ওয়ারগ্রেভ ঘড়ি খুলে টেবিলে রাখলেন। বাঁধানো দুপাটি দাঁত খুলে একটা গ্লাসে জলে ডুবিয়ে রাখলেন।
কিন্তু এত কিছুর পরেও সেটন মুক্তি পায়নি। তার রায়েই মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল লোকটার।
ওয়ারগ্রেভ যেন আলো সহ্য করতে পারছিলেন না। দ্রুত হাতে আলোটা নিভিয়ে দিলেন।
রজার্স তার কাজ শেষ করে এনেছে। এমনি সময়ে হঠাৎ ঘটনাটা তার নজরে পড়ে গেল।
এ কী করে সম্ভব? হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে সে। একটু আগেও দশটা পুতুল সে দেখেছে, কিন্তু এখন রয়েছে একটা কম–নটা পুতুল।
আর্থার রিচমণ্ডের মুখটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। তাই বিছানায় শুয়েও কেবলই এপাশ-ওপাশ করছেন জেনারেল ডগলাস।
তরুণ অফিসারটিকে তিনি পছন্দ করতেন। তাঁর স্ত্রী লেসলিও খুশি হয়েছিল তাকে দেখে। ফলে যাতায়াত বাড়ল।
গল্পগুজব, একসঙ্গে খেলা ঘোরা সবই হতে লাগল। এখন বুঝতে পারছেন, স্নেহের ভাবটাকে প্রশ্রয় দিয়ে সেদিন কী ভুলটাই করেছিলেন।
লেসলির বয়স ছিল উনত্রিশ আর রিচমণ্ডের আঠাশ। বয়সের পার্থক্যটা চিন্তা না করেই দুজেনর মেলামেশার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
লেসলি ছিল সুন্দরী। তিনি ভালবাসতেন তাঁকে। বিশ্বাস করতেন। কিন্তু এমনভাবে যে আঘাত পাবেন বুঝতে পারেননি।
তিনি ছিলেন ফ্রান্সে–বাহিনীর সঙ্গে। রিচমণ্ডও সেখানে। মাঝে মাঝে সে দেশে–ইংলণ্ডে যেত। লেসলি ছিল সেখানেই। অবাধে মেলামেশার সুযোগ তারা পেয়েছে।
বিচিত্র উন্মাদনায় ডুবেছিল তারা। হঠাৎ লেসলির একটা চিঠি তার হাতে পড়ে যায়–রিচমণ্ডকে লেখা। কিছু আর জানতে বাকি থাকে না।
রিচমণ্ডের ঘন ঘন দেশে যাবার রহস্যটা পরিষ্কার হয়ে গেল। উঃ কী নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণায় ভুগেছেন তিনি।
সেই সময় লড়াই শেষ হবার মুখে। ফ্রান্সে শত্রুপক্ষের কয়েকটা সুরক্ষিত ঘাঁটি তখনো থেকে গিয়েছিল। তারই একটায় আক্রমণের নেতৃত্ব দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেন রিমণ্ডকে। সেই যাওয়াই তার শেষ যাওয়া হয়।
লেসলিকে তিনি রিচমণ্ডের মৃত্যু সংবাদ জানিয়েছিলেন। যুদ্ধ শেষ হলে দেশে ফিরেছেন তিনি। কিন্তু লেসলিকে কিছুই জানতে দেননি।
চমৎকার অভিনয় করে গেছেন চার বছর। লেসলি তারপর মারা গেল নিউমোনিয়া জ্বরে। সে তো আজ ষোল বছর আগের ঘটনা।
কিন্তু এই ঘটনা তো কেউ জানতো না। অথচ এতদিন পরে জানা গেল কেউ একজন। রিচমণ্ডের কথা জেনে গেছে। কিন্তু কে সে?
সমুদ্রের গর্জন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। জেনারেল ডগলাসের মনে হল শব্দটা যেন ক্রমেই তীব্রতর হচ্ছে।
.
ঘরের ছোট্ট আলোটা জ্বলছে, ভেরা শুয়ে আছে বিছানায়। ঘুম আসছে না তার চোখে।
হুগোর কথা মনে পড়ছে তার। মার্সটনের মৃত্যু কী এক অজ্ঞাত কারণে আলোড়ন তুলেছে। মনে।
মিষ্টি চেহারার চঞ্চল ছোট্ট সিরিল। শ্রীমতি হ্যাঁমিলটন তার মা।
সেদিন সন্ধ্যায় সিরিলকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল ভেরা। নিজের ঘরে যেতে গিয়ে পেছন থেকে হুগোর ডাক শুনতে পেল। বলল, চলো, দুজনে একটু বেড়িয়ে আসি।
করনওয়াল … পাহাড়ঘেরা অঞ্চল … নীল আকাশ … সামনে সমুদ্র … নরম হলুদ বালির বালিয়াড়ি–
ভেরা সম্মত হয়। নির্জন সমুদ্রতীরে এসে পাশাপাশি বসে দুজন।
হুগো জানায়, ভেরা আমি তোমায় ভালবাসি।
–আমি জানি।
–কিন্তু তুমি জান না, আমি খুব গরীব। তোমার আমার মাঝের ব্যবধান কোনোদিনই ঘুচবার নয়।
–গরীব তো কি এসে যায়–গরীব তো আমিও।
–সমস্ত সম্পত্তির অধিকার দাদার। আমিই সম্পত্তির মালিক হতে পারতাম—কিন্তু
কিন্তু কি?
–না, দাদার তো বয়স অনেক হয়েছে, সকলেই ধরে নিয়েছিল ছেলেপুলে কিছু আর হবে না। কিন্তু … তার পরেই এলো সিরিল। সে যদি মেয়ে হতো তাহলে … যাক …. সিরিলকে আমি ভালবাসি, ও বেঁচে থাকুক।
ভেরার বুঝতে কিছুই বাকি থাকল না। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। সে জানতো, হুগো, তার ভাইপোকে অসম্ভব ভালোবাসে।
তারপরের দিনই তো দুর্ঘটনা ঘটে গেল। দুষ্টুমি করে জলে নেমে আর ওঠেনি সিরিল।
ভেরা জানে, সেদিন সে তাকে স্বচ্ছন্দে বাঁচাতে পারতো। কিন্তু তার যে কোথায় বাধা ছিল–সে সিরিলকে ইচ্ছে করেই বাঁচাবার চেষ্টা করেনি।
হা ঈশ্বর! ক্ষমা করো।
ভেরা জানে না ঈশ্বর তাকে ক্ষমা করেছেন কি না। কিন্তু হুগো ক্ষমা করেনি। ওই ঘটনার পর সে আর তার মুখদর্শন করেনি।
ভেরার বুকের ভেতরে তোলপাড় শুরু হলো। সে উঠে ঘুমের ওষুধ খেলো। তারপর দুহাতে মুখ গুঁজে বসে থাকে।
রাত এগিয়ে চলে ভোরের দিকে।
২. দরজায় ধাক্কার শব্দ
০৬.
দরজায় ধাক্কার শব্দে তন্দ্রার ভাবটা কেটে যায়, ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলেন ডাঃ আরমস্ট্রং।
দরজা খুলতেই দেখেন রজার্স দাঁড়িয়ে, তার চোখে জল, মুখ শুকনো।
–তোমার কি হয়েছে রজার্স?
–আমার স্ত্রী, গলা ধরে আসে রজার্সের, সে কোনো সাড়া দিচ্ছে না।
–চলো, দেখি ব্যাপারটা।
ড্রেসিং গাউন জড়িয়ে রজার্সের ঘরে উপস্থিত হন ডাক্তার। বিছানায় বসে আস্তে করে রজার্সের স্ত্রীর হাতটা তুলে নিলেন।
বরফের মত শীতল হাত। চোখের পাতা তবু টেনে দেখলেন। তারপর গম্ভীর মুখে । অন্যদিকে তাকান।
রজার্স এগিয়ে আসে, কোন কথা বলতে পারে না, দুচোখে জল।
ডাক্তার মৃতদেহ আর একবার পরীক্ষা করলেন। তারপর বিছানা, পাশের টেবিল, ওয়াশস্ট্যান্ড সবকিছু খুঁটিয়ে দেখলেন।
–স্যার, রজার্স ধীরে ধীরে ডাকে।