ডাক্তার জানতে চাইলেন, কিন্তু এখন তুমি নিশ্চয়ই অন্যরকম ভাবছ?
লমবার্ডের মুখভাব কঠিন হয়ে ওঠে। সে বলে, এখন আমার অবস্থা আর সকলেরই মত–কুচক্রী আওয়েনের ফাঁদে পড়েছি।
একটু থেমে সে আবার বলে, দুজন লোক মারা গেল, অমনি দুটো পুতুলও উধাও হল, কেউ দেখতেই পেল না কখন এসব হল। সবই সেই শয়তান আওয়েনের কাজ।
কথা শেষ হবার পরক্ষণেই লাঞ্চের ঘন্টা বেজে উঠল। খাওয়ার ঘরে প্রথম ঢুকল লমবার্ড। রজার্স অপেক্ষা করে ছিল।
লমবার্ড জিজ্ঞেস করল, রজার্স রান্নাবান্না করতে খুব অসুবিধা হয়েছে?
–না স্যর। তেমন কিছু হয়নি। টিনের খাবার তো প্রচুর ছিল। তাই দিয়েই কাজ চালিয়ে নিয়েছি। নারাকোট তো আর এল না–ব্যাপারটা আমার ভাল ঠেকছে না।
-হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ।
তারপর একে একে সকলেই এসে পৌঁছলেন। আবার টেবিলে বসার পর দেখা গেল জেনারেল তখনো অনুপস্থিত।
রজার্স জানতে চাইল, আপনারা শুরু করবেন না জেনারেলের জন্য অপেক্ষা করবেন?
ভেরা জানাল, তাঁকে তো সমুদ্রতীরে বসে থাকতে দেখে এলাম। কেমন অন্যমনস্ক। মনে হয় ঘন্টার শব্দ শুনতে পাননি।
রজার্স বলল, আমি তাহলে তাকে গিয়ে লাঞ্চের কথাটা জানিয়ে আসি।
ডাক্তার বললেন, তুমি সকলকে পরিবেশন কর, আমি তাকে নিয়ে আসছি।
সমুদ্রের গর্জন ক্রমশই বেড়ে উঠছিল। বাতাসও প্রবল হচ্ছে সেই সঙ্গে। আসন্ন ঝড়ের ইঙ্গিত।
রজার্স সকলকে পরিবেশন করতে লাগল। মাংস দিতে দিতে সে বলল, কেউ যেন দৌড়ে আসছেন?
সমুদ্রের গর্জনের ভেতরেই পায়ের আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পাওয়া গেল।
ডাক্তার হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে এসে ঢুকলেন, জেনারেল—
জেনারেল কি? মারা গেছেন? ভেরা ব্যগ্র হয়ে ওঠে।
–হ্যাঁ।
চমকে ওঠে সকলে। একে অপরের দিকে তাকাল। কিন্তু কারো মুখে কথা নেই।
সমুদ্রের দাপাদাপি আর বাতাসের হাহাকারের শব্দে ঘর ভরে ওঠে।
.
শেষ পর্যন্ত ঝড় শুরু হয়ে গেল।
সবাই মিলে ধরাধরি করে জেনারেলের দেহটা দোতলায় তুলে নিয়ে গেল।
খাবারের প্লেট কেউ স্পর্শও করেনি। ভেরা দরজায় এসে দাঁড়ায়।
রজার্স সবার আগে নেমে আসে নিচে। ভেরাকে বলে, দেখতে এলাম কটা পুতুল রয়েছে।
ভেরা তাকিয়ে দেখল। বলল, ওই দেখ সাতটা পুতুল।
–সাতটা!
.
জেনারেলের ঘরেই খাটের ওপরে শুইয়ে দেওয়া হল মৃতদেহ। সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হল। ডাক্তার শেষবারের মতো তাকে পরীক্ষা করলেন। তারপর নিচে নেমে এলেন।
ভেরা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। কোলের ওপর উল আর কাটা পড়ে রয়েছে, এমিলি আর বুনছেন না।
ব্লোর হাঁটুর ওপরে কনুই আর মাথায় হাত রেখে বসে আছে।
অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন লমবার্ড। ঘরের এক কোণে বড় আরাম কেদারায় চোখ বুজে বসে রয়েছেন ওয়ারগ্রেভ।
ডাক্তার ঘরে প্রবেশ করতে ওয়ারগ্রেভ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কি বুঝলেন ডাক্তার?
গম্ভীর স্বরে ডাক্তার জবাব দিলেন, ভারি কিছু দিয়ে পেছন থেকে মাথায় আঘাত করা হয়েছে। তাতেই মৃত্যু ঘটেছে।
একটা চাপা ফিসফিসানি ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল।
–যে জিনিসটা দিয়ে আঘাত করা হয়েছে সেটা কি আপনি দেখেছেন?
–না। তবে আমি নিঃসন্দেহ।
ওয়ারগ্রেভ এবারে সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এক কঠিন জটিল পরিস্থিতির মধ্যে আমরা পড়ে গেছি। আপনারা আজ যখন ব্যস্ত ছিলেন, আমি বারান্দায় চুপচাপ বসে ছিলাম। আপনারা যে সেই গুপ্তঘাতককে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন, তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম।
লমবার্ড বলল, কিন্তু কোথাও কিছু পাওয়া গেল না।
ওয়ারগ্রেভ যেন সভাপতিত্ব করছেন, যেন সকলের নেতৃত্বের ভার নিজের হাতে নিয়েছেন, এমনি ভঙ্গি ও স্বরে বললেন, এখন নিশ্চয়ই আর কারো সন্দেহ নেই যে রজার্সের স্ত্রী এবং মাসটনের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। এখানে আমাদের নিমন্ত্রণ জানানো যে আওয়েনের ষড়যন্ত্র তাও এখন আর অপরিষ্কার নেই।
ব্লোর বলল, ওটা একটা পাগল কিন্তু বিপজ্জনক।
ওয়ারগ্রেভ বললেন, পাগল হোক যাই হোক, তাকে নিয়ে আলোচনা করে আর লাভ নেই। এখন আমাদের উদ্ধারের পথ ভাবা দরকার।
ডাক্তার বললেন, কিন্তু এই দ্বীপে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। আজ তন্নতন্ন করে খুঁজেছি আমরা। ….
ওয়ারগ্রেভ বললেন, নেই যে আজ সকালে আমিও বুঝতে পেরেছি। যাই হোক, আমি চিন্তা করে দেখলাম, আওয়েন কতগুলো লোককে শাস্তি দেবার জন্য আঁটোসাঁটো পরিকল্পনা এঁটেছে। এই লোকগুলোর অপরাধ আইনের চোখকে ফাঁকি দিয়েছে। তার এই পরিকল্পনা মতই মাসটন, রজার্সের স্ত্রী এবং ডগলাস প্রাণ হারিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে দশটা পুতুলের তিনটে পুতুল উধাও হয়েছে।
এখন কথা হল, পরিকল্পনা কার্যকরী করবার জন্য আওয়েনকে এখানে থাকা প্রয়োজন–এবং সে যে আছে তার প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে।
একটু থেমে তিনি আবার বললেন, একটি উপায়েই তার এখানে থাকা সম্ভব। আমার বিশ্বাস সে আমাদের মধ্যেই একজন।
–না, না-তা হতে পারে না। ভেরার গলা কান্নায় ভিজে এলো।
ওয়ারগ্রেভ ভেরার দিকে তাকিয়ে বললেন, ভেরা, এখন এমন একটা সময়, এড়িয়ে চলা বিপজ্জনক। অদৃশ্য আওয়েন যে আমাদের মধ্যেই একজন তাতে কোন সন্দেহ নেই।
আমরা দশজন ছিলাম, তার মধ্যে এখন রয়েছি সাতজন। এই সাতজনের মধ্যে যে কেউ হতে পারে।
একটু নেমে তিনি ফের বললেন, আশা করি সকলেই একমত হবেন।
ডাক্তার মৃদুস্বরে বললেন, আপনার কথা সত্যি ভাবতে বড় খারাপ লাগছে। তবু মনে হচ্ছে, আপনার ধারণাই ঠিক।