–দক্ষতার সঙ্গে মামলা পরিচালনা করার জন্য আপনি কোন পুরষ্কার পাননি?
–হ্যাঁ, আমার পদোন্নতি হয়েছিল। তাতে কোনো সন্দেহ নেই যে আমি আমার কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করেছিলাম। জানায় ব্লোর।
.
এরপরে ডাঃ আরমস্ট্রং তাঁর বক্তব্য পেশ করলেন।
–সকলেই যখন বললেন, আমাকেও বলতে হল। কিন্তু কি বলব বলুন? ওই রোগীর নামও আমার মনে নেই আর। অনেকদিন আগের কথা। মনে হয় হাসপাতালের কোন অপারেশন কেস।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে যেন কিছু মনে করবার চেষ্টা করলেন ডাক্তার। পরে বললেন, শেষ মুহূর্তে এসেছিল হাসপাতালে। হ্যাঁ, আমি মদ্যপান করেছিলাম, কিছুটা নেশাও হয়েছিল। সেই অবস্থাতেই তাকে অপারেশন করেছিলাম।
হ্যাঁ, বলতে পারেন সেই মহিলাকে আমিই মেরে ফেলেছি। সামান্য অপারেশন হলেও, হাত কাঁপছিল, গোলমাল করে ফেলেছিলাম। কিন্তু এক সিনিয়র সিস্টার ছাড়া আর কেউ জানত না সেই ঘটনা।
কিন্তু, এই রহস্য আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না, এতদিন পরে কে সেই কথা জানল?
-আমার কাছ থেকে কিছু শুনবার জন্য নিশ্চয় আপনারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন? বললেন এমিলি ব্রেনট, কিন্তু আমার কিছুই বলার নেই।
বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ প্রশ্ন করলেন, কিছুই নেই?
–না, কিছুই নেই। কেন না, চিরকাল আমি আমার বিবেকের নির্দেশেই চলে এসেছি, আজও সেভাবেই চলেছি।
–বেশ, তাহলে এখানেই আমার তদন্ত শেষ হল।
এই বলে বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ সামান্য কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিলেন। তারপর রজার্সের দিকে তাকিয়ে বললেন, আচ্ছা রজার্স আমরা কজন, তুমি আর তোমার স্ত্রী ছাড়া এই দ্বীপে আর কি কেউ আছে?
–না স্যার, আমি ভাল করেই জানি।
-দেখ, যে লোকের আমন্ত্রণে আমরা এখানে এসেছি সে মোটেই সুবিধের লোক বলে মনে হচ্ছে না। আমাদের সকলের পক্ষেই ক্ষতিকর। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই দ্বীপ থেকে আমাদের চলে যাওয়া উচিত। সম্ভব হলে আজ রাতেই–
–কিন্তু স্যার এখন তো বোট নেই।
–তাহলে তীরের সঙ্গে তোমরা যোগাযোগ রাখ কি করে?
–নারাকোট রোজ সকালে আসে, রুটি, দুধ আর চিঠিপত্র থাকলে দিয়ে যায়। কিছু ফরমাস থাকলে পরে তার ব্যবস্থা করে।
–তাহলে, কাল সকালেই আমরা দ্বীপ ছেড়ে চলে যাব, আপনারা কি বলেন?
সকলেই বিচারপতির প্রস্তাব একবাক্যে সমর্থন করল। একমাত্র মার্সটন বলল, আমি কিন্তু যাচ্ছি না, বিপদে আমি ভয় পাই না, এই রহস্যের শেষ দেখে আমি যেতে চাই।
কথা শেষ করে টেবিলের ওপর থেকে একটা জলের গ্লাস তুলে নিলেন। কিন্তু মুখে ঠেকাবার সঙ্গে সঙ্গেই তার হাত থেকে গ্লাসটা পড়ে গেল। মুখটা কুঁচকে উঠল, চেয়ার থেকে টলে পড়ে গেলেন।
.
০৫.
এমন আকস্মিকভাবে ঘটনাটা ঘটল যে, বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই সকলের কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল।
সবার আগে ছুটে গেলেন ডাক্তার। নাড়ী পরীক্ষা করলেন, গম্ভীর গলায় বললেন, আশ্চর্য, এর মধ্যেই মৃত্যু!
গ্রীক ভাস্কর্যের মত সুন্দর স্বাস্থ্যোজ্জ্বল যুবক মার্সটন। এমনভাবে তার মৃত্যু হবে, কেউ যেন বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলেন না। এমন অসম্ভব ঘটনা কি করে সম্ভব হয়?
জেনারেল ডগলাস জানতে চাইলেন, বিষম লেগেই কি এমনটা হল?
–হ্যাঁ, শ্বাসরোধেরই ঘটনা। তবে পরীক্ষা করে দেখা দরকার।
এই কথা বলে ডাক্তার গ্লাসটা তুলে নাকের কাছে ধরলেন। আঙুলের ডগা দিয়ে তলানি থেকে কি তুলে নিলেন, আলতো করে জিভে ঠেকালেন।
এবারে তিনি তাকালেন মার্সটনের মৃতদেহের দিকে। মুখটা সামান্য বিকৃত হয়ে গেছে। ঠোঁটদুটো নীল।
ডাক্তার উত্তেজিত স্বরে বলে উঠলেন, এ মৃত্যু স্বাভাবিক নয়।
–তবে? ভেরা অস্ফুটে উচ্চারণ করল।
–আমার বিশ্বাস পটাসিয়াম সায়ানাইড, তাই সঙ্গে সঙ্গে কাজ করেছে।
–তাহলে কি গ্লাসে ছিল? ওয়ারগ্রেভও বিস্ময় প্রকাশ করলেন।
–হ্যাঁ!
–এমন বিষ কি নিজেই মিশিয়েছিল? লমবার্ড জানতে চান।
ব্লোর প্রতিবাদ করেন, অমন মানুষের আত্মহত্যা করা অসম্ভব। অসম্ভব।
–মনে হয় আত্মহত্যাই। চিন্তিতভাবে বললেন ডাক্তার।
পরিস্থিতি বিবেচনা করে অন্য সকলেই ডাক্তারের সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন।
অন্য গ্লাসগুলোও পরীক্ষা করা হল। কিন্তু সন্দেহ করার মত কিছুই পাওয়া গেল না।
ব্লোর বলল, এর মধ্যে নিশ্চয় কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে।
–আমিও আপনার সঙ্গে একমত। চিন্তিতভাবে বললেন ডাক্তার।
.
মার্টনের মৃতদেহ ধরাধরি করে তার ঘরে রেখে এলেন ডাক্তার আর লমবার্ড। সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে রেখে আসা হয়েছে।
একটা অদৃশ্য ঝড় যেন বয়ে গেল সকলের ওপর দিয়ে। অস্বাভাবিক থমথমে হয়ে গেল সমস্ত পরিবেশ।
রাত অনেক হয়েছিল। বারোটা। ওয়ারগ্রেভ বললেন, রাত অনেক হল, সবারই একটু ঘুম দরকার।
রজার্স বলল, আপনারা শুতে চলে যান। আমি খাবার ঘরটা পরিষ্কার করে এখুনি যাচ্ছি।
ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার স্ত্রী এখন কেমন আছে?-
-এখন ঘুমোচ্ছে।
–বেশ। ঘুমটা দরকার।
.
রাতের পোশাক পরে ওয়ারগ্রেভ শুতে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন। সহসা এডওয়ার্ড সেটনের কথা তার মনে পড়ল।
দুঁদে উকিল ম্যাথুস ওর হয়ে খুব জোরালো সওয়াল করেছিল। কিন্তু সরকার পক্ষের উকিল ছিল একেবারে অপদার্থ।
জেরার উত্তরে সেটনও শান্ত সংযতভাবে সুন্দর জবাব দিয়েছিল। জুরিরাও প্রভাবিত হয়েছিল। সকলেই ধরে নিয়েছিল সে বেকসুর খালাস পেয়ে যাবে।