পরিচারকটি আবার বলে, আপনারা এখানে বিশ্রাম করুন। আমার নাম রজার্স। আমি এবং আমার স্ত্রী আপনাদের দেখাশোনা করব।
মিঃ আওয়েন দুঃখের সঙ্গে জানিয়েছেন, তিনি আজ আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে পারছেন না। তবে আগামীকাল দুপুরের মধ্যে এসে যাবেন। আপনাদের সকলের জন্যই আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করা আছে।
আপনারা বিশ্রাম করুন, আটটায় ডিনার।
এই বলে বিদায় নিয়ে রজার্স তার কাজে চলে গেল।
রজার্সের স্ত্রীর সঙ্গে ভেরা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এল। একটা ঘরের দরজা খুলে সে বলল, ম্যাডাম এটা আপনার ঘর।
চমৎকার সাজানো গোছানো ঘরটা দেখে ভেরার খুব পছন্দ হল। সে খুশি হয়ে বলল, খুব সুন্দর ঘর।
–আপনার কিছু প্রয়োজন হলে দয়া করে বেল বাজাবেন।
ভেরা বলল, আচ্ছা শোন, আমি হলাম মিসেস আওয়েনের সেক্রেটারি। আমার কথা তোমাকে নিশ্চয়ই কিছু বলেছেন তিনি?
–না ম্যাডাম; আমি কিছুই জানি না। আমরা কেবল একটা তালিকা পেয়েছি, তাতেই জানানো ছিল কে কোন ঘরে থাকবেন।
ভেরা কথাটা শুনে বিরক্ত হল। ভদ্রমহিলা তো অদ্ভুত! তাঁর নিজস্ব কর্মচারি হয়ে আসছে। সে, অথচ–
ভেরা জিজ্ঞেস করল, তোমরা কাজের লোক এখানে কজন আছ?
–আমরা দুজন। রান্নার কাজটা আমি দেখি, বাইরের অন্যসব কাজ আমার স্বামী দেখেন। আপনাদের কোনো অসুবিধাই হবে না।
–আমরা তো লোক কম নই, দশজন। তার ওপর মিঃ ও মিসেস আওয়েন আসবেন। এতজনের কাজ–
–অসুবিধে হবে না। ম্যাডাম, এবার আমি একটু কিচেনের দিকে যাচ্ছি।
রজার্সের স্ত্রী চলে গেল। মহিলার চোখমুখ ফ্যাকাসে। রক্তশূন্যতা বলেই মনে হল ভেরার। কিন্তু সমস্ত অবয়বে কেমন যেন একটা ভয়-ভয় ভাব। কিসের ভয়?
দিন শেষ হবার মুখে মুখে ডাঃ আরমস্ট্রং বোট থেকে পান্না দ্বীপে নামলেন। বোটচালকের নাম নরোকট।
অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। দ্বীপের চারদিক পরিষ্কার দেখা গেল না। ডাক্তার সমুদ্রের দিকে তাকালেন। মনে বড় আরাম পেলেন।
ধীর পায়ে এগিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলেন ডাক্তার। একজন বয়স্ক ভদ্রলোকের দিকে চোখ পড়ল তার। চিনতে পারলেন তাকে–বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ।
একবার তার এজলাসে ডাক্তারকে সাক্ষ্য দিতে হয়েছিল। দক্ষ বিচারপতি। দোষীদের প্রতি নিষ্করুণ। সেই কারণে অনেকেই আড়ালে তাকে নিষ্ঠুর বলে।
এখানে যে তার দেখা পাবেন ডাক্তার আশা করতে পারেননি।
.
বিচারপতি ওয়ারগ্রেভও ডাক্তারকে দেখে ভাবছিলেন, এই ভদ্রলোকই তো–হ্যাঁ, নামটা মনে পড়েছে, আরমস্ট্রং–একবার সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন।
মিঃ ওয়ারগ্রেভ একবার যাকে দেখেন, সহজে তাকে ভোলেন না। তিনি ডাক্তারকে বললেন, ওই হলঘরে গিয়ে বসুন।
ডাক্তার জানান, ভাবছি মিঃ ও মিসেস আওয়েনের সঙ্গে একবার দেখা করব।
–তা তো সম্ভব নয়!
–নয়?
–ওরা কেউ এখানে নেই। কোথায় যে এসেছি, কিছুই বুঝতে পারছি না।
ডাক্তার কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। তারপর তিনি হলঘরের দিকে এগিয়ে যান।
.
অ্যান্টনি মার্সটন পথের ক্লান্তি দূর করল প্রাণভরে স্নান করে। নতুন পোশাক পরে বেশ ধোপদুরস্ত হয়ে নিয়েছে।
নির্জন জায়গাটা তার কেমন অদ্ভুত লাগছে। একটা যেন ছমছমে ভাব। তবে এ নিয়ে তার মনে ভয়টয়ের কোনো ব্যাপার নেই। ভয় কাকে বলে সে জানে না।
.
ব্লোর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথায় চিরুনি বোলায়, টাইয়ের নটটাও ঠিকঠাক করে নিতে ভোলে না।
মনে মনে ভাবছে, এতগুলো মানুষ এখানে জড়ো হয়েছে, কেউ কাউকে চেনে না। আমন্ত্রণকারীও অনুপস্থিত। সবই যেন কেমন অদ্ভুত। কেউ বিশেষ কোন কথা বলছে না, কিন্তু পরস্পরের দিকে যেন কেমন করে তাকাচ্ছে।
ব্লোর-এর মনে পড়ল, ছোটবেলায় একবার এই দ্বীপে বেড়াতে এসেছিল। ভাগ্যের কি নির্বন্ধ, আবার এসেছে এখানে।
.
কাঁটায় কাঁটায় রাত আটটায় ডিনারের ঘন্টা বাজল। ফিলিপ লমবার্ড ঘর থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে নিচে নেমে এল।
মিস এমিলি বাইবেল খুলে বসেছিলেন। ডিনারের ঘন্টা শুনে বই বন্ধ করে রাখলেন। তারপর ধীরে ধীরে নিচে নামতে লাগলেন।
.
০৩.
ডিনারে রজার্সের স্ত্রীর রান্নার প্রশংসা করলেন সকলে। রজার্স নিজেও চমৎকার পরিবেশন করল। অতিথিরা সকলেই খুশি।
এসে অবধি সকলের মধ্যেই যে একটা গুমোট ভাব ছিল সেটা এখন নেই। একে অন্যের সঙ্গে মন খুলে গল্পগুজব করছেন।
ডাক্তার ও মাসটন গল্প জুড়েছেন বিচারপতি ওয়ারগ্রেভের সঙ্গে। আদালতের নানা কাহিনী তিনি শোনাচ্ছেন।
ওদিকে ডগলাস ও মিস এমিলির মধ্যেও আলাপ যেন বেশ জমে উঠেছে।
ভেরা ক্লেথর্ন বরাবরই বড্ড কৌতূহলী। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার গল্প শুনছেন ডেভিসের কাছ থেকে। পাশে বসে শুনছেন লমবার্ডও। মাঝে মাঝে অন্যদের দিকেও তাকাচ্ছে।
–এগুলো কি?
মার্সটনের কথায় সকলেই তাকাল তার দিকে। সকলেরই চোখে পড়ল, ডাইনিং টেবিলের দক্ষিণ কোণে একটা টেবিলে কাচের স্ট্যান্ডে সাজান রয়েছে রঙীন দশটা পুতুল।
-বাঃ ভারি সুন্দর তো। ভেরা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, এ যে অনেকগুলো। এক…দুই… তিন…বাব্বাঃ দশটা পুতুল। ছেলেবেলায় আমারও ছিল কতগুলো।
–সবারই থাকে। একজন বলল।
–এসব হল বড়লোকের বিচিত্র খেয়ালের নমুনা। বললেন ওয়ারগ্রেভ।
–ঠিকই বলেছেন। সমর্থন জানাল মিস এমিলি।
বাতাসের সঙ্গে সমুদ্রের গর্জন ঘরে ঢুকছে। কখনো বাড়ছে কখনো স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে। ভেরা বলে, মনে হয়েছিল ঝড় উঠবে। তাহলে অবশ্য ভয়ের কিছু নেই। মিসেস আওয়েনরা আমাদের জন্য সব ব্যবস্থাই করে রেখেছেন।