ব্লোর বলল, আমার দ্বিমত নেই। একেবারে খাঁটি কথা বলেছেন বিচারপতি।
দেখা গেল একমাত্র ভেরা ছাড়া সকলেই সহমত পোষণ করছে। ভেরা দৃঢ়স্বরে বলল, আমি ওকথা বিশ্বাস করি না।
ব্লোর বলল, আমার একটা কথা, তাকে বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছে, লমবার্ডের কাছে একটা রিভলভার আছে, গতকাল কিন্তু একথা সে স্বীকার করেনি। আজ নিজেই বলেছে।
লমবার্ড মৃদু হেসে বলল, আমি আগেই ব্যাপারটা ডাক্তার ও ব্লোরকে বুঝিয়ে বলেছি। তবু মনে হচ্ছে এখন সকলের কাছেই বুঝিয়ে বলা দরকার। বন্ধুবর ব্লোর, ব্যাপারটা নিয়ে খুবই সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠেছেন–এটা দূর হওয়া দরকার।
এরপর লমবার্ড তার বক্তব্য সকলকে শোনালো।
ব্লোর তবু বলল, এটা যে একটা বানানো গল্প নয়, তার কি প্রমাণ?
বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ বললেন, প্রমাণ আমাদের কারো কাছেই নেই। এক্ষেত্রে পরস্পরকে মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
আমরা এখন চরম সংকটের মুখে। এই অবস্থা আমাদের মোকাবেলা করতে হবে। তবে একটা কথা সকলের মনে রাখতে হবে যে পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায়, এমন একজনও আমাদের মধ্যে নেই।
এমিলি মেঝের দিকে তাকিয়ে বসেছিলেন। তিনি এবারে বললেন, কথাটা মিথ্যা নয় যে, আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেককে সন্দেহ করছি। আমাদের মধ্যেই এমন একজন নিশ্চয় আছে, যার কাঁধে শয়তান ভর করেছে।
ওয়ারগ্রেভ বললেন, তাহলে দেখা গেল এ বিষয়ে আমরা সকলেই একমত যে আমরা সবাই পরস্পরকে সন্দেহের চোখে দেখছি।
বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ এবারে বললেন, এবারে একথা ভাবতে হবে, আমাদের পক্ষে কার পক্ষে তিন তিনটে মানুষকে হত্যা করা সম্ভব হতে পারে।
ব্লোর সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, তাহলে ঘটনাগুলো একটু তলিয়ে দেখা যাক। মার্সটনের ব্যাপারটা এখনো সন্দেহের মধ্যে রয়েছে। কি হয়েছিল তা স্পষ্ট নয়।
তবে রজার্সের স্ত্রীর ব্যাপারে দুজনকে সন্দেহ করা যায়। এর মধ্যে একজন স্বয়ং রজার্স অপরজন ডাক্তার আরমস্ট্রং।
ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র প্রতিবাদ জানালেন, আমি একথার আপত্তি জানাচ্ছি।
ওয়ারগ্রেভ বললেন, ডাক্তার আরমস্ট্রং, আপনার আপত্তি থাকা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তথ্যের মুখোমুখি আপনাকে হতেই হবে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে রজার্সের স্ত্রীকে কিছু খাইয়ে দেওয়ার সুযোগ আপনার এবং রজার্সেরই সবচেয়ে বেশি ছিল।
অবশ্য এ ব্যাপারে অন্যদের ভূমিকাও বিচার্য। আমরা কেউই, মান, সম্মান, যশ, প্রতিপত্তি, নির্বিশেষে, সন্দেহের বাইরে নই।
ভেরা বলল, রজার্সের স্ত্রীর ত্রিসীমানার মধ্যে আমি ছিলাম না।
এমিলি ডাক্তারকে বললেন, ডাক্তার, আপনার দেওয়া ঘুমের ওষুধ খেয়ে রজার্সের স্ত্রী নিশ্চই ঘুমিয়ে পড়েছিল। সেই সময় কেউ ঘরে ঢুকে থাকলে তাকে ঘুমন্ত অবস্থাতেই দেখেছে, তাই না ডাক্তার?
ডাক্তার বললেন, তা জোর দিয়ে বলা যায় না। কারণ এক ওষুধ সবার ক্ষেত্রে একই রকম কাজ দেয় না। পরীক্ষা ছাড়া সঠিক বলা সম্ভব হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, ঘুমের ওষুধ কাজ করেছে অনেকটা সময় নিয়ে।
লমবার্ড চড়াসুরে বলল, আপনি তো এখন আপনার সুবিধামত কথাই বলবেন।
ডাক্তার কি জবাব দিতে যাচ্ছিলেন, ওয়ারগ্রেভ তাকে বাধা দিয়ে বললেন, এভাবে পরস্পরকে হেনস্তা করে কোন লাভ নেই। আমাদের অন্য পথ ধরতে হবে।
.
এরপর ওয়ারগ্রেভ বললেন, আসুন, জেনারেল ডগলাসের মৃত্যু নিয়ে এবারে আলোচনা করা যাক। আমি অবশ্য এব্যাপারে কিছুই জানি না।
সকাল থেকে বারান্দায়ই বসেছিলাম। আমি সেই সময় সমুদ্রতীরেই গিয়ে থাকতে পারি, আমার ওপরে নজর রাখার মত কেউ ছিল না। তবে আমার এজাহার হিসাবে সকলকে জানাতে চাই, আমি সারাক্ষণ বারান্দায়ই ছিলাম।
ব্লোর বলল, আমি সকালটা ডাক্তার এবং লম্বার্ডের সঙ্গে কাটিয়েছি। তারাই এ ব্যাপারে সাক্ষ্য দেবেন বলে আমি আশা করছি।
ডাক্তার বললেন, একথা ঠিকই। তবে একবার তুমি দড়ি আনতে বাড়ি গিয়েছিলে।
–সঙ্গে সঙ্গেই তো দড়ি নিয়ে ফিরে এলাম। খুঁজে নিতে যেটুকু সময় লেগেছিল।
ওয়ারগ্রেভ বললেন, ব্লোর যখন দড়ি আনতে গেল তখন আপনি আর লমবার্ড কি একসঙ্গেই ছিলেন?
ডাক্তার বললেন, হ্যাঁ, তবে লমবার্ড সামান্যক্ষণের জন্য যেন কোথায় গেছিল, আমি ওখানেই ছিলাম।
লমবার্ড জানাল, হ্যাঁ গিয়েছিলাম দেখতে যে দ্বীপটা থেকে বাইরে খবর পাঠাবার কোন উপায় করা যায় কিনা দেখতে। তবে সে তো দু-এক মিনিটের জন্য।
ডাক্তার বললেন, তা ঠিক, ওইটুকু সময়ের মধ্যে একটা মানুষকে খুন করা যায় না।
ওয়ারগ্রেভ বললেন, ডাক্তার নিশ্চয়ই সেই সময় ঘড়ি দেখেননি?
–না।
এমিলি জানালেন, সবটাই আন্দাজ। এতে সঠিকভাবে কিছু বলা যায় না। এবারে আপনার কথা বলুন।
ওয়ারগ্রেভ বললেন, সকালে ভেরাকে নিয়ে একটু বেড়িয়েছি, তারপর বারান্দাতেই ছিলাম।
বারান্দায়? কিন্তু আমি তো আপনাকে দেখতে পাইনি।
–আমি পুবদিকটায় ছিলাম, বেশ বাতাস আসছিল।
–লাঞ্চ পর্যন্ত আপনি ওখানেই ছিলেন?
-হ্যাঁ।
–ভেরা, তোমার কথা বল এবারে।
–আমি মিস এমিলিকে নিয়ে এদিক সেদিক খানিক্ষণ ঘুরে বেড়িয়েছি। সে সময় জেনারেলকে দেখেছিলাম। তাকে কেমন অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল।
ওয়ারগ্রেভ জিজ্ঞেস করলেন, অস্বাভাবিক কিরকম?
–তিনি বলেছিলেন, শেষ ডাকের অপেক্ষা করছেন। এই দ্বীপই আমাদের সকলের শেষ শান্তির জায়গা। শুনে আমার কেমন ভয় করছিল।