ডাক্তার ও ব্লোর চমকে উঠে লম্বার্ডের দিকে তাকায়। একটা অশুভ ইঙ্গিত যেন ওরা দেখতে পায়।
ব্লোর বলল, সবসময়েই ওটা সঙ্গে থাকে নাকি?
–হ্যাঁ, অনেক গোলমেলে জায়গাতেই তো যেতে হয়।
ডাক্তার বললেন, ভালই হল। আওয়েনের কাছে কোন অস্ত্র থাকা অসম্ভব নয়। মোকাবিলা করা যাবে।
.
দ্বীপটা ছোট্ট । গাছপালা ঝোপঝাড় নেই বলে এখানে আড়াল-আবডালের কোন ব্যাপার নেই। একদিকে কেবল সেই ছোট্ট টিলা। তাতেও গুহাটুহা কিছু নেই। ওপরটা বেশ চওড়া আর সমতল।
ওদের তিনজনের দলটা দ্বীপটা খুঁজতে লেগে গেল। ঘুরতে ঘুরতে একজায়গায় এসে দেখল, জলের ধারে জেনারেল ডগলাস চুপচাপ বসে আছেন। তার দৃষ্টি দূর আকাশের শূন্যতায়।
সাড়া পেয়েও ডগলাস ওদের দিকে ফিরে তাকালেন না। নিজের চিন্তাতেই তন্ময় হয়ে আছেন।
ব্লোর গলাটা একটু ঝেড়ে আলাপের ভঙ্গিতে বলল, জায়গাটা সত্যি চমৎকার।
ডগলাস ভুরু কুঁচকে তাকায় এবারে। বলে, আমি একটু একলা থাকতে চাই–সময় ফুরিয়ে এসেছে–
ব্লোর লজ্জিতভাবে বলল, আমি আপনাকে বিরক্ত করতে চাই না। একটা লোককে আমরা তিনজন খুঁজে বেড়াচ্ছি। আপনার সঙ্গে দেখা হল বলে জানলাম।
–সময় নেই হে, তোমরা কিছুই বুঝতে পারছ না। ব্লোর আর তাকে ঘাঁটাল না। দলে ফিরে গেল।
বলল, লোকটার কথাবার্তা কেমন গোলমেলে হয়ে গেছে। আমাকে বলল, সময় ফুরিয়ে আসছে, একা থাকতে চায়।
ডাক্তার বিড়বিড় করে বললেন, তাই তো। ওরকম কথা বলছে, একটু ভেবে দেখা দরকার।
.
সারা দ্বীপ ঘুরে ঘুরে কাউকে কোথাও পাওয়া গেল না। কোন লোক লুকিয়ে থাকতে পারে, এমন জায়গাও কোথাও নজরে পড়ল না।
ক্লান্ত হয়ে ডেভনের দিকে তাকিয়েছিল লমবার্ড। বলল, ঝড় আসছে।
ব্লোর জলের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, এই পাড়টা অনেকটা উঁচু। আচ্ছা, এখানে আড়ালে কেউ লুকিয়ে নেই তো?
ডাক্তার মাথা নেড়ে বলেন, খাড়া পাড় নিচে নেমে গেছে। এখানে কারোর লুকিয়ে থাকা সম্ভব নয়।
ব্লোর বলল, কিন্তু কোনো গর্ত তো থাকতে পারে।
লমবার্ড বলে, তবে কিনারের দিকে একটা নোক লুকিয়ে থাকতে পারে এমন জায়গা আছে। একটা দড়ি পেলে আমি নিচে নেমে যেতে পারতাম।
ব্লোর বলল, সন্দেহটা মিটিয়ে নেওয়া ভাল। আমি দেখছি, দড়ি জোগাড় করতে পারি কিনা।
ব্লোর চলে গেল। লমবার্ড বলল, আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে, অন্ধকার হয়ে আসছে।
ডাক্তার চিন্তিতভাবে বললেন, ভাবছি, ডগলাসের মাথাটা বোধহয় খারাপই হয়ে গেল। মানসিক চাপ সইতে না পেরেই এমনটা হয়েছে।
.
সেই কথাবার্তার পর থেকে ভেরা এমিলিকে এড়িয়ে চলবার চেষ্টা করছে। তাই সকালটা খুব অস্বস্তির মধ্যে কেটেছে তার।
খানিকটা করে দুরত্বে বারান্দায় তিনটে চেয়ারে বসে আছে ওয়ারগ্রেভ, এমিলি আর ভেরা।
ওয়ারগ্রেভের মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকে আছে। নিজের চেয়ারে বসে একমনে উল বুনে চলেছেন এমিলি।
তার মুখটা করুণাহীন, নিষ্ঠুর মনে হওয়ায় চোখ ফিরিয়ে নিল ভেরা। সে আর বসে থাকতে পারল না। চেয়ার ছেড়ে উঠে ধীরে ধীরে সমুদ্রের দিকে হেঁটে চলল।
.
হঠাৎ চমকে ওঠে ভেরা। জেনারেল ডগলাসের গলা। এমিলি এমিলি বলে কি যেন বলছেন। সে এগিয়ে যায়।
দেখে ডগলাস সমুদ্রের ধারে বসে আছেন। তাকে দেখতে পেয়ে বললেন, ওঃ তুমি এসেছে। আমি ভাবলাম লেসলি।
–লেসলি আপনার কে হয়?
–আমার? একদিন ওই আমার সব ছিল।
–আপনার স্ত্রী নিশ্চয়ই?
–হ্যাঁ। আমাকে ভালবাসতো প্রাণ দিয়ে। তাকে নিয়ে আমি শান্তিতে ছিলাম।
–তারপর?
-তারপর–দ্বিধাহীন কণ্ঠে ডগলাস বললেন, আজ আর তোমাকে লুকিয়ে লাভ নেই ভেরা, সবই স্বীকার করছি, রিচমণ্ডকে আমিই পাঠিয়েছিলাম মৃত্যুর মুখে। তাকে আমি যুদ্ধে পাঠিয়েছিলাম, কাজেই সেদিক থেকে বিচার করলে তার মৃত্যুর কারণ আমিই। কিন্তু–..
কিন্তু কি?
–লেসলি এসব কিছুই জানত না। মনে যন্ত্রণা থাকলেও একদিনের জন্যও তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করিনি। কিন্তু তবু লেসলি দিন দিন কেমন শুকিয়ে যেতে লাগল। আমার কাছ থেকে যেন নিজেকে গুটিয়ে নিতে লাগল। তারপর একদিন সেই অবস্থাতেই আমাকে নিঃসঙ্গ করে চলে গেল।
দুজন অনেকক্ষণ কোন কথা বলতে পারল না। পরে ডগলাসই প্রথম কথা বললেন, বসে আছি এখন তার অপেক্ষায়–
–কিসের?
–জীবনের শেষ ডাক, ভেরা!
ভেরা অস্থিরভাবে বলে ওঠে, না, না, ওসব কথা আপনি ভাববেন না।
–আমি ঠিকই ভাবছি ভেরা। আমি ভাল করেই বুঝতে পারছি, এই দ্বীপ থেকে কেউই কোনদিন বাইরে যেতে পারব না। এখানেই চিরবিদায় নিতে হবে। ওহো, ভারাক্রান্ত হৃদয়ের বোঝা বড় ভয়ঙ্কর। এর থেকে নিষ্কৃতি চাই। লেসলি-লেসলি
বলতে বলতে ডগলাস আবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। ভেরার কেমন ভয় করতে লাগল। সে কোন কথা না বলে পা টিপে টিপে সেখান থেকে সরে এলো।
.
কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্লোর দড়ি নিয়ে ফিরে এলো। এসে দেখে ডাক্তার পাহাড়ের নিচের দিকে তাকিয়ে কি ভাবছেন। সে জিজ্ঞেস করল, লমবার্ড কোথায়?
–অ্যাঁ, লমবার্ড? আছে এদিকে কোথাও নিশ্চই। আমি অন্য একটা কথা ভাবছিলাম ব্লোর।
–কি কথা?
–আমরা তো আওয়েনকে খুঁজছি, তাই না? কিন্তু ডগলাস লোকটিকে তোমার কেমন মনে হয়?
এমনিতে তো সন্দেহজনক কিছু মনে হয়নি। তবে তিনি যেন কি একটা আন্দাজ করছেন, সেটা জানা দরকার।
এমনি সময় লমবার্ড এসে গেল। সে দড়িটা পরীক্ষা করে দেখে নিল। তারপর একটা প্রান্ত নিজের কোমরের সঙ্গে বেঁধে নিল।