লমবার্ড ব্যঙ্গের সুরে বলে, সিন্দুকের চাবিটা কি এরপর আপনার কাছে থাকবে?
বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে লমবার্ডের দিকে তাকালেন। তারপর শান্তভাবে বললেন, তাহলে, চলুন নিচে যাওয়া যাক।
নিচে গেরস্থালির চাবি একটা হুকে সাজানো আছে। ওয়ারগ্রেভ একটা রিং তুলে আনলেন। তাতে দুটো চাবি। ওটা সিন্দুকের চাবি।
খুলবার জন্য দুটোই ব্যবহার করতে হয়। ওয়ারগ্রেভ সিন্দুক খুলে ওষুধগুলো রেখে চাবি ঘুরিয়ে আবার বন্ধ করে দিলেন।
তারপর একটা করে চাবি লমবার্ড ও ব্লোরকে দিয়ে তিনি বললেন, তোমরা একে অপরের কাছ থেকে চাবি কেড়ে নিতে পারবে না, দুজনেই শক্তিমান।
সিন্দুক ভাঙা সহজ কাজ হবে না, তাতে শব্দও হবে প্রচণ্ড। কাজেই ওষুধগুলো নিয়ে আর ভয়ের কোন কারণ নেই।
একটু থেমে ওয়ারগ্রেভ আবার বললেন, কিন্তু লম্বার্ডের রিভলভারটা কোথায় গেল সেটাই ভাবছি। আচ্ছা, ওটা তুমি শেষ কখন দেখেছিলে লমবার্ড?
লমবার্ড বলল, কাল রাতে শোবার সময়।
ব্লোর বলল, রিভলভারটা পাওয়া না গেলেও অন্য একটা জিনিস কোথায় আছে আমি বলতে পারি। আপনারা আমার সঙ্গে আসুন।
ব্লোরকে অনুসরণ করে সকলে খাওয়ার ঘরের পেছনে এলো। ব্লোর আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল, জানলার নিচে ঘাসের ওপরে পড়ে রয়েছে সিরিঞ্জ ও একটা ভাঙ্গা পুতুল।
ব্লোর বলল, মিস এমিলিকে হত্যা করে হত্যাকারী ওগুলো ফেলে দিয়েছে।
ভেরা বলল, তাহলে খুঁজলে রিভলভারটাও পাওয়া যেতে পারে বলে মনে হচ্ছে। চলুন। দেখা যাক।
বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ বললেন, চল তাহলে। তবে সবাই আমরা একসঙ্গে থাকব। এখন আলাদা ভাবে থাকা মানেই হত্যাকারীকে সুযোগ করে দেওয়া।
এরপর সকলে মিলে আঁতিপাতি করে খুঁজলেন, কিন্তু রিভলভার কোথাও পাওয়া গেল না।
.
১৩.
অবশিষ্ট পাঁচটা মানুষ। কিন্তু মানসিকভাবে কেউই স্বস্তিতে নেই। প্রত্যেকেই প্রত্যেককে সন্দেহ করছে, কেন না, ওয়ারগ্রেভ বুঝিয়ে দিয়েছেন, খুনী তাদের মধ্যেই একজন। তবু বাঁচার চেষ্টায় তারা পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত না থেকে পারছে না।
প্রকৃতিও আজ বড় অশান্ত। বৃষ্টি ঝরছে অঝোরে। পাল্লা দিয়ে চলেছে ঝোড়ো হাওয়া।
থেকে থেকে দমকা হাওয়া বাড়িটার ওপর আছড়ে পড়ছে প্রচণ্ড আক্রোশে। যেন প্রাসাদোপম বাড়িটা গুঁড়িয়ে দেবে।
ওরা পাঁচজন, বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ, ডাঃ আরমস্ট্রং, ব্লোর, লমবার্ড ও ভেরা ঘরে বসে আছে খানিক দূরে দূরে।
এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, প্রত্যেকে যেন একটা আলাদা দ্বীপ।
সকলেরই মনের মধ্যে একটা কথা কেবলই ঘুরে ফিরছে–খুনী আমাদের মধ্যেই একজন।
দূরেদূরে বসে আছে, কিন্তু তাদের চোরা দৃষ্টি পরস্পরকে তীক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করছে। হাবভাব কতটা সন্দেহজনক তা জরীপ করবার চেষ্টা করে চলেছে।
সময় বয়ে চলে। হাওয়ার গজরানি আর শার্সির গায়ে বৃষ্টি আছড়ে পড়ার শব্দ ছাড়া এঘরে অন্য কোন শব্দ নেই।
ভেরা বলল, চা করে নিয়ে আসা যাক।
ওয়ারগ্রেভ বললেন, মন্দ হয় না। কিন্তু তুমি একা যেয়ো না, আমরাও সঙ্গে যাব। চা টা আমাদের সামনেই করো।
পারস্পরিক এই সন্দেহের খোলামেলা প্রকাশকে এখন আর কেউ অপমানজনক বলে মনে করছে না। তাই ভেরা বলল, বেশ চলুন।
.
সন্ধ্যাবেলা আলো জ্বালতে গিয়ে দেখা গেল, আলো জ্বলছে না। রজার্স মারা যাবার পর আর ইঞ্জিনটা চালানো হয়নি।
লমবার্ড ইঞ্জিনটা চালাবার কথা বললে, ওয়ারগ্রেভ বললেন, এখন আর ঝামেলা করে কাজ নেই। রান্নাঘরে অনেক মোমবাতি আছে, তাই জ্বালানো হোক।
তাই করা হলো।
.
মনের সঙ্গে শরীরের সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। ভেরার মাথাটা ভারি ভারি বোধ হচ্ছিল। শরীরও কেমন ম্যাজম্যাজ করছে। স্নান করলে একটু স্বস্তিবোধ করবে ভেরার মনে হল।
সে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে প্লেটের ওপর বসিয়ে দোতলার ঘরে গেল। চারপাশে অন্ধকার। মোমবাতির সামান্য আলোয় অনেক কষ্ট করে চলতে হচ্ছে।
ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই ভেরার মনে পড়ে গেল হুগোর কথা। তার হাত কেঁপে উঠলো। প্লেটটা পড়ে গেল, বাতি নিভে গেল।
কিছু বুঝতে না পেরে তীব্র আতঙ্কে ভেরা আর্তনাদ করে উঠল। তার মনে হল একটা ঠান্ডা হাত তার কপালে, গলায় গালে ….
ভেরার চিৎকার শুনে সকলে ওপরে ছুটে আসে। একটা করে জ্বলন্ত মোমবাতি সবার হাতে।
ডাক্তার এগিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করলেন ভেরাকে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জানালেন, ভেরা বেঁচে আছে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।
ব্লোর নিচে গিয়ে একটু ব্র্যান্ডি নিয়ে আসে। ভেরাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করতেই বাধা দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল–না, না, আমি কিছু খাবো না।
সেই সন্দেহ। যদি পানীয়ের সঙ্গে কিছু মেশানো থাকে। ব্লোর অপমান বোধ করলেও হাত সরিয়ে আনল।
লমবার্ড বলল, একটা না-খোলা বোতল পাওয়া গেলে ভাল হতো, দেখছি–
বলে সে নিচে নেমে গেল। এত কাণ্ডের পরেও ভেরা যে বিচার শক্তি হারিয়ে ফেলেনি এতে সে খুশি।
ডাক্তার ভেরাকে সাবধানে তুলে ধরে কলের কাছে নিয়ে গেলেন। চোখে মুখে জল ছেটাল ভেরা। ওর সামনেই গ্লাস ধুয়ে জল দিলেন ডাক্তার। জলটুকু খেল সে। তারপর ডাক্তারের হাত ধরে ফিরে এসে খাটের ওপরে বসল।
ভেরা কেন ভয় পেয়েছিল তা জানা গেল। ঘরের সিলিং থেকে ঝুলছে একটা সামুদ্রিক লতা। কিন্তু ওটা আগে ওখানে ছিল না, সদ্য কেউ ঝুলিয়ে রেখে গেছে।