দীর্ঘ নীরবতা নেমে এল দুজনের মাঝে। তারপর আলোচনার মোড় ঘোরানোর জন্য পেলোরেট বলল, তুমি স্টার ফিল্ডের দিকে তাকিয়ে আছ কেন?
অভ্যাস। ক্লান্ত স্বরে বলল ট্র্যাভিজ, কম্পিউটার বলছে গায়ান বা সেশেলিয়ান কোনো মহাকাশযান আমাদের অনুসরণ করছে না। তবুও উদ্বেগ নিয়ে তাকিয়ে আছি। যেখানে কম্পিউটারের সেন্সব আমার চোখের তুলনায় বহুগুণ শক্তিশালী। তা ছাড়া কম্পিউটার মহাকাশের অনেক সূক্ষ্ম বস্তু ধরতে পারছে, যা আমি কখনোই ধরতে পারব না। সব জেনেও আমি তাকিয়ে আছি।
গোলান, আমরা যদি বন্ধু হই–
কথা দিচ্ছি ব্লিসের কষ্ট হয়, এমন কিছু করব না।
অন্য ব্যাপার। তুমি কোথায় যাচ্ছ আমাকে জানাওনি, যেন আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না। আমরা কোথায় যাচ্ছি? তুমি জানো পৃথিবী কোথায়?
দুঃখিত। সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছ থেকে কথাটা গোপন করেছি, তাই না?
হ্যাঁ, কিন্তু কেন?
কেন? কারণ হয়তো ব্লিস।
ব্লিস? তুমি ওকে জানাতে চাও না? পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় ওকে।
ঠিক সেরকম কিছু না। ব্লিসকে অবিশ্বাস করে কি হবে। ইচ্ছা হলেই আমার মাইণ্ড থেকে সে গোপন কথাটা জেনে নিতে পারবে। আসলে কারণটা বেশ শিশুসুলভ। মনে করেছিলাম তুমি ব্লিসকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে আমার কথা ভুলেই গেছ।
পেলোরেট পুরোপুরি হতভম্ব। কিন্তু সেটা সত্যি না, গোলান।
জানি। এই আচরণের কোনো কারণ আমি খুঁজে পাইনি। তুমি যেমন আমাদের সম্পর্ক নিয়ে ভয় পেয়েছিলে, তেমনি ভয় পেয়েছিলাম আমিও। নিজের কাছে স্বীকার করতে পারিনি, কিন্তু মনে হয়েছিল ব্লিস যেন আমাকে কেটে তোমার কাছ থেকে আলাদা করে ফেলেছে। শিশুসুলভ আচরণ।
গোলান!
বললাম তো শিশুসুলভ আচরণ করেছি। যে-কোনো মানুষই করতে পারে। যাই হোক আমরা বন্ধু। তোমার কাছে আর লুকাবো না। আমরা কমপরেলন-এ যাচ্ছি।
কমপরেলন? পেলোরেট বুঝতে পারেনি।
আমার বেঈমান দোস্ত মান-লী-কমপর-এর কথা মনে আছে নিশ্চয়ই।
মনে পড়তেই মুখ উজ্জ্বল হল পেলোরেটের। নিশ্চয় মনে আছে। তার পূর্বপুরুষরা এসেছিল কমপরেলন থেকে।
হয়তো। কমপরের সব কথা আমি বিশ্বাস করিনি। তবে কমপরেলন পরিচিত বিশ্ব, আর কমপর বলেছিল ওই গ্রহের বাসিন্দারা পৃথিবীর কথা জানে। বেশ, আমরা সেখানে গিয়ে খুঁজে বের করব। হয়তো লাভ হবে না, কিন্তু শুরু করার জন্য এই একটা তথ্যই আমাদের হাতে আছে।
তুমি নিশ্চিত?
নিশ্চিত হওয়া বা সন্দেহ করার কিছু নেই। আমরা নিরুপায়। এখান থেকেই আমাদের শুরু করতে হবে।
হ্যাঁ, কিন্তু কমপরের কথা মেনে নিলে তার সব কথাই মানতে হবে। মনে আছে, সে বলেছিল পৃথিবীর সারফেস রেডিওএ্যাকটিভ এবং প্রাণশূন্য। যদি তাই হয় কমপরেলনে গিয়ে আমাদের কোনো লাভ হবে না।
.
খেতে বসেছে তিন অভিযাত্রী।
চমৎকার, তৃপ্তির সাথে বলল পেলোরেট। এই খাবারগুলো কি টার্মিনাস থেকে এনেছিলাম?
না, বলল ট্র্যাভিজ। ওগুলো কবেই শেষ। এগুলো কিনেছিলাম সেশেল থেকে।
স্বাদটা কেমন যেন, তাই না? কোন ধরনের সিফুড।
ব্লিস নিশ্চুপ। খাবার নাড়াচাড়া করছে।
তোমাকে খেতে হবে, ডিয়ার। নরম সুরে বলল পেল।
জানি, পেল। খাচ্ছি।
অধৈর্য স্বরে বলল ট্র্যাভিজ, স্টকে গায়ান খাবার আছে, ব্লিস।
জানি। জমা থাকুক। বলা তো যায় না কতদিন মহাকাশে থাকতে হয়। আর আমাকে আইসোলেট মানুষের খাবারে অভ্যস্ত হতে হবে।
এতটাই খারাপ। নাকি গায়া শুধু গায়াকে খায়?
দীর্ঘশ্বাস ফেলল ব্লিস। আসলে গায়াতে আমি যা খাই, যে অংশ আমার শরীরে মিশে যায় তার সবই গায়া। ব্যাপারটা ঠিক সচেতনতার উঠা নামা। অর্থাৎ যা খাই তার কিছু অংশের সচেতনতা বেড়ে যায়, আর যে অংশ বর্জ্য পদার্থ হিসেবে থাকে তার সচেতনতা নেমে যায়।
বেশ, এই যে সেশেল থেকে আনা নন-গায়ান খাবারগুলো তুমি খাচ্ছ, সেগুলোর কি হবে। এগুলোও কি গায়ার অংশ হবে?
হবে। খুব ধীরে ধীরে। যে অংশটুকু বর্জ্য হিসেবে বের করে দেব সেটা ধীরে ধীরে গায়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। আসলে হাইপার স্পেসে থাকার কারণেই এই খাবারগুলো গায়ার অংশ হতে পারছে।
স্টোরে যে গায়ান খাবার আছে সে গুলোর কি হবে। ধীরে ধীরে গায়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে না। যদি তাই হয়, তবে তোমার খেয়ে ফেলা উচিত।
চিন্তা করতে হবে না। ওগুলো এমনভাবে রাখা আছে যেন দীর্ঘ সময় পরেও গায়ার সাথে যুক্ত থাকে।
হঠাৎ জিজ্ঞেস করল পেলোরেট, আমরা যে গায়ান খাবার খেয়েছি সেগুলোর কী হবে? আমাদেরই বা কী হবে? আমরা ধীরে ধীরে গায়াতে পরিণত হব।
মাথা নাড়ল ব্লিস। চেহারায় অস্বস্তি। না তোমরা যা খেয়েছ সেগুলো আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে গেছে। শরীর থেকে যা বের করে দিয়েছ সেগুলো ধীরে ধীরে আবার গায়াতে পরিণত হবে, যেন ভারসাম্য ফিরে আসে। তবে তোমরা থাকার ফলে গায়ার অনেক অণু বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
কেন? ট্র্যাভিজের কৌতূহলী প্রশ্ন।
তোমরা এই পরিবর্তনে অভ্যস্ত হতে পারতে না। তোমরা ছিলে আমাদের অতিথি। কাজেই তোমাদের নিরাপত্তার জন্য ত্যাগ স্বীকার করতেই হয়েছে।
সেজন্য দুঃখিত। এই নন-গায়ান খাবারগুলো তোমার ক্ষতি করবে না তো?
না। তোমরা যা খেতে পারবে আমিও খেতে পারব। হজম করতে সমস্যা হবে। সেজন্য আস্তে আস্তে খাচ্ছি। তবে সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে।
সংক্রমণ হতে পারে। তীক্ষ্ণ গলায় চিৎকার করে বলল পেলোরেট। আগে মনে আসেনি কেন? প্রতি গ্রহেই জীবাণু থাকতে পারে, তুমি আক্রান্ত হবে সহজেই। আমাদের ফিরে যেতে হবে ট্র্যাভিজ।