“অন্তৰ্জান বলে একটা কথা আছে হ্যারি।”
“সবসময়ই ছিল। আমাদের দরকার আরো বড় কিছু, তাই না? আমাদের দরকার নিখুঁত গাণিতিক সমাধান, যা নির্দিষ্ট এই শর্ত বা ওই শর্তের অধীনে ভবিষ্যতের সুনির্দিষ্ট কিছু সম্ভাবনা আমাদের সামনে তুলে ধরবে। যদি অন্তৰ্জ্জনই যথেষ্ট হতো তাহলে আমাদের সাইকোহিস্টোরির কোনো প্রয়োজনই ছিল না।”
“এটা শুধু এই শর্ত বা ওই শর্তের কোনো বিষয় নয়। আমি দুটোর কথাই বলছি : দুটোর সংমিশ্রণ, যা হয়তো আরো ভালো হবে, অন্তত নিখুঁতভাবে সাইকোহিস্টোরি গড়ে উঠার আগ পর্যন্ত।”
“যদি কখনো হয়,” সেলডন বললেন। “কিন্তু ডেমারজেলের কি বিপদ হবে? কেন তার ক্ষতি হবে বা তাকে অপসারিত করা হবে। আমরা কি তার অপসারণ নিয়ে কথা বলছি?”
“হ্যাঁ,” এমারিলের মুখাবয়বে গাম্ভীর্য আরো অটুট হয়ে বসল।
“তাহলে খুলে বল। মুখকে একটু জ্ঞান দাও।”
লজ্জা পেল এমারিল। “হ্যারি, তুমি আসলে অতিরিক্ত সৌজন্য দেখাচ্ছ। কোনো সন্দেহ নেই যে জো-জো জোরানিউমের নাম তুমি শুনেছ।”
“অবশ্যই। বক্তৃতা বাগীশ নেতা–দাঁড়াও, লোকটা যেন কোত্থেকে এসেছে, নিশায়া, ঠিক? একেবারেই গুরুত্বহীন একটা গ্রহ, ছাগল পালনই তাদের একমাত্র পেশা, এবং খুব সম্ভবত উন্নতমানের পনির উৎপাদনের সুনাম আছে।”
“হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। কিন্তু শুধু বক্তৃতাবাগীশই নয়, অনেক বড় একটা দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে সে এবং দলটা দিনে দিনে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠছে। সে প্রচার করছে যে তার লক্ষ্য হলো সামাজিক ন্যায় বিচার এবং রাজনীতিতে জনগণের আরো ব্যাপক সক্রিয় অংশগ্রহণ।”
“আমিও সেইরকমই শুনেছি,” সেলডন বললেন। “তার শ্লোগান হলো : সরকার জনগণেরই অংশ।”
“পুরোপুরি ঠিক হয়নি, হ্যারি। সে বলছে : জনগণই সরকার।”
মাথা নাড়লেন সেলডন। “চমৎকার, তুমি জানো আমি এই ধারণার সাথে পুরোপুরি একমত।”
“আমিও, যদি জোরানিউম এর উদ্দেশ্য সত্যি সত্যি তাই হতো। কিন্তু সে শুধু নিজের স্বার্থ হাসিল করতে চাইছে। এটা একটা পথ, কোনো লক্ষ্য নয়। সে ডেমারজেলকে সরাতে চায়। তারপর ক্লীয়নকে সামলানো তো সহজ ব্যাপার। জোরানিউম সিংহাসনে বসবে এবং তখন সে-ই হবে জনগণ। তুমিই আমাকে বলেছ। যে ইম্পেরিয়াল ইতিহাসে এমন উদাহরণ অনেক আছে–আর এম্পায়ার এখন আগের চেয়েও অনেক বেশি দুর্বল এবং রুগ্ন হয়ে পড়েছে। গত শতাব্দীতে যে ক্ষুদ্র সমস্যা এম্পায়ারের গায়ে সামান্য আঁচড়ও কাটতে পারত না এখন তাই হয়তো। এম্পায়ারকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেবে। শুরু হবে চিরস্থায়ী গৃহযুদ্ধ এবং পরিত্রাণের উপায় হিসেবে সাইকোহিস্টোরি কোনোদিনই গড়ে উঠবে না।
“হ্যাঁ, তোমার কথা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু ডেমারজেলকে সরানো নিশ্চয়ই এতো সহজ হবে না।”
“তুমি জানো না জোরানিউম দিনে দিনে কতটা ক্ষমতাশালী হয়ে উঠছে।”
“কতটা ক্ষমতা অর্জন করতে পারছে সেটা কোনো ব্যাপার নয়।” সেলডনের চেহারায় একটা ছাপ ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। “অবাক লাগছে ওর বাবা মা ওর নাম রেখেছে জো-জো। কেমন ছেলেমানুষী নাম।”
“এখানে ওর বাবা-মায়ের কোনো দোষ নেই। ওর আসল নাম ছিল লাসকিন, নিশায়াতে বেশ প্রচলিত এই নাম। সে নিজেই জো-জো নাম বেছে নিয়েছে, সম্ভবত তার নামের শেষ অংশের প্রথম অক্ষর বলেই।”
“আরো বেশী বোকামী, তোমার কি মনে হয়?”
“আমার তা মনে হয় না। মিছিল, সমাবেশে তার অনুসারীরা চীৎকার করতে থাকে জো… জো… জো… জো–বারবার। সবাই সম্মোহিত হয়ে পড়ে।”
“যাই হোক, সেলডন তার ট্রাই কম্পিউটারের দিকে ফিরে যন্ত্রটা যে বহুমাত্রিক সিমুলেশন তৈরি করেছে তা এ্যাডজাস্ট করতে লাগলেন, “দেখা যাক কি ঘটে।”
“তুমি কিভাবে বিষয়টাকে এতো স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছ? আমি বলছি বিপদটা স্পষ্ট।”
“না, মোটেই তা নয়,” সেলডন বললেন, দৃষ্টি শীতল, বলার ভঙ্গীতে হঠাৎ করেই কাঠিন্য ফুটে উঠেছে। “তোমার হাতে যথেষ্ট প্রমাণ নেই।”
“আর কি প্রমাণ দরকার?”
“সেটা আমরা পরে আলোচনা করব, ইউগো। এখন তুমি তোমার কাজ কর, ডেমারজেল এবং এম্পায়ারের ভাগ্য আমার হাতে ছেড়ে দাও।”
ক্ষুব্ধ হলো এমারিল, কিন্তু সেলড়নের প্রতি তার আনুগত্য প্রশ্নাতীত। “ঠিক আছে, হ্যারি।”
কিন্তু তারপরেও দরজার কাছে গিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াল সে, বলল, “তুমি ভুল করছ, হ্যারি।”
মৃদু হাসলেন সেলডন। “আমার তা মনে হয় না, তারপরেও তোমার সতর্কবাণী আমার মনে থাকবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
কিন্তু এমারিল চলে যাওয়ার পর সেলডনের মুখের হাসি মুছে গেল–আসলেই কি সব ঠিক হয়ে যাবে?
.
২.
এমারিলের সতর্কবাণী সেলডন ভুলেও যান নি আবার খুব একটা গুরুত্ব দিয়েও ভাবেন নি। এরই মাঝে তার চল্লিশতম জন্মদিন নীরবে এসে চলে গেল।
চল্লিশ! এখন আর তিনি তরুণ নন। জীবন এখন আর তার সামনে অনাবিস্কৃত বিশাল প্রান্তরের মতো ছড়িয়ে নেই, হারিয়ে গেছে অতীতের গর্ভে। আট বছর হয়ে গেল তিনি ট্র্যানটরে এসেছেন, কত দ্রুত সময় পার হয়ে গেছে। আরো আট বছর পরে তার বয়স হবে প্রায় পঞ্চাশ। বুড়ো হয়ে গেছেন তিনি।
অথচ এখন পর্যন্ত সাইকোহিস্টোরির আশানুরূপ সূত্রপাতই করতে পারেন নি! ইউগো এমারিল উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে অনেক নিয়মের কথা বলে, অন্তর্জানের উপর নির্ভর করে বেপরোয়া অনুমিতির দ্বারা অনেক সমীকরণ তৈরি করেছে। কিন্তু সেই সমীকরণগুলো কিভাবে পরীক্ষা করে দেখা যাবে? সাইকোহিস্টোরি এখন পর্যন্ত পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান হিসেবেও গড়ে উঠে নি। সাইকোহিস্টোরি পরিপূর্ণভাবে বোঝার জন্য এতো ব্যাপক পরীক্ষার প্রয়োজন যার অন্তর্ভুক্ত থাকবে কোটি কোটি মানুষের গ্রহ, যা শেষ করতে লাগবে শত শত বছর এবং এখানে নৈতিকতার কোনো স্থান নেই।