ভেরা ভয়ে ভয়ে বলল, উনি একটা ঝুঁকি নিলেন।
ঝুঁকির কিছু নেই। ডাক্তার ওর গায়ের জোরের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে না।
–কিন্তু এই সমস্যার সমাধান কোথায়?
–একটু তলিয়ে ভাবুন। কাল রাতের কথা ভাবুন।
বলে লমবার্ড একটু চুপ করে। তারপরে বলে, ব্লোর তার ঘরের সামনে প্রথম পায়ের শব্দ শুনেছে; তার পরে আমাকে ডেকেছে। আমার বিশ্বাস ডাক্তারকে হত্যা করার পরেই আমাকে, এসে ডেকেছে।
-তা কি করে সম্ভব?
–অতসব বলতে পারব না, আমার যা বিশ্বাস, সেই কথাই আমি বললাম। এটুকু জানি, ওর সম্পর্কে আমাদের সতর্ক থাকা উচিত।
ভেরা এবারে ভয় পেয়ে যায়।–যদি তাই হয়, আমাদের কি হবে?
-কি আবার হবে।
লমবার্ড রিভলভারটা বার করে ভেরাকে দেখায়। বলে, এটা দিয়েই মোকাবিলা করব।
রিভলভার দেখে ভেরা আরও ভয় পেয়ে যায়। সে বুঝতে পারে, লম্বার্ডের কাছে দয়ার পাত্র। যে কোন মুহূর্তে তাকে শেষ করে দিতে পারে।
সে সজাগ হয়, লমবার্ডের মনের কথা সে জানে না। কি উদ্দেশ্যে সে তার কাছে বসে আছে তা-ও সে বুঝতে পারছে না। ভেরা তো তাকে থাকবার জন্য অনুরোধ করেনি।
ভেরাকে চুপ করে থাকতে দেখে লমবার্ড তার মনের কথা অনুমান করতে পারে। বলে, আমার দ্বারা আপনার কোন ক্ষতি হবে না, এটুকু বিশ্বাস রাখতে পারেন।
ভেরা করুণ হেসে বলে, বিশ্বাস না করে উপায় কি। তবে ব্লোরকে আপনি ভুল বুঝেছেন। আমার ধারণা ও ডাক্তারকে খুন করেনি।
তারপর সম্পূর্ণ পাল্টে যায় ভেরার গলার স্বর। নিচুস্বরে বলে, আচ্ছা, আপনার এমন মনে হয়, সবসময় কেউ আমাদের লক্ষ্য করছে?
-না, না, ওটা দুর্বল মনের চিন্তা।
ভেরা এবার চারপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে নেয়। লমবার্ডের দিকে একটু এগিয়ে বসে। তারপর ফিসফিস করে বলে, এমন তো হতে পারে, এসব কিছুর পেছনে রয়েছে কোন মানুষের আত্মা। সে কারণই সবকিছু এমন নিখুঁত–
লমবার্ড বলে, ওসব আত্মা বা অলৌকিক ব্যাপারে আমার বিশ্বাস নেই।
–বিশ্বাস করেন না?
–না। কেন না, আমি ভাল করেই জানি, যা কিছু এখানে ঘটছে, সবের পেছনেই রয়েছে কোন মানুষ। আচ্ছা, এসব আত্মার ব্যাপার আপনি পুরোপুরি বিশ্বাস করেন?
–করি বইকি।
লমবার্ড এবারে মৃদু হাসল। বলল, সবই বিবেকের কাজ।
-মানে? যেন চমকে ওঠে ভেরা।
–না, বলছি বিবেকের কথা। আপনি তাহলে সেই শিশুর মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিলেন?
ভেরা অকস্মাৎ চিৎকার করে ওঠে, না-না–ও বিষয়ে আপনি কী জানেন?
–তা ঠিক কিছুই জানি না। তবু অনুমান করতে পারছি আপনার মত একটি মেয়ে, হৃদয়ঘটিতে কোন ব্যাপার না থাকলে তো এমন কাণ্ড করা সম্ভব নয়?
ভেরা হাঁপাতে লাগল। হঠাৎ তার মুখ ফসকে বেরিয়ে এল, হ্যাঁ ছিল।
লমবার্ডের মনে কি ঈর্ষার ছায়া পড়ল? তার মুখ বিবর্ণ দেখালো কেন?
ঠিক সেই সময় বাড়ির দিক থেকে একটা ভারি কিছু পড়ার শব্দ ভেসে এলো। সেই সঙ্গে একটা আর্তনাদের শব্দ।
চকিতে দুজনে উঠে দাঁড়ালো, পরস্পরের মুখের দিকে তাকালো। লমবার্ড বলল, চলুন দেখা যাক–
ওদের জন্য এক মর্মান্তিক দৃশ্য অপেক্ষা করছিল। তবে এমন ঘটনা অপ্রত্যাশিত ছিল না। তাই আকস্মিকতার ধাক্কা ওরা নীরবেই সামলে নিতে পারল।
চোখের সামনে দেখেও বিশ্বাস করবার মত নয় এই দৃশ্য।
বারান্দার পূবদিকে ব্লোর মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। দু হাত দুদিকে ছড়ানো। মাথাটা একেবারে গেঁৎলে গেছে।
কাছেই পড়ে আছে একখণ্ড ভারি পাথর। পরিষ্কারই বোঝা গেল, ওই পাথর দিয়েই আঘাত করা হয়েছে।
কিন্তু এই কাজ কে করল? ভেরা আর লমবার্ড তো ছিল সমুদ্রতীরে।
কোন সন্দেহ নেই এ কাজ ডাক্তারের। এখনো জীবিত থেকে লোকটি নিষ্ঠুরভাবে তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
লমবার্ড দাঁত দাঁত চেপে বলল, যে করেই হোক ডাক্তারকে এবার খুঁজে বার করব। আমি চললাম।
কাঁদো কাঁদো ভেরা এবারে অদ্ভুত সম্বোধন করে বসল, পাগলামো করো না, লমবার্ড। খুনীর লক্ষ্য এবার আমরা দুজন। আমরা তাকে খুঁজতে বেরব এটাই তার ফাঁদ–না না–তুমি যেতে পারবে না।
লমবার্ড থমকে দাঁড়াল। বলল, তুমি বোধহয় ঠিকই বলছ। বেশ, চলো বাইরে যাই।
ওরা দুজন হাত ধরাধরি করে সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসল। এখন আর ওদের মধ্যে কোন ব্যবধান নেই। ভাগ্যই ওদের দুজনকে কাছাকাছি এনে দিয়েছে।
লমবার্ড বলল, কাল আমরা এমন করে খুঁজলাম, ডাক্তার কোথায় লুকিয়ে থাকতে পারে বলো তো?
–কোথাও নিশ্চয় আছে। আর খুঁজতে গিয়ে কাজ নেই। মৃত্যু চারপাশেই ওত পেতে আছে।
লমবার্ড রিভলভারটা বার করে দেখাল। বলল, এটা এখনো আমার কাছে রয়েছে।
–অত বড়াই করো না লমবার্ড। ব্লোরও কম হুঁশিয়ার ছিল না। তাই বলছি, আর খোঁজাখুঁজিতে গিয়ে কাজ নেই।
লমবার্ড ভেরার কথা অগ্রাহ্য করে না। সে তার পাশেই বসে থাকে।
ভেরা একসময় বলে, আজকের আবহাওয়া বড় চমৎকার। চাঁদের আলোয় সারারাত এখানেই কাটিয়ে দেব। তোমার ভাল লাগবে না?
লমবার্ড বলে, আপত্তি কি। চল, এখন একটু ঘুরে বেড়ানো যাক। অনেকক্ষণ একভাবে বসে আছি।
এরপর দুজনে একসঙ্গে হাত ধরে অনেকক্ষণ এদিক সেদিক বেড়াল।
বিকেলের সোনালী রোদ ছড়িয়ে পড়েছে চরাচরে। আর কিছু সময় পরেই সূর্য অস্ত যাবে।
টিলার নিচের দিকে সমুদ্রের দিকটায় কি চোখে পড়ল লম্বার্ডের। সে সেদিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।
ভেরা জিজ্ঞেস করল, কথা বলছো না কেন? কি দেখছ ওদিকে অমন করে?