প্ল্যাটফর্মের কাছে পৌঁছলেন তিনি, পাটাতনে দুহাতের ভর দিয়ে তিন ফিট উঁচু প্ল্যাটফর্মে উঠে পড়লেন, উঠার সময় ফোঁস করে একটা শব্দও করলেন। খানিকটা বিরক্ত হয়ে ভাবলেন যে দশ বছর আগে এই কাজটাই তিনি এক হাতে এবং নিঃশব্দে করতে পারতেন।
সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। বক্তা কথা থামিয়ে বরফ-শীতল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
“আপনার অনুমতি পত্র, স্যার।” শান্ত সুরে বললেন সেলডন।
“আপনার পরিচয়?” বক্তা জানতে চাইল! উচ্চস্বরে জানতে চাইল। তার কণ্ঠস্বর বাতাসে ভেসে ভেসে পৌঁছে গেল ভীড়ের শেষ মাথা পর্যন্ত।
“আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক,” একই রকম উচ্চস্বরে জবাব দিলেন সেলডন। “অনুমতি পত্র, স্যার।”
“এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার কোনো ক্ষমতা আপনার আছে, আমার তা মনে হয় না।” বক্তার পিছনে দাঁড়ানো ছয় তরুণ ধীরে ধীরে মাঝখানের দূরত্ব কমিয়ে আনতে শুরু করেছে।
“যদি কোনো অনুমতি পত্র না থাকে তাহলে আমি আপনাকে এই মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেব।”
“যদি না যাই?”
“প্রথম কথা, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা কর্মীদের খবর দেয়া হয়েছে, ওরা আসছে।” সমবেত ছাত্রছাত্রীদের দিকে ঘুরলেন তিনি। “শিক্ষার্থীরা, ক্যাম্পাসে স্বাধীনভাবে যে কোনো ধরনের সমাবেশ করার অধিকার আছে আমাদের। কিন্তু সেই অধিকার যে কোনো মুহূর্তে কেড়ে নেয়া হতে পারে যদি আমরা বহিরাগতদের বিনা অনুমতিতে এখানে সমাবেশ করার সুযোগ দেই–“
কাঁধে ভারি হাতের স্পর্শ পেয়ে খানিকটা কুঁকড়ে গেলেন তিনি। ঘুরে ফিনানজিলস এর উল্লেখিত গুন্ডাগুলোর একজনের মুখোমুখী হলেন।
“ভাগো–জলদি।” লোকটা বলল। গমগমে কণ্ঠস্বর। বাচনভঙ্গীটা একেবারেই অপরিচিত, কোন প্রদেশের বুঝতে পারলেন না সেলডন।
“কি লাভ হবে তাতে?” সেলডন বললেন। “নিরাপত্তা কর্মীরা যে কোনো মুহূর্তে এসে পড়বে।”
“সেই ক্ষেত্রে,” মুখে নিষ্ঠুর হাসি ফুটিয়ে নামাত্রি বলল, “একটা সংঘাত হবে। আমরা তাতে ভয় পাই না।”
“ভয় যে পাও না তাতে কোনো সন্দেহ নেই,” সেলডন বললেন। “তোমরা বরং খুশীই হবে, কিন্তু সেরকম কিছু হবে না, তোমরা কোনো ঝামেলা ছাড়াই এখান থেকে চলে যাবে।” ঝাঁকুনি দিয়ে কাঁধের উপর থেকে গুভাটার হাত সরিয়ে দিলেন। শিক্ষার্থীদের দিকে ঘুরে বললেন, “আমরা খেয়াল রাখব যেন কোনো ঝামেলা না হয়, তাই না?”
ভিড়ের মাঝখান থেকে একজন চিৎকার করল, “উনি প্রফেসর সেলডন। আমাদের শিক্ষক। উনার কোনো ক্ষতি করা যাবে না।”
দ্বিধা দ্বন্ধ অনুভব করছেন সেলডন ভীড়ের সকলের মাঝে। নীতিগতভাবে অধিকাংশই চাইছে যেন নিরাপত্তা কর্মীরা এসে সমস্যার সমাধান করে দেয়। অন্য দিকে ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই সেলডনকে চেনে এবং যারা চেনে না তারাও চাইবে না বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক লাঞ্ছিত হোক।
একটা মেয়ে কন্ঠের চিৎকার শোনা গেল। “সাবধান, প্রফেসর।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখোমুখি দাঁড়ানো তরুণকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন তিনি। নিশ্চিত নন কাজটা নিখুঁতভাবে করতে পারবেন কিনা, তার রিফ্ল্যাক্স আগের মতো আছে কিনা, পেশীর জোর আগের মতো আছে কি না।
গুন্ডাদের একজন এগিয়ে আসছে। অতিরিক্তি আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গী। ধীর গতি, ফলে সেলডন প্রয়োজনীয় সময়টুকু পেয়ে গেলেন। আর গুন্ডাটা যেভাবে হাত। বাড়ালো তাতে কাজটা তার জন্য আরো সহজ হয়ে গেল।
বাড়ানো হাতটা ধরেই ঘুরলেন তিনি। ঝুকলেন, বাহু উপরে উঠানো, তারপর ঝট করে নামিয়ে আনলেন (হুশ করে দম ছাড়লেন–হাপাচ্ছেন কেন?), তরুণ উড়ে গিয়ে ধপাস করে প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্তে পড়ল। কাঁধের হাড় সরে গেছে নির্ঘাত।
এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনায় ভিড়ের সবাই হর্ষধ্বনি করে উঠল। নিজেদের সম্মান রক্ষার বিষয়টাই এখন মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে সবার কাছে।
“সব কয়টাকে শেষ করে দেন, প্রফেসর!” একজন বলল। বাকী সবাই তাল মিলাল।
হাতের আঙ্গুলের সাহায্যে মাথার চুলগুলো গুছিয়ে নিলেন সেলডন। আহত গুন্ডা প্ল্যাটফর্মে শুয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছে। পা দিয়ে তাকে একটা খোঁচা দিলেন।
“আর কেউ?” আমুদে গলায় জিজ্ঞেস করলেন তিনি। “নাকি মানে মানে কেটে পড়বে?”
নামাত্রি এবং বাকি পাঁচ গুন্ডা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেলডন বললেন। “তোমাকে সাবধান করে দেয়া আমার কর্তব্য। আমার কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই তোমাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।–বেশ, এরপর কে? এসো। একজন একজন করে।”
শেষ কথাগুলো জোরেই বললেন সেই সাথে আঙ্গুল নেড়ে সামনে এগিয়ে আসার ইশারা করলেন। আনন্দে চিৎকার করে উঠল শিক্ষার্থীরা।
নামাত্রি পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। এগিয়ে গিয়ে সেলডন তার গলা চেপে ধরলেন। ছাত্রছাত্রীরা সবাই প্ল্যাটফর্মে উঠে সেলডন এবং বাকী পাঁচ গুন্ডার মাঝখানে দেয়াল হয়ে দাঁড়াল।
ধীরে ধীরে নামাত্রির কণ্ঠনালির উপর চাপ বাড়াতে লাগলেন সেলডন। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “কাজটা নিখুঁতভাবে করার একটা কায়দা আছে, নামাত্রি। আমি সেই কায়দাটা জানি। অনেকগুলো বছরের অনুশীলন। একটুও যদি নড়ো বা কোনো বদমাইশি করো আমি তোমার কণ্ঠনালি ছিঁড়ে ফেলব। জীবনে আর কখনো ফিসফিসানির চেয়ে উঁচুগলায় কথা বলতে পারবে না। নিজের প্রতি দরদ থাকলে যা বলছি তাই কর। গুন্ডাগুলোকে বল এখান থেকে চলে যেতে। যদি অন্য কিছু বল তাহলে ওগুলোই হবে স্বাভাবিক স্বরে বলা তোমার শেষ কথা। এবং যদি আর কোনোদিন এই ক্যাম্পাসে দেখি তাহলে কাজটা আমি শেষ করব। কোনো দয়া দেখাব না।”