“তোমাকে বেশ খুশি মনে হচ্ছে।”
“অবশ্যই। চল্লিশ বছরের এক বৃদ্ধের জন্য কাজটা সত্যিই গর্বের।”
“সেজন্যই তুমি কাজটা করেছ? চল্লিশ বছর বয়সে নিজের শক্তি পরীক্ষা করার জন্য?”
ডর্সের প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে ভাবতেই সেলডন ডিনার মেনুতে ক্লিক করলেন। তারপর বললেন, “না, আমি সত্যি সত্যি চিন্তিত ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় যেন কোনো সমস্যায় না পড়ে। ডেমারজেলকে নিয়েও চিন্তিত ছিলাম। আসলে ইউগোর মন্তব্য যা ভেবেছিলাম আমাকে তার চেয়েও বেশী চিন্তিত করে তুলেছে। কিন্তু ওটা আমার বোকামী, ডর্স, কারণ আমি জানি যে ডেমারজেল নিজেকে রক্ষা করতে পারবে। এই কথাটা তুমি ছাড়া ইউগো বা অন্য কারো কাছেই আমি বলতে পারব না।”
লম্বা শ্বাস নিলেন তিনি। “আমার জন্য আনন্দের ব্যাপার এই যে অন্তত তোমার সাথে আমি বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে পারি। আমি জানি, তুমি জানো, ডেমারজেল জানে এবং অন্য কেউই জানে না। অন্তত আমি যে জানি সেই বিষয়টা যে ডেমারজেল আনটাচেবল।”
দেয়ালের একটা বোতামে চাপ দিল ডর্স। তাদের বাসস্থানের ডাইনিং সেকশনটা আলোকিত হয়ে উঠল। আলোর রং পীচ ফলের মতো। টেবিলে এরই মধ্যে লিনেন, ক্রিস্টাল এবং প্লেট, চামচ সাজানো হয়ে গেছে। বসার পরপর খাবারও আসতে শুরু করল–সাধারণত রাতের এই সময়ে খুব একটা দেরীও হয় না। সেলডন খুব স্বাভাবিকভাবেই ব্যবস্থাটা মেনে নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সামাজিক মর্যাদা ভোগ করেন তাতে সবার সাথে ফ্যাকাল্টি ডিনারে অংশগ্রহণ করার দরকার হয় না।
মাইকোজেনিয়ান খাবারের স্বাদ সেলডন এখনো ভুলতে পারেন নি–অদ্ভুত। পুরুষতান্ত্রিক, ধর্মান্ধ, অতীত আকড়ে থাকা ওই সেক্টরের মাত্র এই একটা জিনিসই তারা পছন্দ করেছিলেন।
“আনটাচেবল বলতে তুমি কি বোঝাতে চাইছ?” খেতে বসে মৃদু স্বরে প্রশ্ন করল ডর্স।
“আহ্, ডর্স, ডেমারজেল ইমোশন অলটার করতে পারে। কথাটা তুমি নিশ্চয়ই ভুলে যাও নি। যদি জোরানিউম বিপদ হয়ে দেখা দেয়, সে”–হাত দিয়ে তিনি একটা ইশারা করলেন–“অলটার করা যাবে; তার মাইন্ড বদলে দেয়া যাবে।”
ডর্সের চেহারায় অস্বস্তির ছাপ পড়ল। ডিনারের বাকী সময়টা দুজনের মাঝে আর কোনো কথা হলো না। উচ্ছিষ্ট খাবার, ময়লা প্লেট, চামচগুলো টেবিলের মাঝখানে একটা গর্তে ঢুকে যাওয়ার পর (গর্তের মুখটা আবার মসৃণভাবে বন্ধও হয়ে গেল) ডর্স পুনরায় আলোচনা শুরু করল, “বুঝতে পারছি না তোমার সাথে এই বিষয়ে কথা বলা ঠিক হবে কিনা, হ্যারি, আবার তোমাকে অন্ধকারে রাখাও উচিত না।”
“মানে?” ভুরু কোঁচকালেন তিনি।
“হা, কখনো চিন্তাও করি নি যে এই ব্যাপারে কথা বলতে হবে, কিন্তু ডেমারজেলেরও সীমাবদ্ধতা আছে, তারও ক্ষতি হতে পারে, এবং জোরানিউম আসলেই তার জন্য বিপদ।”
“কি বলছ তুমি?”
“সত্যি কথাই বলছি। রোবটের ব্যাপারে তোমার কোনো ধারণাই নেই। বিশেষ করে ডেমারজেলের মতো জটিল রোবট। কিন্তু আমার আছে।”
.
৪.
আবার কিছুক্ষণের নীরবতা। কারণ সেলডনের মনের ভেতর নিঃশব্দে ঝড় বয়ে চলেছে।
হ্যাঁ, কথাটা সত্যি। তার স্ত্রীর রোবটের ব্যাপারে অস্বাভাবিক জ্ঞান রয়েছে। অনেক ভেবেও কোনো কুল কিনারা পান নি হ্যারি। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়েছেন। ডেমারজেল–একটা রোবট–সে না থাকলে ডর্সের সাথে তার পরিচয়ই হতো না। কারণ ডর্স ডেমারজেলের জন্যই কাজ করে। ডেমারজেলই আট বছর আগে ট্রানটরের বিভিন্ন সেক্টরে পালিয়ে বেড়ানোর সময় তার নিরাপত্তার জন্য ডর্সকে নিয়োগ করে। যদিও ডর্স এখন তার স্ত্রী, তার অর্ধাঙ্গিনী, সহকারীনি, তারপরেও রোবটের ব্যাপারে ডর্সের জ্ঞান দেখে অবাক হন হ্যারি। ডর্সের জীবনের এই একটা ক্ষেত্রে হ্যারির কোনো প্রবেশাধিকার নেই। সম্ভবত সেখানে তিনি আমন্ত্রিতও নন। আর তাই প্রায়শই হ্যারির মনে সবচেয়ে বেদনাদায়ক প্রশ্নটার উদয় হয় : শুধুমাত্র ডেমারজেলের প্রতি আনুগত্যের কারণেই কি ডর্স তার সাথে একত্রে বসবাস করছে নাকি তার প্রতি ভালোবাসার কারণে? তিনি অবশ্য পরেরটাই বিশ্বাস করতে চান। কিন্তু তারপরেও…
ডর্সের সাথে তার জীবনটা সুখের, কিন্তু সে জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, কিছু শর্ত মেনে নিতে হয়েছে। অবশ্য পালনীয় একটা শর্ত কারণ কোনো আলোচনা বা চুক্তির মাধ্যমে নয় বরং মুখে না বলা পারস্পরিক বোঝাঁপড়ার মাধ্যমে শর্তটা দুজনের মাঝে আরোপিত হয়।
সেলডন বিশ্বাস করেন একজন স্ত্রীর কাছে তিনি যা আশা করতেন তার সবকিছুই ডর্সের ভেতর আছে। সত্যি কথা তাদের কোনো সন্তান নেই, তিনি আশাও করেন নি, বরং আসল কথা হচ্ছে তিনি কখনো চান নি। রাইখ তার নিজের সন্তানের চেয়েও আপন।
মূল কথা হলো ডর্সই তাকে ভাবতে বাধ্য করেছে যে এতে হয়তো দুজনের সমঝোতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সমঝোতার কারণেই তারা এক সাথে সুখে বাস করতে পারছেন।
সকল চিন্তা, সবগুলো প্রশ্ন আবার মাথা থেকে বের করে দিলেন। তার প্রটেক্টর হিসেবে ডর্সের ভূমিকা তিনি মেনে নিতে শিখেছেন। জানেন এই দায়িত্ব থেকে তাকে টলানো যাবে না। আর হাজার হোক তার সাথেই ডর্স এক ছাদ, একই টেবিল এবং একই বিছানা শেয়ার করছে–ডেমারজেলের সাথে নয়।
ডর্সের কথায় তার স্মৃতিচারণে ছেদ পড়ল। “
জবাব দিচ্ছ না কেন–রাগ করেছ?”