তারপর থেকে কোন দিন আর পানপাত্র স্পর্শ করেননি। আগের তুলনায় অনেক বেশি সতর্কও হয়ে গেছেন।
পান্না দ্বীপ আরও একশো মাইল। এই পথটা দ্রুত অতিক্রম করবার জন্য বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে চলেছেন অ্যান্টনি মাসটন।
সুন্দর স্বাস্থ্যের জন্য তরুণী মহলে খুবই জনপ্রিয় মার্সটন। এ বিষয়ে তিনি নিজেও যথেষ্ট সচেতন।
.
প্লাইমাউথ থেকে ট্রেনটা চলেছে মন্থরগতিতে। ব্লোর এই ট্রেনে চলেছে পান্না দ্বীপে। কামরায় দ্বিতীয় যাত্রী বলতে এক বৃদ্ধ নাবিক। জানালার ধারে বসে ঝিমোচ্ছে।
ব্লোর পকেট থেকে একটা নোটবই বার করে নামগুলোর ওপরে চোখ বুলিয়ে নিল–
এমিলি ব্রেনট, ভেরা ক্লেথর্ন, ডাঃ আরমস্ট্রং, অ্যান্টনি মার্সটন, বিচারপতি মিঃ ওয়ারগ্রেভ, ফিলিপ লমবার্ড, জেনারেল ডগলাস, আর পরিচারক রজার্স ও তার স্ত্রী।
ব্লোর ভাবে, তালিকায় তার নামটাও থাকা উচিত ছিল। নিজেকে কি বলে পরিচয় দেবে সে? দলে একজন ফৌজি জেনারেল রয়েছে, নইলে স্বচ্ছন্দে সে রিটায়ার্ড ফৌজি অফিসার হতে পারত।
একটা পরিচয় অবশ্য নেওয়া যায়–দক্ষিণ আফ্রিকার একজন বিশিষ্ট নাগরিক। খাঁটি ইংরাজ ব্যবসায়ী।
সে আরও ভাবল, ভ্রমণকাহিনী যা পড়া আছে, তাতে দক্ষিণ আফ্রিকা সম্পর্কে সে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল বলে নিজেকে জাহির করতে পারবে।
তালিকায় যাদের নাম দেখল, এরা নিশ্চিত কেউ তার ফাঁকিবাজি ধরতে পারবে না।
জানালার ধারের বুড়ো নাবিক হঠাৎ নিজের মনেই বিড়বিড় করে উঠল–সমুদ্রের গতিক বড় সুবিধার মনে হচ্ছে না।
ব্লোর উপযাচক হয়েই বুড়োর কথার সমর্থন জানাল–তাই বুঝি?
বুড়ো খুক খুক করে কাশল। তারপর সামলে নিয়ে বলল, ঝড় আসছে–ঝড়–
–কিন্তু আবহাওয়া তো ভালোই দেখছি।
–না, না, গন্ধ পাচ্ছি। বড়–ঝড় ভয়ঙ্কর ঝড় আসছে।
ব্লোর কোন জবাব করল না এবারে।
.
০২.
ওক ব্রিজ স্টেশনের বাইরে চারজনের একটা দল জড়ো হয়েছে।
তাদের কারুর সঙ্গে পরিচয় নেই। প্রত্যেকের পেছনেই একটা করে সুটকেস নিয়ে কুলি দাঁড়িয়ে আছে।
দুটো ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে ছিল। একজন চালক এগিয়ে এল। দলের মধ্যে মিঃ ওয়ারগ্রেভ বয়স্ক এবং সম্ভ্রান্ত চেহারার মানুষ। তাকে উদ্দেশ্য করেই ট্যাক্সিচালক বলল, আপনারা পান্না দ্বীপে যাবেন তো, স্যার?
–হ্যাঁ।
–আপনাদের জন্য দুটো ট্যাক্সি রয়েছে। পাঁচমিনিট পরেই এক্সেটার থেকে ট্রেনে এক ভদ্রলোক আসছেন। তাকেও নিয়ে যেতে হবে। আপনাদের মধ্যে একজন তার জন্য অপেক্ষা করে বাকি সকলে আমার সঙ্গে চলুন।
এই ব্যবস্থা মত ভেরা ক্ৰেথর্ন এবং ফিলিপ লমবার্ড রইল। অন্যরা সকলে একটা ট্যাক্সি চেপে। পান্না দ্বীপের দিকে রওনা হয়ে গেল।
ভেরা এবং লমবার্ড স্টেশনের একটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসেছে। পারস্পরিক পরিচয় বিনিময়ের পর কথায় কথায় তারা দুজনেই জানতে পারে নিমন্ত্রণকর্তা মিঃ আওয়েন কারুরই পরিচিত নন।
ব্লোর বলে, আমি মিসেস আওয়েনের সেক্রেটারির চাকরি নিয়ে একমাসের জন্য এখানে এসেছি। আওয়েনদের সম্পর্কে কিছুই জানি না।
.
একটা ট্রেন এসে দাঁড়ায় স্টেশনে। বিরাট চেহারার এক বয়স্ক ভদ্রলোক প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে এলেন। নিখুঁত পোশাকের মানুষটির চালচলন ফৌজিদের মত। ইনিই হচ্ছেন জেনারেল ডগলাস।
ভেরা এবং লমবার্ড এগিয়ে গিয়ে সম্ভাষণ বিনিময় করে। ভেরা বলে, আপনার জন্য গাড়ি অপেক্ষা করছে। চলুন যাওয়া যাক।
তিনজনে ট্যাক্সিতে উঠে বসেন। তীব্রগতিতে ট্যাক্সি ধেয়ে চলে।
.
সমুদ্রতীরে ফেরিঘাটে এসে পৌঁছয় ট্যাক্সিটা। একটা চায়ের দোকানে মাঝি-মাল্লারা বসে আড্ডা মারছে। সেখানেই বসেছিলেন বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ এবং যে বোটে করে তারা যাবে তার চালক ডেভিসও ছিল তাদের সঙ্গে।
ভেরা ট্যাক্সি থেকে নামতেই ডেভিস এগিয়ে গিয়ে জানাল, আসুন, আমরা আপনাদের জন্যই প্রতীক্ষা করছি। আমাদের সকলের জন্য হয়তো মিঃ এবং মিসেস আওয়েন অধীর আগ্রহে রয়েছেন।
নির্জন জায়গাটা দেখে সকলের মনেই কেমন অদ্ভুত একটা শিহরণ জেগে ওঠে। কোথায় যাচ্ছেন, কার কাছে যাচ্ছেন কিছুই তাঁরা জানেন না, তবু অজ্ঞাত সেই আমন্ত্রণকারীর আকর্ষণ তারা কেউ অবহেলা করতে পারছেন না।
বোটচালক ডেভিস বোটে গিয়ে ওঠে। অন্যান্য সকলেও তাকে অনুসরণ করে।
ডেভিস বলে, মিঃ আওয়েন বলেছিলেন, আরও দুজনের আসার কথা আছে। তবে তাদের জন্য আমাদের অপেক্ষা করবার প্রয়োজন নেই।
ঠিক সেই সময়েই প্রচণ্ডগতিতে ধেয়ে এসে একটা সুন্দর ট্যাক্সি সমুদ্রতীরে থামল। নেমে এলেন অপূর্ব সুন্দর একজন মানুষ। গ্রীক ভাস্কর্যেই কেবল তার তুলনা মেলে। ইনিই হলেন অ্যান্টনি মার্সটন।
ডেভিস সম্ভাষণ জানিয়ে আহ্বান জানায়। মিঃ মার্টন বোটে উঠতেই বোট ছেড়ে দিল।
.
সামনেই পান্না দ্বীপ। কিন্তু একটা ছোট্ট পাহাড় তাকে আড়াল করে রেখেছে বলে এখান থেকে দ্বীপটাকে দেখা যায় না।
বোটটা কিছুটা ঘুরে গিয়ে দুটো পাথরের মাঝখানে থামল।
একে একে সকলেই অবতরণ করলেন। জায়গাটা নির্জন ও সুন্দর। চারপাশে ফল, ফুলের গাছ, সুন্দর বাগান, তার মাঝখানে চমৎকার একটা বাড়ি। প্রাসাদোপম। সকলেরই পছন্দ হয় জায়গাটা।
একজন বয়স্ক পরিচারক এগিয়ে এসে বলে, দয়া করে আপনারা এদিকে আসুন।
সকলে পাশাপাশি বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। বিরাট হলঘর সামনে। উপযুক্ত টেবিল চেয়ারও রয়েছে। বড় টেবিলে অনেক পানীয় রয়েছে।