দ্রুতহাতে কাজটা শেষ করেই আবার বারান্দায় ফিরে এসেছিলাম।
১০ই আগস্ট সকালে অভ্যাসমত দাড়ি কামিয়ে রজার্স নিচে গিয়ে রান্নাঘরের কাজে হাত লাগায়। কাঠ দরকার হওয়ায় কাটারী দিয়ে কিছু কাঠ কাটল। সেই সময় নিঃশব্দে পেছন থেকে গিয়ে কুঠারের এক আঘাতে তাকে চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম।
সকলে যখন রজার্সের খোঁজে ছুটোছুটি করছে, আমি কঁক বুঝে লম্বার্ডের ঘরে গিয়ে তার রিভলবারটা নিয়ে এলাম। সেটা কোথায় রাখতো আমি জানতাম।
প্রাতরাশের টেবিলে এমিলির কফিতে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিলাম। খুব সাবধানতার সঙ্গে একাজটা আমাকে করতে হয়েছিল।
কফি পান করেই তিনি আধা অচৈতন্য হয়ে পড়েন। সেই অবস্থায় তাকে একলা পেয়ে ইনজেকশন দিয়ে তার শরীরে কড়া সায়ানাইড সলিউশন ঢুকিয়ে দিলাম।
এই ঘটনাকে অন্যরূপ দেবার উদ্দেশ্যে আমাকে দুটো মৌমাছির সাহায্য নিতে হয়েছিল। এব্যবস্থা আমি আগেই করে রেখেছিলাম।
এতগুলো মৃত্যুর পর পরামর্শের ছলে সকলের মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিলাম। আমার আমন্ত্রিত অতিথিরা পরস্পরকে সন্দেহ করতে শুরু করল।
এই সূত্রেই ঘর তল্লাশী হল। রজার্সের রিভলভার পাওয়া গেল না। সেটা যাতে খুঁজে পাওয়া না যায় সেজন্য আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম নতুন বিস্কুটের টিনের মধ্যে। লেবেল লাগানো ছিল বলে কেউ সেদিকে ফিরেও তাকায়নি।
এরপর এই হত্যা-নাটকের এক বিচিত্র দৃশ্যের অবতারণা করলাম।
ডাক্তারের মনোভাব আমি জানতাম। পরপর কয়েকটা ঘটনায় তার ভূমিকা অনেকেরই সন্দেহ উদ্রেক করেছিল।
সেই অবস্থায় তাকে জানালাম হত্যাকারীকে ধরার জন্য একটা পরিকল্পনা করেছি, তার সাহায্য আমার দরকার।
ডাক্তার এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। তখন তাকে জানালাম, পর পর মৃত্যুর ঘটনাতো ঘটেই চলেছে। এরপর আমি মারা গেছি এমন ভাবে পড়ে থাকব। কেউ সন্দেহ করবে না। আপনি আমাকে পরীক্ষা করে মৃত বলে ঘোষণা করবেন। আপনি বললে আর কেউ সন্দেহ করবে না।
তিনি কিছুমাত্র সন্দেহ করলেন না। তাকে তখন পরিকল্পনাটা খুলে জানালাম।
পরিকল্পনা মত সেদিন সন্ধ্যায় আলো জ্বলল না। মোমবাতি জ্বালানো হল। ভেরাকে ওপরতলায় ভয় দেখাবার ব্যবস্থা করে রাখা ছিল। সে চেঁচামেচি জুড়তেই সকলে তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
আমি সেই সময় আমার ঘরে গিয়ে মরার ভান করে পড়ে রইলাম। যথারীতি ডাক্তার আমাকে পরীক্ষা করে মৃত বলে ঘোষণা করলেন।
সেই রাতেই দুটোর সময় চুপিচুপি ডেকে ডাক্তারকে ঘর থেকে বার করে নিয়ে গেলাম। জরুরী পরামর্শ আছে বলে তাকে সমুদ্রের ধারে টিলার আড়ালে নিয়ে গেলাম।
সেখানে আলোচনার ফাঁকে সজোরে ধাক্কা মেরে ডাক্তারকে টিলার ওপর থেকে নিচে ফেলে দিলাম।
বাড়িতে ফিরে এসে ফের ডাক্তারের ঘরে গেলাম। বেরুবার সময় একটু শব্দ করলাম ইচ্ছে করেই।
ব্লোর ভাবল, ডাক্তার বাইরে গেলেন। আমি সিঁড়ির তলায় লুকিয়ে পড়েছিলাম। ব্লোর আর লমবার্ড যখন ডাক্তারকে খুঁজতে বাইরে গেল, আমি ফের আমার ঘরে গিয়ে মৃতের ভূমিকা গ্রহণ করি।
তার আগে অবশ্য লম্বার্ডের ঘরের ড্রয়ারে তার রিভলভারটা রেখে আসি।
এরপর বাকি রইল তিনজন। ভেরা, লমবার্ড এবং ব্লোর। এদের তিনজনের মনেই ভয় আতঙ্ক, অবিশ্বাস।
ভেরা আর লমবার্ড বাড়িতে যেতে চাইল না। ব্লোর একাই ফিরে গেল।
আমি পাথর নিয়ে প্রস্তুত হয়েই ছিলাম। কাছাকাছি আসতেই ছুঁড়ে মারলাম। বুড়ো বয়সেও নিশানা এতটুকু ফসকায়নি, আশ্চর্য। ব্লোর শেষ হয়ে গেল।
এরপর আমার চোখের সামনেই বুদ্ধিমতী ভেরা লমবার্ডকে গুলি করে মারল। স্বাভাবিক ভাবেই তাদের দুজনের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি তীব্র হয়ে উঠেছিল।
এবারে ভেরা একা হয়ে গেল। সমস্ত দ্বীপে সে একা জীবিত মানুষ।
তার একমাত্র প্রতিবেশী কতগুলো মৃতদেহ। এই পরিস্থিতি এবং তার নিজের মনের পাপ-হুঁগোর প্রতি প্রতারণা, হুগোর ভাইপোর হত্যা এবং সর্বশেষ লমবার্ডকে হত্যা–সব মিলেমিশে তার মনের ওপর প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করল। সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল।
শেষ দৃশ্যটা পরিকল্পনা মত সাজিয়ে রেখেছিলাম। ভেরা প্রত্যাশিতভাবেই আত্মহত্যায় প্রবৃত্ত হল। আমি তার পায়ের নিচ থেকে চেয়ারটা নিয়ে দেয়ালের কাছে সরিয়ে রাখলাম।
.
আমার এই স্বীকারোক্তি কাচের বোতলে ভরে সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হবে। বোতলের মুখ ছিপি আটকে সীল করে দেব।
গতকালই ওরা তিনজন, লমবার্ড, ভেরা আর ব্লোর দ্বীপ থেকে সাহায্য সঙ্কেত পাঠিয়েছিল। উপকূল থেকে সাহায্যকারী দল চলে আসার আগেই আমাকে বাকি কাজটুকু শেষ করতে হবে।
আমার পঁসিনে চশমার কর্ডটা সাধারণ সুতো নয়। ইলাস্টিক। এই কর্ডটা যাতে বাইরে থাকে সেভাবে চশমাটা শক্ত খাপে ভরে রাখতে হবে।
আমার বিছানা থেকে দরজার দূরত্ব খুবই সামান্য। দরজার হাতলের সঙ্গে কার্ডটা অলতোভাবে লাগানো থাকবে।
আমি বিছানায় গিয়ে শোব। চশমার খাপটা রাখব আমার পায়ের তলায়। আর ইলাস্টিক কর্ডটার সঙ্গে রিভলবারটা বেঁধে নেবো।
রিভলভারে রয়েছে ভেরার হাতের ছাপ। রুমাল জড়িয়ে ওটা ধরব। তারপর মাথা লক্ষ্য করে ট্রিগার টিপে দেব।
যে ঘটনাটা ঘটবে তা দাঁড়াবে এরকম–আমার হাত এলিয়ে পড়বে। সেই ঝাঁকুনিতে দরজার হাতল থেকে কর্ডটা খসে পড়বে, আর কর্ডের টানে রিভলভার ছিটকে দরজার কাছে গিয়ে পড়বে, রুমালটা খাটের কাছাকাছি পড়ে থাকব।