ওদের চমকে দিয়ে ডগলাস এসে পাশে দাঁড়াল।–মজাটা ওখানেই। আমরা অধীর হয়ে অপেক্ষা করতে থাকব, দ্বীপ ছেড়ে কেউ যেতে পারব না। বুঝতে পারছ না এখনো–এই দ্বীপই আমাদের চিরশান্তিলাভের স্থান।
কথা শেষ করেই ডগলাস বারান্দা ছেড়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন, তারপর সমুদ্রের দিকে।
ওদের দুজনের মনে হল জেনারেল যেন উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। আগের সেই ফৌজি মেজাজটা আর নেই।
ডঃ আরমস্ট্রং বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। তার চোখে পড়ল বাঁ দিকে নিচু গলায় কথা বলছে ব্লোর আর লমবার্ড। আর ডানদিকে অস্থিরভারে পায়চারি করছে ওয়ারগ্রেভ। তাকে খুবই চিন্তিত দেখাচ্ছে।
ডাক্তার একমুহূর্ত দ্বিধা করে বিচারপতির দিকে এগিয়ে গেলেন।
এমনি সময় রজার্স ছুটে এল ডাক্তারের কাছে। বলল, স্যার, একটা কথা বলার ছিল।
রজার্সের মুখ ফ্যাকাশে। হাত দুটো কাঁপছে থরথর করে। ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন, কি হল রজার্স, এত ভয় পাচ্ছ কেন?
রজার্স ডাক্তারকে বসার ঘরে নিয়ে এল। তার চোখে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। ঘন ঘন সেঁক গিলছে। কোনরকমে হাত তুলে ইঙ্গিত করে বলল, স্যার, ওই পুতুলগুলো।
ডাক্তার তাকালেন সেদিকে,–হা, কি হয়েছে পুতুলগুলো?
–ওখানে দশটা পুতুল ছিল
–হ্যাঁ, সে তো আমরা সকলেই দেখেছি।
–কাল রাতে খাওয়ার পরে ঘর পরিষ্কার করতে এসে হঠাৎ চোখ পড়তে দেখি–দশটা নয়–নয়টা পুতুল রয়েছে।
–তারপর, কিছু হয়েছে?
–হ্যাঁ, সে তা আমরা সকলেই দেখেছি?
–হ্যাঁ, স্যার। এখন কটা আছে দেখুন–আটটা–
ডাক্তার পুতুলগুলোর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, আটটা–দুজন মারা গেছে, সঙ্গে সঙ্গে দুটো পুতুল কমে গেল–কিন্তু কে সরালো? আমাদের মধ্যে কি কেউ? নাকি সেই অদৃশ্য লোকটা?
.
০৭.
প্রাতরাশের পর এমিলি আর ভেরা বেড়াতে বেরুলো। তারা সেই টিলাটার ওপরে গিয়ে উঠল।
মৃদু বাতাসে সমুদ্রে ঢেউগুলো চঞ্চল হয়ে উঠেছে। কোনদিকে একটাও জেলেডিঙি দেখা যাচ্ছে না। মোটরবোটের তো কোনো চিহ্নই নেই।
এমিলি বলল, বোট নিয়ে যদি লোকটা না আসে তাহলে কি হবে বলতো?
ভেরা খেলাধূলা করা মেয়ে। অত সহজে সে ভয় পায় না। তবু এখন সে বলল, এখানে একদম ভালো লাগছে না।
–এখানে কারুরই ভাল লাগবার কথা নয়, ভেরা।
টিলার ওপরে পাশাপাশি বসে আছে ওরা। দৃষ্টি সামনের সমুদ্রের দিকে। যদি মোটরবোটটা চোখে পড়ে।
ভেরা হঠাৎ বলল, প্রাতঃরাশের সময় যে আপনি বললেন, রজার্স আর তার স্ত্রী সেই বৃদ্ধা ভদ্রমহিলাকে মেরে ফেলেছে, একথা কি আপনি বিশ্বাস করেন?
সমুদ্রের দিকে চোখ রেখেই এমিলি ধীরে ধীরে জবাব দেয়, হ্যাঁ, আমি বিশ্বাস করি। তা না হলে, কথাটা শুনেই রজার্স নার্ভাস হয়ে পড়বে কেন? তার স্ত্রীও অজ্ঞান হয়ে গেল। এ থেকেই ব্যাপারটা পরিষ্কার বোঝা যায়–ওরা এই মহাপাপ করেছে।
ভেরা বলল, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন, রজার্সের স্ত্রীর মুখে আতঙ্কের চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু অন্যদের সম্পর্কে কি বলবেন আপনি?
–তোমার কি মতামত?
–অভিযোগ তো সকলের নামেই একটা করে শোনা গেল। সকলেই সেটাকে উড়িয়ে : দিচ্ছে। কিন্তু আপনি কেবল রজার্সদের বেলায় বলছেন ওরা মহাপাপ করেছে।
এমিলি বললেন, তুমি কি বলতে চাইছ বুঝতে পেরেছি। কতগুলো অভিযোগ ভিত্তিহীন হলেও কয়েকটি আবার নির্ভুল।
যেমন ধরো, লমবার্ডের ব্যাপারটা। বিপদেই মানুষ মানুষের বন্ধু হয়। তার গায়ের রং কি, কোন দেশের লোক, এসব বিবেচনায় আসে না। অথচ কুড়িটা লোককে বিপন্ন অবস্থায় ফেলে রেখে সে পালিয়ে এসেছিল।
আবার দেখ, মিঃ ওয়ারগ্রেভ, তিনি তাঁর পবিত্র কর্তব্য পালন করেছেন। সেটা অপরাধ হতে যাবে কেন?
ব্লোরের সম্পর্কেও একই কথা খাটে। তিনি এককালে পুলিসের অফিসার ছিলেন। আমার নিজের ব্যাপারও তাই।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে তিনি সংযতকণ্ঠে বললেন, সব কথা পুরুষদের সামনে বলা যায় না। তাই কাল আমি কিছু বলতে চাইনি। তোমাকে আজ বলছি শোন।
ভেরা বিস্মিত হয়ে এমিলির দিকে তাকায়। বলে, বলুন।
–আমার বাড়িতে একটি মেয়ে কাজ করত। তার নাম ছিল বিয়াত্রিচে স্টেলার। কাজকর্ম বেশ ভালোই করত, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কিন্তু সাজপোশাক পরতে খুব ভালবাসতো।
পরে জানতে পেরেছিলাম, মেয়েটির স্বভাবচরিত্র ভালো নয়। বিয়ের আগেই সে একজনকে সব বিলিয়ে দিয়েছিল। ছেলেটি নাকি কোন বড় ঘরের।
ওই কাণ্ড ঘটার পর ছেলেটি মেয়েটিকে এড়িয়ে যেতে চাইলো। পরে বড় ঘরেরই অপর একটি মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে যায়।
বিয়াত্রিচে ততদিনে মা হতে বসেছে। জানতে পেরে সেই পাপিষ্ঠাকে আর বাড়িতে ঢুকতে দিইনি–দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম।
পাপ কখনো কাউকে রেহাই দেয় না ভেরা। তাকেও দেয়নি। কদিন পরেই সে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে।
হতভাগী, নিজের বুড়ো বাবামায়ের কথাও একবার ভাবল না।
ভেরা বলল, মেয়েটিকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেন কিংবা তার যে অমন শোচনীয় পরিণতি হল, এসবের জন্য আপনার কোন দুঃখ বা অনুশোচনা হয়নি? কখনো আপনার মনে হয়নি যে মেয়েটির মৃত্যুর জন্য আপনিই দায়ী?
-ওসব কী বলছ? এমিলি স্পষ্ট জবাব দেন, আমার কেন অনুশোচনা বা দুঃখ হতে যাবে? আমি তো কোন অন্যায় করিনি। পাপকে কি ঘরে রেখে পুষবো?
একটু থেমে এমিলি ফের বলতে লাগলেন, সে তার পাপের ফল ভোগ করছে। আমি পাপকে প্রশ্রয় দিতে যাব কেন? এমন শিক্ষা কখনো পাইনি।