ভেরা অদ্ভুত দৃষ্টিতে এমিলির মুখের দিকে তাকায়। তার মনে হয় সেই মুখ বড় নিষ্ঠুর ভয়ঙ্কর।
বারান্দায় বসে আছেন বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ। খানিকটা দূরে নিচু গলায় কথা বলছেন লমবার্ড আর ব্লোর। ডাক্তার বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন।
একবার বৃদ্ধ বিচারপতির দিকে তাকালেন। মনে মনে তিনি কি যাচাই করলেন। ভদ্রলোক অভিজ্ঞ বিচক্ষণ সন্দেহ নেই কিন্তু অশক্ত। তার চাই বলিষ্ঠ কর্মপটু লোক। মনে মনে আরো একবার হিসেব করলেন ডাক্তার। লমবার্ডদের দিকেই তিনি এগিয়ে গেলেন। বললেন, লমবার্ড, তোমার সঙ্গে একটু পরামর্শ ছিল।
–আমার সঙ্গে? অবাক হয়ে তাকায় লমবার্ড।
–হ্যাঁ, একটু অন্য ব্যাপার
–বলুন কি বলবেন।
পরিস্থিতিটা তোমার জটিল মনে হচ্ছে কি না বলতো?
–খুবই জটিল এবং রহস্যময়।
–রজার্সদের সম্পর্কে ব্লোর যে কথাটা বলল, তোমার সত্যি বলে মনে হয়?
লমবার্ড বলে, আমার তো মনে হয়, ঠিকই বলেছে। ভদ্রমহিলাকে বিষপ্রয়োগ করা হয়ে থাকতে পারে।
ডাক্তার অন্তরঙ্গ সুরে বললেন, তার চাইতেও সহজে ব্যাপার ঘটতে পারে। আমার অভিজ্ঞতা থেকে যা বুঝতে পারছি তাই বলেছি তোমাকে–
কিভাবে বলতে চাইছেন আপনি?
–ওই ভদ্রমহিলার হার্টের অসুখ ছিল। অসুস্থ বোধ করলেই এক ধরণের ক্যাপসুল খেতেন। তাই সব সময় ওটা হাতের কাছে রাখতে হত।
লমবার্ড উত্তেজিতভাবে বলল, আপনি কি বলতে চাইছেন বুঝতে পারছি। ভদ্রমহিলা যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন সেই সময় সেই ক্যাপসুল না দিয়ে ডাক্তার আনতে ছুটেছিল রজার্স, তাই তো?
বলতে বলতে লমবার্ড চুপ করে গেল। একমিনিট কি চিন্তা করল। পরে বলল, এবারে আমার কাছে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেল।
–কি ব্যাপার?
–অনেক ঘটনাই আছে যার বিচার আইনের চোখ এড়িয়ে যায়। অপরাধী সাজা পায় না। রজার্সের অপরাধটি যেমন। অবশ্য এ তালিকায় স্বয়ং বিচারপতিও বাদ যাবেন না।
–তুমি বিশ্বাস করো ওকথা?
-হ্যাঁ, করি। ওয়ারগ্রেভ খুন করেছেন এডওয়ার্ড সেটনকে। অথচ তা করেছেন সম্পূর্ণভাবে আইনের আশ্রয় নিয়ে বিচারকের আসনে বসে।
সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের নিজের কথাও মনে পড়ে যায়। অপারেশন টেবিলে হত্যার কথা কারুর জানবার কথা নয়।
লমবার্ড বলে চলে, সেই কারণেই এই পান্না দ্বীপ, আওয়েন এসব কিছু আমাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে। আমরা এমন এক জেলখানায় বন্দি, যেখান থেকে পালাবার পথ বন্ধ।
ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গে কথাটা ঘুরিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে বলেন, রজার্সের মৃত্যুর ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের একটু তলিয়ে চিন্তা করা দরকার। আমার ধারণা, তার মৃত্যুর পেছনে দুটো কারণ রয়েছে। এক হল, সে গোপন কথা ফাঁস করে দিতে পারে এই আশঙ্কা, দ্বিতীয়, সে নার্ভাস হয়ে আত্মহত্যা করেছে।
–আত্মহত্যা? তা মনে করা যেতে পারে অবশ্য। আবার ওদিকে মার্সটনের ঘটনাও–কিন্তু মাত্র বারো ঘন্টার ব্যবধানে দু-দুটো আত্মহত্যার ঘটনা, কেমন অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে না? আমি–
-হ্যাঁ, বল, চুপ করলে কেন? ডাক্তার উৎসুক হলেন।
–আমার মনে হয় মার্সটনের মৃত্যু আত্মহত্যা নয়। ডাক্তার চিন্তিতভাবে মাথা নেড়ে সায় দেন, কথাটা অযৌক্তিকও নয়। ওর গ্লাসেই কেবল সায়ানাইড গেল কি করে? আরও তো গ্লাস ছিল–
লমবার্ড হেসে বলল, হয় সে সায়ানাইড নিজে এনেছিল, নয়তো
নয়তো কি? ডাক্তার তাকান লমবার্ডের দিকে।
–বুঝতেই তো পারছেন ভাল করে। তবু আমার মুখে যখন শুনতে চাইছেন বলছি–মার্সটনকে হত্যা করা হয়েছে।
–তাহলে রজার্সের স্ত্রীর ব্যাপারটা কি বলবে, তুমি? ডাক্তার জানতে চান।
কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে লমবার্ড বলে, আসলে দুটো মৃত্যুর মধ্যে সূক্ষ্ম যোগসূত্র আছে বলে আমার ধারণা।
ডাক্তার বললেন, তোমার কথায়, একটা ব্যাপার আমার মনে পড়ে গেল।
এরপরে তিনি খাওয়ার ঘরের টেবিল থেকে দুটো পুতুল নিখোঁজ হওয়ার কথাটা জানালেন।
শুনে লমবার্ডের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। কিছু সময় কি চিন্তা করল। তারপর বলল, আওয়েন লোকটা বিপজ্জনক। সবই তার কীর্তি। দুটো লোক মারা গেল আর অমনি দুটো পুতুল অদৃশ্য–ওই লোক ছাড়া এ কাণ্ড কে করবে।
ডাক্তার বললেন, কিন্তু রজার্স তো বলল এই দ্বীপে আমরা ছাড়া অন্য কোন লোক নেই।
লমবার্ড বলল, রজার্স হয় মিথ্যে বলছে, নয় সে ভুল করছে।
ডাক্তার বললেন, ভয় পেয়ে মিথ্যা বলা অসম্ভব নয়।
–এদিকে দেখুন, অন্যদিন মোটরবোট সকালেই আসে, আর আজ তার কোন পাত্তা নেই। সবই আওয়েনের ষড়যন্ত্র। তবে–
ডাক্তারের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল এই কথা শুনে। কোনরকমে বললেন, তবে কি?
–দ্বীপটা ছোট আর জনমানবহীন। আওয়েনকে খুঁজে বার করা কষ্টকর ব্যাপার নয়। তাই করতে হবে আমাদের।
–কিন্তু লোকটা তো একটা খুনে। যদি–
–কোনো যদি নেই। ওটা একটা শেয়াল। একবার আমার সামনে পড়লেই সে বুঝতে পারবে।
এরপর সে বলে, চলুন ডাক্তার, একটা কাজ করা যাক। ব্লোর লোকটি ভালো, তাকে সঙ্গে নিয়ে দ্বীপটা খুঁজে দেখা যাক।
মেয়েদের এসব ব্যাপারে দরকার নেই। জেনারেল আর ওয়ারগ্রেভ তো ভয়েই জড়োসড়ো হয়ে পড়েছে। কাজটা আমরা তিনজনেই করতে পারব।
.
০৮.
দ্বীপটা তন্নতন্ন করে খুঁজতে হবে। ব্লোর সহজেই রাজি হয়ে গেল। কেবল বলল, এই সময় একটা রিভলভার সঙ্গে থাকলে ভাল হতো।
লমবার্ড প্যান্টের পকেটের ওপর চাপ দিয়ে দেখিয়ে বলল, আমার কাছে একটা আছে।