- বইয়ের নামঃ কাকাতুয়া রহস্য
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ রহস্যময় গল্প, অ্যাডভেঞ্চার, রোমাঞ্চকর গল্প, কল্পকাহিনী, গোয়েন্দা কাহিনী
কাকাতুয়া রহস্য
১
বাঁচাও! তীক্ষ্ণ চিৎকার। বাঁচাও! খানখান হয়ে গেল নীরবতা।
পুরানো ভাঙা বাড়িটার ভেতর থেকে আসছে আর্তনাদ। শিরশিরে ঠাণ্ডা যোত যেন বয়ে গেল সহকারী গোয়েন্দা মুসা আমানের মেরুদণ্ড বেয়ে।
আবার শোনা গেল চিৎকার। শেষ হলো চাপা ঘড়ঘড় করে। শব্দের ভয়াবহতা বাড়িয়ে দিল আরও।
একটা ব্যারেল পামের গোড়ায় হুমড়ি খেয়ে আছে মুসা, চোখ খোয়া-বিছানো আঁকাঝকা পথের দিকে। কেউ আসছে কিনা দেখছে।
চিৎকার শুনে মুসার মতই পথের অন্য ধারের একটা ঝোপে গিয়ে লুকিয়েছে গোয়েন্দাপ্রধান কিশোর পাশা। চেয়ে আছে বাড়ির দিকে।
অপেক্ষা করছে দুজনেই।
স্প্যানিশ ধাঁচের একটা অনেক পুরানো বিলডিং। অযত্নে বেড়ে পুরানো গাছপালা আর লতার ঘন জঙ্গলে ঘিরে রেখেছে বাড়িটাকে।
আর শোনা গেল না চিৎকার। কিশোর, ফিসফিস করে বলল মুসা। পুরুষ না মহিলা? জানি না, ফিসফিসিয়েই জবাব এল। তবে কোনটার মতই তো লাগল না।
কোনটাই না? ঢোক গিলল মুসা। শিশুও নয়। তাহলে আর একটা সম্ভাবনাই থাকে, যেটা ভাবতেও ভয় পাচ্ছে সে।
আড়াল থেকে বেরোল না ওরা। গরমে ঘামছে দরদর করে। রকি বীচের চেয়ে গরম কি বেশি নাকি হলিউডে?
চারপাশে তাল জাতীয় গাছের ছড়াছড়ি, ঘন ঝোপঝাড়, লতা, আর নানা রকম ফুলগাছ। চমৎকার একটা বাগান ছিল এককালে। কিন্তু অযত্নে অবহেলায় এখন জঙ্গল হয়ে গেছে। ওপাশের বাড়িটাও ঠিকমত চোখে পড়ে না।
এক সময়ের বিখ্যাত অভিনেতা মিস্টার মরিসন ফোর্ডের বাড়ি, চিত্রপরিচালক ডেভিস ক্রিস্টোফারের বন্ধু। প্রিয় কাকাতুয়াটা হারিয়ে খুব মনোকষ্টে আছেন অভিনেতা, বন্ধুকে জানিয়েছেন। পরিচালকই তিন গোয়েন্দাকে অনুরোধ করেছেন ব্যাপারটা একটু তদন্ত করে দেখতে। সেজন্যেই এসেছে কিশোর আর মুসা। গেটের ভেতরে ঢুকেই শুনেছে চিৎকার, লুকিয়ে পড়েছে। কি ঘটে, দেখার অপেক্ষায় রয়েছে।
কিশোর, নিচু স্বরে বলল মুসা, খুঁজতে এলাম কাকাতুয়া। এ-যে দেখছি ভূত! ভূতুড়ে বাড়িতে ঢুকলাম না তো, টেরর ক্যাসলের মত? তিন গোয়েন্দার প্রথম রোমাঞ্চকর অভিযানের কথা মনে করল সে।
খুব আশাব্যঞ্জক, বিশেষ বিশেষ সময়ে কঠিন শব্দ ব্যবহার আর দুর্বোধ করে কথা বলা কিশোরের স্বভাব। আরেকটা কেস বোধহয় পেলাম। চলো, এগোই। কি হয়েছে দেখা দরকার।
ভূতেরা খেলায় মেতেছে। বাজি রেখে বলতে পারি, গিয়ে একটা দরজাও খোলা পাব না, সব তালা বন্ধ। আমাদেরকে দেখলেই ঝটকা দিয়ে দিয়ে খুলে যাবে…
চমৎকার বর্ণনা! বাধা দিয়ে বলল কিশোর। মনে রেখো। ঠিক এভা, গিয়ে বলো রবিনকে, নোট করে নেবে…
দেখো কিশোর, রসিকতার সময় নয় এটা…
কিন্তু মুসার কথায় কান নেই কিশোরের। ঝোপের ভেতর থেকে বেরিয়ে গাছের আড়ালে আড়ালে নিঃশব্দে এগোতে শুরু করেছে বাড়ির দিকে।
মুসাও উঠে দাঁড়াল। পথের অন্য ধারে গাছের আড়ালে থেকে এগোল সে-ও।
বাড়িটা শ-খানেক ফুট দূরে থাকতেই কিসে যেন মুসার পা জড়িয়ে ধরল। টান দিয়ে গোড়ালি ছাড়ানোর চেষ্টা করল সে, বাধন আরও শক্ত হলো। হ্যাচকা টানে পা ছুটিয়ে নেয়ার জন্যে সামনে লাফ দিল। পাল্টা টান দিয়ে ফেলে দেয়া হলো তাকে মাটিতে, কিসে ধরেছে দেখতে পাচ্ছে না ঘন পাতার জন্যে।
কিশোর! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। বাঁচাও আমাকে মেরে ফেলল।
ঝোপঝাড় ভেঙে ছুটে এল কিশোর।
দেখো, কিসে জানি টানছে, কোলা ব্যাঙ ঢুকেছে যেন মুসার গলায়, চোখ ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। টেনে নিয়ে যাচ্ছে গর্তে। অজগর…না না, অ্যানাকোণ্ডা।
ভাবান্তর নেই কিশোরের চেহারায়। শান্তকণ্ঠে বলল, তোমার জন্যে দুঃখ হচ্ছে আমার, মুসা। ভয়ঙ্কর ভিটিস ভিনিফেরায় ধরেছে তোমাকে।
খাইছে! আল্লারে, মরে গেলাম! কিশোর, দোহাই তোমার, ভিটিস বি জানি…বাঁচাও…।
আট ফলার প্রিয় ছুরিটা বের করল কিশোর। ধীরে সুস্থে বসে পেঁচিয়ে কাটতে শুরু করল ভিটিস ভিনিফেরাকে।
টান মুক্ত হতেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল মুসা। কিসে ধরেছিল, তাকাল।
নীরব হাসিতে ফেটে পড়ছে কিশোর। ছুরিটা আবার ভাঁজ করে বেল্টে ঝুলিয়ে রাখছে।
ফিক করে হেসে ফেলল মুসা। প্লীজ, কিশোর, রবিনকে বোললা না।
পা ফেলেছিলে লতার ফাঁদে, ভেবেছ সাপ। ওই ভূতের ভয়ই তোমার মনকে . ভারাক্রান্ত করে রেখেছিল, মুসা, উপদেশ দিতে শুরু করল কিশোর। এভাবেই ভয় পেয়ে মরে দুর্বল হৃৎপিণ্ডের লোক, বোকারা ভাবে ভূতে মেরেছে। ভয় আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল তোমার মনকে, ফলে বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়েছিল, বুঝতে পারোনি ওটা সাপ না লতা।
কিশোরের এ ধরনের লেকচারে এখন আর কিছু মনে করে না মুসা, অভ্যস্ত হয়ে গেছে। বলল, ঠিকই বলেছ, ওই চিৎকারই…
সেজন্যেই বিপদে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয়। আতঙ্ক বিপদকে আরও বাড়িয়ে দেয়। সেকারণেই মনীষীরা বলেছেন বলেছেন…।
মনীষীরা যেন ভয় পেতেই বলেছেন কিশোরকে, বড় বড় হয়ে যাচ্ছে চোখ। ধীরে ধীরে ঝুলে পড়ছে চোয়াল। চেহারা ফ্যাকাসে। দৃষ্টি মুসার পেছনে।
সত্যি খুব ভাল অভিনেতা তুমি, কিশোর, প্রশংসা করল মুসা। কেন যে টেলিভিশনে অভিনয় বাদ দিলে। গোয়েন্দাগিরির চেয়ে অনেক বেশি উন্নতি করতে পারতে। এভাবে ভয় পাওয়ার অভিনয়… হঠাৎ সন্দেহ হলো তার। ফিরে তাকাল। স্থির হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে।
অভিনয় করছে না গোয়েন্দাপ্রধান।
বিচ্ছিরি রকম মোটা এক লোক দাড়িয়ে আছে, হাতে ভীষণ চেহারার একটা পুরানো আমলের পিস্তল, পিলে চমকে দেয়। পুরু লেন্সের চশমার জন্যে চোখ দুটো অস্বাভাবিক বড় লাগছে, গোল গোল, যেন মাছের চোখ।
এসো, পিস্তল নাড়লো লোকটা, আগে ঘরে এসো। তারপর শুনব কেন ঢোকা হয়েছে।
মুখ শুকিয়ে গেছে মুসার, পা দুটো যেন দুই মণ ভারি। কোন মতে টেনে টেনে এসে উঠল খোয়া বিছানো পথে। খবরদার, পালানোর চেষ্টা কোরো না, হুশিয়ার করল লোকটা। তাহলে পস্তাবে।
যা বলছে, করো, মূসার কানের কাছে ফিসফিস করল কিশোর। দেখি কি হয়।
পাগলু, জবাব দিল মুসা। পালানোর চেষ্টা করব মরতে? হাঁটতেই তো পারছি না ঠিকমত।
আগে আগে চলেছে দুই গোয়েন্দা।
পেছনে মোটা লোকটার জুতোর মচমচ শব্দে শিরশির করছে মুসার গা, শুয়োপোকা দেখলে অনেকের যে অনুভূতি হয়।
বিশাল সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়াল ওরা, ওপরে টালির ছাউনি বেরিয়ে আছে সামনের দিকে।
দরজা খোলো, হুকুম করল লোকটা। জলদি করো। গুলি করার জন্যে আঙুল নিশপিশ করছে আমার।
নব ঘুরিয়ে ঠেলা দিল কিশোর। খুলে গেল দরজা। আবছা অন্ধকার একটা হলঘর।
ডানে ঘোরো, আবার বলল লোকটা। ওই যে, পাশের দরজাটা, খোলো।
আরেকটা বড় ঘরে ঢুকল ওরা। পুরানো আসবাবপত্র। খবরের কাগজ আর বইয়ে ঠাসা। উল্টো প্রান্তের দেয়াল ঘেঁষে সাজানো রয়েছে কয়েকটা বড় বড় চেয়ার, চামড়ায় মোড়া গদি।
যাও, বসো ওখানে।
যা বলা হলো, করল ওরা।
মুখখামুখি দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। মুখে সন্তুষ্টির হাসি। পিস্তলের নলের মুখে জোরে ফু দিল, যেন ভেতরে জমে থাকা বালি পরিষ্কার করছে। পথ সুগম করে দিচ্ছে বুলেটের।
এবার বলল, কি চুরি করতে এসেছ?
মিস্টার মরিসন ফোর্ডের কাছে… বলতে গিয়ে বাধা পেল কিশোর।
আমিই মরিসন ফোর্ড।
অ। আপনার কাছেই এসেছি…
কিন্তু এবারও কথা শেষ করতে দিল না ফোর্ড। নাকের একপাশ চুলকাল। আমার কাছে? তাহলে এভাবে লুকিয়ে কেন? চোরের মত?
কে যেন বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করল, বলে ফেলল মুসা। তাই লুকিয়ে পড়েছিলাম। ভাবলাম ভেতরে চোর-ডাকাত…কত কিছুই তো ঘটছে আজকাল। দিনে-দুপুরেও লোকের বাড়িতে ডাকাত পড়ে।
অ। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসল লোকটার। শুনেছ, না?
মিস্টার ফোর্ড, বুঝিয়ে বলল কিশোর, মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফার পাঠিয়েছেন আমাদের। আপনার নাকি একটা কাকাতুয়া হারানো গেছে, পুলিশ কিছু করতে পারছে না। সেটাই তদন্ত করতে এসেছি আমরা, পাখিটা খুঁজে বের করতে। পকেট থেকে কার্ড বের করে দিল সে। আমি কিশোর পাশা। ও আমার বন্ধু, মুসা আমান।
গোয়েন্দা, না? একনজর দেখেই কার্ডটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখল লোকটা। কাকাতুয়া খুঁজতে এসেছ। হাসল।
হাঁপ ছাড়ল মুসা। কিন্তু লোকটার পরের কথায়ই চুপসে গেল আবার।
তোমাদের কথা বিশ্বাস করতে তো ইচ্ছে করছে, চেহারা সুরতও ভালই, চোরের মত না। তোমরা ফিরে না গেলে খুব কান্নাকাটি করবে বাবা-মা, না?
খুব শান্ত ভাবে পকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটে লাগাল লোকটা। পিস্তলের নল প্রথমে ধরল কিশোরের বুক সোজা, তারপর ঘোরাল মুসার দিকে।
টিপে দিল ট্রিগার। চাপা একটা আওয়াজ হলো।
ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল মুসা, কিছুই ঘটল না দেখে মেলল আবার।
পিস্তলের নলের মাথায় জ্বলছে নীলচে আগুন। সেটা থেকে সিগারেট ধরিয়ে নিচ্ছে মিস্টার ফোর্ড। নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল ভকভক করে, ফুঁ দিয়ে আগুন নিভিয়ে পিস্তলটা রেখে দিল টেবিলে।
হায় হায়, ভাবল মুসা, এত ভয় পেলাম। ওই সিগারেট লাইটারটা দেখে? দূর, আমি একটা ভীতুর ডিম। রক্ত ফিরে এল আবার চেহারায়। নড়েচড়ে বসল।
চমৎকার, হাসি হাসি ভাব করে বলল লোকটা। পরীক্ষায় পাশ। নাকি আমার অভিনয় ভাল হয়নি?
আরেকটু হলেই হার্টফেল করতাম, বাড়িতে ঢোকার পর এই প্রথম হাসি ফুটল মুসার মুখে। হাত মেলা। লোকটার নরম তুলতুলে হাতের চাপ খুব শক্ত, দেখে মনে হয় না এরকম হবে।
কিশোরের সঙ্গেও হাত মেলাল লোকটা। এভাবে অভিনয় করে অনেক বয়স্ক লোককেও বেহুশ করে দিয়েছি। আর তোমরা ছেলেমানুষ…ভাল গোয়েন্দাই পাঠিয়েছে ডেভিস। ও-ই বলেছিল, তোমাদের একটা টেস্ট নিতে।
মানে ইয়ে… বিশ্বাস করতে পারছে না যেন কিশোর, মিস্টার ক্রিস্টোফার বলেছেন আমাদের সাহসের পরীক্ষা নিতে!
হ্যাঁ, এই তো, একটু আগে ফোন করল। তবে তোমরা ভালই উৎরেছ। জানাব ডেভিসকে। আর হ্যাঁ, তোমাদের কিছু তদন্ত করতে হবে না, সরি।
কিন্তু আপনিই নাকি মিস্টার ক্রিস্টোফারকে জানিয়েছেন কাকাতুয়া হারিয়েছে? মুসা অবাক।
হারিয়েছিল, মাথা ঝাকাল লোকটা। তাকে জানিয়েও ছিলাম। কিন্তু ওটা যে ফিরে এসেছে, জানানো হয়নি আর। ডিয়ার বিলি, কি কষ্টটাই না দিয়েছে আমাকে।
বিলি? কিশোর জিজ্ঞেস করল, কাকাতুয়াটার নাম?
হ্যাঁ, বিলি শেকসপীয়ার, উইলিয়াম শেকসপীয়ারের…
কিন্তু বাঁচাও বাঁচাও বলে কে চেঁচাল? মুসা বলল, এ বাড়ি থেকেই…
খুব খুঁতখুঁতে তোমরা। গোয়েন্দাগিরির জন্যে ভাল। গলা ফাটিয়ে হাসল লোকটা, দুলে উঠল মস্ত ভুড়ি। ওটা বিলির কাণ্ড। নিজেকে অনেক বড় অভিনেতা ভাবে সে, মাঝেমাঝেই সেটা প্র্যাকটিস করে। আমিই শিখিয়েছিযেন হাজতে আটকে রাখা কয়েদী বিলি, তার ওপর নির্যাতন চলছে…হা-হা-হা।
বিলিকে দেখাবেন, প্লীজ? অনুরোধ করল কিশোর। খুব বুদ্ধিমান পাখি, দেখতে ইচ্ছে করছে।
সরি মেঘ জমল লোকটার চেহারায়। আজ বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিল বিলি। তাকে থামানোর জন্যে শেষে খাঁচার ওপর কাপড় দিয়ে ঢেকেছি। এখন
আবার তুললেই হয়তো চেঁচানো শুরু করবে। মাথাই খারাপ হয়ে গেল, না কী।
ঠিক আছে ঠিক আছে, থাক তাহলে, হাত তুলল কিশোর। তদন্ত করার আর তো কিছু নেই, হতাশ হয়েছে খুব। যাই আমরা, মিস্টার ফোর্ড। আপনার কাকাতুয়া ফিরে এসেছে, এটা অরিশ্যি খুশির খবর।
থ্যাংকু বলল মোটা লোকটা। তোমাদের কার্ড রইল। কখনও দরকার পড়লে ডাকব। তিন গোয়েন্দা, মনে থাকবে।
সদর দরজা পর্যন্ত ছেলেদের এগিয়ে দিয়ে গেল ফোর্ড।
খুব খারাপ লাগছে, আঁকাবাঁকা পথে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল কিশোর। আশা হয়েছিল, দারুণ একখান কেস মিলেছে। পোড়া নির্জন বাড়ি, আর্তনাদ, অদ্ভুত এক মোটা লোক…বড় বেশি আশা করে ফেলেছিলাম।
আমার ভালই লাগছে, খুশি দেখাচ্ছে মুসাকে। ঢুকেই যা শুরু হয়েছিল, সত্যি সত্যি হলে এ-যাত্রা ঠিক ভূতের হাতে মারা পড়তাম। দরকার পড়লে আবার ডাকবে বলেছে ফোর্ড। না ডাকুক, সেটাই ভাল। ওকে মোটেও পছন্দ হয়নি ডাকবে হেলে এ-যাত্রা ঠিক খুশি দেখাচ্ছে আশা করে ফেলে নির্জন বাড়ি আমার।
হয়তো, কিছু ভাবছে কিশোর। নীরবে এগোল দুজনে, আলগা খোয়ায় জুতোর শব্দ হচ্ছে। হলিউডের একটা পুরানো এলাকা এটা, বড় বড় বাড়ি আছে। কিন্তু প্রায় সব কটাই যত্নের অভাবে ধ্বংস হতে চলেছে। মালিকেরা অভাবী হয়ে পড়েছে অনেকেই, ঠিকমত যত্ন নিতে পারে না। কিংবা যাদের এখনও টাকা আছে, তারা আর পছন্দ করতে পারছে না এলাকাটা। অন্য জায়গায় নতুন বাড়ি করে উঠে গেছে।
গেটের বাইরে পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে কালো রোলস-রয়েস, জায়গায় জায়গায় সোনালি কাজ করা, আয়নার মত চকচকে শরীর, কিন্তু মডেলটা পুরানো। ইচ্ছে করেই বানানো হয়েছে। একবার বাজি জিতে গাড়িটা তিরিশ দিনের জন্যে ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছিল তিন গোয়েন্দা। এখনও দরকার পড়লে করে, তবে ভাড়া দিতে হয়। খরচ দেয় তাদের এক বন্ধু, অগাস্ট অগাস্ট, রক্তচক্ষু উদ্ধারে তাকে সহায়তা করেছিল তিন কিশোর।
বাড়ি চলুন, হ্যানসন, শোফারকে বলল কিশোর। কাকাতুয়াটা ফিরে এসেছে।
তাই নাকি? ভাল, বিশুদ্ধ ইংরেজিতে বলল হ্যানসন, খাঁটি ইংরেজ বলে গর্ব আছে তার। চলুন।
গাড়ি ঘোরাচ্ছে হ্যানসন।
মিস্টার ফোর্ডের বাগানের দিকে চিন্তিত ভঙ্গিতে চেয়ে আছে কিশোর। গাছের জঙ্গলের জন্যে বাড়িটা দেখা যায় না।
মুসা, হঠাৎ বলল সে, ভাল করে দেখো। কোথায় জানি একটা গোলমাল রয়েছে, ধরতে পারছি না।
কি? বাগানে?
বাগান, ড্রাইভওয়ে, পুরো বাড়িটাই। মাথার ভেতরে কিছু একটা খোঁচাচ্ছে, বের করে আনতে পারছি না।
হাসালে। কিশোর পাশা যেটা বুঝতে পারে না, সেটা আমি পারব?
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে শুরু করেছে কিশোর, মুসার কথা কানে ঢুকল বলে মনে হলো না। গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে।
হ্যানসনকে গাড়ি থামাতে বলে ভালমত দেখল মুসা। কিন্তু গোলমাল চোখে পড়ছে না। অযত্নে বেড়ে উঠেছে বাগান, মালির হাত না লাগলে উঠবেই, স্বাভাবিক ব্যাপার। ড্রাইভওয়েতে তালের পাতা জমে আছে, মাড়িয়ে গেছে গাড়ির চাকা। এতেও অস্বাভাবিক কিছু নেই।
নাহ্, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, মাথা নাড়ল মুসা। গাড়ি ছাড়তে বলল হ্যানসনকে।
কিশোরের কোন খেয়ালই নেই যেন।
গোটা দশেক রক পেরিয়েছে গাড়ি, আচমকা চেঁচিয়ে উঠল কিশোের। হ্যানসন! ঘোরান! গাড়ি ঘোরান! কুইক!
ঘোরাচ্ছি, কিশোরের স্বভাব হ্যানসনেরও জানা, কোন কারণ না থাকলে ঘোরাতে বলত না। তাই কোন প্রশ্ন করল না সে।
কিশোর, কি হয়েছে? আবার কেন?
গোলমালটা ধরে ফেলেছি, উত্তেজনায় লাল হয়ে গেছে গোয়েন্দাপ্রধানের মুখ। মিস্টার ফোর্ডের বাড়িতে টেলিফোন লাইন নেই।
লাইন নেই? তাতে কি?
কারেন্টের লাইন আছে, কিন্তু টেলিফোনের নেই। অথচ ফোনে কথা বলল কি করে মিস্টার ফোর্ড, মিস্টার ক্রিস্টোফারের সঙ্গে? মিথ্যে বলেছে। আর তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে আর যা যা বলেছে, সবই মিছে কথা।
মিছে কথা? মাথা নাড়ল মুসা। কেন বলবে?
কারণ লোকটা মিস্টার ফোর্ড নয়। ভণ্ড, প্রতারক। খুব সম্ভব আসল মিস্টার ফোর্ডই তখন বাঁচাও বাঁচাও বলে চেঁচিয়েছিলেন।
২
নয়টা ব্লক নিঃশব্দে পেরিয়ে এল বিশাল রোলস-রয়েস।
মিস্টার ফোর্ডের গেট দিয়ে ছোট আরেকটা গাড়ি বেরোচ্ছে, মোড় নিয়ে। এগিয়ে আসতে শুরু করল এদিকেই। গতি বাড়ছে, সঁ করে চলে গেল পাশ দিয়ে। পলকের জন্যে ড্রাইভারকে চোখে পড়ল। মোটাসোটা, চোখে চশমা। অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে।
মিস্টার ফোর্ড যাচ্ছেন, চেঁচিয়ে বলল মুসা।
ভুল, শুধরে দিল কিশোর, ও মিস্টার ফোর্ড নয়। হ্যানসন, পিছু নিন।
ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল শোফার। বন বন করে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে মুখ ফেরাল আবার গাড়ির।
মোড়ের কাছে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে কালো গাড়িটা।
ধরতে পারলে কি করব? প্রশ্ন করল মুসা। ওর বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ নেই। বরং আসল ফোর্ডের অবস্থা গিয়ে দেখা উচিত। সাহায্য লাগতে পারে।
দ্বিধা করছে কিশোর। মাথা ঝাকাল। ঠিকই বলেছ। আগে মিস্টার ফোর্ডকে দেখা দরকার, কি অবস্থায় রয়েছেন কে জানে। সরি, হ্যানসন, আবার ঘোরান।
এবার আর বাইরে নয়, কিশোরের নির্দেশে গেটের ভেতরে গাড়ি ঢোকাল হ্যানসন, গাড়িপথ ধরে এগোল।
সরু পথ, এতবড় গাড়ির উপযুক্ত নয়। দুপাশের ঝোপঝাড়ের পাতা, লতার ডগা আর পামের পাতা ঘষা খাচ্ছে গাড়ির গায়ে।
অবশেষে পুরানো বাড়ির গাড়িবারান্দায় এসে থামল গাড়ি, খানিকক্ষণ আগে এখানেই আরেকবার এসেছিল দুই গোয়েন্দা।
মুসা, শান্ত কণ্ঠে বলল কিশোর, যে গাড়িটা বেরিয়ে গেল, ওটার বিশেষ কিছু চোখে পড়েছে?
টু-ডোর, স্পোর্টস মডেল রেঞ্জার, খুব ভাল ইংলিশ কার, বলল মুসা। নতুন ক্যালিফোর্নিয়ার নাম্বার, পুরোটা বলতে পারব না, তবে শেষ দুটো নাম্বার ওয়ান থ্রী।
হ্যানসন, আপনি দেখেছেন নম্বরটা?
না। গাড়ি চালানোয় ব্যস্ত ছিলাম। নজর পথের ওপর। তবে রেঞ্জার ঠিকই। লাল চামড়ার গদি।
যাক, কিছু তথ্য জানা থাকল, বলল কিশোর। পরে মোটা লোকটা আর তার গাড়ি খুঁজে বের করব। দরজা খুলে নামল সে। এখন দেখি মিস্টার ফোর্ডের কি অবস্থা।
কিশোরকে অনুসরণ করল মুসা। বুঝতে পারছে না, কিভাবে পরে লোকটা আর তার গাড়ি খুঁজে বের করবে গোয়েন্দাপ্রধান, দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার লাখ লাখ গাড়ির ভেতর থেকে।
তবে বলেছে যখন, উপায় একটা করবেই কিশোর, তাতে কোন সন্দেহ নেই মুসার।
হঠাৎ থমকে গেল ওরা। বিষণ্ণ বাড়িটা থেকে আবার শোনা গেল সাহায্যের আবেদন, বাঁচাও!…শুনছ কেউ?…প্লীজ, আমাকে ছাড়াও…
জোর নেই তেমন গলায়। মারা যাচ্ছে নাকি? তাড়াতাড়ি বলল মূসা, চলো তো, দেখি।
পেছন দিক থেকে এসেছে আওয়াজ, ওদিকে ছুটল দুই গোয়েন্দা। একটা দরজা সামান্য ফাঁক হয়ে আছে, ওখান দিয়েই বোধহয় বেরিয়ে গেছে মোটা লোকটা, তাড়াহুড়োয় খেয়াল করেনি ভালমত লাগল কি-না।
ঢুকে পড়ল দুজনে। আবছা অন্ধকার। মিটমিট করে চোখে সইয়ে নিল স্বল্প আলো।
কান পেতে শুনছে। নীরব। কোথায় যেন পুরানো তক্তায় চাপ লাগার মৃদু খচখচ,আওয়াজ হলো।
ওই যে, ওই হলটায় ঢুকেছিলাম তখন, হাত তুলে দেখাল কিশোর। চলো, উল্টো দিকের ঘরটায় ঢুকি। ওই যে দরজা।
ঠেলা দিতেই খুলে গেল দরজাটা। বড় একটা লিভিং রুম। ঘুলঘুলি লাগানো মস্ত জানালা আছে একটা।
কে…কে ওখানে? দুর্বল কণ্ঠে বলে উঠল কেউ জানালাটার কাছ থেকে। জানালার নিচে বিশাল এক ফুলের টব, লাল একটা ফুল ফুটে আছে। মুসার মনে হলো, ফুলটাই যেন কথা বলেছে।
কেউ…কেউ এসেছ? গুঙিয়ে উঠল যেন ফুলটা।
টবের ছড়ানো পাতার ওপাশে একটা নড়াচড়া চোখে পড়ল মুসার। বড় বড় পাতাগুলো প্রায় ঢেকে রেখেছে শরীরটা।
ওই যে, চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
কাত হয়ে পড়ে আছে রোগা পাতলা একটা দেহ, হাত-পা বাঁধা।
বাঁধন খুলে মিস্টার ফোর্ডকে ধরে ধরে এনে একটা সোফায় বসিয়ে দিল মূসা আর কিশোর। ক্লান্তিতে এলিয়ে পড়লেন তিনি। ফিসফিস করে ধন্যবাদ দিলেন ছেলেদের।
একটা চেয়ার টেনে মুখোমুখি বসল কিশোর। পুলিশকে খবর দিচ্ছি।
না না,আঁতকে উঠলেন ফোর্ড। ফোনও নেই। খবর দেয়া যাবে না। আমাদের গাড়িতে ওয়্যারলেস টেলিফোন আছে।
না, গড়িয়ে পড়লেন তিনি, কনুইয়ে ভর দিয়ে আধশোয়া হয়ে তাকালেন কিশোরের দিকে। তুমি কে? এখানে এলে কিভাবে?
একটা কার্ড বের করে দিল কিশোর। মিস্টার ক্রিস্টোফার তাদেরকে পাঠিয়েছে, জানাল।
ডেভিসের কাছে আমি ঋণী হয়ে গেলাম।
সত্যি বলছেন পুলিশ ডাকব না? আপনাকে জোর করে বেঁধে ফেলে রেখে গেল, এটা অপরাধ
না। তোমরা গোয়েন্দা, তোমরাই আমার কাকাতুয়াটাকে খুঁজে দাও। পুলিশকে আর ডাকছি না আমি। জানিয়েছিলাম ওদের। প্রথমে বলল, হয়তো উড়ে চলে গেছে। আমি চাপাচাপি করায় শেষে বলল, পাবলিসিটির জন্যে নাকি আমি
এমন করছি।
হুঁ, বুঝলাম। এখন ডাকলে আবার বলবে, পাবলিসিটির নতুন ফন্দি করেছেন।
হ্যাঁ, বুঝেছ। তাহলে কোন পুলিশ নয়, কথা দাও?
কথা দিল কিশোর, পুলিশকে কিছু বলবে না। হারানো কাকাতুয়ার ব্যাপারে সব খুলে বলার অনুরোধ জানাল।
বিলিকে খুব ভালবেসে ফেলেছি, বললেন ফোর্ড। ওর পুরো নাম বিলি শেকসপীয়ার। উইলিয়াম শেকসপীয়ার কে ছিলেন, নিশ্চয় জানো।
জানি। দুনিয়ার সেরা নাট্যকারদের একজন। পনেরোশো চৌষট্টি সালে ইংল্যাণ্ডে জন্মেছিলেন, মারা গেছেন যোলোমশা মোল সালে। তার নাটকগুলো এখনও মঞ্চস্থ হয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। বেশি জনপ্রিয় নাটকটা বোধহয় হ্যামলেট।
বহুবার অভিনয় করেছি আমি হ্যামলেটে, উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলেন ফোর্ড। দর্শকরা বলত, খুব ভাল অভিনয় করি। সোজা হয়ে বসে এক হাত রাখলেন বুকে, আরেক হাত সোজা করে নাটকীয় ভঙ্গিতে ভরাট গলায় বললেন, টু বি, অর নট টু বি, দ্যাট ইজ দা কোয়েশচেন। ছেলেদের দিকে ফিরে বললেন, হ্যামলেটের একটা ডায়লগ। সম্ভবত শেকসপীয়ারের লেখার সবচেয়ে পরিচিত লাইন। আমার কাকাতুয়াটাও শিখেছিল, বার বার আউড়াতো।
শেকসপীয়ারের ডায়লগ বলত? মুসা বলল। খুব শিক্ষিত পাখি তো।
তা বলতে পারো। কথায় ব্রিটিশ টান ছিল। একটা মাত্র জন্মদোষ ছিল পাখিটার।
জন্মদোষ? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
হ্যাঁ, তোতলামি। সে বলত : টু-টু-টু বি অর নট টু-টু-টু বি, দ্যাট ইজ দা কোয়েশচেন।
আগ্রহে উজ্জল হলো কিশোরের চোখ। শুনলে, মুসা? কাকাতুয়া তোতলায়, এই প্রথম শুনলাম। বোঝা যাচ্ছে, দারুণ একখান কেস পেয়েছি।
মুসারও তাই মনে হলো। তবে কিশোরের মত খুশি হলো না, শঙ্কিত হলো।
বিশ্রাম নিয়ে শক্তি ফিরে পেয়েছেন আবার মিস্টার ফোর্ড। খুলে বললেন সব। তিন হপ্তা আগে পাখিটা কিনেছেন তিনি, এক ফেরিওলার কাছ থেকে। ছোটখাট একজন লোক, কথায় জোরালো মেকসিকান টান, গাধায় টানা ছোট একটা গাড়িতে করে এসেছিল।
এক মিনিট স্যার, হাত তুলল কিশোর। আপনার বাড়িতে এল কি করে সে?
ও, মিস জলি বোরো পাঠিয়েছে, আমার পাশের রকটায়ই থাকে। সে-ও একটা কাকাতুয়া কিনেছে। যখন শুনল, শেকসপীয়ারের ডায়লগ বলে বিলি, ভাবল, আমি ইনটারেসটেড হব। তাই পাঠাল।
তাই? নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। সব সময়ই কাকাতুয়া ফেরি করে নাকি লোকটা? পাখিই শুধু বিক্রি করে?
তা-তো জানি না, চোখ মিটমিট করলেন ফোর্ড। আমার কাছে যখন এল, সঙ্গে মাত্র দুটো খাঁচা। একটায় বিলি। আরেকটায় অদ্ভুত একটা কালচে পাখি, দেখে মনে হয়েছে বারোমেসে রোগী। ফেরিওলা জানাল, ওটা দুর্লভ কালো কাকাতুয়া। কিন্তু ওরকম কোন পাখি আছে বলে শুনিনি। লোকটা বলল, পাখিটার রোগা চেহারা দেখে কেউ কিনতে চায় না।
ফেরিওলার নাম জিজ্ঞেস করেছিলেন? কিংবা গাড়িটার কোন নাম ছিল?
না, মাথা নাড়লেন অভিনেতা। পুরানো মলিন কাপড়চোপড় পরনে ছিল, কাশছিল বারে বারে। কাকাতুয়াটা বিক্রি করতে পারলে যেন বেঁচে যায়, এমন ভাবসাব। জিজ্ঞেস করায় বলল, তোতলা বলে নাকি কিনতে চায় না কেউ।
গাড়িটা সাধারণ দু-চাকার গাড়ি, না?
হ্যাঁ। কবে যে রঙ করেছে কে জানে। গাধাটার স্বাস্থ্যও বিশেষ সুবিধের না। ডিংগো বলে ডাকছিল।
কিশোর, মুসা বলল, কাকাতুয়াটা চুরি করে আনেনি তো?
মনে হয় না। ভোলাখুলি রাস্তায় নিয়ে বেরোনোর সাহস করত না তাহলে। চিন্তিত দেখাচ্ছে কিশোরকে। তবে একটা ব্যাপার পরিষ্কার, বিলির আসল মালিক নয় সে, বুলিও সে শেখায়নি।
কি করে বুঝলে?
সহজ। মিস্টার ফোর্ড বলছেন, কাকাতুয়াটার কথায় বিশিট টান ছিল। অথচ ফেরিওলার কথায় মেকসিকান্ত টান।
বিষ খেয়ে মরা উচিত আমার, কি শাস্তি হওয়া উচিত তার সে-ব্যাপারে বিন্দুমাত্র স্বজনপ্রীতি দেখাল না মুসা, মনে মনে বলল। এই সহজ কথাটা বুঝলাম না? আমি গোয়েন্দাগিরির অযোগ্য।
মিস্টার ফোর্ড, বলল কিশোর, পাখিটাহারাল কিভাবে খুলে বলুন তো।
বলছি, ছোট্ট কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিলেন অভিনেতা। দিন তিনেক আগে বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। দরজায় তালা লাগাইনি, জানালাও খোলা ছিল। ফিরে এসে দেখলাম বিলি নেই। ড্রাইভওয়েতে গাড়ির চাকার দাগ। আমার নিজের কোন গাড়ি নেই। অনুমান করতে অসুবিধে হলো না, গাড়ি করে এসেছিল, বিলিকে চুরি করে নিয়ে গেছে। ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, অথচ পুলিশের বক্তব্য, বিলি উড়ে চলে গেছে। আচ্ছা তুমিই বলো, খাঁচা নিয়ে উড়ে যায় কি করে কাকাতুয়া? সম্ভব? এই হলোগে আমাদের পুলিশ সাহেবদের বুদ্ধি।
না, তা সম্ভব নয়, একমত হলো কিশোের। আজকের কথা বলুন। কি কি ঘটেছিল? কেন এসেছিল মোটা লোকটা? কেনই বা আপনাকে বেঁধে ফেলে গেল?
ওই শয়তানটা! জ্বলে উঠলেন ফোর্ড। প্রথমে এসে বলল, তার নাম হাইমাস, পুলিশের লোক। ভাবলাম, বুঝি মত পালটেছে পুলিশ, আমার পাখিটার ব্যাপারে তদন্ত করতে এসেছে। ডেকে এনে বসালাম ঘরে। নানা রকম প্রশ্ন শুরু করল কাকাতুয়া সম্পর্কে। ফেরিওলার কাছ থেকে আমার প্রতিবেশি কেউ আর কোন কাকাতুয়া কিনেছে কিনা জানতে চাইল। মিস জলি বোরোর কথা বললাম।
শুনে খুব উৎসাহী হয়ে উঠল ব্যাটা। জিজ্ঞেস করল, আমার কাকাতুয়াটা কি বুলি আউড়ায়। বললাম, সে কথা পুলিশকে আগেই বলেছি। দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়ল লোকটা। আরেকবার বলার জন্যে অনুরোধ করল। নিছক রুটিন-চেকের খাতিরেই নাকি শুনতে চায়। বললাম : মাই নেইম ইজ বিলি শেকসপীয়ার। টু বি অর নট টু বি দ্যাট ইজ দা কোয়েশচেন।
শুনে খুব উত্তেজিত হয়ে উঠল সে। নোট বই বের করে লিখে নিল।
পাখিটা যে তোতলায় বলেননি তাকে? মুসা জিজ্ঞেস করল।
না, কপালে হাত বোলালেন অভিনেতা। বললে পুলিশ হাসবে মনে করে বলিনি। সোজা কথাই বিশ্বাস করে না, আর তোতলা কাকাতুয়ার কথা করবে।
অথচ, মিস্টার হাইমাস খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ল, বলল কিশোর, ঠিক প্রশ্ন নয়। আর কিছু জানাতে পারেন?
না, আর তেমন কিছু… মাথা নাড়তে গিয়েও নাড়লেন না অভিনেতা, হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। হাইমাস জিজ্ঞেস করেছে, ফেরিওলার কাছে বিক্রি করার মত আর কোন কাকাতুয়া ছিল কিনা। কালো পাখিটার কথা জানালাম। বলতেই এমন উত্তেজিত হয়ে পড়ল।
নিচয় ব্ল্যাকবিয়ার্ড, চেচিয়ে উঠল সে। যা, নিশ্চয় ব্ল্যাকবিয়ার্ড। তার এই ভাবভঙ্গি দেখে সন্দেহ হলো আমার। শিওর হয়ে গেলাম, হাইমাস পুলিশের লোক নয়।
নোট নিতে নিতে মুখ তুলল কিশোর, মিস্টার ফোর্ড, আপনার কাকাতুয়া কেমন তাই জিজ্ঞেস করা হয়নি। কি জাতের? নানারকম প্রজাতি আছে, জানেনই তো।
সরি, জানি না। তবে বিলি খুব সুন্দর, মাথা আর বুক হলুদ রঙের।
হ্যাঁ, তারপর? হাইমাস বুঝল, আপনি সন্দেহ করেছেন?
বুঝবে কি? আমিই তো বলছি। রেগে গিয়ে বলেছি, কিভাবে বলেছেন, অভিনয় করে দেখালেন, তুমি পুলিশের লোক নও। তুমি একটা ভণ্ড, প্রতারক, চোর, আমার বিলিকে চুরি করেছ। জলদি ওকে ফিরিয়ে দাও, নইলে মজা বুঝিয়ে ছাড়ব।
তারপর? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
তারপর, বাইরে একটা শব্দ শুনলাম। লাফ দিয়ে উঠে জানালার কাছে চলে গেল হাইমাস। গাড়িপথ ধরে তোমাদেরকে আসতে দেখল। ভাবল, পুলিশ নিয়ে এসেছ। আমাকে কাবু করে হাত-পা বেঁধে ফেলল। মুখে রুমাল গুঁজে দিল, তার আগে কয়েকবার চেচাতে পেরেছি। বেশি ঠেসে ঢোকায়নি রুমাল, পরে আবার ফেলে দিতে পেরেছি। তা নইলে তোমাদের ডাকতে পারতাম না। হাত নাড়লেন ফোর্ড। কিন্তু কেন কি হচ্ছে, কিছুই মাথায় ঢুকছে না। আমি তো কারও কোন ক্ষতি করিনি। আমারই পাখি চুরি করেছে, আমার ওপরই যত…যাকগে, এখন আমার বিলিকে ফেরতে পেলেই হলো। তোমরা সাহায্য করবে?
সাধ্যমত করব স্যার, কথা দিল কিশোর।
মিস্টার ফোর্ডের কাছে আর কিছু জানার নেই। তাকে ধন্যবাদ আর বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এল দুই গোয়েন্দা।
ডলে ডলে গাড়িটাকে আরও চকচকে করে তুলছে হ্যানসন, ছেলেদেরকে দেখে থেমে গেল। এবার কোথায় যাব, মাস্টার পাশা?
বাড়ি চলুন।
আঁকাবাকা লম্বা গাড়িপথ পেরোচ্ছে রোলস রয়েস। মুসার দিকে ফিরল কিশোর। মনে হয়, হাইমাসই বিলিকে চুরি করেছে। আরও তথ্য জানার জন্যেই ফিরে এসেছে, মিস্টার ফোর্ডের সঙ্গে কথা বলেছে। আমাদের পয়লা কাজ, ওকে খুঁজে বের করা।
আমি ভরসা পাচ্ছি না, সত্য কথাই বলল মুসা। খুব বাজে লোক। তখন সিগারেট লাইটার বের করে ভয় দেখিয়েছে। ঠেকায় পড়লে আসল পিস্তল বের করে গুলিও করে বসতে পারে, ওকে বিশ্বাস নেই। তাছাড়া, কি সূত্র আছে আমাদের হাতে? খুঁজে বের করব কিভাবে?
সেটাই ভাবছি। কোন উপায় নিশ্চয় হ্যানসন, লাগল লাগল।
সতর্ক করার দরকার ছিল না। কিশোরের আগেই ধূসর সেডানটাকে দেখে ফেলেছে হ্যানসন। সাই করে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে নিয়েছে রোলস রয়েসকে। পুরানো, অবহেলিত একটা ফুলের বিছানা মাড়িয়ে একেবারে নষ্ট করে দিল। আর কিছু করারও ছিল না।
বেখেয়ালে গাড়ি চালাচ্ছে সেডানের ড্রাইভার। দুর্ঘটনা যে এড়ানো গেছে, এই যথেষ্ট, তা-ও হ্যানসন, সতর্ক থাকায়।
৩
আর ইঞ্চিখানেক এদিক ওদিক হলেই লেগে যেত একটার সঙ্গে আরেকটা, রোলসরয়েসের চাকচিক্য তো বটেই, বডির মসৃণতাও নষ্ট হত অনেকখানি।
দরজা খুলে ভারিক্কি চালে নেমে গেল হ্যানসন। সেডানের ড্রাইভিং সীটে বসা ছোট্ট মানুষটার মুখোমুখি হলো। কড়া দৃষ্টি নোকটার। দোষ তো করেছেই, উল্টে নেমে এসে কৈফিয়ত চেয়ে বসল, হ্যানসন কিছু বলার আগেই।
দেখেশুনে চালাতে পারো না, গরিলা কোথাকার? চেঁচিয়ে উঠল তীক্ষ্ণচোখে। হ্যানসনের ছয় ফুট দুই ইঞ্চির কাছে তাকে এতটুকু মনে হচ্ছে। তা-ও কি দাপট!
দেখো, বাপু, সম্রান্ত ইংরেজের মত কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব নিচু রাখল হ্যানসন, দোষটা আমার নয়, তোমার। এত স্পীডে গাড়ি ঘোরায় কেউ? গেট দিয়ে ঢুকতে চায়? আরেকটু হলেই তো দিয়েছিলে দুটো গাড়িকেই নষ্ট করে।
দেখো, গর্জে ওঠার আগে এক পা পিছিয়ে গেল লোকটা, বেশি সামনে থেকে গালমন্দ করার সাহস হচ্ছে না বোধহয়, চাকরের মুখ থেকে উপদেশ শুনতে চাই না।
ভদ্রভাবে কথা বললা, শান্ত কণ্ঠে বলল হ্যানসন। নইলে ভদ্রতা শিখিয়ে দেব। এক চড়ে ফেলে দেব বত্রিশটা দাঁত।
রাগে ঘুসি পাকিয়ে এগিয়ে এল তীক্ষ্ণচোখে।
আলগোছে তার হাতটা ধরে ফেলল হ্যানসন, আরেক হাতে কলার চেপে ধরে শূন্যে তুলে ফেলল। হাস্যকর ভঙ্গিতে ছটফট করতে লাগল লোকটা, করুণ হয়ে উঠেছে মুখচোখ।
সেডানের পেছনের দরজা খুলে নামল, আরেকজন লোক। দামী বেশভূষা। ধমক দিল, টমাস। গাড়িতে যাও। বেশ ভারি গলা, আদেশ দিতে অভ্যস্ত, বোঝ গেল কণ্ঠস্বরেই। কথায় ফরাসী টান। সরু গোঁফ, ঠোঁটের কোণে একটা বড় তিল।
হাত থেকে টমাসকে ছেড়ে দিল হ্যানসন। . পড়ে যেতে যেতে কোনমতে সামলে নিল টমাস। দ্বিধা করল। ফিরে গেল। গাড়িতে। পেছনে আরেকজন বসে আছে, হোঁতকা, কুৎসিত চেহারা দেখছে।
সরি, হ্যানসনকে বলল দ্বিতীয় যে লোকটা বেরিয়ে এসেছে সে, খুব বাজে কাজ করেছে আমার ড্রাইভার। রোলস-রয়েসটার দিকে চোখের ইশারা করে বলল, খুব সুন্দর গাড়ি। রঙ-টঙ নষ্ট হলে আমারই খারাপ লাগত। তা, তোমার মালিক কে? আমার সঙ্গে একটু কথা বলবেন?
একে একে এত দ্রুত ঘটনাগুলো ঘটে গেছে, বাধা দেয়ার বা কিছু করার সুযোগই পায়নি কিশোর। এখন নেমে এল।
আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চান?
অবাক হলো বিশালদেহী লোকটা। তুমি মানে আপনি এটার মালিক?
তুমি বললে কিছু মনে করব না, বলল কিশোর। হ্যাঁ, আপাতত আমিই মালিক। পরে কি হবে জানি না।
অ। দ্বিধা করছে লোকটা। তুমি মানে, মিস্টার ফোর্ডের সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলাম। তুমি কি তার কিছু হও?
তা, বন্ধু বলতে পারেন। এই তো, আমরাও কথা বলে বেরোলাম।
তাহলে হয়তো বলতে পারবে। আচ্ছা, তার বিলি শেকসপীয়ারের. কি অবস্থা?
পাওয়া যায়নি এখনও। খুব মনের কষ্টে আছেন বেচারা।
এখনও পাওয়া যায়নি, লোকটার মুখ দেখে বোঝা গেল না কিছু ভাবান্তর হয়নি চেহারায়। সত্যি খুব খারাপ কথা। কোন খবরই নেই?
না পুলিশের কাছেই যাচ্ছি, কতদূর কি করল, জানতে। আপনার কথা বলব? সাহায্য-টাহায্য করতে চান নাকি?
না না, তাড়াতাড়ি দু-হাত নাড়ল লোকটা, আমার কথা বলার দরকার নেই। আমি মিস্টার ফোর্ডের বন্ধু। এ-পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম, খোঁজটা নিয়েই যাই। তোমার কাছেই খবর পাওয়া গেল যখন, এখন-আর যাচ্ছি না। তাড়া আছে। আমার, অন্য সময় আসব। যাই।
নাম-ধাম কিছুই বলল না লোকটা, দ্রুত গিয়ে গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে বলল, টমাস, গাড়ি ছাড়ো। হোটেলে চলো।
ইয়েস, স্যার, ঘোৎ ঘোঁৎ করল তীক্ষ্ণচোখো ড্রাইভার। হ্যানসনের দিকে আরেকবার দৃষ্টির আগুন হেনে গাড়ি পিছাতে শুরু করল। ঘুরিয়ে নিয়ে চলে গেল।
খুব চমৎকার সামলেছেন, স্যার, প্রশংসা করল হ্যানসন। আপনার চাকরি করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি, কিশোরের বার বার নিষেধ সত্ত্বেও অতিবিনয় প্রকাশ করে ফেলে সে মাঝেমাঝে, দীর্ঘ দিনের স্বভাব বদলাতে পারে না।
থ্যাংক ইউ, বলে গাড়িতে উঠল কিশোর।
কিশোর, কৌতুহলে ফেটে পড়ছে মুসা, লোকটার সঙ্গে কিশোরের কি কথা হয়েছে শুনতে পায়নি, এত সহজে তাড়ালে কি করে? মনে তো হলো খুব শক্তপাল্লা। ওসব লোককে চিনি আমি, অন্ধকার গলিপথে সামনে পড়লে ঝেড়ে দৌড় দেব। মনে হলো, তুমিই ওকে ভয় পাইয়ে দিয়েছ?
চেপে রাখা নিঃশ্বাস ফোঁস করে ছাড়ল কিশোর। হেলান দিল গদিতে। তেমন কিছু না। শুধু পুলিশের নাম বলেছিলাম।
আজকাল পুলিশ এত ভয় দেখাতে শুরু করেছে লোককে, গাড়ি পিছিয়ে আবার রাস্তায় তুলছে হ্যানসন, সেদিকে চেয়ে বলল মুসা। আগে জানতাম শুধু বদ লোকেরাই ভয় পায়…।
যারা পালাল, তারাও বদলোক, মুসার কথার পিঠে বলল কিশোর। ড্রাইভারের কোটের তলায় নিশ্চয় শোল্ডার-হোলস্টার আছে। খেয়াল করোনি, হ্যানসন যখন ওকে ধরেছে, বগলের তলায় হাত দিতে যাচ্ছিল? খুন খারাপি অপছন্দ করে না সে। .
পিস্তল? ঢোক গিলল মুসা। ব্যবহার করে?
আরেকটু হলেই আজও করে ফেলেছিল। মনিবের জন্যে পারল না। তার মনিব খুব উঁচুদরের লোক, বোঝাই যায়। এমন একজন মানুষ বন্দুকবাজ ড্রাইভার রেখেছে কেন?
প্রায় নিঃশব্দে, মসৃণ গতিতে আবার চলতে শুধু করেছে রোলস-রয়েস।
ভাবছি, গাল চুলকাল মুসা, এসব লোকের সঙ্গে জড়াচ্ছি কেন? একটা সাধারণ কাকাতুয়া খুঁজতে বেরিয়েছিলাম আমরা।
তা বেরিয়েছিলাম, স্বীকার করল কিশোর। তাহলে? আজব এক মোটা লোকের পাল্লায় পড়লাম শুরুতেই। তারপর আরেক লোক, পোশাক-আশাকে ভদ্রলোক, কিন্তু বন্দুকবাজ পোষে। রহস্যময় এক মেকসিকান ফেরিওলার কথাও শুনলাম। সবাই পাখিটার ব্যাপারে আগ্রহী।
মেকসিকান ফেরিওয়ালা বাদে, শুধরে দিল কিশোর। পাখিটা বেচে দিয়ে গেছে, ব্যস। আর আসেনি।
কিন্তু কেন? তোত একটা কাকাতুয়া এমন কি দামী জিনিস, চুরি করার জন্যে, হাতে পাওয়ার জন্যে খেপে উঠেছে সবাই?
তদন্ত করলে জবাব মিলবে। এ-মুহূর্তে তোমার মতই অন্ধকারে আছি আমি।
থাকার দরকারটা কি? গজগজ করল মুসা। আমি বলি কি, শোনো…
হঠাৎ গতি কমে গেল রোলস-রয়েসের।
কি হয়েছে, হ্যানসন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
এক মহিলা। রাস্তায় এসে উঠেছেন। কিছু হারিয়েছেন বোধহয়।
জানালা দিয়ে মুখ বের করল দুই গোয়েন্দা। ততক্ষণে ব্রেক কষে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ফেলেছে হ্যানসন।
বেঁটে, গোলগাল এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন রাস্তার ওপর, গাড়ি-ঘোড়া আসছে কিনা খেয়ালই নেই। ঝোপের দিকে চেয়ে কাকে জানি ডাকছেন। এসো, লক্ষ্মী,
এসো, জলদি এসো। দেখো কি এনেছি। খুব ভাল সূর্যমুখীর বীচি।
বোধহয় কিছু গণ্ডগোল হয়েছে, গাড়ি থেকে নামতে শুরু করল কিশোর। চলো তো, দেখি।
মহিলার দিকে হাঁটতে শুরু করল দুই গোয়েন্দা। কিন্তু কোন খেয়ালই নেই মহিলার : ঝোপের দিকে চেয়ে মুঠো খুলে দেখালেন, কত ভাল লোভনীয় বীচি এনেছেন! …
মাপ করবেন,কাছে এসে বলল কিশোর। কিছু হারিয়েছেন বুঝি?
অ্যাঁ…হ্যাঁ, পাখির মত মাথা একপাশে কাত করে অনেকটা পক্ষীকণ্ঠেই বললেন মহিলা। এই দেখো না, লিটল বো-পীপকে খুঁজি পাচ্ছি না। কোথায় যে গেছে কে জানে? তোমরা নিশ্চয় দেখোনি, না? লিটল বো-পীপকে?
না, ম্যাডাম, জবাব দিল কিশোর। লিটল বো-পীপ কি কোন কাকাতুয়া?
নিশ্চই, বিস্ময় ফুটল মহিলার চোখে। তুমি জানলে কি ভাবে?
পকেট থেকে কার্ড বের করে দিল কিশোর। আমরা গোয়েন্দা। বুঝতে পারছি, কাকাতুয়াই খুঁজছেন আপনি। ওই যে, ঘাসের ওপর চাটা ফেলে রেখেছেন। হাতে সূর্যমুখীর বীচি, ডাকাডাকি করছেন ঝোপের দিকে চেয়ে। কাকাতুয়া ছাড়া আর কি?
আরও বেশি অবাক হলেন মহিলা। বাহ, বেশ বুদ্ধি তো।
তারপর আরও কয়েকবার ডাকাডাকি করে হতাশ হয়ে দুই গোয়েন্দাকে নিয়ে রওনা হলেন বাড়ির দিকে, লিটল বো-পীপের নিখোজের ব্যাপারে খুলে বলবেন।
হ্যানসন, আপনি এখানেই থাকুন, ডেকে বলল কিশোর।
ইট বিছানো পথ ধরে মহিলার পিছু পিছু চলল দুই গোয়েন্দা। সামনে অনেকগুলো কলা-ঝাড়ের ওপাশে একটা বাংলো।
ছোট লিভিং রুমে দুই গোয়েন্দাকে বসালেন মহিলা, নিজেও বসলেন।
মিস বোরো, বলল কিশোর, কয়েক হপ্তা আগে এক মেকসিকান ফেরিওলার কাছ থেকে কাকাতুয়াটা কিনেছিলেন, না?
হ্যাঁ, চোখ বড় বড় হয়ে গেল তাঁর। আমার নামও জানো দেখছি? তুমি তো খুব ভাল গোয়েন্দা।
আগে থেকেই তথ্য জানা থাকলে ওগুলো বলা শক্ত কিছু না। কিশোর জানাল, মিস্টার ফোর্ড আপনার কথা বলেছেন।
তথ্য জানা থাকলেও অনেকেই বলতে পারে না, বললেন মিস বোরা। আর তথ্য জোগাড় করতেও বুদ্ধি লাগে। যাই হোক, মিস্টার ফোর্ড নিশ্চয় বিলিকে খুঁজে পেয়েছেন।
না, পাননি, মুসা বলল। ওকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাচ্ছি আমরা। আপনারটা হারাল কি করে, বলবেন, প্লীজ?
দোকানে গিয়েছিলাম, মুখ বাঁকালেন মিস বোরো। বীচি ফুরিয়ে গিয়েছিল। সূর্যমুখীর বীচি খুব পছন্দ করে বো-পীপ। গেট দিয়ে বেরিয়েই মরতে বসেছিলাম, প্রায় চাপা দিয়ে দিয়েছিল আমাকে কালো একটা গাড়ি। বিদেশী গাড়ি। আজকাল লোকে যা বেখেয়ালে চালায় না।
একে অন্যের দিকে তাকাল কিশোর আর মুসা। গাড়িটা কার অনুমান করতে কষ্ট হলো না কারোই।
থামতে বললাম, থামল না, বলে গেলেন মিস বোরো। কি আর করার আছে? ভয় পেয়ে পালিয়েছে যখন? দোকানে গিয়ে বীচি কিনলাম। কোন বীচি ভাল, কোনটা খারাপ, খানিকক্ষণ আলোচনা করলাম দোকানের মেয়েটার সঙ্গে। ফিরে এসে দেখি বো-পীপের খাঁচার দরজা খোলা। সে নেই। বোধহয় দরজা খোলাই রেখে গিয়েছিলাম, এই ফাঁকে বেরিয়ে গেছে। ভাবলাম, কোন ঝোপঝাড়ে গিয়ে লুকিয়েছে। খুঁজতে খুঁজতে চলে গেলাম রাস্তায়…তারপর তো তোমাদের সঙ্গে দেখা।
কালো গাড়িটাকে পরে আর দেখেছেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
না, মাথা নাড়লেন মিস বোরো। সা করে গিয়ে মোড় নিয়ে হারিয়ে গেল। গাছপালা ঝোপঝাড় বেশি, মোড় নিলে আর দেখা যায় না। ভুরু কোঁচকালেন। ওই মোটা লোকটাই চুরি করেছে বলছ নাকি?
তাই তো মনে হয়, ম্যাডাম, বলল কিশোর। আমার ধারণা, বিলিকেও সেই চুরি করেছে।
সর্বনাশ! অসহায় মনে হচ্ছে মহিলাকে। তাহলে তো আর তাকে পাব না। কি নিষ্ঠুর গো। লোকের মনে কষ্ট দেয়। কিন্তু দুটো কাকাতুয়া চুরি করতে যাবে কেন? ইচ্ছে করলে তো কিনেই নিতে পারে।
এই প্রশ্নটার জবাব মুসারও খুব জানতে ইচ্ছে করছে।
কিন্তু জবাব জানা নেই গোয়েন্দাপ্রধানের। আপাতত এটা রহস্য, বলল সে। আচ্ছা; মিস বোরো, আপনার লিটল বো-পীপ কি কথা বলতে পারে?
নিশ্চয় পারে। লিটল বো-পীপ বলে তার ভেড়াটা হারিয়েছে। কোথায় হারিয়েছে, জানে না। খুঁজে দেয়ার জন্যে ডাকাডাকি করে শারলক হোমসকে। অদ্ভুত কথা, তাই না? কাকাতুয়াকে আরও কত রকম বুলিই তো শেখানো যায়।
তা যায়, নোট বই বের করল কিশোর। ঠিক কি কি বলত বলুন তো?
লিটল বো-পীপ হ্যাজ লস্ট হার শীপ অ্যাণ্ড ডাটু নো হোয়্যার টু ফাইণ্ড ইট। কল অন শারলক হোমস।
দ্রুত লিখে নিয়ে বলল কিশোর, কথায় ব্রিটিশ টান আছে?
আছে। মনে হয়, খুব যত্ন করে শিখিয়েছে কোন উচ্চ শিক্ষিত ইংরেজ ভদ্রলোক।
হু। মিস বোরো, যা মনে হচ্ছে আপনার বো-পীপকে হাইমাসই মানে, মোটা লোকটাই চুরি করেছে। পুলিশকে ফোন করে জানান।
পুলিশ? ও, মাই গুডনেস! আঁতকে উঠলেন মহিলা। ফোন নেই আমার।। তাছাড়া পুলিশের ঝামেলায় যাব না। এত দূরে শহরে গিয়ে ওদের সাহায্য চাইতে বলছ? যাক, লাগবে না আমার। অনুরোধ করলেন, প্লীজ, তোমরাই খুঁজে দাও। দেবে?
তা দিতে পারি, বলল কিশোর। একই সঙ্গে দুটো তদন্ত চালানো এমন কিছু কঠিন না, তাছাড়া চোর যখন একজন।
প্লীজ। তোমার কথা চিরদিন মনে রাখব তাহলে। দেবে শুনেই যা ভাল্লাগছে না।
আরেকটা প্রশ্ন, মিস বোরো, তর্জনী তুলল কিশোর ! মেকসিকান ফেরিওয়ালা দুই চাকার একটা গাধায় টানা গাড়িতে করে এসেছিল, না?
হ্যাঁ। খুব কাশছিল। মনে হচ্ছিল, ভারি অসুখ। বেচারাকে দেখে খারাপই লাগছিল।
কাকাতুয়া বিক্রি করে রসিদ-টসিদ দিয়েছে কিছু?
না-তো। ইস্, বড্ড ভুল হয়ে গেছে, শূন্য দৃষ্টিতে তাকালেন মিস বোরো। চাওয়ার কথা মনেই ছিল না।
গাড়ির গায়ে কোন নাম বা কিছু লেখা ছিল?
মাথা নাড়লেন মিস বোরো। আর কোন তথ্য দিতে পারলেন না তিনি।
মহিলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এল দুই গোয়েন্দা।
বাইরে বেরিয়েই কিশোরের বাহু খামচে ধরল মুসা। কিশোর, কাকাতুয়া দুটোকে কিভাবে খুঁজে বের করবে? কোথায় আছে ওরা কিছুই তো জানি না। একজন শেকসপীয়ার জানে, অরেকজন মাদার গুজ। কিন্তু জঙ্গল থেকে ধরে এনে ওই বুলি তো যে কোন কাকাতুয়াকে শেখানো যায়। অযথা সময় নষ্ট করছি, বুঝলে?
চিন্তিত দেখাচ্ছে কিশোরকে। হাইমসকে দেখে কি মনে হয়েছে তোমার? ছেলেমানুষী করার লোক?
মোটেই না, জোরে মাথা নাড়ল মুসা। পিস্তল-চেহারার লাইটার দেখিয়ে যে রসিকতা করতে পারে, সে ছেলেমানুষী করার লোক নয়।
এক্কেবারে ঠিক। অথচ সেই লোকই দুই রকম বুলি আউড়ায় এমন দুটো কাকাতুয়া চুরি করল কি কারণে? জোরাল কোন যুক্তি নিশ্চয় আছে, এখন বুঝতে পারছি না।
কিন্তু তাকেই বা খুঁজে পাব কি করে?
আমরা গোয়েন্দা, বুদ্ধির খেলা খেলি। কোনভাবে..সরো সরো! ঝাঁপিয়ে এসে পড়ল মুসার ওপর, নিয়ে পড়ল মাটিতে।
খানিক আগে মুসার মাথা যেখানে ছিল, শিস কেটে ঠিক সে-পথে উড়ে চলে গেল কি যেন একটা। ঘাসে ঢাকা নরম মাটিতে গিয়ে গাঁথল।
সরো…ওহ, সরো! ঠেলে গায়ের ওপর থেকে কিশোরকে সরাল মুসা, শ্বাস নিতে পারছি না।
উঠে দাঁড়াল কিশোর।
মুসাও উঠল। জোরে জোরে শ্বাস নিল কয়েকবার।
নিচু হয়ে জিনিসটা তুলছে কিশোর। লাল টালির একটা টুকরো, মিস বোরোর বাংলোর ছাতে যে-ধরনের টালি, ওখান থেকেই ভেঙে নেয়া হয়েছে কিনা কে জানে।
এটা মাথায় লাগলে না মরলেও বেহুশ হয়ে থাকতে কয়েক ঘণ্টা, কিশোর বলল। ভাগ্যিস ঝোপের দিকে চোখ পড়েছিল।
থ্যা-থ্যাংকস, কাঁপছে মুসার গলা। ছুড়ল কে?
দেখিনি। হুঁশিয়ার করল। ও চায় না আমরা বিলি কিংবা বো-পীপকে খুঁজি।
৪
রাতের খাওয়া খেতে বসছে রবিন। বার বার তাকাচ্ছে টেলিফোনের দিকে। এই খানিক আগে ফিরেছে লাইব্রেরি থেকে, পার্ট-টাইম চাকরি করে ওখানে।
ইস্ এখনও ফোন করছে না কেন কিশোর?
খাওয়া শেষ হয়ে এসেছে রবিনের, তা-ও ফোন বাজছে না। উঠে গিয়ে সিংকে। প্লেট চোবাল, ধুয়ে পরিষ্কার করে এনে রাখল আবার জায়গামত।
কাছেই কাজ করছেন মিসেস মিলফোর্ড।
মা, বলল রবিন, কিশোর কোন খবরটবর দিয়েছে?
ও, হ্যাঁ হ্যাঁ, মুখ ফেরালেন তিনি। ভুলেই গিয়েছিলাম। একটা মেসেজ আছে।
কি মেসেজ? উত্তেজিত হয়ে উঠল রবিন। কি লিখেছে?
আগের দিন যা যা ঘটেছে, তাকে জানিয়েছে কিশোর। সঙ্গে সঙ্গে রিপোর্টের ফাইল তৈরি করে ফেলেছে রবিন, এটা তার দায়িত্ব। আজ বিকেলে হেডকোয়ার্টারে কাকাতুয়ার রহস্য নিয়েই আলোচনা করার কথা।
এই যে, লিখে রেখেছি, মা বললেন, পকেট হাতড়ে বের করলেন এক টুকরো কাগজ। কি যে সব বলে কিশোর, মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝি না। ভুলে যেতাম, তাই লিখে রেখেছি। এই যে।
ও ওরকম করেই বলে, মাকে বোঝাল রবিন, হাত বাড়াল কাগজটার জন্যে।
বেশি পড়াশোনা করে তো, বড় বড় কঠিন শব্দ আপনাআপনি মুখে চলে আসে। চাচা-চাচীর সঙ্গেও ওভাবেই কথা বলে। বেশিদিন তোমার সঙ্গে ওভাবে বললে
তুমিও বুঝে যাবে, আর উদ্ভট লাগবে না।
কি বলছে, কিছুই বুঝিনি। জোরে জোরে পড়লেন মিসেস মিলফোর্ড, লাল কুকুর চার। উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। তীর বরাবর বুকে হাঁটবে। সহজ সহজ বাক্য, অথচ মানে করতে গেলে মনে হয় গ্রীক। কি বুঝিয়েছে রে?
জবাব নেই। রবিন ততক্ষণে পৌঁছে গেছে দরজার কাছে। ডাকলেন মা। এই রবিন, না বলেই চলে যাচ্ছিস যে?
দরজায় দাঁড়িয়ে ঘুরল রবিন, হতাশ ভঙ্গিতে কপাল চাপড়াল, ওফ্ফো, মা, এই সহজ কথাগুলো বুঝতে পারছ না। ইংরেজিই তো লিখেছে।
কোথায় ইংরেজি। কোন ধরনের কোড। এই, বল না। হ্যাঁ, কোডই। বাইরের লোক যাতে বুঝতে না পারে… কি বলছিস তুই, রবিন? মা অবাক। আমি তোর মা, বাইরের লোক?
তোমাকে বাইরের লোক বললাম নাকি? খালি উল্টোপাল্টা বোঝে। ঠিক আছে, কোন্ কথাটা জানতে চাও?
এই যে, উড়ে এসে জুড়ে বসেছে?
কয়েকটা হারানো কাকাতুয়াকে খুঁজছি আমরা, ওটারই কোড : উড়ে এসে জুড়ে বসেছে।
হুঁ, মায়ের আশঙ্কা দূর হলো, ভয়ের কিছু নেই, বিপদ হবে না ছেলের।
যাওয়ার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে রবিন, মা আবার প্রশ্ন করার আগেই বলল, আর লাল কুকুর চার মানে…
থাক থাক, ওগুলোর মানে আর জানার দরকার নেই, হাত তুললেন মিসেস মিলফোর্ড। যা, বেশী রাত করিস না। গির্জার ফাদারকে দাওয়াত করতে যেতে হবে। আগামী রোববারে আমাদের এখানেই খাবেন।
লাল কুকুর চার হলো তিন গোয়েন্দার হেডকোয়ার্টারে ঢোকার অনেকগুলো পথের একটা। ওটা দিয়ে ঢোকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে মেসেজে।
স্যালভিজ ইয়ার্ডের বেড়ায় নানা রকম ছবি। এক জায়গায় একটা লাল কুকুর বসে আছে, একটা বাড়িতে আগুন লেগেছে, তা-ই দেখছে। কুকুরটার একটা চোখ আসলে কাঠের গিঁট। আলগা। নখ দিয়ে খুঁচিয়ে ওটা বের করে নিল রবিন, ভেতরে আঙুল ঢুকিয়ে গোপন সুইচ টিপল। আস্তে করে তিন দিকে সরে গেল বেড়ার তিনটে অংশ, গোপন দরজার পাল্লা। ভেতরে ঢুকে আবার সুইচ টিপে দরজা বন্ধ করে দিল সে।
এক জায়গায় অনেকগুলো তক্তা আর লোহার বীম আড়াআড়ি পড়ে আছে মনে হয়, ওভাবেই ওগুলো সাজিয়েছে তিন কিশোর। নিচে দিয়ে পথ। বুকে হেঁটে যেতে হয়। ওপরে একটা তীর চিহ্ন। ট্রেলারটা কোনদিকে আছে, তার নির্দেশ।
বুকে হেঁটে এগিয়ে ট্রেলারের নিচে পৌঁছে গেল রবিন। দুইবার টোকা দিতেই ভেতর থেকে তুলে নেয়া হলো একটা পান্না। হেডকোয়ার্টারে ঢুকল সে।
হেডকোয়ার্টার মানে তিরিশ ফুট লম্বা একটা বাতিল মোবাইল হোম, জঞ্জালের তলায় চাপা পড়ে আছে। সেটাকে সারিয়ে নিয়ে অফিস সাজিয়েছে তিন গোয়েন্দা। নানারকম সুযোগ-সুবিধে আছে তার মধ্যে। ছোট একটা ল্যাবরেটরিও আছে, আছে ফটো প্রসেস করার ডার্করুম।
ডেস্কের ওপাশে নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে আনমনে একটা পেন্সিল কামড়াচ্ছে কিশোর। রবিনকে দেখে বলল, এত দেরি যে?
মেসেজ দিতে মা ভুলে গিয়েছিল। তবে আগে দিলেও আসতে পারতাম না, খেয়ে আসতে দিত না। কেন ডেকেছ? জরুরী মীটিং?
হ্যাঁ, মাথা ঝাকাল কিশোর। বিলি শেকসপীয়ার আর লিটল বো-পীপকে খুঁজে বের করা দরকার।
কিভাবে, তাই তো মাথায় ঢুকছে না, মুসা বলল। মোটকা হাইমাসকে চিনি, সন্দেহ করছি ওই ব্যাটাই চুরি করেছে। ব্যস! আর কোন সূত্র নেই। পুলিশ চেষ্টা করলে হয়তো গাড়িটা খুঁজে বের করতে পারে, কিন্তু তারা তো শুনলে হাসে। এক কাজ করলে কেমন হয়? গিয়ে পুলিশ চীফ ইয়ান ফ্লেচারকে ধরলে?
ভুলে যাও কেন? ভুরু নাচাল কিশোর। মিস্টার ফোর্ড আর মিসেস বোরো কেউই পুলিশের সাহায্য নিতে রাজি নন।
তাহলে? দু-হাত নাড়ল মুসা। আমি তো কোন উপায়ই দেখছি না।
উপায় একটা আছে।
আছে? এক সঙ্গে গলা সামনে বাড়াল রবিন আর মুসা।
আছে। ভূত-থেকে-ভূতে।
আরে, তাই তো, হাসল রবিন। এই কথাটা মনে পড়েনি!
আমিও একটা আস্ত গাধা, হতাশা চলে গেছে মুসার কণ্ঠ থেকে, উত্তেজনা ফুটেছে চেহারায়। তা এখুনি শুরু করে দিই না। আগামী কাল সকালেই খোঁজ পেয়ে যাব।
তা করতে পারো, রাজি হলো কিশোর।
আচ্ছা, একটা পুরস্কার ঘোষণা করলে কেমন হয়? প্রস্তাব রাখল রবিন।
তাহলে উৎসাহী হবে বাচ্চারা। তাড়াতাড়ি কাজ হবে।
ঠিকই বলছে। কি পুরস্কার দেয়া যায়?
আমি বলছি, হাত তুলল মুসা। বলব, যে আগে খোঁজ দিতে পারবে, তাকে রোলস-রয়েসে চড়িয়ে এক ঘণ্টা ঘোরাব।
মন্দ না, বলল কিশোর। দেখেছি তো, ছেলেমেয়েরা যেভাবে চকচকে চোখে তাকায় গাড়িটার দিকে। তা নাহয় ঘোরালাম। সেই সাথে কিছু নগদের কথাও বলি? এই বিশ-পঁচিশ ডলার? আরও বেশি আগ্রহী হবে।
তা-ই ঠিক হলো। গাড়িতে এক ঘণ্টা চড়ানো, আর পঁচিশ ডলার পুরস্কার।
চালু করে দেয়া হলো ভূত-থেকে-ভূতে।
রাত করতে মানা করে দিয়েছেন মা। উঠল রবিন।
বাড়ি ফিরে দেখল গুম হয়ে বসে আছেন মা, হাতে রিসিভার।
কি হয়েছে, মা? কোন গোলমাল?।
সেই তখন থেকে কতবার চেষ্টা করছি, মিসেস ফেনারকে আসতে বলব। একা কুলিয়ে উঠতে পারব না, অনেক মেহমান আসবেন, আমাকে একটু সাহায্য করবে সে। লাইনই পাচ্ছি না। সব কটা লাইন এনগেজড! কি যে হলো আজ। একটাও খালি নেই।
ঢোক গিলল রবিন। জানে, কেন খালি নেই লাইন। কিন্তু সে-কথা মাকে বলা যাবে না।
আবার ডায়াল ঘোরাতে শুরু করলেন মিসেস মিলফোর্ড। মা এভাবে কষ্ট পাচ্ছেন, খারাপই লাগল রবিনের। কিন্তু কিছুই করার নেই তার এখন। সে নিজে চেষ্টা করলেও লাইন পাবে না।
দোতলায় নিজের ঘ-১ উঠে এল রবিন। কাপড় ছাড়তে ছাড়তে একটা মোটামুটি হিসাব করল : কালো গাড়িটার খোঁজ চেয়ে তারা তিনজনে পাঁচজন করে বন্ধুকে ফোন করেছে। ওরা করবে আরও পাচজনকে, হয়ে গেল পঁচাত্তর। তারা করবে আরও পাঁচজনকে। হয়ে গেল তিনশো পঁচাত্তর। তারা আরও পাঁচ…হলো আঠারোশো পঁচাত্তর…তারা আবার পাঁচ…নয় হাজার তিনশো পঁচাত্তর… আরিব্বাপরে! লস অ্যাঞ্জেলেস আর হলিউডের কোন ছেলেমেয়ের জানতে আর বাকি থাকে না। লুকাবে কোথায় হাইমাস? নাহ্ কিশোরটা একটা জিনিয়াস, বন্ধুগর্বে আধহাত উঁচু হলো রবিনের বুক।
শুয়ে পড়ল রবিন। বালিশে হাত, তার ওপর মাথা রেখে ভাবতে শুরু করল সে। বিলি শেকসপীয়ার, লিটল বো-পীপ আর তাদের বিচিত্র বুলির কথা। গতকাল থেকেই কিছু আছে, কিন্তু ধরতে পারছে না। এখন আরেকবার চেষ্টা করল। টু-টু-টু বি অর নট…আচ্ছা, কাকাতুয়া তোতলাবে কি করে? সে জানে, এর কোন বৈজ্ঞানিক যুক্তি নেই। ইচ্ছে করেই ভুল শেখায়নি তো? কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারল না রবিন, গোলমালটা ধরতে পারছে না। সেটা অন্য কোথাও।
ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল সে। মাঝরাতে ঘুমের ঘোরেই যেন কানের কাছে বলল কেউ ও লিটল বো-পীপ হ্যাজ লস্ট হার শীপ অ্যাণ্ড ডাজ নট নো হোয়্যার টু ফাইণ্ড ইট। কল অন শার্লক হোমস।
ঘুম ভেঙে গেল রবিনের। অখণ্ড নীরবতা। ভুলটা আবিষ্কার করে ফেলেছে মগজ। তার মনে পড়ল মাদার গুজ-এ লেখা লাইনটা হলো : লিটল বো-পীপ হ্যাজ লস্ট হার শীপ অ্যাণ্ড ডাজনট নো হোয়্যার টু ফাইণ্ড দেম।
দেম-এর জায়গায় ইট বলে কাকাতুয়াটা।
ব্যাপারটা হয়তো বিশেষ কিছুই নয়। কিন্তু কিশোরের কাছে শিখেছে রবিন, গোয়েন্দাগিরিতে অতি সামান্য ব্যাপারও অবহেলা করতে নেই।
হুম, চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলাল কিশোর, ঠিকই বলেছ, রবিন। এক বচন বহুবচন দুটোর বেলাতেই হয় শীপ, তাই ইট বললেও শুদ্ধ, দেমও শুদ্ধ। কিন্তু…
খাইছে! হাত তুলল মুসা। এই, তোমাদের ব্যাকরণ ক্লাস থামাও। গুঙিয়ে উঠল, স্কুলে শুনতে শুনতেই অবস্থা কাহিল…
হেডকোয়ার্টারে আলোচনায় বসেছে তিন গোয়েন্দা। দশটা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি। ভুত-থেকে-ভূতের মাধ্যমে খবর আসার সময় হয়েছে।
কিন্তু ভুল করেছে, মুসার কথায় কান দিল না রবিন। যিনি শিখিয়েছেন, ভুল তাঁরই।
কটা ভুল? বলল কিশোর। বিলি শেকসপীয়ার তোতলায়, সেটা একটা ভুল। মাদার গুজ থেকে শেখানো হয়েছে লিটল বো-পীপকে, সেখানে আরেকটা ভুল।
তাতে কি? মুসার প্রশ্ন। মাত্র তো দুটো। এক গ্রামার ক্লাসেই কয়েক ডজন ভুল করি আমি। আর কবিতা মুখস্থ লিখতে দিলে তো….।
সেটা তোমার হয়, বলল কিশোর। কিন্তু উচ্চ শিক্ষিত একজন ইংরেজ ভদ্রলোক এই সাধারণ ভুল করবেন না। একটা হলে ধরে নিতাম, নাহয় হয়ে গেছে কোনভাবে। কিন্তু দুটো? উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হয়।
উদ্দেশ্যপ্র… শূন্য দৃষ্টি ফুটল মুসার চোখে। তাকে দোষ দিতে পারল না রবিন। কিশোর পাশার ভাবনার সঙ্গে সব সময় তাল মিলিয়ে চলা কঠিন। অনেক সময় খুব বেশি শর্টকাটে এগিয়ে যায় তার মস্তিষ্ক।
ইচ্ছে করে ভুল শিখিয়েছেন বলতে চাইছ? জিজ্ঞেস করল রবিন।
হ্যাঁ। দুটো রহস্য আমাদের হাতে। এক : হাইমাস কেন কাকাতুয়া চুরি করছে? দুই? কেন ওগুলোকে ভুল বুলি শেখানো হয়েছে?
মাথায় ঢুকছে না, মাথা নাড়ল রবিন। এত কঠিন বুলি কেন শেখানো হয়েছে, সেটাও তো আরেক রহস্য। এসব কথা সাধারণত লোকে শেখায় না।
গভীর হচ্ছে রহস্য, বাস্তবে নেই যেন কিশোর, কণ্ঠে খুশির আমেজ। জটিল সমস্যা পেয়ে গেছে সে, জট ছাড়াবে ধীরে ধীরে, তাতেই তার আনন্দ। যে-ই শিখিয়েছে, অনেক ধৈর্যের সঙ্গে কষ্ট করে শেখাতে হয়েছে। নিশ্চয় অহেতুক কষ্ট করেনি। আর হাইমাসও বিনা কারণে কাকাতুয়া দুটোকে চুরি করেনি। নিশ্চয় কোন কারণ আছে।
কিশোর! উত্তেজিত মনে হলো রবিনকে। আরও পাখি তো থাকতে পারে? সেই কালো কাকাতুয়াটা? ব্ল্যাকবিয়ার্ড…
আরি সব্বোনাশ! আঁতকে উঠল মুসা। দুটোতেই মাথা ঘুরছে। আরও আমদানী করছ?
হাসতে গিয়েও থেমে গেল অন্য দুজন। ফোন বেজে উঠেছে। ছোঁ মেরে তুলে নিল কিশোর। হ্যালো হ্যাঁ।…তাই নাকি?…শেষ নম্বর দুটো ওয়ান থ্রী? …ও না না, তাহলে না, সরি। থ্যাংকু। হতাশ হয়ে রেখে দিল রিসিভার।
হলিউডের একটা ছেলে, জানাল সে। গাড়ির নম্বর মিলছে না।
আবার বাজল টেলিফোন। রিসিভার কানে ঠেকিয়ে স্পীকারের সুইচ টিপতে আর ভুল করল না কিশোর। সবাই শুনতে পেল ওপাশের কথা। সান্তা মনিকার একটা ছেলে কালো একটা রেঞ্জার দেখেছে, তবে কয়েক বছরের পুরানো গাড়ি। গাড়িতে ছিল দুই তরুণ দম্পতি। না, এবারেও হলো না।
আরও আটজন ফোন করল। কিন্তু সবগুলো বেঠিক।
নাহ্ কাজ হলো না, হতাশ হয়ে ভাবল কিশোর। ভূত-থেকে-ভূতে সাহায্য করল না এবার তিন গোয়েন্দাকে।
৫
চুপ করে আছে ওরা। হাইমাসের কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
স্পীকারে ডাক শোনা গেল মেরিচাচীর, কিশোর, এই কিশোর? একটা ছেলে তোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। মেকসিকো থেকে।
মেকসিকো থেকে!
একই সঙ্গে কথাটা মনে পড়ে তিনজনের : কাকাতুয়া বিক্রি করেছে যে ফেরিওলা, তার কথায় জোরাল মেকসিকান টান ছিল।
হুড়োহুড়ি করে দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে এল ওরা।
এই যে ও, রবিনের সমান লম্বা রুগ্ন চেহারার একটা ছেলেকে দেখালেন মেরিচাচী। মলিন প্যান্ট, শার্টের কয়েক জায়গায় ছেড়া।
এখন কাজের সময়, তাড়াহুড়ো করে অফিসে চলে গেলেন আবার চাচী।
সিনর কিশোর? জানতে চাইল ছেলেটা।
আমি, বলল কিশোর।
আমি ডিয়েগো, কড়া মেকসিকান টান কথায়, রিনরিনে সুরেলা কণ্ঠস্বর। আউ-টোটা কোথায়? দেখাবেন?
আউ-টো? বুঝতে পারছে না কিশোর।
কিন্তু মুসা বুঝে ফেলল। রোলস-রয়েসটার কথা বলছে।
ও, ওটা? গ্যারেজে, বলল কিশোর।
সোনালি আউ-টো। নিশ্চয় খুব সুন্দর। দেখতে ভারি ইচ্ছে করছে, হাসতে গিয়েও হাসল না ছেলেটা, সহজ হতে পারছে না, চোখে ভয়। আমি সিনর কিশোর, আমি গাড়ি খুব ভালবাসি। সব গাড়ি। কোন সময়, কোন একদিন আমিও একটা কিনব।
গাড়ি? দূরে কাজ করছে বিশালদেহী দুই ব্যাভারিয়ান ভাই, বোরিস আর রোভার, ইয়ার্ডের ট্রাকটা ধুচ্ছে, সেদিকে চেয়ে ছেলেটাকে বলল কিশোর, এসো আমার সঙ্গে।
দ্বিধা করল ডিয়েগো। এক মিনিট, বলে ওয়ার্কশপের কোণের দিকে চলে গেল।
উঁকি দিয়ে দেখল মুসা, এই প্রথম দেখতে পেল গাধাটা। লোহার খুঁটির সঙ্গে বাঁধা, কাছেই একটা দু-চাকার গাড়ি।
আদর করে ধূসর জানোয়ারটার পিঠ চাপড়াল ডিয়েগো।
থাক এখানে, ডিংগো। আমি আসছি।
বাক্স, ছোট ড্রাম, যে যা পেল তার ওপরই বসল চারজনে, ওয়ার্কশপে। নানারকম লোভনীয় জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, চোখ বড় বড় করে দেখছে ডিয়েগো।
ডিয়েগো, বলল কিশোর, কালো একটা রেঞ্জারের কথা বলতে এসেছ?
এত জোরে মাথা কঁকাল ডিয়েগো, মুসার ভয় হলো, গলা থেকে ছিড়ে না আলগা হয়ে যায়। সি, সি, সিনর কিশোর, কাল রাতে আমার বন্ধু টিরানো দেখা করতে এসেছিল। বলল, একজন সিনর কিশোর একটা কালো, রেঞ্জারের খোঁজ জানতে চান। শেষ দুটো নম্বর ওয়ানথ্রী।
রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে তিন গোয়েন্দা।
তাদের আগ্রহী চোখের দিকে চেয়ে আশা বাড়ল ডিয়েগোর। আরও বলল..পুরস্কার দেয়া হবে।
পুরস্কার! চেঁচিয়ে উঠল উত্তেজিত মুসা, ভয় পেয়ে গেল বেচারা ডিয়েগো। নিশ্চয়ই। গাড়িটা দেখেছ? কোথায়?
দেখেছি, তিন গোয়েন্দার মুখের দিকে তাকাচ্ছে ডিয়েগো। মোটা এক লোকের। কিন্তু সে যে এখন কোথায়… আঙুলে গুনলো, এক-দুই-তিন-চার…. সাত দিন আগে দেখেছি। তারপর আর দেখিনি।
সাত দিন? ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা, হতাশ হয়েছে। কোন লাভ হলো না। এতদিন মনে রাখলে কিভাবে?
গাড়ি সাংঘাতিক ভালবাসি আমি। গাড়ি আমার স্বপ্ন। কালো রেঞ্জারটা দারুণ এক গাড়ি। লাইসেন্স নম্বর মুখস্থ হয়ে গেছে : এ কে ফোর ফাইভ ওয়ান খ্রী। লাল চামড়ায় মোড়া গদি। সামনের বাম্পারের ডানদিকে ছোট একটা ঘষার দাগ আছে। পেছনের বাম্পারে এক জায়গায় টোল খাওয়া।
ছেলেটার ওপর ভক্তি এসে গেল তিন গোয়েন্দার। গাড়ির ব্যাপারে অনেক ছেলেরই অনেক রকম হবি আছে। কয়েক বছর পরেও একটা বিশেষ গাড়ির কথা মনে রাখতে পারে, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বড় জোর কি গাড়ি আর কি রঙ, এই পর্যন্ত। কিন্তু ডিয়েগো ঠিক মনে রেখেছে লাইসেন্স নম্বর, বাম্পারের কোথায় দাগ, কোথায় টোল খাওয়া, সব। এক হপ্তা পরেও এত খুঁটিনাটি মনে রাখা সত্যি কঠিন।
পুলিশকে জানালে সহজেই খুঁজে বের করে ফেলতে পারবে, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। কিন্তু আমরা কথা দিয়ে এসেছি, পুলিশকে কিছু জানাব না। ডিয়েগোর দিকে ফিরল। দু-এক দিনের মধ্যে আর দেখা হয়নি না?
মাথা নাড়ল মেকসিকান ছেলেটা। তার বাদামী চোখ দুটো বিষণ্ণ। পুরস্কার পাচ্ছি না তাহলে।…গাড়িতে চড়তে পারছি না। সোনালি আউ-টো কি সুন্দর…।
হয়তো চড়তে পারবে, আশ্বাস দিল কিশোর। ডিয়েগো, মোটা লোকটাকে কোথায় কিভাবে দেখলে, বলো তো?
আমার চাচা স্যানটিনোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। কাকাতুয়াগুলোর জন্যে।
কাকাতুয়া? বলে উঠল মুসা। তোমার চাচাই তাহলে বিলি শেকসপীয়ার আর লিটল বো-পীপকে বিক্রি করেছে।
মাথা ঝাকাল ডিয়েগো। অন্যগুলোও। সব কটারই অদ্ভুত নাম।
অদ্ভুত নাম? দ্রুত রবিনের দিকে তাকাল একবার কিশোর। নামগুলো মনে আছে?
ঘন কালো চুলে আঙুল চালাল ডিয়েগো, ওর আবার মাথা ঝাকাল। আছে। শের-লক হোমস আর রবিন হুড।
নোট বই বের করে ফেলেছে রবিন। লিখতে লিখতে বিড়বিড় করল, শারলক হোমস, রবিন হুড।
ক্যাপ্টেন কিড আর স্কারফেস, যোগ করল ডিয়েগো। স্কারফেসের এক চোখ কানা।
নাম দুটো দ্রুত লিখে নিল রবিন। ছটা হলো। আর ছিল?।
মাথা নাড়তে গিয়েও নাড়ল না ডিয়েগো, উজ্জল হলো চোখ। হ্যাঁ, হ্যাঁ, ছিল। কালোটা। ব্লাকবিয়ার্ড দা পাইরেট। সুন্দর কথা বলে। ওই একটা ছাড়া বাকি ছ-টার মাথাই হলুদ। র্যাকবিয়ার্ডের কালো।
ব্ল্যাকবিয়ার্ড দা পাইরেট! লিখে নিল রবিন। ওটার কথা বলেছিলেন বটে মিস্টার ফোর্ড। কিশোর, কি মনে হয়? সাতটাই জড়িত?
পরে জানা যাবে, জবাব দিল কিশোর। ডিয়েগো, মোটা লোকটা ওই কাকাতুয়াগুলোর জন্যেই এসেছিল?
সি।
তোমার চাচা দিয়েছেন?
না, সিনর, বিষণ্ণ ছায়া নামল আবার ডিয়েগোর চেহারায়। তার আগেই বিক্রি করে দিয়েছে চাচা। লোকটা হাজার ডলার দিতে চাইল, কিন্তু পাখি কোথেকে দেবে চাচা? দিতে পারলে তো খুবই ভাল হত, এতগুলো টাকা। রেগে গিয়ে চাচাকে যাচ্ছেতাই গালাগাল করল লোকটা। কোথায় বিক্রি করেছে, ঠিকানা জিজ্ঞেস করল। চাচা তা-ও বলতে পারল না। কি করে বলবে, বলুন? চাচা তো আর লেখাপড়া জানে না। তাছাড়া কখন কোথায় কোন পাখি বিক্রি করেছে, সব কথা কি মনে থাকে ফেরিওলার?
তারমানে বাকি কাকাতুয়াগুলোরও খোজে রয়েছে হাইমাস, দুই সহকারীর দিকে চেয়ে বলল কিশোর। মূল্যবান তথ্য।
তা বলতে পারো, একমত হলো মুসা। একটা খুঁজতে গিয়ে দুটো হারানোর খবর পেলাম। যোগ হলো আরও পাঁচটা। সবগুলোই খুঁজব, না?
ঘুরিয়ে বলল কিশোর, যেহেতু সাতটা পাখিই এ-রহস্যের অংশ, খুঁজে তো বের করতেই হবে।
কিন্তু শুধু বিলি শেকসপীয়ার আর লিটল বো-পীপকে খুঁজে দেয়ার কথা বলেছি। আমরা। এ-রহস্যের মীমাংসার দায়িত্ব তো নিইনি।
রবিন বুঝতে পারছে, অযথা মুখ খরচ করছে মুসা। মুসাও জানে সেকথা। একবার যখন কিশোর পাশা রহস্যের গন্ধ পেয়েছে, ওটার সমাধান না করা পর্যন্ত তার আর স্বস্তি নেই। রক্তের গন্ধ পেয়েছে ব্লডহাউণ্ড, ডেকে তাকে আর ফেরানো যাবে না, শেষ মাথায় পৌছাবেই।
ডিয়েগোর দিকে ফিরল কিশোর। টেলিফোন করলেই তো পারতে? কষ্ট করে রকি বীচে এলে কেন?
ভেবেছি, পুরস্কার মিলবে। জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যাব, তাই গাড়ি নিয়ে এসেছি। তাছাড়া, সিনর, ফোন করার পয়সা তো নেই আমার কাছে।
একে অন্যের দিকে তাকাল তিন গোয়েন্দা। একটা ফোন করার মত পয়সা থাকে না, এমন লোকও আছে দুনিয়ায়, বিশ্বাস করতে পারছে না। তৃতীয় বিশ্বের কিছু দরিদ্র দেশের কথা মনে পড়ল কিশোরের, বাংলাদেশের কথা মনে পড়ল, করুণ কিছু ছবি দেখেছিল পত্রিকায়। দেখে বিশ্বাসই করতে পারেনি সে, এতখানি মানবেতর জীবন যাপন করে অনেক মানুষ, ভেবেছে অতিরঞ্জিত। কিন্তু আজ বিশ্বাস করল। বাংলাদেশ কেন? এই আমেরিকাতেও তো রয়েছে সে-রকম দৃষ্টান্ত। ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আর বন্যাপীড়িত অসহায় বাংলাদেশীদের কথা ভেবে মন খারাপ হয়ে গেল তার। তাছাড়া, রোজই শুনছে, দুর্বিষহ রাজনৈতিক গোলমাল চলছে বাংলাদেশে। একে তো সাংঘাতিক দরিদ্র দেশ, তারপর প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তার ওপর এই গণ্ডগোল কতখানি বিপর্যস্ত করে তুলছে দেশের মানুষকে, ভাবতেই রোম খাড়া হয়ে গেল। তার। কথা বলতে পারল না কয়েক মুহূর্ত।
কিশোরকে বার কয়েক ঢোক গিলতে দেখল রবিন, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। এই প্রথম ভাল করে তাকাল ডিয়েগোর শরীরের দিকে। অস্বাভাবিক রুগ্ন দেহ, হাড়িসর্বস্ব। বলল, তুমি, বেশ কিছু মূল্যবান তথ্য জানিয়েছ, পুরস্কার তোমার পাওনাই হয়েছে। গাড়িটা খুঁজছিলাম আমরা…আচ্ছা, মোটা লোকটা, হাইমাসকোথায় থাকে বলতে পারো কিছু?
মোটা লোকটার নাম হাইমাস? উজ্জল হলো ডিয়েগোর মুখ। ভোলা পকেট হাতড়ে বের করে আনল একটা কার্ড। লোকটা যাওয়ার সময় দিয়ে গেছে চাচাকে, কার্ডটা কিশোরের দিকে বাড়িয়ে দিল সে। বলে গেছে, কাকাতুয়ারগুলোর খোঁজ পেলে যেন এই ঠিকানায় জানাই।
গলা বাড়িয়ে কার্ডের ওপর ঝুঁকে এল তিন গোয়েন্দা।
এই সময় ছাপার মেশিনের ওপর ঝোলানো লাল আলোটা জুলতে-নিভতে শুরু করল, তারমানে হেডকোয়ার্টারে ফোন বাজছে।
ডিয়েগো, বলল কিশোর, ঘুরে বসে চোখ বন্ধ করো।
অবাক হলো ছেলেটা, কিন্তু যা বলা হলো করল।
মুসা, রবিন তোমরা থাকো। আমি দেখে আসি।
দুই সুড়ঙ্গের মুখের ঢাকনা সরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল কিশোর। আবার জায়গামত লাগিয়ে দিল ঢাকনাটা।
ফোন তুলতেই ভেসে এল এক মহিলা-কণ্ঠ, হালো, খুব নিচু গলায় বলল, যেন তার কাছাকাছি কেউ শুনে ফেলবে, তুমি কি কিশোর পাশা? মিস্টার হাইমাসের গাড়ি খুঁজছ?
হ্যাঁ, ম্যাডাম। বলতে পারেন কোথায় আছে?
এমন এক জায়গায় আছে, যেখানে কেউ খুঁজে পাবে না, রাগ বোঝা যাচ্ছে। তুমিও খোঁজার চেষ্টা কোরো না, শুনছ? উনি খুব বদরাগী, তাঁর কাজে বাধা দিলে বিপদে পড়বে। ওঁর কাজে নাক গলাবে না, ব্যস, এই বলে দিলাম।
কিশোর কিছু বলার আগেই লাইন কেটে গেল।
ওয়ার্কশপে ফিরে এল কিশোর। বলল, ডিয়েগোর পুরস্কার দিয়ে দেব আমরা। তার বাড়ি যাব, আঙ্কেল স্যানটিনোর সঙ্গে কথা বলব। ঠিক পথেই এগোচ্ছি আমরা, বোঝা যাচ্ছে, তার শেষকথাটা রহস্যময় মনে হলো অন্য দুই গোয়েন্দার কাছে।
দুই ঘণ্টা পর। দুটো গাড়ির বিচিত্র এক মিছিল দ্রুত এগিয়ে চলেছে উপকূলের মহাসড়ক ধরে, দক্ষিণে। আগেরটা কুচকুচে কালো, সোনালি অলঙ্করণ, রাজকীয় রোলস-রয়েস। অবশ্যই হ্যানসন চালাচ্ছে। পেছনের সীটে বসেছে কিশোর, মুসা আর ডিয়েগো। রবিন গেছে লাইব্রেরিতে, চাকরিতে।
উত্তেজনা চেপে রাখতে পারছে না ডিয়েগো। লাল হয়ে উঠেছে গাল। বার বার ছুঁয়ে দেখছে গাড়ির ভেতরের সোনালি প্লেটিং, পালিশ করা গদির চামড়া। সোনালি রঙের ওয়্যারলেস টেলিফোনটা দেখে এমন ভাব করল, যেন ওটা অপার্থিব, স্বপ্ন দেখছে, ধরার জন্যে হাত বাড়ালেই মিলিয়ে যাবে। বিড়বিড় করল, সোনালি আউ-টো। এত সুন্দর! চড়তে পারব কল্পনাই করিনি।
এক উচ্ছ্বসিত মুহূর্তে জানাল দুই গোয়েন্দাকে, বড় হয়ে সে গাড়ির মেকানিক হবে।
রোলস-রয়েসের পেছনে আসছে স্যালভিজ ইয়ার্ডের ঝরঝরে ঐতিহাসিক (মুসা নামটা রেখেছে। শব্দটা অনেক শুনেছে কিশোরের মুখে। বাংলাদেশে কিছু হলেই নাকি সেটা ঐতিহাসিক হয়ে যায়, তাহলে ট্রাকের ঐতিহাসিক হতে বাধা কোথায়?) ট্রাক, চালাচ্ছে বোরিস। তাতে বোঝাই করা হয়েছে ডিয়েগোর পুরস্কারের টাকায় কেনা মালপত্র। ইয়ার্ড থেকেই কিনেছে সে। কি জিনিস কিনতে চায় ডিয়েগো, শুনে অবাক হয়েছিল তিন গোয়েন্দা। কিছু শক্ত তক্তা, একটা পুরানো আস্ত দরজা, একটা জানালা, কিছু তারকাটা আর টুকিটার্কি আরও কিছু জিনিস, সবই ঘর মেরামতের কাজে লাগে। মেরিচাচীর কানে কানে তখন কি ফিসফিস করেছে। কিশোর। সব জিনিসের দাম অসম্ভব কমিয়ে ধরেছেন চাচা, কিন্তু সেটা বুঝতে দেননি ডিয়েগোকে। বলেছেন, পুরানো জিনিসের দাম ওরকমই। এতকিছু কেনার পরেও পুরস্কারের পাঁচ ডলার বেঁচে গেছে, পকেটে বার বার হাত ঢুকিয়ে দেখছে ডিয়েগো, তার জন্যে এটা এখন রাজার সম্পদ।
জিনিসপত্র সব ভোলার পর সমস্যা দেখা দিয়েছিল ডিয়েগোর গাধা আর গাড়িটা নিয়ে। কি ভাবে নেয়া হবে? সমাধান করে দিয়েছে বোরিস আর রোভার। ওই দুটোও তুলে দিয়েছে ট্রাকের পেছনে। রাস্তায় লোক হাঁ করে দাড়িয়ে যাচ্ছে, কৌতূহলী চোখে দেখছে বিচিত্র মিছিলটাকে।
একটা অত্যন্ত দরিদ্র পল্লীতে এসে ঢুকল রোলস-রয়েস। ছোট ছোট কুঁড়ে, ঠেকাইকা দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে কোনমতে, বেশির ভাগই ভাঙা। একপাশে ফসলের মাঠ, ছোট। এখানেই থাকে ডিয়েগো আর তার চাচা।
গাড়ি দেখে হই-চই করে এসে ঘিরে ধরল বাচ্চা ছেলেমেয়ের দল।
জানালা দিয়ে হাত বের করে ওদের উদ্দেশ্যে নাড়ল ডিয়েগো। রোসি! চেঁচিয়ে নাম ধরে ডাকল সে। টিরাননা! নোলিটা! আমি, আরে আমি, ডিয়েগো। সোনালি আউ-টোতে চড়ছি।
হাঁকডাক শুনে ঘর থেকে আরও ছেলেমেয়ে বেরিয়ে এল, পঙ্গপালের মত ছেকে ধরল। গাড়ি থামাতে বাধ্য হলো হ্যানসন, পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে বাচ্চারা।
সবাই ছুঁয়ে দেখতে চায় রোলস-রয়েস।
তীক্ষ্ণ কণ্ঠে হুশিয়ার করল ওদেরকে ডিয়েগো, স্প্যানিশ ভাষায় ধমক-ধামক দিল। পিছিয়ে গেল ওরা।
এগোব, মাস্টার পাশা? অনুমতি চাইল হ্যানসন। আশ্চর্য শান্ত মেজাজ। অন্য ড্রাইভার হলে রেগে বাচ্চার দলকে গালাগাল শুরু করত এতক্ষণে।
না, পেছনে তাকিয়ে রয়েছে ডিয়েগো। খানিকটা ভোলা জায়গার পর পড়ো পড়ো একটা কুঁড়ে, তার পেছনে ক্ষত-বিক্ষত একটা গ্রীন হাউস। ওটাই আমাদের ঘর। গাড়ি নেয়ার দরকার কি? হেঁটেই তো যেতে পারি। পথও খুব খারাপ। এত সুন্দর গাড়িটা চোট পাবে, গদিমোড়া দেয়ালে হাত বোলাল সে।
প্রস্তাবটা মনে ধরল কিশোরের। নেমে এল তিন কিশোর।
থ্যাংক ইউ, হ্যানসন, কিশোর বলল। গাড়ি আর লাগবে না। ট্রাকে করেই ফিরতে পারব। আপনার আয় কষ্ট করে লাভ নেই? চলে যান।
বোরিস ট্রাক নিয়ে পৌঁছেছে।
তাকে বলল কিশোর, আপনি ওই বাড়িটার সামনে যান। আমরা যাচ্ছি।
স্বভাব-খসখসে গলায় হোকে (ও-কে) বলে এগোল বোরিস।
গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে চলে গেল হ্যানসন।
মেকসিকো থেকে যখন এল চাচা, পকেট খালি, হাঁটতে হাঁটতে বলল ডিয়েগো। এখানেই এসে উঠল। ওই বাড়িটা মাত্র পাঁচ ডলারে ভাড়া নিয়েছে চাচা। মাস মাস সেটা দিতেই অবস্থা কাহিল। এখন একমাসের ভাড়া আছে আমার পকেটে। কিছুদিন আর খাটতে হবে না চাচাকে, শুয়ে থাকতে পারলে তার কাশি ভাল হয়ে যাবে। তখন আবার ভালমত কাজ করতে পারবে।
বাড়ির পেছন দিক দিয়ে এসেছে ওরা, তাই এতক্ষণ কালো গাড়িটা চোখে পড়েনি। সামনের দিকে রাস্তায় দাড়িয়ে আছে ওটা। না, রেঞ্জার নয়, সেডান।
ভ্রূকুটি করল ডিয়েগো। গাড়ি নিয়ে কে আবার এল? কণ্ঠস্বরেই বোঝা গেল, ব্যাপার সুবিধের লাগছে না তার। দৌড় দিল।
পেছনে ছুটল কিশোর আর মুসা। কুঁড়ের আরও কাছে আসতেই ধমক শোনা গেল।
হাইমাস, গতি বাড়াল মুসা।
বল, বলছে লোকটা, জলদি বল, শুয়োর কোথাকার, নইলে ঘাড় মটকে দেব!
চাচা! চেঁচিয়ে উঠল ডিয়েগো।
দরজার জায়গায় কিছুই নেই, খোলা। ছুটে ঢুকে পড়ল ডিয়েগো। পেছনে দুই গোয়েন্দা।
মলিন বিছানায় চিত হয়ে আছে একজন লোক, নিশ্চয় আঙ্কেল স্যানটিনো। তার ওপর ঝুকে রয়েছে মোটা হাইমাস।
মনে কর ব্যাটা! আবার চেঁচাল হাইমাস। কোথায় বেচেছিস? আরগুলোর কথা নাহয় বাদই দিলাম, কিন্তু ব্ল্যাকবিয়ার্ডের কথা তো মনে থাকার কথা। অনেক ঘুরেছিস ওটা নিয়ে, সবশেষে বেচেছিস। নিশ্চয় মনে আছে তোর, বলছিস না। সেফ শয়তানী। চারটে পেয়েছি। আরগুলো কোথায়?
শিকারী কুকুরের মত গিয়ে লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ডিয়েগো।
কিন্তু টলল না দানব। হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেলে দিল রোগা ছেলেটাকে, যেন পোকা তাড়াল। তারপর ঘুরল ঝটকা দিয়ে।
আবার এসে ঝাপ দিল ডিয়েগো।
শার্টের কলার চেপে ধরে চোখের পলকে তাকে শূন্যে তুলে ফেলল হাইমাস। অসহায় ভঙ্গিতে ঝুলে থেকে হাত-পা ছুঁড়তে লাগল ছেলেটা। মুসা আর কিশোরের দিকে চেয়ে শাসাল, খবরদার! এগোবে না। পিচকিটার ঘাড় মটকে দেব তাহলে।
থেমে গেল মুসা। কিশোরও দাড়িয়ে পড়ল।
রাগে জ্বলছে হাইমাসের চোখ। জানোয়ারের মত ঘড়ঘড় আওয়াজ বেরোচ্ছে কণ্ঠ থেকে। কলার ধরে আঁকাচ্ছেডিয়েগোকে।
সইতে পারল না পুরানো কাপড়, শার্টের কলার ছিড়ে থুপ করে মাটিতে পড়ে গেল ডিয়েগো। পড়েই দু-হাতে পা জড়িয়ে ধরল হাইমাসের।
লাথি মেরে পা ছাড়ানোর চেষ্টা করল হাইমাস, পারল না। জোঁক হয়ে গেছে যেন ডিয়েগো।
এই সুযোগ। লাফিয়ে উঠল মুসা। মাথা নিচু করে ছুষ্টি এল সে। তার বিখ্যাত কৌশল প্রয়োগ করল হাইমাসের ভূঁড়িতে।
কেঁপে উঠল যেন পাহাড়। শক্ত খুলির প্রচণ্ড আঘাতে হাঁউক করে উঠল হাইমাস। টলমল করেও সামলে নিল কোনমতে, পড়ল না।
মুসার মাথার এক গুঁতো খেয়েই বুঝে গেছে হাইমাস, ব্যাপার সুবিধের নয়। প্রাণপণে লাথি মেরে ডিয়েগোকে ছাড়িয়েই দৌড় দিল দরজার দিকে। পথরোধ করল কিশোর। কিন্তু লোকটার তুলতুলে শরীরে মোষের শক্তি। এক ধাক্কায় তাকেও ফেলে দিয়ে বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে।
কিশোরকে টেনে তুলতে গিয়ে দেরি করে ফেলল মুসা।
ছুটে বাইরে বেরোল তিন কিশোর।
স্টার্ট নিয়েছে ততক্ষণে কালো সেডান।
বোরিসের ট্রাকাটাও এসে থামল। কিন্তু লাভ নেই। মাল বোঝাই ঝরঝরে ট্রাক নিয়ে অনুসরণ করার কোন মানে হয় না, ধরা যাবে না সেডানটাকে।
ইস, আফসোফ করল মুসা, বোরিস নামা পর্যন্ত যদি আটকে রাখা যেত ব্যাটাকে…
হ্যানসন থাকলেও হত, পিছু নিতে পারতাম, হাঁপাচ্ছে কিশোর। কি আর করা। তবে ব্যাটার কার্ড আছে আমাদের কাছে, নামধাম আছে। কদিন পালিয়ে থাকবে? দেখেছ, কেমন রেগে যায়?
হাইমাস না ওটা, হিপোপটেমাস, মাথা ডলছে মুসা। ভুড়ি তো না, মনে হলো রবারের ব্যাগের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিতা, ব্যাটা রাগলে আমাদের কি লাভ?
ভয় থেকেই জন্ম নেয় রাগ, ব্যাখ্যা করল কিশোর। ভয় পেয়েছে ব্যাটা। আর তোমার গুতো খাওয়ার পর তো আরও চমকে গেছে।
আমাদের ভয় পায় বলতে চাইছ? মুসা বলল। আর আমরা?
নারভাস, বাট কনফিডেন্ট, অন্যমনস্ক হয়ে গেছে কিশোর।
কি বললে এটা? ইংরেজি না গ্রীক?
জবাব না দিয়ে ঘুরল কিশোর।
চাচাকে পানি খাওয়াচ্ছে ডিয়েগো।
ঘরে একটা মাত্র নড়বড়ে চেয়ার, উল্টে পড়ে আছে। তুলে সোজা করে রাখল। ওটা মুসা।
তাদের দিকে ফিরে তাকাল স্যানটিনো। কাশল কয়েকবার। তারপর বলল, তোমরা আমাকে বাঁচিয়েছ। নইলে মেরেই ফেলত। আবার কাশতে শুরু করল।
থাক থাক, কথা বলবেন না, হাত তুলল কিশোর।
ব্ল্যাকবিয়ার্ডের খোঁজ নিতে এসেছিল মোটকাটা, বলল ডিয়েগো। মনেই রাখতে পারে না কিছু চাচা, বলবে কি? তবে সেদিন বলেছিল, কোন এলাকায় নাকি কোন একটা বাড়ি থেকে তিন-চার ব্লক দূরে এক মহিলার কাছে বিক্রি করেছে, পাঁচ ডলারে। আর কেউই কিনতে চায়নি, তাই এত কমে দিয়ে এসেছে।
মোটকা বেশি রেগে গিয়েছিল, বলল মুসা। কিছু একটা ব্যাপার আছে। পাখিগুলোর। ওই ব্যাটা জানে।
এবং ব্যাপারটা খুব জরুরী, যোগ করল কিশোর, খুব মূল্যবান তার কাছে। কিন্তু কি…
বাধা দিল বোরিস। দরজায় এসে দাড়িয়েছে। জিজ্ঞেস করল, মাল নামাব?
হ্যাঁ, নামান, বলল কিশোর। বোরিসের পেছনে এসে দাঁড়ালেন এক বয়স্ক মহিলা, হাতে কার্ডবোর্ডের একটা বাক্স, তাতে ঘোট ঘোট অসংখ্য ছিদ্র, ঝাঝরির মত।
পথে হাত তুললেন মহিলা, বলল বোরিস, এদিকেই আসছিলেন। তুলে নিলাম। সেজন্যেই আমার আসতে দেরি হয়েছে।
কই, সে ধোকাবাজটা কই? দুই গোয়েন্দার দিকে চেয়ে বললেন মহিলা। ফেরিওলার বাচ্চা, স্যানটিনো না ফ্যানটিনো?
মুসা আর কিশোরকে সরিয়ে এগিয়ে এল ডিয়েগো। চাচার শরীর খারাপ। কেন?
টাকা ফেরত চাই! কড়া গলায় বললেন মহিলা। পাখির ব্যবসা করে না ঠকবাজি করে? কাকাতুয়া বলে দিয়ে এসেছে একটা স্টারলিং। ভাগ্যিস আমার জামাই এসেছিল। পাখি চেনে। বলল এটা কাকাতুয়া না, হাতের বাক্সটা ডিয়েগোর হাতে ধরিয়ে দিলেন তিনি। দাও, আমার পাঁচ ডলার ফেরত দাও। নইলে পুলিশের কাছে যাব।
মুখ কালো হয়ে গেল ডিয়েগোর। বাক্সটা মুসার হাতে দিয়ে পকেট থেকে বের করল পাঁচ ডলার, দিয়ে দিল মহিলাকে। এই যে, নিন আপনার টাকা। যান এখন।
হুঁ, এবারের মত মাপ করে দিলাম, গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেলেন মহিলা।
দুই গোয়েন্দার দিকে ফিরল ডিয়েগো। নিশ্চয় ব্ল্যাকবিয়ার্ড। কি পাখি ওটা, আমিও চিনি না, চাচাও না। কোন ধরনের কাকাতুয়াই হবে।
মুসার কাছ থেকে নিয়ে বাক্সটা খুলল সে। ফুড়ুত করে বেরিয়ে সোজা গিয়ে মুসার কাধে বসল কালো পাখিটা, উজ্জ্বল হলদে ঠোর্ট।
স্টারলিং কোথায়? চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। জামাইও পাখি চেনে না। এটা ময়না। কাকাতুয়ার চেয়ে ভালভাবে কথা শেখে, বলতে পারে। ভাল ট্রেনিং পাওয়া ময়নার দাম কাকাতুয়ার চেয়ে বেশি।
আয়্যাম ব্ল্যাকবিয়ার্ড দা পাইরেট! খসখসে কঠিন কণ্ঠে বলে উঠল ময়না, যেন সত্যিই একজন জলদস্য।. আহ্যাভ বারিড মাই ট্রেজার হোয়্যার ডেড ম্যান গার্ড ইট এভার। ইয়ো-হো-হো অ্যাণ্ড অ্যা বটল অভ রাম! তারপর মুখ খারাপ করে গাল দিল কয়েকটা, যা জলদস্যুকেই মানায়।
ব্ল্যাকবিয়ার্ড! বলল উত্তেজিত কিশোর। এটার জন্যেই খেপে গিয়েছিল তখন হাইমাস।
খুব খিদে পেয়েছে যেন ময়নাটার, তাকাল এদিক ওদিক।
ধারেকাছে কোন খাবার নেই, মুসার কানটা খুব লোভনীয় মনে হলো তার কাছে। দিলে কষে এক ঠোকর, লতি ছিড়ে আনার জন্যে।
আউফ, মেরে ফেলেছেরে! বলে মুসা দিল চিৎকার।
ভয় পেয়ে উড়ে গেল ময়নাটা, বেরিয়ে গেল খোলা দরজা দিয়ে।
গেল, মাথা কাত করল কিশোর। মুসা, একটা মূল্যবান সূত্র তাড়ালে।
আমি কি করব? রুমাল দিয়ে কানের লতি চেপে ধরেছে মুসা। ফুটো করে ফেলেছে কান। এই দেখো না, রক্ত।
প্রায় ছুটে বাইরে বেরোল কিশোর।
কিন্তু কোথাও দেখা গেল না ময়নাটাকে। চলে গেছে।
৬
ইংরেজি ভাল বলতে পারে না স্যানটিনো, তাই কিশোরের সঙ্গে কথা বলার সময় দোভাষীর কাজটা নিতে হলো ডিয়েগোকেই।
শুরুতে কয়েকটা সাধারণ প্রশ্ন করল কিশোর, মাথা নেড়ে শুধু সি সি, করল স্যানটিনো।
তারপর আরেকটা প্রশ্নের জবাবে চাচার হয়ে ডিয়েগো বলল, দু-বছর আগে এখানে এসেছে চাচা। মেকসিকো থেকে এসেছে গাধার গাড়িতে চড়ে। হ্যাঁ, ডিয়েগোই নিয়ে এসেছে। চাচা মালীর কাজ খুব ভাল জানে, বিশেষ করে ফুল চাষে ওস্তাদ। কিন্তু হলিউডে এসে কোন কাজ পেল না। তারপর একজন বলল, ফুলের ব্যবসা করতে। খোঁজ করতে করতে চাচা চলে এল এখানে, ভাঙা গ্রীনহাউসটার কথা শুনে। হাউসের বেশির ভাগ কাচই ভাঙা। তবু দেখেটেখে চাচার মনে হলো, কোন কোন জাতের ফুল জন্মানো সম্ভব। মাসিক পাঁচ ডলারে ভাড়া নিয়ে নিল।
পুরানো টিন জোগাড় করে লাগাল ভাঙা কাচের জায়গায়, বাতাস আর তাপ মোটামুটি ঠেকানো গেল এতে। ভাল জাতের দুর্লভ কিছু ফুলের চাষ করল ভেতরে, বাইরে লাগাল সাধারণ ফুল, আবহাওয়া আর তাপমাত্রার কমবেশিতে যেগুলোর কিছু হয় না। সেই ফুল গাধার গাড়িতে করে শহরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে, খাওয়াপরা চলে যেত কোনমতে।
চলে যাচ্ছিল। এই সময় একদিন লম্বা, রোগা এক লোক এল এখানে। তার নাম ক্যাপ্টেন লঙ জন সিলভার। রোগে ভুগে কাহিল, টাকাপয়সা নেই। এসে থাকতে চাইল। লোকটার অবস্থা দেখে মানা করতে পারল না চাচা।
সিনর সিলভারের সঙ্গে ছিল একটা নাবিকদের ব্যাগ, তাতে তার পুরানো কাপড়-চোপড়, আর একটা বাক্স। ধাতুর তৈরি, চ্যাপ্টা। এই এত বড়, হাত ছড়িয়ে দেখাল ডিয়েগো, বাক্সটা কত বড় ছিল।
সি সি, বলে মাথা নাড়ল স্যানটিনো, বোঝাল, ডিয়েগো ঠিকই বলেছে।
চোদ্দ ইঞ্চি বাই চব্বিশ, মনে মনে দ্রুত হিসেব করে নিয়ে বিড় বিড় করল কিশোর। হ্যাঁ, বলো, তারপর?
শক্ত তালা লাগানো থাকত বাক্সটায়, বলল ডিয়েগো। মাথার নিচে রেখে ঘুমাত। রোজ রাতে ডালা খুলে বাক্সের ভেতর তাকাত। খুব সুখী মনে হত তখন তাকে, মুখে হাসি ফুটত।
আবার মাথা নাড়ল স্যানটিনো, সি, সি। খুব সুখী।
চাচা একদিন সিনর সিলভারকে জিজ্ঞেস করল, বাক্সে কি আছে, ঘন চুলের বোঝায় আঙুল চালাল ডিয়েগো, মনে করার চেষ্টা চালাচ্ছে। লোকটা রহস্যময় হাসি হেসে বলল : বাক্সে আছে রামধনুর একটা টুকরো, তার তলায় একপাত্র সোনা।
রামধনুর একটা টুকরো, তার তলায় এক পাত্র সোনা, ডিয়েগোর কথার প্রতিধ্বনি করল যেন কিশোর, ভুরু কুঁচকে গেছে। রহস্যময় বর্ণনা। হ্যাঁ, তারপর?
চাচা অসুখে পড়ল, ভীষণ কাশি। আমাকে আসার জন্যে খবর পাঠাল মেকসিকোয়, তাকে দেখার কেউ ছিল না এখানে। এলাম। কিন্তু ফুলচাষের ব্যাপারে সাহায্য করতে পারলাম না, কাজ জানি না। আমাকে এনেও বিশেষ লাভ হয়নি চাচার।
কি বলিস লাভ হয়নি? বাধা দিয়ে ভাঙা ইংরেজিতে বলল স্যানটিনো। তুই এলে, আমাকে না দেখলে তো এতদিনে মরে যেতাম।
চাচা বাড়িয়ে বলে, আমাকে ভালবাসে তো, উজ্জ্বল হলো ডিয়েগোর মুখ। যাই হোক, সিনর কিশোর, আমি এসেও সিনর সিলভারকে দেখেছি। চাচার চেয়ে বেশি অসুস্থ। কি অসুখ জিজ্ঞেস করলাম। শুধু বলল, এমন এক অসুখ, যা কোনদিন সারবে না। কেন সারবে না, জিজ্ঞেস করলাম। বাক্স খুলে সোনার পাত্র থেকে সোনা বিক্রি করে ভাল ডাক্তার দেখানোর পরার্মশ দিলাম। হাসল সে। কিন্তু আমার মনে হলো, হাসি,নয়, কাদল। বলল, দুনিয়ার তাবৎ সোনা বিক্রি করেও তার রোগ সারানো যাবে না।
ও বলল… লম্বা দম নিল ডিয়েগো, মনে করার চেষ্টা করছে ঠিক কি কি বলেছিল সিলভার। ও বলল তাছাড়া পাত্রের সোনা বিক্রিও করা যাবে না। নাম ভাড়িয়ে বেআইনী ভাবে আমেরিকায় ঢুকেছে সে। বেচতে গিয়ে ধরা পড়লে পুলিশ আবার তাকে পাঠিয়ে দেবে ইংল্যাণ্ডে—যেখান থেকে এসেছে, যতদিন বাঁচে, রোজ রামধনুটা দেখে দেখে দুঃখ ভোলার চেষ্টা করবে। তারপর একদিন বলল, শিগগিরই চলে যাচ্ছে সে।
মেঘ জমল ডিয়েগোর সরল নিস্পাপ চেহারায়। তখন বুঝিনি কি বলতে চেয়েছে। একদিন বাইরে থেকে সাতটা খাঁচা নিয়ে ফিরল সিনর সিলভার, সাতটায় সাতটা কাকাতুয়া। সব কটার হলদে ঝুঁটি। গ্রীনহাউসে রেখে কথা শেখাতে শুরু করল ওগুলোকে।
দ্রুত চোখে চোখে তাকাল একবার কিশোর আর মুসা। কাকাতুয়া-রহস্যের অন্ধকারে আলোর আভাস দেখা যাচ্ছে।
পাখি পোষ মানাতে জানত সিনর সিলভার, বলে গেল ডিয়েগো। বলতে ভুলে গেছি, ব্ল্যাকবিয়ার্ডকে আগেই নিয়ে এসেছিল সে, প্রথম যখন এখানে আসে, তখনই কাঁধে ছিল কালো পাখিটা। সারাক্ষণ তার কাঁধে বসে থাকত পাখিটা, আর মুখ খারাপ করে গালাগাল করত, খুব মজা পেত সিনর সিলভার, জোরে জোরে হাসত।
গ্রীনহাউসে কাজ চলল। দিনের পর দিন ওখানে কাটাতে লাগল সিনর নয়, হয়েছে। সেজলেপলল কিশোর। ইসগুলো, ঠিক বুঝতাম, বুলি সিলভার। একেকটা কাকাতুয়ার একটা করে বিচিত্র নাম দিল। বিচিত্র সব বুলি শেখাতে লাগল। আমার কাছে খুব কঠিন মনে হত কথাগুলো, ঠিক বুঝতাম না।
হ্যাঁ, কঠিনই, মাথা দোলাল কিশোর। ইংরেজি সাহিত্য আর ইতিহাস থেকে নেয়া হয়েছে। সেজন্যেই দুর্বোধ্য ঠেকেছে তোমার কাছে। মনে আছে কোনও বুলি?
না, ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল ডিয়েগো। বুঝিইনি, মনে রাখব কি? একদিন একটা কাকাতুয়া মারা গেল। খুব মুষড়ে পড়ল সিনর সিলভার। শেষে আপনমনেই বলল, কি আর করা? ওটার জায়গা দখল করবে ব্ল্যাকবিয়ার্ড।
যাই হোক, ছ-টা কাকাতুয়া আর কালো কাকাতুয়াটাকে, তোমরা যেটাকে ময়না বলছ, বুলি শেখানো শেষ হলো। সিনর সিলভার নিজেও ময়নাটাকে বলত রেয়ার প্যারট।
কি জানি, নাক চুলকাল কিশোর। কোন ব্যাপারকে ঘোরাল করার জন্যেই হয়তো বলত। তারপর?
বিষণ্ণ ভঙ্গিতে হাত নাড়ল ডিয়েগো। তারপর আর কি? চলে গেল সিনর সিলভার। যেদিন কাকাতুয়াগুলোকে বুলি শেখানো শেষ করল, সে-রাতেই। সঙ্গে নিয়ে গেল তার প্রিয় বাক্সটা। ফিরে এল তিন দিন পর আরও কাহিল, আরও রোগা হয়ে। এসেই বলল, আবার চলে যাবে। বাক্সটা সঙ্গে আনেনি কেন জিজ্ঞেস করায় বলল, ওটা নিয়ে বিপদে পড়ব আমরা। নইলে নাকি যাওয়ার আগে আমাদেরকেই দিয়ে যেত।
লম্বা একটা চিঠি লিখল সে। পোস্ট করার জন্যে দিল আমার হাতে।
ঠিকানাটা মনে আছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
মাথা নাড়ল ডিয়েগো। না, সিনর কিশোর। অনেকগুলো টিকেট লাগাতে হয়েছে। খামের চারধারে লাল-নীল অনেক ডোরা ছিল।
এয়ার মেইলে গেছে মনে হচ্ছে, বলল মুসা। এত বেশি স্ট্যাম্প যখন লাগানো হয়েছে, ইউরোপে পাঠিয়েছে হয়তো।
কাহিল হয়ে বিছানা নিল সিনর সিলভার, বলল আবার ডিয়েগো। হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলাম। বলল দুনিয়ার কোন হাসপাতালই তাকে ভাল করতে পারবে না। বলল, আমরা তার সত্যিকার বন্ধু, আমাদের মাঝেই সে থাকতে চায়।
ভিজে এল ডিয়েগোর চোখ। খানিকক্ষণ কোন কথা বলতে পারল না।
অদ্ভুত লোক ছিল সিনর সিলভার, ধরা গলায় বলল ডিয়েগো। কিন্তু মনটা ছিল বড় ভাল। অদ্ভুত রসিকতা করত, ধাধা বলত, এমনকি কথাও বলত ঘুরিয়ে। আজব বুলি শিখিয়েছিল কাকাতুয়াগুলোকে। কিন্তু ভালবেসেছিল আমাদেরকে, আমরাও… কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে এল তার। সামলে নিয়ে বলল, সিনর সিলভার বলল, একজন খুব মোটা লোক আসবে। আমাদেরকে এক হাজার ডলার দিয়ে কাকাতুয়াগুলো কিনে নিয়ে যাবে। তারপর হাসতে শুরু করল। কাকাতুয়াগুলোকে কথা শেখানোই নাকি তার জীবনের সবচেয়ে বড় রসিকতা। তার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝিনি। বলল, এই রসিকতা নাকি ঘাম ঝরিয়ে ছাড়বে মোটা লোকটার। হাসতে হাসতেই ঘুমিয়ে পড়ল সে।
পরদিন সকালে আর জাগল না সিনর সিলভার, ঢোক গিলে চুপ হয়ে গেল ডিয়েগো।
দুই গোয়েন্দাও চুপ করে রইল। মেকসিকান ছেলেটার দুঃখ বুঝতে পারছে।
মোটা লোকটা আসেনি? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
মাথা নাড়ল ডিয়েগো। সিনর সিলভার আমাদের বন্ধু ছিল, তার লাশ দাফন করার ভারও পড়ল আমাদের ওপর। রাস্তার ওদিকে ছোট একটা গির্জা আছে। ওখানেই তাকে কবর দিলাম। টাকা ছিল না আমাদের কাছে, বাকিতেই সব কাজ সারতে হলো। মোটা লোকটার আসার অপেক্ষায় রইলাম। এক হপ্তা গেল, দুই হপ্তা গেল, তিন হপ্তা গেল, সে এল না। ওদিকে বাকি টাকার জন্যে চাপ দিচ্ছে লোকে। শেষে বাধ্য হয়ে কাকাতুয়াগুলো নিয়ে বেরোল চাচা। হলিউডে গিয়ে বিক্রি করে এল।
লোকে কাকাতুয়া পছন্দ করে দেখলাম। একদিনেই বিক্রি হয়ে গেল সব। টাকা খুব বেশি পাওয়া গেল না, দরাদরি করলে হয়তো যেত, কিন্তু সময় একদম ছিল না। তাড়াহুড়োয় যা পেল তাতেই দিয়ে চলে এল চাচা। সিনর সিলভারের কবরের দাম শোধ করল। ভেবেছিলাম, হাজার ডলার পেলে কুঁড়েটা ঠিক হবে… অনেকক্ষণ পর হাসি ফুটল ডিয়েগোর মুখে। যাই হোক, এখন আর দুঃখ নেই। দরজা-জানালা কিনে ফেলেছি। লাগিয়ে নিলেই হলো। চাচা ভাল হয়ে আবার ফুলের চাষ শুরু করবে। আপনাকে এক হাজার ধন্যবাদ, সিনর কিশোর।
তথ্য যা জানিয়েছ, তাতে আরও কিছু পাওনা হয়ে গেছে তোমার, আশ্বাস দিল কিশোর, ভেব না। আচ্ছা, শেষতক তো মোটা লোকটা এসেছে?
এসেছে, বলল ডিয়েগো।
সি, সি, মাথা নেড়ে ভাতিজার কথায় সায় জানাল স্যানটিনোও।
কাকাতুয়াগুলো বিক্রি করে ফেলার দুই হপ্তা পর এল লোকটা, জানাল ডিয়েগো। বেচে দিয়েছি শুনে রেগে লাল। বকাবকি শুরু করল চাচাকে, শাসাল। যেখান থেকে পারে এনে দিতে বলল। শেষে নরম হলো। অনুরোধ করতে লাগল, পারলে পায়ে ধরে। কি আর করি? শেষে পেট্রল স্টেশনে থেকে গিয়ে একটা ম্যাপ চেয়ে আনলাম। চাচা লেখাপড়া জানে না, ম্যাপের কিছুই বুঝল না। তার কাছ থেকে ধারণা নিয়ে অনুমানে বের করলাম, কোন এলাকায় পাখিগুলো বিক্রি করেছে। দেখালাম মোটা লোকটাকে, ম্যাপে। আর একদণ্ড দেরি করল না সে। রেঞ্জার হাঁকিয়ে চলে গেল।
যাওয়ার আগে কার্ডটা রেখে গেল। বলে গেল, কাকাতুয়াগুলোর কোন খবর পেলেই ফোনে জানাতে। কিন্তু কোথায় পাবে চাচা খবর? পেলে তো কাজের কাজই হত। একহাজার ডলার সোজা কথা? তবে ওই টাকা ছাড়াও বাঁচতে পারব আমরা; মাথা উঁচু করে বলল ডিয়েগো। বন্ধুর কবর দিয়েছি। ঘর মেরামতের ব্যবস্থা করেছি। কোনভাবে এ-মাসের ভাড়াও জোগাড় করব। ভাল হয়ে উঠে চাচা কাজে লাগবে। মোটকা সিনর তখন আর অপমান করার সাহস পাবে না চাচাকে।
তার শেষ কথাটায় না হেসে পারল না মুসা।
গভীর চিন্তায় মগ্ন কিশোর। ঘনঘন চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে। কাকাতুয়াগুলোর ব্যাপারে অনেক কথা জেনেছে, তবে এখনও অনেক কিছু জানা বাকি। ডিয়েগোকে প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল, এই সময় দরজায় দেখা দিল বোরিস।
ডিয়েগোর কাহিনীতে এতই মগ্ন ছিল দুই গোয়েন্দা, বোরিসের কথা ভুলে গিয়েছিল।
সব নামিয়েছি, জানাল বোরিস। যাওয়া দরকার। ইয়ার্ডে অনেক কাজ।
আরেকটু। হয়ে গেছে, বলল কিশোর। ট্রাকে লস অ্যাঞ্জেলেসের ম্যাপ আছে না?
কয়েকটা। লাগবে?
আপনি ট্রাকে বসুন গিয়ে। মুসার কাছে দিয়ে দিন।
ম্যাপ নিয়ে এল মুসা।
ডিয়েগো, ম্যাপ বিছিয়ে বলল কিশোর, দেখাও তো, কোন জায়গা?
খানিকক্ষণ দেখে নিয়ে এক জায়গায় আঙুল রাখল ডিয়েগো, মনে হয়, এখানে।
পেন্সিল দিয়ে একটা এলাকায় গোল বৃত্ত আঁকল কিশোর। ভাঁজ করে পকেট রেখে দিল ম্যাপটা।
থ্যাংকস, ডিয়েগো, বলল সে। বিলি আর বো-পীপকে কোথায় বিক্রি করেছেন তোমার চাচা, জানি। অন্যগুলোও দূরে কোথাও নয় নিশ্চয়। অনেক কথা জানা গেল তোমার কাছে, কিন্তু রহস্যের কোন কিনারা তো হলোই না, আরও জটিল হলো।
ঠিক বলেছ, আঙুল তুলল মুসা।
ইস, হাতে পেয়েও হারালাম ব্ল্যাকবিয়ার্ডকে… আফসোস করল কিশোর। যাকগে, যা গেছে তা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। হাত মেলাল ডিয়েগোর সঙ্গে। আশা করি, শিঘ্রী ভাল হয়ে যাবেন তোমার চাচা। আর হ্যাঁ, মোটকা যদি আবার বিরক্ত করতে আসে, সোজা পুলিশে খবর দেবে।
পুলিশ? জ্বলে উঠল ডিয়েগোর কালো চোখের তারা। মোটকা সিনর আবার এলে… বিছানার তলা থেকে মোটা একটা লাঠি বের করল সে। হাসপাতালে যাওয়ার অবস্থা করে ছেড়ে দেব।
হাসল তিনজনেই।
ছুটে চলেছে ট্রাক। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর।
কি ভাবছ? জবাব না পেয়ে কনুই দিয়ে বন্ধুর গায়ে তো দিল মুসা। হেই, কিশোর?
আঁ?।
কি ভাবছ?
কেসটা জটিল। –
শুধু জটিল? ।
না, বেশ জটিল।
কেন, মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার মত বলতে লজ্জা লাগছে?
না, লাগছে না, স্বীকার করল কিশোর। মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার মতই।
৭
পরদিন সকালে। ইয়ার্ডে কাজকর্ম বিশেষ নেই। মেরিচাচীকে বলে-কয়ে অনুমতি নিয়ে বোরিস আর রোভারকে ডিয়েগোদের ওখানে পাঠাল কিশোর। কুঁড়ে মেরামতের কাজে ছেলেটাকে সাহায্য করার জন্যে। ডিয়েগো আর তার চাচা, দুজনকেই খুব পছন্দ হয়েছে তার। ঠিকমত খেতে পায় না, এত গরীব, কিন্তু আত্মসম্মান বোধ কি প্রচণ্ড।
দুপুরের পর ফিরে এল দুই ব্যাভারিয়ান ভাই।
হাসিমুখে ট্রাক থেকে নামল বোরিস। হাতে কার্ডবোর্ডের একটা বাক্স। ওয়ার্কশপের কাছে কিশোরকে দেখে এগোল।
বাক্সটা দেখেই চিনল কিশোর। এটাতে করেই ব্ল্যাকবিয়ার্ডকে ফেরত দিয়ে গিয়েছিলেন মহিলা।
বাক্সটা বাড়িয়ে ধরল বোরিস। ডিয়েগো দিল।
নিয়ে মুসার হাতে দিল কিশোর।
পকেট থেকে একটা চিঠিও বের করে দিল বোরিস।
বাক্স আর চিঠি নিয়ে ওয়ার্কশপে ঢুকল তিন গোয়েন্দা।
দড়ি কাটো, মুসাকে অনুরোধ করল কিশোর।
বাক্সের দড়ি কেটে ডালা তুলতেই ফড়ফড় করে উঠল কালো ময়না, হলুদ ঠোঁট তুলে তাকাল মুসার দিকে।
আরিব্বাপরে! ব্ল্যাকবিয়ার্ড, চমকে সরে এল মুসা।
হেসে রবিনকে বলল কিশোর, চিঠিটা পড়ে তো কি লিখেছে।
পড়ল রবিন :
ডিয়ার সিনর কিশোর, সিনর ব্ল্যাকবিয়ার্ডকে পাঠালাম। গতকাল দুপুরের খাওয়ার সময় এসে হাজির। আপনারা আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। আরও একটা কারণে পাঠিয়ে দিলাম, সিনর মোটকা এসে কেড়ে নিয়ে যেতে পারে। চমৎকার একটা ঘর হয়েছে আমাদের, আপনাদের সৌজন্যে। এক হাজার ধন্যবাদ।
–ডিয়েগো রটরিজ।
রবিনের চিঠি পড়া শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ছিল যেন ময়নাটা, লাফিয়ে বেরিয়ে এসে বসল বাক্সের কিনারে। কৌতুহলী চোখে তাকাল অসাবধানে বাক্সের কোণে ফেলে রাখা মুসার একটা আঙুলের দিকে।
সময়মত খেয়াল করল মুসা, চেঁচিয়ে এক টানে সরিয়ে আনল আঙুল, না না, আর না! কালই শিক্ষা হয়ে গেছে আমার, লতিটা এখনও শুকায়নি। ব্যাটা তো একেবারে রক্তচোষা ডাকাত। মরলে নির্ঘাত ড্রাকুলা হবে।
তার কথার জবাবেই যেন বার কয়েক ডানা ঝাপটাল পাখিটা, গম্ভীর কণ্ঠে বলল, আয়্যাম ব্ল্যাকবিয়ার্ড দা পাইরেট। আহ্যাভ বারিড মাই ট্রেজার হোয়্যার ডেড ম্যান গার্ড ইট এভার। ইয়ো-হো-হো অ্যাণ্ড অ্যা বটল অভ রাম!
হ্যাঁ, বাবা, তুমি ডাকাতই।
হেসে উঠল অন্য দুজন।
এতে অপমানিত বোধ করল বোধহয় ব্ল্যাকবিয়ার্ড। আরও গম্ভীর হয়ে মুখ খারাপ করে গাল দিল গোটা দশেক।
হেডকোয়ার্টারে আলোচনায় বসেছে তিন গোয়েন্দা। তাদের মাথার ওপরে ঝোলানো খাঁচায় রাখা হয়েছে ব্ল্যাকবিয়ার্ডকে, খাঁচাটা বানানো হয়েছিল টমের জন্যে, সেই রেসিং হোেমার কবুতরটা। ময়নার ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, মহাজ্ঞানী সে, ছেলেদের সব কথা শুনছে যেন মন দিয়ে, দরকার হলেই উপদেশ কিংবা পরামর্শ দেবে।
বিলি শেকসপীয়ার আর লিটল বো-পীপ আছে হাইমাসের কাছে, কিশোরের কথার পিঠে বলল মুসা। ও-তো কাল বললই, চারটে কাকাতুয়া আছে তার কাছে। সোজা গিয়ে এখন তাকে বলতে পারি, মিয়া, পাখিগুলো ফেরত দিলে দাও, নইলে যাচ্ছি পুলিশের কাছে। আসলে তো যাব না পুলিশের কাছে, কারণ দুজনকে কথা দিয়ে এসেছি, কিন্তু সেটা হিপোকে বলতে যাব কেন?
হুমম, আনমনে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। সমস্যা আছে। একটা কথা ঠিক, মিস্টার সিলভার চাইছিল, কাকাতুয়াগুলো হাইমাস পাক।
সেটা সমস্যা হলো নাকি? রবিন প্রতিবাদ করল। সিলভার চেয়েছিল কিনে নিক। কিন্তু হাইমাস তো করেছে চুরি। মুসা ঠিকই বলেছে। চলো, গিয়ে পুলিশের ভয় দেখাই। সাথে বোরিস আর রোভারকে নিয়ে যাব। বেশি তেড়িবেড়ি করলে বাপের নাম ভুলিয়ে ছাড়বে মোটকার।
ঠিক আছে, কার্ড বের করে দিল কিশোর। এই যে, হাইমাসের টেলিফোন নম্বর।
পড়ল রবিন। লেখা আছে :
হাইম হাইমাস
রেয়ার আর্ট ডিলার
লণ্ডন-প্যারিস-ভিয়েনা
তার নিচে হাতে লেখা রয়েছে হলিউডের একটা অ্যাপার্টমেন্টের ঠিকানা আর টেলিফোন নম্বর।
আগে ফোন করো, রবিনকে বলল কিশোর। তোমাকে দেখেনি, গলা চিনবে। বলো, হলদে ঝুঁটিওলা একটা কাকাতুয়া আছে তোমার কাছে, বিক্রি করতে চাও। বলো, এক মেকসিকান ফেরিওলার কাছ থেকে কিনেছেনতোমার মা। হাইমাসের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করো, জিজ্ঞেস করো কোথায় দেখা করতে চায়। আমরা সবাই যাব ওখানে।
ডায়াল করল রবিন। ভাবছে, গুছিয়ে ঠিকমত বলতে পারবে তো মিছে কথাগুলো?
কিন্তু মিথ্যে বলার দরকার হলো না। অ্যাপার্টমেন্টের অপারেটর জানাল, দুই দিন আগে ঘর ছেড়ে চলে গেছেন মিস্টার অ্যাণ্ড মিসেস হাইমাস।
স্পীকারে কিশোর আর মুসাও ওপাশের কথা শুনতে পাচ্ছে। জিজ্ঞেস করো তো, কাকাতুয়াগুলোও নিয়ে গেছে কিনা? বলল কিশোর।
অপারেটর জানাল, তাঁদের সঙ্গে কোন কাকাতুয়া ছিল না। কারণ অ্যাপার্টমেন্ট কর্তৃপক্ষ ভাড়াটেদের পশুপাখি সঙ্গে রাখতে দেন না, এ-ব্যাপারে খুব কড়াকড়ি।
রিসিভার রেখে দিয়ে বলল রবিন, গেল। হাইমাসকে কোথায় পাওয়া যাবে, তা-ও জানি না এখন।
চমৎকার অগ্রগতি, নাক কুঁচকাল মুসা। খালি পিছিয়ে আসা।
এটা আপাতত হচ্ছে, সহজে নিরাশ হওয়ার ছেলে নয় কিশোর। এক ঠিকানায় নেই, নিশ্চয় আরেক ঠিকানায় আছে। এমন কোথাও যেখানে কাকাতুয়া রাখতে বাধা নেই। বেশি ভাড়ার বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে আর বোধহয় থাকবে না, ওসব জায়গায় নানারকম ফ্যাকরা, অন্তত তার জন্যে। তাছাড়া এমন কোথাও থাকবে না যেখানে কাকাতুয়াগুলো খুব সহজে চোখে পড়ে।
আর আমার কোন কথা নেই, হাত ডলছে মুসা। মাথায় কিছু ঢুকছে না।
রবিন কোন নতুন আইডিয়া দিতে পারো? নথি-গবেষকের দিকে তাকাল গোয়েন্দাপ্রধান।
হ্যাঁ, কিছু বললা, মূসাও অনুরোধ করল। কিন্তু দোহাই, কিশোরের মত কঠিন করে বলো না।
সবগুলো ঘটনা আবার গোড়া থেকে ভেবে দেখা দরকার। মাঝখান থেকে ঢুকেছি আমরা, বলল রবিন, মিস্টার ফোর্ডের কাকাতুয়া চুরি হওয়ার পর। অথচ
ব্যাপারটা শুরু হয়েছে আরও অনেক আগে থেকে।
ইয়ো-হো-হো অ্যান্ড অ্যা বটল রাম! কর্কশ চিৎকার করে উঠল ময়নাটা।
বলো, রবিন, হাত নাড়ল কিশোর, বলে যাও। অন্যের মুখে শোনার সময় চিন্তা করতে সুবিধে হয় আমার।
আমার ধারণা, রবিন বলল, সব কিছুর মূলে ওই ইংরেজ লোকটা, ক্যাপ্টেন লঙ জন সিলভার, শুরুটা সে-ই করেছে। কয়েক মাস আগে ডিয়েগোর চাচার ওখানে এসে উঠল। বেআইনী ভাবে পালিয়ে এসেছিল ইংল্যাণ্ড থেকে। সঙ্গে একটা চ্যাপ্টা বাক্স, যেটাতে মূল্যবান কিছু ছিল, যেটা বিক্রি করতে ভয় পাচ্ছিল সে।
কিশোরের দিকে তাকাল রবিন। কোন প্রতিবাদ বা মন্তব্য করল না কিশোর।
মারাত্মক কোন অসুখে ভুগছিল সিলভার, আবার বলল রবিন, যে অসুখ সারার নয়। দ্রুত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছিল লোকটা। মরার আগে বাক্সটা কোথাও লুকিয়ে ফেলল, তার গুপ্তধনসহ, সত্যিই যদি কোন গুপ্তধন থেকে থাকে বাক্সে। রেখে গেল সাতটা পাখি, বিচিত্র কিছু বুলি শিখিয়ে।
হ্যাঁ, সত্যি বিচিত্র, বিড়বিড় করল মুসা। মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার মত।
নোটবই দেখে বলল রবিন, লম্বা একটা চিঠি লিখে ডিয়েগোকে পোস্ট করতে দিল সিলভার। বলল, চিঠি পেয়ে মোটা এক লোক আসবে, স্যানটিনোকে হাজার ডলার দিয়ে নিয়ে যাবে পাখিগুলো। কিন্তু ঠিক সময়ে এল না হাইমাস। ঠেকায় পড়ে কাকাতুয়াগুলো তার আগেই বিক্রি করে দিতে বাধ্য হলো স্যানটিনো। এসে কাকাতুয়া না পেয়ে রেগে গেল মোটা লোকটা। ওগুলোর খোজে বেরোল। খুঁজে খুঁজে বের করে ফেলল চারটি পাখি। আমাদের জানামতে দুটো সে চুরি করেছে, অন্য দুটোও হয়তো তাই করেছে, কিংবা কিনে নিয়েছে। কি করেছে জানি না।
বিলি শেকসপীয়ার চুরি হওয়ার পর কেস হাতে নিয়েছি আমরা। এখন আমাদের কাছে রয়েছে ব্ল্যাকবিয়ার্ড, কোন কারণে এটাকেই বেশি মূল্যবান মনে করছে হাইমাস। গেল পাঁচটা, বাকি আর দুটো পাখির কোন খোঁজ নেই। কিন্তু পাখিগুলো লোকটার কাছে কেন এত মূল্যবান, জানি না আমরা। এ-ও জানি না, নতুন কোন জায়গায় উঠেছে হাইমাস। দম নিল রবিন। এ-যাবৎ যা যা ঘটেছে, এই হলো সারমর্ম। লম্বা লেকচার শেষ করল সে।
লুক আণ্ডার দা স্টোনস বিয়ণ্ড দা বোনস! ডানা ঝাপটে চেঁচিয়ে উঠল ব্ল্যাকবিয়ার্ড। আই নেভার গিভ আ সাকার অ্যান ইভন ব্রেক!
বেশ সাজিয়ে বলেছ, রবিনের দিকে চেয়ে মাথা কাত করল কিশোর। আমি আরও কিছু যোগ করছি। মিস্টার সিলভার বইয়ের পোকা ছিল, খুব পড়ত। নিজের ছদ্মনামটা কি রেখেছে খেয়াল করেছ? ক্যাপ্টেন লঙ জন সিলভার। ট্রেজার আইল্যাণ্ড বইয়ের সেই বিখ্যাত জলদস্যুর নামে নাম। ডাকাত সিলভারের কাঁধে থাকত একটা কাকাতুয়া, আর আমাদের মিস্টার সিলভারের কাঁধে ময়না।
তা-তো বুঝলাম, মুসা বলল। কিন্তু এসব কি প্রমাণ করে?
জলদস্যুর সঙ্গে নাম মিলিয়ে রাখাটা প্রমাণ করে, কিছু একটা চুরি করেছে সে, হয়তো তার সেই রহস্যময় গুপ্তধন, যেটা বিক্রি করার সাহস হয়নি। চুরি করেছে বলেই হয়তো।
তার সাহিত্যপ্রেমের আরেক নমুনা, নাম বাছাই, বলে গেল কিশোর। কিভাবে কাকাতুয়াগুলোর নামকরণ করেছে লক্ষ করেছ? বিলি শেকসপীয়ার, লিটল বো-পীপ, ব্ল্যাকবিয়ার্ড দা পাইরেট, শার্লক হোমস, রবিন হুড, ক্যাপ্টেন কিড।
এবং স্কারফেস, মনে করিয়ে দিল মুসা।
ওটা কোন বই থেকে নয়। মারপিটের কোন সিনেমার হীরো কিংবা ডাকাতের নাম হবে। যাই হোক, ওই একটা ছাড়া বাকি সব নামই বই থেকে নেয়া, ক্লাসিক থেকে, নয়ত ইতিহাস থেকে।
আচ্ছা, কথার মাঝেই বলে উঠল রবিন, তার গুপ্তধন কোন বইও তো হতে পারে? অনেক পুরানো দুর্লভ পুঁথি আছে, যে কোন যাদুঘর পেলে হাজার হাজার ডলার দিয়ে লুফে নেবে।
ভুরু কোঁচকাল কিশোর। হতে পারে। কিন্তু মনে করে দেখো, সিলভার অন্য কথা বলেছে। বলেছে? রামধনুর একটা টুকরোর নিচে একপাত্র সোনা। বই বলে মনে হয়?
না, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল মুসা। কিন্তু তাতে কি? বিলি আর বো-পীপ কোথায় আছে জানি না, এমনকি হাইমাস কোথায় তা-ও অজানা। দেয়ালে ঠেকেছি আমরা, পথ বন্ধ।
কিন্তু ফোকর আছে, নাটকের সংলাপ বলছে যেন কিশোর।
গতকাল হাইমাসকে বলতে শুনেছি দুটো কাকাতুয়া এখনও নিখোঁজ। ওই দুটোকে জোগাড় করব আমরা। ব্ল্যাকবিয়ার্ড সহ আমাদের কাছে থাকবে তখন তিনটে, হাইমাসের কাছে চারটে। আগে পরে সেকথা সে জানবেই, নিতে আসবে।
কোন দরকার নেই, দু-হাত নাড়ল মুসা। আবার ওই হিপোর মুখোমুখি হব? আমি পারব না। তাছাড়া কাকাতুয়া চুরি করতেও যেতে পারব না আমি লোকের বাড়িতে।
কে চুরি করতে বলেছে তোমাকে? কিনে নেব।
যেন দোকানে আছে, গিয়ে নিয়ে এলেই হলো। কোথায় আছে তাই তো জানি না।
জানতে হবে, শান্ত কণ্ঠে বলল কিশোর। আবার চালু করে দেব ভূত-থেকেভূতে। কাকাতুয়া পছন্দ করে অনেক ছেলেমেয়ে, আর সেগুলো যদি ক্লাসিক ডায়ালগ বলে তাহলে কোন কথাই নেই। বাচ্চাদের চোখে পড়বেই পড়বে। হলিউডের একটা ম্যাপ বের করে এক জায়গায় আঙুল রাখল সে। এখানকার তিনটে ছেলেকে চিনি আমি।ওরা ছড়িয়ে দেবে খবর।
৮
খুব সহজেই কাজ হলো এবার।
এটাই তো মনে হচ্ছে, হাতের কাগজটার দিকে চেয়ে ঠিকানা মিলিয়ে নিল মূসা দুটো ঠিকানা লিখে নিয়েছে, তার একটা মিলছে। গাড়ি রাখুন।
রাস্তার ধারে রোলস নামিয়ে আনল শোফার। হ্যানর্সন নয়, নতুন আরেকজন। বেঁটে, শয়তানী ভরা চাহনি, নাম ক্র্যাব। মুসার মনে হলো কাঁকড়ার দাঁড়ার মতই হাত নাড়ে লোকটা। রবিনও রয়েছে গাড়িতে। দুজনের কেউই পছন্দ করতে পারছে নতুন শোফারকে। সকালে রোলস-রয়েসের জন্যে ফোন করেছিল কিশোর, কোম্পানির ম্যানেজার জানিয়েছে জরুরী কারণে ছুটি নিয়েছে হ্যানসন। নতুন ড্রাইভার দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে গাড়ি।
এঞ্জিন বন্ধ করে দুই গোয়েন্দার দিকে ফিরে হাসল ক্র্যাব। কিশোর আসেনি সঙ্গে। বোরিস আর রোভার গেছে পুরানো মাল আনতে। চাচা-চাচী গেছেন আরেক কাজে। ফলে বাধ্য হয়ে ইয়ার্ডে পাহারায় থাকতে হয়েছে কিশোরকে।
কিছু তদন্ত করতে যাচ্ছ তোমরা? জিজ্ঞেস করল ক্র্যাব। হ্যানসন বলেছে। তোমাদের কথা। এসব ব্যাপারে আমিও খুব ইনটারেসটেড। যাও, আমি গাড়িতে আছি। দরকার পড়লে ডেকো। নিজের কপালে টোকা দিল। চোর-ডাকাতের স্বভাব রেকর্ড করা আছে এখানে।
লোকটার অহঙ্কারী ভাবসাব ভাল লাগল না মুসার। বলল, চোর-ডাকাত ধরতে যাচ্ছি না। একটা হারানো কাকাতুয়া খুঁজতে যাচ্ছি।
হারানো কাকা:… থেমে গেল ক্র্যাব, বিষয় পছন্দ হলো না। কিংবা হয়তো ভাবল মুসা তার সঙ্গে রসিকতা করছে। গম্ভীর হয়ে একটা খবরের কাগজ টেনে নিয়ে পড়ায় মন দিল।
ভূত-থেকে-ভূতে চালু করে দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই দুটো কাকাতুয়ার খোঁজ পাওয়া গেছে। আরও কিছু তথ্যও জানা গেছে। কদিন ধরেই নাকি কয়েকটা কাকাতুয়ার জন্যে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে মোটা এক লোক, শেষে ক্যাপ্টেন কিড আর শারলক হোমস নামের দুটো কাকাতুয়া পেয়ে ডবল দাম দিয়ে কিনে নিয়ে গেছে।
বাকি দুটো কাকাতুয়া, স্কারফেস আর রবিন হুডকে নিতে এসেছে এখন রবিন আর মুসা। ওগুলোর বর্তমান মালিকেরা বিক্রি করতে রাজি হলে কিনে নিয়ে যাবে, আর তা নাহলে রেকর্ড করে নিয়ে যাবে কাকাতুয়া দুটোর বুলি। টেপরেকর্ডার নিয়ে এসেছে সে-জন্যে সঙ্গে করে।
সিমেন্টে বাঁধানো পথ ধরে হাঁটতে শুরু করল দুই গোয়েন্দা। দু-ধারে উঁচু পাতাবাহারের ঝাড়। পথের শেষ মাথায় পুরানো একটা বাড়ি, নতুন প্লাসটার করা হয়েছে।
ওরা বাড়িটার ফুট বিশেক দূরে থাকতেই খুলে গেল সামনের দরজা। বেরিয়ে এল ওদের চেয়ে সামান্য বেশি বয়েসী একটা ছেলে। টিংটিঙে তালপাতার সেপাই, মুসার চেয়ে লম্বা, বাঁকা নাক। দুই গোয়েন্দাকে দেখে বত্রিশ দাঁত বের করে হাসল।
এহহেরে! আবার এসেছে জ্বালাতে! বলে উঠল মুসা। এই রবিন সরো, সরো, শুঁটকির গন্ধ লাগবে গায়ে।
রকি বীচে ফিরে এসেছে আবার তিন গোয়েন্দার চিরশত্রু টেরিয়ার ডয়েল।
মুসার কথায় কিছুই মনে করল না টেরি। হাসি আরও বিস্তৃত হলো। হাতের খাঁচাটা তুলে ধরে এগোল কয়েক পা, বলল, এটার জন্যেই এসেছ, না?
খাঁচার ভেতরে একটা কাকাতুয়া। হলদে ঝুঁটি। এক চোখ কানা, ভয়ানক কোন লড়াইয়ে স্বজাতির ঠোঁট কিংবা নখের আঘাতে হারিয়েছে বোধহয় চোখটা।
কাকাতুয়া? বিস্ময় চেপে রাখতে পারল না মুসা। বলেই ফেলছিল, এটার জন্যেই এসেছে।
কিন্তু তাড়াতাড়ি বাধা দিল রবিন। কাকাতুয়া? ওই কানা পাখি আমাদের কি কাজে লাগবে, মিস্টার শুঁটকি?
কিন্তু ধাপ্পাটা কোন কাজে লাগল না। টেরি জানে, এটার জন্যেই এসেছে রবিন আর মুসা।
গতরাতে এসেই শুনল্লাম কাকাতুয়ার খবর, হেসে মুসার দিকে চেয়ে চোখ টিপল টেরি, রাগানোর জন্যে। তা কালু মিয়া কাকাতুয়া দিয়ে কি করবে? ভেজে খাবে?
শুঁটকির ভর্তা বানিয়ে খাব, রেগে গেল মুসা।
হা-হা করে হাসল টেরি। দারুণ বলেছ হে কালু মিয়া। বুদ্ধি খুলছে আজকাল। তো তোমাদের খোকা শারলক কই? কাকাতুয়ার খবর চেয়েছে কেন?
শার্টের হাতা গোটাতে শুরু করল মুসা।
হাত চেপে ধরল রবিন। টেরিকে জিজ্ঞেস করল, তুমি খবর পেলে কি করে?
এটা একটা প্রশ্ন হলো নাকি? আমেরিকার সব ছেলেই তো জানে, দুটো কাকাতুয়ার খোঁজ চায় শারলক পাশা। আমিও শুনলাম বন্ধুদের কাছে। তাই সকাল সকালই চলে এসেছি। চল্লিশ ডলারে কিনেছি এটা। নেবে নাকি? দেড়শো ডলার লাগবে।
এক আধলা দিয়েও নেব না আমরা, জবাব দিল রবিন। ওই কাতুয়া চাইনি আমরা, কানা কাকাতুয়া।
তাই নাকি? তাহলে অযথা সময় নষ্ট করছি। আরেক কাস্টোমার আগেই বলে রেখেছে আমাকে। পুরো দেড়শো দেবে। চলি, বাই-বাই। পা বাড়াল টেরি।
আই নেভার গিভ আ সাকার অ্যান ইভন ব্রেক! হঠাৎ কর্কশ গলায় বলে উঠল কাকাতুয়াটা।
অবাক হয়ে পাখিটার দিকে তাকাল টেরি। ভাবল, বকাটা তাকেই দিয়েছে। রেগে গিয়ে ধমক লাগাল, শাটাপ! গটমট করে হেঁটে গেল গাড়িবারান্দার এক দিকে। এঞ্জিন স্টার্ট নিল। শাঁ করে ঝোপের ওপাশ থেকে বেরিয়ে এল নীল একটা স্পোর্টস কার, চালিয়ে নিয়ে চলে গেল টেরি।
শুঁটকি কার কাছে বেচবে? রবিনকে জিজ্ঞেস করল মুসা। হাইমাস?
জবাব দিতে পারল না রবিন। তাড়াতাড়ি নোট বই বের করে লিখে নিল, স্কারফেস—মানে কানা কাকাতুয়াটা কি বুলি আউড়েছে।
একটা তো গেল, বলল মুসা। চলো, দেখি আরেকটা পাই কিনা।
ক্র্যাবকে আরেক ঠিকানায় যেতে বলল মুসা।
কয়েক রক পরেই বাড়িটা। এত পুরানো বিলডিং, জায়গায় জায়গায় প্ল্যাস্টার খসে গেছে, বেরিয়ে পড়েছে ইটের পাজর।
গাড়ি থেকে নেমে বাড়িটার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল মুসা, ভাবছি, ভূতথেকে-ভূতের সুবিধে যেমন, অসুবিধেও তেমনি। সবাই জেনে যাচ্ছে খবর, শত্রুরাও জেনে যাচ্ছে। ফলে বেকায়দা হয়ে যায়। শুঁটকি তো কয়েকবারই অসুবিধেয় ফেলল এভাবে।
রবিন হুডকে না নিয়ে গেলেই বাঁচি, বলল রবিন।
পাওয়া গেল রবিন হুডকে। কোন কারণে খোঁজ পায়নি বা খবরই জানেনি শুঁটকি, কিংবা আগ্রহ দেখায়নি। যা-ই হোক, নিতে পারেনি, বা নেয়নি। আছে। বাড়ির মালিকের মাথা জুড়ে বিশাল টাক। জানাল, কেনার সময় একবারই কথা বলেছিল কাকাতুয়াটা, সেজন্যেই কিনেছে, তারপর একেবারে জবান বন্ধ। আর একটি বারও বুলি আউড়ায়নি। বাড়িওয়ালী গেছে রেগে। স্বামীকে কদিন ধরেই চাপ দিচ্ছে কাকাতুয়াটা বিদেয় করে দিয়ে একটা ক্যানারি কেনার জন্যে।
কাজেই, সস্তায়ই পাওয়া গেল কাকাতুয়াটা। পঁচিশ ডলারে কিনেছিল বাড়িওয়ালা, পঁচিশ ডলারেই বিক্রি করে দিল দুই গোয়েন্দার কাছে। টীকাটা গুণে নিয়ে পকেট রেখে বলল, কেন কিনছ, বুঝতে পারছি না। কথা জানে ব্যাটা, কিন্তু বলে না। দেখো, তোমরা বলতে পারো কিনা। বাচ্চারা অনেক সময় অনেক কিছু পারে, যা বুড়োদের পক্ষে অসম্ভব।
থ্যাংক ইউ, স্যার, বলল রবিন। দেখব চেষ্ট করে।
কাকাতুয়াটাকে নিয়ে বেরিয়ে এল ওরা।
বিষণ্ণ হয়ে খাঁচায় বসে আছে রবিন হুড। ছেলেদের দিকে ফিরেও তাকাল না।
তাজ্জব ব্যাপার? বলল মুসা। কথা বলে না কেন?
দেখা যাক, কিশোর বলাতে পারে কিনা…আরে, গাড়িটা গেল কোথায়? এখানেই তো ছিল।
আশেপাশে গাড়িটাকে খুঁজল ওরা। কিন্তু নেই।
ওই ক্র্যাবের বাচ্চাকে দেখেই ভাল্লাগেনি আমার, গোমড়া মুখে বলল মুসা। ব্যাটা আমাদের ফেলে চলে গেছে।
তা-তো গেছে, যাই কি করে এখন? আরেকটা গাড়ি কিংবা ট্যাকসির জন্যে, এদিক ওদিক তাকাল রবিন। যেন তার মনের খবর জানতে পেরেই ঘ্যাচ করে এসে পাশে থামল একটা ঝরঝরে ভ্যান। ড্রাইভিং সীট থেকে জানালা দিয়ে মুখ বের করল এক মহিলা। রোলস-রয়েসটাকে খুঁজছ? ওদিকে চলে যেতে দেখলাম।
কেন যে গেল বুঝতে পারছি না, কপাল চুলকাল রবিন।
যাবে কোথায় তোমরা?
জানাল মুসা।
এসো, বাস স্টেশনে নামিয়ে দেব। ওদিকেই যাচ্ছি, আমন্ত্রণ জানাল মহিলা।
মহিলাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাল মুসা। এসো, রবিন। কি আর করা। উইলশায়ার থেকে বাস ধরব।
মহিলার পাশে উঠে বসল মুসা।
রবিন উঠল তার পাশে। চিন্তিত। চেনা চেনা লাগছে মহিলার কণ্ঠস্বর, আগে কোথাও শুনেছে।
চলতে শুরু করেছে ভ্যান।
আরে, ওদিকে কোথায়? তাড়াতাড়ি বলল রবিন। উল্টোদিকে যাচ্ছেন তো। উইলশায়ার ওদিকে।
উইলশায়ারে যাচ্ছেটা কে? পেছন থেকে বলে উঠল একটা কর্কশ কণ্ঠ, কথায় ব্রিটিশ টান। অন্যখানে যাচ্ছি আমরা।
চমকে ফিরে চাইল দুই গোয়েন্দা।
সীটের পেছনের একটা পার্টিশন সরে গেছে। আরাম করে বসে আছে হাইমাস। গোল মুখে কুৎসিত হাসি।
আমার সঙ্গে যাবে তোমরা, যেখানে নিয়ে যাব, আবার বলল হাইমাস। একটু গোলমাল করেছ কি… কথাটা শেষ করল না সে। ইয়া বড় এক ছুরি বের করল। পাতলা ঝকঝকে বাঁকা ফলা, হাতলের কাছটায় একটা সাপের ছবি খোদাই করা।
এটার নাম সর্প-ছুরি, ভীষণ ভঙ্গিতে ছুরিটা নাড়ল সে। হাজার বছর আগে দামেসকে তৈরি হয়েছিল। এটার একটা বাজে ইতিহাস আছে। বারোজন লোককে খুন করেছে ইতিমধ্যেই। আরও এক বা দুজনকে খুন করতে কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। তেরো নম্বর কে হতে চাও? আনলাকি থারটিন?
৯
দ্রুত ছুটছে ভ্যান। হলিউডের পরে খাড়া রুক্ষ পাহাড়শ্রেণী ছাড়িয়ে এল।
আগেই সতর্ক করেছি তোমাদের, এক সময় বলল মহিলা। শোনোনি।
এইবার মনে পড়ল রবিনের, কেন চেনা চেনা লাগছিল কণ্ঠস্বর। সেদিন এই মহিলাই ফোনে হুঁশিয়ার করেছিল। হাইমাসের ব্যাপারে নাক না গলাতে বলেছিল।
পাহাড়ী পথ ধরে পাহাড়ের মধ্যে ঢুকে যেতে শুরু করল গাড়ি, সরু গিরিপথ।
কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল মুসা, একটা কথা বলবেন, মিস্টার হাইমাস, ক্র্যাবকে তাড়ালেন কিভাবে?
আরে ওটা একটা গাধা, হাসল হাইমাস। নিজেকে খুব চালাক মনে করে। সেদিন রেন্ট-আ-রাইড কোম্পানিতে একটা গাড়ি ভাড়া করতে গিয়ে দেখেছি ওকে, তখনই বুঝেছি। রেঞ্জারটা লোকের চোখে পড়ে তো, তাই সাধারণ একটা গাড়ি নিতে গিয়েছিলাম। রোলস রয়েসটা সেদিনই দেখলাম। তোমাদেরকে চড়তেও দেখেছি। জানলাম, একটা ওয়্যারলেস টেলিফোন আছে ওতে।
আজ তোমাদের অনুসরণ করেছি। গাড়ি থেকে নেমে পুরানো বাড়িটায় যখন ঢুকলে, কোণের একটা স্টোর থেকে গিয়ে ক্র্যাবকে ফোন করলাম। বললাম, বাড়ির ভেতর থেকে বলছি। তোমরা দুপুরের খাবার খেয়ে যাবে, যেতে দেরি হবে, সে যেন চলে যায়। বিকেলে এসে নিয়ে যায় তোমাদের। সামান্যতম সন্দেহ করল না গাধাটা। চলে গেল।
হাইম, কথাবার্তা থেকেই বোঝা গেল, মহিলা হাইমাসের স্ত্রী, তুমি নিশ্চই…
না, বাধা দিল হাইমাস, বুঝে ফেলেছে তার স্ত্রী কি বলতে চায়। রাস্তা খারাপ, দেখে চালাও। রিয়ার-ভিউ মিররে চোখ রাখছ তো?
হ্যাঁ। ছোট একটা গাড়ি একবার দেখলাম মনে হলো। এখন আর দেখছি না।
সাবধান। সামনে বাঁক।
গতি কমিয়ে তীক্ষ্ণ মোড় নিল গাড়ি। বেরিয়ে এল পাহাড়ের মাঝের লম্বা ফাঁপা একটা ফাঁকা জায়গায়। একটা বাড়ি আছে ওখানে। ডাবল গ্যারেজ। তাতে দাঁড়িয়ে আছে সেই কালো রেঞ্জারটা। ওটার পাশে এসে থামল ভ্যান।
বিচ্ছু মিয়ারা, নামো, আদেশ দিল হাইমাস। তাড়াহুড়ো করবে না। তোমাদের বিশ্বাস নেই।
ধীরে সুস্থেই নামল দুই গোয়েন্দা। পেছনে নামল হাইমাস।
চমকার সাজানো গোছানো বড় একটা লিভিং রুমে ছেলেদের নিয়ে এল হাইমাস। এক কোণে একটা টেবিল রাখা চারটে খাঁচায় চারটে হলদে ঝুঁটি কাকাতুয়া। মানুষের সাড়া যেন কানেই যায়নি পাখিগুলোর। একই ভাবে বসে রয়েছে, নীরব। হাইমাস যখন রবিন হুডের খাঁচাটা রাখল ওগুলোর পাশে, তখনও নড়ল না।
বড় সোফায় বসল রবিন আর মুসা। তাদের মুখোমুখি উল্টো দিকের আরেকটা সোফায় বসল হাইমাস, আনমনে আঙুল দিয়ে ছুরির ধার পরীক্ষা করছে।
তারপর বিচ্ছুরা, বলল সে, কয়েকটা কথা জানাও তো আমাকে। সিলভারের ট্রেনিং দেয়া সাতটার মধ্যে পাঁচটা কাকাতুয়াই পেয়ে গেছি। বাকি দুটোও জোগাড় করব। তা শোঁপার খপ্পড়ে পড়লে কি করে তোমরা? কতখানি জানে সে?
শোঁপা? চোখ মিটমিট করল মুসা। রবিনের দৃষ্টি শূন্য।
না জানার ভান করে লাভ হবে না, অধৈর্য হয়ে ছুরি নাড়ল সে। শোঁপা, ওই ফরাসীটা। ইউরোপের সবচে বড় আর্ট থিফ। সাংঘাতিক লোক সে। আমার পেছনে লেগেছে।
মাথা নাড়তে যাচ্ছিল রবিন, তার আগেই বলে উঠল মুসা, মাঝারি উচ্চতা, কালো সরু গোফ, কথায় ফরাসী টান, ওই লোকটার কথা বলছেন?
হ্যাঁ। চেনো তাহলে, স্বীকার করছ।
চিনি বললে ভুল হবে, তবে দেখা হয়েছে, বলল মুসা। আরেকটু হলেই রোলস-রয়েসের সঙ্গে লাগিয়ে দিয়েছিল ধাক্কা। ওই যে, বিলি শেকসপীয়ারকে যেদিন খুঁজতে গিয়েছিলাম, সেদিন। দোষ করল তার ড্রাইভার, উল্টে ঝগড়া লেগে গেল হ্যানসনের সঙ্গে, সব কথা খুলে বলল সে।
হ্যাঁ, ওই ব্যাটাই, বলল হাইমাস। কিন্তু শেপার হয়ে কাজ না করলে কাকাতুয়াগুলোর ব্যাপারে এত আগ্রহ কেন তোমাদের?
মিস্টার ফোর্ডের হারানো কাকাতুয়া খুঁজতে গিয়ে কিভাবে জড়িয়ে পড়েছে তিন গোয়েন্দা, বলল মুসা।
শঙ্কা আর উত্তেজনা দূর হয়ে গেল হাইমাসের। ও, এই ব্যাপার। আমি তো ভয় পাচ্ছিলাম, শোঁপার হয়ে কাজ করছ তোমরা। সেদিন হয়েছিল কি জানো? চশমা খুলে শার্টের কোণায় ডলে পরিষ্কার করে নিয়ে আবার নাকে বসাল সে। অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে ফিরে দেখি রাস্তার মোড়ে বসে আছে শোঁপা। বাড়ির দিকে নজর। ঘরে ঢুকেই বুঝলাম কেউ ঢুকেছিল। কিছু খোজাখুঁজি করে গেছে। স্ত্রীর দিকে চেয়ে বলল, তুমি তো সেদিন বিশ্বাস করতে চাওনি। এখন তো মানবে? ব্যাটা ঘরে ঢুকে সেদিন নোটগুলো পড়ে গেছে।
হ্যাঁ, ঠোঁট কামড়াল মহিলা, শোঁপাই পিছে লেগেছে। তবে এখানে আমাদেরকে খুঁজে পাবে না।
তা কে জানে। ছেলেদের দিকে ফিরল হাইমাস। এই পাহাড়ের মধ্যিখানে কেন বাড়ি ভাড়া নিয়েছি জানেন? শোঁপার ভয়ে। তাছাড়া কাকাতুয়াগুলো রাখারও সুবিধেমত জায়গা পাচ্ছিলাম না। রেঞ্জারটাও এখানে লুকিয়ে রাখতে পারছি। তোমরা গাড়িটা যে খুঁজছিলে, অ্যাপার্টমেন্টের ম্যানেজারের কাছে শুনেছি। তার ছেলে বার বার নাকি জিজ্ঞেস করছিল গাড়িটার কথা। ধমক দিয়ে ছেলেকে থামিয়েছে ম্যানেজার, শাসিয়েছে, ভাড়াটের কোন কথা বাইরের কারও কাছে ফাঁস করলে ভাল হবে না। কিন্তু ধমক-ধামক দিয়ে বাচ্চাদের মুখ বন্ধ করা যায়? তাই পালিয়েই এলাম।
ওই ছেলেটার কাছেই তোমাদের নম্বর পেয়েছি, জানাল হাইমাসের স্ত্রী। তোমাদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছিলাম, হাইমাসের ব্যাপারে নাক গলাতে মানা করেছিলাম।
রেগে গেলে আমার মেজাজ ঠিক থাকে না, সামলাতে পারি না নিজেকে, স্বীকার করল হাইমাস। লোকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে বসি। তোমাদের সঙ্গেও করেছি। এতখানি অবশ্য করতাম না, যদি না ভাবতাম শোঁপার সঙ্গে তোমরা হাত মিলিয়েছ।
হাতের ছুরিটার দিকে চোখ পড়ল তার, সরিয়ে রাখল তাড়াতাড়ি। লজ্জিত হেসে বলল, ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম, আর কিছু না। এত বেশি দুশ্চিন্তায় আছি…
যা হয়ে গেছে, গেছে, বাধা দিয়ে বলল তার স্ত্রী। এক কাজ করো না কেন? ওদের সাহায্য চাও। বুদ্ধিসুদ্ধি আছে ওদের, বোঝাই যায়। তুমি যা পারোনি তাই ওরা করেছে। স্কারফেস আর রবিন হুডকে খুঁজে বের করেছে।
ঠিকই বলেছ, তোয়ালের সমান এক রুমাল বের করে থলথলে গালের ঘাম মুহল হাইমাস। সত্যিই আমি লজ্জিত, সরি। বদমেজাজী লোককে কেন লোকে পছন্দ করে না, বুঝতে পারছি।
দৃষ্টি বিনিময় করল দুই গোয়েন্দা। থাক থাক, ভুল হয়েই থাকে মানুষের, হাত তুলল রবিন।
আমরা বয়েসে অনেক ছোট, আমাদের কথা বাদ দিন। কিন্তু মিস্টার ফোর্ড আর মিসেস বোরোর কাছে গিয়ে মাপ চাওয়া উচিত আপনার। তাদের কাকাতুয়া চুরি করেছেন, মিস্টার ফোর্ডকে তো হাত-পা বেঁধে ফেলে এসেছিলেন। যদি আমরা না যেতাম, কি অবস্থা হত?
না, কিছু হত না, আরেক দিকে চেয়ে বলল হাইমাস। তোমরা না গেলে পরে এক সময় গিয়ে খুলে দিয়ে আসতাম। তবে হ্যাঁ, মাপ চাওয়া উচিত, ঠিকই বলেছ।
কাকাতুয়াগুলো চুরি করলেন কেন?
না করে উপায় ছিল না। জন সিলভারের লুকানো গুপ্তধনের চাবিকাঠি রেখে গেছে সে কাকাতুয়াগুলোর কাছে।
কিশোর এটাই সন্দেহ করছে, হঠাৎ বুঝে ফেলল রবিন। মিস্টার হাইমাস, বলল সে, কাকাতুয়াগুলোর বুলিতে রয়েছে সঙ্কেত। সাতটা বুলি মিলিয়ে বুঝতে
হবে কোথায় রয়েছে গুপ্তধন।
বুদ্ধিমান ছেলে, বলল হাইমাস। ঠিক ধরেছ। আমার সঙ্গে তিক্ত রসিকতা করেছে জন সিলভার। আসলে এক ধরনের প্রতিশোধ। কাকাতুয়াকে বুলি শিখিয়ে গেছে, তাতে রয়েছে গুপ্তধনের সঙ্কেত, সেই সঙ্কেত বুঝে তারপর খুঁজে বের করতে হবে আমার। তার স্বভাবই ছিল এটা। অসাধারণ বুদ্ধিমান ছিল সিলভার, এবং পাগল।
হাইম, বলে উঠল মিসেস হাইমাস, খালি কথা বললে পেট ভরবে? কিছু খেতেটেতে হবে না? সেই কখন খেয়েছি…যাই, কয়েকটা স্যাণ্ডউইচ বানিয়ে আনি।
খাবারের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মোচড় দিয়ে উঠল মুসার পাকস্থলী। অবাক হয়ে ভাবল, এতক্ষণ ভুলে ছিল কি করে? রবিনেরও খিদে পেয়েছ। উত্তেজনার কারণেই ভুলে ছিল।
মিসেস হাইমাস রান্নাঘরে চলে গেল।
ইংল্যাণ্ডে থাকতেই মিস্টার সিলভারকে চিনতেন? জিজ্ঞেস করল রবিন।
হ্যাঁ, দুবছর ধরে। আমার কর্মচারী ছিল। রেয়ার আর্ট কেনাবেচার কাজে সাহায্য করত। লণ্ডনে। উচ্চ শিক্ষিত লোক, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমান। তবে অদ্ভুত রসবোধ ছিল, আর এ-কারণেই কোন চাকরিতে বেশি দিন টিকতে পারত না, গুণ থাকা সত্ত্বেও। শেষে তো এমন অবস্থা হলো, কেউ আর চাকরি দিতে চায় না। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ধাধা আর জোক পাঠিয়ে কোনমতে দু-বেলা দুমুঠো জোগাড় করত।
এই সময়ই একদিন চাকরির জন্যে এল আমার কাছে। সাহিত্য আর শিল্প সম্পর্কে তার জ্ঞানের বহর দেখে সত্যি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তার দুর্নাম আমার কানেও এসেছিল, তবু চাকরি দিলাম। বুঝেছিলাম, খুব কাজে লাগবে।
ভালই কাজ চালাচ্ছিল, ছোটখাট রসিকতা করে মাঝেমাঝে জালাত অবশ্য। তবে সহ্য করে নিচ্ছিলাম। যাই হোক, একদিন একটা ছবি কিনে নিয়ে এল। অতি সাধারণ ছবি, হলদে ঝুঁটিওয়ালা দুটো কাকাতুয়া গাছের ডালে বসে আছে। অনেক বেশি দাম দিয়ে বাজে একটা জিনিস নিয়ে আসায় রাগ হয়েছিল খুব, বকে ছিলাম। চুপ করে রইল সিলভার। ভাবলাম, ওটাও আরেক রসিকতা। গেলাম রেগে, মেজাজ ঠিক রাখতে না পেরে দিলাম চাকরি থেকে বরখাস্ত করে।
জন সিলভার কিন্তু তার আসল নাম নয়, তবু ওই নামেই ডাকা হোক, এটা চাইত। নিজের নাম নিয়েও রসিকতা, পাগল আর কাকে বলে? অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে সে বলল, ওটা ডাবল পেইন্টিং। ডাবল পেইন্টিং মানে, রঙ লেপে মূল ছবিটাকে ঢেকে দিয়ে তার ওপর আরেকটা ছবি আঁকা। বিখ্যাত চিত্রকর্ম লুকিয়ে রাখার জন্যে কখনও কখনও করা হয় এটা। আমি তার কথা বিশ্বাস করলাম না। কিন্তু জোর গলায় বলে গেল সে, সেটা প্রমাণ করে দেখাবে। করলও তাই। চুপ করল হাইমাস।
আগ্রহে সামনে ঝুঁকে এসেছে রবিন আর মুসা, রোমাঞ্চকর এক গল্প শুনছে যেন।
হ্যাঁ, সত্যি সত্যি প্রমাণ করল সে। ওপরের ছবিটা মুছে ফেলল। বেরিয়ে পড়ল এক অসামান্য চিত্রকর্ম। একটা ভেড়ার বাচ্চাকে আদর করছে এক মেষপালক। আমাকে দেখাতে নিয়ে এল।
এক নজর দেখেই বুঝলাম কি ভুল করেছি তাকে তাড়িয়ে দিয়ে। এক মস্ত শিল্পীর আঁকা ওই ছবি নিখোঁজ ছিল অনেক দিন, কেন নিখোঁজ ছিল তখন বুঝতে পারলাম। চোরের ভয়ে ডাবল পেইন্ট করে ফেলা হয়েছিল। ছোট্ট ছবি, কিন্তু দাম অনেক। পাঁচ সাত-লাখ ডলারের কম নয়।
খাইছে! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। একটা ছবির এত দাম? এক ডলারেই তো ফ্রেমসহ পাওয়া যায় কত ছবি।
সেগুলো ছাপা কপি, রবিন বলল। নিউ ইয়র্ক সিটির মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অভ আর্ট যাদুঘরের নাম শুনেছ? বিখ্যাত ডাচ চিত্রকর রেমব্রান্ত-এর একটা ছবি বিশ লাখ ডলারে কিনেছে ওরা। কিছু কিছু জিনিস আছে যেগুলোর আসল মূল্যের চেয়ে অ্যানটিক মূল্য বেশি।
মারছে! চোখ কপালে উঠল মুসার। একটা ছবির জন্যে বিশ লাখ ডলার। কত রকমের পাগল যে আছে দুনিয়ায়।
হ্যাঁ, তারপর কি হলো শোননা, থেমে গেল হাইমাস। খাবারের ট্রে নিয়ে এসেছে তার স্ত্রী। বড় প্লেটে কয়েকটা স্যাণ্ডউইচ, দুই গ্লাস দুধ আর দুই কাপ কফি। টেবিলে নামিয়ে রাখল।
যার যার খাবার তুলে নিয়ে খেতে শুরু করল সবাই।
স্যাণ্ডউইচ শেষ করে কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল হাইমাস, হা, সিলভার বলল, যেহেতু সে তখন চাকরিতে নেই, ছবিটার মালিক সে। বললাম, চাকরিতে থাকার সময় আমার টাকায় কিনেছে, কাজেই ছবির মালিক আমি। অনেক তর্কাতর্কির পর আধাআধি বখরা অফার করল আমাকে।
ভালই তো প্রস্তাব, দুধের শূন্য গেলাসটা নামিয়ে রাখল মুসা। হাজার হোক, ছবিটা তো সে-ই খুঁজে পেয়েছে।
কিন্তু আমাকে ধরল ভূতে, আফসোসের সুরে বলল হাইমাস, তাতেও রাজি হলাম না। পুলিশের ভয় দেখালাম তাকে। রুখতে পারলাম না, ছবিটা নিয়ে পালাল। থানায় ডায়েরী করে তার নামে ওয়ারেন্ট বের করলাম। কিন্তু একেবারে গায়েব হয়ে গেল। পরে জানা গেল, একটা মালবাহী জাহাজে করে ইংল্যান্ড থেকে বেরিয়ে গেছে সে। সঙ্গে করে নিয়ে গেছে দামী মেষপালক।
দোষ তো তোমারই, বলল মিসেস হাইমাস।
হ্যাঁ, আমারই দোষ। ছেলেদের দিকে ফিরে বলল হাইমাস, দেশ-বিদেশের চেনা সমস্ত চিত্ৰব্যবসায়ীকে জানিয়ে দিলাম ছবিটার কথা। চোখ খোলা রাখতে অনুরোধ করলাম। কিন্তু বাতাসে মিলিয়ে গেল যেন সিলভার। ক্যালিফোরনিয়ায় এসে লুকিয়ে রইল।
হ্যাঁ, বলল রবিন, মিস্টার স্যানটিনোর বাড়িতে। সঙ্গে একটা ধাতুর বাক্স ছিল। রোজ রাতে নাকি খুলে দেখত আর বলত, আহা, কি সুন্দর রামধনুর টুকরো, নিচে একপাত্র সোনা।
একেবারে নিখুঁত বর্ণনা, সায় দিল হাইমাস। রামধনুর সাতরঙেই আঁকা হয়েছে ছবিটা। সোনার চেয়েও দামী। হ্যাঁ, তারপর হঠাৎ একদিন সিলভারের লম্বা এক চিঠি এসে হাজির আমার অফিসে। লিখেছে, ছবিটা নিরাপদেই আছে, লুকানো। সেটা বের করতে হলে একটা ধাধার রহস্য সমাধান করতে হবে। আরেক রসিকতা। আমার মনের ওপর অত্যাচার, এটা তার প্রতিশোধ।
চিঠিতে জানিয়েছে সে, ছয়টা কাকাতুয়া আর একটা ময়নাকে বুলি শিখিয়েছে, তাতেই রয়েছে ধাধার সমাধান। আমেরিকায় এসে স্যানটিনো নামের এক লোককে এক হাজার ডলার দিয়ে তার কাছ থেকে কিনে নিতে হবে পাখিগুলো। হলদে ঝুঁটি কাকাতুয়া বাছাই করেছে সে, কেন, তা-ও জানিয়েছে। ওই যে, মূল-ছবির ওপর ওই রঙের কাকাতুয়াই আঁকা ছিল, আর তাই নিয়ে আমার সঙ্গে ঝগড়া।
কিছু মনে করবেন না, নরম গলায় বলল মুসা, ঠিকই করেছে সিলভার। আপনি তার সঙ্গে যেরকম দুর্ব্যবহার করেছেন…
ঠিকই বলেছ, খুব শান্তভাবেই স্বীকার করল হাইমাস। তবে এত কষ্ট হত না। আমার। এটাকে দুর্ভাগ্য বলতে পারো, চিঠিটা যখন পৌঁছল, আমি তখন নেই। জরুরী একটা ব্যবসার কাজে জাপানে গেছি। ফিরতে দেরি হয়ে গেল। এসে চিঠি পেয়ে তো চমকে গেলাম, সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এলাম আমেরিকায়। কিন্তু ততদিনে পাখিগুলো বিক্রি করে দিয়েছে স্যানটিনো।
ওই বেচারার সঙ্গেও কম দুর্ব্যবহার করেননি আপনি, কায়দামত ঝাল ঝাড়ছে মুসা।
হ্যাঁ, আগেই বলেছি, এ-জন্যে দায়ী আমার বদমেজাজ। তাছাড়া, কিভাবে জানি শুনে ফেলেছে শোঁপা, আমার পিছু নিয়েছে, সেটা আরেক দুশ্চিন্তা। মেজাজ ঠিক রাখতে পারিনি। ব্যাটা যে কিভাবে শুনল, কে জানে। হয়তো অফিসে লোকের সামনে খোলাখুলি কিছু বলে ফেলেছিলাম, ঘুষখোর কর্মচারীর তো অভাব নেই।
হ্যাঁ, শেপাকে নিয়ে ভয়ই, মাথা দোলাল মিসেস হাইমাস। গন্ধ যখন পেয়েছে, সহজে ছাড়বে না।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম, আবার শুরু করল হাইমাস, স্যানটিনোকে অনেক রকমে জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু কোথায় পাখিগুলো বিক্রি করেছে সঠিক বলতে পারল না। মোটামুটি ধারণা দিতে পারল শুধু। লোকের দ্বারে দ্বারে ফকিরের মত ঘুরলাম কয়েকদিন। চারটে পাখি জোগাড় করলাম, তোমরা বের করলে আরও দুটো।
চারটেই চুরি করেছেন? জিজ্ঞেস করল মুসা।
না, দুটো। আর দুটো ডবল দামে কিনেছি। মিস্টার ফোর্ড আর মিসেস বোরো বেচতে রাজি হলো না, তাই চুরি করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। ও হ্যাঁ, ফোর্ডের কাছেই লিটল বো-পীপ আর ব্ল্যাকবিয়ার্ডের কথা শুনেছি।
এত বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম, যে কি বলব। কোনরকম ভাবনা চিন্তা না করে গিয়ে মিসেস বোরোর বাড়িতে ঢুকলাম। খালি বাড়ি, চুরি করলাম কাকাতুয়াটা। বেরিয়ে আসছি, এই সময় দুই কিশোরকে ঢুকতে দেখলাম। তুমি একজন, মুসার দিকে আঙুল তুলল হাইমাস।
হ্যাঁ, সঙ্গে কিশোর ছিল, মুসা বলল। টালি ছুঁড়ে আরেকটু হলেই দিয়েছিলেন তো আমার মাথা ফাটিয়ে।
ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম, কপাল ডলল হাইমাস।
ভয়? কিশোর আমাকে ধাক্কা দিয়ে না ফেললে তো গেছিলাম। মেরেছিলাম যাতে তোমার আশেপাশে পড়ে, কিন্তু নিশানা ফসকে…
হেসে ফেলল মুসা। নিশানা ফসকে লাগতে যাচ্ছিল। আমারও হয় ওরকম, এয়ারগান দিয়ে শিকারের সময়। একবার একটা ঘুঘুকে সই করে মারলাম, তিন হাত দূরের আরেকটা পড়ে গেল। হা হা…
সে-কথা মনে করে রবিনও হেসে ফেলল।
পরিবেশ সহজ হলো অনেকটা। মিস্টার আর মিসেস হাইমাসও হাসল।
এসব করেই জটিলতা আরও বাড়িয়েছেন আপনি, বলল রবিন। খোঁচা মেরে জাগিয়ে দিয়েছেন কিশোর পাশাকে। ব্যাস, লেগে গেছে পেছনে। ও একবার যেটার পেছনে লাগে শেষ না দেখে ছাড়ে না।
মুসা, তোমার খুলি ভীষণ শক্ত, এমনভাবে ভূঁড়িতে হাত ডলল হাইমাস, যেন ব্যথাটা এখনও রয়েছে।
কেন হয়েছে, জানেন? ব্যাখ্যা করল মুসা। পড়া না পারলে মা খালি গাট্টা মারত মাথায়। কত আর সওয়া যায়? একদিন টেলিভিশনে দেখলাম, জুডো-কারাতে শেখানোর আগে বালির বস্তায় ঘুসি মেরে, ইটে কোপ মেরে হাত শক্ত করে ছাত্ররা। চট করে বুদ্ধি এল মাথায়। সেদিন থেকেই লেগে গেলাম, হাত নয়, মাথা শক্ত করতে। দেয়ালে বাড়ি মেরে মেরে কপাল-মাথা ফুলিয়ে ফেলেছি কতদিন। তাআরপর একদিন, হাসিতে বিকশিত হল ঝকঝকে সাদা দাঁত, পড়তে বসে ইচ্ছে করেই ভুল করতে লাগলাম। কষে এক গাট্টা মারল মা।…হি-হি…পুরো এক কৌটা বাতের মলম শেষ করেছে বাবা, মায়ের আঙুলে ডলে।
হো-হো করে হেসে উঠল মিস্টার আর মিসেস। ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল যেন হাইমাসের ছোটখাট পাহাড়টা।
যাই হোক, আবার কাজের কথায় এল হাইমাস, তোমরা পিছু লাগলে। শোঁপা তো আগে থেকেই আছে, লুকিয়ে পড়তে হলো আমাকে। রেঞ্জারটা লুকিয়ে ভ্যানটা ভাড়া নিতে হলো। আজ সকালে কাকাতুয়া খুঁজতে বেরিয়ে তোমাদের রোলস রয়েসটা নজরে পড়ল। কৌতূহল হলো। পিছু নিলাম।
একটা বাড়ির কাছে গাড়ি রেখে নামলে তোমরা। লুকিয়ে তোমাদের ওপর চোখ রাখলাম। লম্বা একটা ছেলের সঙ্গে দেখা হলো তোমাদের।
শুঁটকি টেরি, বলল মুসা। আমাদের শত্রু। পারে না তো কচুটাও করতে, খালি ঘাপলা বাধায়।
ওর হাতে একটা খাঁচা, বলে গেল হাইমাস, তাতে একটা কাকাতুয়া। নীল স্পোর্টস কারে চড়ে চলে গেল পাখিটা নিয়ে। ভেবেছিলাম, পিছু নিই। পরে ভাবলাম, গাড়ির নম্বর তো জানাই রইল, খুঁজে বের করে ফেলব। তোমরা কি করো, দেখতে লাগলাম। থামল এক মুহূর্তের জন্যে। তাছাড়া আরও একটা কারণে তার পিছু নেয়ার দরকার মনে করিনি। কানা কাকাতুয়াটা কি বলেছে, শুনে। ফেলেছি।
কি? নোটবই বের করল রবিন।
হাইমাসও নোটবই বের করল। বলেছে, আই নেভার গিভ আ সাকার অ্যান ইভন ব্রেক।
গালি, বিড়বিড় করল মুসা।
গালি ঠিক নয়, একটা পুরানো স্ল্যাঙ। তবে সঙ্কেত হিসেবে খুবই কঠিন। কি বোঝাতে চেয়েছে সিলভার, সে-ই জানে।
সাতটা পাখির বুলি এক করে ভাবলে হয়তো কিছু বোঝা যাবে, রবিন বলল।
সেটাই তো হলো সমস্যা, মুখ বাকাল হাইমাস। সাতটার মাঝে পাচটা পেয়ে গেছি, বাকি রয়েছে শুধু স্কারফেস আর ব্ল্যাকবিয়ার্ড। স্কারফেসের বুলিও জানি। কিন্তু, সেটা সহ জানা হয়েছে মাত্র তিনটে।
তিনটে কেন? জিজ্ঞেস করল রবিন। ছ-টা তো হওয়ার কথা।
কথা, কিন্তু হয়েছে তিনটে, বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল হাইমাস। কথা বলেছে শুধু বিলি আর বো-পীপ। বাকিগুলো একেবারে চুপ। টু শব্দও করে না। কি বুলি জানে, কি জানি!
১০
মুখ ফিরিয়ে খাঁচাগুলোর দিকে তাকাল দুই গোয়েন্দা। চুপ করে বসে আছে। পাখিগুলো, যেন প্রাণ নেই। নড়ছেও না। কথা বলার মুড যে নেই বোঝাই যাচ্ছে।
খাঁচার দিকে চেয়ে মেজাজ আবার খারাপ হয়ে গেল হাইমাসের। লাফিয়ে উঠে গটমট করে গিয়ে দাঁড়াল টেবিলের কাছে। গর্জে উঠল, বল, হারামজাদারা। জলদি বল সিলভার কি শিখিয়েছে? এই, শুনছিস? বলবি?
ভয় পেয়ে আরও দূরে সরার চেষ্টা করল কাকাতুয়াগুলো, খাঁচার কোণে জড়সড় হয়ে রইল।
এই রকমই করে, জানাল মিসেস হাইমাস। প্রথম পাখিটা আনার পর থেকেই খালি ধমকাচ্ছে। কোনোটাকে বাদ দিচ্ছে না।
এ-কারণেই মুখ খুলছে না ওরা, হয়তো, রবিন বলল। খুব নাজুক স্বভাব। জোরে কোন শব্দ করলে, কিংবা জায়গা বদলালে চুপ হয়ে যায়।
ফিরে এসে ধপাস করে সোফায় গড়িয়ে পড়ল পাহাড়। আর ধৈর্য নেই! গুঙিয়ে উঠল হাইমাস। এভাবে আর কত? ওদিকে পিছে লেগেছে শেপা। যখনতখন এসে হাজির হতে পারে। সাংঘাতিক লোক।
তাহলে বসে আছো কেন, বাপু? টাকার লোভ ছেড়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও না, তাহলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়, কথাগুলো বলতে ইচ্ছে করল মুসার। বলল, কয়েকটা বুলি বা মেসেজও বলা যায়, জানি আমরা। কিন্তু মাথামুণ্ড কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। তবে, আমরা আপনার কাছে যা যা জানলাম, কিশোরকে জানালে হয়তো উপায় একটা করে ফেলতে পারবে।
এক কাজ করি না কেন? পরামর্শ দিল রবিন। যে কটা মেসেজ জানি, লিখে ফেলি কাগজে। তারপর দেখি, কোন মানে বের করা যায় কিনা।
ভাল কথা বলেছ, তর্জনী নাচাল মিসেস হাইমাস। স্বামীকে বলল, তোমাকে সেদিনই বলেছি, ছেলেগুলো চালাক। ওদের সঙ্গে কথা বলো।
তা বলেছ। কিন্তু কতখানি দুশ্চিন্তায় রয়েছি:.
রাখো তোমার দুশ্চিন্তা, মুখ ঝামটা দিল মিসেস। এক কথা শুনতে শুনতে কান পচে গেল। রবিন, আমি একটা প্রস্তাব দিচ্ছি। ভেবে দেখো। ছবিটা যদি বের করে দিতে পারো, এক হাজার ডলার পুরস্কার দেব।
খাইছে! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। এই রবিন, দেরি করছ কেন? শুরু করে দাও।
দাঁড়াও, হাত তুলল হাইমাস, আরেকটা কথা মনে পড়েছে। চিঠিতে সিলভার লিখেছিল, সাত ভাগে ভাগ করেছে সে মেসেজটা। সিরিয়ালি সাজিয়েছে। এভাবে ও লিটল বো-পীপ এক নম্বর, দুই-বিলি শেকসপীয়ার, তিনব্ল্যাকবিয়ার্ড, চার-রবিন হুড, পাঁচ-শারলক হোমস, ছয়-ক্যাপ্টেন কিড, এবং সাত–স্কারফেস।
ভাল পয়েন্ট মনে করেছেন, বলল রবিন, খসখস করে লিখে চলেছে নোটবুকে। নইলে উল্টোপাল্টা লিখতাম, ধাধার সমাধান হয়তো হত না।
লিখে এক টানে ফড়াত করে ছিড়ে কাগজটা হাইমাসকে দেখাল রবিন। লিখেছে :
স্যাপ্টেন লঙ জন সিলভারের মেসেজ (অসম্পূর্ণ)
১। লিটল বো-পীপ : লিটল বো-পীপ হ্যাজ লস্ট হার শীপ অ্যাণ্ড ডাজ নো হোয়্যার টু ফাইণ্ড ইট। কল অন শারলক হোমস।
২। বিলি শেকসপীয়ার : টু বি অর নট টু বি, দ্যাট ইজ দা কোয়েশচেন।
৩। ব্ল্যাকবিয়ার্ড : আয়্যাম ব্ল্যাকবিয়ার্ড দা পাইরেট, অ্যাণ্ড আহ্যাভ বারিড মাই ট্রেজার হোয়্যার ডেড ম্যান গার্ড ইট এভার। ইয়ো-হো-হো অ্যান্ড অ্যা বটল অভ রাম।
৪। রবিন হুড : ?
৫। শারলক হোমস : ?
৬। ক্যাপ্টেন কিড : ?
৭। ক্ষারফেস : আই নেভার গিভ আ সাকার অ্যান ইন ব্রেক।
তাহলে, রবিন বলল, সাতটার মাঝে চারটা মেসেজই জেনে গেলাম। ব্ল্যাকবিয়ার্ডকে যে পেয়েছে তিন গোয়েন্দা, সেকথা হাইমাস দম্পতিকে জানানোর ইচ্ছে নেই। ব্ল্যাকবিয়ার্ডের বুলি শুনেছি, স্যানটিনোর ভাতিজা ডিয়েগোর কাছে।
হতাশায় চোখের দু-ধারে ভাজ পড়ল হাইমাসের। কিছু বোঝা যায় না…কিচ্ছু না।
হাইম, স্বামীর চেয়ে স্ত্রীর মেজাজ অনেক ঠাণ্ডা, বুদ্ধিও রাখে, এত ভেঙে পড়ছ কেন? দেখিই না চেষ্টা করে। প্রথম কাকাতুয়াটার কথাই ধরি, বো-পীপ তার ভেড়া হারিয়েছে বলছে। ধরে নেয়া যায়, ছবিটার কথা বলছে। ওটাও তো একরকম হারানোই আছে এখন। কোথায় আছে জানে না, তারমানে আমরা জানি না।
বেশ, হলো, বলল হাইমাস। কিন্তু শারলক হোমসকে ডাকার মানে কি?
বুঝতে পারছি না। এবার দু-নম্বরটার কথা ধরা যাক। বিলি শেকসপীয়ার বলে, টু বি অর নট টু বি…
ও ভাবে বলে না, তোতলায়, ফাঁস করে দিল মুসা।
তোতলায়! কাকাতুয়া? আঁতকে উঠেছে হাইমাস। না, আর হলো না। এ রহস্যের সমাধান আমার কাজ নয়। গোঙাতে শুরু করল সে। লরা, পেটটা চিনচিন করছে আবার।
কতবার বলেছি, উত্তেজিত হয়ো না, উদ্বিগ্ন হলো মিসেস।
ডাক্তারও তো বারণ করেছে। একটা ছবির জন্যে মিছেমিছি…হ্যাঁ, যা বলছিলাম, দুই নম্বর মেসেজ কিছুই বুঝছি না। তিন নম্বরে বোধহয় বোঝাতে চাইছে, কোন এলাকায় লুকানো রয়েছে ছবিটা।
হোয়্যার ডেড ম্যান গার্ড ইট এভার, এক হাতে পেট চেপে ধরে আরেক হাতে কপালের ঘাম মুছল হাইমাস। কোন জলদস্যুর দ্বীপ মনে হচ্ছে। জলদস্যু
আর গুপধনের গল্প দারুণ ভালবাসত জন সিলভার।
হ্যাঁ, জলদস্যুর দ্বীপের মতই শোনায়, একমত হলো মিসেস হাইমাস। ভালমত ভাবতে হবে।
কিন্তু ওই সাত নম্বরটা কি? ভুরু নাচাল হাইমাস। একটা আমেরিকান স্নাঙ, শুনে মনে হয় এক ডাকাত আরেক ডাকাতকে তার ন্যায্য পাওনা কিংবা অধিকার দিতে চাইছে না। কিংবা কোন সমঝোতায় আসতে চাইছে না। এর একটাই মানে, আপনাদের পাওনা দেয়ার ইচ্ছে নেই সিলভারের, আমাদের সঙ্গে কোন চুক্তিতে আসতে রাজি নয়।
বাকি তিনটে মেসেজ পেলে হয়তো কিছু বোঝা যাবে, বলল মিসেস। ওগুলো ছাড়া হবে না।
এক কাজ করলে হয়, আঙুলে চুটকি বাজাল রবিন।
কী? এক সঙ্গে প্রশ্ন করল মিস্টার আর মিসেস।
রবিন হুড, শারলক হোমস আর ক্যাপ্টেন কিড তো আছেই। ওদের দিয়ে কথা বলালে হয়। তারপর সঙ্কেতের মানে বের করে ফেলতে পারবে কিশোর।
কিন্তু কথা তো বলে না, মুখ গোমড়া হয়ে গেল হাইমাসের। ওই দেখো না, কেমন চুপ করে আছে? চেঁ-টোও করছে না।
স্যানটিনো হয়তো বলাতে পারবে, বলল মুসা। তিন হপ্তা কাকাতুয়াগুলোকে পুষেছে, তাকে ওরা চেনে। আমার মনে হয় ও চেষ্টা করলে পারবেই।
ঠিক বলেছ, লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল হাইমাস, দুলে উঠল জালার মত পেট, স্যানটিনো পারবে। চলো, এক্ষুণি।
১১
ছুটে চলেছে ভ্যান।
সামনের সীটে হাইমাসের পাশে বসেছে রবিন আর মুসা।
পেছনে মিসেস হাইমাস। তার মাথার ওপরে ভ্যানের ছাতের রডে ঝুলছে পাঁচটা খাঁচা।
হাইমাস যেখানে নতুন বাসা নিয়েছে, তার থেকে অনেক দূরে স্যানটিনোর গ্রাম, উপকূলের ধারের সমভূমিতে। পৌঁছতে বিকেল হয়ে যাবে।
আঁকাবাঁকা নির্জন পাহাড়ী পথ ধরে ছুটছে গাড়ি।
হঠাৎ শোনা গেল মিসেসের উত্তেজিত কণ্ঠ, হাইম, একটা গাড়ি! পিছু নিয়েছে।
গাড়ি? রিয়ার-ভিউ মিররে তাকাল হাইমাস। কই?।
মোড়ের ওধারে…ওই যে বেরোচ্ছে: কোয়ার্টার মাইল দূরে।
হ্যাঁ হ্যাঁ, দেখছি। সেডান পিছু নিয়েছে, কি করে বুঝলে?
তাই তো মনে হচ্ছে?
কি রঙ? ধূসর? উত্তেজিত হয়ে বলল মুসা। কই, দেখি তো?
তার পাশের মিররে দেখা যাচ্ছে না গাড়িটা, পেছন দিকে উঁকি-ঝুঁকি দিয়েও কিছু দেখল না। শেষে কেবিনের দরজা খুলে শক্ত করে তার হাত ধরতে বলল রবিনকে। দরজা দিয়ে বের করে দিল শরীরের অর্ধেকটা। কই…ও, হ্যাঁ, দেখেছি। সেদিন ওই গাড়িটাই দেখেছিলাম, ধাক্কা লাগিয়ে দিচ্ছিল।
শোঁপা! গুঙিয়ে উঠল হাইমাস। কি করি এখন?
চালিয়ে যাও, তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে মিসেসের কণ্ঠ, সামনের শহরটায় ঢোকার আগে ধরতে দেবে না।
কিন্তু মাইল পঁচেকের ভেতর তো কোন শহর নেই। খালি পাহাড় আর পাহাড়। অ্যাক্সিলারেটর টিপে ধরল সে, যতখানি গেল। প্রচণ্ড গোঁ গোঁ করে প্রতিবাদ জানাল পুরানো এঞ্জিন, ঝনঝন করে কাপছে ঝরঝরে বডি, বিপজ্জনক গতিতে ছুটল পাহাড়ী পথ ধরে।
টায়ারের কর্কশ আর্তনাদ তুলে বাঁক ঘুরল গাড়ি। এক ধারে হালকা লোহার বেড়া, জোরে ধাক্কা লাগলে ঠেকাতে পারবে না, উড়ে গিয়ে পাঁচশো ফুট নিচের খাদে পড়বে গাড়ি। জোরে মোড় নিতে গিয়ে বেড়ার সঙ্গে নাক ছুঁই-ছুঁই হয়ে গেল ভ্যানের, দম বন্ধ করে ফেলল দুই গোয়েন্দা। কিন্তু সময়মত সরিয়ে আনল হাইমাস।
একেবারে পিছে এসে গেছে, চেঁচিয়ে জানাল মিসেস। পাশ কাটাতে চাইছে।
আয়নায় দেখতে পাচ্ছি, বিড় বিড় করল হাইমাস। কিন্তু সাইড দেব না।
সাঁই করে রাস্তার মাঝখানে গাড়ি নিয়ে এল সে। পেছনে টায়ারের তীক্ষ্ণ চিৎকার শোনা গেল, গাল দিয়ে উঠল যেন হর্ন।
ঝাঁকুনি খেতে খেতে ছুটে চলেছে পুরানো ভ্যান, বডির বিচিত্র শব্দে আরোহীদের কান ঝালাপালা। কিন্তু উপায় নেই। গতি কমানো যাবে না। পেছনে ছায়ার মত লেগে আছে বিশাল সেডান। খালি পাশ কাটানোর চেষ্টা।
খানিকদূর নেমে ধীরে ধীরে আবার উঠে গেছে পথ। হঠাৎ যেন মাটি খুঁড়ে উদয় হলো বিশাল এক ট্রাক, পথের শেষ মাথায়। পুরো রাস্তা জুড়ে আসছে, ফাঁক খুবই সামান্য।
মস্ত এক দানব যেন ছুটে আসছে পাহাড় কাঁপিয়ে।
চিল্কার করে মাথা নুইয়ে ফেলল রবিন।
শেষ মুহূর্তে স্টিয়ারিং ঘোরাল হাইমাস, কোনমতে পাশ কাটিয়ে এল ট্রাকের। পলকের জন্যে ট্রাক-ড্রাইভারের এক জোড়া বিস্মিত চোখ নজরে পড়ল মুসার।
সেডানটাও নিরাপদেই ট্রাকের পাশ কাটাল। খানিকটা পিছিয়ে পড়ল। কিন্তু গতি বাড়িয়ে পুষিয়ে নিল আবার ফারাকটা। রাস্তার মাঝখানে ভ্যান তুলে আনার কথা যেন ভুলে গেল হাইমাস, সুযোগটা কাজে লাগাল সেডান। চলে এল ভ্যানের পাশে।
সীটের ধার, দরজার কিনার, যে যেটা পারছে খামচে ধরে সীটে বসে থাকার চেষ্টা চালাচ্ছে দুই গোয়েন্দা। ঝাঁকুনির চোটে বার বার সরে যাচ্ছে, পড়ে যেতে চাইছে সীট থেকে। ওই অবস্থায় থেকেই নজর দিল সেডানের ভেতর। চারজন আরোহী, তিনজন বয়স্ক, আরেকজন তরুণ। ফেকাসে চেহারা। লম্বা নাক চেপে ধরেছে জানালার কাচে, বিকৃত হয়ে গেছে চেহারা। কিন্তু তা-সত্ত্বেও চিনতে পারল দুই গোয়েন্দা।
টেরিয়ার ডয়েল।
শুঁটকি! বোম ফাটল যেন মুসার কণ্ঠে। হারামী কোথাকার।…দাঁড়াও, আগে ধরি, তারপর… আস্তিন গোটানোর জন্যে হাত সরিয়ে আনতেই খামচে ধরল জানালার কিনার।
ঢালু হয়ে গেছে আবার পথ। ভ্যানের এক পাশে একশো ফুট গভীর খাদ, আরেক পাশে সেডান। সরে আসছে পাশে, ইঞ্চি ইঞ্চি করে ভ্যানটাকে সরিয়ে দিচ্ছে খাদের দিকে। ধাক্কাধাক্কি করে সেডানের শক্তিশালী এঞ্জিনের সঙ্গে পারা যাবে না, বুঝে গেছে হাইমাস। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, না, হবে না। না থামলে খাদে ফেলে দেবে।
ব্রেক কষল সে। থেমে গেল ভ্যান, ডান পাশের চাকা দুটো খাদের কিনার থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে। বাঁ পাশে ভ্যানের একেবারে গা ঘেষে দাঁড়াল সেডান। দরজা খোলার উপায় নেই। ডান পাশের দরজা খোলা যায়, কিন্তু লাভ কি? একশো ফুট নিচে তো লাফিয়ে নামতে পারবে না।
ওদের দিকে চেয়ে মসৃণ হাসি হাসল ফরাসী লোকটা, দাঁতে চেপে রেখেছে সাগর কলার মত মোটা এক সিগার। ওটা সরিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল, এই যে, হাইমাস, দেখা হয়েই গেল। যতখানি ভেবেছিলাম তত বড় নয় আমেরিকা।
কি চাই এনথনি? ভোঁস ভেঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছে হাইমাস, ঘামছে দরদর করে। মেরেই ফেলেছিলে।
কি যে বলো। মারব কেন? খুব বাজে ড্রাইভ করো তুমি, মাতালে ওরকম করে। এক কাজ করো খাঁচাগুলো আমার গাড়িতে তুলে দাও। টমাস, যাও তো, ভ্যানের পেছনের দরজাটা খুলে দেবে ওরা। খাঁচাগুলো নিয়ে এসো, সহজ ভঙ্গিতে কথা বলছে সে। যে কোন ব্যাপারই না এসব।
যাচ্ছি, স্যার, মনিবের মত শান্ত নয় বেঁটে ড্রাইভার, গাড়ি চালাতে হয়েছে তো, তাই বোধহয় সামান্য হাঁপিয়ে পড়েছে।
লরা, দরজা খুলে দাও, হাইমাস বলল, আর কিছু করার নেই। বাধা দিলে খাদে ফেলে দেবে।
অনিচ্ছাভরে উঠল মিসেস হাইমাস, পেছনের দরজার হুক সরিয়ে ওপরের দিকে তুলে দিল দরজা।
দুই গোয়েন্দা দেখছে টেরিকে। খুব মজা পাচ্ছে সে। হাসছে দাঁত বের করে। জোরে ঠোঁট কামড়ে ধরল মুসা। পারছে না নামতে, নইলে হাসি বের করে দিত। টেরির দাঁত ফেলে দেয়ার জন্যে হাত নিশপিশ করছে তার।
ব্যাপারটা বুঝতে পারছে টেরি। মুসাকে আরও রাগিয়ে দেয়ার জন্যে ভেঙচি কাটল। হাহ, গোয়েন্দা। চোরের সঙ্গে গিয়ে হাত মিলিয়েছে।
অনেক কষ্টে চুপ রইল মুসা আর রবিন।
খাঁচাগুলো নামাচ্ছে টমাস, শব্দ শোনা যাচ্ছে।
বস, টমাসের গলা শোনা গেল, জায়গা হচ্ছে না সবগুলো। ছেলেটাকে নামিয়ে দিলে হবে।
এই ছেলে,শোঁপা বলল। নামমা তো।
নামব? হাসি হাসি ভাবটা চলে গেল টেরির। নামব কেন? আমিই তো দেখালাম।
দেখানো শেষ হয়েছে। এবার নামো।
তর্ক শুরু করল টেরি।
টমাস, বলল শোঁপা, ছুঁড়ে ফেলে দাও তো বেয়াদবটাকে।
কুৎসিত হাসি হেসে এগিয়ে এল টমাস। টেরির ঘাড় ধরে বেড়াল-ছানার মত টেনে বের করে ফেলে দিল রাস্তায়।
উঠে বসল টেরি। বোকা হয়ে গেছে, বিশ্বাস করতে পারছে না এই ব্যবহার করা হবে তার সঙ্গে। কিন্তু আমাকে পাঁচশো ডলার পুরস্কার দেবেন বলেছিলেন।
বিল পাঠিয়ে দিয়ো তোমার বাবার কাছে। অনেক বড়লোক, আমাদের হয়ে দিয়ে দেবে, ময়লা দাঁত বের করে হেসে চোখ টিপল টমাস। সব কটা খাঁচা গাড়িতে তুলল। বস, একটা কম। কালো পাখিটা নেই।
নেই? জানালা দিয়ে মুখ বের করল শেপা। হাইমাস? ব্ল্যাকবিয়ার্ড কোথায়? সাতটা পাখিই তো লাগবে।
ও, আমার ঘরে ঢুকেছিলে তুমিই? কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক হচ্ছে না হাইমাসের। জেনেছ সবাই। চোর কোথাকার।
ব্ল্যাকবিয়ার্ড কোথায়? হাসি সামান্যতম মলিন হলো না শোঁপার। সাতটাই লাগবে।
উড়ে গেছে।
যাহ মিছে কথা বলছ। মুসা আর রবিনের দিকে তাকাল শোঁপা, শীতল চাহনি। তোমাদের কাছে আছে, না? খুব চালাক তোমরা।
নেই, চোখ সরিয়ে নিল রবিন। কোথায় আছে জানি না।
হাইমাসের পকেটের দিকে চোখ পড়ল শোঁপার। তাড়াহুড়ো করে রবিনের লেখা কাগজটা খুঁজে রেখেছিল হাইমাস, অনেকখানি বেরিয়ে আছে। শোঁপার দৃষ্টি অনুসরণ করে পকেটের দিকে চেয়েই সামান্য চমকে গেল সে। ঠিকই খেয়াল করল ধুরন্ধর চিত্র-চোর। হাত বাড়াল, দেখি কাগজটা? নইলে ধাক্কা দিয়ে গাড়ি খাদে ফেলে দেব।
মুসার হাতে কাগজটা দিল হাইমাস, মুসা দিল শেপাকে।
হুঁ, হাসিমুখে মাথা দোলাল শেপা, সাতটার মধ্যে তিনটে। বাকিগুলো কথা বলেনি, না? বলবে, বলবে। ব্ল্যাকবিয়ার্ডকে দরকার। দেখি পারলে খুঁজে নেব। চলি হাইমাস, লণ্ডনে দেখা হবে।
চলে গেল সেডানটা।
ছাই হয়ে গেছে হাইমাসের চেহারা। স্টিয়ারিং খামচে ধরে গুঙিয়ে উঠল সে, পরক্ষণেই দু-হাতে চেপে ধরল পেট.। উফফ…
কি হলো, হাইম? ভুরু কোঁচকালো মিসেস। খারাপ লাগছে?
ব্যথা।…বেড়েছে…
হ্যাঁচকা টানে দরজা খুলে নেমে এল মিসেস হাইমাস। মুসা আর রবিনকে নামতে বলল। হাইমাসকেও নামাল ধরে ধরে। নিজে উঠে বসল ড্রাইভিং সীটে। তার পাশে উঠল আবার হাইমাস। মুসা আর রবিন উঠল পেছনে।
তাদের দিকে ফিরে বলল মিসেস, বেশি উত্তেজনা। অ্যাসিডিটি বেড়ে যায় ওর, আলসার আছে। গাড়ি স্টার্ট দিল, এখন সোজা হাসপাতাল। পড়ে থাকবে কয়েকদিন। স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে খাদের ধার থেকে গাড়ি সরিয়ে আনতে আনতে বলল, কাউকে কিছু বোলো না। পুলিশকে বলে কিছু হবে না। এদেশে শেপার বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই পুলিশের।…তবে, তোমাদের হাজার ডলার ঠিকই পাবে, যদি ছবিটা আমাকে দিতে পারো।
ব্রেক কষল মিসেস। সামনে দু-হাত তুলে দাঁড়িয়েছে টেরিয়ার। শুনুন। আমাকে ফেলে যাবেন না, প্লীজ।
কঠিন চোখে তাকাল মিসেস হাইমাস। কুঁকড়ে গেল টেরিয়ার।
যাও, ওঠো, কড়া গলায় বলল মিসেস।
গাড়িতে উঠল টেরিয়ার।
বলল, কি হয়েছিল, গাড়ি চালাতে চালাতে বলল মিসেস হাইমাস। শোঁপা খুঁজে পেল কি করে আমাদের? তুমি কিছু করেছ।
এই শুঁটকি, সরো, গন্ধ লাগে, ঝাল মেটানোর সুযোগ পেয়ে গেছে মুসা।
থাক, মুসা, বাধা দিল মিসেস। এই, তুমি বলো। চুপ করে আছো কেন?
রকি বীচের মেইন রোডে হাঁটছিলাম, মিনমিন করে বলল টেরিয়ার। হঠাৎ পাশে এসে থামল শেপার গাড়ি। জিজ্ঞেস করল, রোলস-রয়েস চড়ে এমন তিনটে ছেলেকে চিনি কিনা। বললাম, চিনি, আড়চোখে রবিন আর মুসার দিকে তাকাল, অস্বস্তি চাপা দিতে পারছে না। শোঁপা বলল, হলুদ ঝুঁটিওয়ালা কয়েকটা কাকাতুয়া খুঁজে বের করে দিতে পারব কিনা, ওগুলো নাকি তার, চুরি হয়েছে। প্রতিটি পাখির জন্যে দেড়শো ডলার করে দেবে। বললাম, পারব। আমাকে একটা ফোন নম্বর দিয়ে সে চলে গেল।
সে-রাতে এমনি ঘুরতে গিয়েছিলাম হলিউডে, কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করলাম। ওরা সবাই জানে কাকাতুয়ার কথা, খোজাখুঁজি করছে। আমিও যোগ দিলাম। একটা কাকাতুয়া কোথায় আছে, জেনে ফেললাম। গো… ইয়ে… গোয়েন্দাদের আগেই গিয়ে হাজির হলাম। নিয়ে গেলাম। ফোন করলাম শেপাকে।
খুব খুশি হলো ও। তখন বলল, কিশোর গোয়েন্দারা নাকি কয়েকটা চোরকে সাহায্য করছে। ওদের পিছু নিতে বলল।
রোলস রয়েসের পিছু নিলাম। একটা পুরানো বাড়ির সামনে থামল গাড়িটা। কিছুক্ষণ পর দেখলাম, গোয়েন্দাদের না নিয়েই গাড়িটা চলে যাচ্ছে। একটু পর দুই গোয়েন্দা বেরোল আরেকটা কাকাতুয়া নিয়ে। তারপর আপনাদের ভ্যান এল, ওদের তুলে নিতে দেখলাম।
ভ্যানকে অনুসরণ করে দেখে এলাম কোথায় থামে। পাহাড়ের চিপা থেকে বেরিয়ে একটা ফোনবুদে গিয়ে আবার ফোন করলাম শেপাকে। ছুটে এল সে।
তারপর আর কি? তিক্ত কণ্ঠে বলল টেরিয়ার। বেঈমানী করল সে, পাঁচশো ডলার দিল না…
ঘাড়েও হাত দিল…আহারে! জিভ টাকরায় ঠেকিয়ে চুকচুক শব্দ করল মুসা।
থাক, মুসা, টেরিয়ারের করুণ দশায় দুঃখ হচ্ছে রবিনের। আর কিছু বোলো।।
একটা মোড়ে এসে গাড়ি রাখল মিসেস হাইমাস। টেরিয়ারকে বলল, আমরা এখন হাসপাতালে যাব। হেটে চলে যাও বাস স্টপেজে।
টেরিয়ার নেমে গেলে দুই গোয়েন্দাকে বলল মিসেস হাইমাস। হ্যাঁ, তোমরা কিন্তু খোজা বন্ধ কোরো না, হাজার ডলার পাবে।
১২
হেডকোয়ার্টারে আলোচনায় বসেছে তিন গোয়েন্দা।
সারাদিন ইয়ার্ডে ব্যস্ত থেকেছে কিশোর, একা একা অনেক কাজ করেছে। রবিন আর মুসাকে আরেকটা বাস স্টপেজে নামিয়ে দিয়েছিল মিসেস হাইমাস। ওখান থেকে রকি বীচে ফিরে যার যার বাড়ি গিয়ে খেয়ে তারপর ইয়ার্ডে এসেছে।
তিনজনেই শ্রান্ত।
ওই রোলস-রয়েসই যত নষ্টের মূল, কথা শুরু করল কিশোর। ওটাই ফাঁস করে দিল দু-বার, চোরেরা আমাদের পিছু নিতে পারল। শিক্ষা হলো একটা। চট করে লোকের চোখে পড়ে এমন কোন কিছু ব্যবহার করা উচিত নয় গোয়েন্দাদের।
শুধু একথা বলার জন্যেই বসেছ? হাত ওল্টাল মুসা। সারাদিন কত কাণ্ড হলো। হাতে পেয়েও হারালাম কাকাতুয়াগুলো। কষ্ট করলাম আমরা, আর শুঁটকির বদৌলতে ওগুলো সব পেল শোঁপা।
কাকাতুয়াগুলোরও অনেক হয়রানি হচ্ছে, কিশোর বলল। আমার মনে হয়, এত সহজে শোঁপার কাছে মুখ খুলবে।
কিন্তু ও খোলাবেই, রবিন বলল। ও যে-রকম মানুষ দেখলাম, কাকাতুয়াও ওর কাছে মুখ না খুলে পারবে না।
পারলেও সময় লাগবে। তাতে কিছুটা সময় পাব আমরা।
কি হবে তাতে? মুসা জিজ্ঞেস করল। চারটে মেসেজ জানি আমরা, লাগবে সাতটা। বাকি তিনটে শেপার কাছ থেকে ছিনিয়ে আনবে নাকি?
না, তা আনতে পারব না, স্বীকার করল কিশোের। মিস্টার ফোর্ডের কাকাতুয়া এনে দিতে পারব না, মিসেস বোরোরটাও দিতে পারব না। ছবিটা খুঁজতে সাহায্য করতে পারব না মিসেস হাইমাসকে…।
এমনকি শুঁটকির লম্বা নাকটা ঘুসি মেরে ভোতাও করে দিতে পারব না, মুসার সব রাগ গিয়ে পড়েছে টেরিয়ারের ওপর, তার জন্যেই হাত থেকে ফসকে গেল পাখিগুলো। ব্যাটা পালিয়েছে, আসার সময় শুনলাম। কোন আত্মীয়ের বাড়ি নাকি বেড়াতে গেছে। মরুকগে, হারামজাদা।
কয়েক মিনিট নীরবতা। চুপচুপ নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। অবশেষে মাথা ঝাকাল, হ্যাঁ, ভরসা কম।
আবার নীরবতা। ব্ল্যাকবিয়ার্ড দানা ঠুকরে খাচ্ছে, শুধু তার মৃদু খুটখুট আওয়াজ।
ক্যাপ্টেন কিড, শারলক হোমস আর রবিন হুডকে কথা বলাতে পারলে কিছু হয়তো করা যেত, বিড়বিড় করল রবিন।
রবিন হুড, খপ করে কথাটা ধরল ব্ল্যাকবিয়ার্ড। মাথা কাত করে তাকাল তিন গোয়েন্দার দিকে। ডানা ঝাপটাল। আয়্যাম রবিন হুড, স্পষ্ট উচ্চারণ। আই শট অ্যান অ্যারো অ্যাজ এ টেস্ট, আ হানড্রেড পেসেস শট ইট ওয়েস্ট।
ঝট করে মুখ তুলে তাকাল তিনজনেই।
শুনলে কি বলল? মুসার প্রশ্ন।
তোমার কি মনে হয়… কিশোরের দিকে চেয়ে থেমে গেল রবিন, ডোক গিলল।
চুপ, ফিসফিস করে বলল কিশোর। ওকে বাধা দিয়ো না। দেখি, আবার বলে নাকি? ময়নার দিকে চেয়ে জোরে বলল, হালো, রবিন হুড।
আয়্যাম রবিন হুড, আবার বলল ব্ল্যাকবিয়ার্ড আই শট অ্যান অ্যারো অ্যাজ এ টেস্ট আ হানড্রেড পেসেস শট ইট ওয়েস্ট, বলেই ডানা ঝাপটাল আবার।
হাঁ হয়ে গেছে মুসা।
কিশোরও অবাক। আস্তে বলল, মনে আছে, ডিয়েগো বলেছিল, ময়নাটা জন সিলভারের কাঁধে বসে থাকত? কাকাতুয়াগুলোকে যখন বুলি শেখাত তখনও।
হ্যাঁ, উত্তেজনায় কথা আটকে যাচ্ছে রবিনের। আরেকটা ব্যাপার সেদিন খেয়াল করিনি, ময়নাটা কিন্তু স্কারফেসের বুলি বলেছিল, আই নেভার গিভ আ সাকার অ্যান ইভন বেক…সত্যি, ময়নারা কাকাতুয়ার চেয়ে অনেক ভাল কথা শেখে কিশোর, অন্য দুটো…।
দেখি চেষ্টা করে, বেছে ভাল একটা সূর্যমুখীর বীচি নিয়ে ব্ল্যাকবিয়ার্ডের ঠোঁটের কাছে বাড়িয়ে ধরল কিশোর। ডাকল, হালো, শারলক হোমস। হালো, শারলক হোমস।
আগের বারের মতই সাড়া দিল ময়না। ডানা ঝাপটে বলল, ইউ নো মাই মেথডস, ওয়াটসন। থ্রি সেভেনস লীড টু থারটিন, কথায় কড়া ব্রিটিশ টান।
লিখে নাও, রবিন, নিচু গলায় বলল কিশোর। দরকার ছিল না, সে বলার আগেই লিখতে শুরু করেছে নথি-গবেষক।
ক্যাপ্টেন কিড, ময়নার ঠোঁটের ফঁাকে আরেকটা বীচি ধরিয়ে দিল কিশোর। হালো, ক্যাপ্টেন কিড।
আয়্যাম ক্যাপ্টেন কিড, জবাব দিল ময়না। লুক আনডার দা স্টোনস বিয় দা বোনস ফর দা বক্স দ্যাট হ্যাজ নো লকস।
খাইছে! কণ্ঠস্বর কিছুতেই দাবিয়ে রাখতে পারল না মুসা। এ-তো দেখি জ্যান্ত টেপ রেকর্ডার। সব মুখস্থ করে রেখেছে
আগেই আন্দাজ করা উচিত ছিল আমার, গম্ভীর হয়ে বলল কিশোর। ওই যখন, স্কারফেসের বুলি বলল…। ২ বলার নেশায় পেয়েছে যেন ব্ল্যাকবিয়ার্ডকে, স্কারফেসের নাম শুনেই চেঁচিয়ে উঠল, আই নেভার গিভ আ সাকার অ্যান ইভন ৰেক! অ্যাণ্ড দ্যাটস আ লেড পাইপ সিনশ। হা-হা-হা! টেনে টেনে হাসল সে, যেন এক মহা-রসিকতা করে ফেলেছে।
কাগজের ওপর পেন্সিলের তুফান চালাচ্ছে রবিন। লেখা শেষ করে পাতাটা বাড়িয়ে দিল কিশোরের দিকে। নাও, সাতটাই হয়ে গেল।
তা হলো, মাথা কাত করল মুসা। কিন্তু আরেকটা কাজ বাকি রয়ে গেল। খুব ছোট্ট সহজ একখানা কাজ।
কি? রবিন বলল।
মেসেজগুলোর মানে বের করা। খুবই সহজ, না?
১৩
লাইব্রেরির কাজে কিছুতেই মন বসাতে পারছে না রবিন। শেষে বই গোছানো বাদ দিয়ে কোডস অ্যাণ্ড সাইফারস নাম লেখা একটা বই তাক থেকে নিয়ে টেবিলে মেলে বসল। মাথায় ঘুরছে সাতটা মেসেজ। কিন্তু বইয়ের সাহায্য নিয়ে অনেক চেষ্টা করেও কিছু বুঝল না। বিরক্ত হয়ে রেখে দিল শেষে। আশা করল, এতক্ষণে হয়তো মানে বের করে ফেলেছে কিশোর।
ছুটির পর বাড়ি ফিরে কোনমতে নাকেমুখে কিছু খুঁজে দিয়ে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল আবার।
নিরাশ হলো হেডকোয়ার্টারে ফিরে। শূন্য চোখে তার দিকে তাকাল মুসা।
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। রবিনের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির জবাবে বলল, কয়েকটা ব্যাপার মোটামুটি আন্দাজ করা যাচ্ছে, বাকি কিছুই বুঝছি না। এক নম্বর ধরো, বো-পীপ তার ভেড়া হারিয়েছে, তারমানে ছবিটা হারানোর কথা বলছে, মিসেস হাইমাসেরও তাই ধারণা।
সায় জানিয়ে মাথা ঝাকাল অন্য দুজন।
কিন্তু কল অন শারলক হোমসের মানে কি? প্রশ্ন করুল রবিন।
ডেকে আনা গেলে তো ভালই হত, মুসা বলল। ভদ্রলোকের সাহায্য এখন খুব দরকার আমাদের।
বুঝতে পারছি না, মুসার রসিকতায় কান দিল না কিশোর। পাঁচ নম্বরে আবার শারলক হোমসের কথা বলা হয়েছে : ইউ নো মাই মেথডস, থ্রি সেভেনস লীড় টু থারটিন..
মাথা কাত করল ব্ল্যাকবিয়ার্ড, বলে উঠল, থ্রি সেভার্স লীড টু থারটিন।
সেভারস? মুসা ধরল শব্দটা।
সেভেনসকেই ওরকম উচ্চারণ করে অনেক ইংরেজ, বলল রবিন। তারপর, বলল, কিশোর?
দুই নম্বরে বিলি শেকসপীয়ার যা বলছে, বলল কিশোর, কিছুই বুঝতে পারছি।
তিন নম্বরে, রবিন বলল, মনে হয় কোন জলদস্যুর দ্বীপের কথা বোঝননা হয়েছে।
একটা ম্যাপ খুলল কিশোর। এই যে, এটা লোয়ার ক্যালিফোর্নিয়া। ডিয়েগো বলেছে, তিনদিনের জন্যে চলে গিয়েছিল জন সিলভার।.হেঁটে গিয়েছিল, না কাউকে ধরে গাড়িতে করে গিয়েছিল, জানি না। ওই তিন দিনেই বাক্সটা লুকিয়ে রেখে ফিরে এসেছিল। ধরি, হেঁটেই গিয়েছিল, অন্তত যাওয়ার সময়। গাড়িতে উঠলে তার চেহারা, পোশাক আর হাতের বাক্স দেখে লোকের কৌতুহল হতে পারে, সেটা এড়ানোর জন্যে। কতদূর যেতে পারে? ক্যাটালিনা আইল্যাও? মেকসিকো? বড় জোর ডেথ ভ্যালি?
ডেথ ভ্যালি, চেঁচিয়ে উঠল মুসা। মানুষের হাড়ের অভাব নেই ওখানে। ওটাই। কিন্তু একটা ছবির জন্যে যাব ওখানে? দুদিনেই ওখানে আরও তিনটে কঙ্কাল বাড়বে।
সম্ভাবনার কথা বলছি, বলল কিশোর। ওখানেই আছে, বলিনি।
চার নম্বরে বলছে, রবিন বলল, একশো কদম পশ্চিমে। কোনও একটা নির্দিষ্ট জায়গা থেকে কোনদিকে কতখানি যেতে হবে।
তা-তো বুঝলাম, সঙ্গে সঙ্গে বলল মুসা। কিন্তু কোন জায়গা থেকে? হলিউড, নাকি ভাই? নাকি পুরো উত্তর আমেরিকা?
পাঁচ নম্বর বুঝতে পারছি না, এবারেও মুসার কথায় কান দিল না কিশোর। ছয় নম্বরে আবার দিক নির্দেশনা, এবং ঠিক কোন জায়গায় খুঁজতে হবে, বলছে।
কিন্তু আবার সেই পাথর আর হাড়ের কথা, গজগজ করুল মুসা।
ঘুরেফিরে সেই জলদস্যুর দ্বীপ, রবিন যোগ করল।
ক্যাটালিনা আইল্যাণ্ডে কখনও জলদস্যু ছিল বলে তো শুনিনি? আর, ওদিকে ওই একটা দ্বীপই আছে।
স্বর্ণ-সন্ধানের যুগে দলে দলে চোর-ডাকাত ওদিকে ছুটেছিল, মনে করিয়ে দিল কিশোর। ওদের কথাও বলে থাকতে পারে।
হ্যাঁ, তা পারে, মাথা দোলাল রবিন। এবার শেষ মেসেজটা, কি বলতে চায়? আমার মনে হয় কি জানো, এটাতেই রয়েছে জন সিলভারের প্রতিশোধ। হয়তো বলছে, সবগুলো মেসেজের মানে বের করার প্রও ছবিটা তুমি খুঁজে পাবে না।
তাহলে আর কষ্ট করে লাভ কি? হাত ঝাড়ল মুসা।
রহস্য ভালবাসে কিশোর। জটিল রহস্যের সমাধান করে আনন্দ পায়। কিন্তু গোলকধাধায় পথ হারাতে রাজি নয়। এই কেস যেন অনেকটা তাই, গোলকধাধায় ফেলে দিয়েছে তাকে, কিছুতেই কিছু করতে পারছে না। শোঁপারও অবস্থা হয়তো আমাদেরই মত, বলল সে। মাথা ঘুরছে। আমাদের তো তবু ব্ল্যাকবিয়ার্ড আছে, মেসেজ সব পেয়েছি, তার তো তা-ও নেই। তবে, চিত্র-চোর তো, কোড-ফোড নিশ্চয় আরও অনেক ভেদ করতে হয়েছে, অভ্যস্ত। হয়তো বুঝে ফেলবে। তার আগেই কিছু একটা করা দরকার আমাদের।
কিছুক্ষণ নীরবতা।
তারপর উঠে দাঁড়াল গোয়েন্দাপ্রধান, যাও, বাড়ি চলে যাও, বসে থেকে লাভ নেই। কিছু বুঝলে ফোন করে জানাব। তোমরাও বুঝলে জানিয়ো।
এত তাড়াতাড়ি ছেলেকে বাড়ি ফিরতে দেখে রবিন আর মুসা দু-জনেরই বাবামা অবাক হলেন।
পরদিন, সারাদিন ইয়ার্ডে কাজ করল কিশোর। খরিদ্দারদের জিনিসের দাম হিসেব করতে ভুল করল তিনবার।
গ্যারেজে নিজেদের গাড়ি পরিষ্কার করতে গিয়ে আরও ময়লা লাগাল মুসা।
লাইব্রেরিতে এক তাকের বই আরেক তাকে রাখল রবিন, এক বই এনে দিতে বললে ভুলে এনে দিল অন্য বই। অন্যমনস্ক। ব্যাপারটা বুঝলেন লাইব্রেরিয়ান, ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন রবিনকে।
বাড়ি এসে সোজা বিছানায় গড়িয়ে পড়ল রবিন। চিত হয়ে বালিশে মাথা রেখে খোলা জানালা দিয়ে চেয়ে রইল সান্তা মনিকা পর্বত-চূড়ার ওপরে ভেসে যাওয়া মেঘের দিকে। সাতটা প্রশ্ন অস্থির করে তুলছে তাকে।
বাড়ি ফিরে ছেলের ভাবসাব দেখে অবাক হলেন মিস্টার মিলফোর্ড। কি রে, রবিন, কি হয়েছে? শরীর খারাপ?
বাবা, একটা জিনিস বুঝতে পারছি না, একটা ধাধা, উঠে বসল রবিন। ধরো, কেউ তোমাকে বলল, আহ্যাভ বারিড মাই ট্রেজার, হোয়্যার ডেড ম্যান গার্ড ইট এভার। কি বুঝবে?
ট্রেজার আইল্যাণ্ড, দাঁতের ফাঁক থেকে পাইপ সরিয়ে বললেন মিস্টার মিলফোর্ড। রবার্ট লুই স্টিভেনসনের সেই বিখ্যাত বই, জলদস্যুদের কাহিনী।
কিন্তু ধরো, যেখানকার কথা বলা হচ্ছে, তার ধারে-কাছে কোথাও কোন দ্বীপ নেই। তাহলে গুপ্তধন আর কোথায় লুকানো থাকতে পারে?
জোরে জোরে বার দুই পাইপ টানলেন বাবা, ধোঁয়া ছাড়লেন নাক দিয়ে, তারপর বললেন, তাহলে আর একটা জায়গার সঙ্গেই ওই বর্ণনা মেলে।
কোন জায়গা? লাফিয়ে বিছানা থেকে নামল রবিন। গোরস্থান, মিটিমিটি হাসছেন তিনি।
এত জোরে টেলিফোনের দিকে ছুটে গেল রবিন, আরেকটু হলে ধাক্কা দিয়ে বাবার হাত থেকে পাইপ ফেলে দিয়েছিল।
ছেলের কাণ্ড দেখে হেসে মাথা নাড়লেন মিস্টার মিলফোর্ড, হাত-মুখ ধোঁয়ার জন্যে বাথরুমে গিয়ে ঢুকলেন।
কিশোর, ওপাশ থেকে কথা শোনা যেতেই বলল রবিন, গোরস্থান! দ্বীপ বাদ দিলে আর একমাত্র ওখানেই মরা মানুষেরা গুপ্তধন পাহারা দিতে পারে।
দীর্ঘ এক মুহূর্ত নীরবতার পর শোনা গেল আবার কিশোর পাশার কণ্ঠ, রবিন, ফোনের কাছাকাছি থেকো। কোথাও বেরিয়ো না।
খাবার টেবিলে খাবারের দিকে মন দিতে পারল না রবিন, বার বার তাকাচ্ছে ফোনের দিকে। আধপ্লেট বাকি থাকতেই বাজল ফোন। দ্বিতীয় বার রিঙ হওয়ার আগেই রিসিভার তুলে নিল সে। বলো?
রবিন, কিশোরের উত্তেজিত গলা, লাল কুকুর চার! জলদি!
রিসিভার রেখে মা-বাবার দিকে তাকাল রবিন। আমার ফিরতে দেরি হবে: রাত দশটা…
কেউ মুখ খোলার আগেই ছুটে বেরিয়ে গেল সে।
ব্যাপার কি? জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার মিলফোর্ড। এত উত্তেজিত?
একটা হারানো কাকাতুয়া খুঁজছে, জানালেন মিসেস মিলফোর্ড, সেদিন বলেছিল আমাকে।
হারানো কাকাতুয়া? হাহ-হা, কফির কাপে চুমুক দিলেন মিস্টার মিলফোর্ড। কিন্তু গোরস্থানে কি করতে যাবে
চমকে উঠলেন মা। তাড়াতাড়ি দরজার দিকে ছুটলেন। কিন্তু রবিনকে দেখা গেল না। চলে গেছে।
১৪
প্রায় একই সময়ে লাল কুকুর চার-এর কাছে পৌঁছল রবিন আর মুসা। কোন কথা বলল না। গেট খুলে সাইকেল ভেতরে ঢুকিয়ে রেখে, জঞ্জালের তলা দিয়ে ক্রল করে এসে ঢুকল হেডকোয়ার্টারে।
ডেস্কের ওধারে মহাব্যস্ত কিশোর। এক গাদা বই, ম্যাপ, কাগজ ছড়িয়ে রয়েছে ডেস্কে। তার চেহারাই বলছে, সুসংবাদ আছে।
তাড়াতাড়ি করতে হবে আমাদের, বলল কিশোর। সে জন্যেই ডেকেছি।
মানে বুঝেছ? রবিন জিজ্ঞেস করল।
পুরোপুরি নয়। তবে কাজ শুরু করা যেতে পারে। তোমার গোরস্থান থেকেই সূত্রটা পেয়েছি।
আমার আইডিয়া নয়, বাবার, বলল রবিন, কিন্তু তার কথা কিশোরের কানে ঢুকল কিনা বোঝা গেল না। বইপত্র নিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এক সময় মুখ তুলে বলল, কিছুদূর এগিয়েছি। সাত ভাগে মেসেজগুলোকে ভাগ করেছে জন সিলভার। পাখির কথা ভুলে গিয়ে শুধু এক দুই করেই চালিয়ে যাব।
যেভাবে খুশি চালাও, গুঙিয়ে উঠল মুসা। কিন্তু জলদি আসল কথা কিছু বলো।
তিনে বলেছে গোরস্থানে ছবিটা লুকিয়ে রেখেছে জন সিলভার। তারমানে, এক আর দুই আমাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে সেখানে।
কিভাবে? রবিনের প্রশ্ন।
এক-এ বলা হয়েছে : লিটল বো-পীপ হ্যাজ লস্ট হার শীপ অ্যাণ্ড ডাজনট নো হোয়্যার টু ফাইণ্ড ইট। কল অন শারলক হোমস। অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ করেছ?
শারলক হোমস মারা গেছে, এই তো? মুসা বলল।
বইয়ের চরিত্র শারলক হোমস, মরল না বাচল, কিছু এসে যায় না। সাহায্যের জন্যে তাকে ডাকতে পারছি না আমরা, বলল রবিন।
ঠিক, তর্জনী দিয়ে বাতাসে কোপ মারল কিশোর। তাই মেসেজে কল ইন শারলক হোমস না বলে বলা হয়েছে কল অন…মানে? তার বাড়ি গিয়ে দেখা করো। কোথায় বাড়ি শারলক হোমসের?
লণ্ডনে, জবাব দিল মুসা।
লণ্ডনে, বেকার স্ট্রীটে, বলল রবিন।
বেশ, কিশোর বলল, তাহলে তাকে খুঁজতে বেকার স্ট্রীটেই যেতে হবে আমাদের। দুইয়ে বলা হচ্ছে, টু-টু-টু বি আর নট টু-টু-টু বিকাকাতুয়া পাখি, তোতলায় না, তার জিভ আর কণ্ঠনালীর গঠনই এরকম, তোতলামি রোগই হয় না। তার মানে? ইচ্ছে করেই শেখানো হয়েছে, যেটা আগেই সন্দেহ করেছিলাম।
তাতে কি? মুসার জিজ্ঞাসা।
একটা কাগজে কিছু লিখল কিশোর। এই যে, দেখো, বাড়িয়ে দিল দুজনের দিকে।
লিখেছে : বেকার স্ট্রীট ২২২বি।
আরি! চমকে গেল মুসা। ঠিকানা!
গোরস্থানের? ভুরু কোঁচকাল রবিন।
ম্যাপের স্তুপ থেকে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার পুরানো একটা ম্যাপ বের করল কিশোর। শত শত শহর রয়েছে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায়, একাধিক বেকার স্ট্রীট। তবে, কবরস্থানই পথ দেখিয়েছে। এই যে, লস অ্যাঞ্জেলেসের দক্ষিণে একটা শহর, মেরিটা ভ্যালি। আর এই যে বেকার স্ট্রীট, আর এটা ভ্যালি স্ট্রীট, আড়াআড়ি কেটেছে দুটো পথ, এক কোণায় আঙুল রাখল সে, এই যে, গোরস্থান। এটার কেয়ারটেকারের বাড়ির নম্বর, টু-টু-টু বি।
আরিসব্বোনাশ! জানলে কি করে? মুসা অবাক।
এই যে রেফারেন্স বইগুলো ঘেঁটে, ডেস্কে ছড়ানো বইগুলো দেখাল কিশোর। তাছাড়া টেলিফোন তো আছেই। গোরস্থানের ওপর লেখা একটা পুস্তিকা পেয়েছি, ট্যুরিস্টদের জন্যে ছাপা হয়েছে। শোনো, পুস্তিকা খুলে পড়তে শুরু করল, ক্যালিফোর্নিয়ার সব চেয়ে পুরানো কবরস্থানগুলোর অন্যতম মেরিটা ভ্যালির গোরস্থান। এখন অব্যবহৃত, অযত্নে পড়ে আছে। শোনা যাচ্ছে, শিগগিরই সংস্কার করে ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। পুস্তিকাটা বন্ধ করল। স্যানটিনো
আর ডিয়েগো যেখানে থাকে, সেখান থেকে জায়গাটা মাত্র তিরিশ মাইল দূরে। তিন। দিনে হেঁটে গিয়ে হেঁটে ফিরে আসা সম্ভব ছিল না অসুস্থ জন সিলভারের পক্ষেও।
বাকি মেসেজগুলো কি বলে? জিজ্ঞেস করল রবিন। বুঝেছ?
না, এখানে বসে বোঝা যাবে না। গোরস্থানে গিয়ে মেলাতে হবে।
চলো, কাল ভোরেই রওনা হয়ে যাই। রোলস-রয়েসের কথা বলে রাখতে হয়, বলল মুসা।
শোঁপা এতক্ষণে বুঝে ফেলেছে কিনা কে জানে, হাত ওল্টাল কিশোর। বুঝলে সময় নষ্ট করবে না। আমাদেরও করা উচিত হয়। সকাল হতে অনেক দেরি। বেলা আছে এখনও। তাড়াহুড়ো করলে আঁধার নামার আগেই ফিরে আসতে পারব। তবে সবাই এক সঙ্গে যেতে পারছি না…
কেন?
শোঁপা নিশ্চয় লোক লাগিয়ে রেখেছে, চোখ রেখেছে আমাদের ওপর। রোলস-রয়েসটা চোখে পড়বেই। আমাদের পিছু নেবে।
তাহলে?
কি কি করতে হবে, দ্রুত ব্যাখ্যা করল কিশোর। ক্ষীণ প্রতিবাদ জানাল রবিন, কিন্তু গোয়েন্দাপ্রধানের জোরাল যুক্তির কাছে টিকল না।
কয়েক মিনিট পর হাজির হলো রোলস-রয়েস।
ধীরেসুস্থে চড়ল তাতে তিন গোয়েন্দা, কেউ যদি চোখ রেখে থাকে, যেন সে ভালমত দেখতে পারে।
ছুটি শেষ হয়নি হ্যানসনের। আজও গাড়ি নিয়ে এসেছে ক্র্যাব। হলদে দাঁত বের করে হাসল। পাখি খুঁজে পেয়েছ এক-আধটা?
কয়েকটা, লোকটার কথার ধরন পছন্দ হলো না কিশোরের। একটাকে পুলিশেও খুঁজছে। চালান এখন। সামনের গেট দিয়ে বেরিয়ে ঘুরে পেছনের রাস্তায় চলে যান। রাস্তায় গিয়ে খুব ধীরে চালাবেন, থামবেন না।
পাত্তা না পেয়ে মুখ কালো করল ড্রাইভার। তবে যা বলা হলো করল।
গাড়ি পেছনের রাস্তায় আসতেই রবিনকে হেডকোয়ার্টারে থেকো বলে দরজা খুলে ডাইভ দিয়ে লাল কুকুর চারের কাছে নেমে পড়ল কিশোর। মুসাও নামল।
তারপর, মাস্টার মিলফোর্ড? মুখ গোমড়া করে বলল শোফার। কোথায় যাব? কাকাতুয়া ধরতে?
না, কিশোর আর মুসার সঙ্গে যেতে না পারার ক্ষোভ চাপতে পারছে না রবিন। উপকূল ধরে চালান আধঘণ্টা। তারপর পুবে মোড় নিয়ে কোন একটা গিরিপথের ভেতর দিয়ে ফিরে আসবেন এখানে।
১৫
কাঁকর বিছানো অসমতল পথে ঝাঁকুনি খেতে খেতে ছুটে চলেছে ইয়ার্ডের ছোট ট্রাক। চালাচ্ছে বোরিস। পাশে বসে পথের দিকে তাকিয়ে রয়েছে দুই গোয়েন্দা।
মাত্র কয়েক মিনিট আগে উঠে বসেছে। এতক্ষণ হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল মেঝেতে। ইয়ার্ডের দশ মাইল দূরে চলে এসেছে গাড়ি। এতদূরে নিশ্চয় আর কেউ নেই তাদের ওপর চোখ রাখার জন্যে।
কেউ পিছু নেয়নি আমাদের, এক সময় বলল বোরিস। কিন্তু ও-কি? ওটা শহর না ভূতের গী। আমাদের ব্যাভারিয়ায় ওরকম অনেক শহর আছে… ভূতের গল্প আরু করল সে।
এমনিতেই চলেছে গোরস্থানে। এসব ভূতের গল্প এখন মোটেই ভাল লাগছে না মুসার।
মেরিটা ভ্যালিতে পৌঁছতে এক ঘন্টা লাগল। ঠিকই বলেছে বোরিস, এটাকে শহর বলা চলে না। বাণিজ্য কেন্দ্রগুলো ফেলে এল পেছনে। ছাল চামড়া ওঠা, পুরানো বেকার স্ট্রীট ধরে এগিয়ে চলল। দুই ধারে একটা বাড়িও চোখে পড়ল না। পথের শেষ মাথায় পাথরের ছড়ানো দেয়াল। দেয়ালের ওপাশে পাথরের শত শত কুশ আর স্মৃতিস্তম্ভ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। মেরিটা ভ্যালির গোরস্থান।
হাত তুলে দেখাল মুসা। দেয়ালের এক জায়গায় ফাঁক, মানে দেয়াল নেই ওখানে। কাঠের একটা পুরানো সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে।
২২২বিবেকার স্ট্রীট।
এখানেই থামব? জিজ্ঞেস করল মুসা।
মাথা নাড়ল কিশোর। বোরিস, ডানে যান। পরের রাস্তাটায়।
হোকে, যাচ্ছি।
মস্ত কবরস্থান, অনেক পুরানো। দেয়ালের কোণের দিকে আসার পর চোখে পড়ল প্রাচীন গির্জার ধ্বংসাবশেষ, পাথর আর কাঁচা ইটে তৈরি। নির্জন, পরিত্যক্ত।
মোড় নিল বোরিস। এগোল আরও শ-খানেক গজ। কবরস্থান পেছনে ফেলে চলে এল ইউক্যালিপটাস গাছের বেশ বড়সড় একটা ঝাড়ের কাছে। পথের ওপর মাথা নুইয়ে আছে ডালপালা, বয়েসের ভারে বাঁকা হয়ে গেছে যেন কোমর। পাতার ঝঝাল তৈলাক্ত গন্ধ ভারি করে তুলছে বাতাস।
গাছের নিচে রাখুন, বোরিসকে বলল কিশোর।
নামল দুই গোয়েন্দা।
আমাদের দেরি হবে, বলল কিশোর, আপনি এখানে থাকুন।
হোকে। রেডিও অন করে দিয়ে একটা খবরের কাগজ টেনে নিল বোরিস।
এবার কি? জিজ্ঞেস করল মুসা।
নীরবে একটা ফাঁকা মাঠ দেখাল কিশোর, কোণাকুণি গিয়ে মিশেছে গোরস্থানের দেয়ালের সঙ্গে। কেউ না দেখে ফেলে আবার। ভেতরে কেউ থাকতেও পারে।
নিঃশব্দে দেয়াল টপকাল দুজনে।
নেই কেউ, বলল মুসা, তবে থাকলে ভাল হত। বড় বেশি নির্জন। ভয় লাগছে।
জবাব দিল না কিশোর। অনেক দিনের অব্যবহৃত একটা পথ ধরে এগিয়ে চলল। দু-ধারে অসংখ্য ছোটবড় স্মৃতিস্তম্ভ আর ক্রুশ, কোনটা আস্ত কোনটা ভাঙা, কোনটা হেলে রয়েছে বিষণ্ণ ভঙ্গিতে।
পথ চিনে রাখো, মুসা, অন্ধকার হলেও যেন ফিরে যাওয়া যায়। তুমিই পারবে, আমাকে দিয়ে হবে না।…এহহে, যাহ, টর্চ আনতে ভুলে গেছি।
মরেছি! অন্ধকারে? কুকুরছানার মত কেউ করে উঠল মুসা। দরকার কি এতক্ষণ থাকার? হালকা এক ঝলক ধোঁয়ার মত কিছু উড়ে গেল ওদের সামনে দিয়ে। আরে? আবার কুয়াশা।
পশ্চিমে তাকাল কিশোর, প্রশান্ত মহাসাগরের অসীম বিস্তার যেন পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। হ্যাঁ, ঠিকই আন্দাজ করেছে মুসা। পানির ওপরে চাপ চাপ ধোঁয়ার মেঘ ভাসছে, বাতাসে দুলে ধীরে ধীরে সরে আসছে এদিকেই।
এরকম হয় দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায়। কোন আভাস না দিয়েই হঠাৎ করে কুয়াশা জমতে শুরু করে সাগরের ওপর, ধেয়ে আসে উপকূলে, দিনের বেলায়ও তখন কয়েক হাত দূরের জিনিস দেখা যায় না।
দিল বোধহয় সর্বনাশ করে, কিশোরের কণ্ঠে শঙ্কার ছায়া, মুখ গম্ভীর।
অন্ধকারের চেয়েও খারাপ। এসে পড়ার আগেই যদি ছবিটা খুঁজে পেতাম।…ওই যে, রাস্তাটা।
লম্বা লম্বা পায়ে হেঁটে চলল কিশোর। দুটো বড় স্মৃতিস্তম্ভের মাঝ দিয়ে এসে থামল অনেকগুলো পথের একটা সঙ্গমস্থলে। পথের শাখাপ্রশাখা এখান থেকে বেরিয়ে আলের মত ছড়িয়ে গেছে বিশাল গোরস্থানের ভেতরে ভেতরে। জায়গাটা ২২২ বি লেখা সাইনবোর্ডের কাছেই।
এবার? অস্বস্তি লাগছে মুসার।
পকেট থেকে নোট লেখা কাগজ বের করল কিশোর। টু টু টু বি বেকার স্ট্রীটে এলাম। চার নম্বর মেসেজ বলছে, একশো কদম পশ্চিমে যাও। গেটের মুখ উত্তর দিকে…তাহলে, এই যে, এদিকে…
কি?
একশো কদম মানে একশো গজ, বিড়বিড় করল কিশোর। জন সিলভারের কথা মোতাবেক এখান থেকে একশো গজ পশ্চিমে যেতে হবে আমাদের। মুসা, শুরু করো। তোমার পা লম্বা, বড়দের সমান হবে।
এক…দুই…তিন করে গুণে গুণে পা ফেলতে শুরু করল মুসা। তার পেছনে রইল কিশোর।
এক জায়গায় চল্লিশ ফুট দূরের দেয়ালের সঙ্গে সমান্তরাল হয়ে চলে গেছে একটা পথ, ওটা ধরেই এগোচ্ছে এখন।
একশো গুণে থামল মুসা। এবার?
পাঁচ নম্বর বলছে, ইউ নো মাই মেথডস, ওয়াটসন। থ্রি সেভেনস লীড টু থারটিন।
মাথা লিখেছে, রাগ করে বলল মুসা।
চিন্তিত চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে কিশোর। হঠাৎ বলল, মুসা, তোমার কদম কি পুরো এক গজ?
কি জানি। মেপে তে দেখিনি।
তাহলে মেপে দেখা যাক। পকেট থেকে একটা প্লাসটিকের টুকরো বের করল কিশোর, একটা তিন বছরের পকেট ক্যালেণ্ডার। এক ধারে চার ইঞ্চি লম্বা স্কেল রয়েছে। মুসার ছড়ানো কদম মেপে দেখল। হুমম। তিরিশ ইঞ্চি। একশো কদমে কম হয়েছে পঞ্চাশ ফুট। হাঁটো। আরও বিশ কদম।
একেবারে পেছনের দেয়ালের কাছে চলে এল ওরা। কিন্তু দৃষ্টি আকর্ষণ করার মত পাথর বা কোন কিছু নেই।
দেখো, হাত তুলে উল্টোদিকে খানিক দূরের তিনটে পাথরের ফলক দেখাল মুসা। পাশাপাশি তিনটে কবরের মাথার কাছে গাথা। তিনটে ফলকে তিনটে নাম হিউগো সেভার্ন, পিটার সেভার্ন, মরিস সেভার্ন। ১৮৮৮ সালের একটা তারিখ লেখা রয়েছে নিচে, একই দিনে তিনজনে পীতজুরে মারা গেছে।
সেভার্ন। চেঁচিয়ে উঠল মুসা, সেদিনই ধরেছিলাম। রবিন উড়িয়ে দিল ইংরেজদের কথার টনি বলে। খ্রি সেভার্নস লীড টু থারটিন।
হ্যাঁ, সেভার্নরা রয়েছে এখানে। কিন্তু তেরোর কাছে নিয়ে যাবে কিভাবে? দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল কিশোর।
পাথরগুলো রয়েছে এক সারিতে, বুদ্ধি খুলে যাচ্ছে মুসার, এক লাইন। লাইনটা ধরে ডানে-বাঁয়ে যে কোন একদিকে হাঁটি।…ইয়াল্লা, কিশোর, জলদি, করো। কুয়াশা এসে পড়ছে।
পাক খেয়ে খেয়ে এগিয়ে আসছে হালকা কুয়াশা, এটা সামনের স্তর, ঘিরে ধরল দুই গোয়েন্দাকে। হাহাকার করে গেল বাতাস, যেন অশরীরী কোন প্রেতের বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস। শিউরে উঠল মুসা। ককিয়ে বলল, কিশোর, জলদি করো, প্লীজ!
বিষণ্ণ পরিবেশকে আরও বিষণ্ণ করে তুলছে বিচ্ছিরি কুয়াশা, কিন্তু কিশোরের ভাবান্তর নেই। গালে টোকা দিচ্ছে, তাকাচ্ছে আশেপাশে। হুঁ!, লাইনটা গিয়ে শেষ হয়েছে ওই পাথরটায়। চলো তো দেখি।
আরেকটা প্রস্তরফলক। এপাশে কিছুই লেখা নেই। ঘুরে ওপাশে আসতেই দেখতে পেল ওরা, লেখা রয়েছে :
চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে আছে এখানে
তেরোজন অচেনা ভ্রমণকারী
ইণ্ডিয়ানরা খুন করেছে এদের সবাইকে।
জুন ১৭, ১৮৭৬
থারটিন! ফিসফিস করল মুসা, জোরে বলতে ভয় পাচ্ছে, যেন ঘুম ভেঙে যাবে তেরোজন হতভাগ্য মানুষের। তিন সেভার্ন নিয়ে এল তেরোর কাছে।
ছয় নম্বর বলছে, কিশোর বলল, লুক আনডার দা স্টোনস বিয়ণ্ড দা বোনস ফর দা বক্স দ্যাট হ্যাজ নো লকস।
কিন্তু কোন পাথরটা? এখানে তো পাথরে বোঝাই।
মেসেজ বলছে, বিয়ণ্ডা দা বোনস, বাঁকা চোখে কয়েকটা পাথরের দিকে তাকাল কিশোর। দূর, কুয়াশা এসেই পড়ল দেখি।…ওই যে, দেয়ালের ধারের ওই মনুমেন্টের কাছে, পাথর পড়ে আছে কতগুলো…কোনকালে পড়েছিল কে জানে, ঠিক করেনি আর।…আচ্ছা, তেরোজনের হাড়গোড়কে বোনস ধরে নিলে ওগুলোকেই স্টোনস বোঝায়, আশেপাশে আর যা আছে, একটা করে পাথর, সুপ নেই…।
কিশোরের কথা শেষ হওয়ার আগেই ছুটে গেল মুসা। দু-হাতে পাথর সরাতে শুরু করল। মুখ না তুলে বলল, কিশোর, হাত লাগাও। কুয়াশার আগেই শেষ করতে হবে।
কাজে এতই মগ্ন রয়েছে ওরা, পেছনে পদশব্দ শুনতে পেল না।
বাহ, খুব কাজের ছেলে, বলে উঠল কেউ।
কানের কাছে যেন বাজ পড়েছে, এত জোরে চমকে উঠল দুজনে।
ঘনায়মান কুয়াশার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে তিনটে মূর্তি, একজন শোঁপা, কোন সন্দেহ নেই, পাশের দুজনকেও চেনে, একজনের নাম জানে, টমাস, আরেকজনের জানে না।
তোমাদের কাজ শেষ, কাছে এসে হাসল শোঁপা। আর কষ্টের দরকার নেই। এবার আমরাই পারব। টমাস, ধরো ওদের।
মনে মনে, এক সঙ্গে একই সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেল দুই গোয়েন্দা। লাফিয়ে উঠে দুজন ছুটল দুদিকে। কিন্তু পারল না। ধরা পড়ে গেল।
টমাস, তুমি ধরে রাখো, আদেশ দিল শোঁপা। ডিংকি, পাথর সরাও।
মুসার হাত মুচড়ে ধরল টমাস, পিস্তল বের করে পিঠে ঠেকাল। কিশোরকে বলল, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। নাকি বন্ধুর পিঠ ফুটো করাতে চাও?
১৬
ঠাণ্ডা, ভেজা গুড় দিয়ে ওদেরকে পেঁচিয়ে নিচ্ছে যেন ঘন কুয়াশা।
দ্রুত হাত চালাচ্ছে ডিংকি, লুকানো হাড় খুঁজছে যেন ক্ষুধার্ত কুকুর। ছোটবড় পাথর, টালি আর কাঁচা ইটের টুকরো ছুঁড়ে ফেলছে চারপাশে, একটা ভাঙা ডাল ছুঁড়ে ফেলল, একটা পুরানো পাইপ ফেলল, কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা টমাস আর ছেলেদের গায়েও এসে পড়ছে কিছু।
এই, দেখেটেখে ফেলো, বলল টমাস। লাগে।
হ্যাঁ, এত তাড়াহুড়ো কি? বলল শোঁপা। আরও আস্তে সরাও না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছে দুই গোয়েন্দা। তেতো হয়ে গেছে মন। এত কষ্টের পর লাভটা কি হলো? ওরা ছবি বের করে দিল, মজা লুটবে এখন ওই বিদেশী চোর।
মন খারাপ লাগছে? শান্তকণ্ঠে বলল শোঁপা। জানো, দুনিয়ার অনেক জায়গায় গিয়েছি আমি, অনেক মিউজিয়ম থেকে ছবি চুরি করেছি, অনেক উঁদরেল পুলিশ আর গার্ডকে বোকা বানিয়ে এসেছি, নিজেকে খুব চালাক ভাবতাম। কিন্তু না বলে পারছি না, তোমরা আমার মত লোককেও বহুত নাকানি-চুবানি খাইয়েছ। ওই গাড়ি বদলানোর বুদ্ধিটা তো রীতিমত…কি বলব? হতবাক করে দিয়েছে আমাকে। কুয়াশায় ভিজে নিভে যাওয়া সিগারেট আবার ধরিয়ে নিয়ে হাসল। কুয়াশার মধ্যে জ্বলন্ত লাইটার হাতে কালো আলখেল্লা পরা মূর্তিটাকে ঠিক মানুষ মনে হচ্ছে না এখন, কবর থেকে উঠে এসেছে যেন, ভূত। আন্দাজ ঠিকই করেছিলে তোমরা, তোমাদের ওপর চোখ রাখতে বলেছিলাম। রেখেছিলও। রোলস-রয়েসটাকে অনুসরণ করেছিল। বিশ মিনিট পর ওটার পাশ কাটিয়ে আসার সময় দেখল ভেতরে মাত্র একটা ছেলে। ফোনে জানাল আমাকে। প্রথমে বুঝতেই পারিনি, ঘটনাটা কি ঘটেছে। অনেক ভাবার পর..নাহ, ইয়াং ম্যান, তোমরা প্রতিভাবান। আমার ভক্তি এসে গেছে। আমি চোর, ঠিক, কিন্তু এনথনি শোঁপার শ্রদ্ধা পেতে হলে… জোরে জোরে কয়েকবার টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল সে, কিন্তু কুয়াশার জন্যে দেখা গেল না ধোঁয়া, এক রঙ হয়ে গেছে।
পাথর সরিয়েই চলেছে ডিংকি।
জন সিলভারের কয়েকটা মেসেজ বুঝেছি তাড়াতাড়িই, আবার বলল শোঁপা। তবে এই কবরখানার কথা ভাবিনি প্রথমে। তাড়াহুড়ো ছিল। ম্যাপ-ট্যাপ নিয়ে বসতে পারলে অবশ্য বুঝে যেতাম। শেষে টুরিস্ট ব্যুরোকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম, আশেপাশে নির্জন পোড়ো জায়গা কোথায় কোথায় রয়েছে। মেরিটা ভ্যালির কথা ওরাই জানাল।
টমের পায়ে এসে পড়ল মাঝারি সাইজের একটা পাথর। গাল দিয়ে উঠল সে। ধমক দিয়ে বলল, এই, দেখে ফেলতে পারো না?
দেখেই ফেলো, ডিংকি, নরম গলায় বলল শোঁপা। পাথর হাড্ডিতে পড়লে ব্যথা লাগে।
বড় চ্যাপ্টামত একটা পাথর সরিয়েই অস্ফুট শব্দ করে উঠল ডিংকি। টেনে পাথরের তলা থেকে বের করে আনল জিনিসটা। এই যে নিন, মিস্টার শোঁপা, আপনার বাক্স।
বাহ! এগিয়ে গিয়ে বাক্সটা নিল শোঁপা। পাশে চোদ্দ ইঞ্চি, লম্বায় তার প্রায় দ্বিগুণ। ছোট শক্ত একটা তালা লাগানো রয়েছে কড়ায়। হ্যাঁ, সাইজ ঠিকই আছে। ভেরি গুড, ডিংকি।
ওটাই, বাংলায় বলল কিশোর, বিষণ্ণ কণ্ঠ।
মুসা বুঝল। কিশোরের কাছে বাংলা মোটামুটি শিখে নিয়েছে সে আর রবিন।
পকেট থেকে খুব শক্তিশালী ঘোট একজোড়া কাটার বের করল শেপী, এক চাপেই কট করে কেটে ফেলল ধাতব আঙটা।
বাজে অবস্থা, কুয়াশার দিকে চেয়ে বলল শোঁপা। তবে মনে হয় না ছবিটার কোন ক্ষতি হবে। ভাল ছবি ভাল রঙ দিয়েই আঁকা হয়। এক পলক দেখি, নিজেকেই বোঝাচ্ছে সে, আসলে লোভ সামলাতে পারছে না।
সাবধানে ডালা তুলে ভেতরে চেয়েই চেঁচিয়ে উঠল রাগে। লাফ দিয়ে তার, পাশে এসে দাঁড়াল ডিংকি। ছেলেদের দিকে মনোযোগ হারিয়েছে টমাসও, গলা বাড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল বাক্সের ভেতর কি আছে।
এক টুকরো কাগজ রয়েছে শুধু বাক্সের ভেতরে। বের করে জোরে জোরে পড়ল শোঁপা, সরি, বন্ধু, মেসেজের মানে ঠিকমত বোঝনি।
কিশোর, ফিসফিস করে বাংলায় বলল মুসা, এই-ই সুযোগ, বলেই ঝাড়া মারল। বাক্সের ভেতর কি আছে দেখার জন্যে ঢিল দিয়েছিল টমাস, ঢিলই রয়ে গেছে আঙুল, ফলে ছুটিয়ে নিতে পারল মুসা। একই সঙ্গে ডাইভ দিয়ে পড়ল সামনে। ছো মেরে তুলে নিল পায়ের কাছে পড়ে থাকা পুরানো পাইপটা। গুলি করবে কিনা দ্বিধা করছে টমাস, সুযোগটা কাজে লাগাল মুসা। এক বাড়ি দিয়ে ফেলে দিল পিস্তল। পরক্ষণেই গায়ের জোরে বাড়ি মারল টমাসের মাথা সই করে।
চট করে সরিয়ে নিয়ে মাথা কোনমতে বাঁচাতে পারল টমাস, কিন্তু কাঁধ বাঁচাতে পারল না। আঁউউ করে উঠে কাঁধ চেপে ধরে বসে পড়ল। দাঁড়িয়েই আছে কিশোর। এসব বিশেষ মুহূর্তে তার পেশী যেন জড় হয়ে যায়, নড়তে চায় না। এক হাতে পাইপ, আরেক হাতে কিশোরের কজি চেপে ধরে টান মারল মুসা। দৌড়ে গিয়ে ঢুকে গেল ঘন কুয়াশার মধ্যে। সামনে খানিকটা জায়গায় কুয়াশা যেন জট বেঁধে কালো হয়ে গেছে, আসলে ইউক্যালিপটাসের একটা ঝাড়। কিশোরকে নিয়ে ছুটে ওটার ভেতরে ঢুকে পড়ল মুসা।
ট্রাকটা ওদিকে, ফিসফিস করে বলল মুসা, হাত তুলে একটা দিক দেখাল। কিছুই চোখে পড়ল না কিশোরের। কোনটা যে কোন দিক, মুসা কি করে খেয়াল রেখেছে, সে-ই জানে। কিশোরের কাছে সব দিক একই রকম লাগছে।
কি করে বুঝলে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
বুঝেছি, শুধু বলল মুসা।
বিশ্বাস করল কিশোর। দিকচিহ্ন খুঁজে বের করার ব্যাপারে ওস্তাদ তার সহকারী। রাতের বেলায়ও এমন সব জায়গায় পথ খুঁজে বের করে ফেলে মুসা, কিশোর যেখানে দিনেই হারিয়ে যায়।
শোননা, দ্রুত বলল মুসা, দেয়ালের ধার ধরে যাও, মাঝে মাঝেই ইউক্যালিপটাসের ঝাড় পাবে। আমরা যেখান দিয়ে ঢুকেছিলাম সেই ফাঁকটার কাছে চলে যেতে পারবে। ঝড়ের ভেতরে ভেতরে চলে যাও!
পারব না, অনিশ্চিত শোনাল গোয়েন্দাপ্রধানের কণ্ঠ, হারিয়ে যাব।
হারাবে না…ওই যে, ব্যাটারা আসছে, ওদের ভুল পথে তুলে দিয়ে আসিগে। গাছের দিকে চোখ রাখবে। আশ্চর্যবোধক আর তীর চিহ্ন এঁকে এঁকে যাব। অসুবিধে হবে না তোমার। যাও।
কাঁধ চেপে ধরে ঝটকা দিয়ে বন্ধুকে ঘুরিয়ে সামনে ঠেলে দিল মুসা। তারপর আরেক দিকে ঘুরে লোকগুলোকে শুনিয়ে জোরে জোরে বলল, এই কিশোর, এই যে এদিকে, এসো।
হই-চই শোনা গেল তিনজন মানুষের।
আবার শোনা গেল মুসার কথা। সরে যাচ্ছে। দূর থেকে দূরে লোকগুলোকে সরিয়ে নিয়ে চলল সে।
অন্ধের মত ছুটছে কিশোর। ভাঙা কুশ, শুভ আর পাথরে হোঁচট খেলো, হুমড়ি খেয়ে পড়ল কয়েকবার। কনুই আর হাঁটুর চামড়া ছিলল কয়েক জায়গায়। এক ঝাড় থেকে বেরিয়ে অনেক কষ্টে খুঁজে পেল আরেকটা ঝাড়।
কুয়াশা এখানে সামান্য হালকা, যেন পানির নিচে রয়েছে সে। কয়েক ফুটের বেশি নজর চলে না। কুয়াশা আসছে…আসছেই ঢেউয়ের মত একনাগাড়ে। গাঢ় হচ্ছে ধূসর রঙ। ওপর দিকে কুয়াশা অনেক পাতলা, তার মধ্যে দিয়ে কোণাকুণি দৃষ্টি চলে অনেক দূর। প্রায় চল্লিশ ফুট দূরে একটা গাছের মাথা আবছামত দেখতে পেল কিশোর। দৌড় দিল সেদিকে।
তিন দিকে ছড়িয়ে পড়েছে তিনজন মানুষের কণ্ঠস্বর, পথ হারিয়েছে মনে হচ্ছে।
মুসার কোন সাড়াশব্দ নেই, কোথায় রয়েছে বোঝা যাচ্ছে না।
গাছের কাছে এসে থামল কিশোর। কুয়াশা এখানে খুবই পাতলা। গাছের গায়ে নীল চকে আঁকা আশ্চর্যবোধকটা স্পষ্ট। তীর চিহ্ন বয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত করছে।
ছুটল কিশোর।
আরেকটা ঝাড়ের কাছে চলে এল। আশ্চর্যবোধক আর তীর চিহ্ন আঁকা আছে আমি টিকা দিপে ধরল
গাছের গায়ে। কি ভাবে যেন কিশোরের আগে চলে গেছে মুসা। পেছনে একজন লোকের চিৎকার শোনা গেল, কোন কিছুতে হোঁচট খেয়ে পড়ে ব্যথা পেয়েছে। অন্য দুজনের গলাও শোনা যাচ্ছে, সরে যাচ্ছে দূরে।
কিশোর যেখানে রয়েছে, সেখানেও ঘন হতে শুরু করেছে কুয়াশা। ভীষণ এক দুঃস্বপ্নে রয়েছে যেন সে, কিংবা কোন প্রেতপুরীতে। গাছের ডালপাতাগুলোকে মনে হচ্ছে কোন পিশাচের বাহু, ধারাল নখ দিয়ে খামচে ধরতে আসছে তাকে। অতি সাধারণ স্তম্ভগুলোও ভয়াবহ ভূতুড়ে রূপ নিয়ে পথ রোধ করতে চাইছে তার। ছোটার সময় কয়বার যে বাড়ি খেয়েছে, কপাল ফুলে গেছে, ব্যথা করছে বুকের একপাশ। কিন্তু সেসব খেয়াল করার সময় এখন নেই।
ছুটে চলেছে কিশোর। যখন মনে করল, দেয়ালের ফাঁকের আর দেখা পাবে না, ঠিক সেই সময়ই দেখতে পেল দেয়ালটা। কুয়াশার মধ্যে দিয়ে শুধু ওপরের অংশ দেখা যাচ্ছে, কালো মোটা রেখার মত।
দেয়ালের ওপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে এসে পড়ল কিশোর। মোটা রেখাটা ধরার জন্যে হাত বাড়াল ওপরে।
কে যেন চেপে ধরল কজি, জীবন্ত আরেকটা হাত।
ঝটকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিতে যাচ্ছিল কিশোর, ফিসফিসিয়ে বলল মূসা, কিশোর, আমি।
বন্ধুর গলা এত মধুর আর কখনও মনে হয়নি কিশোরের। টেনে তাকে দেয়ালের ওপর তুলে নিল মুসা।…
দুজনে লাফিয়ে নামল ওপাশে।
হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল মুসা। নতুন অভিজ্ঞতা হচ্ছে আজ গোয়েন্দাপ্রধানের। কোন ব্যাপারে কারও ওপর এতখানি নির্ভরও আর কখনও করেনি।
ঘন কুয়াশার ভেতরে দেখা যাচ্ছে হলুদ দুটো ঘোলাটে আলো, যেন কোন দানবের চোখ। ট্রাকের হেডলাইট।
হাঁপাতে হাঁপাতে ট্রাকের কাছে এসে থামল দুই কিশোর।
তোমরা হোকে? পাশে এলিয়ে পড়া দুই গোয়েন্দাকে জিজ্ঞেস করল বোরিস।
হ্যাঁ হ্যাঁ, হোকে, দম নিয়ে সারতে পারছে না কিশোর, ফেটে যাবে যেন ফুসফুস। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, আর আলসেমি নয়, কাল থেকেই সকালে উঠে মুসার সঙ্গে ব্যায়াম শুরু করবে সে। আরিব্বাপরে বাপ, দৌড়ানো এত কষ্ট! বাড়ি যান। হারামি এই কুয়াশার ভেতর থেকে বেরোন।
সাবধানে এগিয়ে চলল বোরিস। পুবে। পাতলা হতে হতে এক সময় পেছনে পড়ে গেল কিশোরের হারামি কুয়াশা।
১৭
ট্রাক ছুটছে।
অনেকক্ষণ কোন কথা বলতে পারল না ছেলেরা।
একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত, অবশেষে বলল কিশোর। হারামী হোক আর যাই হোক, কুয়াশা আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে। পিছু নিতে পারেনি শেপার দল।
কেন পিছু নেবে? মুসা বলল। ছবিটা পাইনি আমরা।
ওদের ধারণা, পেয়েছি, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে শুরু করল কিশোর। খুব একচোট দেখিয়েছে জন সিলভার। সাংঘাতিক রসিকতা। এত কষ্টের পর পাওয়া গেল খালি বাক্স, তার ওপর আবার একটা নোট।
জাহান্নামে যাক ব্যাটারা, কিশোরের কথায় বিশেষ কান নেই মুসার। এখন আসুক। বোরিস আছে আমাদের সঙ্গে। পিটিয়ে তক্তা করে দেব। হাতের পাইপটা দেখাল সে। এখনও রয়েছে ওটা তার হাতে, ফেলেনি এত কিছুর পরও। তার কারণ, এটা একটা অস্ত্র। টমাসের বাচ্চাকে যদি আরেকটা খিচতে পারতাম! দাতে দাঁত চাপল সে।
যা একখান খিচেছ সেটাই জিন্দিগিভর মনে রাখবে, মাথায় লাগলে মরেই যেত, বলল কিশোর। দারুণ দেখিয়েছ আজ তুমি, মুসা। আমিও অনেকদিন মনে রাখব।
অবাক হলো মুসা, খুশিও। কিশোর পাশা প্রশংসা করছে। যে শুধু লোকের দোষ ছাড়া আর কিছু দেখে না (মুসার ধারণা) যাক, আজ তাহলে দেখিয়ে দিতে পেরেছে গোয়েন্দাপ্রধানকে, সুযোগ পেলে সে-ও মনে রাখার মত কিছু করতে পারে।
মেসেজের মানে তো বের করলাম, বলল কিশোর। বাক্সটাও পেলাম। কিন্তু ছবি কই?
বলেছেই তো : আই নেভার গিভ আ সাকার অ্যান ইভন ব্রেক, মনে করিয়ে দিল মুসা। হাইমাসের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে।
হয়তো, ভাবনায় ডুবে গেল কিশোর।
সারা পথে আর কোন কথা হলো না। কিশোর ভাবতেই থাকল, মুসাও বাধা দিল না।
রকি বীচে ঢোকার আগে খানিক দুর হালকা কুয়াশার ভেতর দিয়ে আসতে হয়েছে। ছড়িয়ে পড়েছে কুয়াশা। মেরিটা ভ্যালির গোরস্থানে এখন কি অবস্থা ভাবতেই রোম খাড়া হয়ে গেল মুসার।
জোর বাতাস বইতে শুরু করল, দ্রুত দক্ষিণে সরে গেল কুয়াশা।
নিরাপদেই স্যালভিজ ইয়ার্ডে ঢুকল ট্রাক।
চলে হেডকোয়ার্টারে, মুসাকে বলল কিশোর। রবিন নিশ্চয় বসে আছে।
অধীর হয়ে আছে রবিন। বসতে পারছে না। খালি ছটফট করছে, পায়চারি করছে ট্রেলারের ছোট্ট পরিসরে।
দুজনকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠল সে, পেয়েছ?
কিন্তু বন্ধুদের মুখ দেখেই প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেল রবিন। কারও হাতেই বাক্স নেই, মুসার হাতে শুধু পাইপটা। অস্ত্র অনুমান করতে কষ্ট হলো না রবিনের, মারপিট করে এসেছে মুসা।
শোঁপা ধরে ফেলেছিল, ধপাস করে গিয়ে নিজের চেয়ারে গড়িয়ে পড়ল কিশোর।
তবে ছবিটা সে-ও পায়নি, যোগ করল মুসা। নিজের সীটে বসল। বাক্সটা পাওয়া গেছে, ভেতরে শুধু একটা নোট। তাতে লেখা, মেসেজটার মানে নাকি ঠিকমত করতে পারিনি।
তাই? বলল রবিন। অবাক কাণ্ড! জন সিলভার শুধুই রসিকতা করল? খালি খাটানোর জন্যে? নো রেজাল্ট?
আমার তা মনে হয় না, চেহারা বিকৃত করে রেখেছে কিশোর। তাহলে অন্য কিছু লিখত। মেসেজটার মানে ঠিকমত করা হয়নি, একথা লিখত না।
আগেই বলেছিলাম… বলা আর হলো না, ফোন বেজে উঠল।
পরস্পরের দিকে তাকাল ওরা। কে? এখন তো কারও ফোন করার কথা নয়।
হবে হয়তো মিসেস হাইমাস, বলতে বলতে রিসিভার তুলে নিল কিশোর, স্পীকারের সুইচ অন করে দিয়ে বলল, হালো, তিন গোয়েন্দা।
কংগ্রাচুলেশনস, ইয়াং ডিটেকটিভস, শুকনো হাসির সঙ্গে বলল একটা খনখনে কণ্ঠ, কথায় কড়া ফরাসী টান।
কার গলা ঠিকই বুঝতে পেরেছে কিশোর, তবু জিজ্ঞেস করল, কে বলছেন?
এত তাড়াতাড়িই ভুলে গেলে? এই তো খানিক আগে মেরিটা ভ্যালির গোরস্থানে দেখা হয়েছিল। তোমাদের সঙ্গে কয়েকটা কথা বলার লোভ সামলাতে পারলাম না। জন সিলভার খুব বোকা বানিয়েছে আমাকে। আর ঘোরাঘুরি করে কি লাভ? আমি পরাজিত, হতাশা ঢাকতে পারল না এনথনি শোঁপা।
চুপ করে রইল কিশোর।
এয়ারপোর্ট থেকে বলছি, আবার বলল শোঁপা। চলে যাচ্ছি আমি। পুলিশকে জানাতে পারো, লাভ হবে না। ওরা ধরতে পারবে না আমাকে। কেন ফোন করেছি জানো? আরেকবার তোমাদের প্রশংসা করতে। হাইমাসকে বলবে, আমি তার শুভকামনা করছি।
থ্যাংক ইউ, শুধু বলল কিশোর।
আমাকে টেক্কা দিয়েছ তোমরা, আবার বলল শেপা, আজতক আর একজন কি দুজন সেটা পেরেছে। দাওয়াত দিয়ে রাখছি। যদি কখনও ইউরোপে বেড়াতে আসসা, খুঁজে বের কোরো আমাকে। ইচ্ছে করলে সেটাও পারবে তোমরা, আমি জানি। ফ্রান্সের অপরাধ জগত ঘুরিয়ে দেখাব তোমাদের। কত রহস্য, কত রোমাঞ্চ আর উত্তেজনা যে লুকিয়ে আছে সেখানে, কল্পনাও করতে পারবে না। আরেকটা কথা, হয়তো ভাববে চোরের উপদেশ কি শুনব? তবু বলছি, মানুষের কল্যাণে লাগিয়ে তোমাদের মেধা, মানুষের উপকার কোরো, আমার মত চোর হয়ো না। তোমাদের ওপর হয়তো অনেক অন্যায় করেছি, কষ্টও দিয়েছি, মাপ কোরো।
কি যে বলেন, এতই অবাক হয়েছে কিশোর, মিটমিট করছে চোখের পাতা।
কিশোর, আবার বলল শোঁপা, লেকচারের মত শোনাচ্ছে কথাগুলো, তবু বলছি, তোমার দেশ, বাংলাদেশে গিয়েছিলাম একবার। আহা, কি যে কষ্ট ওখানকার মানুষের। চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। বড় হয়ে তোমার দেশে চলে যেয়ো, যদি কোনভাবে পারো, সাহায্য কোরো দেশের মানুষকে..ওরা সত্যি বড় অসহায়…
জোরে জোরে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর, কি যেন মনে পড়ি পড়ি করেও পড়ছে না। কিন্তু মনে পড়ে গেল হঠাৎ। মশিয়ে শোঁপা, আপনি সেই লোক নন তো? ফ্রান্সের গরীব-দুঃখীরা যাকে আধুনিক রবিন হুড বলে?
ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা, কিশোরের প্রশ্ন এড়িয়ে গেল শোঁপা, কাকাতুয়াগুলো ওশেন স্ট্রীটের একটা গ্যারেজ আছে, ঠিকানাটা লিখে নাও চট করে…
দ্রুত লিখে নিল রবিন।
অউ রিভোয়া, মাই বয়েজ, বলল শোঁপা, অ্যাণ্ড এগেন কংগ্রাচুলেশনস।
কেটে গেল লাইন।
অদ্ভুত একটা পরিবেশ সৃষ্টি হলো হেডকোয়ার্টারে। অনেকক্ষণ কেউ কোন কথা, বলতে পারল না। যেন অতি পরিচিত একজন বন্ধু চলে গেল ওদের।
কে ওই আধুনিক রবিন হুড? জিজ্ঞেস করল মুসা।
আমিও শুনেছি ওর নাম, বলল রবিন। দুর্দান্ত এক দস্যু। সেই প্রাচীন কথাটা—ধনীর যম, গরীবের বন্ধু…।
আমি পাল্টে দিচ্ছি কথাটা, কিশোর বলল। উৎপীড়কের যম, উৎপীড়িতের বন্ধু…দুনিয়ার সব ধনীরাই খারাপ নয়…যাই হোক, আমাদের আসল আলোচনা থেকে অনেক দূরে সরে গেলাম।
হ্যাঁ, ছবিটা কোথায় থাকতে পারে? পাইপ দিয়ে হাতের তালুতে আস্তে বাড়ি দিল মুসা। আরে অমন করে চেয়ে আছো কেন আমার দিকে…
ছয় নম্বর মেসেজে কি বলা হয়েছে? নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে কিশোরের।
লুক আণ্ডার দা স্টোনস বিয়ণ্ড দা বোনস ফর দা বক্স দ্যাট হ্যাজ নো লকস, জবাব দিল রবিন।
কিন্তু মূসা, কিশোর বলল, ডিংকি যে বাক্সটা পেয়েছে, ওটাতে তালা লাগানো ছিল। অথচ মেসেজে পরিষ্কার বলছে, ছবি যেটাতে থাকবে তাতে কোন তালা থাকবে না।
ঠিক! চেঁচিয়ে উঠল মুসা, আরেকবার পাইপ দিয়ে বাড়ি দিল হাতের তালুতে। আরেকটা বাক্স আছে…না। আর থাকতে পারে না। খুব ভালমত খুঁড়েছে ডিংকি।
কিন্তু এমন যদি হয়? হাতের তালুতে খুঁতনি রাখল কিশোর। ঘোট অন্য কোন ধরনের বাক্স? যেটাকে বাক্স মনে হবে না? আচ্ছা, সাত নম্বরে কি লিখেছে?
আই নেভার গিভ আ সাকার অ্যান ইভন ব্রেক, বলল মুসা। স্কারফেসকে ওকথাই বলতে শুনেছি, না রবিন?
হ্যাঁ, রবিন মাথা ঝাকাল। তবে তার সঙ্গে ব্ল্যাকবিয়ার্ড যযাগ করেছে, অ্যাণ্ড দ্যাটস আ লেড পাইপ সিশ। এটাও আরেকটা পুরানো স্যাঙ।
তাই? আপনমনে বলল কিশোর। প্রথম স্ল্যাঙে দৃষ্টি দূরে সরানো হয়েছে, তার পরেরটায় দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে, তাই তো বোঝায়? নাকি?
দূর! ঠকাস করে পাইপটা টেবিলে নামিয়ে রাখল মুসা। মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে আমার।
মুসা, পাইপটা কোথায় পেয়েছ? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
কেন জানো না? মুসা অবাক। গোরস্থানে। ডিংকি তুলে ছুঁড়ে ফেলেছিল।
ঝট করে পাইপটার দিকে চোখ চলে গেল রবিনের।
খাঁচার ভেতরে অযথাই ডানা ঝাপটাল একবার ব্ল্যাকবিয়ার্ড।
এটা দিয়েই খিচেছিলাম জনাব টমাস মিয়াকে, হেসে রবিনকে বলল মুসা।
ওই একই জায়গায় পাওয়া গেছে, যেখানে বাক্সটা পাওয়া গেছে, মুসার কথা কানেই ঢুকছে না যেন কিশোরের।
এবং এটা সীসার পাইপ, যোগ করল রবিন।
চোখ বড় বড় হয়ে যাচ্ছে মুসার।
এবং রবিনের কথার সঙ্গে যোগ করল কিশোর, সীসার পাইপ আজকাল খুব রেয়ার, কেউ ব্যবহার করে না। মাথায় দেখো, ক্যাপ লাগান রয়েছে। ভেতরের জিনিস সহজে নষ্ট হবে না।
তালাও নেই, থাবা দিয়ে পাইপটা তুলে নিল মুসা। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুলতে শুরু করল ক্যাপ। এই প্রথম খেয়াল করল, পাইপটা চোদ্দ ইঞ্চির মত লম্বা।
ক্যাপটা টেবিলে রেখে পাইপের ভেতরে আঙুল ঢুকিয়ে দিল মুসা। টেনে বের করে.আনল গোল করে পাকান এক টুকরো ক্যানভাস।
খুলে টেবিলে বিছাল।
হাঁ হয়ে গেল তিন গোয়েন্দা।
চোদ্দ বাই চব্বিশ ইঞ্চি ক্যানভাসের টুকরো। তাতে আঁকা রয়েছে অপরূপ সুন্দরী এক কিশোরী, মধ্যযুগীয় মেষপালিকার পোশাক পরনে, এক মেষশিশুর ভাঙা পায়ের পরিচর্যা করছে। ছবি সম্পর্কে তেমন কোন ধারণা নেই ওদের, তবু স্বীকার করে পারল না, অপূর্ব! দক্ষ শিল্পীর তুলির ছোঁয়ায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে, যেন এখুনি ভেড়ার বাচ্চা কোলে তুলে নিয়ে নাচতে নাচতে চলে যাবে মেয়েটা।
মাস্টারপীস, কোন সন্দেহ নেই।
রামধনুর এক টুকরো, বিড়বিড় করল কিশোর, এক পাত্র সোনা। ঠিকই বলেছে জন সিলভার। এত অল্প কথায় এর চেয়ে ভাল বর্ণনা আর হয় না।
ঘুম পাতলা হয়ে এসেছিল বোধহয় ময়নার, জন সিলভার নামটা কানে যেতেই ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। বার দুই ডানা ঝাপটে বলল, আমি জন সিলভার। কি সুন্দর ছবি, আহা! খুক খুক করে কাশল কয়েকবার, যেন ভারি হয়ে কফ জড়িয়ে গেছে গলায়। তারপর আবার ঠোঁট জল পালকের তলায়, ঘুমিয়ে গেল।
তিন গোয়েন্দার মনে হলো, ব্ল্যাকবিয়ার্ড নয়, কথাগুলো বলল স্বয়ং জন সিলভার।
১৮
দুই দিন পর। বিখ্যাত চিত্রপরিচালক মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফারের অফিসে ঢুকল তিন গোয়েন্দা।
খবরের কাগজ পড়ছেন পরিচালক। ইঙ্গিতে ছেলেদেরকে চেয়ার দেখিয়ে দিয়ে আবার পড়ায় মন দিলেন।
পড়া শেষ হলে কাগজটা ভাঁজ করে রেখে দিলেন। হু। পত্রিকার খবর হয়ে গেছ দেখছি। ছবিও ছাপা হয়েছে।
ফাইলটা পরিচালকের দিকে ঠেলে দিল রবিন।
টেনে নিয়ে খুললেন মিস্টার ক্রিস্টোফার। পাতা উল্টে চললেন একের পর এক।
ঘরে পিনপতন নীরবতা। অপেক্ষা করে আছে ছেলেরা।
ফাইল পড়া শেষ করলেন পরিচালক। ঘড়ি দেখলেন। আজকে সময় খুব কম। জরুরী কাজ আছে। সংক্ষেপে কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দাও তো। কাকাতুয়াগুলো কি করেছ?
বিলি শেকসপীয়ার আর লিটল বোপীপকে যার যার মালিকের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছি, জবাব দিল কিশোর। অন্যগুলোর তো মালিক নেই, হাইমাসের স্ত্রীকে নিতে বলেছি, রাজি হয়নি। ভাবছি মিস কারমাইকেলের পাখির আশ্রমেই দিয়ে আসব।
হ্যাঁ, সেই ভাল হবে, একমত হলেন পরিচালক। তা হাইমাসের খবর কি? তার অসুখ?
পুরোপুরি ভাল হয়নি এখনও, রবিন বলল। আরও কয়েক দিন লাগবে।
মিসেস হাইমাস তোমাদের এক হাজার ডলার দিয়েছে?
দুই হাজার দিয়েছে। এত দামী ছবি খুঁজে পাওয়ার খুশিতে আত্মহারা মহিলা, বলল কিশোর।
খুব ভাল। অনেক টাকা। আচ্ছা, ডিয়েগো আর তার চাচার কি খবর?
দুই হাজার ডলারই মিস্টার স্যানটিনোকে দিয়ে দিয়েছি আমরা, বলল কিশোর। টাকাটা তো আসলে তারই প্রাপ্য। জন সিলভারকে আশ্রয় দিয়েছিল, খাইয়েছিল। কবর দিয়েছিল। এই কেসে যে আনন্দ আমরা পেয়েছি, আমরা তাতেই খুশি।
এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন পরিচালক। মনে মনে বোধহয় প্রশংসা করছেন। ছেলেদের। স্যানটিনো কোথায়?
মেকসিকো চলে গেছে, বাড়িতে। অনেক টাকা পেয়েছে, ওখানে গিয়ে ফুলের বাগান করতে পারবে। কাশির চিকিৎসাও করাতে পারবে, বলল কিশোর।
আর ডিয়েগো?
ও-তো মহাখুশি, স্যার, বলে উঠল মুসা। অটো কোম্পানিতে গিয়েছিলাম আমরা তিনজনে। ম্যানেজারকে অনুরোধ করতেই রাজি হয়ে গেল। ডিয়েগোকে অ্যাপ্রেনটিস হিসেবে নিয়ে নিয়েছে। মনের মত কাজ পেয়ে ডিয়েগো খুশির ঠেলায় রোজ দশবার করে ফোন করে আমাদের।
ভাল হয়েছে। গাড়ির জগতে যুগান্তকারী কিছু করে বসলেও অবাক হব না। মেধা আছে।..ততা, কিছু খাবে? আইসক্রীম…
না, আপনার তাড়া আছে বললেন, তাড়াতাড়ি হাত তুলল কিশোর। আরেকদিন। আজ যাই।
ঠিক আছে, এসো। গুড বাই, ইন্টারকমের সুইচ টিপলেন তিনি, সেক্রেটারিকে জরুরী নির্দেশ দেয়ার জন্যে।
দরজার কাজে চলে এসেছে তিন গোয়েন্দা, পেছন থেকে ডাকলেন পরিচালক, কিশোর?
ফিরে তাকাল তিনজনেই।
এনথনি শোঁপাই ফ্রান্সের আধুনিক রবিন হুড, বললেন তিনি। মহাপুরুষ হওয়ার মত অনেক গুণ আছে তার। তার উপদেশ মনে রেখো।
রাখব, স্যার, একই সঙ্গে মাথা কাত করল তিন গোয়েন্দা।