- বইয়ের নামঃ ফাউণ্ডেশন
- লেখকের নামঃ আইজাক আসিমভ
- প্রকাশনাঃ সংহতি প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
ফাউণ্ডেশন
১. মনোইতিহাসবিদদের কথা
ফাউণ্ডেশন – সায়েন্স ফিকশন – আইজাক আসিমভ
অনুবাদ – জি. এইচ. হাবীব
শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞান কল্প-কাহিনীকার। জাতিতে ইহুদী; জন্ম, ১৯২০ সালে, মস্কো থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমের একটি ছোট্ট শহর পেট্রেভিচ-এ। কিন্তু মাত্র তিন বছর পরই সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে কেটেছে তার শৈশব। ওখানেই এক গ্রামার স্কুলে পড়াশোনায় হাতেখড়ি। স্মৃতিশক্তি ছিল খুব ভাল, তাই হাই স্কুলের গণ্ডী পেরোন ষোল বছরে পা দেবার আগেই। ১৯৩৯ এবং ১৯৪১-এ যথাক্রমে বিএসসি, এবং এমএসসি পাস করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফিলাডেলফিয়া নেভাল এয়ার এক্সপেরিমেন্টাল স্টেশনে কেমিস্ট হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন। ১৯৪৫, ১৯৪৬– এই দুবছর মার্কিন সেনা বিভাগে চাকরি করে কর্পোরাল পদে উন্নীত হওয়ার পর অবসর নেন। ১৯৪৯ সালে পিএইচডি করেন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। তারপর ওখানে নিউক্লেয়িক এসিড নিয়ে কিছুদিন গবেষণা করে ঐ বছরই বায়োকেমিস্ট্রির ইন্ট্রাক্টর হিসেবে বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৫৫ সালে উন্নীত হন সহযোগী অধ্যাপক পদে।
লেখালেখির আগ্রহ কৈশোর থেকেই। আর তাই দেখে, ১৯৩৬ সালে তার বাবা একটা টাইপরাইটার কিনে দেন। এই টাইপরাইটারই পরে তাঁর জীবনের প্রধান সঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়। দিনে গড়পড়তা বারো ঘণ্টা কাটাতেন তিনি এটার সান্নিধ্যে। প্রথম সায়েন্স ফিকশনটি লেখেন ১৯৩৮ সালে। গল্পটি নিয়ে সোজা গিয়ে হাজির হন অ্যাসটাউণ্ডিং সায়েন্স ফিকশন পত্রিকার সম্পাদক জন ডাব্লিউ ক্যাম্পবেলের কাছে। শুধু সেটিই নয়, পরপর বারোটি গল্প তিনি বাতিল করে দেন। অবশ্য গল্প লেখার ব্যাপারে তিনি অনেক প্রয়োজনীয় উপদেশও দেন। সে-বছরই অ্যামেজিং স্টোরিজ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তার গল্প মেরুনড় অভ ভেসটা। প্রথম বই বেরোয় ১৯৫০ এ, পেবল ইন দ্য স্কাই। ১৯৫০ সালেই বেরোয় দ্বিতীয় উপন্যাস আই, রোবট। ১৯৫৪ এবং ১৯৫৭ সালে ডিটেকটিভধর্মী দুটো সায়েন্স ফিকশন দ্য কেভস অভ স্টিল এবং দ্য নেকেড সান। উল্লেখযোগ্য কিছু গল্প সংকলনও বেরোয় : দ্য মার্সিয়ান ওয়ে (১৯৫৫), নাইন টুমরোজ, টেলস অভ নিউ ফিউচার (১৯৫৯), ট্রায়াঙ্গল (১৯৬১), ইত্যাদি।
পাঠক এবং সমালোচকদের ধারণা, ফাউণ্ডেশন ট্রিলজি-ই তাঁর সেরা রচনা; এই ট্রিলজির তিনটি খণ্ড হচ্ছে ফাউণ্ডেশন (১৯৫১), ফাউণ্ডেশন অ্যান্ড এম্পায়ার (১৯৫২), এবং সেকেণ্ড ফাউণ্ডেশন (১৯৫৩)। ১৯৬৬ সালে ট্রিলজিটি দ্য ওয়ার্ল্ড সায়েন্স ফিকশন কনভেনশন থেকে বেস্ট অল-টাইম সায়েন্স ফিকশন সিরিজ হিসেবে হুগো অ্যাওয়ার্ড লাভ করে। সব মিলিয়ে তিনবার হুগো অ্যাওয়ার্ড এবং একবার নেবুলা অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন আসিমভ। ফাউণ্ডেশন ট্রিলজি রচনার প্রায় তিরিশ বছর পর সিরিজটিকে তিনি সম্প্রসারিত করেন ফাউণ্ডেশনস এজ (১৯৮২) ও ফাউণ্ডেশন অ্যাণ্ড আর্থ (১৯৮৩) নামের দুটো উপন্যাস লিখে। এবং ১৯৮৮ সালে প্রিলিউড টু ফাউণ্ডেশন নামে আরেকটি উপন্যাস লেখেন। সেটা ফাউণ্ডেশন অ্যান্ড আর্থ-এর সিকোয়েল নয়, বরং প্রথম খণ্ড অর্থাৎ ফাউণ্ডেশন-এর আগের কাহিনী। অবশ্য ওটা না পড়লেও ফাউণ্ডেশন পড়তে কোনো অসুবিধা হবে না।
রোবোটিকসের চারটি অসাধারণ সূত্রের জন্যেও আসিমভ বিখ্যাত। বিজ্ঞানের খটোমটো বিষয়গুলোকে যথাসম্ভব সহজ সাবলীল ভাষায় সাধারণ পাঠকের হাতে তুলে দিয়েছেন তিনি সফলভাবে। এ-ধরনের কিছু নির্জলা বিজ্ঞান নির্ভর বই হচ্ছে, দ্য রিল অভ নাম্বার্স (১৯৫৯), দি ইন্টেলিজেন্ট ম্যানস গাইড টু সায়েন্স (১৯৬০), দ্য জেনেটিক কোড (১৯৬৩), ইত্যাদি।
ছোটদের জন্য লাকি স্টার নামের এক নড়োচরের কাহিনী লিখেছেন লাকি স্টার অ্যাও ওশেনস অভ ভেনাস, লাকি স্টার অ্যাণ্ড দ্য বিগ সান মারকারি এবং লাকি স্টার অ্যান্ড মুনস অভ জুপিটার- এই উপন্যাসগুলোয়।
সব মিলিয়ে তার গ্রন্থসংখ্যা প্রায় পাঁচশ। ১৯৯২ সালের ৬ই এপ্রিল তিনি মারা যান।
.
সূচিক্রম
প্রথম পর্ব মনোইতিহাসবিদদের কথা
দ্বিতীয় পর্ব বিশ্বকোষ রচয়িতাদের কথা
তৃতীয় পর্ব। মেয়রদের কথা
চতুর্থ পর্ব বণিকদের কথা
পঞ্চম পর্ব বণিক রাজপুত্রদের কথা।
*
প্রথম পর্ব – মনোইতিহাসবিদদের কথা
হ্যারি সেলডন-… গ্যালাকটিক এরা-র ১১,৯৮৮ তম বর্ষে জন্মগ্রহণ করেন, মারা যান ১২,০৬৯ সালে। তারিখ দুটো আরো সহজভাবে ফাউণ্ডেশন এরা অনুযায়ী এভাবে লেখা হয় : জন্ম:- ৭৯; মৃত্যু:-১ এফ. ই.। হেলিকন-এর এক মধ্যবিত্ত পরিবারে আর্কটারাস সেক্টরে জন্ম তাঁর। (কিংবদন্তী আছে, আর্কটারাস সেক্টরে তাঁর বাবা গ্রহের হাইড্রোপনিক প্ল্যান্টে তামাক চাষ করতেন। অবশ্যি এটা কতটুকু সত্যি তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।) শৈশবেই তিনি অংকশাস্ত্রে অসাধারণ পারদর্শিতা প্রদর্শন করেন যার প্রচুর উদাহরণ লোকের মুখে মুখে ফেরে। কিন্তু সেগুলোর কিছু কিছু পরস্পর বিরোধীও বটে। বলা হয়ে থাকে, তার বয়স যখন দুবছর…
… নিঃসন্দেহে তার সবচেয়ে বড় অবদান মনস্তাত্ত্বিক ইতিহাস বা সাইকোহিস্ট্রির ক্ষেত্রে। সেলডন যখন বিষয়টিতে হাত দেন তখন এটা ছিল নিতান্তই কিছু অস্পষ্ট, স্বতঃসিদ্ধ ধারণার একটি সমষ্টি মাত্র। কিন্তু সাইকোহিস্ট্রিকে তিনি একটি একটি নিগূঢ়, পরিসংখ্যান-নির্ভর বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে রেখে যান।…
… গাল ডরনিকের লেখা জীবনীটিকেই এখন পর্যন্ত তাঁর জীবন সম্পর্কে সবচেয়ে প্রামাণ্য গ্রন্থ বলে গণ্য করা হয়। মহান এই গণিতজ্ঞের মৃত্যুর দুবছর আগে তার সঙ্গে দেখা হয় যুবক ডরনিকের। সেই প্রথম সাক্ষাতের কাহিনী…
-ইনসাইক্লোপীডিয়া গ্যালাকটিকা।*
——–
* এখানে ব্যবহৃত ইনসাইক্লোপীডিয়া গ্যালাকটিকার সমস্ত উদ্ধৃতি প্রকাশকদের অনুমতিক্রমে ইনসাইক্লোপীডিয়া গ্যালাকটিকা পাবলিশিং কোং, টার্মিনাস কর্তৃক ১০২০ এফ. ই.-তে প্রকাশিত ১১৬তম সংস্করণ থেকে নেয়া হয়েছে।
.
নাম তার গাল ডরনিক। নেহাতই এক গাঁয়ের ছেলে বলা যেতে পারে ওকে, কারণ এর আগে ট্রানটর দেখেনি সে। অর্থাৎ কিনা, চর্মচক্ষে। হাইপার-ভিডিওতে তো কতবারই দেখেছে। কোনো রাজকীয় অভিষেক বা কোনো গ্যালাকটিক কাউন্সিলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান কাভার-করা অসাধারণ ত্রিমাত্রিক খবরেও দেখেছে মাঝে মধ্যে।
যদিও ওর সারা জীবন কেটেছে সিন্যাক্স-এ, কিন্তু রু ড্রিফট-এর প্রান্তে একটি নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণরত এই গ্রহটি সভ্যতার আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত ছিল না মোটেই। সত্যি কথা বলতে কী, সে-সময়ে গ্যালাক্সির কোনো অংশই অবহেলিত ছিল না।
গ্যালাক্সির দুই কোটি পঞ্চাশ লক্ষ গ্রহে তখন মানুষের বাস। এর মধ্যে একটিও গ্রহ নেই যেটি এম্পায়ার-এর প্রতি অনুগত নয়। এবং গত পঞ্চাশ বছর ধরে ট্রানটরই এম্পায়ার-এর রাজধানী হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে।
গালের জন্য এবারের এই ভ্রমণ নিঃসন্দেহে তার নবীন শিক্ষা জীবনের চূড়ান্ত পর্ব।
মহাশূন্যভ্রমণ একবারে নতুন নয় তার কাছে। সুতরাং এটাকে স্রেফ একটা আকাশযাত্রা হিসেবে তেমন কিছু মনে হচ্ছে না ওর। অবশ্যি ওর দৌড় সিন্যাক্স-এর একমাত্র উপগ্রহ পর্যন্ত। গবেষণাপত্রের জন্য উল্কা-পতনের মেকানিক্স সম্পর্কে উপাত্ত সংগ্রহ করতে গিয়েছিল সে উপগ্রহটায়। কিন্তু তাতে কী? পাঁচ মাইলের মহাশূন্যভ্রমণও যে কথা, কয়েক আলোকবর্ষ ভ্রমণও ঐ একই কথা।
হাইপার-স্পেসের ভেতর দিয়ে জাম্প-এর জন্য শরীরটা একটু শক্ত করে ফেলল সে। আন্তঃগ্রহ ভ্রমণের জন্য অবশ্যি এ-ধরনের জাম্পের প্রয়োজন হয় না। অনেকদিন থেকেই চলে আসছে জাম্পের ব্যবহার। সম্ভবত অনন্তকাল ধরেই চলবে। কারণ, এক নক্ষত্র থেকে অন্য নক্ষত্রে যাবার এটাই কার্যকর পদ্ধতি। সাধারণ মহাশূন্যে চলাচলের জন্য স্রেফ আলোর গতি হলেই চলত (মানব ইতিহাসের সেই বিস্মৃত উষালগ্নের অল্প যে কটি বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এখনো টিকে আছে, এটি তার অন্যতম); কিন্তু তাতেও সবচেয়ে কাছের বসতিতে পৌঁছুতে কয়েক বছর লেগে যেত। হাইপার-স্পেস মহাশূন্য নয়, সময়ও নয়; বস্তু নয়, শক্তিও নয়; কিছু নয়, আবার কিছু না-ও নয়। গ্যালাক্সির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে কয়েক মুহূর্তের বেশি সময় লাগে না এই হাইপার-স্পেসের ভেতর দিয়ে।
সামান্য ভীতির একটা কুণ্ডলী পাকানো অনুভূতি পেটের মধ্যে নিয়ে প্রথম জাম্প এর জন্য অপেক্ষা করে রইল গাল। এবং সামান্য একটু ঝাঁকিতে শেষ হয়ে গেল জাম্পটা। শরীরের ভেতর ছোট্ট একটা ঝাঁকিও সে অনুভব করেছে কিনা সে-ব্যাপারে নিশ্চিত হবার আগেই থেমে গেল। ব্যস, ঐ পর্যন্তই।
এরপর ওর অনুভূতি জুড়ে রইল শুধু ১২,০০০ বছরের ইম্পেরিয়াল উন্নতির নির্লিপ্ত, শীতল ফলশ্রুতি এই প্রকাণ্ড ও চকচকে মহাশূন্যযানটি আর সে নিজে, যার থলেতে রয়েছে গণিতশাস্ত্রে সদ্য অর্জিত একটা ডক্টরেট ডিগ্রী আর মহান হ্যারি সেলডনের আমন্ত্রণ- ট্রানটরে গিয়ে বিশাল এবং কিছুটা রহস্যময় সেলডন প্রজেক্টে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ।
জাম্প-এর ব্যাপারে হতাশ হবার পর গাল অপেক্ষা করছে ট্রানটর দেখার জন্য। ভিউরুমে ঢু মারল সে বার বার। পূর্বঘঘাষিত সময় অনুযায়ী স্টীলের শাটারগুলো তুলে দেয়া হয়; প্রতিবারই সময়মত গিয়ে হাজির হয় গাল। উপভোগ করে তারার চোখ ধাঁধানো দীপ্তি; চলার পথে ধরা পড়ে চিরতরে স্থির হয়ে যাওয়া জোনাকি পোকার দানবীয় ঝাঁকের মতো নক্ষত্রপুঞ্জের অবিশ্বাস্য, অস্পষ্ট সমাবেশ। একবার শিপের পাঁচ আলোকবর্ষের মধ্যে একটা গ্যাসীয় নীহারিকার ঠাণ্ডা, নীল-সাদা ধোঁয়া দেখা গেল; জানালার ওপর সে-ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ল পাতলা দুধের মতো, ঘর ভরে গেল বরফ-সাদা আলোয়। দুঘণ্টা পর চোখের আড়ালে হারিয়ে গেল সেটা, আরেকটা জাম্পের পর।
প্রথম দেখায় ট্রানটরের সূর্যটাকে মনে হল কঠিন, সাদা একটি বিন্দুর মতো। একইরকম অগুনতি বিন্দুর মধ্যে সেটা নজরেই পড়েনি বলতে গেলে। চেনা গেল নেহাত শিপের গাইড দেখিয়ে দিল বলে। গ্যালাকটিক সেন্টারের এখানটায় তারার সংখ্যা একটু বেশি। কিন্তু প্রতিটি জাম্পের পর সূর্যটা উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হল আশ-পাশের সবগুলোকে ঔজ্জ্বল্যে এবং বিশালতায় স্নান করে দিয়ে।
একজন অফিসার এসে বললেন, ট্রিপের বাকি সময়টা ভিউ-রুম বন্ধ থাকবে। নামার জন্য তৈরি হোন।
অফিসারের সাদা ইউনিফর্মের আস্তিনে এম্পায়ার-এর মহাকাশযান এবং সূর্যের নকশা আঁকা।
গাল বলল, আমি কি একটু থাকতে পারি না? ট্র্যানটরটা দেখতে চাই আমি।
অফিসার মৃদু হাসলেন। গাল লজ্জা পেল একটু। আঞ্চলিক উচ্চারণে কথা বলার কারণেই ভদ্রলোক হাসলেন বলে মনে হলো তার।
অফিসার বললেন, সকালের মধ্যেই ট্রানটরে ল্যাণ্ড করব আমরা।
মানে, আমি স্পেস থেকে দেখতে চাই গ্রহটাকে।
ওহ্ সরি, মাই বয়। এটা স্পেস-ইয়ট হলে সে-ব্যবস্থা করতে পারতাম। কিন্তু সানসাইডে স্পিন করে নামছি আমরা। তুমি নিশ্চয়ই একই সঙ্গে অন্ধ, দগ্ধ আর
রেডিয়েশনে ক্ষত-বিক্ষত হতে চাও না?
অগত্যা ফিরে যাবার জন্য পা বাড়াল গাল।
অফিসার পেছন থেকে বলে উঠলেন, এখান থেকে ট্র্যানটরকে কেবল ধূসর আর আবছা দেখাবে। ট্রানটরে নেমে স্পেস-টুরে গেলেই তো পারেন। বেশ সস্তা কিন্তু।
ফিরে তাকাল গাল। পরামর্শের জন্যে ধন্যবাদ, শুকনো গলায় বলল শুধু।
মনঃক্ষুণ্ণ হওয়াটা যে ছেলেমানুষি, তাতে সন্দেহ নেই; কিন্তু ছেলেমানুষিতে তো শুধু বাচ্চাদেরই পায় না, বড়দেরও পায়। গালের গলার কাছে কী যেন দলা পাকালো। জীবনের বিশালতা নিয়ে, তার সমস্ত বিস্ময় নিয়ে, চোখের সামনে ট্র্যানটরকে বিস্তৃত হয়ে পড়ে থাকতে সে কখনও দেখেনি। ভাবেনি, আরও বেশ কিছুক্ষণ ওকে অপেক্ষা করতে হবে।
.
দুই
শিপটি অবতরণ করল বিচিত্র ধরনের কিছু শব্দের মধ্যে। ধাতব গা কেটে সরে যাওয়া বায়ুমণ্ডলের দূরবর্তী হিসহিস, সংঘর্ষজনিত তাপ সামাল দেয়া কণ্ডিশনারগুলোর অবিরাম গুনগুন, গতি মন্থরে ব্যস্ত এঞ্জিনগুলোর চাপা, ভারি গুম গুম। সেই সঙ্গে রয়েছে ডিবার্কেশন রুমগুলোয় জড়ো হওয়া নারী-পুরুষের সম্মিলিত কণ্ঠ আর শিপের লম্বা অক্ষ বরাবর ব্যাগেজ, মেইল এবং অন্যান্য মালামাল তোলায় ব্যস্ত হয়েস্টগুলোর ধুপধাপ। মালামালগুলো পরে আনলোডিং প্লাটফর্মে সরিয়ে নেয়া হবে।
হালকা একটা ঝাঁকি অনুভব করল গাল। অর্থাৎ এই মুহূর্ত থেকে শিপটির আর তার নিজস্ব, স্বাধীন গতি রইল না। কয়েক ঘণ্টা ধরেই গ্রহের অভিকর্ষ একটু একটু করে জায়গা করে নিচ্ছিল শিপের অভিকর্ষ সরিয়ে। নমনীয় ফোর্স-ফীল্ডের কারণে ডিবার্কেশন রুমগুলো দুলছে মৃদু গ্র্যাভিটেশনাল ফোর্স-এর পরিবর্তনশীল ডিরেকশানের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে যেন নিজেদের। হাজার হাজার যাত্রী ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিল রুমগুলোয়। এবার তারা বাঁকা র্যাম্প ধরে বিশাল, মুখ ব্যাদান করা লকগুলোর দিকে এগোল ধীরে ধীরে।
গালের মালপত্র সামান্য। একট ডেস্কের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে চটপট এবং দক্ষতার সঙ্গে খুলে আবার বন্ধ করে দেয়া হল সেটা। ভিসা পরীক্ষা করে সীল মেরে দেয়া হল। ও নিজে এদিকে কোনো নজরই দিল না।
এই তাহলে ট্রানটর! ওর বাড়ি যেখানে, সেই সিন্যাক্স গ্রহের চেয়ে বাতাসটা একটু ভারি, অভিকর্ষও সামান্য বেশি। অবশ্যি অভ্যস্ত হয়ে যেতে তেমন সময় লাগবে না। তবে এই বিশালত্বের সঙ্গে নিজেকে সে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে কিনা সেটাই চিন্তার বিষয়।
ডিবার্কেশন রুমটা তো রীতিমতো অসাধারণ। ছাদটা প্রায় হারিয়েই গেছে উঁচুতে। কল্পনার চোখে গাল প্রায় দিব্যি দেখতে পেল, সেই বিশালতার নিচে মেঘ জমেছে। মুখোমুখি কোনো দেয়াল দেখতে পেল না সে। শুধু মানুষ আর ডেস্ক, আর এক সময় দূরে ঝাপসা হয়ে হারিয়ে যাওয়া একবিন্দুমুখী মেঝে।
ডেস্কের লোকটা কথা বলে উঠেছে ফের। তার গলায় ঈষৎ বিরক্তি। লোকটা বলল, এগিয়ে যান, ডরনিক। ওর নামটা ভুলে যাওয়ায় ভিসা খুলে দেখে নিতে হয়েছে তাকে।
গাল জিগ্যেস করল, কো-কোনদিকে-
কিন্তু ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে, বুড়ো আঙুল ঝাঁকিয়ে লোকটা বলল, ডাইনে অথবা বাঁয়ে তিন নম্বর বাঁকে ট্যাক্সি পাবেন।
গাল এগোয়; দেখে ওপরে শূন্যে, জ্বলজ্বলে অক্ষরে লেখা রয়েছে, ট্যাক্সি। যে কোনো দিকের জন্য।
গাল সরে যেতেই কে-জানে-কোত্থেকে একজন এগিয়ে এল, তারপর ডেস্কটার সামনে এসে দাঁড়াল। ডেস্কের লোকটা মুখ তুলে তাকাল। মাথা ঝাঁকাল মৃদু। উত্তরে আগন্তুকও মাথা ঝাঁকাল, তারপর অনুসরণ করল প্রবাসী যুবকটিকে।
নিজেকে একটা রেলিং-এর সামনে আবিষ্কার করল গাল। ছোট্ট এক সাইনে লেখা, সুপারভাইজার। কিন্তু সাইন নির্দেশিত সুপারভাইজার লোকটা মুখ তোলে না। শুধু জিগ্যেস করে, কোথায় যাবেন?
গাল ইতস্তত করতে থাকে। ও নিজেই ঠিক নিশ্চিত নয় এ-ব্যাপারে। কিন্তু জবাব দিতে এমনকি কয়েক সেকেণ্ড দেরি করার অর্থ ওর পেছনে লোকের লাইন পড়ে যাওয়া।
মুখ তুলে তাকাল সুপারভাইজার, কোথায় যাবেন?
গালের হাতে টাকা-কড়ি বিশেষ কিছু নেই। তবে মাত্র এক রাতের ব্যাপার, তারপরই সে কাজ পেয়ে যাচ্ছে। সে হালকা চালে বলে, যে-কোনো একটা ভালো হোটেল।
সুপারভাইজার লোকটা ভাবলেশহীনের মতো বলে, সবগুলোই ভালো, নাম বলুন।
গাল মরিয়া হলে বলে উঠল, সবচেয়ে যেটা কাছে।
একটা বোতাম স্পর্শ করল সুপারভাইজার। আলোর একটা সরু রেখা তৈরি হল মেঝে বরাবর। বিভিন্ন রঙে আর শেডে কখনো উজ্জ্বল, কখনো নিভু নিভু হয়ে আসা অন্য অনেক রেখার মধ্যে মোচড় খেতে লাগল সেটা। একট টিকেট ধরিয়ে দেয়া হল গালের হাতে। হালকা দীপ্তি ছড়াচ্ছে সেটা।
সুপারভাইবার বলে, ওয়ান পয়েন্ট ওয়ান টু।
খুচরো পয়সার জন্য পকেট হাতড়ায় গাল। জিগ্যেস করল, কোথায় যাচ্ছি আমি?
আলোটা ফলো করুন। যতক্ষণ ঠিক পথে যাবেন টিকেটটা জ্বলতে থাকবে।
মুখ তুলে হাঁটতে শুরু করল গাল। বিশাল মেঝে বরাবর নিজের নিজের ট্রেইল ধরে এগিয়ে যাচ্ছে সবাই। ইন্টারসেকশন পয়েন্টগুলোতে তোতি করতে করতে সুড়ৎ করে বেরিয়ে চলে যাচ্ছে যার যার গন্তব্যে।
গালের ট্রেইল ফুরোল। চকচকে নতুন, দাগশূন্য প্লস্টো-টেক্সটাইলে তৈরি, উজ্জ্বল চোখ ধাঁধানো নীল-হলুদ ইউনিফর্ম পরা এক লোক ওর ব্যাগ দুটোর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। লাক্সর-এর ডিরেক্ট লাইন, লোকটা বলল।
যে লোকটা গালকে অনুসরণ করছিল, সে শুনতে পেল কথাগুলো। উত্তরে গালের বলা চমৎকার শব্দটাও কানে গেল তার। সে দেখল, নাক ভোতা একটা বাহনে চেপে বসল যুবকটি।
সোজা ওপরের দিকে উঠে গেল ট্যাক্সি। বাঁকা, স্বচ্ছ জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল গাল। বন্ধ একটা জায়গায় এই আকাশভ্রমণে বেশ রোমাঞ্চিত বোধ করছে সে। সহজাত প্রবৃত্তির বশেই ড্রাইভারের সীটের পেছনের অংশটা আঁকড়ে ধরল সে। সঙ্কুচিত হয়ে এল বিশালতা। লোকগুলো সব পিঁপড়ের আকার ধারণ করল। গোটা দৃশ্যটা ছোট হয়ে এলো আরো। তারপর পিছিয়ে যেতে থাকল।
সামনে একটা দেয়াল দেখা দিল। অনেক উঁচুতে, শূন্যেই শুরু হয়েছে সেটা, তারপর ওপরে উঠে হারিয়ে গেছে চোখের আড়ালে। শত শত গর্ত দেয়ালটার গায়ে। আসলে টানেলের মুখ ওগুলো। গালের ট্যাক্সি সেই অগুনতি মুখের একটা লক্ষ্য করে এগোয়। তারপর একসময় ঢুকে যায় সুড়ৎ করে। মুহূর্তের জন্য গাল
অবাক হয়ে ভাবে, এত মুখের মধ্যে ড্রাইভার লোকটা ঠিক মুখটা চিনল কী করে?
নিকষকালো অন্ধকার ঘেঁকে ধরেছে ট্যাক্সিটাকে। মাঝে মাঝে শুধু রঙিন সিগন্যাল লাইটের আলো দ্রুত পেছনে সরে যাচ্ছে। সঁ সঁ একটা শব্দ হচ্ছে বাতাসে।
ট্যাক্সির গতি কমে আসতে সামনে ঝুঁকে পড়ল গাল। টানেল থেকে বেরিয়ে এল ওরা। তারপর আবার নেমে এল গ্রাউণ্ড লেভেলে।
লাক্সর হোটেল, ঘোষণা করল ড্রাইভার, যদিও তার কোনো দরকার ছিল না। ব্যাগ দুটোসহ গালকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করল সে। ব্যবসায়িক ভঙ্গিতে পকেটে ঢোকাল টেন্থক্রেডিট বকশিশ। তারপর একজন অপেক্ষমান যাত্রীকে তুলে নিয়ে উড়াল দিল ফের।
শিপ থেকে নামার পর এপর্যন্ত আকাশের চিহ্নটুকু চোখে পড়েনি গালের!
.
তিন
ট্র্যানটর-… এয়োদশ সহস্রাব্দের গোড়াতেই চরমে পৌঁছায় এই প্রবণতাটি। গ্যালাক্সির কেন্দ্রীয় অঞ্চলের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এবং শিল্পোন্নত বিশ্বগুলোর মধ্যে অবস্থিত হওয়াতে আর নিরবচ্ছিন্ন কয়েকশো প্রজন্ম ধরে ইম্পেরিয়াল গভর্নমেন্ট-এর মধ্যমণি হয়ে থাকার ফলে, ট্রানটর গ্রহটি অবধারিতভাবে সর্বকালের সবচেয়ে জনবহুল এবং সমৃদ্ধশালী মানবগোষ্ঠীর বাসস্থান হয়ে ওঠে।
গ্রহটির ক্রমবর্ধমান নগরায়ন শেষ পর্যন্ত উপনীত হয় চূড়ান্ত অবস্থায়। সাত কোটি পঞ্চাশ লক্ষ বর্গমাইলব্যাপী ট্র্যানটরের সমস্ত ভূ-ভাগই পরিণত হয় একটি শহরে। জনসংখ্যা পৌঁছায় চার হাজার কোটিরও ওপর। বিশাল এই জনগোষ্ঠী প্রায় পুরোপুরিভাবেই আত্মনিয়োগ করে এম্পায়ার-এর প্রশাসনিক কাজে। সেই সঙ্গে তারা এটাও উপলব্ধি করে যে কাজটির জটিলতার তুলনায় তাদের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য (এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে, পরবর্তী সম্রাটদের নির্জীব নেতৃত্বে গ্যালাকটিক এম্পায়ার-এর সুষ্ঠু পরিচালনা হয়ে পড়ে অসম্ভব এবং এম্পায়ার-এর পতনের এটি একটি মূল কারণ)। প্রতিদিন কয়েক লাখ শিপের বহর বিশটি কৃষিভিত্তিক বিশ্বের উৎপন্ন দ্রব্য ট্রানটরবাসীদের খাবার টেবিলে পৌঁছে দিত।…
খাদ্যের জন্য, এবং প্রকৃতপক্ষে, জীবনধারণের প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছুর ব্যাপারে ট্র্যানটরের এই পরনির্ভরতার কারণেই গ্রহটি ক্রমেই নিজেকে এমন এক শিকারে পরিণত করে যাকে অবরোধের মাধ্যমে খুব সহজেই গ্রাস করা সম্ভব। এম্পায়ার-এর শেষ সহস্রাব্দে একঘেয়ে অসংখ্য বিদ্রোহ একের পর এক বিভিন্ন সম্রাটকে এ-ব্যাপারে সচেতন করে তোলে। ফলে, যে কোনো মূল্যে ট্রানটরের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই হয়ে পড়ে ইম্পেরিয়াল পলিসির একমাত্র উদ্দেশ্য।
-ইনসাইক্রেপীডিয়া গ্যালাকটকা
.
সূর্য আলো দিচ্ছে কি না বুঝতে পারছে না গাল। সেজন্যই এখন দিন না রাত ঠাহর করতে পারছে না সে। কাউকে জিগ্যেস করতে লজ্জা লাগছে তার। মনে হল গোটা গ্রহটাই ধাতু দিয়ে ঢাকা। একটু আগে ও যে-খাবার খেল, সেটাকে বলা হয়েছিল লাঞ্চ। তবে অনেক গ্রহ আছে যেখানে জীবনযাত্রা চলে একটা স্ট্যাণ্ডার্ড টাইম-স্কেল অনুযায়ী এবং সেখানে দিনরাতের সম্ভাব্য অসুবিধাজনক পরিবর্তনের দিকে ভ্রূক্ষেপও করা হয় না। সব গ্রহের আবর্তনের সময় এক নয় এবং ট্রানটরের কত সেটা জানে না গাল।
সান রুম সাইন দেখে খুব উৎসাহ নিয়ে ছুটে গেল সে। কিন্তু গিয়ে দেখল, ওটা স্রেফ কৃত্রিম বিকিরণে রোদ পোনর জায়গা। একটু ইতস্তত করে লাক্সর-এর মেইন লবিতে চলে এল সে। রুম ক্লার্ককে জিগ্যেস করল, প্ল্যানেটরি টুরের টিকিট কোথায় কিনতে পাওয়া যাবে?
এখানেই।
শুরু হবে কখন?
একটুর জন্য মিস করলেন। পরেরটা আগামীকাল। এখন টিকিট কিনে রাখলে আমরা আপনার জন্য জায়গা করে রাখব।
ইশ। কাল বড্ড দেরি হয়ে যাবে। ইউনিভার্সিটিতে যেতে হবে ওকে আগামীকাল। ও আবার শুধাল, আচ্ছা, এখানে অবজারভেশান টাওয়ার বা ঐ জাতীয় কিছু নেই? মানে বলতে চাইছি খোলা জায়গায়?
অবশ্যই আছে! যদি চান সে-জন্যেও টিকিট কিনতে পারেন। দাঁড়ান, আগে চেক করে দেখি বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে কিনা। কনুইয়ের কাছে একটা কনট্যাক্ট ক্লোজ করল লোকটা। অস্বচ্ছ একটা ক্রীনে ফুটে ওঠা লেখাগুলো পড়ল। গালও পড়ে ফেলল তার সঙ্গে।
রুম ক্লার্ক বলল, চমৎকার আবহাওয়া। বোঝা যাচ্ছে, শুকনো মৌসুম এখন। আলাপ জমাবার সুরে যোগ করল, আমি নিজে অবশ্য বাইরের ব্যাপারে মাথা ঘামাই না। শেষ খোলা আকাশের নিচে গেছি তা প্রায় তিন বছর হতে চলল। একবার দেখলেই, বুঝলেন, দেখার কিছু আর থাকে না তেমন। এই নিন আপনার টিকেট। স্পেশাল এলিভেটরটা একদম শেষের দিকে। টু দ্য টাওয়ার লেখা আছে দেখবেন। ওটাতে চড়লেই চলবে।
এলিভেটরটা নতুন ধরনের। গ্র্যাভিটিক রিপালশানের সাহায্যে চলে। ঢুকে পড়ল গাল। ওর পেছনে স্রোতের মত অন্যরাও ঢুকে গেল। একটা কনট্যাক্ট ক্লোজ করল অপারেটর। মুহূর্তের জন্য গালের কাছে মনে হল, অভিকর্ষ পুরোপুরি লোপ পেয়েছে। এবং মহাশূন্যে ভাসছে সে। তারপরই এলিভেটরটা ওপরে উঠতে শুরু করায় ধীরে ধীরে ওজন ফিরে পেল সে। এরপর শুরু হল মন্দন আর সঙ্গে সঙ্গে ওর পা জোড়া মেঝে ছেড়ে উঠে গেল ওপরে। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই চেঁচিয়ে উঠল সে।
তীক্ষ্ণ গলায় অপারেটর বলে উঠল, রেলিং-এর নিচে পা ঢুকিয়ে দিন। সাইনটা পড়তে পারেন না?
অন্যরা আগেই সেরেছে কাজটা। ওকে পাগলের মত দেয়াল আঁকড়ে নিচে নামার ব্যর্থ চেষ্টা করতে দেখে হাসছে সবাই। তাদের জুতো মেঝে বরাবর দু ফুট দূরে দূরে সমান্তরালভাবে বসানো ক্রোমিয়ামের প্রলেপ দেয়া রেলিং-এর ওপরের দিকে সেঁটে আছে। ঢোকার সময়ই গাল লক্ষ্য করেছিল রেলিংগুলো; কিন্তু গুরুত্ব দেয়নি।
হঠাৎ একটা হাত এগিয়ে এসে ট্রেনে নামিয়ে নিল ওকে।
হাঁফাতে হাঁফাতে ধন্যবাদ জানাল গাল ত্রাণকর্তাকে। ততোক্ষণে থেমে গেছে এলিভেটর।
খোলা একটা চাতালে পা রাখতেই রোদ্রের তীব্রতায় চোখ ধাঁধিয়ে গেল গালের। যে-লোকটা একটু আগে ওকে সাহায্য করেছিল সে ওর ঠিক পেছনেই রয়েছে।
লোকটা নরম গলায় বলল, অনেক সীট আছে।
গাল মুখ বন্ধ করল, হাঁফাচ্ছে সে তখনো। বলল, তাইতো দেখছি, তারপর স্বয়ংক্রিয়ভাবে এগিয়ে গেল সেদিকে। দু পা এগিয়েই থমকে দাঁড়াল। বলল, যদি কিছু মনে না করেন, আমি একটু রেলিং-এর কাছে দিয়ে দাঁড়াব কিছুক্ষণের জন্যে। আ-আমি একটু ভাল করে দেখতে চাই।
স্মিত হেসে হাত নেড়ে ওকে এগিয়ে যেতে বলল লোকটা। কাঁধ-সমান উঁচু রেলিং এর সামনে গিয়ে ঝুঁকে পড়ল গাল। সামনের বিশাল দৃশ্যপটে ডুবিয়ে দিল নিজেকে।
মাটি পর্যন্ত চোখ পৌঁছল না ওর। মানুষের তৈরি বিভিন্ন ক্রমবর্ধমান কাঠামোর জটিলতায় হারিয়ে গেছে ভূ-পৃষ্ঠ। এমনকি দিগন্তও দেখতে পেল না গাল। বরং সেখানে আকাশের গায়ে সবখানে প্রায় একই রকম ধূসরতা নিয়ে বিস্তৃত হয়ে আছে ধাতব দিগন্ত। ও জানে, গ্রহটির সমস্ত ল্যাণ্ড-সারফেস জুড়েই এই অবস্থা। কোথাও তেমন কোনো নড়াচড়া নজরে পড়ল না ওর। আকাশের গায়ে কয়েকটা প্রমোদতরী ভেসে বেড়াচ্ছে শুধু। কিন্তু গাল জানে, কোটি কোটি লোকের ব্যস্ত চলাচল রয়েছে গ্রহটির ধাতব চামড়ার নিচে।
সবুজের কোনো চিহ্ন নেই; সবুজ নেই, মাটি নেই, মানুষ ছাড়া কোনো প্রাণী নেই। অথচ, ও অস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করল, এই গ্রহেরই কোথাও একশো বর্গমাইল জায়গা জুড়ে সম্রাটের যে প্রাসাদ রয়েছে সেখানে সবই আছে- মাটি, সবুজ গাছপালা, নানান ফুলের রঙধনু- সব। ইস্পাতের সমুদ্রের মধ্যে এটা একটা ছোট্ট দ্বীপ। কিন্তু ও যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে দেখতে পাচ্ছে না জায়গাটা। হয়ত সেটা দশ হাজার মাইল দূরে কোথাও। জানে না গাল।
খুব তাড়াতাড়ি ট্যুরে যেতে হবে ওকে!
শব্দ করে শ্বাস ফেলল গাল। ভাবল, অবশেষে সত্যি তাহলে ট্রানটরে এসেছে সে; গোটা গ্যালাক্সির কেন্দ্র আর মানব জাতির মর্মস্থলে সত্যি তাহলে পৌঁছুছে সে। গ্রহটার কোনো দুর্বলতা ধরা পড়ল না ওর চোখে। খাদ্য নিয়ে কোনো শিপকে ল্যাণ্ড করতে দেখেনি সে। ট্রানটরের চল্লিশ বিলিয়ন লোককে গ্যালাক্সির বাকি অংশের সঙ্গে সূক্ষ্মভাবে যুক্ত করছে যে প্রাণ-প্রবাহ, সে সম্পর্কেও সচেতন নয় গাল। ওর চোখে শুধু ধরা পড়ছে মানুষের প্রবলতম কীর্তি; একটি গ্রহের সম্পূর্ণ এবং প্রায় উদ্ধত রকমের চূড়ান্ত বিজয়।
কেমন একটা ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে ফিরে এল সে। ওর এলিভেটরের বন্ধু তার পাশের সীটটা দেখিয়ে দিল। গাল বসে পড়ল সেখানে। হাসল লোকটা। আমার নাম জেরিল। ট্রানটরে এই প্রথম?
হ্যাঁ, মি. জেরিল।
অনুমান করেছিলাম। জেরিল আমার ফার্স্ট নেইম। মনটা কবিসুলভ হলে ট্র্যানটর ভালো লাগবে না কারো। অবশ্য ট্রানটরবাসীরাও কখনো আসে না এখানে। পছন্দ করে না ওরা জায়গাটা। বিরক্তি বোধ করে।
বিরক্তি বোধ করে!–ভাল কথা, আমার নাম গাল। বিরক্তি বোধ করে কেন? গ্রহটা তো অসাধারণ।
যদি আপনি জন্ম নেন একটা ছোট্ট ঘরে, বেড়ে ওঠেন করিডরে, কাজ করেন একটা সেলে আর ছুটি কাটান লোক বোঝাই কোনো সান রুমে, সেক্ষেত্রে মাথার ওপর খোলা আকাশ ছাড়া কিছু নেই এমন জায়গায় এলে নার্ভাস ব্রেক ডাউন হয়ে যেতে পারে আপনার। সন্তানের বয়েস পাঁচ বছর হলে বছরে একবার করে তাদের এখানে নিয়ে আসে ট্রানটরবাসীরা। জানি না এতে কোনো উপকার হয় কিনা বাচ্চাগুলোর। প্রথম দিকে তো হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীর মতো চেঁচাতে থাকে। মায়ের দুধ ছেড়ে দেবার পর থেকেই ওদের এখানে আনা শুরু করা উচিত, আর সেটা সপ্তাহে একবার করে।
বলেই চলে সে, অবশ্যি এতে কিছু আসে যায় না। ওরা যদি আদৌ বাইরে না বেরোয় তাহলেই বা ক্ষতিটা কী? নিচেই ওরা সুখী। আর সাম্রাজ্য চালায় তো ওরাই। আমরা কত উঁচুতে আছি বলে মনে হয় আপনার?
গাল উত্তর দিল, আধ মাইল? বলেই ভাবল কথাটা বোকার মতো শোনাল কিনা।
তাই শোনাল হয়ত, কেননা জেরিল মুখ টিপে, শব্দ করে হাসল। বলল, না, মাত্র পাঁচশো ফুট।
কী! কিন্তু এলিভেটর তো প্রায়-?
জানি। কিন্তু ঐ সময়ের বেশির ভাগই ব্যয় হয়েছে গ্রাউণ্ড লেভেল পর্যন্ত উঠতে। মাটির নিচে এক মাইলেরও বেশি গভীর টানেল খোঁড়া রয়েছে ট্র্যানটরে। গ্রহটা আইসবার্গের মতো অনেকটা। দশ ভাগের নয় ভাগই চোখের আড়ালে। উপকূল অঞ্চলে তো সাব-ওশান সয়েলের কয়েক মাইল নিচেও টানেল আছে। সত্যি কথা বলতে কী, আমরা এতই নিচে বাস করি যে, আমাদের প্রয়োজনীয় সমস্ত শক্তির জন্য গ্রাউণ্ড লেভেল আর তার মাইল দুয়েক নিচের মধ্যেকার তাপমাত্রার পার্থক্যটাকে কাজে লাগাতে পারি। আপনি জানতেন কথাটা?
না, আমি ভেবেছিলাম আপনারা অ্যাটমিক জেনারেটর ব্যবহার করেন।
একসময় করতাম। কিন্তু এটা বেশি সস্তা।
আমারও তাই মনে হয়।
তা, সব মিলিয়ে কী মনে হচ্ছে? মুহূর্তের জন্য সদাশয় ভাবটা উবে গিয়ে ধুরন্ধর একটা ভাব ফুটে উঠল লোকটার চেহারায়। অনেকটা ধূর্তের মতো দেখাচ্ছে তাকে এখন।
একটু অসহায় বোধ করল গাল। তারপর আবার আগের বিশেষণটা ব্যবহার করল সে, অসাধারণ।
এখানে কি ছুটিতে এসেছেন? বেড়াবেন? দর্শনীয় জায়গা দেখবেন?
ঠিক তা নয়। সত্যি বলতে, ট্র্যানটরে বেড়াতে আসার ইচ্ছে আমার অনেক দিনের। কিন্তু এসেছি আসলে একটা কাজের জন্য।
ও!
আরেকটু ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন বোধ করল গাল। ট্রানটর ইউনিভার্সিটিতে ড. সেলডনের একটা প্রজেক্টে।
অপয়া সেলডন?
না। আমি হ্যারি সেলডনের কথা বলছি। সাইকোহিস্টোরিয়ান সেলডন। অপয়া সেলডন বলে কাউকে চিনি না।
আমিও হ্যারির কথাই বলছি। লোকে ওকে অপয়া বলে ডাকে। গালি, বুঝতেই পারছেন। কেবলই ধ্বংসের ভবিষ্যদ্বাণী করে লোকটা।
তাই নাকি? গাল সত্যিই অবাক হল।
সত্যিই তাই, আপনার জানা উচিত। এখন আর হাসছে না লোকটা। আপনি তাহলে তার প্রজেক্টে কাজ করতে এসেছেন?
ইয়ে- মানে, হ্যাঁ। আমি যাকে বলে, গণিতবিদ। তা, উনি ধ্বংসের কথা বলেন কেন? কী ধরনের ধ্বংস?।
কী ধরনের বলে মনে হয় আপনার?
দেখুন, এ-সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। আমি শুধু ড. সেলডন আর তাঁর দল যে সব গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন সেগুলো পড়েছি। ওগুলো সব গাণিতিক তত্ত্ব নিয়ে লেখা।
আচ্ছা।
গাল বিব্রত বোধ করল। এবার আমি আমার ঘরে যাই। খুব খুশি হলাম আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে।
গা-ছাড়াভাবে হাত নেড়ে ওকে বিদায় জানাল জেরিল।
গাল ঘরে ঢুকে দেখে একজন লোক বসে আছে। ও এততাই অবাক হল যে, এ পরিস্থিতিতে অবধারিতভাবে ঠোঁটের ডগায় চলে আসা আপনি এখানে কী করছেন? প্রশ্নটাও করতে পারল না।
চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াল লোকটি। এগিয়ে এল। লোকটি বৃদ্ধ। প্রায় সমস্ত মাথা জোড়া টাক। একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছে সে। তবে তার চোখ জোড়া উজ্জ্বল আর নীল।
গালের হতবুদ্ধি মস্তিস্ক বহুবার ছবিতে দেখা একটি মুখের স্মৃতির পাশাপাশি এই মুখটিকে স্থাপন করার ঠিক আগের মুহূর্তে বৃদ্ধ লোকটি বলে উঠল, আমি হ্যারি সেলডন।
.
চার
সাইকোহিস্ট্রি…অগাণিতিক ধারণার সাহায্যে গাল ডরনিক সাইকোহিস্ট্রির সংজ্ঞা দিয়েছেন এই বলে যে, এটি গণিতের সেই বিশেষ শাখা যা একটি নির্দিষ্ট সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে মানবগোষ্ঠীসমূহের প্রতিক্রিয়া নিয়ে কাজ করে।…
…উল্লিখিত সব কটি সংজ্ঞার মধ্যেই একটি ধারণা অন্তর্নিহিত রয়েছে যে, অভ্রান্ত বা কার্যকর পরিসংখ্যানগত প্রয়োগের জন্যে বিশেষ মানবগোষ্ঠীকে হতে হবে যথেষ্ট বড়। এ-ধরনের গোষ্ঠীর আকার কত বড় হবে তা সেলডনের প্রথম সূত্র থেকে বের করা যায়। এ সূত্র অনুযায়ী…।
…আরেকটি প্রয়োজনীয় ধারণা এই যে, প্রতিক্রিয়াগুলো যাতে সত্যিই অ পূর্বনির্ধারিত হয় সেজন্য মানবগোষ্ঠীকে মনো-ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ বা সাইকোহিস্টোরিক অ্যানালাইসিস সম্পর্কে অনবহিত থাকতে হবে…।
সেলডন ফাংশন-এর উন্নতির ওপরই নির্ভর করছে সমস্ত কার্যকর সাইকোহিস্ট্রির ভিত্তি। এই সেলডন ফাংশনগুলোর বৈশিষ্ট্য কিছু সামাজিক এবং
অর্থনৈতিক শক্তির অনুরূপ। আর সেই শক্তিগুলো হচ্ছে…
–ইনসাইক্লোপীডিয়া গ্যালাকটিকা
.
গুড আফটারনুন, স্যার, বলে উঠল গাল। আ-আমি–
ভাবোনি যে আগামীকালের আগেই দেখা হয়ে যাবে আমাদের, এই তো? স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে হয়ত হতো না। কিন্তু এ-মুহূর্তে অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে, তোমাকে আমাদের সহকর্মী হিসেবে পেতে হলে দ্রুত কাজ করা ছাড়া উপায় ছিল না। নতুন লোক পাওয়া দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে।
ঠিক বুঝতে পারলাম না, স্যার।
অবজার্ভেশান টাওয়ারে তুমি একজন লোকের সঙ্গে কথা বলেছিলে, তাই না?
হ্যাঁ। লোকটার ফাস্ট নেইম জেরিল। এর বেশি কিছু জানি না তার সম্পর্কে।
লোকটার নামে কিছু আসে যায় না। আসল কথা হচ্ছে, লোকটা কমিশন অভ পাবলিক সেইফটি-র একজন এজেন্ট। স্পেস-পোর্ট থেকেই তোমাকে ফলো করছিল সে।
কিন্তু কেন? আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।
লোকটা আমার সম্পর্কে কিছু বলেনি?
একটু ইতস্তত করে গাল জবাব দিল, সে আপনাকে অপয়া সেলডন বলছিল।
কারণটা বলেনি?
বলল, আপনি নাকি সব সময় ধ্বংসের ভবিষ্যদ্বাণী করেন।
করি। তা ট্রানটর কীরকম মনে হচ্ছে তোমার কাছে?
সবাই দেখছি ট্র্যানটর সম্পর্কে তার মত জানতে চাইছে, ভাবল গাল। অসাধারণ, স্রেফ এই শব্দটা ছাড়া বলার আর কিছু পেল না সে।
চিন্তা না করেই বললে কথাটা। সাইকোহিস্ট্রির কী হল?
এক্ষেত্রে এটা প্রয়োগ করার কথা ভাবিনি আমি।
এখন থেকে সব সমস্যায় সাইকোহিস্ট্রি প্রয়োগ করা শিখতে হবে তোমাকে; স্বাভাবিক নিয়মেই। খেয়াল কর- বলেই বেল্টের পাউচ থেকে তার ক্যালকুলেটর প্যাডটা বের করলেন ড. হ্যারি সেলডন। লোকে বলে, তার বালিশের নিচেও নাকি সবসময় একটা ক্যালকুলেটর থাকে, ঘুমিয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত ব্যবহারের জন্য। এটার পালিশ অতি ব্যবহারে নষ্ট হয়ে গেছে খানিকটা। বয়সের কারণে দাগ-পড়া সেলডনের আঙুলগুলো প্যাড ঘিরে থাকা শক্ত প্লাস্টিকের ওপর দ্রুত খেলে বেড়াল কিছুক্ষণ। ছাই রঙ ভেদ করে লাল কিছু প্রতীক ফুটে উঠল।
সেলডন বলে উঠলেন, এটা এম্পায়ার-এর বর্তমান অবস্থা রিপ্রেজেন্ট করছে।
অপেক্ষা করছেন তিনি।
শেষে গাল বলল, নিশ্চয়ই এটা কমপ্লিট রিপ্রেজেন্টেশান নয়?
না, সম্পূর্ণ নয়, একমত প্রকাশ করলেন সেলডন। আমার কথা অন্ধের মতো মেনে নিচ্ছ না দেখে খুশি হলাম। এটা একটা আসন্ন মান যা প্রপোজিশান বা প্রতিজ্ঞাটিকে ডেমনস্ট্রেট করবে। কি, এটা তো মানো?
মানি, তবে ফাংশন অভ ডেরিভেশান সম্পর্কে আমার পরবর্তী ভেরিফিকেশান সাপেক্ষে। সাবধানে, সম্ভাব্য একটা ফাঁদ এড়িয়ে গেল গাল।
গুড, তাহলে এর সঙ্গে এই জিনিসগুলোর নোন প্রোবাবিলিটি যোগ দাও ইম্পেরিয়াল অ্যাসাসিনেশান, রাজপ্রতিনিধিদের বিদ্রোহ, অর্থনৈতিক মন্দাকালীন অবস্থার সমসাময়িক পুনরাবৃত্তি, প্ল্যানেটারি এক্সপ্লোরেশানের ক্রমহাসমান হার, …।
গড় গড় করে বলে চললেন তিনি। একেকটা আইটেম উচ্চারণ করছেন, সেই সঙ্গে নতুন নতুন প্রতীক প্রাণ পাচ্ছে তাঁর হাতের স্পর্শে, মিশে যাচ্ছে বেসিক ফাংশনের সঙ্গে; ফলে ক্রমাগত বাড়ছে এবং পরিবর্তিত হচ্ছে সেটা।
মাত্র একবার তাকে বাধা দিল গাল। আমি ওই সেট-ট্রান্সফর্মেশনের কোনো কার্যকারিতা দেখতে পাচ্ছি না।
আরো ধীরে ধীরে পুরোটা পুনরাবৃত্তি করলেন সেলডন।
গাল বলল, কিন্তু এটা তো করা হল একটা নিষিদ্ধ সোশিও অপারেশান-এর সাহায্যে।
গুড। তোমার মাথা দ্রুত কাজ করে; কিন্তু যথেষ্ট দ্রুত বলা যায় না একে। যাই হোক, এক্ষেত্রে এটা নিষিদ্ধ নয়। এবার এক্সপ্যানশন-এর সাহায্যে করছি, লক্ষ কর।
এ-পদ্ধতিটা সময় নিল আরো বেশি। এবং শেষে গাল বিনীত ভঙ্গিতে বলল, হ্যাঁ, এবার বুঝতে পারছি।
অবশেষে থামলেন সেলডন। বললেন, এটা হচ্ছে আজ থেকে পাঁচশো বছর পরের ট্রানটর। কীভাবে ব্যাখ্যা করবে তুমি এটাকে, হ্যাঁ? মাথাটা একপাশে কাত করে গালের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে রইলেন তিনি।
অবিশ্বাসের সুরে গাল বলে উঠল, টোটাল ডেস্ট্রাকশন! কিন্তু-কিন্তু এটা তো অসম্ভব। ট্র্যানটর কখোনোই-
ছেলেমানুষের মত ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়লেন সেলডন। আহহা, তুমি তো দেখলেই কী করে এই রেজাল্টটা পেলাম। ভাষায় রূপ দাও একে। সিম্বলিজমের কথা ভুলে যাও কিছুক্ষণের জন্য।
গাল একটা ঢোক গিলে বলল, ট্র্যানটর যতই স্পেশ্যালইজড় হচ্ছে ততই এটা দুর্বল হয়ে পড়ছে, ততই নিজেকে রক্ষা করতে অক্ষম হয়ে পড়ছে। তাছাড়া গ্রহটা যত বেশি এম্পায়ার-এর প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠছে, ততই আরো বড় টোপে পরিণত হচ্ছে। ইম্পেরিয়াল সাকসেশান যতই অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে এবং সেই সঙ্গে বড় বড় পরিবারগুলোর ভেতর দ্বন্দ্ব যতই বাড়ছে, সামাজিক দায়িত্ববোধ ততই শূন্যের কোঠায় নেমে যাচ্ছে।
যথেষ্ট হয়েছে। এবার বল, পাঁচশো বছরের মধ্যে ট্রানটরের পুরোপুরি ধ্বংস হওয়ার সংখ্যাগত সম্ভাবনা, মানে নিউমেরিকাল প্রোবাবিলিটি কত?
বলতে পারব না।
তুমি নিশ্চয়ই ফীল্ড-ডিফারেন্টেশান করতে পার?
চাপের মুখে পড়ল গাল। ক্যালকুলেটর প্যাডটা দেয়া হয়নি তাকে। ওর চোখ থেকে মাত্র এক ফুট দূরে রয়েছে যন্ত্রটা। গভীর মনোযোগ দিয়ে হিসাব করতে শুরু করল সে। খানিক পরই অনুভব করল কপালে ঘাম দেখা দিয়েছে ওর।
শেষে ও বলল, অ্যাবাউট এইটি ফাইভ পারসেন্ট?
মন্দ না, নিচের ঠোঁটটা বাইরের দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন ড. সেলডন, তবে ভালো-ও না। আসল ফিগার হচ্ছে নাইনটি টু পয়েন্ট ফাইভ পারসেন্ট।
গাল বলল, এ-জন্যেই তাহলে আপনাকে অপয়া সেলডন বলা হয়? জার্নালগুলোয় তো এসব কিছুই নজরে পড়েনি আমার।
না পড়ারই তো কথা। দিস ইজ আনপ্রিন্টেবল। তুমি কি মনে কর এসব ছেপে ইম্পেরিয়াম তার দুর্বলতা ফাঁস করে দেবে? এটা তো সাইকোহিস্ট্রির খুব সামান্য একটা ডেমনস্ট্রেশান। তবে আমাদের কিছু কিছু রেজাল্ট অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে ফাঁস হয়ে গেছে।
তাই নাকি? তাহলে তো মুশকিল!
অতো ঘাবড়ানোর কিছু নেই। সব দিকেই নজর দেয়া হয়েছে।
কিন্তু এর জন্যই কি আমাকে চোখে চোখে রাখা হচ্ছে?
হ্যাঁ। আমার প্রজেক্টের সমস্ত কিছুই চোখে চোখে রাখা হচ্ছে।
আপনি কি বিপদের মধ্যে আছেন, স্যার?
তা তো বটেই। আমাকে মেরে ফেলার এক দশমিক সাত ভাগ সম্ভাবনা আছে। তাতে অবশ্যি প্রজেক্টটা বন্ধ হবে না। এ-কথাটাও ভেবে রেখেছি আমরা। যাকগে, এ নিয়ে ভেবো না। আগামীকাল ইউনিভার্সিটিতে আসছ নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে দেখা করতে।
হ্যাঁ, স্যার, জবাব দিল গাল।
.
পাঁচ
কমিশন অভ পাবলিক সেইফটি-…এনটান বংশের শেষ সম্রাট প্রথম ক্লিয়ন আততায়ীর হাতে নিহত হবার পর ক্ষমতায় আসে অভিজাত শ্রেণী। ইম্পেরিয়ামের কয়েক শতাব্দীব্যাপী অস্থিরতা এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে তারা নিয়ম-শৃঙ্খলার মোটামুটি একটা আবহাওয়া সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়। তবে মুখ্যত দুই প্রধান পরিবার শেন এবং ডিভার্ট-এর নিয়ন্ত্রণাধীন এই শ্ৰেণীটি অবশেষে তকালীন সামাজিক পরিস্থিতি রক্ষণাবেক্ষণের আজ্ঞাবাহী যন্ত্রে পরিণত হয়। …রাজ্যের একটি শক্তি হিসেবে তারা সুসম্পূর্ণভাবে অপসারিত হয় শেষ প্রতাপশালী সম্রাট দ্বিতীয় ক্লিয়ন ক্ষমতা গ্রহণের পর। প্রথম চীফ কমিশনার…
… এক হিসেবে কমিশনের পতন সূচিত হয় ফাউণ্ডেশন এরা শুরু হবার দুবছর আগে, হ্যারি সেলডনের বিচারের মধ্য দিয়ে। গাল ডরনিকের লেখা হ্যারি সেলডনের জীবনীতে বিচারটির বর্ণনা আছে।…
-ইনসাইক্লোপীডিয়া গ্যালাকটিকা
.
প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি গাল।
একটি বাজার ওর ঘুম ভাঙায় পরদিন সকালে। গাল সাড়া দিতেই খুব শান্ত, ভদ্র এবং স্বাভাবিক কণ্ঠে ডেস্ক-ক্লার্ক জানায়, কমিশন অভ পাবলিক সেইফটি-র নির্দেশক্রমে ডিটেনশনের আওতায় রয়েছে সে।
তড়াক করে বিছানা ছেড়ে দরজার দিকে ছুটে গেল ও। না, খোলা গেল না দরজাটা। এখন কাপড়-চোপড় পরে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তার।
ওরা এসে অন্য জায়গায় নিয়ে গেল গালকে। তবে তাতে ওর অবস্থার হেরফের হল না কোনো; কারণ, ডিটেনশনেই রইল সে ওখানেও। যারপরনাই ভদ্রতার সঙ্গে ওকে জেরা করা হল। পুরো ব্যাপারটাই ছিল খুব মার্জিত। গাল ওদের জানাল, সে সিন্যাক্স প্রদেশবাসী, এই এই স্কুলে বিদ্যা অর্জন করেছে, অমুক তারিখে ডক্টর অভ ম্যাথেমেটিক্স ডিগ্রী অর্জন করেছে, ড. সেলডনের স্টাফের পদের জন্যে আবেদন করেছে এবং সে-আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। বার বার ওকে এই কথাগুলো বলতে হল এবং বার বার ওরা সেলডন প্রজেক্টে ওর যোগ দেয়ার প্রসঙ্গে ফিরে এল। কীভাবে প্রজেক্টটার কথা শুনল সে? তার কাজ কী হবে সেখানে? কী কী গোপন ইন্সট্রাকশন পেয়েছে? প্রজেক্টটা কী সম্পর্কিত?
গাল সাফ জবাব দিল, সে জানে না। কোনো গোপন ইনস্ট্রাকশন সে পায়নি, সে একজন স্কলার এবং গণিতবিদ। রাজনীতির ব্যাপারে তার কোনো উৎসাহ নেই।
অবশেষে অমায়িক প্রশ্নকর্তা জিগ্যেস করল, ট্রানটর কবে নাগাদ ধ্বংস হচ্ছে?
থতমত খেয়ে গেল গাল। আমার নিজস্ব ধারণা থেকে এ-ব্যাপারে কিছু বলতে পারব না।
অন্য কারো ধারণা থেকে পারবেন?
অন্যেরটা কী করে বলব? উত্তেজিত বোধ করল গাল ভীষণ। প্রশ্নকর্তা জিগ্যেস করল, কেউ কি আপনাকে এ-ধরনের কোনো ধ্বংসের কথা বলেছে? বা কোনো তারিখ দিয়েছে?
গাল ইতস্তত করছে দেখে লোকটা যোগ করল ডক্টর, আপনাকে কিন্তু আগাগোড়া চোখে চোখে রাখা হয়েছে। আপনি যখন পৌঁছান আমরা তখন এয়ারপোর্টে ছিলাম। অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য অপেক্ষা করছিলেন যখন, তখন অবজার্ভেশান টাওয়ারে ছিলাম। আর আড়িপেতে ড. সেলডনের সঙ্গে আপনার কথাবার্তাও শুনে ফেলেছি আমরা।
গাল একটু অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল, তাহলে তো তিনি এ-ব্যাপারে কী ভাবছেন সেটা আপনারা জানেন-ই।
হয়ত জানি। তবে সেগুলো আমরা আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই।
তিনি বলছেন পাঁচ শতাব্দীর মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাবে ট্র্যানটর।
তিনি কি এটা- মানে, গাণিতিকভাবে প্রমাণ করেছেন?
হ্যাঁ, অসহিষ্ণু সুরে বলল গাল।
আপনি নিশ্চয়ই বিশেষ এই গণিতবিদ্যাকে কার্যকর বলে মনে করছেন?
ড. যদি বলে থাকেন তাহলে সেটা অবশ্যই কার্যকর।
সেক্ষেত্রে আমরা এখন ফিরব।
দাঁড়ান। একজন লইয়ার পাওয়ার অধিকার আছে আমার। একজন ইম্পেরিয়াল সিটিজেন হিসেবে আমি আমার অধিকার দাবি করছি।
পাবেন।
এবং সত্যিই পেল সে।
দীর্ঘদেহী এক লোক ঘরে ঢুকল একসময়। তার মুখটা যেন কতকগুলো উল্লম্ব রেখা দিয়ে তৈরি। তাছাড়া মুখটা এতই সরু যে, ওখানে একটা হাসির জায়গা হয় কিনা সন্দেহ জাগে।
গাল মুখ তুলে তাকাল। বিধ্বস্ত আর বিপর্যস্ত বোধ করছে সে। ট্র্যানটরে পা দিয়েছে তিরিশ ঘন্টাও হয়নি, অথচ এরি মধ্যে কতকিছু ঘটে গেল!
লোকটি বলল, আমি লর্স অ্যাভাকিম, আপনার প্রতিনিধিত্ব করার জন্যে ড. সেলডন পাঠিয়েছেন আমাকে।
তাই? তাহলে শুনুন, এক্ষুনি আমি সম্রাটের কাছে আপীল করতে চাই। কোনো কারণ ছাড়াই এখানে ধরে রাখা হয়েছে আমাকে। আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ; সম্পূর্ণ। সজোরে বাঁ হাতের চেটোয় মুষ্টিবদ্ধ ডান হাতের একটা ঘুষি বসাল গাল। এই মুহূর্তে সম্রাটের সামনে একটা শুনানির ব্যবস্থা করতে হবে আপনাকে।
মন দিয়ে একটা চ্যাপ্টা ফোল্ডারের ভেতর থেকে জিনিসপত্র বের করে মেঝেতে রাখছিলেন অ্যাভাকিম। উত্তেজিত বলে খেয়াল করল না গাল, নইলে সে ধাতব চিকন, টেপ মতন দেখতে সেলোমেট লিগ্যাল ফর্মগুলো চিনতে পারতো- একটা পার্সোনাল ক্যাপসুলের মতো ছোট জিনিসেও পুরে রাখার উপযোগী সেসব। এমনকি চিনতে পারতো পকেট রেকর্ডারটাও।
ফেটে পড়া গালের দিকে নজর না দিয়ে নিজের কাজ সারলেন অ্যাভাকিম। শেষে মুখ তুলে তাকিয়ে বললেন, আমি নিশ্চিত, আমাদের কথাবার্তা শোনার জন্য স্পাই-বীম ধরে আছে কমিশন। কাজটা আইনবহির্ভূত ঠিকই, কিন্তু ওরা করবেই।
দাঁতে দাঁত ঘষল গাল।
সে যাই হোক, ধীরেসুস্থে একটা চেয়ারে বসে অ্যাভাকিম বললেন, টেবিলের ওপর যে রেকর্ডারটা রেখেছি, দেখতে সেটা একেবারে সাধারণ মনে হলেও কাজ ভালই করে। আর সেই সঙ্গে স্পাই-বীমও অকেজো করে দেয় একেবারে। হঠাৎ করে জিনিসটা খুঁজে পাবে না ওরা।
তাহলে তো আমি কথা বলতে পারি।
অবশ্যই।
দেন আই ওয়ান্ট আ হিয়ারিং উইদ দি এম্পেরর।
বরফশীতল একটা হাসি দেখা দিল অ্যাভাকিমের ঠোঁটে। কোনোমতে একটা হাসি যে চিকন মুখটাতে এঁটে যায়, সে-সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়া গেল এতক্ষণে। হাসির জায়গা করে দিতে গাল দুটো কুঁচকে গেল তাঁর।
বললেন, আপনি প্রদেশ থেকে এসেছেন।
তাতে কী? আপনার মতো, কিংবা এই কমিশন অভ পাবলিক সেইফটি-র যে কারো মতো আমিও একজন ইম্পেরিয়াল সিটিজেন।
তা তো বটেই, তা তো বটেই। আমি শুধু বলতে চাইছি একজন প্রাদেশিক বাসিন্দা হিসেবে আপনি ট্রানটরের জীবন-ব্যবস্থাটা বুঝতে পারছেন না। সম্রাটের সামনে এখানে কোনো শুনানি হয় না।
তাহলে এই কমিশনের বিরুদ্ধে লোকে কার কাছে আপীল করবে? অন্য কোনো নিয়ম-কানুন নেই?
না। সত্যিকার অর্থে, সাহায্যের কোনো পথ নেই। ম্রাটের কাছে আপনি আপীল করতে পারেন; কিন্তু কোনো হিয়ারিং পাবেন না। এখনকার সম্রাট এনটান রাজবংশের কোনো সম্রাট নন, জানেনই তো। ট্রানটর এখন অভিজাত পরিবারগুলোর হাতের মুঠোয়, আর কমিশন অভ পাবলিক সেইফটি এই পরিবারগুলোর সদস্যদের নিয়েই তৈরি। এ-রকম যে হবে এটাও সাইকোহিস্ট্রিতে খুব ভালভাবেই বলা আছে।
বটে! সেক্ষেত্রে, ড. সেলডন যদি ট্রানটরের আগামী পাঁচশো বছরের ইতিহাস সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন
তিনি আগামী পনেরোশো বছরের ইতিহাস সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন।
পনেরো হাজার হোক গে। কিন্তু মাত্র গতকাল কেন তিনি আজ সকালের ঘটনা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে আমাকে সতর্ক করে দিতে পারলেন না? নো, আই অ্যাম সরি। বেশ বুঝতে পারছি সাইকোহিস্ট্রি স্রেফ একটা স্ট্যাটিসটিক্যাল সায়েন্স; মাত্র একজন লোক সম্পর্কে এটা নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে না। বুঝতেই পারছেন, ভীষণ হতাশ হয়ে পড়েছি আমি।
কিন্তু আপনি ভুল করছেন। ড. সেলডন কিন্তু নিশ্চিত ছিলেন, আজ সকালে আপনি গ্রেফতার হবেন।
কী! ব্যাপারটা দুর্ভাগ্যজনক, কিন্তু সত্যি। কমিশন তাঁর কার্যকলাপের ব্যাপারে দিন দিন ভীষণ শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠছে। নতুন যারা দলে যোগ দিচ্ছে, তাদের হয়রানির ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। গ্রাফগুলো দেখিয়েছে, ব্যাপারটা এ-মুহূর্তে চূড়ান্ত পৌঁছুনো দরকার। কমিশনের লোকেরা সম্প্রতি একটু ঢিল দিয়েছিল এ-ব্যাপারে। তাই ওরা যাতে আরো সক্রিয় হয়ে ওঠে, সেজন্য গতকাল ড. সেলডন নিজেই দেখা করেছিলেন আপনার সঙ্গে। অন্য কোনো কারণ ছিল না।
দম বন্ধ হয়ে এল গালের। আমি অপমানিত বোধ করছি–
প্লীজ, মাঝ পথে গালকে থামিয়ে দিলেন অ্যাভকিম। এর দরকার ছিল না। আপনাকে কোনো ব্যক্তিগত কারণে ধরে আনা হয়নি। আপনাকে বুঝতে হবে যে, আঠারো বছরেরও বেশি সময়ের ডেভলপড় ম্যাথমেটিক্স-এর ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা উ. সেলডনের প্ল্যান সব ধরনের পরিণতির কথাই গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনা হিসেবে বিবেচনা করে। এটা তারই একটা। আমি এখানে আর কোনো উদ্দেশ্যে আসিনি, এসেছি শুধু আপনাকে এ-ব্যাপারে নিশ্চিত করতে যে, ভয়ের কোনো কারণ নেই আপনার। কথায় বলে, শেষ ভাল যার সব ভালো তার। এটার শেষটাও ভালভাবেই হবে; প্রজেক্টের ক্ষেত্রে তো সেকথা প্রায় নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়, আপনার বেলাতেও সে-সম্ভাবনা অনেকখানি।
ফিগার দুটো কত?
প্রজেক্টের বেলায়, ওভার নাইনটি নাইন পয়েন্ট নাইন পারসেন্ট।
আর আমার বেলায়?
আমাকে বলা হয়েছে, আপনার ক্ষেত্রে সম্ভাবনাটা সেভেনটি সেভেন পয়েন্ট টু পারসেন্ট।
তাহলে তো দেখছি পাঁচ ভাগের মধ্যে এক ভাগ সম্ভাবনা আছে আমার জেল বা মৃত্যুদণ্ড হবার।
শেষেরটার সম্ভাবনা শতকরা এক ভাগ।
বটে। একজনকে নিয়ে হিসেবের কোনো অর্থ নেই। আপনি ড. সেলডনকে পাঠিয়ে দিন আমার কাছে।
দুর্ভাগ্যবশত তা করতে পারছি না। ড. সেলডন নিজেই গ্রেফতার হয়েছেন।
গাল বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠার আগেই দড়াম করে খুলে গেল দরজাটা।
ভেতরে ঢুকল একজন গার্ড। সোজা চলে এল টেবিলটার কাছে। ছোঁ মেরে তুলে নিল রেকর্ডারটা। দেখল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। তারপর চালান করে দিল পকেটে।
শান্তভাবে অ্যাভকিম শুধু বললেন, যন্ত্রটা আমার দরকার।
আমরা আপনাকে এমন একটা দেব যেটা স্ট্যাটিক ফীল্ড ছড়ায় না, কাউন্সেলর।
সেক্ষেত্রে আমার ইন্টারভিউ এখানেই শেষ।
গাল দেখল, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি ওকে একা রেখে।
.
ছয়
বিচারটি শেষ হতে সময় তেমন লাগল না (গালের পড়া বিচারের যাবতীয় খুঁটিনাটি প্রণালীর সঙ্গে আইনগতভাবে তেমন কোনো সাদৃশ্য না থাকলেও সে এটাকে একটা বিচার হিসেবেই ধরে নিল)। আজ তৃতীয় দিন, অথচ পেছনে ফিরে প্রথম দিনের কথাও ভালো করে মনে করতে পারল না গাল।
ওকে তেমন বিরক্ত করা হয়নি। ভারি অস্ত্রগুলো সব ড. সেলডনের দিকেই তাক করা ছিল। হ্যারি সেলডন অবশ্যি নির্লিপ্তভাবে বসেছিলেন। গালের কাছে মনে হল, সারা বিশ্বে তিনিই একমাত্র স্থিরতার প্রতীক। দর্শকের সংখ্যা অল্প। বেছে বেছে কেবল এম্পায়ার-এর ব্যারনদেরই ঢুকতে দেয়া হয়েছে। ড. সেলডনের বিচার হচ্ছে এ-খবরটা বাইরের তেমন কেউ জানে কিনা সন্দেহ। বিচারের রকম-সকমে বিবাদিপক্ষের প্রতি একটা বৈরীতার গোড়া থেকেই বেশ নগ্নভাবে ফুটে রয়েছে।
চউঁচু একটা ডেস্কের পেছনে বসে আছেন কমিশন অভ পাবলিক সেইফটির পাঁচ সদস্য। পরনে লাল এবং সোনালি রঙের ইউনিফর্ম; মাথায় আঁটোসাঁটো, চকচকে, প্লাস্টিকের টুপি- তাদের বিচার সংক্রান্ত দায়িত্বের প্রতীক। মাঝখানে বসে আছেন চীফ কমিশনার লিঞ্জ শেন। এত বড় একজন লর্ড আগে কখনো সামনা-সামনি দেখেনি গাল। চোখে একটা মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল সে। বিচার চলাকালীন দুচারটের বেশি শব্দ উচ্চারণ করেননি শেন। বেশি কথা বলাটাকে যে তিনি অসম্মানজনক বলে মনে করেন, সেটা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছেন ভদ্রলোক।
কমিশনের অ্যাডভোকেট তার কাগজপত্র দেখে নিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো সেলডনকে জেরা করতে শুরু করলেন :
প্রঃ আচ্ছা ড. সেলডন, আপনি যে-প্রজেক্টের প্রধান তাতে কতজন লোক নিয়োজিত আছে?
উঃ পঞ্চাশ জন গণিতবিদ।
প্রঃ ড. গাল ডরনিককে ধরে?
উঃ গাল ডরনিক একান্নতম।
প্রঃ ও আচ্ছা, তাহলে একান্নজনকে পাচ্ছি আমরা। স্মৃতি ঘেঁটে দেখুন, ড. সেলডন, বায়ান্ন বা তিপ্পান্ন জনও থাকতে পারে। কিংবা তার চেয়ে বেশি?
উঃ ড. ডরনিক এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে আমার প্রতিষ্ঠানে যোগ দেননি। দিলে দস্য সংখ্যা একান্নতে দাঁড়াবে। এখন সেটা আগে যা বলেছি তাই। অর্থাৎ পঞ্চাশ।
প্রঃ এক লাখ সম্ভবত হবে না, তাই না?
উঃ কী, গণিতবিদ? না।
প্রঃ আমি গণিতবিদ বলিনি। সব মিলিয়ে এক লাখ হবে?
উঃ সব মিলিয়ে আপনার সংখ্যাটি ঠিক হতে পারে।
প্রঃ হতে পারে? কিন্তু আমি বলছি তাই। আমি বলছি আপনার প্রজেক্টে লোক সংখ্যা আটানব্বই হাজার পাঁচশো বাহাত্তর জন।
উঃ আমার ধারণা, আপনি মহিলা এবং বাচ্চাদেরও ধরছেন হিসেবের মধ্যে।
প্রঃ (উচ্চ কণ্ঠে) আমি বোঝাতে চেয়েছি আটানব্বই হাজার পাঁচশো বাহাত্তর জন ব্যক্তি। কথা ঘোরাবার কোনো প্রয়োজন নেই।
উঃ আমি সংখ্যাটা মেনে নিচ্ছি।
প্রঃ (নোট দেখে) এ-ব্যাপারটা আপাতত মূলতবি থাক। এবার বরং অন্য একটা বিষয় নিয়ে আলাপ করা যাক। অবশ্যি এ নিয়ে আগে খানিকটা আলাপ করেছি। আপনি কি ট্র্যানটরের ভবিষ্যতের ব্যাপারে আপনার ধারণাটা আবার বলবেন একটু?
উঃ আমি আগেও বলেছি, আবারও বলছি, আগামী পাঁচ শতাব্দীর মধ্যে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে ট্রানটর।
প্রঃ আপনার কি মনে হচ্ছে না আপনি রাজদ্রোহীর মতো কথা বলছেন?
উঃ মোটেই না। বিজ্ঞানলব্ধ সত্য এসবের উর্ধ্বে।
প্রঃ আপনি কি নিশ্চিত আপনার বক্তব্যটি একটি বিজ্ঞানসম্মত সত্য?
উঃ আমি নিশ্চিত।
প্রঃ কীসের ভিত্তিতে?
উঃ ম্যাথমেটিক্স অভ সাইকোহিস্টির ভিত্তিতে।
প্রঃ আপনি কি প্রমাণ করতে পারবেন যে এই ম্যাথমেটিক্স সিদ্ধ?
উঃ কেবল আরেকজন ম্যাথমেটিশিয়ানের কাছে।
প্রঃ (হেসে) অর্থাৎ আপনি দাবি করছেন আপনার সত্যটি এতোই উচ্চমাগীয় যে, সেটি সাধারণ লোক বুঝতে পারবে না। আমার তো মনে হয়, সত্য হওয়া উচিত আরো পরিষ্কার, আরো কম রহস্যপূর্ণ এবং মানুষের আরো কাছাকাছি।
উঃ কারো কাছেই এটি দুর্বোধ্য নয়। আমরা যাকে থার্মোডাইনামিক্স বলি, সেই শক্তি রূপান্তরের পদার্থবিদ্যা পৌরাণিক যুগ থেকেই সবার কাছে পরিষ্কার এবং সত্য। কিন্তু তারপরেও অনেক অনেক লোকই হয়ত রয়েছে যারা একটা পাওয়ার এঞ্জিনের ডিজাইন তৈরি করতে পারবে না। এমনকি উচ্চমেধাসম্পন্ন লোকও নয়। আমার সন্দেহ, বিদগ্ধ কমিশনারগণ—
এই সময় একজন কমিশনার অ্যাডভোকেটের দিকে ঝুঁকে কী যেন বললেন, বোঝা গেল না। তবে তাঁর কণ্ঠের হিসহিস শব্দে একটা কর্কশ ভাব ছিল। অ্যাডভোকেট লাল হয়ে উঠলেন একটু। সেলডনকে থামিয়ে দিলেন তিনি মাঝ পথে।
প্রঃ আমরা এখানে বক্তৃতা শুনতে আসিনি ড. সেলডন। আমরা ধরে নিচ্ছি, আপনি আপনার বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। সেক্ষেত্রে আমি বলছি, আপনার ধ্বংসের ভবিষ্যদ্বাণী সম্ভবত একান্তই আপনার স্বার্থসিদ্ধির জন্য ইম্পেরিয়াল গভর্নমেন্ট সম্পর্কে জনগণের নষ্ট করার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে।
উঃ না, তা নয়।
প্রঃ আমি বলছি, আপনি দাবি করছেন যে ট্রানটর-এর তথাকথিত ধ্বংসের পূর্ববর্তী একটি নির্দিষ্ট সময় বিভিন্ন ধরনের অস্থিরতায় পরিপূর্ণ থাকবে।
উঃ হ্যাঁ, তা ঠিক।
প্রঃ এবং স্রেফ ভবিষ্যদ্বাণীর মাধ্যমেই আপনি ঐ অস্থিরতা ডেকে আনতে চান এবং তখন এক লাখ লোকের একটা সামরিক বাহিনী নামাতে চান।
উঃ প্রথম কথা হচ্ছে, এটা সত্যি নয়। আর সত্যি যদি হয়ও, তদন্ত করলে দেখা যাবে, সাকুল্যে দশ হাজার লোকও মিলিটারি এইজ-এর নয়। এবং এদের কারোরই অস্ত্র সম্পর্কে কোনো প্রশিক্ষণ নেই।
প্রঃ আপনি কি কারও এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন?
উঃ মি. অ্যাডভোকেট, কেউ এ-কাজে নিযুক্ত করেনি আমাকে।
প্রঃ আপনি কি সম্পূর্ণ স্বার্থশূন্যভাবে কাজ করছেন? আপনি কি বিজ্ঞানের সেবা করছেন?
উঃ করছি।
প্রঃ তাহলে দেখা যাক, কীভাবে। ড. সেলডন, ভবিষ্যৎ কি পরিবর্তন করা যায়?
উঃ অবশ্যই। আগামী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এই আদালত কক্ষ বিস্ফোরিত হতে পারে আবার না-ও হতে পারে। যদি হয় তাহলে ভবিষ্যৎ কিছু ছোট ছোট ক্ষেত্রে অবশ্যই পরিবর্তিত হবে।
প্রঃ আপনি কথা ঘোরাচ্ছেন, ড. সেলডন। মানব জাতির সামগ্রিক ইতিহাস কি পরিবর্তন করা যায়?
উঃ যায়।
প্রঃ সহজেই?
উঃ না, অনেক সমস্যা মোকাবিলা করে তবেই।
প্রঃ কেন?
উঃ একটি গ্রহের জনগণের সাইকোহিস্টোরিক ট্রেণ্ডের মধ্যে এক বিরাট জড়তা আছে। পরিবর্তিত হওয়ার জন্য এই ট্রেণ্ডকে অবশ্যই সমজড়তাসম্পন্ন কোনো কিছুর সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। হয় সমানসংখ্যক জড়তা দরকার হবে, আর নয়ত, যদি জনগণের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হয়, বেশ দীর্ঘ একটি সময়ের প্রয়োজন হবে। বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই?
প্রঃ মনে হচ্ছে পারছি। যদি একটি বিশাল জনগোষ্ঠী ধ্বংসের বিপক্ষে কাজ করে তবে ট্রানটর ধ্বংস হবে না।
উঃ ঠিক।
প্রঃ এক লাখের মতো লোক?
উঃ নো, স্যার। এক লাখ খুবই কম।
প্রঃ আপনি নিশ্চিত?
উঃ ভেবে দেখুন, ট্রানটরের জনসংখ্যা চার হাজার কোটিরও ওপরে। আরো ভেবে দেখুন, এই ধ্বংসের প্রবণতাটা কেবল এই ট্র্যানটরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা গোটা এম্পায়ার জুড়েই বিরাজ করছে। এবং এই এম্পায়ার-এর জনসংখ্যা প্রায় এক কুইন্টিলিয়ন।
প্রঃ ও, আচ্ছা। এক লাখ লোক এবং তাদের বংশধরেরা যদি পাঁচশো বছর পরিশ্রম করে তাহলে সম্ভবত তারা এই প্রবণতাটির পরিবর্তন ঘটাতে পারবে, কি বলেন?
উঃ আমার মনে হয় না। পাঁচশো বছর খুবই কম সময়।
প্রঃ আচ্ছা। সেক্ষেত্রে, ড. সেলডন, আপনার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা পাচ্ছি যে, আপনার প্রজেক্টের আওতায় আপনি এক লাখ লোক সংগ্রহ করেছেন। পাঁচশো বছরের মধ্যে ট্রানটরের ইতিহাস পরিবর্তন করার জন্যে সংখ্যাটা অপ্রতুল। অন্য কথায় বলতে গেলে, তারা যত যা-ই করুক না কেন, ট্রানটরের ধ্বংস রোধ করতে পারবে না।
উঃ দুর্ভাগ্যবশত, আপনি ঠিকই বলেছেন।
প্রঃ এবং অন্যদিকে, আপনার এই এক লাখ লোকের কোনো বেআইনী উদ্দেশ্য নেই।
উঃ ঠিক বলেছেন।
প্রঃ (ধীরে ধীরে এবং স্বস্তির সঙ্গে) সেক্ষেত্রে, ড. সেলডন- খুব মন দিয়ে শুনুন, কারণ আমরা একটি সুচিন্তিত জবাব চাইছি- আপনার এই এক লাখ লোকের উদ্দেশ্য কী?
শেষের দিকে অ্যাডভোকেটের কণ্ঠ তীক্ষ্ণ এবং কর্কশ হয়ে উঠল। ফাঁদে ফেলে সেলডনকে কোণঠাসা করে ফেলেছেন তিনি। কৌশলে তিনি তাকে এমন জায়গায় ঠেলে নিয়ে গেছেন যে ড. সেলডনের মুখ থেকে কোনো উত্তর বের হবার সম্ভাবনা নেই। মৃদু গুঞ্জন উঠল সারা আদালত কক্ষে। দর্শকদের সারি থেকে সেটা এমনকি কমিশনারদের সারিতেও ছড়াল। লাল-সোনালি পোশাক পরিহিত কমিশনাররা একজন আরেকজনের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। শুধু চীফ কমিশনারের মুখে কোনো চাঞ্চল্য লক্ষ করা গেল না। স্থির হয়ে বসে আছেন তিনি একদম।
বিচলিত হননি আরেকজন। তিনি হ্যারি সেলডন। গুঞ্জনটা মিলিয়ে যাবার অপেক্ষা করছেন তিনি।
উঃ সেই ধ্বংসের এফেক্টগুলো কমিয়ে আনা।
প্রঃ ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন?
উঃ ব্যাখ্যাটা খুব সরল। ট্রানটরের আসন্ন ধ্বংসটা কিন্তু নিজে কোনো ঘটনা নয়, মানব উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় একটি বিচ্ছিন্ন ব্যাপার মাত্র। একে আপনি বহু শতাব্দী আগে শুরু হওয়া একটা জটিল নাটকের ক্লাইম্যাক্স বলতে পারেন। আর নাটকটা অনবরত খুব দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। জেন্টেলমেন, আমি আসলে গ্যালাকটিক এম্পায়ারের ক্রমবর্ধমান ক্ষয় এবং পতনের কথা বলতে চাইছি।
গুঞ্জনটা এবার ভোঁতা গর্জনে পরিণত হলো। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে চেঁচিয়ে উঠলেন অ্যাডভোকেট, আপনি খোলাখুলিভাবে ঘোষণা করছেন যে-। তারপরই থেমে গেলেন। কারণ তখনই দর্শকদের সম্মিলিত রাজদ্রোহ শব্দটা বুঝিয়ে দিল যে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবার প্রয়োজন হয়নি, তারা সবাই ড. সেলডনের বক্তব্যের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন।
চীফ কমিশনার তাঁর হাতুড়িটা আস্তে করে উঠিয়ে ছেড়ে দিলেন। মিষ্টি, নরম ঘণ্টধ্বনির মতো শব্দ উঠল। সেটার প্রতিধ্বনি থিতিয়ে আসতে দর্শকদের কথাও থেমে গেল। লম্বা করে একটা শ্বাস নিলেন অ্যাডভোকেট।
প্রঃ (নাটকীয় সুরে) ড. সেলডন, আপনি কি উপলব্ধি করতে পারছেন যে আপনি এমন একটি এম্পায়ার সম্পর্কে মন্তব্য করছেন যা বিভিন্ন প্রজন্মের নানান উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে বারো হাজার বছর ধরে টিকে আছে এবং যার পেছনে রয়েছে এক কোয়াড্রিলিয়ন লোকের ভালবাসা এবং শুভেচ্ছা?
উঃ এম্পায়ার-এর বর্তমান অবস্থা এবং অতীত ইতিহাস- দুটো সম্পর্কেই আমি সচেতন। কোনোরকম অশ্রদ্ধা প্রদর্শন না করেই বলছি, এ ঘরে উপস্থিত যে-কারোর চেয়ে ভাল ধারণা রয়েছে আমার এই এম্পায়ার সম্পর্কে।
প্রঃ এবং তারপরেও আপনি এর ধ্বংসের কথা বলছেন?
উঃ কথাটা বলা হয়েছে ম্যাথমেটিক্সের সাহায্যে। আমি কোনো নৈতিক বিচারের দিকে যাচ্ছি না। ব্যক্তিগতভাবে আমি এই পরিণতির জন্যে দুঃখবোধ করি। যদি ধরেও নিই যে এম্পায়ার একটা খারাপ জিনিস (আমি অবশ্য তা বলছি না) তাহলেও, এর পতনের পর যে নৈরাজ্য দেখা দেবে সেটা হবে আরো খারাপ। আর এই অরাজক পরিস্থিতি মোকাবিলা করারই অঙ্গীকার করছে আমার প্রজেক্ট। এম্পায়ারের পতন একটি বিশাল ব্যাপার। এবং সেটাকে আর যাই হোক সহজে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। উঠতি আমলাতন্ত্র, পশ্চাৎগামী উদ্যোগ, ঔৎসুক্যের অবদমন- এরকম একশোটা ফ্যাক্টর আছে এর পেছনে। পতনের প্রক্রিয়াটা চলছে, আমি আগেই বলেছি, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। এবং এটা এতই বিশাল আর রাজকীয় একটি গতি যে, একে থামান সম্ভব নয়।
প্রঃ এম্পায়ার যে আগের মতোই শক্তিশালী রয়েছে এখনো কি সেটা সবার কাছে স্পষ্ট নয়?
উঃ শক্তির একটা বাহ্যিক রূপ আপনার চারপাশে বিরাজ করছে। মনে হচ্ছে যেন চিরকালই এই অবস্থা বজায় থাকবে। কিন্তু মি. অ্যাডভোকেট, ঝড়ে দু টুকরো হওয়ার আগের মুহূর্তেও কিন্তু পচা একটা গাছের গুঁড়িকে বরাবরের মতো শক্তিশালী এবং অক্ষতই দেখায়। ঠিক এই মুহূর্তেও এম্পায়ার-এর ডালপালার ভেতর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে চলেছে। সাইকোহিস্ট্রির কান দিয়ে শুনুন, আপনিও ভাঙনের শব্দ শুনতে পাবেন।
প্রঃ (দ্বিধাগ্রস্তভাবে) ড. সেলডন, আমরা এখানে বক্–
উঃ (দৃঢ়তার সঙ্গে) এম্পায়ার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, সেই সঙ্গে নিশ্চিহ্ন হবে এর যত ভাল জিনিস। এর পুঞ্জীভূত জ্ঞান ধ্বংস হয়ে যাবে। যে শৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল, তা-ও নষ্ট হয়ে যাবে। আন্তঃনাক্ষত্রিক যুদ্ধ চলবে অনন্তকাল ধরে। ধসে পড়বে আন্তঃনাক্ষত্রিক বাণিজ্য। জনসংখ্যা কমে যাবে। গ্যালাক্সির মূল অংশের সঙ্গে গ্রহগুলোর যোগাযোগ নষ্ট হয়ে যাবে- সব মিলিয়ে পরিস্থিতিটা দাঁড়াবে ঠিক এ-রকম।
প্রঃ (অখণ্ড নীরবতার মধ্যে একটা মৃদু কণ্ঠ) চিরকালের জন্য?
উঃ সাইকোহিস্ট্রি শুধু এই পতন সম্পর্কেই নয়, পতন পরবর্তী অন্ধকার যুগ সম্পর্কেও ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম। জেন্টেলমেন, কিছুক্ষণ আগেই বলা হয়েছে এই এম্পায়ার বারো হাজার বছর ধরে টিকে আছে। আসন্ন অন্ধকার যুগটি বারো নয়, ত্রিশ হাজার বছর স্থায়ী হবে। একটি সেকেণ্ড এম্পায়ার এর উত্থান হবে ঠিকই, কিন্তু সেই দ্বিতীয় সাম্রাজ্য এবং আমাদের সভ্যতার মাঝখানে থাকবে এক হাজার প্রজন্মের দুঃখগ্রস্ত মানবগোষ্ঠী। একে রুখতেই হবে আমাদের।
প্রঃ (কিছুটা ধাতস্থ হয়ে) আপনি স্ববিরোধী কথা বলছেন। খানিক আগেই আপনি বলেছেন যে, ট্রানটর-এর ধ্বংস আপনি রুখতে পারবেন না; অতএব, সম্ভবত এম্পায়ার-এর তথাকথিত পতনটাও ঠেকাতে পারবেন না।
উঃ পতনটা আমরা ঠেকাতে পারব সেকথা আমি এখনো বলছি না। কিন্তু পতনের পর থেকে সেকেণ্ড এম্পায়ার গজিয়ে ওঠার মাঝখানে যে অরাজক পরিস্থিতির উদ্ভব হবে, তার মেয়াদটা কমিয়ে আনার সময় এখনো পেরিয়ে যায়নি, জেন্টেলমেন, অরাজক পরিস্থিতির মেয়াদ ত্রিশ হাজার বছর থেকে কমিয়ে এক হাজার বছরে নিয়ে আসা সম্ভব, যদি আমার দলটিকে কাজ করতে দেয়া হয়। আমরা ইতিহাসের একটি ক্রান্তিলগ্নে বাস করছি। ছুটন্ত বিশাল ঘটনাপুঞ্জকে সামান্য একটু সরিয়ে দিতে হবে এর পথ থেকে সামান্য একটু। এই সরাটা বেশি হবার উপায় নেই, তবে মানব ইতিহাস থেকে উনত্রিশ হাজার বছরের যন্ত্রণা উপশমের জন্য এটাই হয়ত যথেষ্ট।
প্রঃ কাজটা আপনি কীভাবে করতে চান?
উঃ জাতির জ্ঞানকে বাঁচিয়ে রেখে। মানবজ্ঞানের সমষ্টি একজন লোকের নাগালের বাইরে; এক হাজার লোকের ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমাদের সমাজ কাঠামো ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান ভেঙে লক্ষ লক্ষ টুকরো হয়ে যাবে। যা জানা দরকার তার অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দিকগুলোর অনেকটাই জানবে একজন লোক। অসহায় এবং অকেজো হয়ে পড়বে তারা নিজেদের দ্বারাই। অর্থহীন হয়ে পড়া খণ্ড খণ্ড জ্ঞান অগ্রসর হতে পারবে না। প্রজন্মের মধ্যেই হারিয়ে যাবে প্রজন্মের জ্ঞান। কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা যদি সব জ্ঞানের এক বিরাট সারাংশ তৈরি রাখি, তা কখনোই হারাবে না। আগামী প্রজন্ম গড়ে উঠবে এর ওপর ভিত্তি করেই এবং নতুন করে এসব জ্ঞান তাদের আবার আবিষ্কার করতে হবে না। এক সহস্রাব্দ ত্রিশ সহস্রাব্দের কাজ করবে।
প্রঃ এসব–
উঃ এই হচ্ছে আমার প্রজেক্ট। তাদের স্ত্রী এবং সন্তানদের নিয়ে আমার ত্রিশ হাজার লোক একটা ইনসাইক্লোপীডিয়া গ্যালাকটিকা তৈরির কাজে মন-প্রাণ ঢেলে দেবে। কাজটা তারা তাদের জীবদ্দশায় শেষ করে যেতে পারবে না। এমনকি আমিও কাজটা ভাল করে শুরু হল কিনা তা দেখে যেতে পারব না। কিন্তু ট্রানটর ধ্বংস হতে হতে কাজটা শেষ হয়ে যাবে। এবং বিশ্বকোষটার কপি গ্যালাক্সির প্রধান সব কটা লাইব্রেরীতে থাকবে।
চীফ কমিশনারের হাতুড়িটা উঠল এবং পড়ল। হ্যারি সেলডন কাঠগড়া ত্যাগ করে শান্তভাবে গালের পাশে এসে বসলেন। মৃদু হেসে জিগ্যেস করলেন, নাটকটা কেমন লাগল?
গাল জবাব দিল, আপনি বাজিমাৎ করে দিয়েছেন, কিন্তু এখন কী হবে?
বিচার মুলতবি ঘোষণা করবে ওরা। তারপর আমার সঙ্গে একটা ব্যক্তিগত আপোষরফায় আসা যায় কিনা সেই চেষ্টা করবে।
কী করে বুঝলেন?
সেলডন বললেন, আই উইল বি অনেস্ট। আমি জানি না। ব্যাপারটা নির্ভর করছে চীফ কমিশনারের ওপর। বেশ কয়েক বছর ধরে স্টাডি করেছি আমি লোকটাকে। বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি তার কাজকর্মের গতিপ্রকৃতি। কিন্তু সাইকোহিস্টোরিক ইকুয়েশনে মাত্র একজন লোকের প্রবণতা বা খেয়াল ঢোকানোটা যে কত ঝুঁকিপূর্ণ, তা তো তুমি জানোই। তবুও আমি আশাবাদী।
.
সাত
অ্যাভাকিম এগিয়ে এসে গাল-এর উদ্দেশে মাথা ঝাঁকিয়ে সেলডনের কানের ওপর ঝুঁকে পড়লেন। বিচার মুলতবির ঘোষণা শোনা গেল।
পরদিনের শুনানিটা হলো একেবারে ভিন্ন ধরনের। কমিশনের পাঁচ সদস্যের সঙ্গে হ্যারি সেলডন আর গাল ছাড়া কেউ নেই। পাঁচ বিচারক আর দুই অভিযুক্ত এই টেবিলে বসা। তাঁদের মধ্যে দূরত্ব সামান্যই। এমনকি সিগারও অফার করা হলো ওঁদের। রঙধনুর মতো সাতরঙা প্লাস্টিকের তৈরি সিগারের বাক্সটা দেখলে মনে হয় সেটার ওপর দিয়ে কুলকুল করে পানি বয়ে যাচ্ছে। অবশ্যি হাত দিলে শুকনো, শক্ত প্লাস্টিকের স্পর্শে ভুল ভাঙে।
সেলডন একটা নিলেন, গাল ফিরিয়ে দিল।
সেলডন বললেন, আমার লইয়ার উপস্থিত নেই।
একজন কমিশনার বললেন, এখানে বিচার হচ্ছে না ড. সেলডন। আমরা এখানে এসেছি রাজ্যের নিরাপত্তা সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা করতে।
লিঞ্জ শেন বলে উঠলেন, আমি বলব।
অন্যান্য কমিশনার যার যার চেয়ারে স্থির হয়ে বসলেন তার কথা শোনার জন্যে। মুহূর্তের মধ্যে পিনপতন নীরবতা নেমে এল ঘরটায়।
গাল রুদ্ধশ্বাসে বসে আছে। হালকা-পাতলা, তবে শক্ত চেহারার লোক শেন। অবশ্যি বয়সের চেয়ে বুড়ো দেখায় তাকে। সত্যি বলতে, গোটা গ্যালাক্সির আসল সম্রাট তিনিই। বর্তমানে যে শিশুটি এই উপাধি ধারণ করছে, সে শেন-এর তৈরি একটি প্রতীক ছাড়া কিছু নয়, এবং এ ধরনের প্রতীক এটাই প্রথম নয়।
শেন বললেন, ড. সেলডন, আপনি সম্রাটের সাম্রাজ্যের শান্তি বিঘ্নিত করছেন। গ্যালাক্সির নক্ষত্রগুলোয় এ-মুহূর্তে যে কোয়াড্রিলিয়ন লোক বাস করছে, এক শতাব্দী পর তারা কেউই বেঁচে থাকবে না। তাহলে আগামী পাঁচশো বছর পরের ঘটনা নিয়ে আমরা কেন মাথা ঘামাতে যাব?
আমি নিজে আর পাঁচ বছরও বাঁচব না, সেলডন নির্লিপ্ত মুখে বললেন। কিন্তু তারপরেও আমি প্রচণ্ড মাথা ঘামাচ্ছি এ-নিয়ে। আদর্শবাদ বলতে পারেন একে। মানুষ শব্দটি দিয়ে আমরা যে রহস্যময় সরলীকরণ বুঝিয়ে থাকি, তার সঙ্গে আমার অভিন্নতাও বলতে পারেন একে।
মিস্টিসিজম নিয়ে মাথা ঘামানোর কষ্ট স্বীকার করতে রাজি নই আমি। তার চেয়ে আজ রাতে আপনাকে মেরে ফেললেই তো আমার সমস্যা মিটে যায়। আপনার সঙ্গে সঙ্গে পাঁচশো বছরের এমন এক ভবিষ্যতের ঝামেলা থেকেও রেহাই পাওয়া যায় যা অস্বস্তিকর, অপ্রয়োজনীয় এবং আমি দেখতে পাব না। আপনি আমাকে বলুন, আমি এই সহজ পথটা কেন বেছে নেব না?
এক হপ্তা আগে, হালকা সুরে সেলডন বললেন, আপনি কাজটা করতে পারতেন এবং তাতে করে এ-বছরের শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকার দশ ভাগের এক ভাগ সম্ভাবনা বজায় রাখতে পারতেন। কিন্তু আজ সেই এক দশমাংশ সম্ভাবনাটা কমে দশ হাজার ভাগের এক ভাগও আছে কিনা সন্দেহ।
ঘরের ভেতর বেশ কিছু সশব্দ নিঃশ্বাস পড়ল, অস্বস্তিকর কিছু নড়াচড়া লক্ষ্য করা গেল। গালের মনে হল, ওর ঘাড়ের কাছে ছোট ছোট চুলগুলো সব এক নিমেষে খাড়া হয়ে গেছে। এমনকি স্বয়ং শেন-এর চোখের ওপরের পাপড়ি দুটো বুজে এল খানিকটা।
কী করে?
ট্র্যানটরের পতন রোধ করে এমন কোনো শক্তি নেই। অবশ্যি পতনের গতিটা ত্বরান্বিত করা সম্ভব খুব সহজেই। আমার অর্ধ-সমাপ্ত বিচারের কাহিনী গ্যালাক্সি জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে। ধ্বংসের প্রচণ্ডতা কমাবার উদ্দেশে তৈরি করা আমার পরিকল্পনার অপমৃত্যু লোকের মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল করবে যে, তাদের আর ভবিষ্যৎ নেই। এখনই তারা তাদের বাপ-দাদার জীবনকে ঈর্ষার চোখে দেখে। তারা উপলব্ধি করবে, রাজনৈতিক অভ্যুত্থান আর ব্যবসা-বাণিজ্যের অচলাবস্থা ক্রমেই বাড়তে থাকবে। সারা গ্যালাক্সি জুড়ে এই ধারণাটা ছড়িয়ে পড়বে যে, একজন মানুষ যতটুকু আঁকড়ে ধরে থাকতে পারবে, শুধু সেটুকুর-ই যা তোক কিছু একটা মূল্য থাকবে। উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষ আর অপেক্ষা করবে না, বিবেকহীন লোকগুলোও বসে থাকবে না। তাদের প্রতিটি কাজের মাধ্যমে তারা বিশ্বের ধ্বংস ত্বরান্বিত করবে। মেরে ফেলুন আমাকে, পাঁচ শতাব্দী নয়, মাত্র পঞ্চাশ বছরে ধ্বংস হয়ে যাবে ট্রানটর। আর আপনি মাত্র এক বছরের মধ্যে।
শেন বললেন, বাচ্চারাই শুধু এসব জুজুবুড়ির কথা শুনলে ভয় পায়। আর তাছাড়া, কেবল আপনি মরলেই তো পুরোপুরি স্বস্তি পাচ্ছি না আমরা। যে কাগজগুলোর ওপর তার চিকন হাতটা পড়ে ছিল সেটা ওঠালেন তিনি। মাত্র দুটো আঙুল ওপরের কাগজটা স্পর্শ করে রইল। বললেন, আচ্ছা বলুন তো, আপনার কাজ কি আপনি যে ইনসাইক্লোপীডিয়ার কথা বলছেন সেটার প্রস্তুতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
থাকবে।
এবং সেটা কি এই ট্র্যানটরে বসেই করতে হবে?
মাই লর্ড, ট্রানটরে ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরী রয়েছে; তাছাড়া এখানে ট্র্যানটর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারলি রিসোর্সগুলোও আছে।
কিন্তু তারপরেও যদি আপনাকে অন্য কোথাও পাঠানো হয়। যেমন ধরুন, এমন এক গ্রহে, যেখানে শহরের নানান কোলাহল জ্ঞানের চর্চা ব্যাহত করবে না, যেখানে আপনার লোকজন পুরোপুরি এবং একাগ্রতার সঙ্গে কেবল তাদের কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারবে। আপনার সুবিধে হবে না?
খুব কম, সম্ভবত।
এরকম একটা গ্রহ খুঁজে বের করা হয়েছে, আগের কথার খেই ধরে বলে চললেন শেন। আপনি আপনার এক লাখ লোক নিয়ে সেখানে আপনার ইচ্ছেমতো কাজ করতে পারবেন। সারা গ্যালাক্সির লোক জানবে আপনি পতনের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছেন, যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। তাদেরকে এ কথাও বলা হবে যে, আপনি পতন বা ধ্বংসটা রোধ করতে পারবেন। মুচকি হাসলেন তিনি। আমি যেহেতু অনেক কিছুই বিশ্বাস করি না, তাই এই পতনটার কথাও অবিশ্বাস করতে বাধবে না আমার, কাজেই আমি পুরোপুরি নিশ্চিত যে সত্যি কথাটাই বলবো আমি জনগণকে। আর এদিকে ট্রানটরও নিরুপদ্রব থাকবে, সম্রাটের শান্তিভঙ্গেরও কোনো কারণ হবেন না আপনি।
বিকল্প হিসেবে রয়েছে আপনার এবং আপনার অনুসারীদের মধ্যে যত জনের দরকার মনে হবে তত জনের মৃত্যু। আপনার ঐ হুমকিগুলো পুরোপুরি অগ্রাহ্য করছি আমি। মৃত্যু আর নির্বাসনের মধ্যে যে-কোনো একটা বেছে নেয়ার জন্য আপনাকে এই মুহূর্ত থেকে ঠিক পাঁচ মিনিট সময় দেয়া গেল।
কোন গ্রহটা ঠিক করা হয়েছে, মাই লর্ড, সেলডন নিরুদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিগ্যেস করলেন।
ওটার নাম সম্ভবত টার্মিনাস, শেন জবাব দিলেন। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ডেস্কের ওপর পড়ে থাকা কাগজগুলো আঙুলের ডগা দিয়ে তুলে এমনভাবে ধরলেন যাতে সেগুলো সেলডনের দিকে ফিরে থাকে। গ্রহটা জনমানবশূন্য, তবে পুরোপুরি বাসযোগ্য। স্কলারদের প্রয়োজনমত গড়ে তোলারও উপযুক্ত একদম। তবে কিছুটা বিচ্ছিন্ন।
সেলডন বাধা দিলেন, গ্রহটা গ্যালাক্সির একেবারে প্রান্তসীমায়, স্যার।
বললাম তো, খানিকটা বিচ্ছিন্ন। আপনার অখণ্ড মনোযোগের জন্যে সুবিধে হবে। জলদি, মাত্র দুমিনিট সময় আছে আপনার হাতে।
সেলডন সে-কথায় কর্ণপাত না করে বললেন, এ-ধরনের ট্রিপের জন্যে তৈরি হতে বেশ সময় লাগবে আমাদের। প্রকল্পটার সঙ্গে বিশ হাজার পরিবার জড়িত।
সময় দেয়া হবে আপনাকে।
এক মুহূর্ত ভাবলেন সেলডন। শেষ মিনিটটিও ফুরিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলে উঠলেন, আমি নির্বাসনই গ্রহণ করলাম।
গালের হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল সেলডনের কথা শুনে। প্রচণ্ড একটা সুখের অনুভূতি ওর মনের সমস্ত অংশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। মৃত্যুর হাত থেকে পার পেয়ে কার-ই বা তা না হবে! তবুও, এই প্রবল স্বস্তির মধ্যেও, সে এই কথাটা ভেবে দুঃখ পেল যে, সেলডন হেরে গেলেন।
.
আট
কয়েকশো মাইল লম্বা, আঁকাবাঁকা টানেলগুলো ধরে ট্যাক্সি ছুটে চলেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে। বেশ কিছুক্ষণ দুজনে চুপচাপ থাকার পর গাল নড়েচড়ে উঠল।
বলল, কমিশনারকে আপনি যা বললেন তা কি সত্যি? আপনাকে মেরে ফেললে পতনটা কি সত্যিই ত্বরান্বিত হবে?
সেলডন জবাব দিলেন, সাইকোহিস্টোরিক ফাইণ্ডিংস সম্পর্কে আমি কখনো মিথ্যে কথা বলি না। তাতে অন্তত এই ব্যাপারে কোনো উপকারও হতো না। শেন নিউ আই স্পোক দ্য টুথ। লোকটা খুব ঝানু পলিটিশিয়ান। আর পলিটিশিয়ানদের, তাদের কাজের প্রকৃতি অনুসারেই, সাইকোহিস্টোরিক টুথ সম্পর্কে সহজাত অনুভূতি থাকতে হয়।
তাহলে কি আপনার নির্বাসন মেনে নেবার দরকার ছিল?
গালের এই প্রশ্নের কোনো জবাব দিলেন না সেলডন।
অবশেষে ওরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটি খুঁড়ে বেরুল, গালের শরীরের সমস্ত পেশী যেন অসাড় হয়ে এল। ট্যাক্সি থেকে তাকে একরকম ধরেই নামাতে হল। গোটা বিশ্ববিদ্যালয় সূর্যের আলোয় ঝকঝক করছে। সূর্য বলে কিছু যে থাকতে পারে, গাল প্রায় ভুলতেই বসেছিল। অবশ্যি বিশ্ববিদ্যালয়টা উন্মুক্ত নয়। দালানগুলো দানবীয় আকারের গম্বুজে ঢাকা। গম্বুজগুলো কাঁচ আবার ঠিক-কাঁচ-নয় এমন কিছু দিয়ে তৈরি। এবং পোলারাইজড। ফলে, জ্বলন্ত নক্ষত্রটির দিকে সরাসরি তাকাতে কোনো অসুবিধে হলো না গালের। তাই বলে আলোটা কিন্তু নিপ্ৰভ নয়। যতদূর দৃষ্টি যায়, ধাতব দালানগুলোর ওপর আছড়ে পড়ছে সেই আলো।
ট্রানটর-এর বাকি অংশের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রাকচারগুলো কঠিন ইস্পাত ধূসর নয়। বরং বেশ খানিকটা রুপোলি। ধাতব দীপ্তিটা অনেকটা হাতির দাঁতের মতো সাদা।
সেলডন বলে উঠলেন, মনে হচ্ছে সৈন্য।
কী? নীরস মাটিতে চোখ নামিয়ে আনতেই গাল দেখতে পেল একটু দূরে একজন সেন্ট্রি দাঁড়িয়ে আছে।
দুজনে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই কাছের একটা প্রবেশ পথ থেকে উদয় হল এক মৃদু-কণ্ঠ ক্যাপ্টেন।
জিগ্যেস করল, ড. সেলডন?
হ্যাঁ।
আমরা আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। এখন থেকে আপনি এবং আপনার লোকজন মার্শাল ল-র আওতাভুক্ত থাকবেন। আপনাকে জানিয়ে দিতে বলা হয়েছে আমাকে যে, টার্মিনাস-এর উদ্দেশে রওনা হবার প্রস্তুতির জন্যে ছমাস সময় পাবেন আপনি।
ছমাস! চেঁচিয়ে উঠল গাল। আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল সে; কিন্তু সেলডনের আঙুলের হালকা চাপ অনুভব করল সে তার কনুই-এর ওপর।
চলে গেল লোকটা। গাল সেলডনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ছমাসের মধ্যে কী করে সম্ভব? কী করা যাবে এই অল্প সময়ের মধ্যে? এটা খুন ছাড়া আর কিছু নয়, তবে একটু ধীরে ধীরে এই যা তফাৎ।
ধীরে, ধীরে। আগে অফিসে চল।
অফিসটা তেমন বড় নয়। তবে সম্পূর্ণ স্পাই প্রুফ। তার চেয়ে বড় কথা, ঘরটা যে স্পাই প্রুফ সেটা ধরারও কোনো উপায় নেই। ঘরটির ওপর ছোঁড়া স্পাই বিম সন্দেহজনক কোনো নীরবতা অথবা আরো বেশি সন্দেহজনক কোনো স্ট্যাটিক ফীল্ড পায় না এখানে। তার বদলে সেটা বিভিন্ন কণ্ঠে এবং সুরে, বিশাল এক নির্দোষ শব্দভাণ্ডার থেকে তৈরি করা উদ্দেশ্যবিহীন কিছু কথাবার্তা রিসিভ করে।
এবার শোন, বেশ আয়েশ করে চেয়ারে বসে সেলডন বললেন, ছমাসই যথেষ্ট।
বুঝতে পারছি না, কীভাবে।
তার কারণ, মাই বয়, আমাদের এই ধরনের কোনো পরিকল্পনায় বিপক্ষের অ্যাকশন আমাদেরই চাহিদার ওপর নির্ভরশীল। তোমাকে তো আগেই বলেছি, শেন-এর স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের ওপর যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে তা ইতিহাসে অন্য কোনো মানুষের ওপর করা হয়নি। আমাদের নিজেদের পছন্দমাফিক সময় এবং পরিস্থিতি তৈরি হবার আগ পর্যন্ত কিন্তু বিচারটা শুরু হতে দেয়া হয়নি।
কিন্তু আপনি কি ঠিক করতে পারতেন–
টার্মিনাসেই নির্বাসনে যাব কিনা? কেন নয়? তিনি তাঁর ডেস্কের একটা বিশেষ স্থান আঙুল দিয়ে স্পর্শ করতেই তাঁর পাশে দেয়ালের সামান্য অংশ সরে গেল। ব্যাপারটা শুধু তার আঙুলের সাহায্যেই সম্ভব, শুধু তার আঙুলের বিশেষ প্রিন্ট প্যাটার্নই নিচের স্ক্যানারটা সক্রিয় করে তোলে।
ভেতরে বেশ কিছু মাইক্রোফিল্ম আছে, সেলডন বললেন। টি লেখা ফিল্মটা বের কর। নির্দেশ পালন করল গাল।
সেলডন ফিল্মটাকে প্রজেক্টরে ঢুকিয়ে গালের হাতে একজোড়া আই-পীস ধরিয়ে দিলেন। চোখে পরে নিল গাল। দেখল, ওর চোখের সামনে খুলে যাচ্ছে মাইক্রোফিল্মটা।
বলে উঠল সে খানিক পরে, কিন্তু তাহলে–
বাগড়া দিলেন সেলডন মাঝপথে, জিগ্যেস করলেন, কোন জিনিসটা অবাক করছে তোমাকে?
আপনি কি দুবছর ধরে ব্র্যানটর ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন? অবিশ্বাস ভরা কণ্ঠে গাল পাল্টা প্রশ্ন করল।
আড়াই বছরে ধরে। অবশ্যি শেন যে টার্মিনাসই পছন্দ করবে সে-ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারিনি। তবে ভেবেছিলাম, হলেও হতে পারে, সেই ধারা অনুযায়ীই কাজ।
কিন্তু কেন ড: সেলডন? নির্বাসনে যাবার প্রস্তুতি নিলেন কেন আপনি? ট্রানটরে থেকেই কি সবকিছু আরো ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যেত না?
কেন, তার কিছু কারণ আছে। ইম্পেরিয়াল সাপোর্ট পাবো আমরা টার্মিনাসে কাজ করলে। কারণ, তাতে করে কখনোই এ-সন্দেহের উদ্রেক হবে না যে, আমরা কোনোভাবে সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করব।
কিন্তু আপনি সেই সন্দেহেরই উদ্রেক করেছেন স্রেফ নির্বাসনটা আদায় করতে গিয়ে। আমি এখনও বুঝতে পারছি না কিছু। উম্মা ঝরে পড়ল গালের কণ্ঠ থেকে।
বিশ হাজার পরিবার সম্ভবত স্বেচ্ছায় ট্রানটর ছেড়ে গ্যালাক্সির শেষ মাথায় যেতে চাইত না।
কিন্তু তাদের যেতে বাধ্য করা হবে কেন? থামল একটু গাল। তারপর আবার প্রশ্ন করল, আমি কি জানতে পারি না?
নট ইয়েট, সেলডন জবাব দিলেন। আপাতত শুধু এটুকু শুনেই সন্তুষ্ট থাক যে, টার্মিনাসে একটা সায়েন্টিফিক রিফিউজ বা বৈজ্ঞানিক আশ্রয় শিবির স্থাপন করা হবে। এবং আরেকটা স্থাপন করা হবে গ্যালাক্সির অন্য প্রান্তে; বলতে পার, মৃদু হাসলেন তিনি, স্টারস এও-এ। আর বাদবাকি ব্যাপারগুলোর মধ্যে শুধু এটুকু বলি, শিগগিরই মারা যাচ্ছি আমি। আর আমি যা যা দেখে গেলাম, তুমি তারচেয়ে অনেক বেশি দেখে যাবে- না, না, আঁতকে ওঠার কারণ নেই, আমার জন্যে মঙ্গল কামনা করারও দরকার নেই। ডাক্তার বলে দিয়েছে আমাকে, বড় জোর আর এক কি দুবছর টিকব আমি। কিন্তু তাতে আফসোস নেই, যা করার ইচ্ছে ছিল তা শেষ করতে পেরেছি আমি জীবনে। এর চেয়ে ভাল আর কোন অবস্থায় একটা লোক মৃত্যুবরণ করতে পারে, বলো?
আর আপনি মারা যাওয়ার পর কী হবে, স্যার?
কেন, উত্তরাধিকারীরা থেকে যাবে- হয়ত তুমি হবে তাদেরই একজন। এরাই প্রজেক্টের ফাইনাল টাচ দেবে। সেই সঙ্গে অ্যানাক্রিয়ন-এ সময়মত, সঠিকমতো বিদ্রোহের সূচনা করবে। তারপর ঘটনা আপনা আপনিই গড়াতে থাকবে।
বুঝলাম না। বুঝবে। প্রায় সবাই টার্মিনাসে চলে যাবে। কেউ কেউ অবিশ্য থেকে যাবে, তবে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে অসুবিধে হবে না। আর আমার কথা যদি বল, গলাটা তাঁর একেবারে খাদে নেমে গেল এখানে এসে, গাল কোনোরকমে শুনতে পেল, আই অ্যাম ফিনিশড্।