পিটার্স বলছিলো, ভাবছি-এখান থেকে আমরা কোথায় যাবো? অদ্ভুত শান্ত তার গলা, এতটুকু ভয় নেই, পিছু তাকানো নেই, শুধু সামনে এগিয়ে যাওয়া।
হিলারীও ঠিক এই কথাই ভাবছিলো। ও মিসেস বেকারকে জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাচ্ছি আমরা? এরপর কী হবে?
দেখতেই পাবেন, মিষ্টি হেসে বললেও বেকারের কথাগুলোরমধ্যে কেমন যেন আতঙ্কের আভাস ছিলো। রাত্রি নামলো, ওরা প্রধান সড়ক দিয়ে না গিয়ে মেঠোপথ, কখনো কাঁচা রাস্তা ধরে এগোচ্ছে।
অনেকক্ষণ জেগে থাকায় অজস্ব চিন্তা আর দুর্ভাবনায় মাথার মধ্যেটা ঝিমঝিম করছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঘুমিয়ে পড়লো।
গাড়িটা হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে যেতে ওর ঘুম ভেঙে গেলো। দেখলো, পিটার্স আস্তে আস্তে ওর হাত ধরে নাড়া দিচ্ছে, উঠে পড়ুন। আমরা মনে হচ্ছে কোনো একটা আস্তানায় পৌঁছে গেছি।
সবাই নেমে পড়লো। অন্ধকারে মনে হলো পামগাছে ঘেরা একটা বাড়ির সামনে নিয়ে এলো। দুটি দেহাতী মেয়ে খিলখিল করে বেকারের দিকে তাকিয়ে হাসছিলো। তিনজন মহিলাকে ওপরের একটা ঘরে নিয়ে আসা হলো। ঘরের মেঝেয় তিনটে মাদুর পাতা আর কম্বল চাদরের একটা গাদা।
মিসেস বেকার হিলারীকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কেমন বোধ করছেন মিসেস বেটারটন? গাড়ির ঝাঁকুনিতে আপনার মাথার ব্যথাটা নিশ্চয়ই বেড়ে গেছে?
-হ্যাঁ, তাই মনে হচ্ছে, হিলারী বললো।
-এক্ষুনি আমাদের খাবার এসে পড়বে, খেয়ে নিয়ে কটা অ্যাসপিরিনের ব্যবস্থা করে দেবো-চটপট শুয়ে পড়বেন।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ এবং নারীকন্ঠের খিলখিল হাসি শোনা গেল। দেহাতী মেয়ে দুটো খাবারের থালা নিয়ে ঘরে ঢুকলো। একজন হিলারীর পশমের কোটটায় হাত বুলোতে লাগলো।
–এই, যা–ভাগ, ভাগ এখন, মিসেস বেকার তাদের তাড়া করলেন। মিসেস বেকার বললেন, খুব নিরীহ ওরা। মাঝে মাঝে ওদের জ্বালায় অস্থির হয়ে উঠতে হয়।
যাক এখন যতটা সম্ভব বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন আমাদের।
চা এলো সেই পুদিনাপাতার গন্ধ। হিলারী চা দিয়ে কটা অ্যাসপিরিন খেয়ে নিলো। তারপর চা খেয়ে শুয়ে পড়লো।
পরদিন অনেক বেলা করে উঠলো ওরা। মিসেস বেকার আগেই বলে দিয়েছিল সেদিন সন্ধ্যার আগে আর কোথাও যাওয়া যাবে না।
ঘুম থেকে উঠে মিসেস বেকার দরজার কাছে জড়ো করা একরাশ পোশাক দেখিয়ে বলেছিলেন, এখন থেকে আমরা এই দেহাতী পোশাক পরবো। আমাদের জামাকাপড় এখানেই ছেড়ে দিতে হবে।
তিনজন আধুনিক মহিলা এখন দেহাতীদের পোশাক পরে মরোক্কোবাসিনী হয়ে ছাদে গল্প করছেন।
আগাগোড়া সমস্ত ঘটনাগুলোই কেমন অস্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছিল হিলারীর। মিস নীডহেইমকে সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলো। তার চেয়ে বয়েসে ছোট হবে। গায়ের চামড়া বিবর্ণ, ক্ষুদে ক্ষুদে আঙুল। আকর্ষণীয় চেহারা নয়।
মিসেস বেকারকে বিচার করতে গিয়ে, তাকে আরও জটিল প্রকৃতির মনে হলো হিলারীর।
সন্ধ্যে পেরিয়ে আবার যাত্রা শুরু হলো, এবার আর মালগাড়িতে নয়। মাথাখোলা একটা বড় গাড়িতে, প্রত্যেকের পরনে দেহাতী পোশাক, পুরুষদের গায়ে জড়ানো আলখাল্লা, মেয়েদের মুখটাকা বোরখা। ছজন যাত্রী নিয়ে অন্ধকারের বুক চিরে গাড়ি চলছিল।
-এখন কেমন বোধ করছেন, মিসেস বেটারটন? অ্যান্ড্রু পিটার্সের দিকে চেয়ে মৃদু হাসলো হিলারী। তখন সবে সূর্য উঠেছে। প্রাতরাশের জন্য থামলো ওরা।
-মনে হচ্ছিলো যেন একটা স্বপ্নের নাটকের পাত্রপাত্রী আমরা, হিলারী বললো।
–হ্যাঁ, ব্যাপারটা সেইরকমই মনে হচ্ছে।
—এখন আমরা কোথায় আছি?
কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন পিটার্স, কী জানি? একমাত্র মিসেস কেলভিন বেকারই জানেন, আর কেউ না।
–এ দেশটা বড় ফাঁকা ফাঁকা।
–হ্যাঁ, প্রায় মরুভূমি বলা যায়। সে তো হতেই হবে, তাই নয় কি?
তার মানে আপনি বলতে চাইছেন যাতে কোনোরকম সূত্র পড়ে না থাকে সেই জন্যে?
-হ্যাঁ। সমস্ত ব্যবস্থাটা যে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে করা হবে এটাই কি ভাবা ঠিক নয়। আমাদের যাত্রাপথে একটার সঙ্গে একটার কোনোও মিল নেই। প্রথমে একটা প্লেন–সেটা পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। দ্বিতীয়ত, একটা পুরোনো মালগাড়িতে সে রাত্রির যাত্রা। গাড়িটা যদি কেউ লক্ষ্যও করে থাকে দেখবে, এই অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খোঁড়াখুঁড়ির কাজে ব্যস্ত রয়েছে গাড়িটা। তারপর এই ভোলা গাড়িতে দেহাতী লোক এ অঞ্চলের রাস্তার অতি স্বাভাবিক দৃশ্য। এরপর হয়তো–কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো সে, কী জানি!
–কিন্তু আমরা যাচ্ছিটা কোথায়?
অ্যান্ড্রু পিটার্স মাথা নেড়ে বললো, জিজ্ঞাসা করে কোনো লাভ নেই। এক সময় নিজেরাই দেখতে পাবো।
ডাঃ ব্যারন এসে তাদের আলোচনায় যোগ দিলেন। বললেন, হ্যাঁ, আমরা দেখতে পাবো বৈকি। কিন্তু কী আশ্চর্য, আমরা জিজ্ঞেস করতেও পারছি না? সবসময় আগামীকাল কী হবে, আগামীকাল কোথায় থাকবে এই নিয়েই আমাদের মাথাব্যথা।
পৃথিবীটাকে খুব তাড়াতাড়ি বদলে ফেলতে চান আপনি, তাই না ডাক্তার? পিটার্স জিজ্ঞেস করলো।
–কত কী পাবার রয়েছে, ডাঃ ব্যারন বলতে লাগলেন, অথচ জীবনটা কত ছোট্ট। জীবনটা আরও দীর্ঘ হওয়া উচিত ছিলো–আরও অনেকদিন যদি বাঁচতে পারতাম–
হিলারীর দিকে তাকিয়ে পিটার্স বললো, আপনাদের দেশে চার রকমের কী স্বাধীনতার কথা আপনারা বলেন যেন? অভাব থেকে মুক্তি, ভয় থেকে মুক্তি…