পুনরাবৃত্তির সুর লক্ষ্য করে বুঝতে পারলেন যে তিনি আসলে ডর্সের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে নিজের চিন্তায় গভীরভাবে ডুবে গিয়েছিলেন। ধীরে সুস্থে বলতে শুরু করলেন, “দুঃখিত, না, রাগ করি নি। শুধু ভাবছিলাম যে তোমার মন্তব্যটা কিভাবে নেব।”
“রোবটের ব্যাপারে?” ডর্সকে আগের চেয়েও শান্ত মনে হলো।
“তুমি বলেছ যে রোবটের ব্যাপারে আমি তোমার মতো অত বেশী জানি না। এই মন্তব্যটার জবাব কিভাবে দেয়া উচিত?” থামলেন, তারপর শান্ত গলায় যোগ করলেন (বুঝতে পারলেন যে তিনি আসলে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে চাইছেন), “অন্তত মনে কষ্ট না নিয়ে কিভাবে বলা যায়।”
“আমি এই কথা বলি নি যে তুমি রোবটের ব্যাপারে কিছু জান না। বলতেই যদি চাও তাহলে যা বলেছি সেটা ঠিক মতো বল। আমি বলেছি যে রোবটের ব্যাপারগুলো। আমি যতটুকু বুঝি তুমি তত বোঝ না। কোনো সন্দেহ নেই যে তুমি জানো অনেক বেশী হয়তো বা আমার চেয়েও বেশী। কিন্তু জানা আর বোঝার মাঝে অনেক তফাৎ।”
“ডর্স, তোমার এই স্ববিরোধী বক্তব্য আমার কাছে বিরক্তিকর। কোনো বিষয়ে অনিশ্চয়তা থাকলে অথবা ইচ্ছে করে স্ববিরোধীতা তৈরি করা যায়। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার ক্ষেত্রে আমি তা পছন্দ করি না। অবশ্য হাসানোর উদ্দেশ্যে করা হলে অন্য ব্যাপার। তবে আমার মনে হয় না এখন পরিস্থিতি সেই রকম।”
ডর্স তার চিরাচরিত ভঙ্গীতে হাসল, যেন নিজের আনন্দটা এতোই মূল্যবান যে তা সহজে অন্য কারো সাথে ভাগাভাগি করা যাবে না। “আসলে স্ববিরোধীতা তোমার অহংবোধ প্রকাশ করে দেয় বলেই বিরক্ত হও। আর তোমার অহংবোধটা যখন প্রকাশ হয়ে পড়ে তখন তোমাকে হাস্যকর দেখায়। যাই হোক, বুঝিয়ে বলছি। তোমাকে বিরক্ত করা আমার উদ্দেশ্য নয়।” স্পর্শ দিয়ে তাকে শান্ত করার জন্য হাত বাড়ালো ডস, কিন্তু তিনি হাত মুঠো পাকিয়ে ফেললেন। নিজের আচরণে নিজেই বিস্মিত এবং বিব্রত হলেন।
“সাইকোহিস্টোরির অনেক কথাই তুমি আমাকে বল, তাই না?” ডর্স বলল।
গলা পরিষ্কার করে নিলেন সেলডন। এই ব্যাপারে আমি তোমার সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। প্রজেক্টটা গোপনীয়–এটাই এই প্রজেক্টের বিশেষ প্রকৃতি। এই বিজ্ঞান যে মানবগোষ্ঠীকে পরিচালিত করবে তাদের কাছ থেকে এর ফলাফল গোপন রাখা না হলে সাইকোহিস্টোরি ব্যর্থ হয়ে যাবে, কাজেই এই ব্যাপারে আমি শুধু ইউগো এবং তোমার সাথেই কথা বলতে পারি। ইউগোর কাছে পুরো ব্যাপারটাই অনুমান নির্ভর। সে মেধাবী, বেপরোয়ার মতো অন্ধকারে ঝাঁপ দিতে শ্রী। আগ্রহী, তাই আমাকে সবসময় তাকে সামলে রাখতে হয়। কিন্তু আমার মাথায়ও অনেক বেপরোয়া চিন্তা আসে, ওগুলো নিজের কানে শুনতে পারলে চিন্তাভাবনাগুলো আরো সুসংহত হয়, এমন কি”–মুচকি হাসলেন তিনি, “এটা জানার পরেও যে আমি যা বলছি তার একটা বর্ণও তুমি বুঝতে পারো না।”
“আমি যে তোমার সাউন্ডিং বোর্ড তা জানি এবং আমি কিছু মনে করি নি–বিশ্বাস করো সত্যিই কিছু মনে করি নি, কাজেই মনে মনে নিজের এই আচরণ পাল্টানোর চেষ্টা শুরু করে দিও না। তোমার অংক শাস্ত্র বোঝার সাধ্য আমার নেই। আমি একজন ইতিহাসবিদ–যদিও বিজ্ঞানের ইতিহাস আমি কিছুই জানি না। এই মুহূর্তে আমার গবেষণার মূল বিষয়বস্তু রাজনৈতিক উত্তরণে অর্থনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাব–“
“হ্যাঁ, লক্ষ্য করেছ কিনা জানি না, এই ক্ষেত্রে আবার আমি তোমার সাউন্ডিং বোর্ড। সময় হলে বিষয়টা আমার সাইকোহিস্টোরিতে প্রয়োজন হবে। তখন তুমিই হবে আমার একমাত্র সাহায্যকারী।”
“চমৎকার! যেহেতু মোটামুটি একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেল কেন তুমি আমার সাথে থাকছ সন্দেহ নেই যে আমার বাহ্যিক রূপে তুমি আকৃষ্ট হওনি সেহেতু আমাকে একটু ব্যাখ্যা করার সুযোগ দাও। মাঝে মাঝে যখন তোমার আলোচনা গণিত থেকে দূরে সরে যায় তখন কিছু বিষয় আমার নজরে এসেছে। বেশ কয়েকবারই তুমি মিনিমালিজম এর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছ। এই বিষয়টা সম্ভবত আমি বুঝতে পেরেছি। তুমি আসলে বোঝাতে চেয়েছ–“
“আমি জানি আমি কি বোঝাতে চেয়েছি।”
এই মন্তব্যে ডর্স খানিকটা আহত হলো। “এতো বাজে ব্যবহার করো না, প্লিজ, হ্যারি। তোমাকে নয় বরং নিজেকেই বোঝানোর চেষ্টা করছি। একটু আগেই বলেছ আমি তোমার সাউন্ডিং বোর্ড। সেইরকম আচরণ করাই তো উচিত নাকি?”
“ঠিক, তেমন আচরণ করাই উচিত। কিন্তু সামান্য একটা কথাতেই তুমি যদি আমাকে বাজে ব্যবহারের–“
“যথেষ্ট হয়েছে। থামো।–তুমি বলেছ যে প্রায়োগিক সাইকোহিস্টোরিতে মিনিমালিজম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো অগ্রগতিকে কাক্ষিত অথবা কম অনাকাঙ্ক্ষিত পথে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে। তুমি বলেছ যে পরিবর্তনের মাত্রাটা হবে সামান্য, অতি ক্ষুদ্র–“
“হ্যাঁ, কারণ–“
“না, হ্যারি। আমাকে বলতে দাও। দুজনেই জানি যে তুমি বুঝতে পারবে। তোমাকে অবশ্যই মিনিমালিজম পেতে হবে, কারণ প্রতিটি পরিবর্তন, যে কোনো পরিবর্তনেরই অগনিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। যদি পরিবর্তনটা হয় ব্যাপক এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় অগনিত তখন নিঃসন্দেহে বলা যায় যে ফলাফল তোমার পরিকল্পনার ধারে কাছেও যাবে না বরং তা হয়ে উঠবে অনুমান অযোগ্য বা আনপ্রেডিক্টেবল।”