সমস্যাটা এতো প্রকট মনে হলো যে ডিপার্টমেন্টের কোনো কাজেই মন বসল না । ঠিকমতো। একরাশ বিরক্তি নিয়ে দিন শেষে তিনি বাড়ির পথ ধরলেন।
সাধারনতঃ ক্যাম্পাসে হাঁটতে তার ভালো লাগে। স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয়ের গম্বুজগুলো ভীষণ উঁচু। মনে হতে পারে উন্মুক্ত প্রান্তর, উপরে ধাতব আচ্ছাদন নেই। এবং তার জন্য প্যালেস গ্রাউণ্ডে একমাত্র ভ্রমণের সময় যে আবহাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেটা অনুভব করার দরকার নেই। এখানে আছে চমৎকার লন, গাছপালা, ফুটপাথ যেন তিনি তার নিজ গ্রহ হ্যাঁলিকনে নিজের পুরনো কলেজের ক্যাম্পাসে হেঁটে বেড়াচ্ছেন।
আজকের দিনের জন্য বেছে নেয়া হয়েছে মেঘের বিভ্রম এবং সূর্যের আলো (অবশ্য কোনো সূর্য নেই, শুধুই আলো) ক্ষণে ক্ষণেই মিলিয়ে যাচ্ছে আবার ফিরে আসছে। এবং বাতাস কিছুটা ঠাণ্ডা খুবই সামান্য।
সেলডনের মনে হলো আজকাল খুব দ্রুত শীতকাল চলে আসে, অন্তত যে। ধরনের ঋতুচক্রের সাথে তারা অভ্যস্ত তারচেয়েও দ্রুত। ট্রানটর কি এনার্জি বাঁচিয়ে রাখছে? প্রতিটি ক্ষেত্রে কি দক্ষতা কমে যাচ্ছে? নাকি (ভাবনাটা মাথায় আসতেই তিনি মনে মনে ভুরু কুঁচকালেন) তিনি বৃদ্ধ হয়ে পড়ছেন? জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে কাঁধ সামান্য উঁচু করে হাঁটতে লাগলেন।
সাধারণত: বাড়ি ফেরার সময় পথের দিকে খুব একটা মনযোগ দেন না তিনি। তার দেহ অফিস থেকে কম্পিউটার রুম, সেখান থেকে বাড়িতে ফেরার পথটুকু খুব ভালো করেই চিনে রেখেছে। বরং এই সময়টাতে তিনি অনেক বিষয় নিয়ে ভাবনা চিন্তা করেন, কিন্তু আজকে একটা শব্দ তাকে ভাবনার জগৎ থেকে ফিরিয়ে আনল। অর্থহীন একটা শব্দ।
জো… জো… জো… জো…
মৃদু এবং অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে কিন্তু তার সব মনে পড়ে গেল। হ্যাঁ, এমারিলের সতর্কবাণী। সেই বক্তৃতাবাগীশ। সে কি ক্যাম্পাসে এসেছে?
কোনো কিছু ভাবার আগেই সেলডনের পদযুগল শব্দের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে যাওয়ার ঢালু পথ বেয়ে উঠতে লাগলেন। খেলাধুলা এবং আরো বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য এই মাঠ ব্যবহার করা হয়।
মাঠের ঠিক মাঝখানে ছাত্রছাত্রীদের বেশ বড় একটা ভিড়। সবাই প্রবল উৎসাহে সুর করে কোনো একটা শব্দের স্তব করছে। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে তিনি চিনতে পারলেন না, লোকটার কণ্ঠস্বর জোড়ালো এবং আবেগপূর্ণ।
না, এই লোক জোরানিউম নয়। জোরানিউমকে তিনি বেশ কয়েকবার হলোভশনে দেখেছেন, বিশেষ করে এমারিল সতর্ক করে দেয়ার পর আরো খুঁটিয়ে দেখেছেন। জোরানিউম দীর্ঘদেহী এবং ঠোঁটে সবসময়ই একটা চাতুর্যপূর্ণ হাসি লেগে থাকে। তার চুল ঘন এবং রংটা বালির মতো। চোখের রং হালকা নীল।
কিন্তু এই লোকটা বেটে এবং হালকা পাতলা গড়নের, প্রশস্ত মুখ, কালো চুল, জোড়ালো কণ্ঠস্বর। কোনো কথাই শুনছেন না সেলডন তবে একটা বাক্য তার কানে ঢুকল, “পাওয়ার ফ্রম দ্য ওয়ান টু দ্য মেনি।” অনেকগুলো কণ্ঠ তার সাথে সুর মিলাল।
চমৎকার, ভাবলেন সেলডন। কিন্তু কাজটা সে কিভাবে করবে এবং সে কি এই ব্যাপারে সত্যি আন্তরিক?
ভীড়ের পিছন প্রান্তে পৌঁছে গেলেন তিনি, আশে পাশে তাকালেন পরিচিত কেউ আছে কিনা দেখার জন্য। ফিনানজিলসকে দেখতে পেলেন, গণিত বিভাগের আন্ডার গ্র্যাজুয়েট। ভালো ছাত্র, ভেড়ার পশমের মতো ঘন চুল। ছেলেটাকে ডাকলেন তিনি।
সেলডনের ডাক শুনে ফিনানজিলস কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল, যেন কম্পিউটারের কী বোর্ড ছাড়া সেলডনকে চিনতে তার কষ্ট হচ্ছে। তারপর বলল, “প্রফেসর সেলডন, আপনিও বক্তৃতা শুনতে এসেছেন?”
“আমি আসলে দেখতে এসেছি এখানে গোলমাল কিসের। লোকটা কে?”
“ও হচ্ছে নামাত্রি, প্রফেসর। জো-জোর দলের লোক।”
সেলডন আবার কিছুক্ষণ শ্রোতাদের সুর করে বলা স্লোগান শুনলেন। বক্তা কিছুক্ষণ পরপরই তাদের মুখে একটা করে বাক্য তুলে দিচ্ছে আর শ্রোতারা সবাই তা জোরালো কণ্ঠে স্লোগান দিয়ে শেষ করছে। “নামটা অপরিচিত। কোন ডিপার্টমেন্টের?”
“বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ না, প্রফেসর, ও হচ্ছে জো-জোর লোক।”
“বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্য না হলে এখানে বিনা অনুমতিতে রাজনৈতিক সমাবেশ করার কোনো অধিকার নেই ওর। তোমার কি মনে হয় অনুমতি আছে?”
“আমি কিভাবে বলব, প্রফেসর?”
“বেশ, দেখা যাক আছে কি না।” ভিড় ঠেলে এগোতে শুরু করলেন সেলডন, কিন্তু ফিনানজিলস বাধা দিল, “কিছু করতে যাবেন না, প্রফেসর। ওর সাথে গুন্ডা আছে।”
বক্তার পিছনে ছয়জন তরুণ। পা অনেকখানি ছড়িয়ে দাঁড়ানো, হাত বুকের উপর বাধা, ভুরু কুঁচকে রেখেছে।
“গুণ্ডা?”
“যদি কেউ বাহাদুরি দেখানোর চেষ্টা করে তাদেরকে ঠেকানোর জন্য।”
“তার মানে সে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্য নয় এটা নিশ্চিত এবং কর্তৃপক্ষের অনুমতি থাকলেও তা দিয়ে সাথে গুন্ডা নিয়ে আসার দোষ কাটবে না–ফিনানজিলস, সিকিউরিটিকে খবর দাও।”
“আমার ধারণা ওরা কোনো ঝামেলা চাইছে না,” বিড় বিড় করে বলল ফিনানজিলস। “প্রফেসর, দয়া করে আপনি নিজে কিছু করতে যাবেন না। সিকিউরিটিকে খবর দিচ্ছি আমি। কিন্তু ওরা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।”
“হয়তো ওরা আসার আগেই আমি খেলাটা শেষ করে দিতে পারব।” ভিড় ঠেলে এগোতে লাগলেন তিনি। খুব একটা সমস্যা হলো না। ভীড়ের অনেকেই তাকে চিনতে পেরেছে। যারা চেনে না তারাও সেলডনের কাঁধে লাগানো প্রফেসরিয়াল ব্যাজ দেখে তাকে পথ করে দিল।