- বইয়ের নামঃ সাগরসৈকত
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ রহস্যময় গল্প, অ্যাডভেঞ্চার, রোমাঞ্চকর গল্প, গোয়েন্দা কাহিনী
সাগরসৈকত
এক
প্রথম প্রকাশ: মার্চ, ১৯৮৭
চিঠিটা অদ্ভুত। হাতে নিয়ে চিন্তিত চোখে ওটার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ কিশোর পাশা, তৃতীয়বার পড়ল:
তিন গোয়েন্দা,
স্কুল তো ছুটি, চলে এসো না তিনজনেই আমাদের বাড়িতে। চমৎকার জায়গা, বুঝেছ, খুবই সুন্দর। সাগর, পাহাড়, পাখি, কি যে দারুণ, না দেখলে বুঝবে না! হ্যাঁ, আরেকটা কথা, রহস্যের পূজারি তোমরা, কথা দিচ্ছি-এখানে এলে কোন না কোন রহস্য পেয়ে যাবেই যাবে। তোমাদের সঙ্গে আমারও ছুটিটা কাটবে ভাল। এসো, পছন্দ না হলে পরের দিনই চলে যেয়ো আবার, খরচ-খরচা সব আমার।
আসবে তো? তোমাদের অপেক্ষায় রইলাম।
-জর্জ গোবেল।
হেডকোয়ার্টারে বসে আছে তিন গোয়েন্দা। কিশোরের ডেস্কের। উল্টোদিকে বসেছে মুসা আর রবিন।
খামটা উল্টেপাল্টে দেখছে রবিন। খামের এক কোণে প্রেরকের ঠিকানা রয়েছে: জর্জ গোবেল, গোবেল ভিলা, গোবেল বিচ।
ঠিকানাটাও অদ্ভুত! বিড়বিড় করল রবিন।
জায়গাটা কোথায়? মুসার প্রশ্ন।
ড্রয়ার খুলে একটা ম্যাপ বের করে বিছাল কিশোর। তিনজনেই হুমড়ি খেয়ে পড়ল তার ওপর। একটা জায়গায় আঙুল রাখল রবিন। এই যে, এই তো…লস অ্যাঞ্জেলেসেই। যা মনে হচ্ছে…শহরের বাইরে, গ্রামট্রাম থাকবে হয়তো আশপাশে। সাগরের তীরে, এই যে। নাহ, জায়গাটা সুন্দরই হবে।
কিন্তু এই জর্জ গোবেলটা কে? কিশোরের দিকে তাকাল মুসা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। আমাদের পরিচিত না!
কী জানি! নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কয়েকবার গোয়েন্দাপ্রধান, চিন্তিত। কিন্তু চিঠি পড়ে মনে হচ্ছে, আমাদের নাড়িনক্ষত্র সব তার জানা।
দূর! ঠোঁট ওল্টাল মুসা। আমার মনে হয়, কারও শয়তানী। শুঁটকি টেরিও হতে পারে। আমাদের বোকা বানানোর জন্যে করেছে। গেলেই ব্যাটার হাসির খোরাক হব হয়তো।
তা-ও হতে পারে! রবিন বলল।
চিঠিটার দিকে আরেকবার তাকাল কিশোর পাশা, নীরবে কিছুক্ষণ ভাবল। মুখ তুলল হঠাৎ। এই ছুটিতে তোমাদের কোথাও যাওয়ার কথা আছে?
মা আয়ারল্যাণ্ডে যাবে, রবিন বলল। অনেক দিন আমার নানা নানীকে দেখে না, এবার নাকি দেখতে যাবে। বাবা সঙ্গে যেতেও পারে, না-ও যেতে পারে। আমাকে যেতে বলেছিল, আমি মানা করে দিয়েছি। যা শীত এখন, কে যায় মরতে! সারাক্ষণ বাড়িতে বসে থাকা কাথামুড়ি হয়ে, বরফের জ্বালায় বাইরে বেরোনোর জো নেই। তার চেয়ে আমাদের রকি বিচই অনেক ভাল। আমি যাচ্ছি না।
আমার আম্মা-আব্বা যাবে নিউ ইয়র্কে, মুসা বলল। মার বোনের সঙ্গে দেখা করতে। আমি যাব..যদি না…
যদি না? কিশোর ভুরু কেঁচিকাল।
যদি না গোবেল বিচে যাওয়া হয়। নিউ ইয়র্কের লোকের ভিড়ের চেয়ে সাগর অনেক ভাল। তা ছাড়া বলছে, পাহাড়, পাখি…
আরে, আরে! তুমি আবার কবি হলে কবে থেকে! টিপ্পনী কাটল রবিন। ফুলের কথা কিন্তু বলেনি।
কড়া একটা জবাব দেয়ার জন্যে ঘুরে চাইল মুসা। সঙ্গে সঙ্গে হাত তুলল কিশোর, রাখো, রাখো, ঝগড়া বাধিয়ো না, জরুরি আলাপ এটা। হ্যাঁ, তা হলে দেখা যাচ্ছে, তোমরা দুজন কোথাও যাচ্ছ না। আমিও না। তা হলে গোবেল বিচে যেতে বাধা কোথায়?
যাবে ঠিক করে ফেলেছ? মুসার কণ্ঠে বিস্ময়। যদি শুঁটকির কাজ হয়? ও ব্যাটা রকি বিচে আসেনি এবার ছুটিতে, ওখানে গিয়ে বসে আছে। কিনা, কে জানে?
গেলে গেল। ওর চিঠি পেয়ে আমরা গেছি, কী করে জানছে? আমরা কি বলতে যাচ্ছি? তোমার এয়ারগানটা সঙ্গে নেবে, রবিন আর আমি ছিপ নেব। চুটিয়ে পাখি শিকার করব, খরগোশ মারব, মাছ ধরব।
থাকব কোথায়? রবিনের জিজ্ঞাসা।
গোবেল ভিলায়। আর ওরকম কোন ভিলা না থাকলে শহরে এসে তাঁবু-টাবু কিনে নিয়ে যেতে পারব। অসুবিধে কী?
না, কোন অসুবিধে নেই। আরও খানিকক্ষণ আলাপ-আলোচনা করে একমত হয়ে গেল তিন কিশোর, গোবেল বিচেই যাবে। আসছে বুধবার, মাঝখানে শুধু একটা দিন বাকি।
.
মাত্র একটা দিনই যেন আর ফুরোতে চায় না। অবশেষে বুধবার এল। ভোরে উঠে তাড়াহুড়ো করে তৈরি হয়ে নিল রবিন আর মুসা, নাশতা সেরেই পাশা স্যালভেজ ইয়ার্ডে চলে এল। কিশোরও তৈরি হয়ে ওদের অপেক্ষা করছে, দুই বন্ধু আসতেই ওদেরকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল, তিনজনের কাঁধেই ব্যাগ। মুসার হাতে এয়ারগান, রবিন আর কিশোরের হাতে ছিপ।
ছুটির সময়। বাস স্টেশনে বেশ ভিড়। স্কুল ছুটি, বড়দের চেয়ে বাচ্চা ছেলেমেয়েদের ভিড়ই বেশি। কোলাহল, কলরব, উত্তেজনা, সবাই আনন্দমুখর। কোথাও না কোথাও ছুটি কাটাতে যাচ্ছে সবাই।
প্রথম বাসটায় জায়গা পেল না তিন গোয়েন্দা, পরের বাসের টিকিট কাটতে হলো।
বাস ছাড়ল। রাস্তায় গাড়ির ভিড়।
শহর ছাড়িয়ে এল এক সময় বাস। ধীরে ধীরে কমছে যানবাহনের ভিড়। পথের দুপাশে বাড়িঘর আর তেমন নেই এখন, পাহাড় আর টিলাটব্ধরও কমে আসছে। খোলা প্রান্তর।
তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে গাড়ি। জানালার কাছে বসেছে কিশোর, তার দুপাশে অন্য দুই গোয়েন্দা। হু হু বাতাসে চুল উড়ছে ওদের। মনে দারুণ সুখ। আর থাকতে না পেরে এক সময় গান গেয়ে উঠল মুসা। তার সঙ্গে যোগ দিল রবিন, দেখতে দেখতে গান শুরু হয়ে গেল সারা বাস জুড়ে। হাতে তালি দিয়ে তাল দিচ্ছে কয়েকটা ছেলে। বাসের কণ্ডাকটরও যোগ দিল তাদের সঙ্গে। তালে তালে আস্তে আস্তে মাথা দোলাচ্ছে ড্রাইভার। নাহ, ছুটি বটে!