সেই অনুযায়ী মৃত্যুগুলো পরপর এভাবে ঘটে–মার্সটন, রজার্সের স্ত্রী, জেনারেল ডগলাস রজার্স, এমিলি ব্রেনট এবং ওয়ারগ্রেভ।
মেন একটু থামল। মাথা নত করে কি ভাবল। পরক্ষণে বলল ভেরা তার ডায়েরিতে লিখেছে, ডাক্তারকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। লমবার্ড আর বোর সেই রাতে তাকে খুঁজতে বের হয়।
ব্লোরও তার নোটবইতে লিখেছে, ডাক্তার নিরুদ্দেশ। এরপর এসম্পর্কে কেউ আর কোন কথা লেখেননি।
এখন স্যার, ডাক্তার যে এই তিনজনকে হত্যা করে নিজে জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছে তা বলা যাবে না। কেন না, ডাক্তারকে জল থেকে তুলে আনা হয়েছে এবং টিলার ওপরে রাখা হয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে কেউ তখনো বেঁচেছিল।
ব্লোর আর ভেরাকে হত্যা করার পর লমবার্ড আত্মহত্যা করেছে–এরকম ভাবাও সম্ভব হচ্ছে না কারণ তাহলে রিভলভারটা তার কাছে পাওয়া যেত। সেটা পাওয়া গেছে ওয়ারগ্রেভের ঘরে।
-আচ্ছা, সেটাতে কোন ছাপ পাওয়া গেছে?
হা স্যার, ভেরার হাতের ছাপ পাওয়া গেছে।
–গন্ডগোল তো মিটছে না দেখছি।
–গন্ডগোল আরও একক্ষেত্রেও পাওয়া যাচ্ছে। যদি ধরা যায় ভেরা লমবার্ডকে গুলি করে হত্যা করার পর ব্লোরকে পাথর ছুঁড়ে নিহত করেছে। কিন্তু তার পরই সূত্র ছিঁড়ে যাচ্ছে।
ভেরার পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে একটা চেয়ারে অথচ সে চেয়ারটা তার পায়ের নিচে ছিল না। চেয়ারটা পাওয়া গেছে ঘরের এক কোণে।
–এ কী করে সম্ভব?
–আমারও জিজ্ঞাসা সেটাই। যাই হোক, সবশেষে ব্লোরের কথা বলছি। যদি ধরে নিই সে লমবার্ডকে গুলি করে হত্যা করে এবং পরে ভেরাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে নিজে আত্মহত্যা করেছে, তাহলে গোলমাল থাকছে।
–কি রকম?
–সে মারা গেছে একটা পাথরের আঘাতে, সেটা ছুঁড়ে মারা হয়েছিল পেছন দিক থেকে। তাহলে পাথরটা কে ছুঁড়ে মারল?
-হ্যাঁ, ঠিক কথা।
–সব মিলিয়ে ব্যাপারটা তাহলে দাঁড়াচ্ছে এরকম, আওয়েন দশজনকে হত্যা করে নিজে ওই দ্বীপে ছিল। তারপর তার আর কোন হদিশ পাওয়া যায়নি। ডেভনের লোকদের দৃঢ় বিশ্বাস, প্রথম, সাহায্য-সঙ্কেত পাবার পর থেকে উদ্ধারকারী দল পৌঁছবার আগে পর্যন্ত ওখান থেকে পালায়নি।
এই পরিস্থিতিতে পান্না দ্বীপের মৃত্যু-রহস্যের সমাধান আদৌ সম্ভব নয়। এই ঘটনা রহস্যাবৃতই থেকে যাবে।
-আমিও ভেবে পাচ্ছি না, কে এই রহস্যের নায়ক?
.
গ্রন্থিমোচন
একটা মাছধরার জালে মাছের সঙ্গে একটা কাচের বোতল পাওয়া গিয়েছিল। বোতলের ছিপি খুলে তার মধ্যে একটা লেখা পাওয়া গিয়েছিল। জাহাজের মালিক সেই লেখা কাগজ স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডে পাঠিয়ে দেয়। নিচে সেই লেখাটা দেওয়া হল।
.
আমার এই স্বীকারোক্তি সমুদ্রে ভাসিয়ে দিচ্ছি। যদি এটা কারোর হাতে পড়ে ভাল নইলে হয়তো ঢেউয়ের ধাক্কায় পাথরে লেগে ভেঙ্গে সমুদ্রে ভেসে যাবে।
অবশ্য তাহলে মন্দ হয় না।
ছেলেবেলা থেকেই একটা নিষ্ঠুরতা আমার মধ্যে আত্মপ্রকাশ করেছিল। অকারণে পোকামাকড়দের কষ্ট দিতে আমার ভাল লাগত।
বড় হয়ে এই ভাবটার প্রকাশভঙ্গী পাল্টে ছিল। তখন আমার মধ্যে সজাগ হয়েছে। ন্যায়বোধ। ভাল এবং মন্দকে বিচার করতে শিখেছি।
নিরপরাধ পেত সহানুভূতি। আর অপরাধীর প্রতি হতাম নির্দয়। ছেলেবেলার নিষ্ঠুরতা বা জিঘাংসা মিশে থাকত এই নির্দয়তার মধ্যে।
ভাগ্যক্রমে, ন্যায়নীতি এবং দণ্ডনীতি দুই সমানভাবে প্রয়োগ করবার অধিকার আমি পেয়ে গিয়েছিলাম, অর্থাৎ আমার হাতে ছিল বিচারের দণ্ড! আমার যাবতীয় কার্যকলাপ ছিল আইনের আঙিনাকে ঘিরে।
আইনশাস্ত্র সম্পর্কে আমার গভীর জ্ঞানের প্রশংসা সকলে করলেও, অনেকে নিষ্ঠুর জজ বলেও কটাক্ষ করত আমাকে। কথাটার মধ্যে অবশ্যই সভ্যতা ছিল। কোন নিরপরাধী আমার কাছে কখনো সাজা পায়নি।
তার বিরুদ্ধে যত প্রমাণই দাঁড় করানো হোক না কেন, আইনের সূক্ষ্মবিচারে তাকে আমি মুক্ত করে এনেছি।
আবার প্রকৃত অপরাধী, আমার হাতে কখনো রেহাই পায়নি। আমি তার উপযুক্ত দণ্ডবিধান করেছিনের মামলারভাবে বেকসুর খাল
সেটনের মামলাটার কথাই ধরা যাক। সে নিজে তার বক্তব্য সুন্দরভাবে পেশ করেছিল। তার কৌসুলীও সুন্দরভাবে কেস সাজিয়ে তাকে নির্দোষ প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছে। সকলেরই ধারণা ছিল সেটন বেকসুর খালাস পেয়ে যাবে।
কিন্তু আইনের চুলচেরা বিচারে আমি তাকে চরম সাজা দিয়েছি। প্রথমে এই মামলা নিয়ে কিছু সমালোচনা হলেও পরে এই মামলা ছাত্রদের পাঠ্যপুস্তকে স্থান পেয়েছে উৎকৃষ্ট বিচারের নিদর্শন হিসেবে।
একসময় এজলাস থেকে অবসর নিলাম। এদিকে স্বাস্থ্যও ভাল যাচ্ছিল না। বুঝতে পারছিলাম আমার সময় ফুরিয়ে আসছে।
একদিন এক ডাক্তারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি কথা প্রসঙ্গে জানালেন, অনেক মানুষই এমন কিছু অপরাধ করে, আইন তাকে সেজন্য সাজা দিতে পারে না, তখনই তিনি রজার্স দম্পতির ঘটনাটা বললেন।
এক ভদ্রমহিলার বাড়িতে তারা কাজ করতো। ওরা তার সেবা-যত্ন করত। সেই মহিলা। কৃতজ্ঞতার বশে ওদের নামে উইল করে গেছেন, রজার্স দম্পতি তা জানতে পেরেছিল।
স্বাভাবিক মৃত্যুর ব্যাপারটা অনিশ্চিত। এতদিন তারা অপেক্ষা করতে রাজি ছিল না। সুযোগের অপেক্ষায় রইল।
ভদ্রমহিলা অসুস্থ হলে তাকে বিশেষ ধরনের একটা ওষুধ খাওয়াতে হতো। একবার অসুস্থতার সময়ে তারা তাকে তা খাওয়ালো না। ফলে তিনি মারা যান।