ঘুমে চোখ বুজে আসছিল। এই পর্যন্ত লিখে এমিলি টেবিলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়লেন।
একটু পরেই তন্দ্রা কেটে যায়। হাতে ধরা কলম তুলে আবার তিনি লিখতে শুরু করেন–
প্রত্যেকেই জানতে চাইছেন, কার পক্ষে এসব কাজ করা সম্ভবপর। কিন্তু সঠিক উত্তর কারোরই জানা নেই। কিন্তু আমি জানি, একজনের ওপরে ভর করেছে বিয়াত্রিচে টেলার।
হঠাৎ তার খেয়াল হল। লেখার শেষ অংশটুকু পড়ে তিনি ভাবেন, এসব কি লিখেছি? ও নাম কেন লিখলাম? সঙ্গে সঙ্গে শেষের লাইন দুটো কেটে দিলেন ভালভাবে যাতে পড়তে পারা না যায়।
.
জোরালো হাওয়ার গর্জন ক্রমশ বেড়ে উঠছে। সঙ্গে সমুদ্রের ফোসানি। সকলেই ঘরের মধ্যে রয়েছে। শার্সিগুলো বন্ধ। ঘর জুড়ে মেঘলা দিনের আবছা অন্ধকার।
কেউ কোন কথা বলছেন না। মন সকলেরই বিক্ষিপ্ত যেন প্রত্যেকেই এক একজন আসামী।
রজার্স চায়ের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকল। ভেরা এমিলির দিকে তাকিয়ে বলল, চা টা আপনিই তৈরি করবেন।
এমিলি বললেন, আমার মন মেজাজ ভাল নেই, তুমিই কর।
ভেরা চা তৈরি করে পরিবেশন করল। ঘরের গুমোট ভাবটা খানিক হাল্কা হল।
একটু পরেই রজার্স ফের ঘরে ঢোকে। সে জানাল, ওপরের একটা স্নানের ঘরের পর্দা কে। খুলে নিয়েছে।
–কি রকম পর্দা ছিল? ব্লোর জানতে চায়।
–লাল সিল্কের।
–ও নিয়ে কেউ আর মানুষ খুন করতে পারবে না। যেতে দাও।
এমিলি বললেন, আমারও দুটো উলের গোলা খুঁজে পাচ্ছি না।
ভেরা বলল, কোথাও পড়ে গেছে হয়তো।
–তাই হবে।
রজার্স চলে গেল। সকলেই যার যার মত চা পান করতে লাগলেন। সকলের মনেই সন্দেহের মেঘ জমাট বাঁধতে শুরু করেছে।
.
সবে ডিনার শেষ হয়েছে। রাত তখন নটা। সকলকেই শুতে যেতে হবে।
প্রথমে উঠে দাঁড়াল এমিলি এবং ভেরা।
বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ বললেন, শুভরাত্রি জানাবার আগে সকলকেই আর একবার মনে করিয়ে দিচ্ছি, শুতে যাবার আগে দরজা ভাল করে বন্ধ করে দেবেন। সাবধানতা অবলম্বন করতে ভুলবেন না। কাল আবার সকলে এখানে মিলিত হব।
চারজন পরপর সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল। দরজা বন্ধ করবার শব্দও পাওয়া গেল।
রজার্সকে একাই সব কাজ করতে হচ্ছে তখন। সে খাওয়ার ঘর পরিষ্কার করে। তারপর আলো নিবিয়ে ঘরে চাবি দিয়ে দেয়।
রজার্স তার নতুন ঘরে চলে আসে। দরজা বন্ধ করে ঘরটা একবার ভাল করে দেখে নেয়। আলমারি, খাটের তলা, কোন কিছু দেখতে বাকি রাখে না।
রজার্স শুয়ে পড়বার আগে ভাবল, আজ রাতে নিশ্চয় পুতুল কম হবে না। সংখ্যাটা একই থাকবে।
৩. লমবার্ড ঘড়িটা দেখল
১১.
লমবার্ড ঘড়িটা দেখল, সাড়ে নটা। ভাবল, নাঃ আর পড়ে থাকবো না। এবারে ওঠা দরকার।
সকালে ঘুম থেকে দেরি করে ওঠা তার বরাবরকার অভ্যাস। ঘুম ভাঙলেও বালিশে মুখ এঁজে পড়ে থাকে।
দরজা খুলে বাইরে আসে সে। দেখে ব্লোরের ঘর বন্ধ। এগিয়ে এসে টোকা দেয়।
একটু পরেই দরজা খুলে বেরিয়ে আসে ব্লোর। তাকে দেখে লমবার্ডের মনে হয়, একটু আগেই ঘুম থেকে উঠেছে।
ঘুমঘুম চোখে ব্লোর বলে, কি ব্যাপার?
–কটা বাজে খেয়াল আছে?
ব্লোর ঘড়ি দেখে। লজ্জিত ভাবে বলে, সর্বনাশ পৌনে দশটা। আসলে মনটা বড্ড অবসন্ন তো।
লমবার্ড বলে, তোমাকে কেউ ডেকেছিল? রজার্স চা দিয়ে গেছে?
-কই না তো? রজার্স কোথায়? যেন চমকে ওঠে ব্লোর। লমবার্ড বলে, ঘুম ভাঙ্গার পর থেকে আমারও এই কথাই মনে হচ্ছে।
দেখা গেল রজার্স নিরুদ্দেশ। সে তার ছোট্ট ঘরে বা রান্না ঘরে নেই। উনুনে আগুনও দেয়নি।
খবরটা অন্যদেরও দেওয়া হল। এমিলি ও ওয়ারগ্রেভ ছাড়া সকলেই রজার্সের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ল।
রজার্সের ঘরে দেখা গেল, বিছানা এলোমেলো। শোবার পোশাকটা ঘরের বাঁ পাশে পড়ে রয়েছে। দাড়িকাটার সরঞ্জাম টেবিলের একপাশে রয়েছে।
ব্রাশটা ভেজা, বোঝা গেল, দাড়ি কামিয়ে সে নিচে নেমেছে। সকলেই একে একে খাওয়ার ঘরে পা দিলেন।
বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ বললেন, বাঃ রজার্স দেখছি বেশ পরিবাটি করে ব্রেকফাস্ট টেবিল সাজিয়েছে।
ভেরা হঠাৎ বিচারপতির হাত চেপে ধরে চিৎকার করে ওঠে, দেখুন, পুতুল ছটা–
সকলেই সেদিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে রইল।
.
রজার্সের মৃতদেহের সন্ধান পাওয়া গেল খানিক পরেই। রান্নার কাঠ কাটতে গিয়েছিল রান্নাঘরের পেছনে। একটা কাটারি হাতেই ধরা ছিল। পাশেই কিছু কেটে রাখা কাঠ। হাত কয়েক দূরে দেয়ালে হেলান দেওয়া রয়েছে একটা রক্তমাখা কুঠার।
রজার্সের ঘাড়ে গভীর ক্ষতচিহ্ন।
.
১২.
এমিলি আর ভেরা মিলে সকালের খাওয়ার পাট কোন রকমে সমাধা করল। টিনের খাবার ছিল প্রচুর। তাই বিশেষ অসুবিধা হয়নি।
রজার্সের ঘটনাটা নিয়ে আলোচনার পরে সকলে বসার ঘরে হাজির হয়েছেন। কেবল বাদ ছিলেন এমিলি।
তার শরীর গোলাচ্ছিল বলে খাবার ঘরের চেয়ারেই বসেছিলেন।
ডাক্তার ওষুধ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এমিলি খেতে চাননি।
এমিলির খুব ঘুম পাচ্ছিল। মৃদু গুঞ্জনের শব্দ তার কানে গেল। তাকিয়ে দেখেন জানালার কাছে একটা মৌমাছি উড়ছে।
হঠাৎ এমিলির মনে হল, কেউ যেন ঘরে প্রবেশ করল। মাথা ঘুরিয়ে দেখতে ইচ্ছে হলেও পারলেন না।
কিন্তু কে এলো? তার মনে হল, বিয়াত্রিচে যেন। তার সর্বাঙ্গ জলে ভেজা। ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরছে তা থেকে।
মৌমাছির গুঞ্জন শব্দটা যেন কাছে এগিয়ে আসছে। হুল ফুটিয়ে দেবে না তো?
.
বসার ঘরে সকলে এমিলির জন্যই অপেক্ষা করছিল। ভেরা তাকে ডাকতে যাবে বলে উঠে দাঁড়াল। ব্লোর তাকে বাধা দিয়ে বলল, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে যিনি রয়েছেন তিনিই খাবার ঘরে বসে আছেন।