড় করে দিতে ইচ্ছে হলো হিলারীর। শুধু–যদি সে বলতে পারতো : টম বেটারটন আমার স্বামী নয়। ওর সম্পর্কে কিছুই জানি না আমি। জানি না এখানে আসার আগে ও কেমন লোক ছিল। কিছু জানি না আমি–সম্পূর্ণ অন্ধকারে রয়েছি। ওকে আমি সাহায্য করতে পারি না, কারণ ওকে কী বলবো কী করবো কিছুই যে জানি না।
একথা মনে হতেই সাবধান হয়ে উত্তর দিলো হিলারী। বললো, টমকে এখন আমার কেমন যেন অচেনা মানুষ বলে মনে হয়। ও আমাকে কিছু বলে না। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় এই খোঁয়াড়ে বন্দী থাকার চিন্তায় ও পাগল হতে বসেছে।
–খুবই স্বাভাবিক, পিটার্স বললো, হতেই পারে।
–কিন্তু আপনি বলুন–একটু আগে আপনি জোর গলায় এখান থেকে পালাবার কথা বলছিলেন। কেমন করে পালাবেন? সত্যিকারের কোনো সম্ভাবনা কি দেখতে পাচ্ছেন?
-সমস্ত ব্যাপারটা চিন্তা করে, পরিকল্পনা করে আমাদের পালাতে হবে। কত বন্দীই তো কত অসম্ভব জায়গা থেকে পালায়। জার্মানির বন্দীশালা থেকে পালানোর ঘটনা নিয়ে আমার এবং আপনার দেশে তো কত বই লেখা হয়েছে।
-সেটা সম্পূর্ণই আলাদা ব্যাপার।
–মূল কথাটা কিন্তু আলাদা নয়। যেখানে ঢোকার রাস্তা আছে, বেরুনোর রাস্তাও নিশ্চয়ই আছে সেখানে। যদি মনের জোর নিয়ে এগোনো যায়, তাহলে ছদ্মবেশ ধরে, অভিনয় করে, ঘুষ দিয়ে বা যে-কোনো শঠতার আশ্রয় নিয়ে এগোলে এ কাজ অসম্ভব নাও হতে পারে। তবে অনেক ভাবতে হবে–বুদ্ধি বের করতে হবে। এখন আমি জোর গলায় বলছি–এখান থেকে আমি পালাবোই, সে যেভাবেই হোক।
–আপনি তা পারবেন বলেই বিশ্বাস করি, কিন্তু আমি কি পারবো?
–তা-আপনার ক্ষেত্রে অবশ্য এটা আলাদা।
পিটার্সের গলাটা যেন কেমন ধরা ধরা ঠেকছিলো হিলারীর কানে। ওর কথাটা উপলব্ধি করতে মুহূর্তের জন্য মনটা থমকে দাঁড়ালো। মনে পড়লো–সে যে তার ইঙ্গিত বস্তু লাভ করেছে এটাই তো লোকের ভাবা স্বাভাবিক। এখানে সে এসেছে প্রিয়তমের সঙ্গে মিলিত হতে। এখানে একা পালানোর প্রয়োজনীয়তা নিশ্চয় থাকতে পারে না।
এই মুহূর্তে পিটার্সকে সত্যি কথাটা বলে দেবার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় ছটফট করে উঠলো হিলারী–কিন্তু কোন্ এক শক্তি যেন তাকে থামিয়ে দিলো।
শুভরাত্রি জানিয়ে তাড়াতাড়ি সে ছাদ থেকে নেমে এসেছিলো।
১৬. রোগা পাতলা মেয়েটি
১৬.
–শুভ সন্ধ্যা, মিসেস বেটারটন।
-শুভসন্ধ্যা মিস জেনসেন।
চশমা পরা রোগা পাতলা মেয়েটিকে বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছিলো। মোটা কাঁচের পেছনে চোখ দুটো চকচকে করছে। বললো, আজ রাত্রে একটা পুনর্মিলন উৎসব হবে। পরিচালক স্বয়ং আমাদের সামনে ভাষণ দেবেন।
-বাঃ ঢমকার, কাছেই পিটার্স দাঁড়িয়ে ছিলো, সে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো। পরিচালককে একবার চোখে দেখার জন্য আমি দিন গুনছিলাম।
মিস জেনসেন কড়া চোখে তাকিয়ে বললো, আমাদের পরিচালক, অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি।
-এখানে থাকার সবচেয়ে মুশকিল হচ্ছে, কোথায় যে যাচ্ছেন তা কখনোই সঠিক জানতে পারবেন না। আমিও আমেরিকা ছাড়ার আগে যদি জানতে পারতাম যে এসব আদর্শ টাদর্শ ধোঁকা, আসলে কোনো স্বৈরাচারীর খপ্পরে গিয়ে পড়ছি, তাহলে
–আসলে যে এরা তা নয়, সেটাও কিন্তু এখনও জানতে পারেননি, হিলারী স্মরণ করিয়ে দিলো।
–হুঁ, এখানের বাতাসে যেন সেই রকম গন্ধই পাচ্ছি।
–সত্যি! হিলারী প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো। আপনি এখানে আছেন বলে কী ভালোই না লাগছে।
মিস জেনসেনের ঘোষণা মতো নৈশভোজের পর সেই পুনর্মিলন উৎসবের আসর বসলো, সংস্থার প্রতিটি সদস্য এসে বিশাল বক্তৃতা ঘরে জড়ো হয়েছে।
শ্রোতাদের মধ্যে সবরকমের পেশার লোক রয়েছে এখানে। কারিগরী শিক্ষার লোকজন ছাড়াও সেখানে রয়েছে ব্যালে নাচের একটি দল, সামরিক তকমা আঁটা কিছু হোমরাচোমরা। এছাড়া একপাশে রয়েছে সুন্দরী মেয়েদের দল। এরা এই সংস্থার যে-সমস্ত পুরুষের স্ত্রী নেই বা যারা এখানকার নারী কর্মীদের সঙ্গে কোনোরকম বিশেষ সম্পর্ক পাতায়নি তাদের দৈহিক সাহচর্য দান করে সংস্থার সেবা করে।
বেটারটনের পাশে বসে হিলারী দারুণ উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছিলো, কখন সেই প্রায় অলৌকিক চরিত্রটি পরিচালক, বক্তৃতা মঞ্চে পা দেবেন। টমকে জিজ্ঞেস করায় কিছু ভাসা ভাসা উত্তর পেয়েছে সে।
টম বলেছিলো, দেখার মতো কোনো বৈশিষ্ট্য তার নেই, কিন্তু তার উপস্থিতির একটা তীব্র প্রভাব আছে। আসলে আমিও তাকে দুবারের বেশি দেখিনি। প্রত্যেকে অনুভব করে কী দারুণ প্রভাব ওঁর-সত্যিই তাই, অথচ কেন, তা আমি আজও বুঝতে পারিনি।
শ্রদ্ধায় গদগদ মিস জেনসেন ও আর কটি মহিলা পরিচালক সম্পর্কে আলোচনা করছিলো। হিলারী মনে মনে পরিচালকের একটি ছবি ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করলোসোনালি শ্মশ্রুগুম্ফমণ্ডিত আনন, শ্বেতশুভ্র উত্তরীয়-আবৃত দীর্ঘ ঋজু দেহ–অনেকটা দেবতার মতো আবছা একটা ছবি।
শ্রোতৃবৃন্দ নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াতে হঠাৎ সে চমকে দাঁড়ালো। হিলারী দেখলো, একজন মধ্যবয়সী মোটাসোটা লোক ধীর পায়ে মঞ্চে উঠে এলো।
তিনটি ভাষায় তিনি বক্তৃতা করলেন। প্রথমে ফরাসি, তারপর জার্মান তারপর ইংরেজি তিনটি ভাষায় সমান সাবলীলতায় অনর্গল কথা বলছিলেন।
নবাগত সহকর্মীদের কিছু প্রশস্তি জানিয়ে তিনি এই সংস্থার উদ্দেশ্য এবং চিন্তাধারা সম্পর্কে দীর্ঘ বক্তৃতা করলেন।
পরে তাঁর কথাগুলো মনে করতে চেষ্টা করে বিফল হয়েছে হিলারী।
নিরাসক্তির প্রবল বাধাসত্ত্বেও কথাগুলো যেন তীব্র উন্মাদনায় হিলারীর মনের অর্গল মুক্ত করে তাকে নাড়া দিতে লাগলো, তাকে ভাসিয়ে নিয়ে চললো। পরিচালক অত্যন্ত সহজভাবে ব্যাখ্যা করছিলেন। তাঁর বক্তৃতার প্রায় সবখানি জুড়ে যৌবনের গুণগান। যৌবনের পরেই মানবজাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
পুঞ্জীভূত অর্থ, প্রতিপত্তি, ক্ষমতাবান মুষ্টিমেয় পরিবার–এ সমস্ত পুরোনো দিনের নির্ধারক শক্তি। কিন্তু আজ, যুবসমাজই সেই শক্তির ধারক। মানুষের বুদ্ধিই হচ্ছে আসল শক্তি। সে বুদ্ধি রসায়নশাস্ত্রে, পদার্থবিদ্যায়, শারীরবিদ্যায়…গবেষণাগার থেকেই ব্যাপক ধ্বংসকার্যের শক্তি স্ফুরিত হয়। আমাদের এই সংস্থা, সারা দুনিয়ার সেই শক্তিমানদের সমন্বয় ক্ষেত্র। এখানে আপনারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে জড়ো হয়েছেন, সঙ্গে এনেছেন সৃজনী বিজ্ঞানের নানান তথ্য জ্ঞান, আর এনেছেন–আপনাদের যুবশক্তি। এমন একদিন আসবে, যখন আমরা আমাদের একটা অছি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারবো। বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিমত্তার জিম্মাদার হবে এই অছি-সংস্থা। পুঁজিপতি আর রাজাদের ওপর আমরা হুকুম করবো–সৈন্যবাহিনী আর শিল্পসংস্থা চলবে আমাদের নির্দেশে।
আচমকা বক্তৃতা শেষ করলেন পরিচালক। সাহস এবং জয়। শুভরাত্রি! হলঘর থেকে বেরিলয়ে এলো হিলারী–কেমন যেন স্বপ্নাচ্ছন্ন মূক। আশপাশের সব মুখগুলোই এই অনুভূতির ছাপ দেখলো।
হঠাৎ কনুইয়ের কাছে তার স্পর্শ অনুভব করলো হিলারী। অ্যান্ড্রু পিটার্স! কানের কাছে মুখ এনে বললো, চলুন ছাদে যাই। একটু হাওয়ার দরকার এখন।
লিফটে উঠে কেউ কোনো কথা বললো না। ছাদে এসে, তারাভরা আকাশের নিচে পামগাছের জটলার মধ্যে হারিয়ে গেলো দুজনে। পিটার্স গভীর শ্বাস টেনে বললো, আ! এইটাই দরকার ছিলো। এমন হাওয়া যা অহঙ্কারের ঘন মেঘকে দূরে তাড়িয়ে নিয়ে যায়।
হিলারী উত্তরে শুধু দীর্ঘ করে একটা শ্বাস ফেললো। এখনও যেন ঠিক প্রকৃতিস্থ হতে পারছে না সে।
পিটার্স আলতো করে ওর হাতখানা তুলে নিলো। এসব ভুলে যাও অলিভ। এসব ভুলে যাও। তুমি নারী সম্পূর্ণ নারী হয়ে যাও। বাস্তবে ফিরে এসে রূঢ় বাস্তবকে দেখো। এই অহঙ্কারের বিষ বাষ্পের রেশ যখন কেটে যাবে, তখন বুঝতে পারবে–সেই আগের মতো, সেই পুরোনো কথাগুলিই তুমি শুনছিলে।
–কিন্তু সত্যিই সুন্দর মানে, চমৎকার আদর্শ এটা।
–আদর্শের নামে এ পাগলামি। ঘটনাগুলো সাজাও। যুবশক্তি এবং মস্তিষ্ক–চমৎকার! একেবারে স্তোত্রপাঠ। আর এই যুবশক্তি আর মস্তিষ্কের ধারক কারা? এতক্ষণ যে বক্তৃতা শুনে এলে তার মোদ্দা কথা হচ্ছে-সাংঘাতিক ক্ষতিকর পাগলামি।
আলসের ওপর বসে পড়ে হিলারী বললো, আপনি হয়তো বুঝবেন আপনার কথাই ঠিক বলে আমি বিশ্বাস করি…কিন্তু অহঙ্কারের সেই ঘন মেঘ যে এখনও থমকে রয়েছে। এই মেঘ উনি কিভাবে সৃষ্টি করতে পারলেন? উনি কি নিজেই এসব বিশ্বাস করেন?
উদাস স্বরে পিটার্স বললো, শেষ পর্যন্ত কিন্তু সব জিনিষেরই একই পরিণতি হয়। আর প্রত্যেক পাগলই নিজেকে ঈশ্বর বলে ভাবে।
হঠাৎ হিলারীর কি মনে হলো, বললো, কাজটা বোধহয় ঠিক করিনি। বেটারটন কী ভাববে? নিশ্চয়ই বিসদৃশ লাগবে ওর চোখে।
-না না, আমার তা মনে হয় না। ও হয়তো খেয়ালই করেনি।
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে পিটার্স বললো, আমি দুঃখিত অলিভ। এ জায়গাকে তোমার নিশ্চয়ই সাজানো নরক বলে মনে হচ্ছে। তোমার স্বামী ধীরে ধীরে সেই নরকের পাঁকে ডুবে যাচ্ছে।
এখান থেকে আমাদের পালাতেই হবে–পালাতেই হবে।
আমরা পালাতে পারবো।
একথা তো আগেই বলেছো পিটার্স–কিন্তু এতটুকুও এগোতে পারিনি আমরা–ওর হাতটা আঁকড়ে ধরলো হিলারী।
পেরেছি বইকি। আমি চুপ করে বসে নেই। বিস্ময়ে স্তব্ধ মুক দৃষ্টি তুলে তাকালো হিলারী।
কোনো পরিকল্পনা ঠিক করিনি, কিন্তু তলে তলে আমি একে ধ্বংস করার কাজ শুরু করে দিয়েছি। প্রচণ্ড অসন্তোষ ধুমায়িত হয়ে রয়েছে এখানে–সে অসন্তোষ, সে বিদ্বেষ আমাদের ‘প্রভু পরিচালক কল্পনা করতেও পারবেন না। এ অসন্তোষ এখানকার নিচুতলার মধ্যেই সবচেয়ে ব্যাপক। খাদ্য, অর্থ, বিলাসিতা এবং নারীই জীবনের সবকিছু নয়। আমি তোমাকে এখান থেকে উদ্ধার করবোই, অলিভ।
–আর টম?
পিটার্সের মুখখানা থমথমে হয়ে উঠলো। শোনো অলিভ, আমার কথা বিশ্বাস করো, টম এখানে থাকার জন্যই আপ্রাণ চেষ্টা করবে। হ্যাঁ সে…বাইরের জগতের চেয়ে এখানেই অনেক বেশি নিরাপদ মনে করবে।
নিরাপদ? কী বলছো তুমি পিটার্স? হিলারী বললো, তুমি ঠিক কি বলতে চাইছো আমি বুঝতে পারছি না, টম–নিশ্চয়ই এ কথা বোঝাতে চাইছে না যে, সে সম্পূর্ণ পাগল হয়ে গেছে।
মোটেই না। হয়তো সে খুবই অস্থির হয়ে পড়েছে, কিন্তু আমি বলবো বেটারটন ঠিক তোমার আমার মতোই সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ।
–তাহলে সে নিরাপদে এখানে থাকবে, একথা বলছো কেন?
খুব ধীরে ধীরে পিটার্স বললো, খাঁচার মতো নিরাপদ জায়গা আর নেই, একথা স্বীকার করবে?
-না, প্রায় চিৎকার করে উঠলো হিলারী। তুমিও যে একথা বিশ্বাস করো তা বোলো না আমায়। নিরাপদ, পোষমানা, সুখী জীবন? না, আমরা বিদ্রোহ করবোই। মুক্তি আমাদের চাই-ই।
-জানি, কিন্তু…তুমি জানো না টম এখান থেকে মুক্তি পাবার জন্য ছটফট করছে।
–টম হয়তো জানে না তার পক্ষে কোন্টা ভালো কোন্টা মন্দ।
হঠাৎ টমের কথায় হিলারীর মনে পড়ে গেলো। তাই তো, সে যদি কোনো গোপন তথ্য ফাস করে দিয়ে থাকে, তাহলে তো তাকে সরকারী গোপনীয়তা রক্ষা আইনানুসারে শাস্তি পেতে হবে! হিলারী আবার বললো, টমও যাবে আমাদের সঙ্গে।
পিটার্সের গলায় তিক্ততার আভাস পেয়ে ভীষণ চমকে গেলো হিলারী। নিজের কথা আগে ভাবো। আমি বার বার তোমায় বলেছি, অলিভ। ওই লোকটা কে–কেন তুমি ওর জন্য এত ভেবে মরছো আমি বুঝতে পারছি না।
আতঙ্কে স্থির চোখ মেলে চেয়ে রইলো হিলারী। অনেক অনেক কথা সে বলতে চেয়েছিলো। অনেক কষ্টে সে নিজেকে সংযত করলো।
বিছানায় শুয়ে টম সিগারেট টেনে হিলারীকে বললো, আমেরিকান বন্ধুটির সঙ্গে খুব ভাব জমেছে দেখছি!
হিলারীর গাল দুটো লাল হয়ে উঠলো। বললো–আমরা একসঙ্গে এখানে এসেছি। তাছাড়া কিছু কিছু বিষয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনাও এক।
টম বলে উঠল, না না, তোমাকে আমি দোষ দিচ্ছি না। সত্যিই তোমাকে খুব সুন্দর দেখতে অলিভ।
সেই প্রথম দিন থেকে হিলারী টমকে বার বার অনুরোধ করেছে তাকে তার স্ত্রীর নাম ধরে ডাকতে। এতদিনে আজ ডাকলো।
হিলারীকে ভালো করে দেখে টম বললো, সত্যিই তুমি অসম্ভব সুন্দরী। একটিবার অত্যন্ত এটা আমার চোখে পড়া উচিত ছিলো। কিন্তু এখন সবকিছুর মতো এও আমার মনে রেখাপাত করে না।
হিলারী বললো, হয়তো এটাই স্বাভাবিক। হিলারী টমের পাশে গিয়ে বসলো। বললো, তোমার কী হয়েছে বলে তো টম?
–তোমাকে তো বলেছি, একটুও কাজে মন বসাতে পারছি না আমি। বিজ্ঞানী হিসেবে আমি চুরচুর হয়ে ভেঙে পড়েছি। এই জায়গা
–অন্যেরা সবাই-বা বেশির ভাগ লোকই এখানে–তোমার মতো কই ভাবে না তো?
–কারণ–তারা সব জঘন্য অনুভূতিশূন্য মানুষের খোলস।
অনেকেরই কিন্তু অনুভূতি বেশ প্রবল। তোমার যদি এখানে একজন বন্ধু থাকতো সত্যিকারের একজন বন্ধু
-হ্যাঁ আছে, ওই মার্চিসন। মাথায় অবশ্য কিসসু নেই। সম্প্রতি টরকুইল এরিকসনের সঙ্গে বেশ জমিয়ে নিয়েছে।
–সত্যিই মাথা আছে লোকটার। ওর মতো যদি আমার বুদ্ধি থাকতো।
হিলারী বললো, কেমন যেন অদ্ভুত লোক। ভদ্রলোককে তো আমার সবসময়ে ভীতিকর বলে মনে হয়।
–ভীতিকর? টরকুইল? না না–একেবারে মাটির মানুষ ও। ছোট্ট শিশুর মতো–দুনিয়া সম্পর্কে কোনো জ্ঞানই জন্মায়নি এখনও।
হিলারী আতঙ্কে বললো, তবুও আমার যেন কেমন ভয় ভয় করে।
–উ–তোমার মনের জোর কমে আসছে মনে হচ্ছে।
-এখনও কমেনি, তবে কমবে বলেই ভয় হচ্ছে। টম-তুমি ওই টরকুইল এরিকসনের সঙ্গে বেশি মিশো না।
স্থির চোখে তাকালো টম, কেন?
-তা জানি না। কিন্তু আমার মনে হয়–আমি অনুভব করি এটা।
.
১৭.
ঘনঘন কাঁধ ঝাঁকাতে লাগলো লেবল্যাঙ্ক। ওরা যে আফ্রিকা ছেড়ে গেছে, এটা কিন্তু নিশ্চিত।
ফরাসি ভদ্রলোকটি বললো, ঠিক নিশ্চিত না হলেও সেটা একটা সম্ভাবনার দিক।
–আমরা যা ভাবছি সেটাই যদি ওদের গন্তব্যস্থল হয়, তাহলে আফ্রিকা থেকে ওরা যাত্রা শুরু করবে কেন? ইউরোপের যে-কোনো স্থল থেকেই এটা অনেক সহজ হতে পারতো।
–তা ঠিক। কিন্তু এখানে জড়ো হয়ে এখান থেকে যাত্রা করার কথা কেউ সন্দেহই করতে পারবে না।
এছাড়া আরো কিছু কারণ আছে বলে আমার মনে হচ্ছে, জেসপ বললো। ওই বিমানবন্দরে একমাত্র ছোট প্লেনই ওঠানামা করে। ভূমধ্যসাগর পার হবার আগে তাকে তেল নেবার জন্য এখানে নামতেই হবে। আর এখানে তারা তেল নিতে নামবে, সেখানে কিছু না কিছু সূত্র পড়ে থাকবেই।
–তেজস্ক্রিয়তা ধরার বিশেষ যন্ত্রে একসময়-না-একসময়ে ধরা পড়বেই। খুব অল্প সংখ্যক প্লেন পরীক্ষা করলেই চলবে।
জায়গাটা আমরা খুঁজে পাবোই। জেসপ নাছোড়বান্দা হয়ে বললো। আমার মনে হচ্ছে কি জানো?
আমরা তো ধরেই নিয়েছি ওরা উত্তর দিকে গেছে–মানে ভূমধ্যসাগরের দিকে-ধরো তার বদলে, ওরা যদি দক্ষিণে গিয়ে থাকে।
–মানে–একই পথে ওরা দুবার ঘুরে গেছে বলতে চাইছেন? কিন্তু তাহলে ওরা যাবে কোথায়? সুউচ্চ অ্যাটলাসের উঁচু উঁচু চুড়ো–আর তার ওপারে অনন্ত বিস্তৃত মরুভূমি।
.
মিশকালো গম্ভীর মুখটার দিকে চিন্তিতভাবে তাকালো পিটার্স। ওই কালো চেহারায় ধবধবে সাদা পোশাকে অপূর্ব দেখাচ্ছিলো মহম্মদকে। পিটার্স বললো, আমরা যদি এখান থেকে বেরোতে পারি তবেই তোমার বাসনাটা পূরণ হবে।
কালো ঠোঁটের আড়াল থেকে ঝকঝকে কটা সাদা দাঁত হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। না পারলে মৃত্যু আমার ক্ষেত্রে এটা নিশ্চিত। আপনার ক্ষেত্রে হয়তো তা হবে না কারণ এদের কাছে আপনি মূল্যবান।
–এখানে এরা মৃত্যুকে খুব সাধারণ চোখে দেখে, তাই না?
মহম্মদ বললো, মৃত্যু! কী তা জানি না। সেটাও নিশ্চয়ই আল্লাহর ইচ্ছা।
-তোমাকে কী কী করতে হবে বুঝে নিয়েছ তো?
-বুঝেছি, বাবু। অন্ধকার নামলে আপনাকে ছাদে নিয়ে আসতে হবে। আমি আর অন্যান্য চাকরবাকরেরা যে পোশাক পরি, সেইরকম একটা পোশাক আপনার ঘরে রেখে আসতে হবে। পরে–অন্য কাজগুলো করতে হবে।
-ঠিক আছে, এবার বরং তুমি আমাকে লিফট থেকে নামিয়ে দাও। কেউ হয়তো দেখে ফেলবে যে, বার বার আমরা ওঠানামা করছি। হয়তো কিছু সন্দেহ করবে।
নাচ চলছিলো, অ্যান্ড্রু পিটার্স জেনসেনের সঙ্গে পা মেলাচ্ছিলো। জেনসেনের কানের কাছে কিছু বলছিলো। ঘুরতে ঘুরতে ওরা হিলারীর কাছে এলো। আর তখনি হিলারীকে চোখ টিপে কী যেন ইঙ্গিত করলো।
হিলারী দ্রুত চোখ সরাতেই ওধারে বেটারটনকে দেখলোটরকুইল এরিকসনের সঙ্গে গল্প করছে। দুজনকে একসাথে দেখে নিজের অজান্তেই ভুরু দুটো কুঁচকে উঠলো হিলারীর।
হিলারীর কানের কাছে এসে মার্চিসন জিজ্ঞেস করলো, আমাদের সঙ্গে একটু নাচবে নাকি অলিভ?
বললো, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই নাচবো, সাইমন।
মার্চিসন সাবধান করে দিলো হিলারীকে, আগেই কিন্তু বলে রাখছি, আমি মোটেই ভালো নাচতে পারি না। হিলারীকে বললো, বিয়াঙ্কাকে তোমার কথা বলেছিলাম, এখানে এসে চমৎকার মানিয়ে নিয়েছ তুমি। সত্যিই চমৎকার জায়গা। টাকাপয়সার জন্য ভাবতে হয় না, আয়কর দেবার ঝঞ্ঝাট নেই, কোথায় কখন কোনটা প্রয়োজন, আগে থেকেই সে ব্যবস্থা করে রাখে।
আচ্ছা–টম কোথায় গেলো?–ও ওই তো টরকুইলের সঙ্গে গল্প করছে। টরকুইল ডোকরা তোমার ভক্ত হয়ে পড়েছে।
এক চক্কর নাচ শেষ হলো। অ্যান্ড্রু পিটার্স পরের বার হিলারীর সঙ্গে নাচতে চাইলো।
–আমি আমার কাজ গোছাচ্ছিলাম, দেখেছো তো? আঁ! ওই জেনসেনের সঙ্গে?
–হা, রাখঢাক না করে যদি বলি তাহলে বলতে হয়, এই ধরনের মেয়েদের পটাতে পারলে খুব সহজেই গলে যায়।
-তুমি নিশ্চয়ই ওর প্রেমে পড়ার ভান করছো?
-তা তো বটেই। এই মেয়েটাকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলে অনেক খোঁজখবর আমরা পাবো; অলিভ, এখানকার অভিসন্ধি ও সব জানে। এখানে কিছু লোকের সমাবেশ ঘটবে, এটা ওঁর কাছ থেকে জানতে পারলাম।
অ্যান্ড্রু তুমি কি ভাবছো তখন কোনো সুযোগ পাওয়া যাবে…?
-না, তা আমি মনে করছি না। কারণ, আমার ধারণা ওই সময়ে যথেষ্ট কড়া ব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু এর থেকে অনেক ধারণা গড়তে পারবো–এই সময়ে কেমন ধরনের ব্যবস্থা করা হয়। সেইমতো পরের বার কিছু ব্যবস্থা করা যাবে। এই সময়টাতে জেনসেনকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখলে ওর কাছ থেকে খোঁজখবর আদায় করতে পারবো।
-যারা আসছে তারা এখানকার সম্পর্কে সবকিছু জানে?
–আমাদের-মানে এই সংস্থা সম্পর্কে কিছু জানে না। আমার মনে হয় ওরা শুধু এখানকার ব্যবস্থাপত্র দেখবে একটু, বড়জোর ডাক্তারি গবেষণাগারগুলো একবার পরিদর্শন করবে। এই জায়গাটাকে ইচ্ছে করেই একটা গোলকধাঁধার মতো করে সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে বাইরের কেউ ভেতরে এলেও এর কোথায় কী আছে সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা করতে না পারে। আমার ধারণা–কোনো একটা গোপন দরজা আছে, যেটা বন্ধ করে দিলে আমাদের এদিকটা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
সবকিছুই যেন কেমন অদ্ভুত শোনাচ্ছে। জানি, এখানে থাকলে অর্ধেক সময়ই স্বপ্নের ঘোরে কাটাতে হয়। এখানকার সবচেয়ে আশ্চর্য জিনিষ হচ্ছে–এখানে একটি শিশু দেখা যায় না। নেই তাই রক্ষে! তোমারও যে কোনো শিশুসন্তান নেই এটা তোমার পক্ষে যথেষ্ট সুখের বিষয়।
হিলারীকে হঠাৎ কেমন আড়ষ্ট হয়ে যেতে দেখলো পিটার্স। নিজেও সে অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। আমি দুঃখিতনা জেনে হয়তো ভুল কিছু বলে ফেলেছি!
-না না, কিছু ভুল বলনি তুমি। সত্যিই আমার সন্তান ছিলো…সে মারা গেছে…
–তোমার সন্তান ছিলো? বিস্ময়ে স্থির হয়ে তাকালো পিটার্স। আমি ভেবেছিলাম–মানে শুনেছিলাম যে বেটারটনের সঙ্গে তোমার মাত্র ছমাস আগে বিয়ে হয়েছে!
অলিভ আরক্ত হয়ে উঠলো, তাড়াতাড়ি বললো, হ্যাঁ ঠিকই শুনেছে। কিন্তু আমি আগেও একবার বিয়ে করেছিলাম। প্রথম স্বামীর সঙ্গে আমার বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেছে।
হিলারী বলে উঠলো, আমিও তোমার কথা কিছুই জানি না। কেমনভাবে তুমি মানুষ হয়েছে, কোথায়–তোমার বাড়ির কথা
–আমি একদম কড়া বৈজ্ঞানিক আবহাওয়ায় মানুষ। বিজ্ঞানের কথা ছাড়া আর কোনো কথা কেউ বলতো না। হঠাৎ পিটার্স বলে উঠলোনাঃ, ওসব কথা আর ভাবতে চাই না–এখানে, এই মুহূর্তে আমাদের অনেক কাজ রয়েছে।
হিলারী, টরকুইল এরিকসনকে দেখে চিন্তা করলো যে ওর সাথে বোরিস গ্লাইদরের বর্ণনা হুবহু মিলে যাচ্ছে। জেসপের কাছ থেকে বোরিসের যে বর্ণনা শুনেছিলো, তার সঙ্গে এ বর্ণনার এতটুকুও পার্থক্য নেই। হিলারী পিটার্সকে জিজ্ঞেস করলো, উনি সত্যিই এরিকসন তো? মানে–অন্য কেউ হতে পারে না নিশ্চয়? না মানে আমি বলতে চাইছি–উনি এরিকসন সেজে এখানে আসেননি তো?
ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ চিন্তা করলো পিটার্স। না, আমার তা মনে হয় না, ও যে বিজ্ঞানী এতে কোনো সন্দেহ নেই, তাছাড়া…এরিকসন, ওদেশে অতি সুপরিচিত ব্যক্তি।
–কিন্তু এখানকার কেউ তো ওঁকে আগে কখনো দেখেনি? কিংবা একদিকে উনি হয়তো সত্যিই এরিকসন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় একটা সত্তাও ওঁর থাকতে পারে।
-তুমি বলতে চাইছে-এরিকসন দ্বৈত জীবন যাপন করছে? হ্যাঁ, তা হতে পারে। কিন্তু এটা বোধহয় ঠিক বাঞ্ছনীয় নয়।
-না! মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়।
না, এরিকসন কক্ষনো বোরিস গ্লাইদর হতে পারে না। কিন্তু অলিভ বেটারটন কেন বার বার টমকে বোরিস সম্পর্কে সাবধান করে দেবার জন্য পীড়াপীড়ি করেছিলো? সে কি জানতে পেরেছিলো যে, রোরিস এই সংস্থায় আসার জন্য রওয়ানা হয়ে গেছে? আচ্ছা এও তো হতে পারে–লন্ডনে যে লোকটা বোরিস গ্লাইদর বলে পরিচয় দিয়েছিলো, আসলে সে বোরিস নয়? সেই হয়তো আসলে টরকুইল এরিকসন! বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। এখানে আসার পর থেকে সে টমের প্রতি বড্ড বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। যাইহোক্ এরিকসন যে একজন সাংঘাতিক লোক হতে পারে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
অলিভ-কী হলো তোমার? এমন করছো কেন?
-নাহ ও কিছু না। ওদিকে দেখো, সহকারী পরিচালক বোধহয় কিছু ঘোষণা করবেন বলে মনে হচ্ছে।
ডাঃ নিয়েলসন হাত তুলে সবাইকে চুপ করতে বলছিলেন, বন্ধু এবং সহকর্মীবৃন্দ। আগামীকে আপনাদের সকলকে জরুরী বিভাগে থাকার জন্য নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। বেলা ঠিক এগারোটার সময়ে আপনারা এক জায়গায় জড়ো হবেন, সেখানে প্রত্যেকের নাম ডাকা হবে। আপনাদের সামান্য যেটুকু অসুবিধা হবে তার জন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করছি।এই বলে তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন, আবার বাজনা শুরু হলো।
আবার আমাকে জেনসেনের শরণাপন্ন হতে হবে, পিটার্স বললো। থামের আড়াল থেকে ও সাগ্রহে আমাকে লক্ষ্য করছে। ওর কাছ থেকে জেনে নিতে হবে, এই জরুরী বিভাগের কোথায় কী আছে। এই বলে সে জেনসেনের দিকে এগিয়ে গেলো।
নতুন করে আবার ভাবতে লাগলো অলিভ। সত্যিই কি তার এই চিন্তাটা নেহাত কল্পনা? টরকুইল এরিকসন? বোরিস গ্লাইদর? এরা কি…
বিশাল হলঘরে এক এক করে নাম ডাকা হচ্ছিল। সবাই উপস্থিত। নাম ডাকার সঙ্গে সঙ্গে এক-একজন করে সাড়া দিচ্ছিলো। নাম ডাকা শেষ হতে সবাইকে দাঁড় করানো হলো, তারপর কুচকাওয়াজের ভঙ্গিতে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দেওয়া হলো।
পথ সেই একই রকম, অজস্র বারান্দায় পাক খাওয়া গোলকধাঁধার জটিলতা। অলিভ পিটার্সের পাশে পাশে হাঁটছিলো। পিটার্সের হাতের চেটোয় যে ছোট্ট দিকদর্শক যন্ত্র লুকানো আছে, সে জানে। এর থেকে পিটার্স একমনে দিক ঠিক করার চেষ্টা করছিলো।
–নাঃ, এতে কাজ হবে না মনে হচ্ছে, হতাশ সুরে গলা নামিয়ে বললো পিটার্স। কী জানি কেন–এই মুহূর্তে এটা কাজ করছে না। কিন্তু এক সময় হয়তো কাজে লাগবে–শেষ বারান্দার প্রান্তে একটা দরজা দেখা গেল। দরজাটা আপনা থেকে খুলে যেতে দেখে, সবাই একসঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়লো।
পিটার্স পকেট থেকে সিগারেট বের করার সাথে সাথেই ভ্যান হিদেম স্পষ্ট স্বর ভেসে এলোধূমপান করবেন না দয়া করে। একথা আগে থেকেই আপনাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
–দুঃখিত স্যার। পিটার্স বললো।
–একটু পরেই সবাইকে এগোতে বলা হলো।
হিলারী বললো, ঠিক যেন ভেড়ার পাল যাচ্ছে।
মেয়েদের থাকার জায়গায় আলাদা–ডানদিকে, মিস জেনসেন মেয়েদের নিয়ে ডানদিকে বেঁকে গেলো। ছেলেরা বাঁ-দিকে।
লম্বা শয়নঘরটা অনেকটা হাসপাতালের রোগীদের ঘরের মতো–দেওয়ালের দুধারে সার সার করে খাট পাতা-শালীনতা রক্ষার জন্য প্লাস্টিকের পর্দা টেনে আড়াল করার ব্যবস্থা তাতে। বিছানার পাশেই ছোট্ট একটা দেরাজ। হাসপাতালের মতোই কিসের গন্ধে ম ম করছে ঘরটা।
মিস জেনসেন বললো, এখানকার ব্যবস্থাপত্র একেবারেই ছিমছাম। ওই ডানদিকে স্নানঘর, আর ওপাশের ওই দরজার ওধারের ঘরে সকলের গল্পগুজব, খেলাধুলার ব্যবস্থা আছে।
গল্প করার ঘরে মেয়ে পুরুষ আবার একসাথে মিলিত হলো।
দিনের বেলাটা ভালোই কাটলো। ছোট্ট পর্দায় দুটো ছবি দেখানো হলো। ঘরে আলোর ব্যবস্থা চমৎকার। ঘরে যে জানালা নেই এটা ঢাকা দেবার জন্যই যেন দিনের আলো ফোঁটাবার সার্থক প্রয়াস। সন্ধ্যার দিকে নতুন আলোর ব্যবস্থা।
-বাঃ! চমৎকার বুদ্ধি তো! পিটার্স বললো। যাতে কেউ চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দী রয়েছে না ভাবতে পারে তার চমৎকার ব্যবস্থা।
হিলারী ভাবছিলো নিজেরা কত অসহায়। এখানে কোথাও তাদের খুব কাছেই, বাইরের দুনিয়া থেকে একটি দল এসে রয়েছে। অথচ তাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করার কোনো উপায় নেই।
পিটার্স মিস জেনসেনের সঙ্গে গল্প করছে বসে। হিলারী মার্চিসনদের কাছে ব্রিজ খেলার প্রস্তাব করলো। টম বেটারটনকে রাজি করানো গেল না। তার কিছুতেই মন বসছে না। ডাঃ ব্যারন ওদের সঙ্গে তাসে বসলেন।
আশ্চর্য! খেলতে খেলতে একসময় হিলারীর মনে হলো, খেলতে তো খারাপ লাগছে না। বেশ জমেছিলো খেলাটা, হিলারী হাতঘড়িটা দেখলো একবার। ও বাবা–অনেক রাত হয়ে গেছে দেখছি! তা আমাদের মহামান্য অতিথিরা এতক্ষণে নিশ্চয়ই চলে গেছেন–নাকি রাত্রে এখানে থাকবেন?
সাইমন বললো, ঠিক বলতে পারব না।
বিয়াঙ্কা বললো, যাই বলো ব্যবস্থাপত্র কিন্তু দারুণ ভালো। হিলারীকে সঙ্গে নিয়ে সে মেয়েদের ঘরে যাবার জন্য এগোল।
হিলারী তাকে এগিয়ে যেতে দিয়ে ইচ্ছে করেই একটু পিছিয়ে পড়লো। আর তখনই হাতে একটা মৃদু স্পর্শ অনুভব করলো। চট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলো, দীর্ঘকায় একজন সুরেশ ভৃত্য তার পাশে দাঁড়িয়ে। কালো গায়ের রঙ। ভৃত্যটি বললো, মাফ করবেন, মাদাম, আপনাকে আমার সঙ্গে আসতে হবে।
-আসতে হবে? কোথায় আসতে হবে?
দয়া করে আমার সঙ্গে আসুন—
মুহূর্তের সংশয় নিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইলো হিলারী। বিয়াঙ্কা ঘরে চলে গেছে। এ ঘরে মার্চিসন আর ডাঃ ব্যারন কী যেন আলোচনায় মগ্ন। হাতের ওপর আবার সেই জরুরী তাগিদের স্পর্শ। আসুন মাদাম।
হিলারী একটু ইতস্তত করে পা বাড়ালো।
অন্যান্য ভৃত্যদের তুলনায় এই ভৃত্যটির পোষাক-আশাক যে অনেক অভিজাত সেটা হিলারী দেখলো।
বসার ঘরের এককোণের একটা ছোট্ট দরজা দিয়ে সে তাকে নিয়ে চললো। তারপর আবার সেই গোলকধাঁধা বারান্দা। যে পথ দিয়ে তারা এখানে এসেছিলো, এটা সে পথ বলে মনে হলো না। সমস্ত পথগুলোই এমন নিখুঁত পরিকল্পনায় তৈরি যে, সবগুলোই একই রকম মনে হয়।
শেষ পর্যন্ত একটা বারান্দার শেষে এসে, দেওয়ালের গাছে একটা বোতাম টিপলো লোকটা। দেওয়ালের খানিকটা অংশ একপাশে সরে গেলো। পেছনে একটা ছোট্ট লিস্ট। হিলারীকে উঠতে ইঙ্গিত করে সে নিজেও উঠলো।
এবার সরাসরি প্রশ্ন করলো হিলারী। কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমায়?
লোকটি বললো, কর্তার কাছে, মাদাম, এটা আপনার পক্ষে দারুণ সম্মানের বিষয়।
-কর্তা–মানে? পরিচালকের কথা বলছো?
–না-কর্তার কাছে..
লিফট থামলো। একপাশে সরে দরজা খুলে সে হিলারীকে নামতে বললো। তারপর আবার বারান্দা পেরিয়ে একটা দরজা-ভৃত্যটি আস্তে আস্তে টোকা দিতে দরজাটা খুলে গেলো। এখানে আরেকজন ভৃত্য দাঁড়িয়ে আছে।
নতুন লোকটি হিলারীকে একটা ছোট্ট লাগোয়া ঘরের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে চললো। ঘরের মেঝেতে লাল কার্পেট, ওধারের দেওয়ালের ভারী পর্দা একদিকে সরানো। সেই নিচু নিচু সোফা, কফির টেবিল, নকশা কাটা সুন্দর পর্দা। আর একটা নিচু ডিভানে বসে একটা আবছা মূর্তি নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারলো না হিলারী। চামড়া কোঁচকানো, হলুদ রঙের ছোট্ট এক বৃদ্ধ–। অবিশ্বাসভরে স্থির চোখে বৃদ্ধ মিঃ অ্যারিস্টাইডসকে দেখতে লাগলো হিলারী।
.
১৮.
আসুন মাদাম, মিঃ অ্যারিস্টাইডস অভ্যর্থনা জানালেন। তার হাতের ইঙ্গিতে হিলারী একটা ডিভানে বসলো।
মিঃ অ্যারিস্টাইডসের গলায় অদ্ভুত চাপা অট্টহাসি ফুটলো। খুব অবাক হয়েছেন, তাই না? একেবারে অপ্রত্যাশিত, কি বলেন?
হিলারী বললো, তা বটে, আমি কল্পনাও করতে পারিনি যে, আপনি
মিঃ অ্যারিস্টাইডসকে চিনতে পারার সঙ্গে সঙ্গে, গত দশদিনের অবাস্তব স্বপ্নময় জগতের ছবিটা ভেঙে খান খান হয়ে গেলো। সত্যিই এটা একটা অবাস্তব সংস্থা। বাইরে থেকে যা বলে এটাকে প্রচার করা হয় আসলে এটা মোটেই তা নয়। মহামান্য পরিচালকের ওই মোহময় কণ্ঠস্বর, ওটাও অবাস্তব–আসল সত্য লুকিয়ে রয়েছে এখানে–এই ছোট্ট প্রাচ্য অনুভূতি মাখা ঘরটায়। এই বিশাল কর্মকাণ্ডের মধ্যমণি হিসেবে মিঃ অ্যারিস্টাইডসকে দেখে সবকিছুরই পরিষ্কার অর্থ খুঁজে পাওয়া গেলো–নিষ্ঠুর অথচ বাস্তব দৈনন্দিন জীবনের ছবিটা স্পষ্ট ফুটে উঠলো হিলারীর চোখে।
-এতক্ষণে বুঝলাম, এ সবকিছুই আপনার তাই না?–হিলারী বললো।
–ঠিকই বুঝেছেন, মাদাম।
–আর পরিচালক? আপনার ওই পরিচালক?
মিঃ অ্যারিস্টাইডস প্রশংসা করে বললো, খু-উ-ব ভালো লোক, অগাধ টাকা মাইনা দিই। ওঁকে। পুনরভ্যুত্থান সংক্রান্ত সভার বক্তৃতা দেওয়াই ওঁর প্রধান কাজ।
চিন্তিতভাবে কমুহূর্ত নীরবে ধূমপান করার পর তিনি হিলারীকে বললেন, ওখানে আপনার পাশে তুরস্কের বিখ্যাত পানীয় আছে। কিছু মিষ্টিও আছে। ইচ্ছে করলে নিতে পারেন। আবার কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললেন, আমি একজন জনহিতৈষী সামান্য মানুষ, মাদাম। আর আপনি তো জানেন আমি বিরাট ধনী। আমার এই অগাধ অর্থ নিয়ে, জনগণের সেবা করার একটা কর্তব্যজ্ঞান বার বার আমাকে পীড়িত করে। তাই এই মরুপ্রান্তরে কুষ্ঠরোগীদের সেবার জন্য আমি একটা আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছি। দুনিয়ার সবচেয়ে নামীদামী ডাক্তার, বিজ্ঞানীরা কুষ্ঠরোগ নিরাময়ের জন্য মূল্যবান গবেষণা চালাচ্ছেন এখানে। দেখা গেছে কয়েক ধরনের কুষ্ঠরোগই সারানো সম্ভব বাকিগুলো সম্ভব নয়, কিন্তু আমরা হাল ছাড়িনি। লোকে যেমন কুষ্ঠরোগকে ছোঁয়াচে মনে করে সেরকম ছোঁয়াচে নয়। বসন্ত, টাইফয়েড, প্লেগ বা ওই ধরনের রোগগুলো যেমন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, কুষ্ঠরোগ তত দ্রুত ছড়ায় না। তবুও আপনি যদি কাউকে বলেন, ওটা কুষ্ঠরোগীদের আশ্রম, সে সভয়ে অনেক দূরে চলে যাবে। কুষ্ঠরোগীদের প্রতি ভীতি সেই বাইবেলের কাহিনী থেকে শুরু হয়েছে। এই আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে আমি নিজেকে শান্তি দিয়েছি।
–শুধু এইজন্যই আপনি এ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন?
-হ্যাঁ। এখানে ক্যানসার নিয়ে গবেষণারও আলাদা বিভাগ রয়েছে আর যক্ষ্মারোগ নিয়ে উন্নতমানের কাজ সমাপ্তপ্রায়। জীবাণু নিয়ে গবেষণা চলছে। আমার এই বিস্ময়কর কাজ দেখে সারা দুনিয়া অবাক হয়ে গেছে। পৃথিবীখ্যাত ডাক্তার, শল্যচিকিৎসক, আর রসায়নবিদেরা মাঝেমাঝেই এখানে এসে আমাদের কাজ দেখে বিস্মিত হন। তেমনি একটা দল আজ এসেছে। এখানকার বাড়িগুলো অত্যন্ত নিপুণভাবে তৈরি, যার ফলে এর একটা বিশেষ অংশ বাইরের জগতের সামনে সম্পূর্ণ বন্ধ, এমনকি আকাশ থেকেও তা দেখা যায় না। অতি গোপনীয় গবেষণাগারগুলো পাহাড়ের নিচে সুড়ঙ্গ কেটে তৈরি। কোনো দিক দিয়েই কেউ এতটুকুও সন্দেহ করতে পারবে না কারণ–আমি কী বিরাট ধনী তা তো আপনি জানেনই।
-কিন্তু কেন? হিলারী বললো, কেন এই ধ্বংস যজ্ঞের আয়োজন?
–ধ্বংসের প্রতি আমার কোনো স্পৃহা নেই, মাদাম। আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন।
মিঃ অ্যারিস্টাইডস বলে চললেন, আমি একজন ব্যবসায়ী, সেই সঙ্গে আমি একজন সংগ্রাহকও। অর্থ যখন মানুষের কাছে পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে তখন তার থেকে মুক্তি পাবার একটামাত্র উপায়। সারাজীবনই অজস্র জিনিষ সংগ্রহ করেছি আমি। যেমন ধরুন–ইউরোপের সবচেয়ে সুন্দর এবং দামী ছবি, বিশেষ ধরনের মৃৎশিল্প এবং ডাকটিকিট সংগ্রহ। বিশেষ কয়েকটা জিনিষের নমুনা সংগ্রহ যখন সম্পূর্ণ তখন অন্য কিছু সংগ্রহের দিকে ঝোঁক পড়েই। আমি বৃদ্ধ মানুষ, তাছাড়া সংগ্রহ করার মতো কিছু বাকি নেই দেখে শেষ পর্যন্ত মানুষের মস্তিষ্ক সংগ্রহ করতে লেগে গেলাম।
হিলারী আঁতকে উঠে বললো, মস্তিষ্ক?
আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন তিনি, হ্যাঁ, মস্তিষ্ক মানুষের বুদ্ধি। সমস্ত বুদ্ধিমান মাথাগুলোকে এখানে এনে জড়ো করেছি। বুদ্ধিমান কাঁচামাথা, শুধু এরাই আমার সংগ্রহ।
বুঝতে পারছেন এটাই আমার পেশা হিলারীকে বললো, আমি টাকার ব্যাপারী।
–আপনি বলছেন–এসবের সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই? বিশ্বশক্তিকে নিজের হাতের মুঠোয় আনতে চান না?
ভর্ৎসনায় ভরে উঠলো তার মুখ। ঈশ্বরের আসনে বসার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই।
–কিন্তু এতসব নামী নামী লোকদের আপনি এখানে আনলেন কী করে?
–ওদের আমি কিনেছি। বেশির ভাগ সময়েই ওঁদের আমি কিনি আদর্শের বিনিময়ে। কখনো কখনো আমি তাদেরও কিনি যারা আইনের চোখে অপরাধী–তাদের কিনি নিরাপত্তার বিনিময়ে।
হিলারী বললো, এতক্ষণে সব বুঝতে পারলাম। এখানে আসার পথে যা যা দেখে আমি সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছিলাম, এতক্ষণে সেগুলো পরিষ্কার হলো।
-ও! আসার সময় তাহলে খুব আশ্চর্য হয়েছিলেন আপনি?
-হ্যাঁ। ছোট্ট প্লেনের পাঁচটি যাত্রী–প্রত্যেকের লক্ষ্য কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন। অ্যান্ড্রু পিটার্স, ওই–আমেরিকার যুবকটিকে দেখে মনে হয় সম্পূর্ণ বামমার্গী। কিন্তু এরিকসন, অতিমানবে শুধু বিশ্বাসী তাই নয়–একেবারে বদ্ধ পাগল। হেলগা নীডহেইম তো উদ্ধত, নিকৃষ্ট ধর্মের চণ্ডনীতির একনিষ্ঠ পূজারী। ডাক্তার ব্যারন, উনি স্রেফ টাকার জন্যই এসেছেন।
হ্যাঁ সত্যিই আপনি বুদ্ধিমতী, মাদাম। ফেজ-এ আপনাকে প্রথম দেখেই আমি বুঝে নিয়েছিলাম। আপনি হয়তো জানেন না, মাদাম, আমি ফেজ-এ গিয়েছিলাম স্রেফ আপনাকে দেখার জন্য।
-আচ্ছা! বিস্ময় প্রকাশ করলো হিলারী।
এখানকার অনেক কিছুই আস্তে আস্তে আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন মাদাম। তবে একটা বিষয়ে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন যে, যদিও এখানকার লোকেরা সবাই ভিন্ন ভিন্ন আদর্শ নিয়ে এসে মোহমুক্ত এবং বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে, কিন্তু আমি বলছি, শেষ পর্যন্ত এরা সব্বাই একটা মাত্র আদর্শ মেনে নিতে বাধ্য হবে।
হিলারী বললো, নিশ্চিতভাবে সে কথা আপনি বলতে পারেন না আপনি।
–এ দুনিয়ার কোনো বিষয়েই কেউ সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারে না। এদিক থেকে আমি আপনার সঙ্গে একমত।
কেমন যেন আতঙ্কিত চোখে তাকালো হিলারী। কী সাংঘাতিক! ঠিক যেন টাইপিস্টদের একটা দল-মুখের কথা খসামাত্রই মেসিন থেকে কিছু উগরে বের করে দেবে। টাইপিস্টদের বদলে আপনি এখানে কিছু মস্তিষ্কের সমাবেশ ঘটিয়েছেন শুধু।
–ঠিক তাই। ভারি সুন্দর ভাবে জিনিষটা বুঝিয়েছেন মাদাম।
আর এই দল থেকে আপনি এক-একজন বিজ্ঞানীকে বিক্রি করবেন যে সবচেয়ে বেশি দাম দেবে তার কাছে?
-হ্যাঁ, মোটামুটি এটাই হচ্ছে আমার সাধারণ নীতি, মাদাম। লোবোটমি কথাটা কখনও শুনেছেন, মাদাম? কপালে ভাঁজ পড়লো হিলারীর।
মস্তিষ্কে একধরনের অস্ত্রোপচার, তাই তো?
–ঠিক বলেছেন, আসলে উন্মাদ রোগের চিকিৎসার জন্য এই অস্ত্রোপচার প্রচলিত। আপনাকে আমি সহজ ভাষায় বলছি, এই অস্ত্রোপচারকে আমরা নতুন কাজে লাগিয়েছি। এই অস্ত্রোপচারের পর সেই রোগীর আর আত্মহত্যা করার কোনো স্পৃহা থাকবে না, অপরাধবোধ হারিয়ে যায়, সে তখন অবচেতন মন নিয়ে উদাসভাবে ঘুরে বেড়ায়, কাজ করে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা অত্যন্ত প্রভুভক্ত হয়ে পড়ে।
-এ পরীক্ষায় আপনি সফল হয়েছেন কি?
–অতীতে হইনি। কিন্তু এখন এ বিষয়ে গবেষণায় আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেছি। আমার এখানে এখন তিনজন নামকরা শল্যচিকিৎসক রয়েছেন, একজন রাশিয়ার, একজন ফ্রান্সের আর একজন অস্ট্রিয়ার। মস্তিষ্কের বিভিন্নরকম পরীক্ষা চালিয়ে তারা এই সিদ্ধান্তেই এসেছেন যে, মানুষের স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তিকে এতটুকুও খর্ব না করেই এই অস্ত্রোপচারের সাহায্যে তাকে সম্পূর্ণ বশীভূত করা সম্ভব।
–কিন্তু কী ভয়ঙ্কর-ওঃ! চিৎকার করে উঠলো হিলারী।
-না, প্রয়োজন। অবিচল স্বরে শুধরে দিলেন অ্যারিস্টাইডস। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটা মানুষেরই উপকারের জন্যই।
–এরকম যে কোনোদিন হবে, আমি বিশ্বাস করি না।
-শুনুন মাদাম, আমি যদি বলি এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করার যোগ্য নন আপনি, আমায় মাফ করবেন।
-আমি বলতে চেয়েছিলাম–কর্মসচেষ্ট, বিশ্বস্ত একটা জানোয়ার যে সত্যিকারের কোনো বুদ্ধির কাজ দেখিয়ে কোনো কিছু সৃষ্টি করতে পারে, এ আমি বিশ্বাস করি না।
–আপনি বুদ্ধিমতী, হয়তো ঠিকই বলেছেন। সময়েই সেটা দেখা যাবে। গবেষণা পরীক্ষা নিরীক্ষা তো চলছে, দেখা যাক।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা! মানে? মানুষ নিয়ে পরীক্ষা?
–তা তো বটেই, মাদাম। সত্যিকারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার একমাত্র মাধ্যমই তো মানবদেহ।
–কিন্তু কী ধরনের মানবদেহ সেগুলো?
অযোগ্য লোকদের নিয়েই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়। যারা এখানকার জীবনযাত্রার সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারে না। তারা আমাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার চমৎকার মাধ্যমে পরিণত হয়।
আঁতকে উঠলো হিলারী। সামনে বসা বৃদ্ধটিকে কেমন যেন বীভৎস অমানুষ বলে মনে হলো অথচ ওর কথাগুলো মিথ্যে নয়, অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ। হিলারী বললো, আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না? আপনি বাইবেল পড়েন তো?
নিশ্চয়ই, রোজ পড়ি মাদাম।
–মোজেস আর অ্যারন, ফারাওকে কী বলেছিলেন মনে আছে? বলেছিলেন, আমার লোকজনদের যেতে দাও।
অদ্ভুত হাসলেন অ্যারিস্টাইডস। তাহলে আমি হচ্ছি ফারাও?–আর আপনি একই দেহে মোজেস এবং অ্যারন? আপনি আমাকে এটাই বোঝাতে চাইছেন তাই তো, মাদাম? এই লোকগুলোকে যেতে দিতে বলছেন–সব্বাইকে নাকি শুধু–বিশেষ কাউকে!
-আমি তো বলবো সব্বাইকে।
–কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, এতে শুধুই সময় নষ্ট হবে। তার চেয়ে বরং…আপনার স্বামীর জন্য ওকালতি করলে ভালো হতো না?
–সে এখন আপনার কাছে অপ্রয়োজনীয় এতদিনে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন?
-আপনার কথাই হয়তো ঠিক, মাদাম। হ্যাঁ, টমাস বেটারটন সম্পর্কে দারুণ হতাশ হয়েছি আমি। আমি ভেবেছিলাম আপনি আসার পর সে আবার প্রতিভার উন্মেষ ঘটাতে পারবে। কিন্তু আপনি আসার পরও ওর কাজে কোনো উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। স্রেফ শুধু সাধারণ কাজ করছে।
হিলারী বললো, এক-এক জাতের পাখি, যারা খাঁচাবন্দী অবস্থায় তেমন মিষ্টি সুরে গান গাইতে পারে না। হয়তো বিজ্ঞানীদের মধ্যেও তেমন জাত আছে, যারা বিশেষ বিশেষ অবস্থা সৃষ্টির চিন্তায় মনোনিবেশ করতে পারে না।
–তা হতে পারে। আমি অস্বীকার করছি না।
–তাহলে আপনি বেটারটনকে বাইরের জগতে ফিরে যেতে দিন।
–তা সম্ভব নয়, মাদাম। বাইরের দুনিয়ার কাছে এই জায়গায় খবর পৌঁছে দেবার মতো প্রস্তুতি এখনও গড়ে তুলতে পারিনি আমি।
–ও কাউকে কিছু বলবে না, এই শপথ করিয়ে নিতে পারেন।
–শপথ ও করবে–হ্যাঁ কিন্তু সে শপথ রাখবে না।
নিশ্চয়ই রাখবে। আমি বলছি ও কথা রাখবে।
-এই তো ঠিক সহধর্মিণীর মতো কথা। তবে এক্ষেত্রে বউদের কথা তেমন যুক্তিগ্রাহ্য নয়। অবশ্য ও যদি এখানে জামিন হিসেবে কাউকে রেখে যায়, তাহলে হয়তো ওর মুখ বন্ধ থাকবে।
–তার মানে?
–আমি বলতে চাইছিলাম ধরুন টমাস বেটারটন যদি চলে যায় আর তার জামিন হিসেবে আপনি এখানে রইলেন–ব্যাপারটা কেমন লাগবে আপনার? আপনি কি রাজি হবেন?
হিলারী জেসপের কথা শুনতে পাচ্ছে। আর তার নির্দেশগুলো মনে করার চেষ্টা করছে। টমাস বেটারটনকে মুক্ত করার যদি কোনো সুযোগ পাওয়া যায়, তা এখনই, পরিবর্তে তাকে এখানে থাকতে হবে। হিনারী জানে সাধারণভাবে জামিন বলতে যা বোঝায় সে তা নয়। একথা অবশ্য মিঃ অ্যারিস্টাইডস জানেন না। জানেন না যে টমাস বেটারটনের কাছে তার এতটুকুও মূল্য নেই। যে স্ত্রীকে সে ভালোবাসতো আগেই সে মারা গেছে, সুতরাং…
-আমি রাজি, বললো হিলারী।
-আপনার সাহস, নিষ্ঠা এবং আত্মত্যাগের যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে। যা বাকি কথাগুলো অন্যসময় আলোচনা করা যাবে।
-ওহ না না। হিলারী হঠাৎ দুহাতে মুখ ঘাটলো। এ আমি সহ্য করতে পারছি না। কী ভয়ঙ্কর অমানুষিক!
অত অস্থির হবেন না, মাদাম। বৃদ্ধ লোকটির গলায় সান্ত্বনার আশ্বাস। আজ আপনাকে আমার লক্ষ্য এবং উচ্চাশার কথা বলতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত। আমি বলতে পারি কিছুদিন পরে সবকিছুই আপনার কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হবে।
-না-না! ফুঁসে উঠলো হিলারী। কক্ষনো না, কক্ষনো না।
–আচ্ছা–এই তো লালচুলের বীরত্ব ঘুচে আবেগ ঝরছে! আমার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী-তারও লালচুল ছিলো। লালচুলওয়ালা সবসময়েই আমি প্রশংসা করি। আপনারও কিছু গুণ আছে–আপনার প্রাণপ্রাচুর্য, আপনার সাহস এবং আপনার একান্ত নিজস্ব একটি বুদ্ধিমান মাথা। এখানে অনেক নারী আছে কিন্তু এমন বেশ উত্তেজক মানসিক সঙ্গিনীর প্রয়োজন আমার। বিশ্বাস করুন, আপনার সাহচর্য আমাকে অনেকখানি শান্তি দিয়েছে।
-আচ্ছা ধরুন–এতক্ষণ যে সমস্ত কথা আমাকে বললেন, আমি যদি আপনার স্বামীকে সব বলে দিই?
অ্যারিস্টাইডস হেসে বললেন, ও আচ্ছা ধরে নিলাম আপনি বলে দেবেন। কিন্তু সত্যিই কী আপনি বলবেন?
-না–মানে আমি ঠিক জানি না।
-আচ্ছা! খুব চালাক আপনি। এমন কিছু জিনিষ আছে যা মেয়েদের চেপে রাখাই উচিত। আপনি এখন ভীষণ ক্লান্ত, বিপর্যস্ত তাই বলে ফেললেন। যাক মাঝে মাঝে আমি যখন এখানে আসবো, আপনাকে ডাকবো–অনেক কিছু আলোচনা করা যাবে।
হিলারী হঠাৎ দুহাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, আমাকে এখান থেকে যেতে দিন-দয়া করে আমাকে যেতে দিন।
অ্যারিস্টাইডস আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বললেন, কী করে আপনাকে যেতে দিতে পারি বলুন? এখানে আপনি যা যা দেখেছেন, সেই গল্প বাইরের জগতে কী করে ছড়াতে দিতে পারি, আপনিই বলুন?
-আমি যদি শপথ করে বলি যে একটা কথাও আমি কাউকে বলবো না, বিশ্বাস করবেন না আমায়?
-না বিশ্বাস করবো না, বিশ্বাস করলে বোকামি করবো।
–আমি এখানে থাকতে চাই না। এই বন্দীশালায় এক মুহূর্তও থাকতে চাই না আমি। আমায় মুক্তি দিন।
-কিন্তু এখানে আপনার স্বামী রয়েছেন। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় মিলিত হবার জন্যই আপনি এখানে এসেছিলেন।
–কিন্তু কোথায় আসছি তা আমি জানতাম না, কোনো ধারণাই ছিলো না আমার।
না, সত্যিই আপনার কোনো ধারণাই ছিল না। কিন্তু আমি আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি যে বিশেষ জগতে আপনি এসে পড়েছেন সে জগৎ অনেক সুখের। এখানে আপনার প্রয়োজনের সবকিছুই হাতের কাছে পাবেন।
উঠে দাঁড়িয়ে তিনি আস্তে করে কাঁধ চাপড়ে দিলেন হিলারীর। এখানে আপনি ঠিক মানিয়ে চলতে পারবেন। একবছর, বড়জোর দুবছরের মধ্যে আপনি নিজেকে সবচেয়ে সুখী বলে মনে করবেন।
.
১৯.
পরের রাত্রে ভীষণ চমকে ধড়মড় করে জেগে উঠলো হিলারী। আধশোয়া হয়ে কান খাড়া করে শব্দটা শুনতে চেষ্টা করলো, টম, টম–শুনতে পাচ্ছো?
-হ্যাঁ–একটা উড়োজাহাজ-খুব নিচু দিয়ে উড়ছে, ও নিয়ে ঘাবড়াবার কিছু নেই। মাঝে, মাঝেই এমনি ওপর দিয়ে যায়।
–ও আমি ভেবেছিলাম–কথাটা সে শেষ করলো না।
ঘুম এলো না আর, শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলো। অ্যারিস্টাইডসের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে দেখা হওয়া, কথাবার্তা বার বার সব মনের মধ্যে তোলপাড় করতে লাগলো। বুড়ো যেন-হঠাৎ খেয়ালে ওর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছে।
বুড়োর এই খেয়ালটাকে ও কি কাজে লাগাতে চেষ্টা করবে? ভালোবাসার অভিনয় করে, শেষ পর্যন্ত বুড়োর সঙ্গে বাইরের জগতে ফিরে যাবার জন্য কি তার ওপর চাপ ফেলতে পারবে?
পরের বার বুড়ো যখন আসবে, তখন যদি আবার ডেকে পাঠায়, হিলারী ওর লালচুলওলা বউয়ের আলোচনা পাড়বে। অন্ধকারে হিলারী হাসলো। ওর মনে পড়ে গেলো চেলটেমহ্যামের জর্জ কাকার কথা। জর্জ কাকা আর অ্যারিস্টাইডসের মধ্যে পার্থক্য নেই।
টমকে সেদিন হিলারী বলেছিলো, এখান থেকে মুক্তি পাবার একটা পথ আমি বের করবোই। সেই পথ কী অ্যারিস্টাইডস? তা যদি হয় পথটা সহজ হবে না…
খবর, শেষপর্যন্ত একটা খবর এসেছে, লাফিয়ে উঠলো লেবল্যাঙ্ক।
সবেমাত্র একটা আর্দালি একটা কাগজ দিয়ে গেছে। কাগজের ভাজ খুলেই সে উত্তেজিত। আমাদের পরিদর্শক প্লেনের একজন চালক এই খবর পাঠিয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলে এক বিশেষ স্থানে আসতেই সে লক্ষ্য করলো, সঙ্কেত বাতিটা জ্বলছে নিভছে। বিশেষ সাঙ্কেতিক তারবার্তা পরপর দুবার। সে এই বার্তা সংগ্রহ করে। এই যে দেখুন। জেসপের সামনে সে কাগজটা মেলে ধরলো।
ইংরেজীতে লেখা। C.O.GL.E.PR.O.S.I.E.S.L. শেষ দুটো অক্ষর পেনসিলের দাগ দিয়ে আলাদা করে দিলো লেবল্যাঙ্ক। বললো–SL–এটা আমাদের সঙ্কেত লিলি–যার অর্থ, প্রাপ্তি স্বীকার করতে হবে না।
আর COG হচ্ছে–যা দিয়ে সঙ্কেতবার্তা শুরু হচ্ছে তার আদ্যাক্ষর এবং আমাদেরই লোকের পাঠানো সঙ্কেতের প্রমাণ, তাই তো? বললে জেসপ।
হা। তাহলে বাকিটুকুই হচ্ছে আসল সংবাদ, বাকি অক্ষরগুলোর তলায় মোটা করে দাগ টানলো লেবল্যাঙ্ক। বললো, বাকি রইলো LEPROSIE, অনিশ্চিত শব্দটা বার বার দেখতে লাগলো সে।
-Leprosy? মানে কুষ্ঠ? জেসপের মুখে কথাটা যেন আপনা থেকেই জুগিয়ে গেলো।
তোমাদের এখানে কুষ্ঠরোগীদের কোনো নামজার্দা বা সাধারণ আশ্রম-টাম আছে নাকি?
লেবল্যাঙ্ক একটা বিরাট মানচিত্র এনে টেবিলের ওপর বিছিয়ে দিলো। আঙুল দিয়ে একটা স্থান নির্দেশ করলো। এই যে, এই জায়গাটুকুর ওপর আমাদের এই প্লেনের পর্যবেক্ষণের ভার ছিলো। দাঁড়ান, খুঁজে দেখি মনে হচ্ছে পাবো।
দ্রুতপায়ে ঘর থেকে বেরিলয়ে গিয়ে আবার ফিরে এসে বললো, পেয়েছি। এই জায়গাটায় এক বিখ্যাত ভেষজ গবেষণাকেন্দ্র আছে। একজন সুপরিচিত জনহিতৈষী এর প্রতিষ্ঠাতা এবং কর্ণধার। জায়গাটা মরুভূমির মাঝখানে–একেবারে নির্জন। কিন্তু যতদূর জানি এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আমাদের প্রজাতন্ত্রে রাষ্ট্রপতি স্বয়ং এর পৃষ্ঠপোষক।
-হুঁ। দারুণ চমৎকার কাজ স্বীকার করতেই হবে। জেসপের চোখে মুখে প্রশংসা ফুটলো।
কিন্তু যে-কোনো সময় পরিদর্শন করার জন্য এ জায়গা উন্মুক্ত। এই বিষয়ে উৎসাহী ডাক্তার গবেষকরা প্রায়ই পরিদর্শনে যান ওখানে।
এবং তাদের যা দেখার নয়, তা দেখতে পান না। কেনই বা পাবেন বলো? সর্বোচ্চ সম্মানের আড়ালে কোনো খারাপ কাজ করা যত সহজ, এত সহজ আবহাওয়া আর কিছুতেই সৃষ্টি করা যায় না।
তা অবশ্য ঠিক,-লেবল্যাঙ্ক বললো, হতে পারে যাত্রাপথে কেউ কেউ হয়তো ওখানে থামে। মধ্য ইউরোপের দু-একজন ডাক্তার নাকি একবার অমনি নেমেছিলে শুনেছি। এরকম ছোট্ট ছোট্ট দল, যেমন একটি দলের সন্ধান পেয়েছি আমরা–তারা হয়তো তাদের গন্তব্যস্থলে যাবার পথে কটা দিন ওখানে কাটিয়ে যায়।
তারচেয়েও অনেক বেশি কিছু বলে আমার মনে হচ্ছে। আমার মনে হয়–সম্ভবত এখানেই যাত্রা শেষ হয়।
কুষ্ঠরোগীদের আশ্রম–কথাটা বেশ ইঙ্গিতবহ মনে হচ্ছে।…আমার বিশ্বাস, আধুনিক, চিকিৎসায় কুষ্ঠরোগ আজকাল বাড়িতেও সারানো সম্ভব।
-সভ্যদেশে হয়তো সম্ভব। কিন্তু এ দেশে সেকথা কেউ চিন্তাও করতে পারে না।
-ঠিক তা নয়। কুষ্ঠরোগ–কথাটার মধ্যেই যেন মধ্যযুগীয় চিন্তাধারা লুকিয়ে রয়েছে, যখন কুষ্ঠরোগীদের গলায় ঘন্টা ঝুলিয়ে পথচারীদের পথ ছেড়ে দেবার জন্য সাবধান করে দেওয়া হতো। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক কে? সেই জনহিতৈষী দানশীল মহাপুরুষের নামটা জানতে পারি?
সহজেই জানা যাবে। একটু দাঁড়ান। কয়েক মিনিটের মধ্যে পাশের ঘর থেকে একটা নথি নিয়ে এলো।-বেসরকারী একটি সংস্থা এই আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা। জনহিতৈষী কিছু লোক– যাঁদের মধ্যে প্রধান হচ্ছেন মিঃ অ্যারিস্টাইডস। নিশ্চয় জানেন–এই ভদ্রলোকের অগাধ টাকা। প্যারিস এবং সেভিলিতে বিরাট বিরাট হাসপাতাল তৈরি করে দিয়েছেন উনি। এই প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পনা এবং কাজকর্ম সবকিছুই তার, অন্যান্য দাতারা নামেমাত্র তার সহযোগী।
–আচ্ছা তাহলে এটা একটা অ্যারিস্টাইডসের সংস্থা! আর এই অ্যারিস্টাইডস অলিভ বেটারটন যখন ফেজ-এ ছিলো তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
-অ্যারিস্টাইডস! লেবল্যাঙ্ক পাথর হয়ে গেলো। কিন্তু এও কি সম্ভব?
–সম্ভব!
–এ–সম্পূর্ণ অবাস্তব?
বাস্তবিকই!
–যাই বলুন–এ কিন্তু ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক কাজ।
–বটেই তো।
–কিন্তু কাজটা যে কতখানি বিপজ্জনক তা কি বুঝতে পারছেন? লেবল্যাঙ্ক উত্তেজনায় ছটফট করে উঠলো। এই অ্যারিস্টাইডস, বলতে গেলে দেশের সবকিছুর ওপরেই এঁর প্রভাব রয়েছে। ব্যাঙ্ক, কলকারখানা, অস্ত্রশস্ত্র, পরিবহন, সরকার সবকিছুর পেছনেই এঁর অদৃশ্য হাত। কেউ তাঁকে কোনোদিন চোখে দেখেনি, বড়জোর হয়তো ওঁর নাম শুনেছে। প্রচুর প্রতিপত্তি তার।
এই সমস্ত নিরুদ্দেশ সংক্রান্ত ব্যাপারে অ্যারিস্টাইডসের হাত থাকতে দেখলে মোটেই আশ্চর্য হবে না, বরং বলবো–একথা আগেই আমাদের চিন্তা করা উচিত ছিলো। এটা একটা চমৎকার ব্যবসায়িক চাল। রাজনীতির সঙ্গে বিন্দুমাত্র সংস্রব নেই এর। কিন্তু আসল প্রশ্ন হচ্ছে–এ ব্যাপারে আমরা কী করছি?
লেবল্যাঙ্কের মুখে যেন অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। না না, এ কাজ মোটেই সহজ নয় বুঝতেই পারছেন, আমাদের ধারণা যদি ভুল হয় তাহলে কী যে হবে বুঝতেই পারছেন। আর যদি সত্যি হয়, তাহলে এটা যে সত্যি তা আমাদের প্রমাণ করতে হবে। এমনকি আমরা যদি অনুসন্ধান শুরুও করি, তাহলেও যে-কোনো মুহূর্তে ওপরওয়ালাদের সর্বোচ্চ স্তর থেকে অনুসন্ধান বন্ধ করার নির্দেশ আসতে পারে–বুঝতে পারছেন? কিন্তু এ কাজ সহজ না হলেও আমাদের করতেই হবে।
.
২০.
পাহাড়ী পথেও ঝড় উড়িয়ে গাড়িগুলো পাহাড়ের গায়ে বসানো বিশাল ফটকটার সামনে এসে থামলো। চারটে গাড়ির প্রথমটায় রয়েছেন ফরাসি মন্ত্রীসভার একজন সদস্য আর আমেরিকান রাষ্ট্রদূত। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় গাড়িতেও নামকরা লোক আছেন। চতুর্থটির যাত্রীরা সাধারণ লোকের কাছে তেমন সুপরিচিত নন, কিন্তু নিজ নিজ পদমর্যাদায় এঁরা যথেষ্ট নামী লোক। এঁদের মধ্যে রয়েছে ক্যাপ্টেন লেবল্যাঙ্ক এবং মিঃ জেসপ। ধোপদুরন্ত সোফাররা গাড়ির দরজা খুলে বিশিষ্ট অতিথিদের সম্মান দেখাবার জন্য নুয়ে পড়লো। বিশাল ফটকটা যেন হুট করে খুলে গেলো। পরিচালক স্বয়ং অভ্যর্থনায় এগিয়ে এলেন, সঙ্গে সহপরিচালক, দুজন নামকরা ডাক্তার এবং রসায়নশাস্ত্রের গবেষক একজন।
অনেকক্ষণ ধরে অভ্যর্থনাপর্ব চললো। দু-পক্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় শেষ হতে মন্ত্রীমহাশয় জিজ্ঞেস করলেন, অ্যারিস্টাইডসকে দেখছি না। সে আমাকে কথা দিয়েছিল এখানে আমার সঙ্গে দেখা করবে।
অ্যারিস্টাইডস গতকালই স্পেন থেকে এসেছেন, উনি আপনাদের জন্য ভেতরে অপেক্ষা করছেন।
ছোট্ট দলটা এগিয়ে চললো। মন্ত্রীমহাশয় যেন ঈষৎ উদ্বিগ্ন। ভয়ে ভয়ে ডানদিকের মোটা লোহার বেড়ার দিকে তাকালেন। ফাঁক দিয়ে সামান্য দেখা গেলো, কুষ্ঠরোগীরা যেন সব সারবন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে।
চমৎকার সাজানো গোছানো অতি আধুনিক লাউঞ্জে অতিথিদের অপেক্ষায় বসেছিলেন মিঃ অ্যারিস্টাইডস।
একজন সাংবাদিক অ্যারিস্টাইডসকে বললো, বাঃ! একটা চমৎকার জায়গা তৈরি করেছেন, স্যার।
অমায়িক হাসি হেসে অ্যারিস্টাইডস বললেন, হ্যাঁ, এ জায়গা আমার গর্ব।
অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য চমৎকার ভোজর আয়োজন করেছিলেন অ্যারিস্টাইডস। নানারকমের পানীয় এলো। তুর্কী কফির পর পরিদর্শনের কাজ শুরু হলো।
ঘণ্টাদুয়েক ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু তারা দেখলেন। পরিদর্শনের কাজ শেষ হতে মন্ত্রীমহাশয় খুব খুশী। মন্ত্রীমহাশয় মুগ্ধ হলেও অন্যদের অনুসন্ধিৎসা কিন্তু বাধ মানছিলো না। এখানকার ডাক্তার গবেষকরা কীরকম জীবন কাটান, রোগীদের কী ভাবে রাখা হয় ইত্যাদি নানারকম খুঁটিনাটি প্রশ্নে তারা ডাঃ ভ্যান হিদেমকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলেন।
লেবল্যাঙ্ক আর জেসপ, যথাক্রমে মন্ত্রীমহাশয় ও ব্রিটিশ বাণিজ্যদূতের সঙ্গে হাঁটছিলো। দুজনেই ইচ্ছে করে খানিক পিছিয়ে পড়লো। অন্যান্য লাউঞ্জে গিয়ে বসলো। লেবল্যাঙ্ক ফিসফিস করে বললোকই কোনোরকম সূত্র তো পাওয়া যাচ্ছে না–একটুও কিছু পাচ্ছি না–
-না, কোনো সঙ্কেতই পাচ্ছি না।
–তা যদি হয়, মানে আমরা যদি ভুল পথে এসে থাকি তাহলে যে কী হবে ভাবতে পারছি না।
-এখনও বিশ্বাস হারাচ্ছি না আমি, জেসপ বললেন। আমাদের বন্ধুরা এখানেই আছে। এ বিষয়ে আমি স্থির নিশ্চিত।
–কিন্তু তাদের তো কোনো পাত্তাই নেই।
–তা অবশ্য ঠিক। হয়তো নিজের সন্ধান জানাবার কোনো সুযোগই তারা পায়নি।
–তাহলে আমরা প্রমাণ পাবো কী করে?
–অস্থির হয়ো না, লেবল্যাঙ্ক। আমি বলছি, এখনি হতাশ হবার মতো কোনো কারণ ঘটেনি।
–আপনি খুব আশাবাদী…হতাশ ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকালো লেবল্যাঙ্ক।
–গাইবার কাউন্টারের নাম শুনেছো, লেবল্যাঙ্ক?
–নিশ্চয়ই শুনেছি। কিন্তু আমি বিজ্ঞানী নই, বুঝতেই পারছেন।
–আমিও নই। তবে এটুকু জানি যে গাইগার কাউন্টার, তেজস্ক্রিয় ধরার অতি শক্তিশালী যন্ত্র। সুতরাং
–সুতরাং?
–আমাদের বন্ধুরা এখানেই আছে, আমার গাইগার কাউন্টার তাই বলছে। আমাদের বন্ধুরা এখানে খুব কাছাকাছি রয়েছে। এই অট্টালিকা অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে গোলকধাঁধার মতো করে সৃষ্টি করা হয়েছে। এখানে কোনো একটা অংশ নিশ্চয়ই আমার দেখতে পাচ্ছি না। সেটা আমাদের দেখানোও হয়নি।
–শুধু তেজস্ক্রিয়তার সূত্র ধরেই কি আপনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছচ্ছেন?
–ঠিক তাই।
আমার প্রধান ভরসাস্থল ঐ সাংবাদিকরা। খবর সংগ্রহ করার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে ওদের। গোপন কিছু গন্ধ পেলেই ওদের কান খাড়া হয়ে ওঠে। সাধারণ লোকে যা একেবারে হেসে উড়িয়ে দেয় সে খবরও বিশ্বাস করে ওরা। আর বিশ্বাস আছে আমার–ওই বৃদ্ধ মানুষটির ওপর।
সবশেষে মন্ত্রীমহাশয় চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে একটু যেন শঙ্কিত স্বরে বললেন, তাহলে–আমার মনে হয়, এখন আমাদের যাবার সময় হয়েছে। যা যা দেখার ছিলো সবই আমাদের দেখা হয়ে গেছে…শেষ কথাগুলো একটু যেন তাৎপর্যপূর্ণ। ঝোঁক টেনে বললেন, এবার আমরা বিদায় নিতে পারি। আপনারা কি বলেন?
কথাগুলো একদিক থেকে একেবারে সাধারণ ভদ্রতা দেখানোর মতো। আসলে কিন্তু সমস্ত কথাগুলোই ইঙ্গিতপূর্ণ। মন্ত্রীমহাশয় তাঁর সঙ্গীদের ঘুরিয়ে একথাই বোঝালেন, আপনারা তো সবই দেখলেন, কিছুই নেই। আপনারা যা সন্দেহ করেছিলেন, যে আশঙ্কা ছিলো আপনাদের, তার বিন্দুমাত্র চিহ্নও এখানে নেই। এবার আমরা মনে শান্তি নিয়ে ফিরতে পারি।
ঠিক সেই মুহূর্তে গম্ভীর স্বরে জেসপ মন্ত্রীকে বললেন, আপনার অনুমতি নিয়ে আমি কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই, স্যার।
-ও-নিশ্চয়ই। হ্যাঁ মিঃ জেসপ, প্রশ্ন করুন।
জেসপ সোজা ডাঃ ভ্যান হিদেমের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অ্যারিস্টাইডসকে এড়িয়ে গিয়ে বললেন, এখানে আপনাদের অনেক লোকজন দেখলাম। সত্যিই অবাক হতে হয়। কিন্তু আমার এক পুরানো বন্ধু এখানে আছে, তার সঙ্গে কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। যাবার আগে তার সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করতে আপনাদের কোনো অসুবিধে হবে না আশা করি?
-আপনার বন্ধু? ভীষণ চমকানিটা সামলে নিলেন ডাঃ ভ্যান হিদেম।
–হ্যাঁ–ঠিক বলতে গেলে–দুজন বন্ধু। একজন মহিলা, মিসেস বেটারটন, অলিভ বেটারটন। যতদূর জানি, তার স্বামী এখানে গবেষণা কাজে লিপ্ত। আগে হারওয়েল থাকতেন, তার আগেও আমেরিকায় ছিলেন। যাবার আগে ওঁদের সঙ্গে একটু দেখা করতে পারলে খুশি হতাম।
ভ্যান হিদেমের চোখেমুখে চিন্তার ছায়া পড়লো। কপালে বিস্মরণের ভাজ ফেলে বললেন, বেটারটন-মিসেস বেটারটন। না এ নামে এখানে কেউ নেই বলেই আমার বিশ্বাস।
একজন আমেরিকান ভদ্রলোকও এখানে থাকেন, জেসপ বললেন, অ্যান্ড্রু পিটার্স। খুব সম্ভবত রসায়নশাস্ত্র নিয়ে গবেষণা তার পেশা। হ্যাঁ আমি ঠিক বলেছি বোধহয়, তাই না স্যার? বলেই তিনি মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দিকে তাকালেন।
রাষ্ট্রদূত অত্যন্ত চতুর। কূটনৈতিক বুদ্ধি যেমন প্রখর, তেমনি আদর্শবান। জেসপের চোখে চোখ রেখে বললেন, আরে তাই তো, অ্যান্ড্রু পিটার্স। খেয়ালই ছিল না আমার, সত্যিই ওর সঙ্গে দেখা হলে খুব খুশি হতাম। ভ্যান হিদেমের শান্ত বিস্ময়টা ক্রমশ বিস্ফারিত হতে লাগলো। জেসপ এবার অ্যারিস্টাইডসকে দেখে নিলেন।
অ্যান্ড্রু পিটার্স? না স্যার, আপনারা কোনো ভুল সংবাদ পেয়েছেন বলেই আশঙ্কা হচ্ছে আমার। ও নামে আমাদের এখানে কেউ নেই, কাউকে চিনিও না।
–টমাস বেটারটনের নামটা নিশ্চয়ই শুনেছেন, তাই না? আচমকা প্রশ্ন করলেন জেসপ।
–টমাস বেটারটন? হা মানে, মনে হচ্ছে–
সাংবাদিকদের একজন হঠাৎ যেন কথাটা লুফে নিলো। টমাস বেটারটন। হা, কী হয়েছে? বিরাট খবর হয়ে উঠেছিলেন তিনি। মাত্র ছমাস আগে, তিনি নিরুদ্দেশ হন। সমস্ত দেশবিদেশ তোলপাড় করে পুলিস তাকে খুঁজেছে।
ভ্যান হিদেম বললেন, আশঙ্কা করছি, কেউ আপনাদের ভুল খবর দিয়েছে। সম্ভবত কেউ ধোঁকা দেবার চেষ্টা করেছে আপনাদের। আমাদের প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি কর্মীকে আজ আপনারা দেখেছেন। সমস্ত কিছুই দেখেছেন আপনারা।
পুরোপুরি সবকিছু নয় বলেই আমার মনে হচ্ছে, ঠান্ডা গলায় বললেন জেসপ। এরিকসন নামে আর-একজন যুবকও আছে, আর আছেন ডাঃ লুই ব্যারন, আরও সম্ভবত মিসেস কেলভিন বেকার
-ও-ডাঃ ভ্যান হিদেম যেন আশার আলো দেখতে পেলেন। কিন্তু ওই নামের সব্বাই তো মরক্কোর কাছে এক প্লেন দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন।
-তাহলে আপনি বলছেন–আমি ভুল করেছি? বলছেন–এই লোকগুলোর কেউ এখানে নেই?
কি করে তারা এখানে থাকতে পারেন, আপনিই বলুন স্যার? তারা তো সবাই প্লেন দুর্ঘটনায় নিহত। যতদূর জানি, সব মৃতদেহগুলোই পাওয়া গিয়েছিলো।
যে দেহগুলো পাওয়া গিয়েছিলো সেগুলো এমন ভয়ঙ্করভাবে পোড়া যে, সেগুলো যথাযথভাবে সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
কাঁপা কাঁপা সরু একটা গলা ভেসে এলো, কী বললেন? আপনি কি বলছেন যে, মৃতদেহগুলো যথাযথভাবে সনাক্ত করা হয়নি? অবসরপ্রাপ্ত জজসাহেব, লর্ড অ্যালভারস্টোক দুহাতে কান আড়াল করে বুকে পড়লেন।
-সরকারীভাবে যথাযথ সনাক্তকরণ সম্ভব ছিলো না, স্যার, জেসপ বললেন, আমাদের বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, এই লোকগুলি প্লেন দুর্ঘটনায় মারা যায়নি।
–বিশ্বাস? অখুশিভাবে প্রায় চিৎকার করে উঠলেন লর্ড অ্যালভারস্টোক।
–বিশ্বাস ঠিক নয়, এঁরা যে বেঁচে আছেন তার প্রমাণও আছে আমার কাছে।
–প্রমাণ? কী ধরনের প্রমাণ আছে মিঃ জেসপ?
মিসেস বেটারটন যখন ফেজ থেকে ম্যারাকাশের পথে রওনা হন, তখন তাঁর গলায় একটা ঝুটো মুক্তোর আঁটা হার ছিলো। সেই হারেরই একটা মুক্তো, প্লেনটা যেখানে পুড়েছে তার থেকে আধমাইল দূরের একটা জায়গায় পাওয়া গিয়েছে।
নিশ্চিত করে কী করে আপনি বলছেন যে, যে মুক্তোটা পাওয়া গিয়েছে সেটা মিসেস বেটারটনের হারেরই?
কারণ ওই হারের প্রতিটি মুক্তোয় এমন একটা করে ছোট্ট চিহ্ন ছিল যা খালি চোখে দেখা যায় না, কিন্তু শক্তিশালী আতস কাঁচে দেখা যায়।
–মুক্তোগুলোর গায়ে এই চিহ্ন কে দিয়েছিলো?
–আমি দিয়েছিলাম, লর্ড অ্যালভারস্টোক–আমার এই সহকর্মী, লেবল্যাঙ্কের সামনে এ কাজ আমি করেছিলাম।
-মুক্তোগুলোর গায়ে ওইরকম চিহ্ন এঁকে দেবার নিশ্চয়ই কোনো কারণ ছিলো আপনার?
-হা, লর্ড অ্যালভারস্টোক। আমার বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ ছিল যে, মিসেস বেটারটন আমাদের তার স্বামীর কাছে পৌঁছে দেবেন, যাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।–জেসপ বলে চললেন। আরও দুটো মুক্তো আমাদের নজরে পড়ে। দুটোই পাওয়া যায়, যেখানে প্লেন দুর্ঘটনা ঘটেছে সেখান থেকে আসার মধ্যবর্তী পথে। মুক্তোগুলো যেখানে যেখানে পাওয়া যায়, সেখানে সেখানে খোঁজখবর নিয়ে ছজন লোকের বর্ণনা পেয়েছি আমরা। এই ছজনের সঙ্গে যারা পুড়ে গেছে বলে প্রকাশ তাদের বর্ণনা প্রায় হুবহু মিলে গেছে। এই দুজন যাত্রীর মধ্যে একজনের কাছে ছিলো আমাদের দেওয়া দস্তানা। যার গায়ে জ্বলজ্বলে ফসফরাসের রঙ লাগিয়ে দেওয়া ছিল। এই ফসফরাসের ছাপ একটি গাড়ির গায়ে দেখতে পাওয়া যায়, যে গাড়িটা এই যাত্রীদের আসার পথে অনেকখানি পথ বয়ে এনেছে।
লর্ড অ্যালভারস্টোক মন্তব্য করলেন, খুব গুরুতর ব্যাপার।
চেয়ারের মধ্যে বসে থাকা মিঃ অ্যারিস্টাইডস জিজ্ঞেস করলেন, শেষ কোথায় এই দলটির দেখা পাওয়া যায়?
–একটা পরিত্যক্ত বিমানঘাঁটিতে। জেসপ জায়গাটার মোটামুটি একটা বর্ণনা দিলেন। অ্যারিস্টাইডস বললেন, সে তো এখান থেকে অনেক দূরে।…যেহেতু বিমানঘাঁটিটা এখান থেকে কয়েক শো মাইল দূরে, আমি বুঝতে পারছি না কিসের ভিত্তিতে আপনি বলছেন যে তারা এখানেই এসেছেন। কেনই বা তারা আসবেন এখানে?
–কিছুদিন আগে আমাদের একটা সন্ধানী প্লেন একটা সঙ্কেতবার্তা ধরে ফেলে। সেই বার্তাটি লেবল্যাঙ্কের কাছে যায়। গোপন সঙ্কেতলিপি দিয়ে শুরু করা সেই বার্তাটি সন্ধান দেয় যে, যাদের আমরা খুঁজছি সেই লোকগুলো কোনো এক কুষ্ঠ আশ্রমে আছে।
এবার অ্যারিস্টাইডস বললেন, সত্যিই খুব গুরুতর ব্যাপার মনে হচ্ছে, খুবই গুরুতর। কিন্তু আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, আপনাদের যে ভুল পথে নিয়ে আসা হয়েছে এ বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এঁদের কেউ এখানে নেই। আমার এই প্রতিষ্ঠানে যেমন খুশি অনুসন্ধান করার পূর্ণস্বাধীনতা আপনাদের রয়েছে–আপনারা দেখতে পারেন।
-খুঁজে কিছু পাবো কিনা সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে, স্যার-জেসপ বললেন, মানে ওপর ওপর খুঁজে কিছু পাওয়া যাবে না। এবার এক মোম চাল চাললেন জেসপ, কিন্তু ঠিক কোন্ জায়গা থেকে অনুসন্ধান শুরু করতে হবে সেটা আমি জানি।
–আচ্ছা! তা সে জায়গাটা কোথায় শুনি?
–দ্বিতীয় গবেষণাগার পেরিয়ে চতুর্থ বারান্দার একেবারে শেষে বাঁদিকে যেতে হবে।
হঠাৎ কেমন চঞ্চল হয়ে উঠলেন ডাঃ ভ্যান হিদেম। হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে জেসপ বললেন, দেখতেই পাচ্ছেন ডাক্তার, আমাদের হাতে অনেক পাকা খবর আছে।
তীক্ষ্ণস্বরে চটপট জবাব দিলেন ভ্যান হিদেম, এ অসম্ভব। সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। আপনারা ইঙ্গিত করছেন যে, কিছু লোককে আমরা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এখানে আটকে রেখেছি। এ অভিযোগ আমি সরাসরি অস্বীকার করছি।
মন্ত্রীমহাশয় বললেন, মনে হচ্ছে আমরা কানাগলিতে ঢুকে পড়েছি।
মিঃ অ্যারিস্টাইডস শান্ত স্বরে কথা বললেন, আপনাদের তত্ত্বটা সত্যিই চমকপ্রদ কিন্তু নেহাতই তত্ত্ব। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তিনি ব্যস্ত হয়ে বললেন, মহাশয়রা আমায় মাফ করবেন, এবার আপনাদের উঠতে হবে। বিমানঘাঁটি পর্যন্ত অনেকখানি রাস্তা আপনাদের মোটরে পাড়ি দিতে হবে, সময়মতো পৌঁছতে না পারলে চারদিকে আবার খবর চলে যাবে আপনাদের সন্ধান করার জন্য সুতরাং
লেবল্যাঙ্ক এবং জেসপ দুজনেই উপলব্ধি করলেন, এই মুহূর্তে সামনাসামনি ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় এসে গেছে। অ্যারিস্টাইডস তার ব্যক্তিত্বকে কাজে লাগাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এরা কিছু করুক বা না করুক তা আর সে চাইছে না।
অ্যারিস্টাইডস জেসপ আর লেবল্যাঙ্কের মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছেন। কিন্তু ওপরওলার নির্দেশ ছাড়া ওরা কিছুই করতে পারবে না।
লর্ড অ্যালভারস্টোক বললেন, আমার মত–আমাদের যাত্রাকে ত্বরান্বিত করা উচিত হবে না। কারণ এখানে এমন একটা ঘটনা রয়েছে যার ভালো ভাবে তদন্ত প্রয়োজন। অত্যন্ত সাংঘাতিক সব অভিযোগ করা হয়েছে, আমার মতে ছেড়ে দেওয়া যায় না। এই অভিযোগ খণ্ডন করার আইনসঙ্গত সুযোগ এঁদের দেওয়া উচিত।
–প্রমাণ করার দায়িত্ব কিন্তু আপনার উপর বর্তাবে, অ্যারিস্টাইডস তাঁর ব্যক্তিত্বের রোশনি ছড়ালেন।
দারুণ চমকে বোঁ করে ঘুরে দাঁড়ালেন ডাঃ ভ্যান হিদেম। একজন মুর ভৃত্য কখন সামনে এগিয়ে এসেছে। চমৎকার স্বাস্থ্যবান ভৃত্যটির গায়ে কাজ করা সাদা পোশাক, মাথায় মরক্কো টুপি; তেলতেল কালো মুখটা চকচক করছে।
নিগ্রোদের মতো পুরু ঠোঁটের আড়াল থেকে পরিষ্কার শুদ্ধ ইংরেজি উচ্চারণ শুনে সমস্ত দলটা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো।
ভৃত্যটি বলে উঠলো, প্রমাণ আছে। আপনারা এখনই আমার সাক্ষ্য নিতে পারেন। এই ভদ্রলোক বলছেন যে, অ্যান্ড্রু পিটার্স, টরকুইল এরিকসন, মিঃ এবং মিসেস বেটারটন ও ডাঃ লুই ব্যারন এখানে আছেন–এবং তাদেরই প্রতিনিধি। এক পা এগিয়ে এসে সে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সামনে দাঁড়ালো। বললো, এই মুহূর্তে হয়তো আমাকে চিনতে আপনার কষ্ট হচ্ছে স্যার–আমি অ্যান্ড্রু পিটার্স।
অ্যারিস্টাইডস তার দিকে তাকিয়ে একটা ক্ষীণ শব্দ করে ভাবলেশহীন মুখ নিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন।
সব্বাইকে এখানে লুকিয়ে রাখা হয়েছে, পিটার্স বললো, মিউনিখের স্কুয়াজ, হেলগা নিডহেইম, আমেরিকার পল ওয়েড, ইংরেজ বিজ্ঞানি জেফ্রি এবং ডেভিডসন, ইতালির রিকোসেটি, বিয়াঙ্কা এবং মার্চিসন–সবাই এখানে আছেন। মাঝখানের দরাজাটা বন্ধ করার এমন অপূর্ব কৌশল যে খালিচোখে সে দরজার হদিস কেউ পাবে না। গোপন গবেষণাগারগুলোও তৈরি করা হয়েছে, পাহাড়ের তলায় সুড়ঙ্গ কেটে।
–হায় ভগবান, মার্কিন রাষ্ট্রদূত বললেন, ভৃত্যটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তিনি বললেন, না, এখনও যে তোমাকে ঠিক চিনতে পেরেছি তা বলবো না আমি।
ঠোঁটে প্যারাফিন ইনজেকশন নেওয়ার ফলে এইরকম হয়েছে স্যার। আর গালের রঙের ব্যাপারটা না বললেও চলবে।
-তুমি যদি পিটার্স হও, এফ.বি.আই.-এর কোন নাম্বারে তুমি কাজ করছো?
–৮১৩৪৭১ স্যার।
বেশ। আর তোমার ছদ্মবেশের আদ্যাক্ষর?
বি.এ.বি.ডি.জি. স্যার।
রাষ্ট্রদূত বললেন, এ লোক পিটার্স কোনো সন্দেহ নেই আমার, মন্ত্রীর দিকে ফিরলেন তিনি।
মন্ত্রীবর পিটার্সকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি বলছো–এই সমস্ত লোকদের তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে এখানে আটকে রাখা হয়েছে?
-কেউ কেউ স্ব-ইচ্ছায় আছেন, কেউ কেউ নয়, স্যার।
–হু, সে ক্ষেত্রে তাদের জবানবন্দি নিতেই হবে। পুলিসের বড়কর্তার দিকে তাকালেন তিনি। ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন।
–একটু দাঁড়ান, অ্যারিস্টাইডস নির্দেশ দিলেন। ধীর শান্ত হতাশ স্বরে বললেন, সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে, আমার বিশ্বাসের ওপর চরম আঘাত হেনেছে এরা। আরক্ত শীতল দৃষ্টিতে ভ্যান হিদেম এবং পরিচালককে বললেন, বিজ্ঞানের আবিষ্কার উন্মাদনায় মেতে আপনারা এখানে কী যে করেছেন তা আমার জানা নেই। আমার এই কল্যাণ প্রতিষ্ঠানের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো বিজ্ঞানের সাধনা। যদি এঁদের অভিযোগ সত্য হয় তাহলে এই মুহূর্তে সেই লোকদের আপনি এখানে হাজির করুন, যাদের বেআইনিভাবে এখানে আটকে রাখা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
কিন্তু স্যার, এ অসম্ভব। আমি–মানে এতে–
কোনরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা যদি ভেবে থাকেন, তা এখানেই শেষ করতে হবে। আশাকরি, মহাশয়দের এ আশ্বাস আমাকে মুখ ফুটে বলে দিতে হবে না যে, এখানে সত্যিই যদি কোনো বেআইনী কাজ কারবার চলে থাকে তা সম্পূর্ণ আমার অগোচরেই ঘটেছে।
এ যেন জবাবদিহি নয়, আদেশ। এ আদেশ অর্থের, এ আদেশ অসীম ক্ষমতার এবং বিশাল প্রতিপত্তির। মিঃ অ্যারিস্টাইডস, দুনিয়াজোড়া যাঁর নাম, তাকে এ ব্যাপারে জড়ানো চলবে না। তবে এই অপরাধের পঙ্কিল আবর্ত থেকে যদিও তার হাতে দাগ না লাগে, তবুও এ তার পরাজয়। এ পরাজয়, এ ব্যর্থতা জীবনে বার বার এসেছে তার। ব্যর্থতা কাটিয়েই মাথা উঁচু করেছেন মিঃ অ্যারিস্টাইডস।
অদ্ভুত হাতের ভঙ্গি করে বললেন তিনি, ঈশ্বর করুন, এসব ব্যাপারে আমার যেন কোন সংস্রব না থাকে।
পুলিশ অধিকর্তা এগিয়ে এলেন। বললেন, কোনোরকম বাধা যেন না দেওয়া হয়। আমার কর্তব্য আমাকে করতে দিতে হবে।
ফ্যাকাসে মুখ নিয়ে এগিয়ে এলেন ভ্যান হিদেম। আমার সঙ্গে আসুন, আমাদের সংরক্ষিত ঘরগুলো আপনাদের দেখিয়ে দিচ্ছি আমি।
২১. একটা দুঃস্বপ্ন
২১.
মনে হচ্ছে একটা দুঃস্বপ্ন দেখে উঠলাম। বুক খালি করে নতুন করে শ্বাস নিলো হিলারি।
তাঞ্জিয়েরের একটা হোটেলের চত্বরে ওরা বসেছিলো। সকালের প্লেনেই পৌঁছেছে এখানে। হিলারী আবার বললো, এতসব ঘটনা কি সত্যিই ঘটেছিলো? নাকি স্বপ্নই।
সত্যিই ঘটেছিলো, বললো টম বেটারটন, মনে হয় সত্যিই যেন দুঃস্বপ্ন। শেষপর্যন্ত তাহলে ওখান থেকে বেরোতে পারলাম।
জেসপ চত্বর পেরিয়ে ওদের পাশে এসে বসলেন।
হিলারী জিজ্ঞেস করলো, অ্যান্ড্রু পিটার্স কোথায় গেলেন?
–এখুনি এসে পড়বে। কয়েকটা টুকিটাকি কাজ সারছে, জেসপ বললো।
–তাহলে-পিটার্স আপনারই লোক। হিলারী বললো, কিছু ফরফরাসের গুড়ো আর তেজস্ক্রিয় পদার্থে ভরা এক সীসার সিগারেট কেস দিয়ে সে এতসব কাণ্ডকারখানা করে ফেললো। আমি কিন্তু ওকে এতটুকুও সন্দেহ করতে পারিনি।
-সেই জন্যই দুজনেই যথেষ্ট সতর্কতার পরিচয় দিয়েছে। তবে, ঠিকমতো বলতে গেলে পিটার্স আমার লোক নয়। উনি আমেরিকার পক্ষ থেকে এসেছেন।
–সেইজন্যই তখন আপনি বলেছিলেন, সত্যিই যদি আমি টমের কাছে পৌঁছতে পারি সেখানে আমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকবে? অ্যান্ড্র পিটার্সের কথাই আপনি বলতে চেয়েছিলেন, তাই না?
-হুঁ, ঘাড় নাড়লেন জেসপ।
ওই যে আমার বন্ধু লেবল্যাঙ্ক আসছে। যাই ওর সঙ্গে একটু কথা বলি, জেসপ উঠে পড়লেন। চত্বর পেরিয়ে চলে গেলেন।
সঙ্গে সঙ্গেই টম বেটারটন ব্যস্ত হয়ে বললো, আমার জন্য আরও একটা কাজ তোমাকে করতে হবে অলিভ, করবে না? এখনও তোমাকে অলিভই বলছি–কেমন যেন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে।
-হা হা বলবেন। তাতে কী হয়েছে?
-তুমি আমার সঙ্গে চত্বরের ওধারে চলো। তারপর এখানে ফিরে এসে ওদের বলবে আমি আমার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ছি।
বিস্মিত চোখ তুললো হিলারী, কেন? কী করবেন আপনি
–চলে যাবো, অলিভ। চলে যাওয়াই আমার পক্ষে ভালো।
–চলে যাবেন। কোথায়?
–যেখানে হয়।
–কিন্তু কেন?
–এখানকার অবস্থা আমার জানা নেই। এই তাঞ্জিয়ের এক অদ্ভুত জায়গা নির্দিষ্ট কোনো রাষ্ট্রের আইনের আওতায় পড়ে না। কিন্তু আমি জানি, তোমাদের সঙ্গে জিব্রাল্টার পৌঁছলেই কী ঘটবে। সেখানে আইন আছে, সরকার আছে। প্রথমেই ওরা আমাকে গ্রেপ্তার করবে সেখানে।
হিলারীর চোখে মুখে গভীর চিন্তার রেখা পড়লো। অ্যারিস্টাইডসের মরণফাঁদ থেকে মুক্তি পাবার উত্তেজনায়, টম বেটারটনের দুশ্চিন্তার কথা সে ভুলেই গিয়েছিলো। বললো, আপনি কি ভাবছেন, সরকারী গোপন তথা ফাঁসের অভিযোগে আপনাকে অভিযুক্ত করা হবে? তা যদি হয়, তাহলে কি আপনি পালিয়ে বাঁচতে পারবেন? কোথায় যাবেন আপনি? ওরা অনেক বেশি শক্তিশালী। এই দুনিয়ার যেখানে যেভাবেই থাকুন-না-কেন ওরা আপনাকে খুঁজে বের করবেই।
সেটা খুব সহজ হবে না। আমার যে বর্ণনা ওদের কাছে আছে তার সঙ্গে আমার বর্তমান চেহারার কোনো মিলই নেই। আমার উদ্দেশ্য ছিলো-ইংল্যান্ড থেকে পালিয়ে, কিছু টাকা-পয়সার ব্যবস্থা করে নিজের চেহারা সম্পূর্ণ পালটে ফেলা, যাতে বাকি জীবনটা নিরাপদে কাটাতে পারি।
দু চোখে সন্দেহ ঘনালো হিলারীর। বললো, আপনি ভুল করছেন। এর চেয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে বিচারের সামনে দাঁড়ানো অনেক ভালো।
এখন তো আর যুদ্ধের সময় নয়। হয়তো অনেক বছরের জেল হবে। সারাজীবন পুলিশের তাড়া খাওয়ার কী দরকার?
–তুমি বুঝছে না। যাকগে, নষ্ট করার মতো আর একটুও সময় আমার নেই।
চত্বরের শেষ প্রান্তে পৌঁছলো ওরা। দেওয়ালের গায়ে ছোট্ট একটা দরজা। সেই দরজা দিয়ে সরু একটা রাস্তা পাহাড়ী পথ বেয়ে এঁকে-বেঁকে বন্দরের দিকে চলে গেছে।
বেটারটন বললো, এই পথ দিয়ে আমি বেরিলয়ে যাচ্ছি। কেউ লক্ষ্য করবে না। বিদায়।
–আপনার সৌভাগ্য কামনা করি, বিদায়! স্থির দাঁড়িয়ে সে বেটারটনকে দেখতে লাগলো। দরজাটা খুলে যেতেই বেটারটন এক পা পিছিয়ে এসে নিশ্চল দাঁড়িয়ে পড়লো। দরজা জুড়ে তিনজন লোক দাঁড়িয়ে। তাদের মধ্যে দুজন বেটারটনের দিকে এগিয়ে এলো।
-টমাস বেটারটন, আপনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা রয়েছে আমার কাছে। যতক্ষণ না আপনাকে মার্কিন সরকারের হাতে বিচারের জন্য সমর্পণ করা হচ্ছে, ততক্ষণ আপনি আমাদের হাতে বন্দী হয়ে থাকবেন।
হো হো করে হেসে উঠলেন বেটারটন।
–সবকিছুই আপনারা ঠিকঠাক বলেছেন, শুধু একটু ভুল করে আমাকে টমাস বেটারটন ভেবেছেন। আমি বেটারটন নই।
তৃতীয় লোকটি পিটার্স এবার ভেতরে এসে বেটারটনের মুখোমুখি দাঁড়ালো। আপনিই বেটারটন–টমাস বেটারটুন আপনিই।
বেটারটন আবার হেসে বললো, আমার মনে হচ্ছে, গত একমাস একসঙ্গে থেকে, আমাকে টমাস বেটারটন নামে ডাকতে শুনে, আপনি হয়তো বিশ্বাস করেছেন যে আমিই টমাস বেটারটন। আসলে কিন্তু আমি টমাস বেটারটন নই। বিশ্বাস না হয় ওই ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করুন। উনি আমার কাছে এসেছিলেন, আমার স্ত্রীর ছদ্মবেশে। আমি ওঁকে আমার স্ত্রী বলে মেনেও নিয়েছিলাম। তাই না? আপনি কি বলেন?
হিলারী ধীরে ধীরে মাথা নাড়লো। তার কারণ, বেটারটন বলে চললো, যেহেতু আমি টমাস বেটারটন নই, স্বভাবতই টমাস বেটারটনের স্ত্রীকেও আমার চেনার কথা নয়।
বেটারটন হাসলো, আত্মবিশ্বাসের হাসি। আমি বেটারটন নই। বেটারটনের যে-কোনো ছবির সঙ্গে আমার চেহারা মিলিয়ে দেখুন, দেখবেন সত্যি কথাই বলছি আমি।
পিটার্স এগিয়ে এসে বললো, বেটারটনের ছবি আমি দেখেছি। স্বীকার করছি, টমাস বেটারটন হিসেবে আপনাকে আমি চিনতে পারিনি। কিন্তু আপনিই যে টমাস বেটারটন তাতে কোনো সন্দেহ নেই এবং তা আমি প্রমাণ করবো।
হঠাৎ সে শক্ত মুঠোয় বেটারটনের হাতটা চেপে ধরে, তার জামাটা ফড়ফড় করে ছিঁড়ে ফেললো। আপনি যদি টমাস বেটারটন হন, তাহলে আপনার ডান হাতের কনুইয়ের ওপর ইংরেজী জেড় অক্ষরের মতো একটা কাটা দাগ হবে। বলতে বলতেই সে বেটারটনের ডান হাতটা সবার সামনে মেলে ধরলো।
দাগটা দেখিয়ে বললো পিটার্স, এইখানেই আপনি আটকে গেলেন, মিঃ বেটারটন। যুক্তরাষ্ট্রে আপনার গবেষণাগারের দুজন সহকারী এই দাগ সনাক্ত করবে। এই দাগটার কথা আমি জানি, কারণ আপনার হাতে যখন এই ক্ষতটা হয় এলসা আমাকে চিঠিতে জানিয়েছিলো।
এলসা? বেটারটনের চোখদুটো কৃত্রিম পাথরের চোখের মতো স্থির হয়ে গেলো, এলসা? এলসার কথা কী বলছিলেন?
পুলিশ অফিসার এগিয়ে এসে বললেন, আপনার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ–ঠান্ডা মাথায় খুনের। আপনার স্ত্রী, এলসা বেটারটনকে হত্যা করার অভিযোগ রয়েছে আপনার বিরুদ্ধে।
.
২২.
–আমি দুঃখিত, অলিভ, তোমাকে সাবধান করে দিয়ে সেদিন বলেছিলাম, ও থাক। অ্যারিস্টাইডসের ওখানেই ও নিরাপদে থাকতে পারবে। ওকে ধরার জন্য আমি দুনিয়া চষে বেড়িয়েছি। এলসাকে ও যা করেছে, তার ক্ষমা নেই আমার কাছে।
আমি বুঝতে পারছি না, আপনি কে?
ভেবেছিলাম, তা তুমি জানো। আমি–বোরিস আন্দ্রেই পাভলভ-গ্লাইদর। এলসার পিসতুতো ভাই। আমি আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করে অ্যান্ড্রু পিটার্স হয়ে গেলাম। তারপর এলো মহাযুদ্ধ। ইউরোপে ফিরে গিয়ে আমি প্রতিরক্ষার কাজে যোগ দিলাম। এলসার কথা তোমাকে আগেও বলেছি। সেই সময়ে সে একজন প্রথম শ্রেণীর বিজ্ঞানী। আসলে এলসাই শূন্যশক্তি বিভাজনের আবিষ্কত্রী। বেটারটন একজন কানাডিয়ান যুবক, নিজের গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য সেই সময়ে সে ম্যানহেইমারের অধীনে কাজ করতে আসে। সে ভেবেচিন্তে এলসার সঙ্গে ভাব জমিয়ে তাকে বিয়ে করলো, যাতে এলসার সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করতে পারে। এলসার গবেষণা যখন শেষ হওয়ার মুখে, বেটারটন উপলব্ধি করলো–এই শুন্যশক্তি বিভাজন, কী যুগান্তকারী আবিষ্কার হতে চলেছে। সে এলসাকে বিষ খাওয়ালো।
-ওঃ। না, না।
-হ্যাঁ, তখন কারো কোনো সন্দেহ হয়নি। কাজের মধ্যে ডুবে রইলো সে। নতুন উদ্দীপনায় কাজ করে কিছুদিনের মধ্যে সে শূন্যশক্তি বিভাজনকে তার নিজের আবিষ্কার বলে ঘোষণা করলো। সে যা চেয়েছিলো তাই হলো। খ্যাতি, যশ এবং প্রথমশ্রেণীর বিজ্ঞানী হিসাবে স্বীকৃতি পেলো।
যুদ্ধ শেষ হবার পরেও বেশ কিছুদিন আমাকে ইউরোপে থাকতে হয়েছিলো। মৃত্যুর আগে লেখা এলসার একটা চিঠি পেয়ে আমি ভীষণ চঞ্চল হয়ে উঠলাম। যে রোগে সে ভুগছিলো এবং যাতে সে মারা গেল দুটোই আমার কাছে কেমন যেন রহস্যজনক বলে মনে হলো। শেষ পর্যন্ত যখন আমেরিকায় ফিরলাম, এ নিয়ে নানারকম অনুসন্ধান শুরু করলাম আমি। যা আমি খুঁজছিলাম, সেটা পেয়ে গেলাম। বেটারটন দেখলো, হত্যার অপরাধে ধরা পড়ার এবং শাস্তি এড়াবার চমৎকার পথ খোলা রয়েছে তাই অ্যারিস্টাইডসের শর্ত মেনে নিয়ে সে ওখানে চলে গেলো। তার নিজের একমাত্র দাবি ছিলো,–অস্ত্রোপচার করে তার মুখের চেহারা সম্পূর্ণ বদলে দিতে হবে। আসলে সে দেখলো, এক বন্দীশালা এড়িয়ে সে অন্য এক ভয়ঙ্কর বন্দীশালায় এসে পড়েছে। আরও বিপদ–সে দেখলো, সে এদের চাহিদা মতো নতুন কিছু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করতে পারছে না–এ এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। নতুন আবিষ্কার করা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না–কারণ সে কোনোদিনই বৈজ্ঞানিক প্রতিভার অধিকারী ছিলো না।
-আর-আপনি ওকে অনুসরণ করলেন?
-হা কাগজের পাতায় পাতায় যখন কৃতী বিজ্ঞানী টমাস বেটারটনের নিরুদ্দেশ নিয়ে তোলপাড় চলছে, আমি ইংল্যান্ডে এসে আবিষ্কার করলাম স্পীডার নামে এক ভদ্রমহিলা, বেটারটনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। মোটামুটি খোঁজখবর করে আমি ভদ্রমহিলার সাথে আলাপ জমালাম। ভান করলাম, যেন আমি অতি বড় বামপন্থী চিন্তাধারার সমর্থক। প্রথম থেকেই আমার ধারণা ছিলো বেটারটন নিশ্চয়ই কোনো কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে তাই কমিউনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গীর সমর্থক সেজেছিলাম। কারণ আমি জানতাম–আর কেউ না পারুক, সমস্ত ঝুঁকি নিয়েও আমাকে যে তার কাছে পৌঁছতেই হবে।.এলসা একজন প্রথম শ্রেণীর বিজ্ঞানী ছিলো, কী সুন্দর শান্ত নম্র মেয়ে। সেই শান্ত মেয়েটা যাকে ভালোবেসেছিলো, যাকে বিশ্বাস করেছিলো–সেই তাকে খুন করলো, তার সর্বস্ব অপহরণ করে তাকে নিঃস্ব করে দিলো। যদি প্রয়োজন হয়, নিজের হাতে বেটারটনকে খুন করতেও একটুকু হাত কাঁপবে না আমার।
এবার আমি সব বুঝতে পারছি।
পিটার্স বললো, ইংল্যান্ডে পৌঁছে আমি তোমাকে চিঠি লিখে সবকিছু জানিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো উত্তর দাওনি তুমি। ধরে নিয়েছিলাম, তুমি আমার কথা বিশ্বাস করোনি। তারপরেই আমি গোয়েন্দা দপ্তরে যাই। সেখানে নিজেকে পোল্যান্ডের গোয়েন্দা দপ্তরের একজন অফিসার বলে পরিচয় দিই। যাই হোক শেষ পর্যন্ত জেসপের সহায়তায় একসঙ্গে কাজে লেগে গেলাম। আজ সকালে আমার অভিযান শেষ হয়েছে। বেটারটনকে আমেরিকায় পাঠানো হবে, সেখানেই তার বিচার হবে। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে সে উদাস চোখে দূরে সমুদ্র দেখলো। অস্থির হয়ে সে বললো, সবচেয়ে বিশ্রী ব্যাপার হলো–হঠাৎ এর মধ্যে তুমি এসে পড়লে। আমি তোমাকে দেখলাম। মিথ্যা বলবো না-ভালোবেসেও ফেললাম। সবচেয়ে দুঃখ আমার এটাই, অলিভ। বিশ্বাস করো, অবস্থাটা এমন দাঁড়ালো যে, তোমাকে ভালোবেসেছি যে আমি সেই আমিই তোমার স্বামীকে বৈদ্যুতিক চেয়ারে বসানোর জন্য প্রধান দায়ভাগী হলাম। এ অবস্থা থেকে মুক্তির কোনো উপায় আমাদের নেই, অলিভ। উঠে দাঁড়ালো পিটার্স। যাক সম্পূর্ণ ঘটনা আমি তোমাকে নিজের মুখে বলতে চেয়েছিলাম। বলা শেষ, এবার আমি বিদায় নেবো।
একটু দাঁড়াও। ঘুরে দাঁড়ালো পিটার্স। আমারও তোমাকে কিছু বলার আছে, যা তুমি জানো না। আমি-বেটারটনের স্ত্রী নই। বেটারটনের স্ত্রী অলিভ, ক্যাসাব্লাঙ্কার প্লেন দুর্ঘটনায় মারা গেছে। জেসপ আমাকে অলিভের ছদ্মবেশ নিয়ে এই অভিযানে আসতে অনুরোধ করেন
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো পিটার্স। তুমি অলিভ বেটারটন নও?
-না।
–হা ঈশ্বর! সে ধপ করে হিলারীর পাশে বসে পড়লো। অলিভ, আমার অলিভ।
–আমাকে অলিভ বলে ডেকো না। আমি হিলারী ক্র্যাভেন। হিলারী? উঁ…এ নামটায় অভ্যস্ত হতে আমার বেশ সময় লাগবে। হিলারীর কাঁধে একটা হাত রাখলো পিটার্স।
–চত্বরের ও প্রান্তে জেসপ, নানারকম জটিলতা নিয়ে লেবল্যাঙ্কের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। কথার মাঝে হঠাৎ তিনি থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হা কী বলছিলেন যেন?
আমি বলছিলাম–অ্যারিস্টাইডসের মতো একটা জানোয়ারের বিরুদ্ধে আমরা বোধহয় বেশিদূর এগোতে পারবো না।
না-না, অ্যারিস্টাইডসরা চিরকালই জয়ী হয়। কিন্তু ওর প্রচুর টাকা লোকসান হয়ে গেলো, এ শোক ও ভুলতে পারবে না। ওর চোখ মুখ দেখে মনে হলো ও মৃত্যুকে বেশিদিন ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। ওপরওয়ালাই ওকে শীঘ্র শাস্তি দেবেন।
-আপনি এমন হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠছেন কেন বলুন তো?
-ওই দেখো–না, ওই দুটি। আমি কিনা হিলারী ক্র্যাভেনকে পাঠালাম অজানা মৃত্যুর ঠিকানায়, কিন্তু এখন দেখে মনে হচ্ছে শেষ পর্যন্ত ওর যাত্রারও সেই একই পরিণতি হলো। হাঃ হাঃ!
বিভ্রান্ত হয়ে একবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে লেবল্যাঙ্ক হেসে ফেললো। ও আচ্ছা আপনাদের শেক্সপীয়রের সেই কথা!
তোমরা ফরাসিরা বাপু বড়ো বেশি পড়াশোনা করো। জেসপ তার হাসির সঙ্গে গলা মেলালেন।