লমবার্ড বলে, ওটা কি বল তো?
আঙুল তুলে দেখায় সে। ভেরা কয়েক মুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে থাকে। পরে বলে, মনে হচ্ছে সামুদ্রিক লতাজাতীয় কিছু জলে ভাসছে।
–চলো, কাছে গিয়ে দেখা যাক। আমার কেমন সন্দেহ হচ্ছে।
ভেরা লমবার্ডকে হাত আঁকড়ে ধরে রেখেছে। সেভাবেই বলল, যাবে তো চলো। আমার কিন্তু অস্বাভাবিক কিছু মনে হচ্ছে না।
–তবু, দেখতে ক্ষতি কি?
কাছে গিয়ে দেখা গেল, ভাসমান বস্তুটা লতা বা শ্যাওলা জাতীয় কিছু নয়। একটা জামা জলে ভাসছে।
আরও একটু কাছে গিয়ে ভাল করে লক্ষ্য করল ওরা। তখন বুঝতে পারল, শুধু পোশাক নয়, একটা মানুষের মৃতদেহ–জলে ভাসছে।
লমবার্ড বলল, জোয়ারের টানে এপাড়ে এসে ভিড়েছে। চিনতে অসুবিধা হল না। ডাক্তার আরমস্ট্রং-এর মৃতদেহ।
.
১৬.
লমবার্ড হেসে বলল, ব্যাপারটা মন্দ হল না, কি বলো ভেরা?
–কি ব্যাপার?
–এই যে তুমি আর আমি–এই দুজন ছাড়া দ্বীপে আর কেউ নেই।
ভেরার মুখ হঠাৎ কেমন কঠিন হয়ে উঠল। চোখের কোমল দৃষ্টি মুহূর্তে আগুন-ঝরা হয়ে উঠল। ও যেন আর মানবী নেই। এক কালনাগিনী।
লমবার্ড আবার বলে, কেবল তুমি আর আমি।
ভেরা অপাঙ্গে লম্বার্ডের দিকে তাকায়। নিজেকে ধিক্কার দেয় মনে মনে। এই লোকটাকে এত বিশ্বাস করছি কি করে? ওর মুখে ক্রমশই একটা হিংস্র ভাব ফুটে উঠছে। হাসছে, কিন্তু হাসিটা স্বাভাবিক নয়। কেমন পৈশাচিক ছাপ। তা না হলে ওই হাসি শুনে বুক কেঁপে উঠছে যেন?
ভেরার অন্তরাত্মা যেন বলে ওঠে, পালাও। পালাও—
মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে পাল্টে নেয় ভেরা।
চোখের চাউনি স্বাভাবিক হল।
মুখে ফুটে উঠল অপূর্ব লাবণ্য।
বুকে জমে উঠল যেন একরাশ মধু।
কোমল মধুর স্বরে ভেরা এগিয়ে যায় লম্বার্ডের দিকে। মোহিনী দৃষ্টিতে তার চোখের দিকে তাকায়।
–শোন। স্বেচ্ছায় ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায় ভেরা। নিজেকে ধরা দেয়।
যে নারী আপনা থেকে নিজেকে এগিয়ে দেয়, তাকে ফিরিয়ে দিতে পারে কোন পুরুষ? লমবার্ড দুহাত প্রসারিত করে জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নেয় ভেরাকে। বলে, ডাক্তারের জন্য তোমার দুঃখ হচ্ছে না?
ভেরা প্রণয়িনীর স্বরে জবাব দেয়, হলেই বা কি করা যাবে।
–চলো দুজনে মিলে ওর দেহটা বাড়ির ভেতরে নিয়ে যাই।
–ওই মৃত্যুপুরীতে?
–হ্যাঁ, মৃত্যুপুরীতে।
–না, ওখানে না।
–তাহলে চলো, জল থেকে একটা পাথরের ওপরে তুলে রাখা যাক।
–তা করা যেতে পারে।
ওরা এগিয়ে যায় জলে ভাসমান মৃতদেহটার দিকে। কিন্তু জলে ভিজে যে মৃতদেহ এমন ভারী হয়ে যায় তা ওদের জানা ছিল না।
লমবার্ডই টেনে পাড়ের দিকে আনল। ভেরা প্রাণপণে তাকে সাহায্য করল।
শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্টে একটা চড়াই বেয়ে ডাক্তারের মৃতদেহ লমবার্ড টিলার পাথরের কাছে বয়ে নিয়ে এল।
ভেরা, পা পিছলে যাবার ভয়ে সারাক্ষণ লমবার্ডকে জড়িয়ে ধরে রইল।
পাথরটার ফাঁকে ফাঁকে ছোট গাছ। কিছু ফুলও ফুটেছে। সেখানেই ডাক্তারের দেহ শুইয়ে দেওয়া হল।
প্রকৃতির পেতে রাখা বিছানাতেই চিরনিদ্রায় শুয়ে রইলেন ডাক্তার।
লমবার্ড বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তার চওড়া বুক জোরে জোরে ওঠানামা করছে। কপালে গলার তলায় ঘাম জমেছে।
শেষ বেলার রোদ পড়ে ঘামের বিন্দু চিকচিক করছে।
রুমাল দিয়ে মুখটা মোছা দরকার। লমবার্ড পকেটে হাত দিতে গিয়ে চমকে ওঠে।
রিভলভার তো পকেটে নেই। সর্বনাশ, পড়ে গেল নাকি জলে?
লমবার্ড ঘুরে দাঁড়ায়। অমনি চোখ পড়ে যায় অদূরে দাঁড়ানো ভেরার দিকে। তার হাতে উদ্যত রিভলভার।
এতক্ষণের মোহিনী আবার কালনাগিনীতে রূপ পাল্টে ফেলেছে। তার বুক ওঠানামা করছে, নিঃশ্বাসে যেন বিষ ছড়াচ্ছে।
চোয়াল দৃঢ় হল লমবার্ডের। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, তোমার ছলাকলার অর্থ এতক্ষণে বোঝা গেল। সত্যিই তুমি অদ্ভুত।
ভেরা কোন জবাব দেয় না। নিশানা অনড়। দৃষ্টি স্থির–লমবার্ডের মুখে।
লমবার্ড গলার স্বর নরম করবার চেষ্টা করে, ভেরা রিভলভারটা ফিরিয়ে দাও।
–ফিরিয়ে দেব। নিষ্ঠুর হাসির উচ্ছ্বাস জাগে তার কণ্ঠে। কী ভয়ংকর সে হাসি।
লমবার্ড ফের বলে, পাগলামি করো না, ভেরা। আমাকে তুমি বিশ্বাস করতে পার।
ভেরা সেই নিষ্ঠুর হাসি হেসে উঠল ফের। তবে উচ্ছ্বাস কিছুটা স্তিমিত।
গলগল করে ঘাম ঝরছে লম্বার্ডের শরীর বেয়ে। ঠোঁটও শুকিয়ে উঠেছে।
লমবার্ড ভেবে পায় না, কি করে এই উন্মাদ মেয়েটাকে বোঝাবে সে নিরপরাধ? একমাত্র সেই পারে তাকে বাঁচিয়ে রাখতে।
তবে বুঝতে পারে, মিনতি করে আর কাজ হবে না। এই মেয়ে তার কোন কথা বিশ্বাস করবে না। সে ভাবল, যদি শক্তি প্রয়োগ করে কিছু করা যায়। সে সুযোগের অপেক্ষা করতে থাকে।
পলকের জন্য বুঝি অন্যমনস্ক হয়েছিল ভেরা। সঙ্গে সঙ্গে লমবার্ড ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
–দাও রিভলবারটা।
–না
–দ্রুত দুপা পিছিয়ে যায় ভেরা; ট্রিগার টিপে দেয়। একটুও কাঁপে না তার হাত।
অস্ফুট একটা আর্তনাদ। লমবার্ড মুখ থুবড়ে পড়ে মাটিতে।
.
ভেরা তখন নিশ্চিন্ত, নিরুদ্বিগ্ন। আর ভয়ের কারণ নেই। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল সে। পৃথিবীটা যেন নতুন করে ভাল লাগছে।
ভেরা এখন একা। সারা দ্বীপে দ্বিতীয় কোন মানুষ নেই। আছে কেবল কটা মৃতদেহ।
কিন্তু, না সে আর ফিরে যাবে না। ভেরা এক পা দু পা করে এসে সমুদ্রের ধারে বসে পড়ল। আঃ। কী স্বস্তি।