এর থেকেই বোঝা যায়, আমার বিচারের কোন ত্রুটি ছিলো না, আমি কোনো অন্যায় করিনি। বিচারক হিসেবে আমি শাস্তিই দিয়েছি। এখানে এসে থামলেন বিচারপতি ওয়ারগ্রেভ নতুন করে একটা সিগার ধরালেন অতঃপর।
এক এক করে পুরো ঘটনাটাই মনে পড়ে গেলো আর্মস্ট্রংয়ের। এক সময়, তার মনে পড়ছে সিট-মামলা দারুণ একটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল জনমানসে। সবাই ধরে নিয়েছিলো বেকসুর খালাস পেয়ে যাবে সিটন। সিটনের উকিল ম্যাথিউ তো ধরেই নিয়েছিলেন, তার মক্কেল বেঁচে যাচ্ছে এ-যাত্রায়। কিন্তু রায় বেরোবার পর সবাই কম অবাক হয়নি। পরে দেখা হতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ম্যাথিউ বলেছিলেন, সিটনের ভাগ্যটাই খারাপ। শুরু থেকেই ওর প্রতি মন বিরুপ করে তোলেন বিচারপতি। অবশ্য এ সব কিছুই বেআইনী নয়, অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ তিনি, আইনের কোনো ভুলচুক করেননি তিনি। তবু সব দিক বিবেচনা করে দেখলে মনে হবে এই মামলার একেবারে শুরু থেকেই সম্পূর্ণ এক ভিন্ন নিরীখে সিটনের তথাকথিত অপরাধের বিচার করতে চেয়েছিলেন তিনি।
এতদিন এই প্রশ্নটা তাকে অহরহ তাগিদ দিয়েছে, কিন্তু প্রকাশ করতে পারেননি, তবে আজ হঠাৎই সেই প্রশ্নটা তার মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো, একটা প্রশ্ন করবো মিঃ ওয়ারগ্রেভ যদি কিছু মনে না করেন। আপনি কি সিটনের এই মামলা শুরু হওয়ার আগে থেকেই চিনতেন?
আচমকা প্রশ্নে বিব্রত ওয়ারগ্রেভ অন্যদিকে মুখ করে জবাব দিলেন না, এই মামলায় তাকে আমি প্রথম দেখি আদালতেই।
স্রেফ মিথ্যে বলছেন বৃদ্ধ বিচারপতি মনে মনে ক্ষেপে উঠলো আর্মস্ট্রং জীবনের প্রায় পুরো অধ্যায় কাটিয়ে এসেও মিথ্যের আশ্রয় নেওয়ার লোভটা সামলাতে পারলো না বৃদ্ধ লোকটি। এই বয়সেও মানুষকে ধোঁকা দিতে বাঁধলো না তার। হ্যাঁ চিৎকার করে আমি বলবো, অবশ্যই তিনি চিনতেন সিটনকে এবং মামলা শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই।
এবার ভেরার পালা। ভয়ে কি না কে জানে, অসম্ভব ঘামছিলো সে। রুমালে মুখ মুছে সে আবার তাকালো চোখ তুলে। কথা বলতে গিয়ে তার কণ্ঠস্বর বুঝি বা একটু কেঁপে উঠলো আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আপনারা গুনলেন একটু আগে, সে ব্যাপারে আমার কিছু বলার আছে। আমি ছিলাম সিরিল হ্যাঁমিলটনের গভর্নের্স। ভাল সাঁতার জানতো না সে। তাই খুব বেশীদূরে বড় একটা যেতো না সে। কিন্তু সেদিন কি যে হলো তার হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে কখন যে সে পার থেকে অনেকখানি দূরে চলে গিয়েছিল খেয়ালই করিনি। হঠাত তার আর্ত চিৎকার শুনে তাকালাম। ভেসে উঠল চোখের সামনে ডুবে যাওয়া তার শরীরটা। গভীর জলে সে কি আকুলি-বিকুলি। ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে উঠে দিলাম ঝাঁপ জলে, সাঁতার কেটে এগোলাম খানিকটা। কিন্তু অনেক দেরী হয়ে গেছে তখন। আমার চোখের সামনে দেখলাম সিরিলকে গভীর জলে তলিয়ে যেতে। আমি তো তাকে বাঁচানোর জন্যে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করিনি। আপনারাই বলুন তার অকাল মৃত্যুর জন্য সত্যি কি আমি দোষী?
ভেরা আবার বলে চলে, তা করোনারের বিচারে আমার কোনো দোষ দেখতে পাওয়া গেল না। সিরিলের মা হ্যামিল্টনও যথেষ্ট উদারতার পরিচয় দিলেন, আমার ওপর দোষারোপ করার কথা ভাবতেই পারলেন না তিনি। আর ভাববেনই বা কি করে, সত্যি সত্যি আমি তো কোনো দোষ করিনি। অথচ এখানে এসে কি ভয়ঙ্কর কথাটাই না শুনতে হলো, সেই পুরনো ঘটনার জের টেনে সিরিলের মৃত্যুর ব্যাপারে আমার উপর একটা মিথ্যে দোষ চাপিয়ে দেওয়া হলো। এ যে কত বড় অন্যায় অবিচার-চাপা কান্নায় তার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এলো।
জেনারেল ম্যাকআর্থার তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বোঝালেন, কেঁদো না। পাগলে কি না বলে ছাগলে কি না খায়। কথাটা তোমার মনে আছে তো? অতএব ঐ ঘেঁদো কথা নিয়ে তুমি আর অহেতুক উত্তেজিত হয়ো না যেন। তারপরেই আচমকা নিজের প্রসঙ্গে বলতে শুরু করে দিলেন তিনি। দেখুন, অন্য সময় হলে ব্যাপারটা আমি উড়িয়ে দিতাম, কোনো গুরুত্বই দিতাম না, কিন্তু আজকের এমন জটিল পরিস্থিতির মধ্যে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের জবাব না দিয়ে থাকতে পারছি না। কিন্তু আগে এক অদৃশ্য অভিযোগকারী যে আর্থার রিচমণ্ডের নাম উল্লেখ করলেন, চাকরী ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আমারই অধীনস্থ একজন অফিসার। আমি তাকে একদিন যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থা নিজের চোখে দেখে এসে আমাকে রিপোর্ট করতে বলি। কিন্তু তার ফেরা আর হলো না যুদ্ধক্ষেত্র থেকে না ফেরার দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। তার জন্যে আমি তো আর অপরাধী হতে পারি না। আর আমার স্ত্রীর স্বপক্ষে একটা কথাই কেবল বলবো তার মতো সৎ কর্তব্যপরায়ণ স্ত্রী অনেক স্বামীর কাছে দুর্লভ। এই পর্যন্ত বলে থামলেন তিনি, তার মুখের উত্তেজনায় রেশ কাটেনি তখনো।
আর আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো আমি নাকি অধিবাসীদের……..লম্বার্ডের ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠলো–
কেন কি হয়েছিল তাদের? মার্স্টান পারলো না তার কৌতূহল চেপে রাখতে।
আরে তেমন কিছুই নয়। লম্বার্ডের কথায় অবজ্ঞার সুর ধ্বনিত হলো। আসলে আত্মরক্ষার তাগিদ আর কি। শিকারে গিয়েছিলাম দলবল নিয়ে। এক সময় পথ হারিয়ে ফেললাম জঙ্গলে। তখন কি আর করা যায়? খাবার-দাবার যা অবশিষ্ট ছিলো সঙ্গে নিয়ে আমরা কয়েকজন ফিরে এলাম। ওরা রয়ে গেল।