কিন্তু তার বিরুদ্ধে যে প্রমাণ পাওয়া গেছে তার চুলচেরা বিচার করে আমি তাকে মৃত্যুদণ্ড দিই।
মিঃ ওয়ারগ্রেভ সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে ফের বললেন, আমি বিচারকের আসনে বসে আইন রক্ষার পবিত্র কর্তব্য পালন করেছি মাত্র। আমার বিবেকের কাছেও আমি পরিষ্কার। আপনারাই বলুন, আমার অপরাধটা কোথায়?
ডাঃ আরমস্ট্রং-এর মনে পড়ে যায় মামলাটার কথা।
এক অ্যাডভোকেট বন্ধুর কাছে তিনি শুনেছিলেন। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, আসামীর ওপর জজের নিশ্চয় কোন পোষা রাগ ছিল। তাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আইন ঘেঁটে তাকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়েছিল।
ডাক্তার বললেন, মামলার আগে থেকে আপনি কি সেটনকে চিনতেন?
কথাটা শুনে ওয়ারগ্রেভের মুখচোখ লাল হয়ে উঠল। কিন্তু আশ্চর্যভাবে নিজেকে সংযত করলেন। বললেন, তার নাম পর্যন্ত আগে কখনো শুনিনি। পরিচয়ের প্রশ্নই আসে না।
ডাক্তার আরমস্ট্রং কিন্তু কথাটা বিশ্বাস করতে পারলেন না। মনে মনে বললেন, জজসাহেব, তুমি মিথ্যাবাদী।
.
বিচারপতির বক্তব্য শেষ হলে ভেরা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আমার কথাটা বলছি শুনুন। একটা শিশু, তার ডাকনাম ছিল সিরিল। আমি তার গভর্নেস ছিলাম। আমি তাকে খুব ভালবাসতাম।
বলতে বলতে কান্নায় বুজে এলো তার গলা। পরে সামলে নিয়ে বলল, একদিন আমি তাকে সাঁতার শেখাচ্ছিলাম।
একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। আমার জলে নামার আগেই দুষ্টুটা জলে নেমে পড়েছিল। খেয়াল হতেই জলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
তাকে টেনে তুললাম বটে, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। এই শিশুটির মৃত্যুর জন্য আমি তো দায়ী ছিলাম না।
ভেরা রুমাল দিয়ে চোখ মুছে নিল। পরে বলল, তদন্তে আমি নির্দোষ প্রমাণিত হই। ওদের পরিবারের কারোরই কোনো অভিযোগ ছিল না আমার ওপরে, সকলেই আমাকে ভালবাসতো।
কিন্তু এখন এতদিন পরে আমাকে এই মৃত্যুর জন্য দোষারোপ করা হচ্ছে। এসব কি? কার এই কারসাজি? উদ্দেশ্য কি?
বলতে বলতে ভেরা কান্নায় ভেঙে পড়ে।
জেনারেল ডগলাস ভেরাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, তুমি কেঁদো না। সবই মিথ্যে। আমরা সকলেই তা বুঝতে পারছি। কোন পাগলেরই কাণ্ড এসব।
এরপর ডগলাস সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অকল্পিত দৃঢ় স্বরে বললেন, আর্থার রিচমণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে আমার স্ত্রীর সম্পর্কে যেসব কথা বলা হয়েছে, তার কোন সত্যতা নেই। আমার স্ত্রী ছিলেন নির্মল চরিত্রের সাধ্বী মহিলা।
রিচমণ্ড ছিল আমার বাহিনীর এক নতুন অফিসার। যুদ্ধক্ষেত্রেই সৈনিকের মত মৃত্যুবরণ করেছিল সে। একজন সৈনিকের যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যু সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ঘটনা।
কথা শেষ করে জেনারেল বসে পড়লেন। মুখ দেখে মনে হচ্ছিল তিনি প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করছেন।
এবারে লমবার্ড বলতে শুরু করলেন। দুচোখে কৌতুকের দৃষ্টি নিয়ে তিনি বললেন, অদৃশ্য অভিযোগকারী কালামানুষগুলোর কথা বলল, তা সম্পূর্ণ সত্য। সকলে চমকে উঠে তাকাল লম্বার্ডের দিকে।
–হ্যাঁ, সম্পূর্ণ সত্যি, হাসল লমবার্ড, বনের মধ্যে আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। খাবারও ফুরিয়ে গিয়েছিল।
দলে আমরা ইংরাজ ছিলাম তিনজন। সবাই চায় নিজের প্রাণ বাঁচাতে। আমরাও ওদের ফেলে রেখে পালিয়ে এসেছিলাম।
–ছিঃ ছিঃ, দলের লোকদের ফেলে পালিয়ে এলে? এ তো কাপুরুষের কাজ। ধিক্কার জানালেন ডগলাস।
–হ্যাঁ, এখন বুঝতে পারছি, লমবার্ড বলল, খাঁটি ইংরাজের মত কাজটা হয়নি। আমাদের তখনকার মনের অবস্থা আশা করি আপনারা বিবেচনা করবেন। তাছাড়া, কুড়িটা জংলী মানুষের চেয়ে তিনজন শ্বেতাঙ্গের প্রাণের মূল্য অনেক বেশি।
.
–আমার নিজের কথা এবারে বলছি, অ্যান্টনি মার্টন বলতে শুরু করলেন, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ শোনানো হয়েছে, জন এবং লুসি কোম্বের হত্যার জন্য নাকি আমি দায়ী।
কিন্তু ঘটনাটা যে একটা দুর্ঘটনা ছিল, তা আপনারাও নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন। কেম্বুিজের কাছে গাড়ি চালিয়ে আসছিলাম, কাছের একটা বাড়ি থেকে দুটো বাচ্চা দৌড়ে আমার গাড়ির তলায় এসে পড়েছিল। এভাবেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল।
.
মিঃ ওয়ারগ্রেভ রজার্সের দিকে তাকালেন। বুঝতে পেরে সে বলল, মিস ব্র্যাডির মৃত্যুর সঙ্গে আমাকে ও আমার স্ত্রীকে জড়িয়ে যা বলা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
–বলে যাও।
সেই বৃদ্ধা ছিলেন চিরকুমারী। তাঁর শরীর ভাল ছিল না। আমরা দুজন দেখাশোনা করতাম। একদিন রাতে তার শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। বাইরে তখন প্রবল বৃষ্টি। তার মধ্যেই পায়ে হেঁটে ডাক্তারের বাড়ি গেলাম। তিনিও এলেন, কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। মিস ব্র্যাডি হার্টফেল করে মারা যায়।
লমবার্ড মুখে কিছু বলল না কিন্তু স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রজার্সের দিকে।
.
লমবার্ড ব্লোরের দিকে তাকিয়ে বলল, এবারে নিজের কথা আপনি কিছু বলুন।
–আমার আর কি কথা!
–কেন, অভিযুক্তদের তালিকায় আপনার নামও তো ছিল।
–ল্যান্ডারের কথা বলছেন, সে-তো ছিল একটা ব্যাঙ্কলুটের আসামী।
বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ একটু নড়েচড়ে বসলেন। বললেন, এই মামলাটা আমার এজলাসে ওঠেনি। তবে মামলার কথা আমার মনে আছে।
আপনার সাক্ষ্য বিবেচনা করেই ল্যান্ডারের শাস্তি হয়েছিল। পুলিসের পক্ষে আপনিই তো মকদ্দমাটা তদারক করেছিলেন, তাই না?
–হ্যাঁ। ব্লোর বলল, রাতের পাহারাদারকে কাবু করে সে তার কাজ হাসিল করেছিল। তার অপরাধ স্পষ্টভাবে প্রমাণ হয়েছিল। কারাবাসেই অসুস্থতায় মৃত্যু হয়েছিল।