রজার্স দম্পতির অপরাধ কিন্তু লোকে বুঝতে পারল না। ওরা ব্যস্তভাবে ডাক্তারের কাছে ছুটোছুটি করেছে, তাদের ব্যাকুলতা, কান্না ইত্যাদি দেখে কেউই তাদের সন্দেহ করতে পারল না।
এই ঘটনা শোনার পর আমার ভেতরের নীতিবোধ এবং জিঘাংসা প্রবৃত্তি একই সঙ্গে যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।
ঠিক করলাম, আইন যাদের সাজা দিতে পারেনি, আমি এমন লোকদের খুঁজে বার করবো। নিজের হাতেই তাদের শাস্তিবিধান করব।
পদমর্যাদায় এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠায় গণ্যমান্য এমন বহুলোকের সঙ্গেই আমার আলাপ-পরিচয় ছিল। তাদের কাছ থেকে গোটা দশেক ঘটনা আমি বার করে নিলাম।
কি করে এই ঘটনাগুলো সংগ্রহ করলাম তা বোঝাবার জন্য দু-একটি ঘটনা উল্লেখ করছি।
একদিন এক প্রৌঢ়া নার্সের সঙ্গে মদ্যপানের অপকারিতা বিষয়ে কথা হচ্ছিল। কথা প্রসঙ্গে তিনি এক ডাক্তারের কথা জানালেন।
এই ভদ্রলোক একদিন মদ্যপ অবস্থায় এক রোগীকে অপারেশন করেন। অপারেশনের ত্রুটির জন্য রুগীটি মারা যায়।
ভদ্রমহিলা অসতর্ক মুহূর্তে সেই ডাক্তারের পরিচয় প্রকাশ করে ফেলেন। সেই ডাক্তারই হলেন আরমস্ট্রং। তার চেম্বার হার্লে স্ট্রিটে।
একদিন এক ক্লাবে দুই ফৌজি অফিসারের সঙ্গে আলাপ হয়। তাদের কাছ থেকে জেনারেল ডগলাসের কাহিনী জানতে পারি।
এক প্রাক্তন সহকর্মী জানিয়েছিলেন ফিলিপ লমবার্ডের কাহিনী।
ব্রেনট এমিলি ছিলেন নীতিবাগিশ মহিলা। সেই জন্য অন্তঃসত্ত্বা বিয়াত্রিচে টেলারকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে দ্বিধা করেননি।
আমাদের সমাজে এমন বহু ধনী ব্যক্তি রয়েছেন যারা অর্থের জোরে যা কিছু করে বেড়ান। আইন বা নীতির তোয়াক্কা করেন না।
এমনি একজন হলেন অ্যান্টনি মার্সটন। এদের কাছে সাধারণ মানুষের মূল্য কানাকড়িও নয়।
কাজে বা দায়িত্বে অবহেলাকে আমি গুরুতর অপরাধ মনে না করে পারি না। আমি তাদের ক্ষমা করতে পারি না। ল্যাণ্ডর মামলা প্রসঙ্গে এমন একজনের নাম শুনেছিলাম, তিনি হলেন পুলিস ইনসপেক্টর ব্লোর।
একবার আমেরিকা যাবার পথে জাহাজে আলাপ হয়েছিল ভেরার প্রেমিক হুগোর সঙ্গে। সে একটু বেশি মদ খেয়ে ফেলেছিল, সেই অবস্থায় ভেরার সবকথা আমাকে জানায়। ভেরাকে। সে আজো ভালবাসে। কিন্তু তার অপরাধকে কোনদিনই ক্ষমা করতে পারবে না।
আমার তালিকার দশম অপরাধী হল মরিস। সে নানাপ্রকার নিষিদ্ধ কাজ করত। চোরাইমালের কাজটাই প্রধান।
লোকের চোখে ফাঁকি দেবার জন্য ঠিকাদারির আড়াল নিয়েছিল। পুলিস সঠিক প্রমাণের অভাবে তাকে কোনদিন ধরতে পারেনি।
নামগুলো সংগ্রহ হবার পর, একটা পরিচ্ছন্ন পরিকল্পনা ছকে ফেললাম। সেই মত পান্না দ্বীপটা কিনে ফেললাম। তারপর মরিসকে দিয়ে সাজানো-গোছানোর কাজটাও করিয়ে নিলাম। এরপর হাত দিলাম আসল কাজে। অনেক ভেবেচিন্তে সুকৌশলে ওদের দশজনকে আমন্ত্রণের ব্যবস্থা করে ফেললাম। ওরা সকলে রাজি হবে কিনা, এব্যাপারে আশঙ্কা ছিল। তা দূর হল ওদের সায় পেয়ে।
প্রথম ধাপে সফল হওয়ায় বেশ স্বস্তিবোধ করলাম।
পান্না দ্বীপে একই দিনে অর্থাৎ ৮ই আগস্ট হাজির হবার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। বলাবাহুল্য, এই দলে আমিও ছিলাম।
হাতের কাছেই ছিল মরিস, আইনের চোখে ফাঁকি-দেওয়া অপরাধী। পান্না দ্বীপে যাবার আগে তার ব্যবস্থাটা করতে হল।
পান্না দ্বীপে যাবার আগের দিন মরিস আমার কাছে এসেছিল। আমি জানতাম সে প্রায়ই বদহজমে ভোগে।
তার অতিশয় কুশলকামী আমি, এমন ভান করতে হল আমাকে। জানালাম, আমি যে ওষুধ খেয়ে বদহজমের রোগমুক্ত হয়েছি, সেটা খেলে সে-ও উপকার পেতে পারে।
আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সে ওষুধের নামটা লিখে দেবার জন্য অনুরোধ জানাল।
আমি আগেই তার জন্য একটা কড়া ঘুমের ক্যাপসুল কিনে এনে রেখেছিলাম। ড্রয়ার হাতড়ে সেটা বার করে তার হাতে দিয়ে ভাল মানুষের মত জানালাম, একটা আমার কাছে ছিল, এটা সে খেতে পারে।
রাতে শুতে যাবার আগে ক্যাপসুলটা খেতে হবে সে-কথাও মরিসকে জানিয়ে দিলাম।
আমি জানি সে আমার নির্দেশমতোই ক্যাপসুলটা খেয়েছিল এবং সে-রাতের ঘুমই তার শেষ ঘুম হয়েছিল।
পান্না দ্বীপে যাবার পর ঠিক করলাম যাদের অপরাধ গুরুতর, তাদেরই আগে সরিয়ে দিতে হবে। আর মৃত্যুর আগে যাতে ভয় ও মানসিক যন্ত্রণায় বিধ্বস্ত হয়, সে ব্যবস্থাও করতে হবে।
মার্সটন টাকার গরমে তার অপরাধের কথা ভুলে থাকবার চেষ্টা করত। তাই প্রথমেই গেল সে।
এরপর গেল রজার্সের স্ত্রী। যদিও স্বামীর নির্দেশেই সে সবকিছু করতে বাধ্য হয়েছিল।
রজার্সের স্ত্রী ও মার্সটনের মৃত্যুযন্ত্রণা কম ছিল।
গ্রামোফোন রেকর্ড চলবার সময় সকলে যখন অন্যমনস্ক বিভ্রান্ত অবস্থায় ছিল, সেই সময় মার্সটনের পানপাত্রে সায়ানাইড মিশিয়ে দিলাম। চুমুক দেবার সঙ্গে সঙ্গেই তার মৃত্যু হল।
গ্রামোফোনের অভিযোগ শুনে রজার্সের স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লে তার জন্য ব্র্যাণ্ডি নিয়ে আসে রজার্স। সকলের অলক্ষ্যে তাতে বেশি মাত্রায় ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিলাম।
তখনো পর্যন্ত মৃত্যুর ব্যাপারে কারো মনে তেমন বিভীষিকা জাগেনি। কাজেই কেউই কিছু সন্দেহ করতে পারল না।
জেনারেল ডগলাসের মৃত্যুটাও আকস্মিকভাবে ঘটিয়েছিলাম, তিনি বিশেষ কষ্ট পাননি। সমুদ্রতীরে আমি তার পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, কিছুই টের পাননি। বারান্দা থেকে সতর্কভাবেই বেরিয়ে গিয়েছিলাম, অন্যরা কেউ বুঝতেই পারেনি।