লমবার্ড একটা আনকোরা ব্র্যান্ডির বোতল নিয়ে এল।
তা থেকে খানিকটা পান করে ভেরা সুস্থ বোধ করতে লাগল।
লমবার্ড বলল, খুনীর একটা চেষ্টা ব্যর্থ হল। ভেবেছিল এই দফায় ভয় পাইয়ে কাজ হাসিল করবে। আপনার মনের জোর আছে বলতে হবে।
ব্লোর যে গ্লাসে করে ব্র্যান্ডি এনেছিল, ডাক্তার মনোযোগ দিয়ে সেটা পরীক্ষা করছিলেন। ব্লোর বলল, আপনি আমায় সন্দেহ করছেন–
আবার অপ্রিয় প্রসঙ্গ উঠে পড়েছে। ভেরা সেটা চাপা দেবার জন্য বলল, আমাদের বিচারপতিকে তো দেখতে পাচ্ছি না। তিনি কোথায়?
তখন সকলের খেয়াল হল। সত্যিই তো, তিনি নেই। ডাক্তার চিৎকার করে ডাকলেন–মিঃ ওয়ারগ্রেভ
কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া গেল না। আবার শুরু হল খোঁজার পালা। খাওয়ার ঘর, বসার ঘর, সিঁড়ি, বারান্দা সব খোঁজা হল।
শেষে তার ঘরে এসে সকলেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
ওয়ারগ্রেভ নিজের ঘরে একটা চেয়ারে বসে আছেন। তার মাথায় একটা পরচুলা, পরণে লাল সিল্কের গাউন।
ডাক্তার এগিয়ে গিয়ে তাকে পরীক্ষা করলেন। ওয়ারগ্রেভ বেঁচে নেই জানালেন।
মাথার পরচুলাটা তুলে ফেলতেই দেখা গেল চকচকে টাকের মাঝখানে একটা লাল দাগ। ডাক্তার জানালেন, গুলির আঘাতেই মৃত্যু হয়েছে।
ভেরা পরচুলাটা কুড়িয়ে নিল। সে চিনতে পারল। বললো, এটা দেখছি এমিলির হারিয়ে যাওয়া উলের গোলা দিয়ে তৈরি। আর গাউনটাও স্নানের ঘরের হারিয়ে যাওয়া পর্দার লাল সিল্কের কাপড়।
ব্লোর বলল, রিভলভারটা কেন সরানো হয়েছে, এবারে পরিষ্কার হল।
.
১৪.
ওরা এবারে চারজন–ডাক্তার, ভেরা, ব্লোর এবং লমবার্ড। সকলে নিচের বসার ঘরে নেমে এলো।
রাতে মুখে তো কিছু দিতে হবে। তার ব্যবস্থা কি হবে। টিনের খাবার ছিল প্রচুর। তাই দিয়ে কোন রকমে চালিয়ে দেওয়া হল। কেউই বিশেষ মুখে তুলতে পারল না।
ব্লোর বলল, এবারে কার পালা কে জানে?
ডাক্তার বললেন, আমাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে।
লমবার্ড বলল, ছাড়ুন তো ওসব কথা। বিচারপতিও তো ও-কথা বারবার বলেছেন, তিনি নিজেই কি রেহাই পেলেন? যা হবার হবে–ও নিয়ে আর ভাববার দরকার নেই।
ডাক্তার বললেন, সত্যি, ঘটনাটা এখনও অবিশ্বাস্য ঠেকছে।
লমবার্ড বলল, খুনীর কৌশলগুলো অতি চমৎকার। মিস ভেরার চিৎকার শুনে আমরা ওপরে গিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম, আর সেই সুযোগে সে কাজ হাসিল করে নিয়েছে।
ব্লোর বলল, কিন্তু গুলির শব্দ তো পাওয়া গেল না।
লমবার্ড বলল, পাব কি করে? একদিকে চিৎকার, দৌড়োদৌড়ি, তার মধ্যে সমুদ্রের গর্জন মিলেমিশে সব একাকার হয়ে গেছে।
তাছাড়া আমাদের মনযোগও ছিল অন্য দিকে।
তারপর আর বেশি রাত করল না তারা। দোতলায় যে যার ঘরে শুতে চলে গেল একটা করে মোমবাতি নিয়ে।
সিঁড়ি দিয়ে তাদের ওপরে ওঠার দৃশ্যটা ছিল বড়ই করুণ। চারজনই পাশাপাশি উঠছে। পরস্পরের প্রতি সন্দেহ এমনই প্রবল যে কেউ কারো পেছনে যেতে রাজি নয়।
এভাবে ওপরে উঠে গিয়ে প্রায় একই সঙ্গে চার ঘরের চারটে দরজা বন্ধ করে তারা স্বস্তি বোধ করল।
.
লমবার্ড তার ঘরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। খুঁটিয়ে দেখল নিজেকে। না, মুখে ভয়ের চিহ্ন নেই। নিজের মনে হাসল সে। এরপর শোবার পোশাক পরে বিছানা নিল।
হাত ঘড়িটা টেবিলে রাখল খুলে। কি মনে হতে ড্রয়ারটা টান দিয়ে খোলে। সঙ্গে সঙ্গে হতভম্ব হয়ে গেল সে। ড্রয়ারের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া রিভলভারটা রয়েছে।
.
ঘড়িতে ঢং ঢং শব্দে রাত বারোটা বাজল।
পুলিস অফিসার ব্লোর বিছানায় ছটফট করছে। ঘুম আসছে না। অন্ধকারের মধ্যে তার মনে পড়ে–যারা তাদের মধ্য থেকে হারিয়ে গেছে তাদের কথা।
হঠাৎ ব্লোরের মনে পড়ে যায় তার স্ত্রীর কথা–ল্যাণ্ডরের। গ্রামাফোন রেকর্ডে তার কথা বলেছে। ওদের একটা দশবছরের মেয়ে ছিল। কী হল তাদের?
হঠাৎ ব্লোর চমকে ওঠে। ঘড়িতে একটার ঘন্টা পড়ল। পরক্ষণেই কার পায়ের শব্দ। বারান্দায় যেন কেউ হাঁটছে।
কান পেতে শুনল ব্লোর। হ্যাঁ, কোন ভুল নেই–কে হাঁটাচলা করছে।
ব্লোরের কপালে ঘাম জমতে থাকে। সে বিছানা ছেড়ে এসে দরজায় কান পাতে। না, এখন আর শব্দ শোনা যাচ্ছে না।
দরজা খুলে বাইরে বেরুবে কিনা ভাবছে ব্লোর। হঠাৎ তার মনে হল কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে।
শব্দটা তার দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর আবার চলতে থাকে–সিঁড়িতে নামার শব্দ পায়। আর কোন আওয়াজ হয় না।
ব্লোর তার সিদ্ধান্ত স্থির করে নেয়। সে চটিজোড়া খুলে নেয়। পায়ে কেবল মোজা।
লোহার ল্যাম্প স্টান্ডটা হাতিয়ার হিসাবে মুঠি চেপে তুলে নেয়। তারপর নিঃশব্দে বারান্দায় বেরিয়ে আসে।
এখন বাতাস ধীর। মেঘও কেটে গেছে। আকাশে চাঁদের হাল্কা আলো। সেই আলোতে ব্লোর দেখতে পায় একটা ছায়ামূর্তি যেন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।
ব্লোর দৌড়োতে গিয়েও সামলে নেয়। না, হত্যাকারীর ফাঁদে ধরা দেবে না।
এবারে সে ডাক্তারের ঘরের দরজায় গিয়ে টোকা দেয়। কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া যায় না।
এরপর লম্বার্ডের দরজায় আঘাত করে। ভেতর থেকে সাড়া আসে, কে—
আমি ব্লোর।
–কি ব্যাপার বলো।
–ডাক্তার দেখছি তার ঘরে নেই।
–আসছি, অপেক্ষা করো।
এরপর ব্লোর ভেরার দরজায় মৃদু আঘাত করে। সাড়া পাওয়া গেল। পরিচয় জানিয়ে বলল, একমিনিট পরে আসছি।
লমবার্ড দরজা খুলে বারান্দায় বেরোয়। গায়ে রাতের পোশাক। হাতে জ্বলন্ত মোমবাতি। একটা হাত জ্যাকেটের পকেটে।