এনসাইক্লোপেডিয়া গ্যালাকটিকা
.
৪. সম্রাট
দ্বিতীয় ক্লীয়ন, লর্ড অব দ্য ইউনিভার্স। দ্বিতীয় ক্লীয়ন অজানা এক কঠিন রোগে ভুগছেন। মানুষের চরিত্রের অস্বাভাবিক নষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলোর বিচারে দুটো বক্তব্য যেমন একটা থেকে আরেকটাকে পৃথক করা যায় না, তেমনি সঙ্গতিহীন।
ইতিহাস বেশ ঘটনাবহুল। কিন্তু এসব ঘটনা নিয়ে দ্বিতীয় ক্লীয়নের কোনো মাথা ব্যথা নেই। কারণ তাতে তার ব্যক্তিগত দুর্ভোগ ইলেকট্রন পরিমাণও কমবে না। এটা ভেবে তিনি একটুও শান্তি পান না যে তার পরদাদার পরদাদা ছিল একটা বর্বর গ্রহের জবরদখলকারী রাজা, আর তিনি নিজে সুদূর অতীতের গ্যালাকটিক রুলারের বংশধর হিসেবে অ্যামেনটিক দ্য গ্রেটের বিশাল জমকালো প্রাসাদে বাস করছেন। এই কথা মনে করে তিনি মোটেই আরাম বোধ করেন না যে তার বাবার প্রচেষ্টার কারণেই সুদীর্ঘ অরাজকতা এবং বিদ্রোহ দমন করে ষষ্ঠ স্ট্যানিলের অধীনে যে শান্তি এবং একতা ছিল তা আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়; যার ফলশ্রুতিতে তার পঁচিশ বছরের রাজত্বকালে ছোটখাটো কোনো বিদ্রোহও রাজকীয় মহিমাকে কলুষিত করতে পারেনি।
গ্যালাক্সির সম্রাট এবং সকল দুর্ভোগের লর্ড তার বালিশের শক্তিবর্ধক ক্ষেত্রে মাথাটা একটু পিছনের দিকে সরানোর সময় আর্তনাদ করে উঠলেন। একটু আরামবোধ করলেন, দেহ শিথিল হল। কষ্ট করে উঠে বসলেন তিনি। গোমড়া মুখে তাকিয়ে রইলেন গ্র্যাণ্ড চেম্বারের দূরের দেয়ালের দিকে। এই শয়নকক্ষেই তিনি কিছু সময়ের জন্য একা হতে পারেন। বিশাল কামরা। সব কামরাই বিশাল।
তবে দরবারের ফিটফাট ভাব, তাদের মিথ্যে ছলনা, ভোতামুখের চেয়ে এখানে একা একা পঙ্গুত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করা অনেক ভালো। ঐসব মুখোশের আড়ালে তার মৃত্যুর পর সিংহাসন দখলের যে নীরব হিসাব-নিকাশ প্রতিনিয়ত চলছে সেগুলো দেখার চেয়ে একা থাকাই ভালো।
তিন পুত্রের কথা মনে পড়ল তার। সুস্থ, সবল, উদ্যমী সম্ভাবনাময় তিন তরুণ। এই দুর্দিনে তারা কোথায়? অপেক্ষা করছে, সন্দেহ নেই। একজন আরেকজনের উপর নজর রাখছে; আর সবাই নজর রাখছে তার উপর।
অস্বস্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকলেন তিনি। ব্রুডরিগ এখন তার সাক্ষাত লাভের জন্য ব্যগ্রভাবে অপেক্ষা করছে। নীচু জাত, বিশ্বস্ত ব্রুডরিগ; বিশ্বস্ত এই কারণে যে সে সকলের ঘৃণার পাত্র এবং এই একটা ক্ষেত্রে যে কয়েক ডজন ক্ষুদ্র স্বার্থান্বেষী দল তার দরবারকে বিভক্ত করে রেখেছে তারা সকলে একমত।
ব্রুডরিগ বিশ্বস্ত ফেভারিট, যার বিশ্বস্ত না হয়ে উপায় নেই, কারণ তার কাছে যদি গ্যালাক্সির সবচেয়ে দ্রুততম মহাকাশযান না থাকে এবং সম্রাটের মৃত্যুর পরপরই যদি সে সেটা নিয়ে পালিয়ে যেতে না পারে তা হলে পরেরদিনই তার স্থান হবে রেডিয়েশন চেম্বার।
দ্বিতীয় ক্লীয়ন তার রাজকীয় শয্যার হাতলে একটা মসৃণ বোতাম স্পর্শ করলেন এবং শেষ মাথায় বিশাল দরজা স্বচ্ছ হয়ে উঠল।
ক্রিমসন কার্পেটের উপর দিয়ে হেঁটে এসে ডরিগ হাটু গেড়ে বসে সম্রাটের দুর্বল হাতে চুমু খেল।
“কেমন আছেন, মহানুভব?” নিচু উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করল প্রিভি সেক্রেটারি।
“বেঁচে আছি,” হাত নেড়ে উন্মা প্রকাশ করলেন সম্রাট। “যদি এটাকে বেঁচে থাকা বল, ঐ গর্দভগুলো চিকিৎসা বিজ্ঞানের বই পড়তে পারে বলেই আমাকে গবেষণার নতুন বিষয় বলে মনে করে। নিরাময়ের নতুন কোনো উপায়, কেমিক্যাল, ফিজিক্যাল, বা নিউক্লিয়ার যা আগে কখনো চেষ্টা করা হয়নি-এমন কিছু পেলেই হল, আগামী কালই তারা এসে হাজির হবে সেটা আমার উপর প্রয়োগ করার জন্য। আর তার কার্যকারীতা প্রমাণ করার জন্য নতুন আবিষ্কৃত কোন প্রাচীন বই মেলে ধরবে সামনে।
“আমার বাবার মতে, রাগের সাথে কথা বলছেন তিনি এমন কোনো দ্বিপদ প্রাণী নেই যে নিজের চোখে পর্যবেক্ষণ না করে কোনো রোগ নিরাময়ের গবেষণা করতে পারবে। এমন কেউ নেই যে সামনে প্রাচীন যুগের একটা বই না রেখে পালস দেখতে পারবে। আমি অসুস্থ, আর ওরা বলছে ‘অজানা। সব গাধা! হাজার বছর ধরে মানব শরীরে যে পরিবর্তন হচ্ছে সেটা প্রাচীন যুগের মানুষেরা কীভাবে গবেষণা করবে, কীভাবেই বা নিরাময়ের ব্যবস্থা করবে। প্রাচীন যুগের মানুষগুলো বেঁচে থাকলে আমি বাঁচতে পারতাম।”
নিচু স্বরে অভিশাপ দিলেন সম্রাট আর ব্রুডরিগ কর্তব্যপরায়ন ভূতত্যর মতো অপেক্ষা করতে লাগলো। দ্বিতীয় ক্লীয়ন জড়ানো স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “বাইরে কতজন অপেক্ষা করছে?”
মাথার ইশারায় তিনি দরজার দিকে দেখালেন। ধৈর্যের সাথে উত্তর দিল ব্রুডরিগ। “গ্রেট হল স্বাভাবিক সংখ্যা ধারণ করছে।”
“বেশ, অপেক্ষা করতে দাও। রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ আমাকে সবসময়ই ঘিরে রেখেছে। গার্ড ক্যাপ্টেন ঘোষণা দিয়েছে? আর নইলে ঘোষণা করতে বল যে আমি আজকে দরবারে বসব না। গার্ডের চেহারা যেন শোক কাতর দেখায়। শেয়াল গুলোর ভেতর সবচেয়ে চতুরগুলো নিজেদের ভেতর বেঈমানী করে বসতে পারে।” বিরক্তিতে নাক কুঁচকালেন তিনি।
“গুজব শোনা যাচ্ছে, মহানুভব” হালকা গলায় বলল ব্রুডরিগ, “আপনার সমস্যা আসলে হার্টে।”
একটু আগে সম্রাটের বিরক্তিতে কুঁচকানো মুখ ছোট হাসিতে পাল্টে গেল। “এটা আমার চেয়ে অন্যদেরই বেশি কষ্ট দেবে। যাই হোক, তুমি কি কাজে এসেছ শোনা যাক।”