- বইয়ের নামঃ ফাউণ্ডেশন্স এজ
- লেখকের নামঃ আইজাক আসিমভ
- প্রকাশনাঃ সন্দেশ
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
ফাউণ্ডেশন্স এজ
১. কাউন্সিলম্যান
ফাউণ্ডেশন্স এজ (১৯৮১) – সায়েন্স ফিকশন
মূল : আইজাক আসিমভ
অনুবাদ : নাজমুছ ছাকিব
কাউন্সিলম্যান
০১.
আমি বিশ্বাস করি না। সেলডন হলের চওড়া সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে গোলান ট্র্যাভিজ কথাগুলো বলল। দূরে টার্মিনাস সিটি সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে।
টার্মিনাসের আবহাওয়া মৃদুভাবাপন্ন, স্থল / জলের অনুপাত অনেক বেশি। আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তির কারণে এটা হয়ে উঠেছে আরো বেশি আরামদায়ক এবং ট্র্যাভিজের মতে পুরোপুরি নিরানন্দ।
আমি এর কোনোটাই বিশ্বাস করি না। হেসে কথাগুলো আবার বলল ট্র্যাভিজ তারুণ্যদীপ্ত মুখে দুধসাদা দাঁতগুলো ঝকমক করে উঠল। ট্র্যাভিজ লম্বা। ঢেউ খেলানো লম্বা কালো চুল। সব সময় নরম ফাইবারের স্যাশ পড়ে।
তার সঙ্গী এবং সহকর্মী কাউন্সিলম্যান মানলী কম্পর অস্বস্তির সাথে মাথা নাড়ল। কম্পরের চুল মাখনহলুদ, চোখ নীল। পোশাক-আশাক সব সময় এলোমেলো। সরাসীরা মূলত দুই শব্দের নাম ব্যবহার করে। কম্পর-এর নাম তিন শব্দে।
কি বিশ্বাস করো না, ট্র্যাভিজ? সে জিজ্ঞেস করল! এই শহর আমরা রক্ষ করেছি, সেটা?
আরে না, টার্মিনাল নিরাপদ থাকবে : সেন চশ বছর আগেই জানতেন। এ-ও জানতেন যে আমরা খুব ভালোভাবেই এই শহর রক্ষা করতে পারব।
কম্পর গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, দেখ, এই কথাগুলে! শুধু তার কাছে বললে, কোনো সমস্যা নেই : কিন্তু চিৎকার করে লোকজনের সামনে বললে, তখন সত্যিকথা বলতে কি আমি তোমার আশেপাশে থাকতে চাই : কারণ ঠিক জানিনা ওরা কতখানি নিখুঁতভাবে রশি দিয়ে আঘাত করতে পারে।
ট্র্যাভিজের হাসি মলিন হলে! ন! ৷ টার্মিনাস নিরাপদ এই কথাগুলো বললে কোনো দোষ হবে। আর এই শহর আমরা রক্ষা করেছি কোনো যুদ্ধ ছাড়াই।
যুদ্ধ করার মতো কোনো প্রতিপক্ষ ছিল না। কম্পর বলল।
তুমি সিভিল ওয়ারের কথা শোননি কম্পর?
রাজধানীর ভিতরে সিভিল ওয়ার?
এই প্রশ্নই সেলডন ক্রাইসিস তৈরি করার জন্য যথেষ্ট। এই কারণেই হ্যাঁনিস এর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার খতম হয়ে গেছে। তুমি আমি কাউন্সিলের মেম্বার হয়েছি। তারপরও ব্যাপারটা এখনো ঝুলে আছে- ট্র্যাভিজ ভারসাম্য রাখার মতো করে দুটো হাত দুদিকে ছড়িয়ে দিল।
ট্র্যাভিজ চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার চারপাশে রয়েছে সরকারের সদস্য, মিডিয়ার লোকজন, সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ যাদেরকে সেলডনের প্রত্যাবর্তন ( অথবা তার ইমেজের প্রত্যাবর্তন) দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সবাই নিচে নামছে, কথা বলছে, হাসছে, সব কিছুর নির্ভুলতা নিয়ে উৎফুল্ল। সেলডনের প্রশংসায় মুখর।
ট্র্যাভিজ কোনোকিছুই লক্ষ্য করছে না। কম্পর দুই ধাপ নিচে নেমে দাঁড়িয়ে পড়েছে। চল যাই, মিটিং শুরু হবে।
এখনই না, দেরী আছে। তাছাড়া মেয়র ব্র্যান্নোর ভাষণ শোনার কোনো ইচ্ছা নেই। চলো বরং শহর দেখি।
দেখেছি। গতকালও দেখেছি।
কিন্তু পাঁচশ বছর আগে যখন এই শহর তৈরি হয়, তখন দেখেছ।
চারশ আটানব্বই বছর আগে, কম্পর স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ভুল শুধরে দিল। ঠিক দুই বছর পরে হেমিমিলেনিয়াম উৎসব হবে। আশা করি ব্র্যান্নো তখনো গদিতে থাকবে।
আশা করি, ট্র্যাভিজ শুকনো গলায় বলল। কিন্তু পাঁচশ বছর আগে টার্মিনাস ছিল একটা শহর। একটা ছোট শহর। অধিবাসী ছিল একদল লোক, একটা এনসাইক্লোপেডিয়া তৈরি করছিল। যা কখনো শেষ হয়নি।
অবশ্যই শেষ হয়েছে।
এখন যে এনসাইক্লোপেডিয়া আমরা ব্যবহার করি, তখন এটা ছিলনা। এখন পুরোটা রয়েছে কম্পিউটারে এবং প্রতিদিন সেটা সংশোধন করা হয়। অসম্পূর্ণ মূল কপি তুমি দেখেছ?
হার্ডিন মিউজিয়ামে যেটা রয়েছে?
স্যালভর হার্ডিন মিউজিয়াম অফ অরিজিন–পুরো নাম বল। দিন-তারিখের ব্যাপারে তুমি যখন এত নিখুঁত। দেখেছ?
দেখা উচিত ছিল?
না তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছুনা। যাই হোক আসল কথা হচ্ছে–একদল এনসাইক্লোপেডিষ্ট পাঁচশ বছর আগে এই ছোট শহরের ভিত্তি তৈরি করে এমন এক বিশ্বে যেখানে ধাতুর নিজস্ব উৎপাদন নেই। যে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে সেটা বাকী গ্যালাক্সি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। গ্যালাক্সির একেবারে শেষ প্রান্তে অবস্থিত। আর এখন আমরা উন্নত বিশ্ব। পুরো গ্রহই বিশাল এক পার্ক। সব কিছুর কেন্দ্র এখন আমরাই।
পুরোপুরি না। কম্পর বলল। এখনো আমাদের সূর্য সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এবং গ্যালাক্সির শেষপ্রান্তে রয়েছে।
তুমি না ভেবেই বলছ। যে সেলডন ক্রাইসিস শেষ হয়েছে তার মূল ব্যাপারটাই এখানে। আমরা টার্মিনাস নামের এই ছোট বিশ্বের চেয়েও বড় কিছু। আমরা ফাউণ্ডেশন-গ্যালাক্সির শেষ প্রান্ত থেকেই আমাদের ক্ষমতা পুরো মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ আমরা আসলে বিচ্ছিন্ন নই–অবস্থান ছাড়া। অবস্থান খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ না।
ঠিক আছে। কম্পর বলল, কোনো আগ্রহ বোধ করছে না। সে আরো একধাপ নামল।
ট্র্যাভিজ এমনভাবে হাত বাড়ালো যেন বন্ধুকে ফিরিয়ে আনতে চায়। তুমি বুঝতে পারছ না কম্পর। এই যে বিশাল সব পরিবর্তন আমরা সেগুলো মেনে নিতে পারছি না। মনে-প্রাণে আমরা অতীতে ফিরে যেতে চাই–সেই বীর নায়ক আর পবিত্র সন্ন্যাসীদের যুগে।
কামঅন, ট্র্যাভিজ!
সত্যি বলছি। এই যে সেলডন হল-কি ছিল তখন? ছোট একটা টাইম ভল্ট আর ছিল এই সিঁড়িগুলো। আর এখন এক বিশাল ভবন। কিন্তু এর চার পাশে কোনো গ্র্যাভিটিক ফিল্ড আছে? কোনো র্যাম্প? কোনো স্লাইডওয়ে? কিছু নেই। শুধু এই সিঁড়িগুলো। স্যালভর হার্ডিন যেগুলো ব্যবহার করতেন। প্রতিটি মুহূর্ত আমরা অতীতকে ধরে রাখতে চাই।
অস্থিরভাবে হাত নেড়ে বাইরের দিকে দেখালো। এমন কিছু দেখাতে পারবে যা ধাতুর তৈরি। একটাও না। এই গ্রহে ধাতুর নিজস্ব উৎপাদন নেই। আর হার্ডিনের সময় তো আমদানী করাও কঠিন ছিল। ভবনগুলো তৈরি করার সময় প্রাষ্টিক ব্যবহার করেছি। সেগুলো বয়সের ভারে ধূসর হয়ে গেছে। অন্য গ্রহের পর্যটকরা। দেখে যেন বলতে পারে গ্যালাক্সি! কি সুন্দর পুরনো প্লাস্টিক কত বড় অপমান, চিন্তা করে দেখ!
তাহলে এই তুমি বিশ্বাস করো না? সেলডন হল?
এবং এর সাথে জড়িত সব কিছু ট্র্যাভিজ হিংস্র স্বরে বলল। দেখ আমাদের পূর্বপুরুষরা এখানে লুকিয়েছিলেন বলে আমাদেরও তাই করতে হবে এমন কোনো কথা নেই! উচিত হবে এখান থেকে বেড়িয়ে মূল স্রোতের সাথে মিশে যাওয়া।
কিন্তু তোমার ধারণা ভুল। সেলডন প্ল্যান যেভাবে কাজ করার কথা, সেভাবেই কাজ করছে।
আমি জানি। টার্মিনাসের প্রত্যেকটি শিশুকেই ছোটবেলা থেকে শেখানো হয় যে হ্যারি সেলডন একটা প্ল্যান তৈরি করেছেন, মানবজাতিকে রক্ষার জন্য ফাউন্ডেশন তৈরি করেছেন আর ভবিষ্যৎ ইতিহাসের এক হাজার বছর অতিক্রম করার পথ দেখিয়ে দিয়েছেন, যেন আমরা পুরনো এম্পায়ার–পাঁচশ বছর আগে যার পতন শুরু হয় এবং দুইশ বছর পূর্বে সেই পতন সম্পূর্ণ হয়–তার চেয়েও শক্তিশালী দ্বিতীয় এম্পায়ার গড়ে তুলতে পারি।
আমাকে এগুলো কেন বলছ গোলান?
কারণ এই ব্যাপারগুলো আমাদের জন্য অপমানজনক। আগে না হলেও এখন তো অবশ্যই। আসলে আমরা নিজেরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করছিনা। আমরাই সেলডন প্ল্যান অনুসরণ করে চলছিনা।
কম্পর অনুসন্ধানী চোখে তার সঙ্গীর দিকে চাইল। এ ধরনের কথা আগেও বলেছ, গোলান। ভেবেছিলাম ঠাট্টা করছ। গ্যালাক্সী! এখন মনে হচ্ছে তুমি সিরিয়াস।
অবশ্যই, আমি সিরিয়াস।
হতে পারে না। হয় তুমি আমার বোঝার অসাধ্য জটিল ধাঁধা তৈরি করছ, অথবা তুমি পাগল হয়ে গেছ।
কোনোটাই না, ট্র্যাভিজ বলল। শান্ত হয়ে এসেছে। স্যাশ-এ বুড়ো আঙ্গুল আটকানো, যেন কথা বোঝানোর জন্য হাত নাড়ার আর প্রয়োজন নেই। স্বীকার করছি আমি অনেক দিন থেকেই ভাবছি, কিন্তু তখন ছিল শুধুই সন্দেহ। আজ সকালের প্রহসনের পর হঠাৎ করেই সবকিছু আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। এখন কাউন্সিল মিটিং-এ সব খুলে বলব।
তুমি পাগল হয়ে গেছ।
চল আমার সাথে, শুনবে।
নিচে নেমে এল দুজন কাউন্সিলের সদস্য সংখ্যা পূর্ণ করতে শুধু এই দুজনই বাকি ছিল। ট্র্যাভিজ যখন সামনে এগুচ্ছে কম্পর তার পিঠের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে বলল বোকা!
.
০২.
মেয়র হারলা ব্র্যান্নে এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের অধিবেশন শুরু করলেন। দেখে মনে হয় কোনোদিকে তার ল্য নেই। কিন্তু উপস্থিত সকলেই জানে যে মেয়র ঠিকই লক্ষ্য করেছেন কারা উপস্থিত হয়েছে এবং কারা এখনো আসেনি।
মেয়রের ধূসর চুল এমনভাবে গোছানো বোঝা যাবে না, পুরুষ না মহিলা। ভাবলেশহীন মুখে কোনো সৌন্দর্য নেই। অবশ্য কেউ তার মুখে সৌন্দর্য অনুসন্ধান করবে না।
তিনি একজন দক্ষ প্রশাসক স্যালভর হার্ডিন বা হোবার ম্যালোর সাথে তাকে তুলনা করা যাবে না। আবার হেরেডিটারী ইন্ডবার্স-মিউলের আগে যে মেয়র ছিল তার নির্বুদ্ধিতার সাথেও কেউ ব্র্যান্যের তুলনা করবে না।
তার বক্তৃতা শুনে কারো রক্ত গরম হয়ে উঠবে না। কোনো নাটকীয় অঙ্গভঙ্গী তিনি করতে পারেন না। তার সবচেয়ে বড় গুণ যা রয়েছে তা হচ্ছে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা এবং তাতে অটল থাকতে পারা। এরকম দৃঢ় মনোভাবের জন্যই প্রতিদ্বন্দ্বীরা মেয়রের ক্যারিক্যাচার এঁকে দেখিয়েছে তার নিচের চোয়াল গ্রানাইট ব্লকের তৈরি। অবশ্য তার চরিত্রের সাথে মিলে গেছে।
সেলডনবাদীদের ধারণা ইতিহাসের গতিপথে অনির্দিষ্ট কিছু ঘটবেনা (মিউলের অপ্রত্যাশিত আবির্ভাবের কথা তারা প্রায়ই ভুলে যায়), তাই সম্ভব হলে যে কোনো শর্তেই ফাউণ্ডেশন ফেডারেশনের রাজধানী হবে টার্মিনাস। এখানে একটা কথা রয়েছে সম্ভব হলে। তাই অনেকেই মনে করে রাজধানী টার্মিনাস থেকে ফাউণ্ডেশন ফেডারেশনের আরো কেন্দ্রের দিকে সরিয়ে নেয়া উচিত।
কিন্তু মেয়র চাননা কেউ এভাবে ভাবুক। তাছাড়া সেলডনের সাম্প্রতিক প্রত্যাবর্তনে তাকেই সমর্থন করেছেন। ফলে তিনি ব্যাপক রাজনৈতিক সুবিধা পেয়ে গেছেন।
এক বছর আগে বলেছিলেন যে পরবর্তী প্রত্যাবর্তনে যদি সেলডন তাকে সমর্থন করেন তবে তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নেবেন। কেউ তার কথা বিশ্বাস না। করলেও প্রতিবাদ করার সাহস সামনে উপস্থিত কারো নেই। এখনো তিনি। রাজনীতির মধ্যবিন্দু। তাছাড়া সেলডন ইমেজ দেখা দিয়ে চলে গেছে। অবসর নেয়ার কোনো নামই নেই।
এখনকার রাজনীতিবিদেরা বক্তৃতা দেয়ার সময় প্রাচীন ইমপেরিয়াল স্টাইল। ব্যবহার করে। কিন্তু মেয়র কথা বলেন পরিষ্কার ফাউণ্ডেশন বাচনভঙ্গীতে
সেলডন ক্রাইসিস শেষ হয়েছে। ফাউণ্ডেশনের পুরনো নিয়ম অনুযায়ী যারা এর বিরুদ্ধে ছিলেন তাদেরকে মৌখিক বা লিখিত কোনোভাবেই কিছু বলা হবে না। তারাও খুশী মনে পরাজয় মেনে নেবেন। দু-পক্ষই পুরো ব্যাপারটা জীবনের মতো ভুলে যাবে।
থেমে অলস চোখে সবার দিকে তাকালেন তারপর শুরু করলেন, অর্ধেক সময় পেরিয়ে এসেছি; এম্পায়ারের পথে বিস্তৃত এক হাজার বছরের অর্ধেক। সময়টা ছিল কঠিন। কিন্তু আমরা অনেক দূর এসেছি। এরই মধ্যে আমরা প্রায় গ্যালাকটিক এম্পায়ারে পরিণত হয়েছি। আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো কোনো শক্তি নেই।
সেলডন প্ল্যান ব্যতীত অরাজকতা চলত ত্রিশ হাজার বছর। তারপরে নতুন এম্পায়ার গড়ে তোলার মতো কোনো শক্তি অবশিষ্ট থাকত কিনা সন্দেহ। হয়তো অবশিষ্ট থাকত কিছু বিচ্ছিন্ন মৃতপ্রায় বিশ্ব।
যা অর্জন করা গেছে তার জন্য আমরা হ্যারি সেলডনের প্রতি কৃতজ্ঞ, বাকি অংশের জন্যেও তার অতি উন্নত চিন্তাভাবনার উপর নির্ভর করতে হবে। তাই এই মুহূর্ত থেকে সেলডন প্ল্যানের উপর অফিসিয়ালি কোনো সন্দেহ করা যাবে না। অর্থাৎ প্রশাসনের সাথে জড়িত কেউ সেলডন প্ল্যানের প্রতি কোনো সন্দেহ বা বিরূপ। সমালোচনা করতে পারবে না। এই প্ল্যান মানবজাতিকে রক্ষা করবে। কাজেই এর উপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস থাকতে হবে।
সদস্যদের মাঝে মৃদু গুঞ্জন শুরু হলো। মেয়র তাকানোর প্রয়োজন মনে করলেন না। এদের নাড়িনক্ষত্র তিনি ভালোভাবেই জানেন? জানেন এই মুহূর্তে কেউ তার বিরোধিতা করবে না। হয়তো আগামী বছর, কিন্তু এখন না। আগামী বছরের সমস্যা আগামী বছরই দেখা যাবে।
শুধু-
থট কন্ট্রোল, মেয়র ব্র্যান্নো? সবাইকে শোনানোর জন্য কথাগুলো ট্র্যাভিজ জোরে বলল। লম্বা পায়ে সামনে এগুচ্ছে।
ব্র্যান্নো তখনো তাকালেন না। খুলে বল, কাউন্সিলম্যান ট্র্যাভিজ।
বলতে চাই আপনি কারো কথা বলার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। যে কেউ, বিশেষ করে কাউন্সিলের সদস্যরা তো অবশ্যই দিনের রাজনৈতিক ঘটনা নিয়ে আলোচনা করতে পারে। কোনো রাজনৈতিক ঘটনাই সেলডন প্ল্যানের বাইরে নয়।
মেয়র হাত ভাঁজ করে চোখ তুলে তাকালেন। এভাবে একটা আলোচনা শুরু করা তোমার ঠিক হয়নি, কাউন্সিলম্যান ট্র্যাভিজ। যাই হোক তোমার কথার উত্তর দিচ্ছি।
সেলডন প্ল্যান নিয়ে স্বাধীনভাবে কথা বলায় কোনো বাধা নেই। সেলডনের ইমেজ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়ার আগে একটা ঘটনার হাজারো ব্যাখ্যা হতে পারে। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার পর এই বিষয়ে কাউন্সিলে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না। এমনকি এর আগেও তোলা যাবে না।
কেউ কোনো প্রশ্ন তুললে, ম্যাডাম মেয়র?
যদি সে সাধারণ নাগরিক হয়, কোনো সমস্যা নেই।
অর্থাৎ, এই নিয়ম শুধু কাউন্সিল মেম্বারদের জন্য?
ঠিক তাই। ফাউণ্ডেশনের পুরনো নিয়ম। এর আগেও অনেক মেয়র ব্যবহার করেছেন। একজন সাধারণ নাগরিকের কথার কোনো গুরুত্ব নেই; একজন সরকারী অফিসারের কথার গুরুত্ব আছে এবং সেটা বিপদ ডেকে আনতে পারে। এই মুহূর্তে বিপদের ঝুঁকি নিতে পারি না।
কিন্তু ম্যাডাম মেয়র, এর আগে ছোটখাটো দু-একটি ক্ষেত্রে হয়তো এই নিয়ম ব্যবহার করা হয়েছে। সেলডন প্ল্যানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কখনোই ব্যবহার করা হয়নি।
সেলডন প্ল্যানের নিরাপত্তা সবচেয়ে বেশি দরকার।
আপনি হয়তো জানেন না, ম্যাডাম মেয়র, তারপর ঘুরে রুদ্ধশ্বাসে বসে থাকা বাকি সদস্যদের উদ্দেশ্য করে বলল, হয়তো আপনারাও জানেন না, বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে সেলডন প্ল্যানের অস্তিত্ব নেই।
আমরা সবাই আজকেই এর কার্যকারিতা দেখেছি, মেয়র ব্র্যানো আগের চেয়েও শান্ত গলায় বললেন আর ট্র্যাভিজ আরো উঁচু গলায় কথা বলতে লাগল।
দেখেছি কারণ আমাদের শেখানো হয়েছে সেলডন প্ল্যান বিশ্বাস করতে।
থামো, কাউন্সিলম্যান ট্র্যাভিজ। তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করছ।
আমার অফিসিয়াল অধিকার রয়েছে, মেয়র।
তোমাকে অফিস থেকে বরখাস্ত করা হলো, কাউন্সিলম্যন।
আপনি তা পারেন না। যে নিয়মের কথা আপনি বলছেন সেটাও আইনসম্মত নয়। এ ব্যাপারে কাউন্সিলে কোনো ভোট নেয়া হয়নি, মেয়র, আর হলেও আমার সে ব্যাপারে প্রশ্ন করার অধিকার রয়েছে।
সেলডন প্ল্যান রক্ষার জন্য যে নিয়মের কথা বলেছি তার সাথে তোমার বরখাস্তের কোনো সম্পর্ক নেই।
তো কিসের সাথে আছে?
তোমাকে বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে অভিযুক্ত করা হলো, কাউন্সিলম্যান। চাই না কাউন্সিল চেম্বারের ভিতরে তোমাকে গ্রেফতার করতে। কিন্তু দরজার বাইরে সিকিউরিটি দাঁড়িয়ে আছে, তুমি বেরোলে ওরাই তোমাকে কাষ্টডিতে নিয়ে যাবে। আমি তোমাকে শান্তভাবে বেড়িয়ে যেতে বলছি। এমন কিছু করো না যাতে সিকিউরিটি এখানে আসতে বাধ্য হয়।
ট্রাভিজের ভুরু কুঁচকে গেছে। হলে পিনপতন নিঃশব্দতা। (সবাই জানত-শুধু সে আর কম্পর বাদে?)। ঘুরে বেরোবার দরজার দিকে তাকালো। কিছুই দেখতে পেল না। কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই মেয়র ব্র্যান্নো ধাপ্পা দিচ্ছে না।
রাগে তোতলাতে লাগল ট্র্যাভিজ। আমি সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিলাম।
তোমাকে হতাশ করতে হলো বলে দুঃখিত।
আমার বিরুদ্ধে কি প্রমাণ রয়েছে?
সেগুলো সময় মতো হাজির করা হবে। নিশ্চিত থাক যতটুকু প্রমাণ দরকার তার সবটুকুই আমাদের হাতে রয়েছে। তুমি একটা অর্বাচীন। আরো জেনে রাখো তোমার বন্ধু তোমার বেঈমানীর সঙ্গী হতে রাজী না।
ট্র্যাভিজ ঝট করে ঘুরে কম্পর-এর দিকে তাকালো।
মেয়র শান্তভাবে বললেন, সবাই খেয়াল রাখবেন আমি বলার সাথে সাথে কাউন্সিলম্যান ট্র্যাভিজ কাউন্সিলম্যান কম্পর-এর দিকে তাকিয়েছিল। এখন তুমি যাবে, কাউন্সিলম্যান? নাকি কাউন্সিলের মর্যাদা নষ্ট করবে?
ট্র্যাভিজ ঘুরে ধীর পায়ে বেড়িয়ে গেল। দরজার বাইরেই দুজন সশস্ত্র সিকিউরিটি দাঁড়িয়ে গেল তার দুপাশে।
আর মেয়র পিছন থেকে তাকিয়ে বিরক্তিতে ফিসফিস করে বললেন, বোকা!
.
০৩.
হারলা ব্র্যান্নোর মেয়রশীপের শুরু থেকেই লিয়েনো কোডেল সিকিউরিটি প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। সে প্রায়ই বলে এই কাজে হাড়ভাঙ্গা কোনো পরিশ্রম নেই। অবশ্য সত্যি বলছে না মিথ্যা বলছে সেটা কেউ বলতে পারবে না।
কোডেলের চেহারা ভরসা করা যায় এমন বন্ধুর মতো। হয়তো তার কাজের জন্য এমন চেহারাই প্রয়োজন। উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে কম, ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। ঝাঁটার মতো গোফ (টার্মিনাসবাসীদের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক ব্যাপার। যার বেশির ভাগই সাদা অল্প কয়েকটা ধূসর। উজ্জ্বল বাদামী চোখ। কভারঅলের বুক পকেটের উপরে পদমর্যাদার চিহ্ন রয়েছে।
বস ট্র্যাভিজ, সে বলল, আমরা বন্ধুর মতো কথা বলার চেষ্টা করি।
বন্ধুর মতো? একজন বিশ্বাসঘাতকের সাথে? ট্র্যাভিজ স্যাশ-এ দুই হাতের বুড়ো আঙ্গুল আটকে দাঁড়িয়ে থাকল।
একজন অভিযুক্ত বিশ্বাসঘাতকের সাথে। আমাদের হাতে এমন কোনো প্রমাণ। নেই যা দিয়ে মেয়র অভিযোগ করার পরও তোমাকে দোষী সাব্যস্ত করা যায়। সেরকম কিছু হবে না আশা করি। আমার কাজ হচ্ছে যদি সম্ভব হয় তোমাকে নির্দোষ প্রমাণ করা। কাজটা খুশী মনেই করব। যদি না তুমি ব্যাপারটাকে পাবলিক ট্রায়ালের পর্যায়ে নিয়ে যাও।
ট্র্যাভিজ অনড়। মিষ্টি কথায় চিড়ে ভিজে না। তোমার কাজ হচ্ছে আমাকে এমনভাবে জেরা করা যেন আমি একজন বিশ্বাসঘাতক। আমি যে তা নই সেটা প্রমাণ করার জন্য তোমাকে আমার সন্তুষ্ট করতে হবে। তুমিও আমাকে সন্তুষ্ট কর।
নীতিগতভাবে পারি না। দুঃখের বিষয় আমার হাতে ক্ষমতা রয়েছে, তোমার হাতে নেই। সে কারণেই আমি প্রশ্ন করতে পারি, তুমি পারো না। যদি কারো মনে হয় আমি বিশ্বাসঘাতকতা করছি তাহলে আমার জায়গায় অন্য কেউ আসবে এবং আমাকে প্রশ্ন করবে। সেও আমাকে একইভাবে বিচার করবে, যেভাবে আমি। তোমাকে বিচার করছি।
তুমি আমাকে কিভাবে বিচার করছ?
বন্ধু হিসেবে। যদি তুমিও অই মনে কর।
তাহলে একটা ড্রিংকস পেতে পারি? ট্র্যাভিজ মুখ ভেঙচে জিজ্ঞেস করল।
পরে হয়তো পাবে। কিন্তু এখন দয়া করে বসো।
ট্র্যাভিজ ইতস্তত করে বসল। কোনোরকম প্রতিরোধ করা তার কাছে হঠাৎ করে মনে হলো অর্থহীন।
এখন আমি যা জিজ্ঞেস করব তার সম্পূর্ণ ও সঠিক উত্তর দেবে?
যদি না দেই? কি ঘটবে? সাইকিক প্রোব?
মনে হয় না।
আমারো তাই মনে হয়। অন্তত কাউন্সিলম্যানের ক্ষেত্রেতো নয়-ই। সাইকিক প্রোব দিয়ে আমি নির্দোষ প্রমাণিত হব। তারপরে তোমার আর মেয়রের বারোটা বাজাবো। সাইকিক প্রোব ব্যবহার করলে তোমাকে অনেক ঝুঁকি নিতে হবে।
ভুরু কুঁচকে ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল কোডেল। না, না। ব্রেইনের অনেক ক্ষতি হয়। যদিও ধীরে ধীরে সেরে যায়। তারপরেও তোমার মতো মাথা গরম লোকের ক্ষেত্রে প্রোব-
হুমকি দিচ্ছ, কোডেল?
শুধু পরিস্থিতি বোঝাচ্ছি, ট্র্যাভিজ। আমাকে ভুল বুঝোনা, কাউন্সিলম্যান। যদি প্রয়োজন হয় অবশ্যই প্রোব ব্যবহার করব। কিন্তু তারপর নির্দোষ প্রমাণিত হলেও কিছু করার ক্ষমতা তোমার থাকবে না।
কি জানতে চাও?
কোডেল তার সামনের ডেস্কের একটা সুইচ বন্ধ করল। আমি যে প্রশ্ন করব, তুমি যা উত্তর দেবে সব রেকর্ড করা হবে, ছবি এবং শব্দ দুটোই। শুধু যা জিজ্ঞেস করব তার উত্তর দেবে। নিজে থেকে কিছু বলবে না। বুঝতে পেরেছ?
আমি বুঝতে পারছি, তুমি তোমার ইচ্ছে মতো রেকর্ড করবে। ট্র্যাভিজ তিক্ত স্বরে বলল।
ঠিক। আবারো বলছি আমাকে ভুল বুঝোনা। তোমার স্টেটমেন্টের কোনো পরিবর্তন হবে না। আমি শুধু কোনটা রাখব, কোনটা বাদ দেবো। কোনগুলো বাদ দেয়া হবে, তুমি জানতে পারবে! এখন আর সময় নষ্ট করো না।
দেখা যাবে।
আমাদের বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে–কোডেলের গলার স্বরে বোঝা গেল রেকর্ডিং চলছে, তুমি খোলাখুলি এবং অনেকবারই বলেছ সেলডন প্ল্যানের অস্তিত্বে বিশ্বাস করো না।
ট্র্যাভিজ ধীরে ধীরে বলল, যদি খোলাখুলি এবং অনেকবারই বলি, তাহলে তোমার আর কি জানার প্রয়োজন আছে?
তর্ক করে সময় নষ্ট করো না, কাউন্সিলম্যান। আমি চাই তোমার স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর রেকর্ড করতে। সম্পূর্ণ নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকলে যেমন ভয়েস প্রিন্ট হয়।
কারণ আমার ধারণা সম্মোহন বা ড্রাগস ব্যবহার করলে ভয়েস প্রিন্ট পাল্টে যায়।
বেশ ভালোভাবেই পাল্টে যায়।
আর তুমি দেখাতে চাও একজন কাউন্সিলম্যানকে জেরা করার সময় বেআইনিভাবে বল প্রয়োগ করা হয়নি। দোষ দেয়া যায় না তোমাকে।
শুনে খুশী হলাম, কাউন্সিলম্যান। আবার শুরু করা যাক। অনেকবারই খোলাখুলিভাবে স্বীকার করেছ যে তুমি লেডন প্ল্যানের অস্তিত্বে বিশ্বাস করো না। ঠিক?
ট্র্যাভিজ শব্দ বাছাই করে ধীরে ধীরে বলল, আসলে সেলডন প্ল্যান হিসেবে যা প্রচলিত রয়েছে তার উপর এত বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত বলে আমি বিশ্বাস করি না।
অস্পষ্ট স্টেটম্যান্ট। একটু বুঝিয়ে বলবে?
আমার কথা হচ্ছে, প্রচলিত যে ধারণা, যে হ্যারি সেলডন সাইকোহিন্ত্রীর গণিতের সাহায্যে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সূক্ষ্ম আচরণ বিশ্লেষণ করে আমাদের জন্য দ্বিতীয় এম্পায়ার তৈরির যে ছক বানিয়েছেন সেটা খুব বেশি সহজ সরল। এমন হওয়ার কথা না।
অর্থাৎ তোমার মতে, হ্যারি সেলডন বলে কেউ ছিলনা?
মোটেই না। অবশ্যই তিনি ছিলেন।
তিনি সাইকোহিস্টোরী বিজ্ঞানের জন্ম দেন নি?
না, এ ধরনের কোনো কথাই আমি বলিনি। দেখ ডিরেক্টর, সুযোগ পেলে কাউন্সিলে সব খুলে বলতাম। এখন তোমাকেই বলি। আমার বক্তব্য খুব সহজ
ডিরেক্টর অফ সিকিউরিটি শান্তভাবে রেকর্ডিং ডিভাইস বন্ধ করল।
ট্র্যাভিজের ভুরু কুঁচকে গেল। বন্ধ করলে কেন?
তুমি আমার সময় নষ্ট করছ কাউন্সিলম্যান। তোমাকে বক্তৃতা দিতে বলিনি?
কিন্তু তুমি আমাকে ব্যাখ্যা করতে বলেছ, বলনি?
মোটেই না। আমি প্রশ্নের উত্তর দিতে বলেছি–সরল, সোজা এবং সরাসরি উত্তর। অন্য কিছু না বলে শুধু যা জিজ্ঞেস করব তার জবাব দাও। তাহলে বেশি সময় লাগবে না।
অর্থাৎ আমার কাছ থেকে এমনভাবে কথা আদায় করবে যেন তোমাদের অবস্থান আরো শক্ত হয়।
তোমাকে শুধু সঠিক স্টেটম্যান্ট দিতে বলেছি। বিশ্বাস করো তুমি যা বলবে তার কোনো পরিবর্তন হবে না। আরেকবার চেষ্টা করতে দাও। হ্যারি সেলডনকে নিয়ে কথা হচ্ছিল। রেকর্ডিং ডিভাইস আবার চালু করে কোডেল শান্তস্বরে একই প্রশ্ন করল, তিনি সাইকোহিষ্ট্ৰী বিজ্ঞানের জন্ম দেননি?
অবশ্যই তিনি একটা বিজ্ঞানের জন্ম দিয়েছেন যাকে আমরা সাইকোহিস্টোরী বলে জানি। ট্র্যাভিজ বলল, তার উত্তেজনা এবং অস্থিরতা চাপা থাকল না।
কিভাবে এই বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা দেবে?
গ্যালাক্সি! সাধারণ ভাষায় সাইকোহিস্টোরী হচ্ছে গণিতের সেই শাখা যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট শর্তের অধীনে নির্দিষ্ট উদ্দীপনায় বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক আচরণ বিশ্লেষণ করা যায়। অন্য কথায় এই বিজ্ঞান সম্ভবত ইতিহাস ও সামাজিক পরিবর্তনের পূর্বানুমান করতে পারে।
তুমি বলছ সম্ভবত, এর গাণিতিক শুদ্ধতা নিয়ে তোমার মনে কোনো সন্দেহ আছে?
না, ট্র্যাভিজ বলল। আমি কোনো সাইকোহিস্টোরিয়ান নাই। ফাউণ্ডেশন সরকারের কোনো সদস্যও তা নয়, টার্মিনাসের কোনো অধিবাসীও নয়, এমনকি কোনো
এক হাত তুলে নরম সুরে বলল কোডেল, প্লীজ, কাউন্সিলম্যান। ট্র্যাভিজ থেমে গেল।
তোমার সন্দেহ করার কোনো কারণ আছে যে হ্যারী সেলডন প্রথম এম্পায়ার থেকে দ্বিতীয় এম্পায়ারে পৌঁছানোর জন্য যে পথ তৈরি করেছেন সেখানে সর্বোচ্চ সম্ভাবনা যুক্ত করে প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণ করতে পারেন নি?
আমি তো তার সাথে ছিলাম না, ট্র্যাভিজ ব্যঙ্গ করে বলল। কি করে জানব।
সেলডন প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণ করেছেন কি করেন নি, তুমি সেটা জানতে পারবে?
না।
তুমি হয়তো মানবে না যে গত পাঁচশ বছর ধরে বিভিন্ন ক্রাইসিসের সময় সেলডনের যে ইমেজ দেখা যায় সেটা সেলডন তার জীবনের শেষ বছরে নিজের হাতে তৈরি করেছেন, ফাউণ্ডেশন প্রতিষ্ঠার কিছুদিন পূর্বে?
সম্ভবত আমি এই ব্যাপারটা অস্বীকার করি না।
তুমি বলছ সম্ভবত। তুমি বলতে চাও পুরো ব্যাপারটা এক ধরনের ছলনা। কোনো উদ্দেশ্য পূরণের জন্য অতীতের কেউ একটা উদ্ভট ডিভাইস তৈরি করেছে?
দীর্ঘশ্বাস ফেলল ট্র্যাভিজ। না, তাও বলছি না।
তোমার কি মনে হয়, হ্যারি সেলডন যে মেসেজ দেন সেটা কেউ একজন ম্যানিপুলেট করে নিজের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে?
না, এমন মনে করার কোনো কারণ ঘটেনি। তাছাড়া ম্যানিপুলেট করা সম্ভব না।
আচ্ছা। তুমি সেলডন ইমেজ-এর সাম্প্রতিক আবির্ভাব প্রত্যক্ষ করেছ। কি মনে হয়েছে? মনে হয়নি যে তার বিশ্লেষণ-পাঁচশ বছর আগে তৈরি-বর্তমান পরিস্থিতির সাথে একেবারেই মেলে না?
বরং, ট্র্যাভিজ হঠাৎ হাসি দিয়ে বলল, পুরোপুরি মিল আছে।
কোডেল প্রভাবিত হলো না। তারপরও কাউন্সিলম্যান, সেলডনের আবির্ভাবের পরও তুমি বিশ্বাস করো সেলডন প্ল্যানের অস্তিত্ব নেই?
অবশ্যই বিশ্বাস করি। বিশ্বাস করি, কারণ তার বিশ্লেষণ এত নিখুঁতভাবে মিলে যায়।
রেকর্ডার বন্ধ করে দিল কোডেল। কাউন্সিলম্যান, মাথা নেড়ে বলল, তুমি আমাকে সমস্যায় ফেলে দিচ্ছ। জিজ্ঞেস করলাম তোমার অদ্ভুত বিশ্বাস এখনো ধরে রেখেছ কি না, তুমি শুরু করলে ভাষণ। আবার জিজ্ঞেস করছি, সেলডনের আবির্ভাবের পরও তুমি বিশ্বাস কর যে সেলডন প্ল্যানের অস্তিত্ব নেই?
তুমি কিভাবে জানো? তার পরে তো আমার প্রাক্তন বন্ধু কম্পর-এর সাথে কথা বলার সুযোগ কারো হয়নি।
ধরে নাও আমরা অনুমান করেছি। আমিও ধরে নিচ্ছি যে তুমি জবাব দিয়েছ। অবশ্যই বিশ্বাস করি অন্য কোনো কথা না বলে আবার এই কথাটা বললেই চলবে।
অবশ্যই বিশ্বাস করি। ট্র্যাভিজ মুখ বাঁকা করে বলল।
বেশ, কোডেল বলল, দুটোর মধ্যে যেটা বেশি স্বাভাবিক শোনায় সেটাই রাখব। ধন্যবাদ কাউন্সিলম্যান। রেকর্ডার বন্ধ করে দিল।
হয়ে গেল? আর কিছু জানার নেই? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল ট্র্যাভিজ।
আমার যতটুকু প্রয়োজন, হ্যাঁ।
আসলে তোমার দরকার আগে থেকে সাজানো কতগুলো প্রশ্নের উত্তর। যেন টার্মিনাস আর ফাউণ্ডেশন ফেডারেশনের সবাইকে দেখানো যায় যে আমি সেলডন প্ল্যান-এর কিংবদন্তী পুরোপুরি মেনে নিয়েছি। পরে যদি অস্বীকার করি তাহলে সবাই আমাকে পাগল ভাববে।
অথবা বিশ্বাসঘাতক, অন্তত যাদের ধারণা ফাউণ্ডেশনের নিরাপত্তার জন্য সেলডন প্ল্যানের প্রয়োজন আছে। হয়তো সবাইকে জানানোর প্রয়োজন হবে না, যদি আমরা একটা সমঝোতায় পৌঁছতে পারি। কিন্তু যদি প্রয়োজন হয় তাহলে সবার কানে যেন পৌঁছায় তার ব্যবস্থা করব।
তুমি এত বোকা, জানতাম না, ট্র্যাভিজ ভুরু কুঁচকে বলল। আমি আসলে কি বলতে চাই, বোঝাতে চাই, সেটা জানার কোনো আগ্রহ তোমার নেই?
মানুষ হিসেবে, যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। সময় পেলে তোমার সব কথা মনোযোগ ও গুরুত্ব দিয়ে শুনব। কিন্তু সিকিউরিটি প্রধান হিসেবে এই মুহূর্তে আমার যতটুকু দরকার পুরোটাই জানা হয়ে গেছে।
আশা করি তুমি জান যে এতে তোমার আর মেয়রের খুব বেশি লাভ হবে না?
খুব বেশি লাভ হবে না, আমিও জানি। এখন তুমি যেতে পার। সঙ্গে গার্ড থাকবে অবশ্যই।
আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে?
কোডেল হাসির ভঙ্গী করল। বিদায়, কাউন্সিলম্যান। তুমি পুরোপুরি কো অপারেটিভ ছিলে না, অবশ্য সেটা আশা করাও ভুল। এক হাত বাড়ালো সে হাত মিলানোর জন্য।
ট্র্যাভিজ উঠে দাঁড়ালো, বাড়ানো হাতটাকে গ্রাহ্য করল না। স্যাশ-এর ভাঁজ ঠিক করতে করতে সে বলল, আসলে যা ঘটবেই, সেটাকে একটু দেরী করিয়ে দিলে। অন্য সবাই এখন আমার মতো চিন্তা করবে, বা এরই মধ্যে চিন্তা করতে শুরু করেছে। আমাকে বন্দি করলে বা মেরে ফেলার অর্থ হবে তাদেরকে উৎসাহিত করা। শেষ পর্যন্ত আমিই জিতব।
কোডেল বাড়ানো হাতটা ফিরিয়ে ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল সত্যিই, ট্র্যাভিজ, সে বলল, তুমি আসলেই একটা বোকা।
.
০৪.
ঠিক মাঝরাতে দুজন গার্ড এল সিকিউরিটি হেডকোয়ার্টারের বিলাসবহুল কামরা থেকে ট্র্যাভিজকে নিয়ে যেতে। কামরাটা যতই আরামদায়ক হোক, সেটা একটা প্রিজন সেল ছাড়া আর কিছুই না।
গত চার ঘণ্টা ট্র্যাভিজ মেঝের উপর অস্থির পায়চারী করেছে আর ভাবনা চিন্তা করেছে।
কম্পরকে সে বিশ্বাস করেছিল কেন?
কেন নয়? কম্পরকে মনে করেছিল বোকা। যার কোনো বিষয়েই নিজস্ব মতামত নেই। সহজেই প্রভাবিত করা যায়। কম্পরের সাথে বলা কথাগুলো তাকে চিন্তা ভাবনা গুছিয়ে নিতে সাহায্য করেছে।
এখন আর ভেবে কোনো লাভ হবে না। সামনের দিনগুলিতে তাকে একটা নীতি মেনে চলতে হবে, কাউকে বিশ্বাস করো না।
কিন্তু কাউকে বিশ্বাস না করে কি জীবন চালানো যায়? যাক বা না যাক তাকে পারতেই হবে।
আর কে জানত যে ব্র্যান্নো কাউন্সিল থেকে একজন সদস্যকে বের করে দিতে পারবে এবং বাকি সদস্যরা কিছুই বলবে না। হতে পারে ট্র্যাভিজের সাথে বাকি কাউন্সিলম্যানদের মতের মিল হয়নি; ব্র্যান্নোর কথা ঠিক প্রমাণ করার জন্য তারা শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত দিতে পারে। তারপরেও একজন সহকর্মীকে রক্ষা করা ছিল তাদের নৈতিক দায়িত্ব। ব্র্যান্নোকে বলা হয় ব্র্যান্নে দ্য ব্রোঞ্জ আর আসলেই তিনি ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা দেখিয়েছেন।
যদি না এরই মধ্যে তিনি তাদের হাতে
না! চিন্তা-ভাবনা করলেই আতঙ্কে গায়ের রোম দাঁড়িয়ে যায়।
তাছাড়া
তার চিন্তা-ভাবনা একটা চক্রের ভেতর ঘুরপাক খেতে লাগল। গার্ড দুজন যখন এল তখনো সে এই চক্র থেকে বেরোতে পারে নি।
আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে, কাউন্সিলম্যান। পদস্থ গার্ড নিরাবেগ গলায় বলল। একজন লেফটেন্যান্ট। ডান চোয়ালে একটা কাটা দাগ এবং প্রচণ্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে। যেন অনেক দিন থেকে দায়িত্ব পালন করেও খুব সামান্যই কাজ করতে পেরেছে যে সৈনিকের নাগরিকরা প্রায় দুইশ বছর ধরে শান্তিতে বসবাস করছে, তাদের বেলায় এমনই ঘটবে আশা করা যায়।
ট্র্যাভিজ নড়লনা, তোমার নাম, লেফটেন্যান্ট?। লেফটেন্যান্ট ইভান্ডার সপলার, কাউন্সিলম্যান।
তুমি জানো তুমি বেআইনী কাজ করছ, লেফটেন্যান্ট সপলার। একজন কাউন্সিলম্যানকে তুমি গ্রেফতার করতে পারো না।
আমাদেরকে সরাসরি নির্দেশ দেয়া হয়েছে, স্যার।
সেটা কোনো ব্যাপার না। কাউন্সিলম্যানকে গ্রেফতার করার আদেশ কেউ তোমাকে দিতে পারে না। এর জন্য তোমার কোর্ট মার্শাল হতে পারে।
আপনাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না, কাউন্সিলম্যান।
তাহলে তোমাদের সাথে আমাকে যেতে হবে কেন?
আমাদের আদেশ দেয়া হয়েছে আপনাকে এসকর্ট করে বাড়ি পৌঁছে দিতে।
আমি পথ চিনি।
এবং পথে বিপদ থেকে রক্ষা করতে।
কি ধরনের বিপদ? কার কাছ থেকে বিপদ?
যে কোনো ধরনের জনরোষের হাত থেকে।
এই মাঝ রাতে?
সে জন্যই আমরা মাঝরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি। এখন আপনি আমাদের সাথে চলুন, স্যার। বলে রাখা দরকার যে বাধা দিলে আমাদের বল প্রয়োগ করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
ট্র্যাভিজের জানা আছে গার্ডরা নিউরোনিক হুইপ ব্যবহার করে। মানসম্মান যতটুকু অবশিষ্ট আছে সেটা নিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। তাহলে আমার বাড়িতেই চল।–নাকি নিয়ে গিয়ে জেলখানায় ঢোকাবে?
আমাকে মিথ্যে কথা বলার আদেশ দেয়া হয়নি, স্যার, লেফটেন্যান্ট গর্বের সাথে বলল। ট্র্যাভিজ বুঝতে পারল তার সামনে দাঁড়ানো লোকটা প্রফেশনাল, যাকে মিথ্যে বলার জন্য সরাসরি আদেশ দিতে হয়। তার আচরণ ও কথাবার্তায়ও সেটা ফুটে উঠেছে।
দুঃখিত, লেফটেন্যান্ট। আমি তোমার কথায় সন্দেহ করছি না।
একটা গ্রাউন্ড কার বাইরে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। রাস্তা ফাঁকা, জনমানুষের কোনো চিহ্নই নেই। লেফটেন্যান্ট সতর্কতার সাথে ট্র্যাভিজকে তার আর গাড়ির মাঝখানে রাখল। সে গাড়িতে ঢুকার সাথে সাথেই লেফটেন্যান্ট ঢুকে পিছনের সিটে তার সাথে বসল।
ড্রাইভার ইঞ্জিন চালু করল।
বাড়ি পৌঁছে, ট্র্যাভিজ বলল, আশা করি আমি স্বাধীনভাবে আমার কাজ করতে পারব–যেমন ইচ্ছে হলে বাড়ি থেকে বোরাতে পারব।
আপনার কাজে বাধা দেয়ার কোনো আদেশ দেয়া হয়নি, শুধু বলা হয়েছে আপনার নিরাপত্তার জন্য যা করার করতে হবে।
মানে?
আমাকে বলা হয়েছে বাড়ি পৌঁছে আপনি ঘর থেকে বেরোতে পারবেন না। রাস্তাঘাট আপনার জন্য নিরাপদ নয়। আর আপনার নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার।
অর্থাৎ আমি গৃহবন্দী।
আমি কোনো উকিল নই, কাউন্সিলম্যান। কাজেই বুঝিয়ে বলতে পারব না।
লেফটেন্যান্ট তাকিয়ে আছে সোজা কিন্তু তার কনুই লেগে আছে ট্র্যাভিজের গায়ের সাথে। ট্র্যাভিজ নড়তে পারছে না।
গ্রাউন্ড কার ফ্লেক্সনার শহরতলিতে ট্র্যাভিজের ছোট বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। এই মুহূর্তে তার কোনো হাউজমেইড নেই। কাজেই কেউ অপেক্ষা করে থাকবে না।
এখন বেরোতে পারি? জিজ্ঞেস করল ট্র্যাভিজ।
প্রথমে আমি বেরোব, কাউন্সিলম্যান। আপনাকে এসকর্ট করে নিয়ে যাব।
আমার নিরাপত্তার জন্য?
ইয়েস, স্যার।
সামনের দরজার দুপাশে আরো দুজন গার্ড রয়েছে। আলো জ্বলছে ঘরের ভিতর, কিন্তু জানালাগুলো অস্বচ্ছ করে রাখায় আলো বাইরে ছড়িয়ে পড়েনি।
তার অনুপস্থিতিতে ঘরে কেউ ঢুকেছে দেখে ট্র্যাভিজের রাগ হলো। তারপর কাধ ঝাঁকিয়ে রাগ দূর করে দিল। কাউন্সিল চেম্বারের ভিতর কেউ তাকে রক্ষা না করতে পারলে, নিজের বাড়িও দুর্গের মতো নিরাপদ হবে না।
তোমরা কতজন সৈনিক আছ এখানে? এক রেজিম্যান্ট? ট্র্যাভিজ জিজ্ঞেস করল।
না কাউন্সিলম্যান, একটা কঠিন ও দৃঢ় কণ্ঠস্বর জবাব দিল। যাদেরকে দেখছ তারা বাদে মাত্র একজন এবং আমি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছি।
হারলা ব্র্যান্নো, টার্মিনাসের মেয়র, লিভিং রুমে ঢোকার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। কথা বলার জন্য যথেষ্ট সময় আছে, তাই না?
ট্র্যাভিজ তাকিয়ে আছে। এত কিছুর
ব্র্যান্নো কঠিন নিচু কণ্ঠে বাধা দিলেন, থামো, কাউন্সিলম্যান।–তোমরা চারজন, বেরিয়ে যাও! সবাই এখানে ভাল থাকবে।
গার্ড চারজন স্যালুট করে বেড়িয়ে গেল। ট্র্যাভিজ আর ব্র্যান্নো একা।
.
মেয়র
০৫.
প্রথম দুই শতাব্দী ছিল ফাউণ্ডেশনের স্বর্ণযুগ, বীরত্বের যুগ। স্যালভর হার্ডিন এবং হোবার ম্যালো ছিলেন দুই মহানায়ক, প্রায় হ্যারি সেলডনের সমকক্ষ মনে করা হয়। এই তিনজনের উপর নির্ভর করে আছে ফাউণ্ডেশনের ইতিহাস।
তখন ফাউণ্ডেশন ছিল খুবই ছোট এক বিশ্ব, মাত্র চারটা রাজ্য শাসন করত। আর ক্ষীণ ভরসা ছিল সেলডন প্ল্যান তাদের রক্ষা করবে। এমনকি মহাশক্তিশালী গ্যালাকটিক এম্পায়ারের অবশিষ্ট শক্তির হাত থেকেও।
রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে ফাউণ্ডেশন যতই শক্তিশালী হয়ে উঠল, যোদ্ধারা ততই গুরুত্ব হারাতে লাগল। লাথান ডেভরস এম্পায়ারের সর্বশেষ গ্রেট জেনারেল বেল রিয়োজকে পরাজিত করেছিল। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাকে মনে রেখেছে খনিতে দাসদের সাথে তার মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য।
বেল রিয়োজ ছিল ফাউণ্ডেশনের ভয়ংকর প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু তার চেয়েও ভয়ংকর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল মিউল, যে একাই সেলডন প্ল্যান ধ্বংস করে ফাউণ্ডেশনকে পরাজিত করে দীর্ঘসময় শাসন করেছিল।
মিউলকে পরাজিত করেছিল এক মহিলা–বেইটা ডেরিল। এইকাজ সে করেছিল কারো সাহায্য ছাড়াই। আবার তার ছেলে টোরান এবং নাতনী আর্কেডি দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনকে পরাজিত করে ফাউণ্ডেশনের আধিপত্য বিস্তারের পথ সুগম করে দিয়েছিল। কিন্তু এগুলো প্রায় সবই ভুলে যাওয়া ইতিহাস।
পরবর্তী যুগে যারা অবদান রেখেছিল, তারা মহানায়কের মর্যাদা পায় নি। সময়টা ছিল দুরন্ত গতিশীল। আর্কেডি, বেইটা ডেরিল এর যে বায়োগ্রাফী তৈরি করেছিল সেখানে তাকে একজন রোমান্টিক চরিত্র হিসেবে দেখিয়েছে।
তারপরে ফাউণ্ডেশন ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে এমন কোনো চরিত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। কোনো রোমান্টিক চরিত্রও না। কালগানিয়ান যুদ্ধ ছিল ফাউণ্ডেশনের উপর চাপিয়ে দেয়া সর্বশেষ লড়াই। কিন্তু সেটা ছিল গুরুত্বহীন এক লড়াই। পরবর্তী প্রায় দুইশ বছর ধরে শান্তি বজায় রয়েছে। একশ বিশ বছরের মধ্যে মহাকাশযানে দুএকটা আঁচড় কাটার ঘটনা ছাড়া আর কিছু ঘটেনি।
খুব ভালোরকম শান্তি, ব্র্যান্নো অস্বীকার করতে পারেন না। ফাউণ্ডেশন এখনো দ্বিতীয় গ্যালাকটিক এম্পায়ার গড়ে তুলতে পারে নি, কিন্তু ফাউণ্ডেশন ফেডারেশন হিসেবে গ্যালাক্সির এক তৃতীয়াংশ পলিটিক্যাল ইউনিটের উপর তার শক্ত কর্তৃত্ব রয়েছে এবং আরো অনেকগুলো ইউনিটকে প্রভাবিত করে রেখেছে। অনেক স্থানেই ফাউণ্ডেশনকে কেউ ভালচোখে দেখে না। কিন্তু গ্যালাক্সিতে এমন কোনো ব্যক্তি নেই। যে নিজেকে ফাউণ্ডেশনের মেয়রের তুলনায় উঁচু মর্যাদাসম্পন্ন বা ক্ষমতাশীল ভাবতে পারে।
এই উপাধি চলে আসছে ঠিক সেই সময় থেকে পাঁচশ বছর আগে যখন সভ্যতা থেকে দূরে গ্যালাক্সির সুদূর প্রান্তে ছোট এক গ্রহে ফাউণ্ডেশনের জন্ম হয়। কেউ এটাকে পরিবর্তন বা গুরুগম্ভীর করার কথা ভাবেনি। তবু এই উপাধি প্রায় ভুলে যাওয়া ইম্পেরিয়াল ম্যাজেস্টির সমকক্ষ।
-টার্মিনাস বাদে। এখানে মেয়রের ক্ষমতাকে সতর্কতার সাথে সীমিত করে রাখা হয়েছে।
আর তিনি হারলা ব্র্যান্নো, মিউলের পর সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক (তিনি নিজেও সেটা জানেন) এবং মহিলা মেয়র হিসাবে পঞ্চম। শুধু আজকেই তিনি তার ক্ষমতা এত খোলাখুলিভাবে ব্যবহার করেছেন।
নিজের মত প্রতিষ্ঠার জন্য তাকে সেইসব একগুয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে লড়তে হয়েছে যারা চেয়েছিল ফাউণ্ডেশনকে গ্যালাক্সির ভিতরের দিকে সরিয়ে নিতে কিন্তু তিনিই জিতেছেন। সেলডনও তাকে সমর্থন করেছেন।
ফলে ফাউণ্ডেশনের সবার চোখেই তিনি কিছু সময়ের জন্য সেলডনের মতো জ্ঞানী বলে স্বীকৃতি পাবেন। কিন্তু জানেন যে কোনো সময়েই তারা একথা ভুলে যেতে পারে।
আর এতগুলো বছরের মধ্যে শুধু এই তরুণ তাকে চ্যালেঞ্জ করল। এই তরুণের জন্য তিনি এমন কতগুলো পদক্ষেপ নিয়েছেন যেগুলোর জন্য তৃতীয় ইন্ডবারের সময় থেকে প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাকে ইমপীচ করা যায়।।
কিন্তু তরুণ যা বলেছে, ঠিকই বলেছে!
আসল বিপদ এখানেই। তরুণের নির্ভুলতা ফাউণ্ডেশনকে ধ্বংস করে দিতে পারে!
এই মুহূর্তে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন তরুণের মুখোমুখি, একা।
তিনি বিষণ্ণ স্বরে বললেন, একা আমার সাথে কথা বলতে পারলে না? কাউন্সিলের সামনে আমাকে বোকা বানানোর জন্য চিৎকার করে বলার প্রয়োজন ছিল? জানো কি সর্বনাশ করেছ, বোকা ছেলে?
.
০৬.
ভেতরের বেড়ে উঠা রাগটাকে দমানোর জন্য ট্র্যাভিজকে রীতিমতো লড়াই করতে হলো। মেয়র একজন বয়স্ক মহিলা, আগামী জন্মদিনে তেষট্টিতে পা দেবেন। নিজের দ্বিগুণ বয়সের কারো সাথে উঁচু গলায় কথা বলার প্রবৃত্তি হলো না।
তাছাড়া রাজনৈতিক যুদ্ধে মেয়র যথেষ্ট অভিজ্ঞ, ভালোমতোই জানেন প্রথমেই প্রতিপক্ষকে অপ্রস্তুত করে দিতে পারলে তিনি অর্ধেক লড়াই জিতে যাবেন। যদিও সেই কৌশল কাজে লাগাতে হলে হলরুম ভর্তি দর্শক চাই। আর এখানে শুধু তারা দুজন রয়েছে।
কাজেই ট্র্যাভিজ মেয়রের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে চরম বিতৃষ্ণা নিয়ে তাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। মেয়র একজন বৃদ্ধ মহিলা, পরেছেন দুটি প্রজন্ম থেকে প্রচলিত ইউনিসেক্স ফ্যাশনের পোশাক। মেয়র লিডার অফ দ্যা গ্যালাক্সি –অত্যন্ত সাধারণ মহিলা, যে কেউ তাকে বৃদ্ধ পুরুষ ভেবে ভুল করতে পারে। শুধু চুল দেখে মানুষের ভুল ভাঙবে। মরিচা রং-এর চুলগুলো প্রচলিত পুরুষালী স্টাইলে ছেড়ে না রেখে শক্ত করে বেঁধে রেখেছেন।
ট্র্যাভিজ সুন্দর করে হাসল। যে কোনো বয়স্ক প্রতিপক্ষ বোকা ছেলে কথাটি শুনে অপমানিত বোধ করবে। কিন্তু এখানে কথিত বোকা ছেলে বয়সে তরুণ এবং সুদর্শন তারা দুজনেই সে ব্যাপারে সচেতন।
ট্র্যাভিজ বলল, ঠিক বলেছেন। আমার বয়স বত্রিশ এবং বলতে গেলে এখনো ছেলে। আবার আমি একজন কাউন্সিলম্যান, যত যাই হোক–প্রাক্তন অফিসিয়ো, যদিও বেপরোয়া। প্রথমটা এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। দ্বিতীয়টার ক্ষেত্রে শুধু বলতে পারি আমি দুঃখিত।
তুমি জানো কি করেছ? দাঁড়িয়ে না থেকে বসো। মাথা খাটাও। যুক্তি দিয়ে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।
আমি জানি আমি কি করেছি। যা ঠিক মনে হয়েছে তাই বলেছি।
আর এমন দিনেই বিরোধিতা করলে যেদিন আমার ক্ষমতা এত বেড়েছে যে তোমাকে কাউন্সিল চেম্বার থেকে বের করে দিয়ে গ্রেফতার করলাম, কেউ কোনো প্রতিবাদ করার সাহস পেলনা।
কাউন্সিল ঠিকই একত্র হয়ে প্রতিবাদ জানাবে। হয়তো এরই মধ্যে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেছে। তারা এখন আরো গুরুত্ব দিয়ে আমার কথা শুনবে।
কেউ তোমার কথা শুনবে না। যদি তুমি এভাবে চালিয়েই যাও, আমিও তোমাকে বিশ্বাসঘাতক হিসাবে আইনের হাতে তুলে দেব।
আরো ভালো হবে। আদালতে কথা বলার সুযোগ পাব।
বেশি আশা করো না। একজন মেয়রের জরুরী ক্ষমতা অসীম, যদিও খুব কমই সেটা ব্যবহার করা হয়।
কিসের ভিত্তিতে আপনি জরুরী অবস্থা ঘোষণা করবেন?
একটা কিছু বের করে নেব। আমার সেই ক্ষমতা আছে, তাছাড়া ঝুঁকি নিতে আমি ভয় পাই না। আমাকে বাধ্য করো না ইয়ং ম্যান। আমি একটা সমঝোতা করতে চাই। যদি না হয়, তুমি আর কখনো স্বাধীন হতে পারবে না। বাকি জীবন প্রিজন সেলে কাটবে। নিশ্চিত থাক।
দুজন পরস্পরের দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে। ব্র্যান্নোর চোখ ধূসর, ট্র্যাভিজের বহুবর্ণ বাদামী।
কি ধরনের সমঝোতা? ট্র্যাভিজ জিজ্ঞেস করল।
আহ, তুমি আগ্রহী। তাহলে তর্কযুদ্ধ না করে আমরা আলোচনা করতে পারি। তোমার সব কথা খুলে বল।
আপনি ভালোমতোই জানেন। কম্পরের সাথে তো আর খোশগল্প করেন নি, তাই না?
আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই। সাম্প্রতিক অতিবাহিত সেলডন ক্রাইসিসের আলোকে বল।
বেশ, আপনি যখন শুনতে চান-ম্যাডাম মেয়র! (বুড়ি মহিলা প্রায় জিভের ডগায় এসে গিয়েছিল, অনেক কষ্টে সামলালো।) সেলডনের ইমেজ খুব নিখুঁত, পাঁচশ বছর পরেও খুব বেশি রকম নিখুঁত। আমার ধারণা এইবার নিয়ে আটবার তার আবির্ভাব ঘটল। কয়েকবার এমনও হয়েছে তার কথা শোনার জন্য সেখানে কেউ উপস্থিত ছিলনা। অন্তত একবার, তৃতীয় ইন্ডবারের সময় বাস্তবের সাথে তার বিশ্লেষণ একেবারেই মেলেনি-অবশ্য সেটা ছিল মিউল-এর যুগ, তাই না? কিন্তু এর আগে কখনো আজকের মতো এমন নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছিলেন?
ট্র্যাভিজ ছোট করে হাসল। কখনোই না, ম্যাডাম মেয়র। পুরনো রেকর্ড থেকে জানা যায় এর আগে কখনোই তিনি পরিস্থিতির এমন নিখুঁত বর্ণনা দিতে পারেন নি, একেবারে খুঁটিনাটিসহ।
ব্র্যান্নো বল্লেন, তোমার ধারণা সেলডনের আবির্ভাব, হলোগ্রাফিক ইমেজ সব নকল; সেলডনের রেকর্ডিং বর্তমান সময়ের কেউ যেমন আমার নিজের তৈরি; একজন অভিনেতা সেলডনের ভূমিকায় অভিনয় করে যাচ্ছে?
অসম্ভব নয়, ম্যাডাম মেয়র, তবে আমি তা বলছিনা। প্রকৃত সত্য আরো ভয়ংকর। আমি বিশ্বাস করি সেলডনের ইমেজ, ইতিহাসের বর্তমান মুহূর্ত নিয়ে তার বিশ্লেষণ সবই পাঁচশ বছর আগে তৈরি। কোডেলকেও এই কথাগুলো বলেছি। সে খুশীমনে আলোচনা এমন দিকে নিয়ে গেছে যেন সবাই ভাবে বোধবুদ্ধিহীন ফাউণ্ডেশনারদের কুসংস্কার আমি বিশ্বাস করেছি।
হ্যাঁ, প্রয়োজন হলে রেকর্ডিংগুলো ব্যবহার করা হবে, যেন ফাউণ্ডেশন বুঝতে পারে তুমি বিরোধী দলে ছিলে না।
ট্র্যাভিজ বাহু দুটো দুদিকে ছড়িয়ে দিল। কিন্তু আমি তাই। আমরা ঠিক যেমন বিশ্বাস করি সেরকম কোনো সেলডন প্ল্যান নেই এবং নেই প্রায় দুই শতাব্দী ধরে। এক বছর আগেই আমার সন্দেহ হয়, কিন্তু বারো ঘন্টা আগে টাইম ভল্টের ঘটনা থেকে নিশ্চিত হয়েছি।
কারণ সেলডন খুব বেশি নিখুঁত?
ঠিক, হাসবেন না। এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর দরকার নেই।
হাসছিনা। বলে যাও।
তিনি এত নিখুঁত হন কিভাবে? দুই শতাব্দী আগে তখনকার বর্তমান নিয়ে তিনি। ছিলেন পুরোপুরি ভুল। ফাউণ্ডেশন তৈরির তিনশ বছরের মাথায় তিনি লক্ষ্য থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত হয়েছিলেন।
একটু আগে তুমি নিজেই ব্যাখ্যা করেছ, কাউন্সিলম্যান। এর কারণ হচ্ছে মিউল। মিউল ছিল অসীম মেন্টাল পাওয়ারের অধিকারী এক মিউট্যান্ট, প্ল্যানে তার সম্বন্ধে কিছু বলা সম্ভব ছিল না।
সম্ভব হোক বা না হোক-কথা একই। সেলডন প্ল্যান লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হলো। মিউল বেশিদিন শাসন করেনি, তার কোনো উত্তরাধিকার ছিলনা। ফলে ফাউণ্ডেশন আবার তার স্বাধীনতা ও রাজত্ব ফিরে পায়। কিন্তু সেলডন প্ল্যান এভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবার পরও কি করে আবার গতিপথে ফিরে এল?
ব্র্যান্নো কঠিন মুখ করে হাত দুটো চেপে ধরলেন। উত্তরটা তুমি জানো। আমরা দুই ফাউণ্ডেশনের একটা। ইতিহাসের বই তুমি পড়েছ।
আমি আর্কেডির লেখা তার দাদির বায়োগ্রাফী পড়েছি-স্কুলে পাঠ্য ছিল। তার উপন্যাসগুলোও পড়েছি। মিউল এবং তার পরবর্তী সময় নিয়ে অফিসিয়াল বর্ণনাও পড়েছি। আমার সন্দেহ আরো বেড়েছে।
কিভাবে?
অফিসিয়ালী, আমাদের প্রথম ফাউণ্ডেশনের রয়েছে বাস্তব বিজ্ঞানের জ্ঞান এবং তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা। আমাদের কাজ করতে হবে প্রকাশ্যে। আমাদের ইতিহাস-আমরা জানি আর না জানি–সেলডন প্ল্যান অনুসরণ করছে। আর দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের রয়েছে সাইকোলজিক্যাল বিজ্ঞানের জ্ঞান এবং তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা, সেই সাথে সাইকোহিষ্ট্রী। এবং তাদের অস্তিত্ব এমনকি আমাদের কাছ থেকেও গোপন রাখা হয়েছে। দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন সেলডন প্ল্যানের ফাইন টিউনিং-এর কাজ করে। যখনই কোনো কিছু বিপথে যায়, তারা সেগুলো সেলডন প্ল্যান অনুযায়ী সঠিক পথে ফিরিয়ে আনে।
তুমি নিজেই উত্তর দিয়েছ, মেয়র বললেন। বেইটা ডেরিল মিউলকে পরাজিত করেছিল, হয়তো দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের অনুপ্রেরণায়, যদিও তার নাতনী সেটা স্বীকার করেন না। নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন মিউলের মৃত্যুর পর গ্যালাক্সির ইতিহাসকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনে, অবশ্যই সফলভাবে। তাহলে তোমার আর কি বলার। আছে?
ম্যাডাম মেয়র, আর্কেডির বর্ণনা অনুযায়ী পরিষ্কার বোঝা যায় যে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন গ্যালাক্সির ইতিহাস কে সংশোধন করতে গিয়ে নিজেদের গোপনীয়তা প্রকাশ করে ফেলে। আমরা প্রথম ফাউণ্ডেশন নিজেদের মিরর ইমেজ দেখতে পারি এবং বুঝতে পারি আমাদের ম্যানিপুলেট করা হচ্ছে। তারপর জীবন-পণ করে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনকে খুঁজে বের করে আমরা ধ্বংস করি।
ব্র্যান্নো মাথা নাড়লেন, এবং বর্ণনা অনুযায়ী আমরা সফল হয়েছি, তবে অবশ্যই গ্যালাক্সির ইতিহাসকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার আগে তাদের ধ্বংস করিনি। এটা এখনো সঠিক পথে চলছে।
আপনি বিশ্বাস করেন যে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন চিহ্নিত করে তার সব সদস্যকে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। সেটা ছিল ৩৭৮ এফ. ই, প্রায় একশ বিশ বছর আগে। পঁচিশ প্রজন্ম আমরা হয়তো দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনকে ছাড়াই চলে এসেছি এবং তারপরও সেলডন ইমেজ আর আপনার বক্তব্য প্রায় এক।
হয়তো ভবিষ্যৎ ইতিহাস গঠনে আমার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা খুব বেশি।
মাফ করবেন, আমি আপনার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ করছিনা। আমার কাছে যেটা অবশ্যম্ভাবী বলে মনে হয় তা হচ্ছে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন কখনো ধ্বংস হয়নি। তারা এখনো আমাদের শাসন করছে, ম্যানিপুলেট করছে।-এবং সে কারণেই আমরা সেলডন প্ল্যানের গতিপথে ফিরে আসতে পেরেছি।
.
০৭.
মেয়র অবাক হলেও প্রকাশ করলেন না, রাত বাজে একটা। তিনি ঝামেলা শেষ করতে চান, কিন্তু তাড়াহুড়ো করা যাবে না। তরুণ তার নিয়মে খেলে যাক। কিন্তু সীমারেখা অতিক্রম করতে দেবেন না তিনি। তাছাড়া তার একটা পরিকল্পনা আছে, সেটা বাস্তবায়নের আগেই তরুণকে নিরুৎসাহ করতে চান না।
তিনি বললেন, তাই? তোমার ধারণা কালগানিয়ান যুদ্ধ নিয়ে আর্কেডির বর্ণনা এবং দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের ধ্বংস হওয়ার কাহিনী সম্পূর্ণ মিথ্যা? নিজস্ব কল্পনা? একটা খেলা? প্রতারণা?
ট্র্যাভিজ ত্যাগ করল। সেগুলো আলোচনার বাইরে। ধরা যাক, আর্কেডি যেমন বর্ণনা দিয়েছে ঘটনা ঠিক সেভাবেই ঘটেছে; অর্থাৎ দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের আশ্রয় খুঁজে বের করে নিশ্চিহ্ন করা হয়। কিন্তু আপনি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন তাদের সবাই ধ্বংস হয়েছে। দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন পুরো গ্যালাক্সির কথা বিবেচনা করত, শুধু টার্মিনাস বা ফাউণ্ডেশনের ইতিহাসকে ম্যানিপুলেট করত না। তাদের দায়িত্ব ছিল। আরো বৃহৎ, আমাদের ক্যাপিটাল ওয়ার্ল্ড এমনকি পুরো ফেডারেশনের চাইতেও বড়। কাজেই এক হাজার পারসেক বা তারও বেশি দূরত্বে কিছু দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনার থাকা অসম্ভব না।
আর যদি সবাইকে নিশ্চিহ্ন না করা যায়, তাহলে আপনি কিভাবে বলতে পারেন আমরা জিতেছি। মিউল বলতে পেরেছিল? মিউল প্রথমে টার্মিনাস দখল করল, সেই সাথে সরাসরি নিয়ন্ত্রণে থাকা বিশ্বগুলো। তারপর স্বাধীন বণিক বিশ্বগুলো দখল। করল। বাকি থাকল তিন পলাতক-এবলিং মিস, বেইটা ডেরিল আর তার স্বামী। মিউল পুরুষ দুজনকে তার মেন্টাল পাওয়ারের কন্ট্রোলে রাখল-শুধু বেইটা ডেরিলকে রাখল আনকন্ট্রোলড। আর্কেডির মতে মিউল সেই সময় আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিল। তার বর্ণনা অনুযায়ী মাত্র একজন-বেইটা ডেরিলকে নিজের ইচ্ছামতো চলার স্বাধীনতা দেয়া হলো–আর তার কারণেই মিউল দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন খুঁজে না পেয়ে পরাজিত হলো।
একজনকে স্বাধীন রেখে মিউল তার সব হারালো। এখানেই একজনের গুরুত্ব, যদিও সেলডন প্ল্যানকে ঘিরে থাকা কিংবদন্তী হলো, একজন কিছুই না, বিশাল জনগোষ্ঠীই সবকিছু।
আর একজন দুজন নয়, ডজন ডজন দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনার পিছনে রেখে আসলে কি ঘটবে। তারা আবার একত্র হয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তৈরি করবে। নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে আর আমরা গিনিপিগে পরিণত হব।
ব্র্যান্নো গম্ভীর গলায় বল্লেন, তুমি সেটা বিশ্বাস কর?
কোনো সন্দেহ নেই।
কিন্তু কাউন্সিলম্যান, ওরা এত কষ্ট করবে কেন? কেন তারা এমন একটা লক্ষ্যের জন্য জীবন উৎসর্গ করবে যা কেউ চায় না। দ্বিতীয় গ্যালাকটিক এম্পায়ারের পথে গ্যালাক্সিকে চালিয়ে নেবার জন্য তাদের এত উৎসাহ কেন? আর তারা সফল হলেও আমাদের ভয় কি? খুশী হয়ে মেনে নেয়াই তো উচিত?
ট্র্যাভিজ চোখ ঘষতে লাগল। বয়সে তরুণ হলেও দুজনের ভেতর তাকে বেশি ক্লান্ত মনে হচ্ছে। মেয়রের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি আপনাকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আপনার কি ধারণা যে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন যা করছে সব আমাদের জন্য? এতদিনের ক্ষমতা ও রাজনীতির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে আপনি বুঝতে পারছেন না যে–তারা এগুলো করছে নিজেদের জন্য?
আমরা হচ্ছি ছুরির ধারালো প্রান্ত। আমরা শ্রম দিচ্ছি, ঘাম ফেলছি, রক্ত দিচ্ছি। তারা হয়তো এখানে একটু সমন্বয় করছে, ওখানে দু-একটা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করছে। এবং এগুলো করছে সহজেই, কোনো ঝুঁকি ছাড়া। এক হাজার বছরের ধৈর্য আর কষ্টের পর যখন আমরা সব শেষ করব, দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন তখন অনায়াসে শাসন ক্ষমতা নিয়ে নেবে, তারাই হবে অভিজাত শাসক শ্রেণী।
ব্র্যান্নো বল্লেন, তুমি দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনকে ধ্বংস করতে চাও, তাই না? যেন আমরাই হতে পারি ক্ষমতার কেন্দ্র।
অবশ্যই! অবশ্যই! আপনিও চান, তাই না? আপনি বা আমি অতদিন বাঁচব না। কিন্তু আপনার নাতি-নাতনী আছে। হয়তো আমারো একদিন হবে। আবার তাদেরও নাতি-নাতনী হবে। এভাবেই চলবে। আমি চাই তারা আমাদের কষ্টের সুফল ভোগ করুক এবং আমরা যা করতে পেরেছি তার জন্য আমাদের শ্রদ্ধা করুক। হ্যারি সেলডনের লুকানো ষড়যন্ত্রের স্বীকার হতে আমি রাজি না–তাকে আমি কোনো আদর্শ বলে মনে করি না। বরং মিউলের চেয়েও বড় হুমকি বলে মনে করি। ওহ্ গ্যালাক্সি, যদি মিউল প্ল্যানটাকে একেবারে ধ্বংস করে দিতে পারত। পরে মিউলের হাত থেকে রক্ষা পেতাম। কারণ সে ছিল মরণশীল। দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন মনে হচ্ছে অমর।
কিন্তু তুমি দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন ধ্বংস করতে চাও, তাই না?
যদি জানতাম কিভাবে হবে?
যেহেতু তুমি জানো, স্বাভাবিকভাবেই ওরা তোমাকে ধ্বংস করবে।
ট্র্যাভিজ উদ্ধত স্বরে বলল, মাঝে মাঝে মনে হয় আপনি তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন। সেলডন ইমেজ কি বলবে তার সঠিক অনুমান, তার পরেই আমার সাথে এমন আচরণ, সবই দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের কাজ বলে মনে হয়।
তাহলে আমাকে সব কথা বলছ কেন?
কারণ যদি আপনি দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের নিয়ন্ত্রিত হন, তাহলে আমি এই খেলায় অনেক আগেই হেরে গেছি, কারণ ভিতরের বেড়ে উঠা রাগ ঝেড়ে ফেলার একটা উপায় খুঁজছিলাম এবং কারণ সত্যি কথা হচ্ছে আমি একটা জুয়া খেলছি। ধরে নিচ্ছি আপনি তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই, শুধু জানেন না কি করতে হবে।
তুমি জুয়ায় জিতেছ, আমি নিজের ছাড়া আর কারো নিয়ন্ত্রণে নেই। কিন্তু তুমি কি নিশ্চিত হতে পারবে যে আমি সত্যি কথা বলছি? দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের নিয়ন্ত্রণে থাকলে কি সেটা স্বীকার করতাম? নিজেই কি জানতাম যে তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছি?
এসব প্রশ্ন করে কোনো লাভ নেই। আমি জানি আমি দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের নিয়ন্ত্রণের অধীন নই, তোমারও সেটা বিশ্বাস না করে উপায় নেই। যদি দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের অস্তিত্ব থাকেই, তবে তাদের সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে গ্যালাক্সির কাছ। থেকে নিজেদের অস্তিত্ব গোপন রাখা। মিউলের কারণেই দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের অস্তিত্ব প্রকাশ হয়ে পড়ে এবং আর্কেডির সময়ে তাদেরকে ধ্বংস করা হয়। নাকি প্রায় ধ্বংস করা হয়, কাউন্সিলম্যান?
এর থেকে আমরা দুটো সিদ্ধান্তে আসতে পারি। প্রথমত; যুক্তি সহকারেই আমরা মেনে নিতে পারি যে তারা যতদূর সম্ভব কম হস্তক্ষেপ করে। ধরে নিতে পারি পুরো পথ আমাদেরকে গাইড করে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। কারণ দ্বিতীয় ফাউন্ডেশনের ক্ষমতারও একটা সীমা আছে।
কষ্ট-কল্পনা হলেও এই যুক্তি আমি মেনে নিচ্ছি। ট্র্যাভিজ বলল। অন্যটা কি?
আরো সহজ এবং প্রত্যাশিত। যদি দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের অস্তিত্ব থাকে এবং তারা সেটা গোপন রাখতে চায়, তবে একটা বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যদি কেউ মনে করে তারা এখনো আছে, সেটা নিয়ে কথা বলে, চিৎকার করে গ্যালাক্সির সবাইকে জানাতে চায়, তবে কোনো সূক্ষ্ম উপায়ে তাকে পথ থেকে সরিয়ে দেয়া হবে। তোমার যুক্তি কি তাই বলে না?
সে কারণেই আপনি আমাকে কাষ্টডিতে রেখেছেন, ম্যাডাম মেয়র? দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের কাছ থেকে রক্ষা করার জন্য?
সে কারণেই বলা যায়। তাছাড়া লিয়নো কোডেল তোমার যে স্বীকারোক্তি রেকর্ড করেছে সেগুলো শুধু টার্মিনাসের জনগণ এবং ফাউণ্ডেশনকে শান্ত রাখার জন্যই ব্যবহার করা হবে না। বরং দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনকে অসতর্ক রাখার জন্যও ব্যবহার করা হবে। যদি তারা এখনো টিকে থাকে, আমি চাইনা তোমার উপর তাদের নজর পরুক।
কল্পনা করা যায়, ট্র্যাভিজ মুখ ভেঙচে বলল, আমার জন্য! আমার সুন্দর বাদামী চোখ জোড়ার জন্য?
ব্র্যান্নো কোনো আগাম সংকেত না দিয়েই নিঃশব্দে হেসে ফেললেন, আমি ততটা বুড়িয়ে যাইনি, কাউন্সিলম্যান, যে আমি বুঝতে পারব না তোমার সুন্দর এক জোড়া চোখ রয়েছে। বত্রিশ বছর আগে হয়তো এ কারণেই অনেক কিছু করতে পারতাম, এই মুহূর্তে ওগুলো বাঁচানোর জন্য এক মিলিমিটারও এগুবনা। কিন্তু যদি দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন আজকে টিকে থাকে এবং তোমার উপরে তাদের চোখ পড়ে, তাহলে তোমাকে দিয়েই শেষ হবে না। আমার নিজের নিরাপত্তার কথাও ভাবতে হবে এবং তুমি ছাড়াও অনেক বুদ্ধিমান এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কথা ভাবতে হবে-আমাদের পরিকল্পনার কথা ভাবতে হবে।
আপনি তাহলে বিশ্বাস করেন দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন আছে? সে কারণেই তাদের সম্ভাব্য আচরণের কথা ভেবে এমন সতর্ক পদক্ষেপ নিয়েছেন?
ব্র্যান্নো টেবিলে হাতের ভর দিয়ে দাঁড়ালেন, অবশ্যই করি। না করলে তোমার কথার এত বেশি গুরুত্ব দিতাম? যদি দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন নাই থাকে, তবে তুমি বললেই বা কি হবে? এক মাস ধরে আমি তোমাকে থামানোর চেষ্টা করছি, কিন্তু কাউন্সিলম্যানদের সাথে কঠিন আচরণ করার ক্ষমতা আমার ছিল না। সেলডনের প্রত্যাবর্তন সাময়িকভাবে আমাকে সেই ক্ষমতা পাইয়ে দিল আর তখনই তুমি তোমার খেলা শুরু করলে। আমিও দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে নিলাম, আর এখন তোমাকে খুন করতে এক মাইক্রোসেকেণ্ডও দ্বিধা করব না। যদি আমার কথা মতো কাজ না কর।
গত এক ঘণ্টার আলোচনার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তুমি যেন আমাকে বিশ্বাস করতে পার। তবে জেনে রাখো দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের সমস্যা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে বাধা দিলে বিনা বিচারে তোমাকে মেরে ফেলব।
ব্র্যান্নো ঠাণ্ডা গলায় বল্লেন, নড়বেনা ট্র্যাভিজ। আমি নিঃসন্দেহে একজন বৃদ্ধ মহিলা, কিন্তু আমাকে ছোঁয়ার আগেই তুমি মারা যাবে, আমার লোকেরা আমাদের উপর নজর রাখছে।
ট্র্যাভিজ বসে পড়ল। আমি বুঝতে পারছি না। যদি দ্বিতীয় ফাউন্ডেশনের অস্তিত্ব থাকে, আপনার এভাবে খোলাখুলি বলা উচিত না। আমি নিজেকে যে বিপদে জড়িয়েছি, আপনারও সেই বিপদে জড়িয়ে পড়া উচিত হবে না।
স্বীকার করছ তাহলে তোমার চেয়ে আমার বুদ্ধি বেশি। অন্যভাবে বলা যায় দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের অস্তিত্ব রয়েছে, তোমার এই বিশ্বাস তুমি গোপন রাখনি, কারণ তুমি বোকা। আমিও গোপন না করেই বলছি দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন আছে। কারণ আমি সতর্কতা অবলম্বন করেছি। যেহেতু তুমি আর্কেডির ইতিহাস খুব ভালোভাবে পড়েছ। তুমি হয়তো জানো তার বাবা মেন্টাল স্ট্যাটিক ডিভাইস নামে একটা যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন। যন্ত্রটা দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের মেন্টাল পাওয়ারের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা শীল্ড হিসেবে কাজ করে। এটা আজও টিকে আছে এবং উন্নত হয়েছে। তোমার বাড়ি এই মুহূর্তে পুরোপুরি নিরাপদ। বুঝতে পারলে পরের কথাগুলো বলতে পারি।
কি?
তোমাকে প্রমাণ করতে হবে আমাদের বিশ্বাস সঠিক। তোমাকে বের করতে হবে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন আছে কিনা, যদি থাকে, কোথায়। এর অর্থ তোমাকে টার্মিনাস ছেড়ে যেতে হবে, কোথায় আমি জানি না। এমনও হতে পারে, শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে আর্কেডির সময়ের মতো আমাদের নিজেদের ভেতরেই দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন রয়েছে। অর্থাৎ আমাকে বলার মতো কিছু না পাওয়া পর্যন্ত তুমি ফিরবে না, আর যদি কিছু নাই পাও তাহলে কোনোদিনই ফিরে এসো না, টার্মিনাস থেকে একটা বোকা কমবে।
ট্র্যাভিজ রাগে কাঁপতে লাগল। কোনো সূত্র ছাড়া আমি কিভাবে খুঁজব? তারা আমাকে স্রেফ খুন করবে।
তাহলে খুঁজবে না। অন্য কিছু খুঁজবে। সমস্ত বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে অন্য কিছু খুঁজবে এবং যদি এইভাবে তাদের সাথে তোমার দেখা হয় এবং তারা তোমাকে গুরুত্ব না দেয়, ভাল কথা। তুমি শুধু হাইপার ওয়েভে শীল্ড করা কোডেড মেসেজ পাঠাবে এবং সেক্ষেত্রে সসম্মানে ফিরে আসতে পারবে।
আমার মনে হয় আপনার অন্য কোনো পরিকল্পনা আছে
অবশ্যই। জেনোভ পেলোরেটকে চেন?
কোনোদিন নাম শুনিনি
আগামী কাল তার সাথে তোমার দেখা হবে। সেই তোমাকে বলে দেবে কি করতে হবে, এবং তোমরা দুজন অতি উন্নত এক মহাকাশযানে করে টার্মিনাস ত্যাগ করবে। শুধু তোমরা দুজন এবং তুমি যদি আমাদেরকে সন্তুষ্ট করার মতো কোনো তথ্য না নিয়ে ফেরার চেষ্টা করো, তাহলে টার্মিনাসের এক পারসেক-এর মধ্যে পৌঁছার আগেই মহাকাশেই তোমাকে যানসহ উড়িয়ে দেয়া হবে। এইটুকুই। আলোচনা এখানেই শেষ।
তিনি উঠে দাঁড়িয়ে হাতে গ্লাভস পড়লেন। ঘুরে দরজার দিকে এগুতেই দুজন সশস্ত্র গার্ড ভেতরে ঢুকে দুপাশে দাঁড়ালো।
দরজার সামনে গিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ালেন। বাইরে আরো অনেক গার্ড রয়েছে। এমন কিছু করোনা যাতে সমস্যায় পড়তে হয়।
আপনিও তখন আমাকে দিয়ে সুবিধা আদায় করতে পারবেন না,
ট্র্যাভিজ চেষ্টা করে হালকা গলায় কথাগুলো বলল।
সেই চান্স আমরা নেব, ব্র্যান্নো হালকা হাসির সাথে বল্লেন।
.
০৮.
লিয়নো কোডেল বাইরে তার জন্য অপেক্ষা করছিল। সব কথাই আমি শুনেছি মেয়র। আপনি অসম্ভব ধৈর্য ধরেছেন।
এবং আমি অসম্ভব ক্লান্ত। দিনটা মনে হচ্ছে বাহাত্তর ঘণ্টা লম্বা। তুমি এখন দায়িত্ব নাও।
নেব, কিন্তু আসলেই কি বাড়ির চারপাশে মেন্টাল স্ট্যাটিক ডিভাইস আছে?
ওহ, কোডেল, ব্র্যানো ক্লান্ত গলায় বল্লেন। তুমি ভালোমতোই জানো কেউ। লক্ষ্য রাখছে তার সম্ভাবনা কতটুকু। তুমি কি মনে কর যে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন সব সময়, সব জায়গায় সব কিছুর উপর চোখ রাখছে। ট্র্যাভিজের মতো আমি রোমান্টিক তরুণ না। সে এমন মনে করতে পারে, কিন্তু আমি করি না। তারপরেও যদি সব জায়গায় দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের চোখ কান থাকে তাহলে মেন্টাল স্ট্যাটিক ডিভাইস থাকলে আমাদের নিজেদেরই ক্ষতি হবে। যেহেতু আমরা পুরোপুরি প্রস্তুত নই সেহেতু এই শীল্ডের গোপনীয়তা শুধু ট্র্যাভিজ না তোমার আর আমার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া
তারা গ্রাউন্ড কারে চড়ল, চালকের আসনে কোডেল। এবং তাছাড়া- কোডেল বলল।
তাছাড়া কি? ব্র্যান্নো জিজ্ঞেস করলেন।–ও হ্যাঁ, তাছাড়া এই তরুণ অত্যন্ত বুদ্ধিমান। আমি অনেকবার তাকে বোকা বলেছি শুধু তাকে থামিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু সে বোকা না। ট্র্যাভিজ বয়সে তরুণ এবং আর্কেডির প্রচুর উপন্যাস পড়েছে। সেখান থেকে তার বিশ্বাস জন্মেছে গ্যালাক্সি গল্পের মতোই-কিন্তু তার আত্মবিশ্বাস আছে এবং তাকে হারালে অনেক ক্ষতি হবে।
আপনি নিশ্চিত যে সে আর ফিরে আসতে পারবে না?
পুরোপুরি নিশ্চিত, ব্র্যান্নো দুঃখিত স্বরে বল্লেন। এটাই বরং ভালো হয়েছে। অন্ধ রোমান্টিক তরুণের কোনো প্রয়োজন নেই আমাদের। তাছাড়া সে একটা উদ্দেশ্য পূরণ করতে যাচ্ছে। সে নিশ্চিতভাবেই দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবে। ফলে তারা হয়তো আমাদের উপেক্ষা করবে। আর এই উপেক্ষাই আমাদের দরকার। তখন তাদেরকে ধ্বংস করার একটা সুযোগ আমরা পাব হয়তো।
ট্র্যাভিজ তাহলে নিজেকে বলির পাঠা বানাচ্ছে।
ব্র্যান্নোর ঠোঁট দুটো চেপে বসল। ঠিক এই শব্দটাই আমি খুঁজছিলাম। সে নিজে আঘাত সহ্য করে আমাদের রক্ষা করবে।
আর পেলোরেট, সেও একই পথের পথিক?
তাকেও যেতে হবে, উপায় নেই।
কোডেল মাথা নাড়ল। বেশ আপনি তো জানেনই স্যালভর হার্ডিন প্রায়ই বলতেন–যা তোমার করা উচিত তাকে কখনো নৈতিকতা দিয়ে আড়াল করো না।
এই মুহূর্তে আমার কোনো নৈতিকতা বোধ নেই, ফিসফিস করে বল্লেন ব্র্যান্নো। শুধু প্রচণ্ড ক্লান্ত বোধ করছি। তাছাড়া আরো অনেকের নাম বলতে পারি যাদেরকে আমি খুব শিঘ্রই হারাতে যাচ্ছি। গোলান ট্র্যাভিজ সুদর্শন তরুণ, বুদ্ধিমান-এবং অবশ্যই সে নিজেও জানে। হালকা ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার কারণে শেষের কথাগুলো শোনা গেল না।
.
ইতিহাসবিদ
০৯.
জেনভ পেলোরেট-এর সব চুল পেকে সাদা হয়ে গেছে, মুখ শান্ত গম্ভীর। ওজন এবং উচ্চতা স্বাভাবিক। চলাফেরায় কোনো জড়তা নেই, আত্মবিশ্বাসী: কণ্ঠস্বর। বায়ান্ন। বছর বয়স হলেও দেখে আরো বেশি মনে হয়।
এই দীর্ঘ জীবনে একবারও সে টার্মিনাস ছেড়ে বাইরে কোথাও যায়নি। অদ্ভুত ব্যাপার, বিশেষ করে তার পেশার লোকের ক্ষেত্রে। সে নিজেও ভেবে পায় না। এইভাবে এক জায়গায় গ্যাট হয়ে বসে থাকার কারণটা কি শুধু ইতিহাসের প্রতি তার সীমাহীন দুর্বলতা নাকি অন্য কিছু।
ইতিহাসের প্রতি তার আগ্রহ জন্মায় হঠাৎ করেই, মাত্র পনের বছর বয়সে। হঠাৎ করেই প্রথম যুগের কিংবদন্তী নিয়ে লেখা একটা বই পায় সে, যেখানে একাকী নিঃসঙ্গ এক গ্রহের কথা বলা হয়েছে–এমন এক গ্রহ যে নিজেও জানত না সে একাকী নিঃসঙ্গ। বইয়ে এর বেশি কিছু লেখা ছিল না।
বইটা তার ঘুম হারাম করে ফেলে। পরবর্তী দুই দিনে তিনবার পড়ে শেষ করে। তার পরের দিন কম্পিউটার টার্মিনালের সাহায্যে টার্মিনাস বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখে, এই বিষয়ের উপর আর কোনো রেকর্ড পাওয়া যায় কিনা।
মোটকথা প্রাচীন কিংবদন্তী তাকে সারাজীবনের জন্য গ্রাস করে ফেলে। টার্মিনাস বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে সে খুব বেশি কিছু খুঁজে পায় নি। কিন্তু পরিণত বয়সে। গ্যালাক্সির বিভিন্ন লাইব্রেরি থেকে বই সংগ্রহ করে। এমনকি হাইপার রেডিয়েশনাল সিগন্যালের মাধ্যমে সুদূর ইফনি থেকেও প্রিন্টআউট সংগ্রহ করেছে।
প্রাগৈতিহাসিক ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে পেলোরেট যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে এবং এই প্রথমবারের মতো সে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক বছরের ছুটি নিয়েছে–উদ্দেশ্য জীবনে প্রথমবার মহাকাশ পাড়ি দিয়ে ট্রানটরে যাবে।
পেলোরেট ভালো করেই জানে টার্মিনাসের কোনো বাসিন্দার স্পেস ভ্রমণের অভিজ্ঞতা না থাকা অস্বাভাবিক। সে ইচ্ছে করে এই অস্বাভাবিকতা অর্জন করে নি। ব্যাপারটা এমন–যখনই কোথাও যাবার প্ল্যান করেছে তখনই তার হাতে নতুন কোনো বই নতুন ধরনের বিশ্লেষণ এসে হাজির হয়েছে। কাজেই ভ্রমণের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে নিজের পাহাড়-প্রমাণ জ্ঞান ভাণ্ডারে নতুন কিছু যোগ করাটাই মনে হয়েছে সঠিক। দুঃখ শুধু একটাই ট্রানটরে এখন পর্যন্ত সে যেতে পারে নি।
ট্রানটর ছিল প্রথম গ্যালাকটিক এম্পায়ারের রাজধানী। বারো হাজার বছর ধরে এই গ্রহ ছিল সম্রাটদের পদচারণায় মুখর, তারও আগে ছিল প্রি-ইম্পেরিয়াল যুগের। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের রাজধানী, এই রাজ্যই ধীরে ধীরে অন্য রাজ্যগুলোকে গ্রাস করে গড়ে তোলে সুবিশাল সাম্রাজ্য।
ট্রানটর ছিল মহাবিশ্বের রক্ষক নগরী, মেটাল কোটেড সিটি। পেলোরেট এগুলো জেনেছে ডাল গরনিকের লেখা পড়ে। গরনিক হ্যারী সেলডনের যুগে ট্র্যানটর ভ্রমণ করেছিল। তার লেখা বই এখন এতই দুপ্রাপ্য হয়ে পড়েছে যে, পেলোরেটের কাছে যে বইটা আছে তার জন্য যে কোনো ইতিহাসবিদ তার সারাবছরের বেতন হাসিমুখে দিয়ে দিতে রাজী হবে।
অবশ্য যে জিনিসটা পেলোরেটকে বেশি আকর্ষণ করে তা হলো গ্যালাকটিক লাইব্রেরি, ইম্পেরিয়াল যুগে (তখন ছিল রাজকীয় গ্রন্থাগার) এটাই ছিল সবচেয়ে বৃহৎ এবং সমৃদ্ধ। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে জনবহুল, রাজ্যের রাজধানী ছিল ট্র্যানটর এবং এর লাইব্রেরিতে মানবজাতির সৃষ্টিশীল, অসৃষ্টিশীল সমস্ত কর্মকাণ্ডের রেকর্ড রাখা আছে। রাখা আছে মানবসভ্যতার অর্জিত সমস্ত জ্ঞান। জটিল কম্পিউটারাইজড পদ্ধতির কারণে বিশেষজ্ঞ ছাড়া এখানে কারো পক্ষে কাজ করা অসম্ভব।
সবচেয়ে বড় কথা লাইব্রেরি আজো টিকে আছে। পেলোরেট-এর কাছে খুব বিস্ময়কর মনে হয়। দুইশ পঞ্চাশ বছর আগে যখন ট্র্যানটর ধ্বংস হয়ে যায়, তখনকার ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেও লাইব্রেরিটা টিকে গেছে। ধারণা করা হয়ে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সুকৌশলে এটা রক্ষা করেছিল (কারো মতে শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের ব্যাপারটা বাড়িয়ে বলা হয়েছে।)
যেভাবেই হোক, এমন ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেও লাইব্রেরি টিকে গেছে। এবলিং মিস্ বিধ্বস্ত গ্রহের এই অক্ষত লাইব্রেরিতে বসেই দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনকে প্রায় ধরে ফেলেছিল (গল্পটা ফাউণ্ডেশনের সবাই বিশ্বাস করলেও ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে।) ডেরিলদের তিন প্রজন্ম বেইটা, টোরান এবং আর্কেডি–প্রত্যেকেই কোনো না কোনো সময় ট্রানটরে বাস করেছে। যদিও আর্কেডি কখনো লাইব্রেরিতে যায়নি এবং তারপরে গ্যালাকটিক ইতিহাসে এই লাইব্রেরির আর কোনো উল্লেখ নেই।
একশ বিশ বছরের মধ্যে ট্র্যানটরে কোনো ফাউণ্ডেশনারের পা পড়েনি। তার মানে এই না যে লাইব্রেরিটা সেখানে নেই, আবার আছে এমন কোনো নিশ্চিত প্রমাণও নেই। তবে ধ্বংস হলে কিছুটা আলোড়ন সৃষ্টি হতো।
গ্যালাকটিক লাইব্রেরি অপ্রচলিত এবং সুপ্রাচীন–ঠিক পেলোরেট যেমন চায়। প্রাচীন কোনো লাইব্রেরির কথা মনে হলেই সে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। যত বেশি পুরনো হবে ততই তার প্রয়োজনীয় উপাদান থাকার সম্ভাবনা বেশি হবে। প্রায়ই সে। কল্পনায় লাইব্রেরিতে ঢুকে প্রশ্ন করে, লাইব্রেরির কি পরিবর্তন হয়েছে? প্রাচীন রেকর্ডগুলো কি ফেলে দেয়া হয়েছে? এবং কল্পনায় বুড়ো লাইব্রেরিয়ানের জবাব শুনতে পারে সে, যেমন ছিল ঠিক তেমনই আছে, প্রফেসর।
তার স্বপ্ন সত্য হতে চলেছে। মেয়র নিজে আশ্বাস দিয়েছেন। তার ব্যাপারে মেয়র এত কিছু কিভাবে জানলেন সে বলতে পারবেনা। প্রকাশনার ক্ষেত্রে সে সফল হতে পারেনি। গবেষণা যতটুকু করেছে তার খুব সামান্যই ছাপার যোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে, সেগুলোও উল্লেখযোগ্য কিছু না। তবে সবাই বলে যে, টার্মিনাসের সব কিছুই ব্র্যান্নো দ্যা ব্রোঞ্জের নখদর্পণে রয়েছে। পেলোরেট-এর বিশ্বাস করতে আপত্তি নেই, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মেয়র যদি জানতেনই, তাহলে টার্মিনাসের কসম, এর আগে কেন তিনি আর্থিক সাহায্য করেননি?
চরম বিতৃষ্ণা নিয়ে সে শুধু একটা সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে সেটা হচ্ছে ফাউণ্ডেশনের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে দ্বিতীয় এম্পায়ার। অতীত নিয়ে ঘাটাঘাটি করার কোনো সময় বা ইচ্ছা তাদের নেই।
সব বোকা, অবশ্যই, কিন্তু সে একা কারো ভুল ভাঙাতে পারবেনা। সেই চেষ্টা করাই ভালো। বরং তার আকাঙ্ক্ষা তার কাছেই থাক। অবশ্যই সেই সময় আসবে যখন সবাই তার অগ্রণী ভূমিকার কথা স্মরণ করবে।
এক অর্থে সে নিজেও ভবিষ্যৎকে নিয়ে ডুবে আছে–যে ভবিষ্যতে সবাই তাকে সেলডনের মতো মহানায়ক হিসাবে, প্রকৃতপক্ষে তার চেয়েও মহান হিসাবে বিবেচনা করবে। কারণ, পঁচিশ সহস্রাব্দ পুরনো অতীত ইতিহাসের ভিত্তিতে সে এক সহস্রাব্দ ভবিষ্যৎ ইতিহাসের পরিষ্কার ছবি বর্ণনা করে যাবে।
এবং সুদিন চলে এসেছে।
মেয়র তাকে বলেছিলেন দিনটা হবে সেলডনের প্রত্যাবর্তনের পরের দিন। এই কারণেই যে সেলডন ক্রাইসিস গত একমাস প্রতিটি টার্মিনাসবাসীর এবং অবশ্যই ফাউণ্ডেশনের সকলের মন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, সেটার ব্যাপারে আগ্রহী ছিল সে।
পেলোরেট যতটুকু বুঝতে পেরেছে তাতে মনে হয়েছে, ক্রাইসিসটা ছিল মূলত ফাউণ্ডেশনের রাজধানী টার্মিনাসে থাকবে নাকি অন্য কোথাও সরানো হবে। ক্রাইসিস দূর হলেও সে নিশ্চিত নয় তার ধারণা ঠিক ছিল কিনা, ঠিক হলেও হ্যারী সেলডন কোনো পক্ষে ভোট দিয়েছেন।
বড় কথা সেলডন আবির্ভূত হয়ে চলে গেছেন এবং তার প্রত্যাশিত দিন এসে গেছে।
দুপুর দুইটার কিছু পরে পেলোরেট-এর শহরতলীর নির্জন বাড়ির সামনে একটা গ্রাউণ্ড কার এসে থামল।
পিছনের দরজা খুলে প্রথমে মেয়রের নিরাপত্তা বাহিনীর পোশাক পরা একজন গার্ড তারপর এক সুদর্শন তরুণ, তার পেছনে আরো দুজন গার্ড নামল।
পেলোরেট খুশী। কারণ মেয়র তার কাজকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন। যে লোকটা তার সঙ্গী হবে তাকে সসম্মানে গার্ড দেয়া হচ্ছে, এবং তাকে কথা দেয়া হয়েছে একটা প্রথম শ্রেণীর আধুনিক মহাকাশযান দেয়া হবে। সেটা চালাবে তার সঙ্গী।
দরজা খুলে দিল হাউজকিপার। তরুণ ভিতরে প্রবেশ করার পর দুজন গার্ড দরজার দুপাশে পজিশন নিল। আরেকজন গার্ড বাইরেই থাকল। জানালা দিয়ে পেলোরেট দেখল আরেকটা গ্রাউন্ড কার আসছে। অতিরিক্ত গার্ড!
অবাক কাণ্ড!
ঘুরে অতিথিকে চিনতে পেরে সে আরো অবাক হয়ে গেল। এই লোককে সে হলোকাষ্টে দেখেছে, তুমি সেই কাউন্সিলম্যান। ট্র্যাভিজ!
গোলান ট্র্যাভিজ। ঠিকই ধরেছেন। আপনি প্রফেসর জেনোভ পেলোরেট?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, পেলোরেট বলল। তুমিই আমার সাথে
আমরা দুজন একসাথে বেড়াতে যাবো, ট্র্যাভিজ কাষ্ঠ গলায় বলল।
কিন্তু তুমি ইতিহাসবিদ না।
না, তা নই। আমি একজন কাউন্সিলম্যান, একজন রাজনীতিবিদ।
হ্যাঁ–কিন্তু আমি এত ভাবছি কেন? আমি নিজেই একজন ইতিহাসবিদ তাহলে আরেকজনের প্রয়োজন কি? তুমি মহাকাশযান চালাতে পার?
হ্যাঁ, ভালোই পারি।
বেশ সেটাইতো প্রয়োজন, আর কি চাই। অবশ্য আমি তোমার মতো বাস্তব চিন্তা করিনা ইয়ংম্যান। এটা মেনে নিতে পারলে আশা করি আমরা দুজন ভালো টীম হিসাবে কাজ করতে পারব।
এই মুহূর্তে নিজের বাস্তব চিন্তা নিয়ে আমি খুব একটা উৎসাহিত না, তবে। এতটুকু বুঝতে পারছি যে ভাল টীম না হয়ে আমাদের উপায় নেই।
আশা করি আমার অহেতুক মহাশূন্য ভীতি কেটে যাবে। আমি আগে কখনো। মহাশূন্যে যাইনি, কাউন্সিলম্যান। ভালো কথা, চা খাবে। মনে হচ্ছে আরো কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। আমি অবশ্য পুরোপুরি তৈরি। দুজনের প্রয়োজনীয় সব কিছু নেয়া হয়েছে। মেয়র বেশ সাহায্য করেছেন। এই প্রজেক্ট নিয়ে তার আগ্রহ অবাক করার মতো।
আপনি আগেই জানতেন তাহলে, কতদিন থেকে? ট্র্যাভিজ জিজ্ঞেস করল।
মেয়র আমার কাছে (পেলোরেট থেমে ভুরু কুঁচকে হিসাব করে নিল) দুই বা তিন সপ্তাহ আগে প্রস্তাব দেন। বেশ খুশী হয়েছিলাম। এখন বুঝতে পারছি আমার আরেকজন ইতিহাসবিদ না একজন পাইলট দরকার। আর সঙ্গী হিসাবে তোমাকে পেয়ে আরো খুশী হয়েছি।
দুই বা তিন সপ্তাহ আগে, ট্র্যাভিজ আচ্ছন্ন গলায় পুনরাবৃত্তি করল। সে আগে থেকেই তৈরী হচ্ছে, আর আমি- ট্র্যাভিজের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
কিছু বলছ?
কিছু না, প্রফেসর। নিজের মনে কথা বলা আমার একটা বদভ্যাস। আপনাকে কষ্ট করে মানিয়ে নিতে হবে।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, পেলোরেট বলল, ট্র্যাভিজকে হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে ডাইনিং রুমের দিকে, তার হাউজকীপার টেবিলের উপর চা তৈরি করে রেখে গেছে। খোলাখুলি বলতে গেলে, মেয়র বলেছেন আমাদের যত সময় দরকার নিতে পারি। পুরো গ্যালাক্সিতে আমরা সাহায্য পাবো এবং যে কোনো স্থান থেকেই ফাউণ্ডেশনের ফান্ড ব্যবহার করতে পারব। মেয়র অবশ্য বুঝে শুনে খরচ করতে বলেছেন। পেলোরেট ঠোঁট ভিজিয়ে হাত ঘষতে লাগল। বসো, মাই গুড ফেলো, বসো। হয়তো আগামী অনেকগুলো দিনের মধ্যে এটাই টার্মিনাসে আমাদের শেষ লাঞ্চ।
ট্র্যাভিজ বসল। আপনার পরিবার আছে, প্রফেসর?
এক ছেলে। সান্তানী বিশ্ববিদ্যালয় ফ্যাকাল্টিতে আছে, কেমিস্ট বা ঐ ধরনের কিছু একটা হবে। মায়ের সাথে থাকে। তার মা আবার অনেকদিন আগেই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। কাজেই আমার কোনো দায়দায়িত্ব নেই, কোনো পোষ্য নেই। তোমারও বোধহয় নেই–স্যান্ডউইচ আছে, নিজে নিয়ে খাও, মাই বয়।
এই মুহূর্তে কেউ নেই। মেয়ে বন্ধু কয়েকজন আছে। তবে স্থায়ী সম্পর্ক নেই।
হা। ব্যাপারটা বেশ মজার বাচ্চা কাচ্চা নেই নিশ্চয়ই।
না।
বেশ। আমার আসলে প্রয়োজন তারুণ্য, প্রাণপ্রাচুর্য এবং এমন একজন যে গ্যালাক্সির গোলকধাঁধায় নিজের পথ করে নিতে পারবে। আমরা একটা অনুসন্ধানে চলেছি–অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধান। কোনো বাহ্যিক পরিবর্তন নেই, কিন্তু পেলোরেট-এর শান্ত মুখ এবং শান্ত স্বর একটা অপার্থিব আবহ তৈরি করেছে।
ট্র্যাভিজ চোখ ছোট করে জিজ্ঞেস করল, গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধান?
হ্যাঁ। গ্যালাক্সির দশ মিলিয়ন বসতিপূর্ণ গ্রহের ভেতর এক অমূল্য রতন লুকিয়ে আছে এবং আমাদের হাতে সামান্য সূত্রও নেই। আমরা খুঁজে পেলে, পুরস্কার হবে অমূল্য। যদি বের করতে পারি, মাই বয়, ট্র্যাভিজ বিশ্বাস করো–এই মহাবিশ্ব ধ্বংস হয়ে গেলেও আমাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
যে পুরস্কারের কথা বলছেন–এই অমূল্য রত্ন-
আমি সেই লেখিকা–আর্কেডি ডেরিল-এর মতো কথা বলছি–দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনারদের মতো তাইনা? তুমি যে থমকে গেছ, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। পেলোরেট এমনভবে পিছন দিকে ঘাড় বাঁকালো যেন প্রচণ্ড হাসিতে ফেটে যাবে কিন্তু শুধু মৃদু একটু হাসল। এর ভেতর অলীক বা বাড়াবাড়ি কিছু নেই, নিশ্চিত থাক।
আপনি দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের কথা বলছেন না, তাহলে কিসের কথা বলছেন?
পোলোরেট হঠাৎ করেই আরো দ্র এবং ক্ষমা প্রার্থনার সুরে বলল, আহ্, মেয়র : তাহলে তোমাকে বলেননি?–পুরো ব্যাপারটিই অদ্ভুত, বুঝেছ। আমি কি করছি সেটা অনেকদিন থেকেই সরকারকে বুঝানোর চেষ্টা করছি, আর এখন হঠাৎ করেই মেয়র আমার ব্যাপারে খুব বেশি উৎসাহী হয়ে পড়েছেন।
হ্যাঁ, ট্র্যাভিজ বলল, তিরস্কারের ভঙ্গি লুকানোর চেষ্টা করল না। মেয়র গোপনে অনেক জনসেবা করেছেন, কিন্তু এই ব্যাপারটা আমাকে বলতে ভুলে গেছেন।
তুমি আমার গবেষণার ব্যাপারে কিছুই জানো, তাহলে?
দুঃখিত, কিছুই জানি না।
ঠিক আছে, দুঃখ প্রকাশ করার কিছু নেই। আমি আসলে প্রচারবিমুখ লোক। এখন বলছি। আসলে আমি আর তুমি যাচ্ছি এক অনুসন্ধানে, এবং যা খুঁজে বের করতে চাই তা হচ্ছে–পৃথিবী।
.
১০.
ট্র্যাভিজ সে রাতে ঘুমোতে পারেনি।
বারবার সে মেয়রের জেলখানা থেকে বেরোতে চেষ্টা করেছে। লাভ হয়নি কোনো।
শান্ত নির্মমতার সাথে মেয়র তাকে নির্বাসন দিয়েছেন এবং তিনি যে অসাংবিধানিক কাজ করছেন সেটা গোপন করার কোনো চেষ্টা করেননি। কাউন্সিলম্যান হিসেবে অধিকার এবং ফাউণ্ডেশনের নাগরিক অধিকারের উপর ট্র্যাভিজ বড় বেশি ভরসা করেছিল। মেয়র সেগুলোকে পাত্তাই দেননি।
আর পেলোরেট, নিজের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন এই অদ্ভুত প্রফেসর বলছে ওই ভয়ানক মহিলা নাকি কয়েক সপ্তাহ থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছে।
নিজেকে তার ছোট খোকার মতই মনে হলো।
এই বন্ধুবৎসল ইতিহাসবিদের সাথেই তাকে নির্বাসনে যেতে হবে। বোঝাই যাচ্ছে পৃথিবীর গ্যালাকটিক অনুসন্ধান শুরু করার জন্য প্রফেসর অস্থির হয়ে আছে।
তাকে জানতে হবে। অবশ্যই, এখনি।
সে জিজ্ঞেস করল, মাফ করবেন, প্রফেসর। আমি আপনার কাজের ব্যাপারে খুব একটা জানি না। তাই খুব সহজ একটা প্রশ্ন করলে নিশ্চয়ই বিরক্ত হবেন না। পৃথিবী কি?
বিশ সেকেণ্ড হাসি মুখে তাকিয়ে থাকল পেলোরেট। তারপর বলল, পৃথিবী একটা গ্রহ। মূল গ্রহ। সেই গ্রহ যেখানে মানুষের প্রথম উদ্ভব হয়েছিল?
মানুষের প্রথম উদ্ভব হয়েছিল? কোথা থেকে?
শূন্য থেকে। এটাই সেই গ্রহ, যেখানে একেবারে আদিম অবস্থা থেকে মানবজাতি চরম সভ্য হয়ে উঠেছিল।
ট্র্যাভিজ কিছুক্ষণ চিন্তা করে মাথা নাড়ল। বুঝতে পারছি না কি বলছেন। হালকা বিরক্তি দেখা দিল পেলোরেটের মুখে। গলা পরিষ্কার করে বলল একটা সময় ছিল টার্মিনাসের বুকে কোনো মানুষ ছিল না। অন্যান্য গ্রহ থেকে মানুষ এসে–এখানে বসতি স্থাপন করে। এটা জানোত?
হা নিশ্চয়ই, ট্র্যাভিজ অধৈর্য স্বরে বলল। পেলোরেটের হঠাৎ শিক্ষকসুলভ আচরণে বিরক্ত।
বেশ। সবগুলো গ্রহের ক্ষেত্রেই কথাটা সত্যি। এনাক্রোন, সান্তানি, কালগান–সবগুলোর ক্ষেত্রেই। প্রত্যেকটি গ্রহেই অতীতের কোনো এক সময় বসতি স্থাপন করা হয়েছে। অন্য কোনো গ্রহ থেকে মানুষ এখানে এসেছে। ট্র্যানটরের বেলায়ও কথাটা সত্যি। হয়তো বিশ হাজার বছর ধরে ট্রানটর ছিল এক মহান নগরী, তার আগে কিন্তু ছিল না।
কেন, আগে কি ছিল?
শূন্য! অন্তত জনমানব শূন্য।
বিশ্বাস করা কঠিন।
সত্যি। পুরনো ইতিহাসে তাই লেখা আছে।
ট্রিানটরে যারা প্রথম বসতি স্থাপন করে সেই মানুষগুলো কোনখান থেকে এসেছিল?
নিশ্চিত করে কারো কথাই বলা যায় না। একশরও বেশি গ্রহ দাবী করে যে সুপ্রাচীন কাল থেকেই সেখানে মানুষ বাস করছে এবং মানুষের প্রথম অভিযাত্রা নিয়ে তাদের নিজস্ব গল্পগাথাও রয়েছে। ইতিহাসবিদদের কাছে এগুলোর কোনো গুরুত্ব। নেই, বরং যে বিষয়টা নিয়ে তারা বেশি চিন্তা করে তা হচ্ছে মূল প্রশ্ন।
কি সেটা? আমি কখনো শুনিনি।
অবাক হচ্ছি না। আসলে বিষয়টা এখন আর ইতিহাসবিদদের কাছে খুব একটা জনপ্রিয় না। তবে একসময়, যখন সাম্রাজ্যের পতন ঘটছে, সেই সময় প্রশ্নটা হঠাৎ করেই পণ্ডিতদের মাঝে আলোড়ন সৃষ্টি করে। স্যালভর হার্ডিন তার স্মৃতিকথায় খুব সুন্দরভাবে এর বর্ণনা দিয়েছেন। মূল প্রশ্ন হচ্ছে একটা গ্রহের অস্তিত্ব এবং অবস্থান নিয়ে, যে গ্রহ থেকেই শুরু হয়েছিল সব কিছু। অতীতের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে সবচেয়ে নতুন গ্রহে মানুষ এসেছে তার চেয়ে পুরনো কোনো গ্রহ থেকে, আবার সেখানে মানুষ এসেছে আরো প্রাচীন কোনো গ্রহ থেকে। এভাবে পিছনে যেতে থাকলে আমরা একটা বিন্দুতে গিয়ে এক হয়ে যাব, যেখান থেকে মানুষ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সেটাই হচ্ছে–মূল গ্রহ।
ট্র্যাভিজের চোখে সাথে সাথেই ভুল ধরা পড়ল। মূল গ্রহ তো একাধিক হতে পারে?
অবশ্যই না। গ্যালাক্সির সব মানুষের গঠন বৈশিষ্ট্য এক ধরনের। একই। বৈশিষ্ট্যের অধিকারী কোনো প্রজাতির উৎপত্তি একাধিক উৎস থেকে হতে পারে না। একেবারেই অসম্ভব।
আপনি কিভাবে জানেন?
প্রথমত- পেলোরেট যেন খুব জটিল বিষয় বোঝাচ্ছে, সেভাবে ডান হাত দিয়ে। বা হাতের আঙ্গুল চেপে ধরে বলল, মাই ডিয়ার ফেলো, তুমি আমার কথা বিশ্বাস। করতে পার।
ট্র্যাভিজ ভদ্রতার সাথে মাথা নিচু করে সম্মান জানালো। আমি স্বপ্নেও আপনাকে অবিশ্বাস করার কথা ভাবতে পারি না, প্রফেসর পেলোরেট। ধরা যাক একটা মূল। গ্রহ রয়েছে, কিন্তু সম্ভাবনা আছে একাধিক গ্রহ সেই সম্মানের দাবীদার হতে চাইবে।
শুধু সম্ভাবনা না, কথাটা আসলেই সত্যি। তবে দাবীর কোনো যথার্থতা নেই। যে একশটা গ্রহ এমন দাবী করছে সেখানে না আছে প্রি-হাইপার স্পেশাল সমাজের কোনো চিহ্ন, না আছে প্রি-হিউম্যান যুগ থেকে উত্তরণের কোনো নিদর্শন।
অর্থাৎ আপনি বলছেন, একটা মূল গ্রহ আছে, যেখানে মানুষের উৎপত্তি হয়েছিল এবং কোনো এক কারণে তারা নিজেদের প্রকাশ করছেনা?
একেবারে সঠিক আন্দাজ করেছ।
আপনি সেটা খুঁজে বের করবেন?
আমরা। এটাই আমাদের মিশন। মেয়র ব্র্যান্নো সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তুমি আমাদের মহাকাশযান চালিয়ে ট্র্যানটরে নিয়ে যাবে।
ট্রানটরে? সেটাতো মূল গ্রহ না। আপনিই একটু আগে বলেছেন।
অবশ্যই? সেটা মূল গ্রহ না। মূল গ্রহ হচ্ছে পৃথিবী।
তাহলে আপনি আমাকে মহাকাশযান চালিয়ে পৃথিবীতে নিয়ে যেতে বলছেন না কেন?
আমি ভালোভাবে বোঝাতে পারিনি। পৃথিবী এক কিংবদন্তীর নাম। প্রাচীন লোককাহিনীর পবিত্র নাম। এর সঠিক অর্থ নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে মানব প্রজাতি উৎপত্তির মূল গ্রহ এর সমার্থক হিসেবে এক শব্দে পৃথিবী ব্যবহার করা সুবিধাজনক। এতগুলো গ্রহের মধ্যে কোনটা পৃথিবী, সঠিক জানা যায়নি।
ট্রানটরে গেলে জানা যাবে?
আশা করছি সেখানে গেলে কিছু তথ্য পাব। সেখানে গ্যালাকটিক লাইব্রেরি রয়েছে, গ্যালাক্সির মধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধিশালী।
নিশ্চয়ই আপনি যাদের কথা বললেন, সাম্রাজ্যের যুগে যারা, মূল প্রশ্ন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করত তারাও খুব ভালোভাবে লাইব্রেরি খুঁজে দেখেছে।
পেলোরেট চিন্তিতভাবে মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, কিন্তু খুব সম্ভব ভালোভাবে করেনি। পাঁচ শতাব্দী আগের রাজকীয় পণ্ডিতদের তুলনায় মূল প্রশ্ন নিয়ে আমি অনেক বেশি জানি। হয়তো পুরনো রেকর্ডগুলো আমি আরো ভালোভাবে বুঝতে পারব। বহুবছর ধরেই গবেষণা করছি এবং আমার মাথায় কিছু চমৎকার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
আমার ধারণা, মেয়র ব্র্যান্নোকে আপনি সব বলেছেন এবং তিনি অনুমোদন করেছেন?
অনুমোদন? প্রিয় বন্ধু, তিনি অত্যন্ত খুশী হয়েছিলেন। বলেছিলেন আমি যা জানতে চাই তার জন্য ট্র্যানটরই আদর্শ।
কোনো সন্দেহ নেই। ট্র্যাভিজ ফিসফিস করে বলল।
সেই রাতে এই ব্যাপারটাই ট্র্যাভিজের মাথা জুড়ে থাকল। মেয়র ব্র্যান্নো তাকে পাঠাচ্ছেন যতটুকু সম্ভব দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের খোঁজ এনে দেয়ার জন্য। তিনি তাকে পাঠাচ্ছেন পেলোরেট-এর সাথে, যেন পৃথিবী অনুসন্ধানের কথা বলে আসল উদ্দেশ্য গোপন রাখা যায়–এমন এক অনুসন্ধান, যা তাকে গ্যালাক্সির যে কোনো স্থানে নিয়ে যেতে পারে। নিখুঁত কভার, সত্যি কথা বলতে কি সে মেয়রের বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা না। করে পারল না।
কিন্তু ট্র্যানটর? এর পেছনে যুক্তি কোথায়? একবার ট্র্যানটরে পৌঁছানোর পর পেলোরেট গ্যালাকটিক লাইব্রেরিতে পড়ে থাকবে। বিপুল পরিমাণের বই। ফিল্ম রেকর্ড এবং জটিল কম্পিউটার পদ্ধতির মাঝখান থেকে তাকে বের করে আনাটা খুব কঠিন হবে।
তাছাড়া
এবলিং মিস মিউলের সময়ে একবার ট্র্যানটরে গিয়েছিল। সেখানে লাইব্রেরিতে বসে মিস দ্বিতীয় ফউণ্ডেশন খুঁজে বের করেছিল কিন্তু প্রকাশ করার আগেই মারা যায়। তারপর আরকেডি ডেরিলও সেখানে যায় এবং সে-ও দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন খুঁজে পেতে সফল হয়। সে অবশ্য তাদের অবস্থান খুঁজে পায় এই টার্মিনাসে। তারপর দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনারদের আস্তানা নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়। দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের যতটুকু টিকে আছে সেটা আছে অন্য কোথাও, কাজেই ট্র্যানটরে আর বেশি কি জানা যাবে। দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন খুঁজে বের করতে হলে তাকে যেতে হবে অন্য কোথাও, ট্রানটরে না।
তাছাড়া
মেয়রের আর কোনো পরিকল্পনা আছে কি না জানে না, কিন্তু এই মুহূর্তে মেয়রকে অমান্য করার অবস্থা তার নেই। ব্র্যান্নো খুব খুশী হয়েছিলেন ট্র্যানটরে যাবার কথা শুনে? বেশ, যদি ব্র্যান্নো চায় তারা ট্রানটরে যাক, তাহলে কোনো অবস্থাতেই সে আর পেলোরেট ট্রানটরে যাবে না। অন্য কোথাও।–কিন্তু ট্র্যানটরে না।
অবশেষে ক্লান্ত ট্র্যাভিজ সেই রাতে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।