.
কিছুক্ষণ পরেই সূর্য অস্ত গেল। অন্ধকার ক্রমশ ঘন হচ্ছে। উঠে দাঁড়ায় ভেরা।
একবার তাকায় বাড়িটার দিকে ফিরে। সে মন ঠিক করে নেয়। আর তো কোন ভয় নেই ওখানে। ছোট্ট ঘরটায় গিয়ে সে পরম স্বস্তিতে গা হাত পা এলিয়ে দিতে পারে।
দরজা এঁটে দিলে, সে সম্পূর্ণ একা। ভয়টা কিসের। বরং এই খোলামেলা জায়গাতে থাকতেই গা ছমছম করবে।
এতক্ষণ পরে খিদে অনুভব হয় তার। বুঝতে পারে সে ক্লান্ত। অবসন্ন। খাদ্য না হলেও বিশ্রাম তার দরকার।
ভেরা দূর সমুদ্রের দিকে একবার ফিরে তাকায়। আবহাওয়ার পরিবর্তন হয়েছে। কাল না হোক পরশু বোট নিশ্চয় আসবে।
যেদিনই বোট আসুক, সে এখন একা, তার কোন ভয় নেই।
ধীর পায়ে সমুদ্রের কাছ থেকে সরে এসে ভেরা একতলার বারান্দায় উঠে আসে। খাবার ঘরে ঢোকে। তাকিয়ে দেখে তিনটে পুতুল রয়েছে।
ভেরা এগিয়ে যায় সেদিকে। তিনটে কেন থাকবে–থাকবার তো কথা একটা। সবাই তো মৃত, বেঁচে আছে কেবল সে একা।
ভেরা আপন মনে বলে উঠল, তোরা শেষের হিসেব মেলাতে পারিসনি। থাকবে ওখানে একটা।
হাত বাড়িয়ে দুটো পুতুল তুলে নেয় সে। ছুঁড়ে ফেলে দেয় জানালা দিয়ে।
শেষ পুতুলটাকেও তুলে নেয় সে।
অদ্ভুত এক কাণ্ড করে বসল ভেরা। পুতুলটাকে আদর করে গালে ছোঁয়াল, চুমু খেলো। তারপর বুকে চেপে ধরে গভীর নিঃশ্বাস নিল।
–চল আমার সঙ্গে।
ভেরা পুতুলটাকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে যায়। ঘর খোলে, আবছা আলো। কোণে কোণে অন্ধকার। কাকে দেখতে পাচ্ছে ভেরা? কে? হুগো? লমবার্ড?
ভেরা চেঁচিয়ে ওঠে, কে–কে
সামনেই একটা দড়ি ঝুলছে। তলায় ফাস। তার নিচে একটা চেয়ার।
কি মনে করে ভেরা এগিয়ে যায় চেয়ারটার দিকে। উঠে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে ফাঁসটা গলায় পরে নেয়।
অকস্মাৎ খিল খিল করে হেসে ওঠে সে। উন্মাদ হয়ে হাসতে থাকে। চেয়ারটা হঠাৎ পায়ের কাছ থেকে সরে যায়।
পুতুলটা হাতেই ধরা ছিল। সেটা ছিটকে মেঝেয় পড়ে ভেঙ্গে যায়। শেষ পুতুল ছিল ওটা।
.
স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের প্রধান কার্যালয়। কথা বলছেন দুজন। স্যার টমাস লেগ এবং ইনসপেক্টর মেন। টমাস হলেন সহকারী কমিশনার।
টমাস বললেন, একটা অবাস্তব ঘটনা বলেই মনে হচ্ছে। পরপর দশজন লোক মারা গেল একটা দ্বীপে, অথচ মৃতদেহ ছাড়া কোন জীবিত লোক সেখানে ছিল না। জবরদস্ত মাথাওয়ালা কোন মানুষের হাত ছিল এই কাণ্ডের পেছনে, তাতে সন্দেহ নেই।
মেন মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বলল, স্যার আমিও আপনার সঙ্গে একমত।
টমাস জানতে চান, ডাক্তারের রিপোর্ট থেকে কোন সূত্র পাওয়া গেছে?
–না স্যার।
এরপর মেন কেন কিভাবে কাকে হত্যা করা হয়েছে তার বিবরণ দেন।
ওয়ারগ্রেভ এবং লমবার্ডকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। গুলি লেগেছে একজনের মাথায়, অপরজনের বুকে।
বিষের সাহায্যে হত্যা করা হয়েছে দুজনকে। তারা হলেন মিস ব্রেনট এমিলি এবং মার্সটন।
রুমাল দিয়ে মুখ মুছে নিলেন মেন। পরে বললেন, বেশি মাত্রায় ঘুমের ওষুধ খাওয়ার ফলে মারা গেছে রজার্সের স্ত্রী। তার স্বামীর মৃত্যু ঘটে কুঠারের আঘাতে।
বিবরণ শুনতে শুনতে স্যার টমাস নড়েচড়ে বসেন। বিস্ময়ে চোখ বড় হয়ে ওঠে তার।
মেন বলে চলেন, ডগলাসের মাথার খুলি ভেঙ্গে গেছে। কোন ধারালো জিনিস দিয়ে তাকে পেছন থেকে আঘাত করা হয়েছিল। ভেরা ক্লেথর্নকে মৃত অবস্থায় কঁসির রজ্জুতে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে।
–আচ্ছা, ডেভনের সমুদ্রতীরের লোকেরা কি বলছে? টমাসের কপালে চিন্তার রেখা পড়ে।
–স্যার, ওরা কিছু জানে না। তাদের কাছ থেকে কেবল জানা গেছে, আওয়েন বলে এক ভদ্রলোক দ্বীপটার মালিক।
–তা, বেশ। দ্বীপটা কেনার পর সাজগোজের কাজ তো করতে হয়েছে? সেসব কে করেছিল?
–আকজাগ মরিস নামে একজন লোক।
এ সম্পর্কে তার কাছ থেকে কিছু জানা গেছে?
–উপায় ছিল না।
–মানে?
–সে মারা গেছে।
–তার সম্বন্ধে খোঁজখবর নেওয়া হয়েছিল?
–হ্যাঁ স্যার। লোকটা চোরাই কারবারের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু প্রমাণের অভাবে তাকে কখনো ধরা যায়নি।
-এই মরিস লোকটা কেবল কি ওসবই করত?
–না স্যার। এমনিতে ঠিকাদারি কাজ করত। তবে ওটা ছিল তার বাইরেকার খোলস।
–মরিস শেষ কবে ডেভান গিয়েছিল?
–এই হত্যাকাণ্ডের আগেই গিয়েছিল। স্থানীয় লোকজনদের সে বুঝিয়ে এসেছিল, মিঃ আওয়েনের কিছু বন্ধু এখানে এসে কিছুদিন থাকবেন। মিঃ আওয়েনের সঙ্গে তারা বাজি ধরেছেন, পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও কিছুদিন বাস করা চলে। কাজেই দু-চারদিনের মধ্যে ওই দ্বীপ থেকে কোন সংকেত এলেও কিছু করার দরকার নেই। তারপর ওদের ব্যবস্থা মিঃ আওয়েনই করবেন।
–এসব কথা ওরা বিশ্বাস করেছিল?
–কেউ কিছু সন্দেহ করেনি স্যার। ভেবেছে এসব বড়লোকদের খেয়াল। আওয়েনের আগে যিনি ওই দ্বীপটার মালিক ছিলেন তিনিও প্রায়ই ওখানে পার্টি দিতেন। এক্ষেত্রেও তাই তারা সন্দেহ করার মত কিছু পায়নি।
একটু থেমে মেন ফের বললেন, যে লোকটা ওদের বোটে করে পৌঁছে দিয়েছিল তার কিছুটা সন্দেহ হয়েছিল।
সে বলেছে, আগে যারা পার্টিতে আসত তারা ছিল পরস্পরের পরিচিত। কিন্তু এবারে যারা গিয়েছিল তারা একে অপরকে চিনত না। আর সকলেই অনেকটা শান্ত প্রকৃতির।
–ও কিছু করেছিল?
–দিন কয়েক পরে ওই দ্বীপ থেকে সাহায্য সংকেত পাওয়া যায়। তখন সে লোকজন জড়ো করে ওখানে উপস্থিত হয়। আর তার ফলেই আমরা এই লোমহর্ষক ঘটনাটি জানতে পারি।