অর্থাৎ গায়ার কাছে আমি জীবন এবং মৃত্যু।
আমরা তাই মনে করি।
হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল ট্র্যাভিজ। টুপি খুলল মাথা থেকে। আকাশের এখানে সেখানে নীলের ছোঁয়া লেগেছে। আমি তোমাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত দিয়েছি। আমাকে মেরে ফেললে সেটা আর পাল্টানো যাবে না।
গোলান, পেলোরেট আতঙ্কিত স্বরে ফিসফিস করে বলল। কী ভয়ংকর কথা।
আইসোলেট মানুষদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক। ব্লিস শান্ত। বোঝার চেষ্টা কর ট্র্যাভিজ, একজন মানুষ হিসেবে তোমার বা তোমার সিদ্ধান্তের কোনো গুরুত্ব নেই। আমরা নির্ভর করছি আসল সত্য বা প্রকৃত ঘটনার উপর। তোমার গুরুত্ব হচ্ছে তুমি সেই সত্য প্রকাশের মাধ্যম। তোমাকে মেরে ফেলার অর্থ হচ্ছে সত্যটাকে নিজেদের কাছ থেকে গোপন করা।
যদি বলি যে আসল সত্য হচ্ছে গায়া মানবজাতির ভবিষ্যৎ হতে পারে না। তখন তোমরা সবাই খুশি হয়ে মারা যাবে।
সবাই খুশি মনে মেনে নেবে না। তবে শেষপর্যন্ত তাই ঘটবে।
যদি কখনো তোমাদের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিই, তার কারণ হবে এই মাত্র তোমার বলা কথাগুলো। তারপর যারা ধৈর্য ধরে দেখছে (সম্ভবত শুনছেও) তাদের দিকে ফিরে ব্লিসকে জিজ্ঞেস করল, ওরা এমন ছড়িয়ে আছে কেন? আর এতজন কেন এসেছে? যে-কোনো একজন এসে ঘটনাটা পর্যবেক্ষণ করতে পারত। তারপর গায়ার সবার স্মৃতিতে ছড়িয়ে দিতে পারত তাই না?
ওরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনাটা পর্যবেক্ষণ করছে, এবং পৃথক পৃথক মস্তিষ্কে সেটা রেকর্ড হচ্ছে। পরে সকলের পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে একজনের বিশ্লেষণের তুলনায় সকলের সমন্বিত বিশ্লেষণ থেকে আজকের ঘটনা আরও ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে।
অন্য কথায়, ক্ষুদ্র অংশের তুলনায় সামগ্রিক কাঠামো আরও ভালোভাবে কাজ করবে।
ঠিক। গায়ার অস্তিত্বের মৌলিক যুক্তিগুলো তুমি বেশ ভালোই বুঝেছ। একা একজন মানুষ হিসেবে তুমি প্রায় ৫০ ট্রিলিয়ন কোষ দিয়ে তৈরি। কিন্তু মাল্টি সেলুলার ইণ্ডিভিজুয়াল হিসেবে তুমি ঐ পঞ্চাশ ট্রিলিয়ন কোষের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নিশ্চয়ই একমত হবে।
হ্যাঁ আমি একমত।
মহাকাশ যানের ভেতর ঢুকে শেষবারের মতো গায়াকে দেখার জন্য ঘুরে দাঁড়ালো ট্র্যাভিজ। বৃষ্টির ফলে চারপাশে তরতাজা ভাব। তার সামনে ছড়িয়ে আছে শান্ত, নিরিবিলি, সবুজ এক বিশ্ব। জটিল ও রহস্যময় গ্যালাক্সির শেষ প্রান্তে এক শান্তিময় উদ্যান।
এবং ট্র্যাভিজ আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করল যেন এই গ্রহ আর দেখতে না হয়।
.
এয়ারলক বন্ধ হয়ে যেতেই ট্র্যাভিজের মনে হল, সে শুধু একটা দুঃস্বপ্নকেই পিছনে ফেলে আসেনি, বরং এক অস্বাভাবিক পরিবেশ থেকে বেরিয়ে এসে বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারছে।
যদিও সেই অস্বাভাবিক পরিবেশের একটা উপাদান-ব্লিস-এখনও তার সাথে রয়েছে। কিন্তু জানে প্রয়োজন আছে তার উপস্থিতির। মনে হয় সেই ব্ল্যাকবক্স আবারও কাজ শুরু করেছে সূক্ষ্মভাবে।
মহাকাশযানের সবকিছুই চমৎকারভাবে আছে। ফাউণ্ডেশন-এর মেয়র তাকে বের করে দেওয়ার পর থেকেই এই যান তার কাছে আছে। এখনও আছে এবং ফেরত দেওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই।
এটা তার কাছে আছে মাত্র কয়েক মাস, কিন্তু এরই মধ্যে তার বাড়িঘর হয়ে উঠেছে এটা। টার্মিনাসে নিজের বাসস্থানের কথা মনে নেই একেবারেই।
টার্মিনাস! ফাউণ্ডেশন ফেডারেশনের কেন্দ্র, সেলডনের পরিকল্পনা অনুযায়ী পরবর্তী পাঁচ শতাব্দীতে দ্বিতীয় আরেকটা শক্তিশালী গ্যালাকটিক এম্পায়ার গড়ে তোলাই যার লক্ষ্য। কিন্তু ট্র্যাভিজ সেই আশাকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। শুরু করেছে নতুন এক সামাজিক ব্যবস্থা, যা আগে কেউ কখনো দেখেনি।
এখন সে অভিযানে বেরিয়েছে প্রমাণ করার জন্য যা সে করেছে তা সঠিক না ভুল।
এভাবে চিন্তায় ডুবে যাওয়ার জন্য বিরক্ত হলো নিজের উপর। দ্রুতপায়ে এগোল পাইলট রুমের দিকে।
কম্পিউটার আগের চেয়েও বেশি ঝকমক করছে। ঝকমক করছে সবকিছুই।
নিখুঁতভাবে যন্ত্রপাতিগুলো কাজ করছে। নিঃশব্দে চলছে ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা।
কম্পিউটারের আলোর বৃত্ত যেন আমন্ত্রণ জানালো তাকে, ট্র্যাভিজ স্পর্শ করতেই আলোটা ছড়িয়ে পড়ল পুরো ডেস্কের উপর, সেই সাথে ডান ও বা হাতের দুটো ছাপ ফুটে ওঠল। আটকে রাখা নিশ্বাস ছাড়ল সে। গায়ানরা ফাউণ্ডেশন-এর প্রযুক্তির কিছুই জানে না। ভয় ছিল তারা হয়তো যন্ত্রগুলো নষ্ট করে ফেলবে। কিন্তু ঠিক আছে সব।
এবার আসল পরীক্ষা। তার ভয় হচ্ছে। যদি কোনো ক্ষতি হয় সে সাথে সাথেই বুঝতে পারবে। বুঝেই বা কী করবে। মেরামতের জন্য ফিরে যেতে হবে সেই টার্মিনাসে। যদি ফিরে যায়, সে নিশ্চিত মেয়র ব্র্যান্নো আর তাকে ছাড়বে না। আর যদি না যায়–
মনে হচ্ছে বুকের খাঁচার ভেতর হৃৎপিণ্ড ফুটবলের মতো লাফাচ্ছে। কিন্তু সঙের মতো দাঁড়িয়ে থেকে কোনো লাভ নেই।
দ্রুত ডান ও বাঁ হাত সামনে বাড়িয়ে ডেস্কের ছাপ দুটোর উপর রাখলো সে। সাথে সাথেই মনে হলো আরেক জোড়া হাত তার হাত দুটোকে আঁকড়ে ধরেছে। এখন সে গায়ার চারদিক দেখতে পারছে। সবুজ ও আর্দ্র। গায়ানরা আছে এখনও। ইচ্ছা শক্তি বাড়িয়ে সে উপড়ে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ দেখল। ইচ্ছা শক্তি আরেকটু বাড়ানোতে মেঘ সরে গিয়ে বেড়িয়ে এল নীল আকাশ।
তারপর ফুটিয়ে তুলল গ্যালাক্সির ইমেজ। ঘুড়ে বেড়াতে লাগল নক্ষত্রমণ্ডলে। কম্পিউটারটা বিভিন্ন ভাবে পরীক্ষা করে সে নিশ্চিত হলে তবেই। সংযোগ বিচ্ছিন্ন। করে ফিরে এল বাস্তবে। একটু ঝুঁকে দাঁড়ানোতে ব্যথা করছে ঘাড় পিঠ।