Site icon BnBoi.Com

ব্ল্যাক ফেয়ারি টেইল – অৎসুইশি

ব্ল্যাক ফেয়ারি টেইল - অৎসুইশি

ব্ল্যাক ফেয়ারি টেইল

০. চোখের স্মৃতি

ব্ল্যাক ফেয়ারি টেইল – অৎসুইশি / ভাষান্তর : সালমান হক
প্রথম প্রকাশ একুশে বইমেলা ২০২০

.

চোখের স্মৃতি

একটা অদ্ভুত দাঁড়কাকের গল্প বলছি শুনুন। শুরুতেই অদ্ভুত শব্দটা দেখে হয়তো বিরক্ত হতে পারেন। ভেবে নিতে পারেন গল্পের চমক বাড়াতে গল্পকার কোন ফন্দি আঁটছে। দাঁড়কাক আবার অদ্ভুত হয় কি করে? দাঁড়কাক তো দাঁড়কাকই! কিন্তু না, কোনরকম বাড়িয়ে বলছি না। এই গল্পের দাঁড়কাকটা অদ্ভুত, কারণ সে মানুষের ভাষায় কথা বলতে পারে। সেটারও উপযুক্ত ব্যাখ্যা আছে বৈকি। দাঁড়কাকটার বাবা মা বাসা বেঁধেছিল এক সিনেমা হলের দেয়ালের খুপড়িতে। সুতরাং একদম ছোটবেলা থেকেই দেয়ালের ফুটোটা দিয়ে সারাক্ষণ সিনেমা দেখেছে কাকটা। মা’র এনে দেয়া। খাবার খেতো আর সিনেমা দেখতে। তার ভাইবোনেরা অবশ্য কখনো সিনেমা দেখার প্রতি আগ্রহী ছিল না। আসলে সিনেমা দেখতে ভালো লাগতো কাকটার। সে সিনেমা দেখতে আর সংলাপগুলো আপনমনে বলতো, এভাবেই মানুষের ভাষায় কথা বলতে শিখে গেল সে।

মেয়েটার সাথে কাকটার দেখা সিনেমা হলটা গুঁড়িয়ে দেয়ার পর। এতদিনের থাকার জায়গা হারিয়ে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে সে। তার বাবা মা আর ভাইবোনেরা আগেই শহরের অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে, একমাত্র সে-ই রয়ে যায়। এখন সে পরিণত বয়স্ক; ডানা ঝাঁপটিয়ে উদ্দেশ্যহীনের মত ঘুরে বেড়াতে থাকে এখান থেকে ওখানে।

উড়তে উড়তেই নীল দেয়ালের ম্যানশনটা চোখে পড়ে তার। সামনে বিশাল বাগান, চারদিকে উঁচু বেড়া। বাড়িটার পাশেই একটা বড়সড় গাছ। ডালগুলোও প্রশস্ত, বিশ্রাম নেয়ার জন্যে একদম যথার্থ। তাই দাঁড়কাকটা নেমে এলো গাছটায়। অনেক ওড়াউড়ি হয়েছে, এবারে একটু বিশ্রাম দরকার।

ডালটার একদম কাছেই বাড়ির দোতলার জানালাটা। ডানা বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। জানালার পাশে বসে থাকা মেয়েটাকে প্রথমে অবশ্য চোখে পড়েনি কাকটার। সাধারণত দেখা যায় যে মানুষের কাছাকাছি গেলেই দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়া হয়। কিন্তু এই মেয়েটা ব্যতিক্রম, মনে হচ্ছে যেন তার অস্তিত্ব চোখেই পড়েনি।

কিছুক্ষণ ডালটায় বসে থেকে মেয়েটাকে দেখলো কাকটা। এর আগে কখনো এত কাছ থেকে কোন মানুষকে দেখেনি সে। হালকা পাতলা গড়নের মেয়েটার ঠোঁট স্ট্রবেরির মতন লাল। জানালার পাশে একটা চেয়ারে বসে শূন্য দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে।

কাকটা একবার ভাবলো ডানা ঝাঁপটে মেয়েটার মনোযোগ আকর্ষণ করবে, কিন্তু বাতিল করে দিল বুদ্ধিটা। মানুষের মনোযোগ আকর্ষণের এর চেয়েও ভালো পদ্ধতি জানা আছে তার।

“আছেন কেমন?”

চমকে উঠলো মেয়েটা। উৎকণ্ঠা আর বিভ্রান্তি ভর করেছে চেহারায়। “কে?” জিজ্ঞেস করলো সে।

কাকটা এতক্ষণে বুঝতে পারলো কেন চোখের সামনে থাকা সত্ত্বেও তাকে খেয়াল করেনি মেয়েটা। সে এখন মেয়েটা থেকে যত দূরে আছে, অন্য কেউ হলে অবশ্যই দেখতে পেতো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, মেয়েটার চোখ আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের চোখের চেয়ে আলাদা। চোখ নেই তার, সে জায়গায় শূন্য দু’টো কোটর। কিছু দেখতে পায় না।

এটাই আমার সুযোগ, কাকটা ভাবলো। মেয়েটা তো আমাকে দেখতে পাবে না, এই সুযোগে কথাবার্তা বলা যাবে। কথা বলতে শেখার পর থেকেই মানুষদের সাথে আলাপ করার ইচ্ছে হয়েছে তার বহুবার। কিন্তু অনেক মানুষেরই বদভ্যাস আছে তার জাতভাইদের ধরে ভেজে খেয়ে ফেলার, তাই আর সাহসে কুলোয়নি।

মেয়েটা যেহেতু দেখছে না যে কে কথা বলছে, সুতরাং এবার সুযোগ নেয়া যেতেই পারে। “কেমন আছেন মিস?” বললো সে খানিকটা গম্ভীর গলায়।

“কে কথা বলছে? কে?”

“ভাববেন না। ক্ষতি করার কোন উদ্দেশ্য নেই আমার। আমি শুধু আপনার সাথে কথা বলতে চাই।”

চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরের মাঝামাঝি গেল মেয়েটা। সামনে হাত বাড়িয়ে শব্দের উৎসের খোঁজ করার চেষ্টা করছে। “আপনি কোথায়?”

জানালাটা খোলাই ছিল। কয়েকবার ডানা ঝাঁপটাতেই ভেতরে পৌঁছে গেল কাকটা। খুবই সুন্দর, সাজানো গোছানো একটা ঘর। দেয়ালে ফ্লাওয়ার প্রিন্টের ওয়ালপেপার, একটা নরম বিছানা আর অগণিত পুতুল। মাঝখানটায় গোল একটা টেবিল। জানালার পাশের চেয়ারটায় বসলো কাকটা।

“আপনার কণ্ঠটা অদ্ভুত শোনাচ্ছে,” মেয়েটা বললল। “আগে কখনো এরকমটা শুনিনি। তবে দ্ৰতাজ্ঞান একদমই কম। মেয়েদের ঘরে প্রবেশের আগে যে দরজায় নক করাটা ভদ্রতা।”

“মাফ করবেন। মাঝে মাঝে এরকম অভদ্রের মতন কাজ করে বসি। আমি তো ছুরি কাঁটাচামচ ব্যবহার করে খেতেও পারি না।”

“তাহলে খান কিভাবে?”

“আমার ঠোঁট দিয়ে ঠুকরিয়ে।”

“ভারি অদ্ভুত তো আপনি,” হেসে বললো মেয়েটা। হাসলে গালে টোল পড়ে তার, ভীষণ মিষ্টি দেখায়। “যাইহোক, আপনার আগমনে খুশিই হয়েছি আমি। কথা বলার মানুষ খুঁজে পাই না, জানেন?”

সেদিন থেকে হাতে(বা ডানায়?) সময় পেলেই মেয়েটার সাথে দেখা করতে আসততা কাকটা। প্রথমদিকে কেবল সিনেমা দেখা শেখে সংলাপগুলো কপচানোর জন্যেই আসততা, কিন্তু কদিন পর আবিষ্কার করলো যে মেয়েটার সাথে কথা বলতে আসলে ভালো লাগে তার।

মেয়েটাকে অন্য আলোয় দেখে সে। বেশিরভাগ মানুষই তাকে দেখলে ইট বা হাতের কাছে যা খুঁজে পায়, ছুঁড়ে মারে। কিন্তু এই মেয়েটা সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকে একা একা, জানালার ধারে। বাইরের শব্দগুলো অনুভবের চেষ্টা করে। তার একাকীত্ব কাকটাকেও পীড়া দেয় যেন।

“হ্যালো মিস,” মেয়েটার উদ্দেশ্যে বললো সে।

সাথে সাথে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার চেহারা। যেন প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে একটু উষ্ণ বাতাসের আবাহন ঘটেছে। “তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না!” পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা হলে যেভাবে কথা বলে সবাই, ওভাবেই কথাটা বললো। এতদিনে কাকটার সাথে তুমি করে কথা বলা শুরু করেছে। সে। “কতবার বলেছি নক করে ভেতরে ঢুকবে!”

মেয়েটার কথা বলার ভঙ্গি ভীষণ আনন্দিত করলো কাকটাকে। ডিম ফেটে বেরুবার পর থেকে আজ অবধি কখনো এরকম অনুভূতি হয়নি। তার মা কখনো তাকে গান গেয়ে শোনায়নি, কেবল কেঁচো ধরে এনে খাওয়াতো। ভাইবোনগুলোও গতানুগতিক পাখিদের মতনই ছিল। জীবন বলতে খাওয়া আর ঘুম তাদের।

সারাজীবন যে সিনেমাগুলো দেখেছে সেখান থেকেই নানারকম গল্প মেয়েটাকে শোনাতে কাকটা। শুধু এই গল্পগুলোর ব্যাপারেই কথা বলতে তারা। নিজের পরিচয় ইচ্ছে করেই গোপন করেছে, সেটার ফলাফল হয়তো ভালো হবে না। বরং বানিয়ে বলেছে অনেক কিছু।

একদিন মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলো সে, “আচ্ছা মিস, আপনার চোখগুলো কোথায় গেল?”

“ছোট বেলার এক দুর্ঘটনায় চোখ দুটো হারিয়েছি,” যথাসম্ভব নিস্পৃহ কণ্ঠে বলে মেয়েটা। “এক রবিবারে বাবা-মা’র সাথে চার্চে গিয়েছিলাম। চার্চটার জানালায় খুব সুন্দর নকশা করা ছিল, পুরোটা সময় সেদিকেই তাকিয়ে ছিলাম আমি, চোখ বড় বড় করে। আর সেটাই ছিল জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। আচমকা জানালার বিশাল কাঁচটা ভেঙে যায়। কিভাবে ভাঙলো তা জানা যায়নি, হয়তো কেউ পাথর ছুঁড়ে মেরেছিল। এক মুহূর্ত আগেই ভাবছিলাম যে জানালাটা কত সুন্দর, আর পরমুহূর্তে ঝরঝর ভেঙে পড়ে গোটা জানালা।”

মেয়েটার কথা শুনে সিনেমা হলের প্রজেক্টরের আলোয় ভেসে বেড়ানো ধূলিকণাগুলোর কথা মনে পড়ে গেল কাকটার।

“দু’টো ধারালো কাঁচের টুকরো বিঁধে যায় আমার দুই চোখে,” মেয়েটা বলে। “বাম চোখে নীল কাঁচ আর ডান চোখে লাল। দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হয় আমাকে, কিন্তু ততক্ষণে আর কিছু করার ছিল না। রক্তপাত বন্ধ করতে আমার দুটো চোখই তুলে ফেলতে হয়। আমার দেখা শেষ দৃশ্যটা ছিল, অজস্র রঙিন কাঁচ বৃষ্টির মত ঝরে পড়ছে। খুবই সুন্দর একটা দৃশ্য।”

কেউ একজন কড়া নাড়লো দরজায়।

“মিস,” কাকটা বললো, “আমার সাথে কথা বলার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। এখন আমাকে আসতে হবে।”

মেয়েটার আপত্তি সত্ত্বেও দ্রুত জানালা গলে বাইরে বেরিয়ে এলো সে।

খুব বেশিদূরে অবশ্য গেল না। জানালার পাশের ডালটায় বসে রইলো। কিছু দেখা না গেলেও ভেতরের শব্দ শোনা যায় এখান থেকে।

কেউ একজন দরজা খুলে প্রবেশ করেছে ভেতরে। “আমি ভাবলাম কারো সাথে কথা বলছিলে তুমি। কেউ এসেছিল?”

কণ্ঠস্বর শুনে মনে হচ্ছে মেয়েটার মা এসেছে।

না দেখলেও কাকটা বুঝতে পারল যে জবাবে কিছু একটা বানিয়ে বলতে বেগ পেতে হচ্ছে মেয়েটাকে। যেরকম অদ্ভুত আনাগোনা তার, এরকমটাই তো হবার কথা। মেয়েটা জানেও না যে সে আসলে কি।

ডানা ঝাঁপটে গাছটা থেকে নেমে পড়লো সে। কিছুক্ষণের মধ্যে বেশ উঁচুতে উঠে গেল। ওপরে অন্তহীন নীল আকাশ আর নিচে ধূসর যান্ত্রিক শহর।

ওকে সব কিছু দেখাতে চাই আমি। আজকের আগে কাকটা বুঝতে পারেনি যে মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলেছে সে।

চোখ দুটো কিভাবে হারিয়েছে সেটা এমন ভঙ্গিতে বলেছে মেয়েটা যেন জীবনের প্রতি আগ্রহই হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু কাকটা যখন সিনেমায় দেখা চমৎকার সব দৃশ্যের বর্ণনা দেয়, একটা প্রশান্তির ভাব ফুটে ওঠে তার চেহারায়। চোখ থাকলে বলা যেত স্বপ্নাতুর দৃষ্টি ভর করছে চোখে। “আমিও দেখতে চাই”, মনে মনে নিশ্চয়ই বলে মেয়েটা।

“আমার স্বপ্নগুলো সব অন্ধকার এখন,” একবার বলেছিল মেয়েটা। এরপরই প্রসঙ্গ বদলে নিজের কষ্ট গোপনের চেষ্টা করে। নিজের প্রিয় বিষয়গুলো কথা বলতে থাকে।

“আপনার কি অন্ধকার ভয় লাগে?” জিজ্ঞেস করে কাকটা।

কিছুক্ষণ ভাবে মেয়েটা, এরপর আলতো মাথা নাড়ে।

মেঘের নিচ দিয়ে উড়ে চলে কাকটা। কোনভাবে যদি তার দৃষ্টিতে আবার রঙ ফিরিয়ে দিতে পারতাম! দরকার হলে পুরো দুনিয়া চষে ফেলবো, রক্তে রাঙিয়ে দেব পথঘাট! তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল সে, শহরের অসংখ্য চোখ থেকে দু’একটা নিয়ে এলে কোন ক্ষতি হবে না।

.

একটা বেকারির ছাদে নেমে এলো কাকটা। আশপাশে নজর বুলাতে লাগলো সতর্ক চোখে। বেকারির পেছনে একটা সবুজ গাছ। ডালগুলো এমন ভাবে বেড়েছে ওটার যেন কোন বডিবিল্ডার নিজের মাসল দেখাচ্ছে। বেকারি মালিক টায়ার দিয়ে বানানো একটা দোলনা ঝুলিয়ে দিয়েছে ডাল থেকে। তার পাঁচ বছর বয়সী ছেলেটা মনে সুখে দোল খায় সেখানে। বর্তমানে অবশ্য ছেলেটাকে উল্টো হয়ে ঝুলতে দেখা যাচ্ছে।

বেকারির ছাদে বসে ছেলেটাকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলো কাকটা। ভেতর থেকে ছেলেটার মায়ের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো কিছুক্ষণ পর, “এখন ঘুমোনোর সময় তোমার! ভেতরে এসো তাড়াতাড়ি।”

সাথে সাথে দোলনা থেকে নেমে ঘরের ভেতরে চলে গেল ছেলেটা।

যে ডাল থেকে দোলনাটা ঝুলছে সেটায় নেমে এলো কাকটা। ওখান থেকে বেকারির দোতলাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেখানে নিজের ঘরে ঢুকে বিছানায় উঠে পড়লো ছোট ছেলেটা।

বেশ, একে দিয়ে শুরু করা যাক তাহলে। সতর্কতা স্বরূপ ছেলেটার ঘুমিয়ে পড়া অবধি অপেক্ষা করলো সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নির্দিষ্ট ছন্দে উঠতে নামতে লাগলো ছেলেটার বুক।

নিঃশব্দে জানালা গলে ভেতরে ঢুকে পড়লো কাকটা। তাজা রুটির ঘ্রাণে ম ম করছে চারদিকে। ছেলেটা এখন গভীর ঘুমে, কাকটার অস্তিত্ব একবারের জন্যেও টের পেল না।

খুব সাবধানে, ছেলেটার ডান চোখ উপড়ে নিল কাকটা। সতর্ক থাকতে হয়েছে যেন তাড়াহুড়োয় উপহারটা নষ্ট না হয়ে যায়।

চমকে জেগে উঠলো ছেলেটা। বাম চোখে দিয়ে কাকটাকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলো তারস্বরে।

“মা! একটা কাক আমার চোখ খেয়ে ফেলছে!”

হন্তদন্ত হয়ে কাকটাকে ধরার চেষ্টা করলো সে এক হাত দিয়ে; তার মায়ের পদশব্দ শোনা যাচ্ছে সিঁড়িতে।

সুযোগ থাকতে থাকতে ডানা ঝাঁপটে ঘরটা থেকে বেরিয়ে পড়লো কাকটা। ঠোঁটে চোখটা চেপে ধরে অনেক উঁচুতে উঠে গেল কিছুক্ষণের মধ্যে। এবারে ম্যানশনটায় ফেরার পালা।

কিন্তু জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকে কাকটা দেখলো ডেস্কের ওপর মাথা দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে মেয়েটা।

কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল কাকটা। ঠোঁটের রক্তাক্ত চোখটা ঘরের মাঝে টেবিলটায় রাখলো প্রথমে, এরপর বললো, “মিস, আপনি কাঁদছেন কেন?”

কাঁপতে কাঁপতে তার দিকে তাকালো মেয়েটা। কণ্ঠস্বর শুনেই বুঝতে পেরেছে সে কোথায় আছে। আমি চাইনি যে তুমি আমাকে এই অবস্থায় দেখো।”

গাল বেয়ে পানি গড়াচ্ছে তার। দৃশ্যটা অনেকটা কাপ থেকে এক ফোঁটা কফি উপচে পড়ার মতন। কাকটার কাছে খুবই সুন্দর লাগলো দৃশ্যটা।

“আজকে আমার সাথে একটা ঘটনা ঘটেছে,” বলে মেয়েটা। “ঘরের মাঝে একটা টেবিল রাখা আছে, দেখেছো নিশ্চয়ই?”

কিছুক্ষণ আগে যে টেবিলটায় চোখটা নামিয়ে রেখেছে সেটার দিকে তাকালো কাকটা। “জ্বি।”

“ওটার ওপরে,” কান্নাভেজা কণ্ঠে বলে অন্ধ মেয়ে, “একটা ফুলদানিতে কিছু ফুল ছিল। আমি ভেবেছিলাম ফুলগুলো একদম তাজা, নীল রঙের।”

আসলে ফুলগুলোর রঙ লাল, বিবর্ণ হয়ে এসেছে।

“আমার মা মিথ্যা কথা বলেছে আমার সাথে।”

“আপনার কি নীল ফুল ভালো লাগে?”

মাথা নাড়ে মেয়েটা। “আমাকে সত্যিটা বললেই তো হতো। বাবা যখন একটু আগে ঘরে এসে বললল লাল ফুলগুলো তো মরে যাচ্ছে মা-তখন সত্যিটা জানতে পারি।”

মেয়েটার কাঁদার দৃশ্য শেলের মত বিধছে কাকটার বুকে।

“কাঁদবেন না, প্লিজ,” বলে সে। “আপনার জন্যে একটা উপহার এনেছি আজকে।”

“উপহার?”

চোখের পানি মুছে ফেলে মেয়েটা। এই ঘরের কোথায় কি আছে সব মুখস্থ তার। মাপা পদক্ষেপে টেবিলটার সামনে পৌঁছুলো সে। এরপর হাতড়াতে হাতড়াতে চোখটা পেয়ে গেল কিছুক্ষণের মধ্যে।

“এটা কি?”

“আপনার কি মনে হচ্ছে হাতে নিয়ে?”

চোখটার ওপর আঙুল বুলিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলো মেয়েটা।

“নরম। নরম আর গোল।”

“আপনার চোখের কোটরে ওটা রাখুন।”

কাঁপা কাঁপা হাতে চোখটা চেহারার কাছে নিয়ে এলো মেয়েটা। “ডান পাশে না বামে?” থেমে জিজ্ঞেস করলো।

“যেটায় ইচ্ছে।”

বাম কোটরে নরম চোখটা ঢুকিয়ে দিল মেয়েটা। সে যেহেতু কিছুই দেখতে পায় না, চোখটা উল্টোভাবে স্থান পেল কোটরে। তবে আটকে রইলো সেখানে, পড়লো না।

“কেমন লাগছে? জানতে চাইলো কাকটা।

“কেমন যেন… শান্ত লাগছে সবকিছু। কিন্তু এটা কি? মনে তো হচ্ছে একটা স্টপার।”

“এটার ব্যাপারে যেন আর কেউ না জানে। কাউকে বলতে পারবেন না যে আমি জিনিসটা এনে দিয়েছি আপনাকে। বাবা-মাকেও না। ওটা চোখে দিয়ে দয়া করে কারো সামনে যাবেন না। বিছানার নিচে লুকিয়ে রাখবেন। আশপাশে যখন কেউ থাকবে না বা কাঁদতে কাঁদতে হয়রান হয়ে গেলে চোখে দেবেন।”

মাথা নেড়ে একবাই হাই তুললো মেয়েটা। তার নতুন চোখটায় হাত বুলালো একবার; ফলে খানিকটা ঘুরে গেলো ওটা।

“ধন্যবাদ, কারাসু, কেন জানে না… হঠাৎই কাকটাকে এই নামে ডেকে উঠলো মেয়েটা। “আপনার উপহারের জন্যে আন্তরিক ধন্যবাদ। শুভরাত্রি।”

বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লো সে।

“শুভরাত্রি,” বলে জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেল কারাসু, নামটা মনে ধরেছে তার। এবারে দ্বিতীয় চোখটা খোঁজার সময় হয়েছে।

*

পরদিন সকালে নতুন একটা উপহার নিয়ে হাজির হলো সে। বাইরের ডালটায় বসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে প্রথমে। যখন নিশ্চিত মেয়েটা একা, জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো।

নতুন উপহারটা আগের জায়গায় রেখে দিল কারাসু। “হ্যালো, মিস।”

“তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম!” মেয়েটা বলে উচ্ছ্বসিত স্বরে। “গতরাতে একটা স্বপ্ন দেখেছি আমি! একটা আসল স্বপ্ন! সবকিছু দেখা যাচ্ছিল সেখানে। শেষ কবে রঙিন কিছু দেখেছিলাম ভুলেই গেছি। আর স্বপ্নটাও ছিল দারুণ। স্বপ্নে, একটা বেকারিতে নিজেকে আবিষ্কার করি আমি।”

চোখ বন্ধ করে স্বপ্নের বিস্তারিত বর্ণনা করে সে। কাকটার বুঝতে সমস্যা হয় না কোটর থেকে তার দেয়া চোখটা বের করে নিলেও স্মৃতিটা মগজে গেঁথে গেছে মেয়েটার।

“স্বপ্নে আমি একটা ছেলে। আমার বাবা আটা কাই করছিল আর মা কেক বানাচ্ছিল। খদ্দেররা সবাই ভেতরে এসে আমাকে একবার আদর করে দেয়। খুব খেলছিলাম। এরপরেই নিজেকে বেকারির বাইরের গাছটায় যে দোলনাটা আছে, সেটা থেকে উল্টোদিকে ঝুলন্ত অবস্থায় আবিষ্কার করি।”

দীর্ঘ একটা সময় অন্ধকারে থাকার পর হঠাৎ এই রঙিন দুনিয়ার হাতছানিতে আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠেছে মেয়েটা। কারাসুও খুব খুশি হলো মেয়েটাকে হাসতে দেখে।

“এত সুন্দর ছিল স্বপ্নটা!” বলে মেয়েটা। “আপনার দেয়া স্টপারটা কোটর থেকে খুলতে ইচ্ছে করছিল না। এমনকি জেগে ওঠার পরেও অনেকক্ষণ খুলিনি। ভাববেন না, কেউ দেখেনি। পায়ের শব্দ শুনেই তাড়াতাড়ি লুকিয়ে ফেলি। আমার বিছানার নিচে একটা কাঁচের বয়ামে রেখে দিয়েছি। কিন্তু একটু একাকী লাগলেই স্টপারটা কোটরে ঢুকিয়ে স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করি। প্রথমে শুধু ঘুমোনোর পরেই বেকারিটা দেখতে পেতাম। কিন্তু এখন দিনের বেলাতেও স্বপ্ন দেখি, দিবাস্বপ্ন।”

“মিস, আপনার জন্যে আরেকটা উপহার নিয়ে এসেছি আজকে।”

“আসলেই?”

কারাসু তাকে বললো যে এবারের উপহারটাও স্বপ্নে ভরপুর। আগ্রহের সাথে রক্তাক্ত চোখটা হাতে তুলে নিল মেয়েটা, এরপর বসিয়ে দিল বাম চোখের খালি কোটরে।

“দেখতে পাচ্ছি কারাসু! দেখতে পাচ্ছি,” বুকের কাছে হাত নিয়ে বলে মেয়েটা। যেন ঈশ্বরের দরবারে ধন্যবাদ জানাচ্ছে অপূর্ব দৃশ্যটার জন্যে। “মনে হচ্ছে কেউ যেন নীল রঙ্গে রাঙিয়ে দিয়েছে পৃথিবীটা। চারিদিকে শুধু রঙ আর রঙ। এই স্টপারটার নীল রঙ প্রবেশ করছে। আমার মনেও।”

এবারে কারাসু যে চোখটা নিয়ে এসেছে সেটা একজন বয়স্ক মহিলার। পাহাড়ি অঞ্চলে ফসলি ক্ষেত আর ফুলের বাগানে ঘেরা এক বাড়িতে বাস করে সে। মেয়েটা যখন কারাসুকে বলেছিল যে নীল রঙের ফুল ভালো লাগে তার, তখনই নীলের সমারোহ থেকে পরবর্তী চোখটা নিয়ে আসবে বলে মনস্থির করে সে।

তার পছন্দের সবকিছু তাকে দেখাতে চাই আমি। এমন কাউকে দরকার যে কিনা সবসময় নীল রঙের ফুলের দিকে তাকিয়ে থাকে।

শহরের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎই একটা নীল ফুলের বাগান চোখে পড়ে কারাসুর। সেই বাগানের মাঝে ছোট্ট একটা বাড়ি। আর বাড়ির ভেতরে বয়স্ক মহিলাটা বসে উল বুনে সারাদিন। প্রত্যেক নাতি নাতনীর জন্যে নিজ হাতে কিছু একটা বুনে দিতে ভালো লাগে তার।

একটা গাছে বসে প্রথমে ভেতরের দৃশ্যটা মনে গেঁথে নেয় কারাসু। চোখে চশমা পড়ে রকিং চেয়ারে বসে একমনে বুনে চলছিল মহিলা। জানালার কাছেই একটা ক্যানারি খাঁচার ভেতরে কিচিরমিচির করছে। কিছুক্ষণ পর চশমাটা খুলে পাশের টেবিলে নামিয়ে রাখে সে। দু’হাত দিয়ে নাকের গোড়ায় হাত বুলায় কিছুক্ষণ। এত লম্বা সময় ধরে একমনে কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল নিশ্চয়ই। অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে যায়।

যতটা সম্ভব নিঃশব্দে জানালা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে কারাসু। রকিং চেয়ারটার একপাশের হাতলে এসে বসে। তার ভারে কিছুটা নড়ে ওঠে চেয়ারটা, তবে মহিলার ঘুম ভাঙে না। কোন এক সুখস্বপ্ন দেখতে ব্যস্ত সে। খাঁচার ক্যানারি পাখিটা ডেকে উঠতে যাবে এমন সময় মহিলার চোখের পাতার নিচে ঠোঁট ঢুকিয়ে দে কারাসু…

“কি সুন্দর ফুলের বাগান!” মেয়েটার গলায় খুশির আমেজ। “এবারের স্বপ্নে আমি কাপড় বুনছি। এর আগে কখনো কিছু বুনিনি।”

আরো সুখী দেখতে চাই আমি তাকে আরো চোখ খুঁজে বের করবো। পুরো পৃথিবী দেখাবো। দুনিয়ার সব জায়গা থেকে চোখ এনে দেব! ওর খুশির জন্যে যে কোন কিছু করতে রাজি।

মেয়েটার চোখের আনন্দাশ্রু দেখে মনে মনে ওয়াদা করলো কারাসু, তার বিছানার নিচে রাখা কাঁচের বয়ামটা চোখে পূর্ণ করে দেব আমি। কানায় কানায় পূর্ণ।

১. সেদিনের ঘটনার বিস্তারিত

প্রথম খণ্ড

সেদিনের ঘটনার বিস্তারিত লোকেমুখে শুনেছি কেবল। আমার নিজের কিছু মনে নেই।

সকাল থেকেই পুরো আকাশ ধূসর করে তুষার ঝরছিল। লোক খুব বেশি বের হয়নি বাসা থেকে। যারা বের হয়েছে ছাতা মাথায় দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছুলেই যেন বাঁচে। তবে আমি যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম সেটায় মোটামুটি ভিড়ই বলা চলে।

সেই ভিড়ের মাঝে রাস্তার ওপর হাঁটুতে ভর দিয়ে তুষার হাতড়ে যাচ্ছি। মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি ওপরে আমার মুখটা। কিছু একটা খুঁজছি। পাশেই পড়ে আছে আমার ছাতাটা।

আশপাশে অনেকে থাকলেও কেউই আমার দিকে একবারের বেশি দু’বার তাকাচ্ছে না। আসলে কেউই ঝামেলায় জড়াতে চাচ্ছে না।

তবে কিছুক্ষণ পর এক ভদ্রলোকের বোধহয় আমার ওপর কিছুটা করুণা হলো। এক হাতে একটা ব্রিফকেস এবং আরেক হাতে ছাতা ধরে ছিল সে, অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিল খুব সম্ভবত। তুমি কি কিছু খুঁজছো, মা? জানতে চায় সে।

আমি বোধহয় শুনতে পাইনি তার কথা। কোন জবাব দেইনি।

চোখের কনটাক্ট লেন্স হারিয়ে গেছে? আমি খুঁজতে সাহায্য করবো?

খুঁজতে খুঁজতেই কান্নাভেজা কন্ঠে বললাম, লেন্স না, অন্য কিছু।

তখন লোকটা বুঝতে পারে যে আসলেও কোন সমস্যা হয়েছে আমার। হাতে কোন গ্লোভস না পরেই তুষার হাতড়ে যাচ্ছি। আঙুলগুলো অসাড় হয়ে পড়ছে ঠান্ডায়, কিন্তু আমার কোন প্রতিক্রিয়া নেই।

কতক্ষণ ধরে হাঁটু গেড়ে বসে আছি, জানি না। আমার পিঠেও তুষার জমতে শুরু করেছে। আশপাশের অবস্থা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথাই নেই, শুধু খুঁজে যাচ্ছি একমনে।

আমার কণ্ঠে ভয় আর উৎকণ্ঠা। কোথায় পড়লো?

এসময় লোকটার চোখে পড়লো আরেকটা ব্যাপার। আমার চারদিকের তুষার লাল হয়ে উঠেছে। রক্তের ফোঁটা সবখানে।

তুমি ঠিক আছো? আমাকে জিজ্ঞেস করে সে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় দৃষ্টিতে তার দিকে মুখ ফেরাই তখন।

খুঁজেই পাচ্ছি না। অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছি। আমার বাম চোখটা এখানেই কোথাও পড়েছে…।

রক্ত ঝরছে আমার চোখের কোটর থেকে। সেই অবস্থাতেই জ্ঞান হারালাম।

যেখানে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি, সেখান থেকে কিছুটা দূরে খুঁজে পাওয়া যায় আমার চোখটা। কাদা আর তুষারে মাখামাখি, পথচারীদের পায়ের চাপে পিষ্ট হয়ে সেটাকে আর চোখ বলে মনে হচ্ছিল না।

কয়েক দিন ধরেই ভারি তুষারপাতে বিপর্যস্ত ছিল জনজীবন। বাধ্য হয়েই ছাতা মাথায় বাইরে বের হতে হচ্ছিল সবাইকে। আমিও ছিলাম তাদের মধ্যে। ফুটপাত দিয়ে হাঁটছি, এমন সময় একজনের ছাতার চোখা অংশটা ঢুকে যায় আমার চোখে। অপটিক নার্ভ থেকে ছিঁড়ে আসে চোখটা। অক্ষিকোটর থেকে পড়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে থাকে। উভ্রান্তের মত উপুড় হয়ে সেটা খুঁজতে শুরু করি আমি।

এগুলো সবই পরে রিপোর্টগুলো পড়ে জেনেছি। সরাসরি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে। আমার ব্যাগে থাকা স্কুলের পরিচয় পত্র থেকে নাম জানতে পারে হাসপাতালের স্টাফ-নামি শিরাকি।

আর এভাবেই, জানুয়ারির এক সকালে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলি আমি।

*

চোখ খুলে প্রথমে ঝাপসা দেখছিলাম সবকিছু। সাদা সিলিঙ আর সাদা দেয়ালের একটা ঘরে বিছানায় শুয়ে আছি আমি। গলা অবধি কম্বল টেনে দেয়া।

পাশেই এক ভদ্রমহিলা বসে পত্রিকা পড়ছেন। কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তবে কিছু বললাম না।

খানিকবাদে পত্রিকার পাতা ওল্টানোর ফাঁকে আমার দিকে তাকালেন ভদ্রমহিলা। সাথে সাথে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, হাতের পত্রিকাটা পড়ে গেল মেঝেতে। “নার্স! কাউকে ডাকুন। নামির জ্ঞান ফিরেছে!”

একজন নার্সকে সাথে দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করলেন ডাক্তার। আমাকে কিছু প্রশ্ন করে গেলেন একটানা। ভদ্রমহিলা এখনও পাশে আছেন, শুনছেন সবকিছু।

|||||||||| “কি সমস্যা, নামি?” জিজ্ঞেস করলেন মহিলা। “আশপাশে না তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে ডাক্তার সাহেবের কথা শোনো।”

হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওগুলোয় ব্যান্ডেজ করা। আমার বাম চোখের ওপরেও একটা ব্যান্ডেজ। চেষ্টা করলাম ব্যান্ডেজটা তুলে ফেলার, কিন্তু ডাক্তার এবং নার্স দু’জনেই বাধা দিল এতে।

ঘাড় কাত করে আমার দিকে তাকালেন মহিলা, “নামি?”

নামি যে একটা নাম সেটা বুঝতে পারছি, কিন্তু কার নাম তা জানি না। সেটাই বললাম ওনাদের উদ্দেশ্যে।

“তোমার নাম নামি,” ডাক্তার বললো। “ওনাকে চিনতে পারছো?” পাশের মহিলাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো সে।

একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ, এরপর মাথা ঝাঁকিয়ে না করে দিলাম।

“ইনি তোমার মা,” ডাক্তার বললো।

আবারও তাকালাম ভদ্রমহিলার দিকে। মুখে হাত চাপা দিয়ে রেখেছেন তিনি এখন।

ডাক্তার ব্যাখ্যা করে বললো যে আমার বাম চোখে আঘাত পেয়েছি এবং প্রচণ্ড শকে স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছি।

*

একটা গাড়িতে ভোলা হলো আমাকে। পেছনের সিটে মার পাশে বসেছি। সামনে ড্রাইভিং সিটে বসে আছে অচেনা একটা লোক। কিছুক্ষণ পর আমাকে তিনি বললেন যে তিনিই আমার বাবা।

বেশ কিছুক্ষণ ধরেই নানা বিষয়ে আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে যাচ্ছে মা, জবাবে কি বলি সেটা শোনার অপেক্ষায় আছে। কিন্তু কোন জবাব বেরুলো না আমার মুখ দিয়ে, কারণ সে যেসব বিষয়ে কথা বলছে, সবগুলোই আমার অচেনা, অজানা। হতাশ মনে হলো তাকে।

“একদম চুপচাপ হয়ে গেছো তুমি,” বাবা বললো।

আমাদের বাড়ি দেখতে কেমন, সেটাও বেমালুম ভুলে গেছি। দরজায় নামফলকে বড় করে লেখা ‘শিরাকি। আমাদের পারিবারিক পদবি। জুতো খুলে ভেতরের করিডোরে রাখলাম, কিন্তু সেখান থেকে কোথায় যাবো জানি না।

মা হাত ধরে প্রথমে লিভিং রুমে, এরপর রান্নাঘরে নিয়ে গেল আমাকে। “এখানকার কথা তো মনে আছে তোমার?”

মাথা ঝকালাম আমি।

দোতলায় আরেকটা রুমে আমাকে নিয়ে গেল মা। একটা পিয়ানো রাখা আছে একপাশে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে কোন মেয়ের রুম।

“এবার?” জিজ্ঞেস করলো মা।

রুমটা বেশ সুন্দর লাগছিল আমার কাছে, সেটাই বললাম। তখন মা বলল যে এটা আমার নিজের রুম। ছোটবেলা থেকে এখানেই থাকি।

খুব ক্লান্ত লাগছিল। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে পারবো কিনা জিজ্ঞেস করলাম।

“তোমার নিজের ঘর,” বললো মা। “যা ইচ্ছে করো।”

এতক্ষণে খেয়াল হলো যে কাঁদছে সে।

কিছুক্ষণ পর ছবির কয়েকটা অ্যালবাম আর বেশ কয়েকটা ট্রফি হাতে রুমে প্রবেশ করলো বাবা। প্রতিটা ট্রফি কোন না কোন পিয়ানো

প্রতিযোগিতায় জেতা।

“তোমার কি কিছুই মনে নেই?” জিজ্ঞেস করে সে।

মাথা ঝাঁকালাম আবারো।

অ্যালবামের ছবিতে দেখলাম ছোট্ট একটা মেয়ে হাতে স্কুপ নিয়ে তাকিয়ে আছে ক্যামেরার দিকে। দু’চোখ ভর্তি পানি।

“আমাকে কি ছোটবেলায় অনেক খেপাতো বন্ধুরা?” জিজ্ঞেস করলাম।

“এই মেয়েটা তোমার বান্ধবী ছিল। তুমি হচ্ছো ওর পেছনের জন, এই যে এটা। হাসছো মুখে হাত চাপা দিয়ে।”

এরপর আমাকে আরো কয়েকটা ছবি দেখালো বাবা। কিন্তু ওগুলোর কোনটা সম্পর্কেই কোন স্মৃতি নেই আমার। আমার নিজের বানানো একটা ফুলদানি নিয়ে আসলো সে, তবুও কিছু মনে পড়লো না। নিজের প্রিয় টেডি বিয়ারটার নামও ভুলে গেছি, যেটা মা আমাকে দিয়েছিল। এমনকি নিজের পছন্দের সিনেমার নামটাও!

*

প্রথম প্রথম সাধারণ সব কাজ করতেও বাবা মাকে জিজ্ঞেস করে নিতে হতো আমাকে। জিনিসপত্র কোথায় কোনটা রাখা, কিছুই মনে নেই আমার। সবকিছুতেই অনুমতি চাইতাম। কিন্তু বাবা এক পর্যায়ে বলে যে এটার কোন দরকার নেই।

কিছু করতে গেলেই বিভ্রান্তি আমার সঙ্গী হয়। এক রাতে ওপরতলার বাতি জ্বালাতে গিয়ে বুঝতে পারি যে সুইচবোর্ড কোথায় সেটাও জানি না। এরপর যখন সুইচবোর্ড খুঁজে পেলাম, কোন সুইচটা জ্বালবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তাই বাধ্য হয়ে মাকে জিজ্ঞেস করতে যাই।

“এই যে এটা! কি জিজ্ঞেস করছো তুমি এসব!” চেঁচিয়ে ওঠে সে।

আমি দুঃখিত, মাথা নিচু করে বলি।

বাবার চাইতে মা-ই বেশি কষ্ট করছে আমার স্মৃতিশক্তি ফিরিয়ে আনার জন্যে। প্রতিদিনই দুর্ঘটনার আগে আমি কেমন ছিলাম, সে বিষয়ে বিস্তারিত বলেন। বেশিরভাগ গল্পই তার আর আমার একসাথে কাটানো কোন সময়ের স্মৃতিচারণা।

“মনে আছে একবার খুব বেশি ঠান্ডা লেগেছিল তোমার? অনেকদিন বিছানাতেই থাকতে হয়েছিল?”

মনে নেই।

“মনে আছে কিভাবে তোমার যত্ন নিয়েছিলাম? আপেল কেটে দিয়েছিলাম?”

দুঃখিত মনে নেই।

“কেন মনে নেই?”

“আমি জানি না। সরি।”

“এত সরি সরি বলছো কেন? কত হাসিখুশি একটা মেয়ে ছিলে। নার্সারিতে পড়ার সময় আমার সাথে বাজারে যেতে তুমি। ফেরার পথে সবসময় রুটির ব্যাগটা আমার জন্যে বয়ে আনতে। মনে আছে?”

আবারো মাথা ঝাঁকাই। মনে নেই।

“কাঁদছো কেন? এসব নিয়ে কাদার তো কিছু নেই।”

যখনই আমি কিছু করতে ভুলে যাই বা কিছু একটা মনে করতে পারি না, মা বিড়বিড় করে বলে, “নামি তো এরকম করতো না। নামি তো কিছু ভুলতো না।”

লম্বা একটা সময় বাড়িতেই থাকি আমি। কিন্তু ধীরে ধীরে বাইরে যাওয়া আসাও শুরু করি। কখনো কখনো প্রতিবেশীরা আমার সাথে কথা বলে।

একদিন রাতের খাবারের সময় বাবা আমাকে বলে, “গতকাল মিঃ সাইতোউ তোমাকে হ্যালো বলেছিল। তুমি কিছু বলোনি কেন জবাবে?”

তার চেহারা মনে করার চেষ্টা করলাম।

“লোকে তোমাকে নিয়ে নানারকম কথা বলা শুরু করেছে। তুমি নাকি কেবল তাদের চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকো। অন্তত বাউ তো করতে পারো।”

“খুবই লজ্জাস্কর একটা ব্যাপার,” মা বললো অসন্তুষ্ট চিত্তে। “হ্যাঁ, সবাই জানে যে দুর্ঘটনায় স্মৃতিশক্তি হারিয়েছো তুমি, সেটাও বিবেচনায় রাখা উচিৎ তাদের। কিন্তু লোকে তোমার প্রতিটি চালচলন খেয়াল করে, সুতরাং তোমারও সেভাবেই চলাফেরা করা উচিৎ। আশা করি খুব দ্রুত স্মৃতিশক্তি ফিরে পাবে। ততদিন অবধি পুরনো নামির মত ব্যবহারের চেষ্টাটুকু অন্তত করো।”

একদিন রাতে মা বাবাকে বলাবলা করতে শুনলামঃ

“একটু বেশিই কড়া ব্যবহার করছো তুমি ওর সাথে,” বাবা বলে মার উদ্দেশ্যে। “আমি আর নিতে পারছি না,” মা ফোঁপাতে ফোঁপাতে জবাব দেয়। “মাঝে মাঝে তো মনে হয়, ও আমাদের মেয়ে-ই না।”

*

আরেকদিন রাতের খাবার শেষে বাবা বলে, “তুমি তো পাবলিক স্কুলের ছাত্রী ছিলে। সহপাঠীদের চেহারা বোধহয় ভুলে গেছে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলাম।

“তোমার টিচারদের সাথে ফোনে কথা হয়েছে আমার। চাইলে যে কোন সময় ক্লাসে ফিরে যেতে পারো।

বাবা সিদ্ধান্ত নিল যে দু’দিন পর, সোমবার থেকে স্কুলে যাবো। একাদশ শ্রেণির ছাত্রী আমি।

রুমে গিয়ে স্কুলের ইউনিফর্ম গায়ে চাপালাম। বই আর নোটবুকগুলো খুলে চোখ বুলালাম কিছুক্ষণ। সব ভুলে গেছি।

বইগুলোয় কয়েক পাতা পরপর ছোট ছোট চিরকুট সেঁটে রেখেছিলাম আমি। কিন্তু এখন বড় অপরিচিত লাগছে সেগুলো, মনে হচ্ছে অন্য কেউ করেছে কাজগুলো।

সোমবার চলে এলো দেখতে দেখতে।

রুমে যে সাদা টোট ব্যাগটা ছিল, সেটাই স্কুলের খাতাবইগুলো ঢোকালাম। বাইরে পা রাখবো এমন সময় মা পেছন থেকে বলে উঠলো, “নামি সবসময় ওর ব্যাকপ্যাকটা কাঁধে নিয়ে স্কুলে যায়। তুমিও তাই করো।” এমনভাবে কথাগুলো বললো সে যেন আমি আর নামি পৃথক কোন সত্তা।

একবার ক্ষমাপ্রার্থনা করে দ্রুত উপরে উঠে ব্যাগ পাল্টে নিলাম।

স্কুলের ঠিকানা ভুলে গেছি, তাই বাবা চললো আমার সাথে।

অনেক বড় একটা স্কুল। সরাসরি স্কুলের অফিস রুমে নিয়ে এলো আমাকে বাবা। টিচাররা সারাদিন বাচ্চাদের কি পড়াবেন, সেগুলো ঠিকঠাক করছিলেন। বাবার সাথে তাল মেলানোর জন্যে দ্রুত পা চালাতে হলো আমাকে।

অফিসে আমার ক্লাস টিচার, মিঃ ইওয়াতার সাথে দেখা হলো।

“তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগছে,” বললেন তিনি, এরপরেই চুপ করে গেলেন কিছুক্ষণের জন্যে। “তোমার কাছে হয়তো স্কুলের প্রথম দিনের মত ঠেকছে,” যেন হঠাৎই মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বললেন।

তার উদ্দেশ্যে একবার বাউ করে বের হয়ে গেল বাবা। অফিসের অন্যান্য সব টিচার আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।

“জানি এভাবে সবাই তাকিয়ে থাকায় অস্বস্তিবোধ করছো, আমার বাম চোখের ওপর যে ব্যান্ডেজটা আছে সেদিকে তাকিয়ে কথাটা বললেন মিঃ ইওয়াতা।

“সবার হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি তোমার কাছে। দুর্ঘটনায় স্মৃতিশক্তি হারিয়েছে, এটা সকলেই জানে।”

কিরকম ছাত্রী ছিলাম আমি, জিজ্ঞেস করি।

“তুখোড়। পড়াশোনা, খেলাধুলা সবখানেই দুর্দান্ত। ক্লাসের মধ্যমণি ছিলে তুমি। সুতরাং এত দুশ্চিন্তার কিছু নেই। চলো তাহলে, ক্লাস শুরু হয়ে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যে।”

তাকে অনুসরণ করে অফিস থেকে হলওয়েতে বেরিয়ে এলাম। হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে তার একদম পেছন পেছন হাঁটছি। একাদশ শ্রেণি, সেকশন ১ লেখা একটা ক্লাসরুমের বাইরে থামলেন তিনি। আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি ঠিক আছে তো?”

মাথা নাড়লাম জবাবে।

আমরা ভেতরে ঢোকার আগমুহূর্ত অবধি হইচই হচ্ছিল গোটা ক্লাসে। কিন্তু আমাকে দেখেই পিনপতন নীরবতা নেমে এলো। সবার চোখ আমার ওপর। রুমের মাঝে খালি একটা ডেস্কের দিকে নির্দেশ করলেন মিঃ ইওয়াতা। সেটায় গিয়ে বসলাম আমি।

আমার অবস্থাটা ক্লাসের অন্য সবাইকে ব্যাখ্যা করলেন টিচার। দুর্ঘটনার কারণে কিরকম অসুবিধার মধ্যে পড়েছি সেটাও বললেন। কিন্তু সবাই যে ইতোমধ্যেই জানে তা বুঝতে অসুবিধে হলো না।

হোমরুম পিরিয়ড শেষ হবার পরপরই আমাকে ঘিরে ধরলো সহপাঠীরা। তাদের একজনের চেহারাও চিনতে পারছি না। কিন্তু আমার সাথে এমন ভঙ্গিতে কথা বলছে যেন অনেকদিনের চেনা। তাদের নামটাও জানি না, কিন্তু তারা আমার সম্পর্কে এমন সব কথা জানে যেগুলো আমি নিজেও শুনিনি কখনো।

“নামি!” একজন বললো। “তোমাকে নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো আমাদের!”

“ঠিক আছে তো?” আরেকজন জিজ্ঞেস করে।

কি বলবো ভেবে উঠতে পারলাম না, তাই চুপ থাকলাম। তাদের উৎসাহ হতাশায় পর্যদুস্ত হতে খুব বেশি সময় লাগলো না।

“তুমি মজার মজার কথা বলছো না কেন? হাসছো না কেন, নামি?”

“চেহারা এত গোমড়া করে রেখেছো কেন?”

আমি দুঃখিত। সরি।

আমার সামনের ডেস্কে বসে থাকা মেয়েটা বললো, “তোমার কি আসলেও কিছু মনে নেই?”

না, কিছু মনে নেই।

“সমস্যা নেই, তোমাকে সব বলবো আমি। সবসময় তোমার হোমওয়ার্ক নকল করেছি, সেটার প্রতিদান বলতে পারো। কি হলো? ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন আমার দিকে?”

তোমার নাম তো জানি না।

“মানে? আমি তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড!”

সরি।

“আচ্ছা, বাদ দাও। আমি ইউরি কাতসুরা। মাথায় গেঁথে নাও, ঠিক আছে?”

ধন্যবাদ।

আমাকে আমার ব্যাপারে বললো সে। যে মেয়েটার কথা শুনলাম তাকে মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন একজন। ইউরি বললো যে চমৎকার একজন মেয়ে ছিলাম আমি। কথার ধরণ শুনেই বোঝা যাচ্ছিল যে আমার ভক্ত ইউরি।

“তুমি ছিলে সবকিছুর মধ্যমণি। যখন হাসতে, সবাই নির্ভার অনুভব করতো। মিঃ কামাতার কথা মনে আছে? ঐ হতচ্ছাড়া ইংরেজি টিচারটা?”

মাথা ঝাঁকালাম।

“ইংরেজিতে একটা তর্কে তাকে হারিয়ে দিয়েছিলে তুমি! সবাই খুব খুশি হয়েছিল লোকটাকে হেনস্তা হতে দেখে।”

সেদিন অন্যান্য ক্লাসগুলোও করলাম, কিন্তু বুঝলাম না কিছুই। আমার টিচাররা সবাই উজ্জ্বল দৃষ্টিতে বারবার তাকাচ্ছিল আমার দিকে। বলছিল কত ভালো ছাত্রী ছিলাম আমি। বেশ কয়েকটা প্রশ্নের সমাধান করতে দেয়া হলো, একটাও পারলাম না। তাদের বিড়বিড় করতে শুনলাম, “এটাও ভুলে গেছে।”

ট্রেনে চেপে বাড়ি ফিরলাম। সাথে করে আনা চিরকুটগুলো দেখে দেখে স্টেশন আর রাস্তা মিলিয়ে নিতে হচ্ছে। কিছুই মনে নেই যে।

*

আমার নানা বেঁচে আছেন। মার কাছে শুনেছি অবসর গ্রহণের আগে একটা বড় কোম্পানির মহাপরিচালক ছিলেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই তাই বেশ জানাশোনা আছে।

আমাকে খুবই আদর করতেন নানা। দুর্ঘটনায় চোখ হারানোয় সবচেয়ে বেশি কষ্ট তিনিই পেয়েছেন। একদিন বাবাকে নানার সাথে ফোনে কথা বলতে শুনলাম। আমাকে দেখে কর্ডলেসটা নামিয়ে বাবা বললো, “নামি, নানা বলেছে তোমার বাম চোখের জন্যে খুব তাড়াতাড়ি কিছু করবেন। জাতীয় চক্ষু সংস্থায় তার পরিচিত কয়েকজন আছে।”

বাম চোখ ফিরে পেলে আমার চেহারা আবার আগের মত হয়ে যাবে। বাবার মতে অপটিক নার্ভও সেরে উঠতে পারে। ফলে আবারো দেখতে পাবো হয়তো।

*

“নামি, তুমি কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে। আরো বেশি কথা বলা উচিৎ তোমার।”

স্কুলে সবাই আমাকে এই কথাটা বলে। যতই দিন যায়, আমার সাথে কথা বলার মত সহপাঠীর সংখ্যাও কমতে থাকে।

একজন আমাকে গতদিন দেখা কোন একটা টিভি শো’র ব্যাপারে বিস্তারিত বলা শুরু করলো। অন্য একটা মেয়ে এসে তার হাত ধরে দূরে টেনে নিয়ে ফিসফির করে কিছু বলার সাথে তার চেহারার অভিব্যক্তি বদলে গেল। ফিসফিস করে বললেও আমার শুনতে অসুবিধে হলো না যে কি বলছে মেয়েটা।

‘নামি এখন আর আগের নামি নেই।”

ইউরি বাদে এখন আর কেউ আমার সাথে কথা বলে না। তবে তার উৎসাহের কমতি নেই। একের পর এক অতীতের গল্প করেই চলে। সেই গল্পে যে শুধু আমিই থাকি, তা নয়। এমন অনেকের কথাই বলে, যাদের চিনি না। হয়তো একসময় চিনতাম। দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে এখন সাধারণভাবে শ্বাস ফেললেই অবাক হয়ে যাই মাঝে মাঝে। আমার দিকে তাকিয়ে যে নামিকে দেখার চেষ্টা করে ইউরি, সে হারিয়ে গেছে।

শুধু ইউরি নয়, আমার টিচারদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এখনও পুরনো আমিকে খুঁজে বেড়ায় তারা। যখনই কোন প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানাতে ব্যর্থ হই, মুখটা গোমড়া করে ফেলেন। চেহারা দেখেই বোঝা যায় যে ভীষণ হতাশ হয়েছেন।

“আগের নামি সবকিছু করতে পারতো,” একদিন ইউরি বলে। “সব।”

আসলেই?

“খুবই কিউট ছিল ও। মানে, তোমার চেহারাও একই। কিন্তু কি যেন একটা নেই। এমনকি তোমার সাথে কথা বলতেও আগের মত ভালো লাগে না। মনে হয় যেন বাতাসের সাথে কথা বলছি।”

আমি দুঃখিত।

*

সবাই বর্তমান নিভৃতচারী আমি আর আগের হাস্যোজ্বল, সব কাজে পারদর্শী নামিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন চোখে দেখে।

দুর্ঘটনার পর চোখ খুলে মার চোখে যে উষ্ণতার ছায়া দেখেছিলাম, তা এই কয়দিনে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। বাবা বলে, আগে নাকি আমি আর মা সবসময় একসাথে থাকতাম। যেন দুই বোন।

আমি ঘরে বসে পড়ছিলাম এসময় বাবা আসে।

“তোমাকে এর আগে কখনো টেবিলে বসে পড়তে দেখিনি,” বলে সে। “তবুও পরীক্ষায় কোনদিন কম নম্বর পাওনি।”

আমি যদি খুব পড়াশোনা করে পরীক্ষায় আগের মতন নম্বর পাই, মা কি আবারো আমাকে ভালোবাসবে?

“সেটা পরে দেখা যাবে,” বাবা অনিশ্চিত কণ্ঠে বলে। “এখন চোখ মোছছা তো মা, তোমাকে কাঁদতে দেখতে অভ্যস্ত নই একদমই।”

*

আমার চোখের অস্ত্রোপচারের আগেরদিন নানা এলেন দেখা করতে।

“নামি,” আমাকে দেখেই ডেকে উঠলেন। “একবার আমার জন্যে পিয়ানো বাজাবে? তোমার স্মৃতিশক্তি চলে গেলেও, মাসল মেমোরি থেকে পিয়ানো বাজাতে পারার কথা।”

আমাকে পিয়ানোর সামনে বসিয়ে দিলেন তিনি। বাবা, মা, নানু, মামা আর মামাতো ভাইবোনেরা-সবাই গোল হয়ে ঘিরে আছে আমাকে। একদৃষ্টিতে দেখছে, অপেক্ষা করছে পিয়ানোর সুরের মূর্ঘনায় হারিয়ে যাবার।

কিন্তু পিয়ানোর কি’গুলোতে কেবল হাতড়েই গেলাম, কোন সুর বেরুলো না। খুব তাড়াতাড়ি হতাশ হয়ে মাথা নামিয়ে নিল সবাই।

দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো নানার বুক চিড়ে।

লজ্জায় চেহারা লাল হয়ে গেছে আমার। কান ঝাঁঝাঁ করছে। মনে হচ্ছে। ছুটে পালাই।

আবারো পুরনো নামির গুণগান গাইতে শুরু করলো সবাই মিলে। সেই নামি কখনো হতাশ করেনি তাদের। আগে কেমন ছিলাম, এখন কিরকম আছি-ঘুরেফিরে এটা নিয়েই আলাপ হয়েছে সারাদিন। একটার পর একটা ভুল ধরে গেছে মা।

মাথা উঁচু করার শক্তিও যেন হারিয়েছি। অদৃশ্য হয়ে যেতে পারলে ভালো হতো। স্কুলে গেলেও একই অনুভূতি হয়। সবাই আগের নামির বন্ধু হতে চায়। এখনকার আমির কোন মূল্যই নেই কারো কাছে। এমনকি যারা করুণা করে এখনও কথা বলে আমার সাথে, তারাও আগের নামিকেই খুঁজে ফেরে।

পরদিন একটা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো আমাকে। এর আগে কখনো এই হাসপাতালটায় আসিনি। শহর থেকে কিছুটা দূরে জায়গাটা।

নানাকে জিজ্ঞেস করলাম যে কেন শহরের বড় হাসপাতালগুলোর একটায় নেয়া হয়নি আমাকে।

“তোমার নতুন চোখের বন্দোবস্ত করার জন্যে কিছু বিশেষ উপায় অবলম্বন করতে হয়েছে আমাকে। সেইজন্যেই এই ছোট হাসপাতালটায় আসতে হয়েছে। চিন্তা কোরো না, আসল ডাক্তারই দেখবে তোমাকে”

অস্ত্রোপচারের ঠিক আগে চোখটা দেখলাম একবার। একটা কাঁচের বয়ামের ভেতর থকথকে তরলে ভাসছে। মনে হচ্ছে যেন দেখছে আমাকে।

অ্যানেস্থেশিয়া দেয়া হলো আমাকে। অন্ধকারের গহীন নিরুদ্দেশে হারিয়ে গেলাম কিছুক্ষণের মধ্যে।

.

অন্য কারো চোখ প্রতিস্থাপিত হলো আমার বাম অক্ষিকোটরে। অপটিক নার্ভগুলোও ঠিকঠাক জোড়া লেগে গেল। অস্ত্রোপচারের পর তিনদিন বাম চোখের কাছে হাত নেয়াই নিষিদ্ধ। ব্যান্ডেজের ওপর দিয়ে হাত দেয়া যাবে না। ডাক্তার বারবার করে বলে দিয়েছেন সম্ভব হলে চোখের নাড়াচাড়াও যথাসম্ভব কম করতে হবে।

মাঝে মাঝে মনে হল যে আমার চেহারার বামপাশে কোন অনুভূতিই নেই। মাথাটা কিঞ্চিৎ হেলে আছে বামদিকে।

চারদিন পর চোখের ওপর থেকে ব্যান্ডেজ সরানো হলো। হাঁটাহাঁটি বা নড়াচড়া এখনও একদম নিষিদ্ধ। তবে অনুভূতি ফিরে আসতে শুরু করেছে বামপাশটায়। পঞ্চম দিনে পুরোপুরি অনুভব করতে পারলাম সবকিছু। বাম চোখে অদ্ভুত অনুভূতিটাও দূর হয়ে গেছে একদম।

“ব্যান্ডেজ খুলে ফেললেও, প্রথম প্রথম দেখতে হয়তো কিছুটা অসুবিধে হবে। নার্ভ ঠিকঠাক সাড়া দিতে কিছুটা সময় লাগতে পারে। তবে খুব শিঘ্রই তোমার শরীরের সাথে মানিয়ে নেবে প্রতিস্থাপিত চোখটা, তখন আশা রাখি দেখায় কোন সমস্যা থাকবে না। খবরদার! ভুলেও চোখ কচলাবে না।”

বাম চোখ খোলার পর মনে হলো যেন একটা ধূসর কাঁচের পেছন থেকে দেখছি আমি। সবকিছু বড্ড বেশি উজ্জ্বল মনে হচ্ছে। এখনও বোধহয় এত আলোর সাথে মানিয়ে নিতে পারেনি চোখটা।

আমার কেবিনের দেয়ালের একপাশে একটা ক্যালেন্ডার ঝুলছে। নিচের অর্ধেকে তারিখ আর ওপরের অর্ধেক জুড়ে একটা রঙিন ছবি। ছবিটায় খালি দোলনা দেখা যাচ্ছে।

ক্যালেন্ডারটা আমার বিছানার বিপরীত দিকে বলে সারাদিন মোটামুটি ওটার দিকেই তাকিয়ে থাকি। ব্যান্ডেজ খুলে ফেলার পর প্রথম কয়েকদিন অবশ্য পরিষ্কার দেখতে পেতাম না, সবকিছু ঝাপসা হয়ে যেত। কিন্তু দুদিন পর দোলনার শেকলগুলোও স্পষ্ট দেখতে পেলাম।

এক সপ্তাহ পর বাসায় ফেরার সময় হলো। মা এসেছে আমাকে বাসায় নিয়ে যাবার জন্যে। অস্ত্রোপচারের পর এই প্রথম হাসপাতালে এসেছে সে। নানা একবার এসেছিলেন, কিন্তু খুব বেশিক্ষণ থাকেননি। আসলে কথা বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তাই একরকম বিরক্ত হয়েই চলে গেছেন।

“তুমি কি বাম চোখ দিয়ে দেখতে পাও?” মা জিজ্ঞেস করলো। “দুর্ঘটনার পর তোমার চেহারাটাই বদলে গেছিল। আমার নামিকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না তোমার মধ্যে। এখন আবার আগের মত লাগছে। আশা করি আচার ব্যবহারেও পরিবর্তন আসবে।”

আয়নায় তাকানোর পর প্রথমবারের মতন খেয়াল করলাম যে আমার দু’চোখের রঙ মিলছে না। বাম চোখ পরিষ্কার বাদামি।

আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে একবার সন্তুষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো মা! “দেখতে অন্তত পুরনো নামির সাথে মিল আছে তোমার। খুব সুন্দর, বলে বুকের ওপর হাত ভাঁজ করে রাখলো সে। “এবার তাড়াতাড়ি স্মৃতি ফিরে আসুক ভোমার। মাঝে মাঝে তো মনে হয় তুমি বুঝি নামিই নও। এরকম হয়ে গেছ কেন, বলো তো? নিজের সন্তানকে চোখের সামনে স্মৃতি হারিয়ে ফেলতে দেখার চেয়ে ভয়ানক আর কিছু নেই কোন মা’র জন্যে।”

হাসপাতালের রিলিজ ফর্মে সই করার জন্যে বাইরে বেরুলো মা।

বিছানায় উঠে বসে আবারো ক্যালেন্ডারটার দিকে তাকালাম। মনে হচ্ছে আমার মস্তিষ্ক আর বাম চোখের অপটিক নার্ভের সংযোগ ঠিকঠাকই হয়েছে। তবুও ক্যালেন্ডারটা ঝাপসা দেখাচ্ছে। আসলে কাঁদছি আমি। পাশের টেবিল থেকে একটা টিস্যু তুলে নিয়ে খুব সাবধানে চোখ মুছলাম।

বুকে ভারি হয়ে চেপে বসে রাজ্যের সব কষ্ট। যেন দশ মণী একটা পাথর বাঁধা। মা আর আমার সহপাঠীদের বলা কথাগুলো অনবরত কানে বাজে। পুরনো আমিকে খুব ভালোবাসততা তারা। কিন্তু নতুন আমি তো কিছুই করতে পারে না ঠিকমতো। বেশিরভাগ সময়েই যখন আমার সাথে কেউ কথা বলতে আসে, খুঁজে পাই না যে কি বলবো।

জানি, যখন আমি আমতা আমতা করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করি, তখন কল্পনায় পুরনো নামির ছবি ভাসে তাদের। সবসময় তুলনা করে। চাইলেও ব্যাপারটা খেয়াল না করে পারি না। এরপর মনে হয় যে সেখানে আমার জায়গায় পুরনো নামি থাকলে কতই না ভালো হতো।

ক্যালেন্ডারের দোলনাটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এসব কথা ভাবতে লাগলাম। একটা বাচ্চা মেয়ে বসে আছে দোলনায়।

সবকিছু গোছগাছ করে ফেলতে হবে মা ফিরে আসার আগে। সেই লক্ষ্যে ক্যালেন্ডারটার দিক থেকে চোখ ফেরাতে গিয়ে থমকে গেলাম। প্রথম প্রথম বুঝতে পারলাম না যে কেন থমকে গিয়েছি, কিন্তু যখন বুঝলাম, ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল মেরুদণ্ডের মাঝ বরাবর।

ক্যালেন্ডারের দোলনাটা তো খালি ছিল। কিন্তু এখন দেখছি একটা মেয়ে বসে আছে সেখানে।

গুঙিয়ে উঠে মুখের বাম দিকে হাত দিলাম। স্বাভাবিকের চেয়ে গরম ঠেকলো জায়গাটা। বাম চোখের ওপর দিকটা থেকে থেকে লাফাচ্ছে।

ক্যালেন্ডারের দোলনাটা নড়ে উঠলো এসময়। নিজেকে বোঝানোনার চেষ্টা করছি যে ব্যাপারটা অসম্ভব, এসময় আবারো নড়ে উঠলো ওটা।

বিস্ময়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম, ভেবেছিলাম অন্ধকার নেমে আসবে চোখে। কিন্তু ভুল ভেবেছিলাম। চোখ বন্ধ করার পরেও মেয়েটাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। বলা যায় এখন আরো পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। তবে আরেকটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেল। শুধু আমার বাম চোখই দেখতে পাচ্ছে দৃশ্যটা। ডান চোখ বন্ধ করে শুধু বাম চোখটা খুললাম; হ্যাঁ, দোলনার মেয়েটা আছে।

নিজেকে প্রবোধ দিলাম যে এটা হয়তো দিবাস্বপ্ন। কিন্তু কিসের কি! ছবিটা আরো পরিষ্কার, প্রাণবন্ত হতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা পার্কে।

হাত দিয়ে বিছানার চাদর চেপে ধরে নিশ্চিত হলাম যে এখনও হাসপাতালেই আছি। মেয়েটা ধীরে ধীরে নেমে পড়লো দোলনাটা থেকে। বয়স একদমই কম মেয়েটার, প্রাইমারি স্কুলেও পড়ার বয়স হয়নি বোধহয়। তবে চুলগুলো বেশ লম্বা।

দোলনাটা বেশ পুরনো। দুপাশের শেকলে মরিচা ধরতে শুরু করেছে। পার্কের পেছন দিকে বেশ ঘন একটা বন দেখা যাচ্ছে।

বাঁ চোখের স্বপ্নটা পাল্টে যেতে শুরু করলো এসময়, সেই সাথে স্বপ্নে আমার দেহাবয়বও পাল্টে গেল। যদিও আমি জানি যে সেটা সম্ভব না। হাসিমুখে আমার দিকে এগিয়ে এল মেয়েটা।

এরপর ঢেউ যেভাবে একসময় মিলিয়ে যায় নদীতে, ঠিক সেভাবে স্বপ্নটাও মিলিয়ে গেল। এখন আবারো আগের মত দেখাচ্ছে ক্যালেন্ডারটা। ফাঁকা একটা দোলনা শোভা পাচ্ছে সেখানে।

বমি বমি লাগছে। কি ছিল এটা? স্বপ্ন? ভ্রম? নাকি অন্যকিছু? যখনই ভাবলাম যে দোলনাটা একবার নড়ে উঠেছে, অমনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো আমার বাঁ চোখ।

আবারো ক্যালেন্ডারটার দিকে তাকালাম। স্বপ্নে যা যা দেখেছি তার চেয়ে বেশ কিছু ফারাক চোখে পড়লো এবারের ক্যালেন্ডারে যে দোলনাটা আছে, সেটার শেকলে কোন মরিচা নেই। পেছনে সমুদ্র।

এসময় দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো মা।

অদ্ভুত সব চিন্তা মাথায় নিয়ে হাসপাতাল ছাড়লাম আমি। একবার মনে হয়েছিল ক্যালেন্ডারটা সাথে করে বাসায় নিয়ে আসবো, কিন্তু কিছু বলার সাহস হয়নি।

স্বপ্নে দেখা মেয়েটার হাসি এখনও ভাসছে মানসপটে। ভীষণ আন্তরিক একটা হাসি। খুব প্রিয়জনদের মুখে এ ধরনের হাসি দেখা যায়। এক অচেনা উষ্ণতায় ভরে উঠলো বুকটা। স্মৃতি হারানোর পর থেকে এই প্রথম এরকম অনুভূত হলো।

হাসপাতাল থেকে বেরুনোর সময় আমার চোখে পানি দেখে কিছুটা অবাক হয়ে গেল মা। “কাঁদছো কেন?” সন্দিহান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো।

কি জবাব দেব ভেবে পেলাম না। ঐ অচেনা মেয়েটার হাসি আসলেও বেশ বড়সড় প্রভাব ফেলেছে আমার মনের পর। কিরকম খারাপ একটা অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি ভেবে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিড়ে।

*

হাসপাতাল থেকে ফিরে আবারো পুরনো রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। স্কুলে যাই, ক্লাস করি। কারো সাথে খুব একটা কথাবার্তা হয়না। মোটামুটি একাই সময় কাটে।

দুর্ঘটনার পর প্রথমবার যখন জ্ঞান ফেরে, সবকিছু বড় বিভ্রান্তিকর ঠেকছিল আমার কাছে। আশপাশের সবার আলাপচারিতা শুনে যাচ্ছিলাম কেবল। কিছু না ভেবে বা না অনুভব করেই মাথা নাড়ছিলাম। কিন্তু অপারেশনের পর সেটা বন্ধ করেছি। এখন মোটামুটি পরিস্থিতি বুঝে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছি।

ক্লাসে আমার ডেস্কে বসে পুরনো, আদর্শ নামির কথা জিজ্ঞেস করলাম। নতুন চোখ প্রতিস্থাপনের পরেও খুব একটা সুবিধে করতে পারছি না।

“পুরনো নামি সবার সাথে মজার মজার কথা বলতে, সবাইকে হাসাতো। তোমার মত মুখ গোমড়া করে বসে থাকতো না।”

আসলেও কি এরকমটা করতাম আমি?

“হ্যাঁ, তোমার থেকে পুরো অন্যরকম ছিল সে। অন্য সবকিছুতেও ভালো ছিল। তোমার জন্যে ভলিবল ম্যাচে হেরে গেছি আমরা। পুরনো নামি হলে চাপ দিয়ে প্রতিপক্ষ দলের বারোটা বাজিয়ে দিত।”

ভলিবল কোর্টে চারপাশে অন্যান্য মেয়েরা থাকা সত্ত্বেও নিজেকে একা মনে হচ্ছিল। এতবার ভুল করি যে কেউ আমার হাতে বলই দিতে চাচ্ছিলো না। চোখে বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছিল বারবার। যেন আমি কোর্ট থেকে বের হয়ে গেলেই বাঁচে।

দুই ক্লাসের মাঝে বিরতি চলছে এখন। চারিদিকে হইচই। নিজের ডেস্কে চুপচাপ বসে পরবর্তী ক্লাসের জন্যে অপেক্ষা করছি। এই বিরতিগুলোয় নিজেকে বড় বেশি একা লাগে। নিজের জন্যে নিজেরই করুণা হয়।

চোখ বন্ধ করে হাসপাতালের দেখা সেই মেয়েটার কথা কল্পনা করলাম। আমার উদ্দেশ্যে তার দেয়া উষ্ণ হাসিটা এখনও কিছুটা মানসিক শান্তি জোগায় মনে। তাকে যেন অনুভব করতে পারি। ওরকম অন্ধকার জগতে একদম একা, ভাবতেই বুকের বাঁ পাশটা মোচড় দিয়ে উঠলো। একাকী লাগলেই স্বপ্নটার কথা ভাবি, কিছুটা প্রশান্তি ভর করে চিত্তে।

মেয়েটা কে ছিল আসলে? আসলেও কি কোন স্বপ্ন দেখছিলাম। সেদিনের পর থেকে আজ অবধি আর কোন স্বপ্ন দেখিনি। যদি আমার ভুলে যাওয়া স্মৃতিগুলোর কিছুটা জড়ো হয়ে আমাকে স্বপ্নটা দেখায়, তাহলে বলতে হবে মেয়েটাকে আমি চিনি। নতুবা স্মৃতিতে সে আসবে কি করে?

মাকে তাই জিজ্ঞেস করলাম, লম্বা চুলের ছোট একটা মেয়ের ব্যাপারে কিছু জানো তুমি? বনের পাশে একটা পার্কে দোলনায় বসে থাকে।

“না,” মাখা ঝাঁকিয়ে বলে মা।

এই উত্তর আশা করিনি। স্মৃতিগুলো যদি আসলেও ফিরে আসতে শুরু করে তাহলে এই দুর্দশা থেকে মুক্তি পাবো। পুরনো নামি, যাকে সবাই ভালোবাসে, সে আবার ফিরে আসবে।

*

স্কুল থেকে বাসার ফেরার পথে ট্রেন স্টেশনে দ্বিতীয় দিবাস্বপ্নটা দেখলাম। আসলে এটাকে ঠিক দিবাস্বপ্ন বলা যাবে কিনা, নিশ্চিত নই। কারণ স্বপ্নটা দেখার সময় ঘুমোচ্ছিলাম না আমি, পুরোপুরি সজাগ ছিলাম।

প্লাটফর্মের ধারে হলুদ রঙের কিছুটা স্টিকার লাগানো থাকে। এই স্টিকারগুলোর অন্যপাশে যাওয়া নিষেধ। সেরকমই একটা স্টিকার জুতো দিয়ে খোটাচ্ছিলাম। আমার চারপাশে শত শত স্কুল ছাত্রী। প্রত্যেকেই বাড়ি ফেরার ট্রেনের অপেক্ষা করছে। হাইস্কুলের ছেলেমেয়েরা একসাথে জড়ো হয়ে আড্ডা দিচ্ছে, মাঝে মাঝে হেসে উঠছে উচ্চস্বরে। বারবার মনে হচ্ছে যেন আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে তারা।

ট্রেন আসতে এখনও কিছুটা সময় বাকি।

হঠাৎই খেয়াল করলাম আমার বাম চোখটা গরম হয়ে উঠছে। প্রথমে ভাবলাম মনের ভুল, কিন্তু না, আসলেও গরম হচ্ছে। চোখের শিরাগুলো রীতিমত দপদপ করছে, যেন হৃৎপিণ্ডটা কেউ চোখে বসিয়ে দিয়েছে আমার।

নিজেকে শান্ত করে যা দেখছি সেটার দিকে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করলাম। এখনও রেললাইনের দিকে তাকিয়ে আছি। কিছুক্ষণ আগে যে রেললাইনটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম সেটা ছিল চকচকে। কিন্তু এখন যেটা দেখছি, যেটা বাদামি মরিচায় জীর্ণ।

কিছুক্ষণের মধ্যেই নতুন একটা স্বপ্ন দেখতে শুরু করবো। চোখ বন্ধ করে নিলাম, হাসপাতালের অভিজ্ঞতা থেকে জানি এতে আরো পরিষ্কার দেখতে পাবো স্বপ্নটা।

রেললাইনটা বেঁকে গেছে মনে হলো। যেন ঘাড় কাত করে নিয়েছি আমি। আমার চোখের সামনে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা প্লাটফর্ম এখন। আকাশ দেখে বোঝা যাচ্ছে সন্ধ্যা নামবে কিছুক্ষণের মধ্যে। একটা বনের মাঝে আমি, চারদিকে কেবল সবুজ আর সবুজ।

নিচে সবুজ, ডানে সবুজ, বামে সবুজ, সামনে সবুজ, পেছনে সবুজ। ট্রেনের একটা জীর্ণ বগি নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে বনের মাঝে। দীর্ঘ সময় ধরে পরিত্যক্ত, এটা স্পষ্ট। একটা জানালাতেও কাঁচ নেই। ছাদে ঘাস জন্মেছে। ধীরে ধীরে বনটার অংশ হয়ে যাচ্ছে ট্রেনটা। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় চকচক করছে গাছের পাতাগুলো। গ্রীষ্মকাল বোধহয়।

দৃশ্যটা এত সুন্দর যে দম আটকে গেল এক মুহূর্তের জন্যে। এরকম গভীর কোন বনের স্মৃতি নেই আমার। সীমাহীন দিগন্তেরও কোন স্মৃতি নেই। গত সতের বছরে এরকম কিছু দেখেছি বলে মনে হয় না। সবকিছু একদম নতুন আমার জন্যে। মনের খালি পাতায় চিরদিনের জন্যে আঁকা হয়ে গেল গোটা দৃশ্যটা।

এই স্বপ্নটাও আগের স্বপ্নটার মতনই। আধ-স্বচ্ছ। কেবল বাম চোখ দেখতে পাচ্ছে। ডান চোখ এখনও আগের প্লাটফর্মটাই দেখছে। যেরকমটা ভেবেছিলাম, আমি বাদে আর কারো চোখে পড়ছে না পুরনো বগিটা। ডান চোখ দিয়ে দেখলাম এক ব্যবসায়ী ভদ্রলোক নিবিষ্ট মনে খবর কাগজে পড়ছেন।

বাম চোখের দৃষ্টির সাথে সাথে ট্রেনটাও নড়ছে। পরীক্ষার জন্যে ডানে বামে, উপরে তাকিয়ে দেখলাম। মনে হচ্ছে যেন আমার বাম চোখ এক জায়গায় আর ডান চোখ আরেক জায়গায়।

এসময় হঠাই বগিটার জানালায় কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়ের মুখ দেখতে পেলাম। এরা কি বগিটা খেলার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করে? হাতে লাঠি নিয়ে বগিটার গায়ে সমানে বাড়ি দিচ্ছে তারা। তবে কোন শব্দ শুনতে পেলাম না আমি। শুধু দৃশ্যটুকুই। তবুও মনে হচ্ছে যেন আশপাশের বনের পাতার মর্মর ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি, ঝিঁঝি পোকার ডাক কানে আসছে।

এসময় নড়ে উঠলো গোটা দৃশ্যটা। নিয়মিত তালে দুলতে লাগলো ট্রেনটা। কিছুক্ষণ পর বুঝলাম যে আসলে স্বপ্নের মধ্যে হেঁটে চলেছি বগিটার দিকে। বাস্তবে কিন্তু দাঁড়িয়েই আছি প্লাটফর্মের ওপর। সাবধান থাকতে হচ্ছে, নতুবা ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাবো নিচে।

ধীরে ধীরে বগিটা বড় হচ্ছে চোখের সামনে। বাচ্চাগুলো এখন তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মাটি থেকে আমার চোখের যে অবস্থান, স্বপ্নে আমার বয়সও নিশ্চয়ই অনেক কম। হয়তো বাচ্চাগুলোর সমান।

বগিটার কাছে এসে একটা জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দেয়ার চেষ্টা করলাম পা উঁচু করে। একটা বাচ্চার চোখে স্বাভাবিকভাবেই বিশাল ঠেকছে ট্রেনটা। মরিচার ফাঁক দিয়ে কিছু জায়গায় এখনও রঙ দেখা যাচ্ছে।

এসময় রাগী রাগী চেহারার একটা ছেলে চোখ বড় করে ভেতর থেকে তাকালো আমার দিকে। একটা ছোট্ট হাত উপরে উঠে এলো, আমার নিজের হাত। মানে স্বপ্নে যে বাচ্চাটা ট্রেনের দিকে এগিয়ে গেছে তার হাত আর কি।

হাত বাড়িয়ে জানালাটা ধরার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। অনেক বেশি উঁচুতে। জানালা দিয়ে যে ছেলেটার মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম, সে উধাও হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্যে। যখন ফিরলো তার হাতে ছোট একটা পাথর। সজোরে সেটা ছুঁড়ে দিল আমার দিকে। শব্দ করে চমকে উঠলাম আমি। আমার পাশে দাঁড়ানো লোকটাও চমকে গেল।

স্বপ্নে যে ছেলেটা একটা লাঠি দিয়ে ট্রেনটার গায়ে বাড়ি দিচ্ছিল, সে লাঠিটা ছুঁড়ে মারলো আমার দিকে। আপনা-আপনিই হাত উঠে এলো নিজেকে বাঁচানোর জন্যে।

প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আবিষ্কার করলাম, বাস্তবেও হাত উঠিয়েছি আমি।

এসময় একটা ট্রেন এসে থামলো সামনে। স্বপ্ন দেখা শেষ। পুরোপুরি বাস্তবে ফিরে এসেছি আবার।

*

বাড়ি ফিরে একটা খালি পাতায় স্বপ্নে যা যা দেখেছি তার বিস্তারিত বর্ণনা লিখে ফেলাম। কয়েকটা ছবিও এঁকে রাখলাম। সেই সাথে স্বপ্নটা দেখার সময় এবং স্থান টুকে নিলাম একপাশে।

আমার সন্দেহ, সামনে এরকম স্বপ্ন আরো দেখতে হবে আমাকে।

প্রথমে দোলনায় ঐ মেয়েটাকে দেখলাম। দ্বিতীয় স্বপ্নে পরিত্যক্ত ট্রেনের বগিটা দেখলাম। পরেরবার কি দেখবো কে জানে। হয়তো এগুলো আমার স্মৃতিশক্তি হারাবার পূর্বের অভিজ্ঞতা। কিংবা আগে দেখা কোন সিনেমার দৃশ্যও হতে পারে।

তবে স্বপ্নগুলোর কিছু অদ্ভুত নিয়ম আছে। যেমন, দু’টো স্বপ্নই নির্দিষ্ট একটা দৃশ্যের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বাস্তবে রূপ নিয়েছে। দু’বারই আমার চোখের সামনে যা ছিল, স্বপ্নেও সেরকম একটা কিছু ছিল। যেমন প্রথম স্বপ্নে দোলনাটা আর দ্বিতীয় স্বপ্নে রেললাইন। স্বপ্ন আর বাস্তবের দৃশ্যের সমাপতন ঘটা মাত্র বাঁ চোখে চলতে শুরু করে স্মৃতিটা। যেন কেউ রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে সিনেমা চালিয়ে দিয়েছে।

শুধু বাঁ চোখেই স্বপ্নগুলো দেখি। চোখটাকে রীতিমত গুপ্তধনের বাক্সের মত মনে হতে থাকে আমার সোনাদানার পরিবর্তে এই বাক্স ভর্তি উষ্ণ, আন্তরিক সব স্মৃতি দিয়ে। বেশিরভাগ সময়েই অবশ্য বাক্সটা বন্ধ থাকে। ডান চোখের মতই স্বাভাবিক কাজ করে সেটা তখন। কিন্তু এমন কোন দৃশ্য যদি চোখে পড়ে যেটা চাবি হিসেবে কাজ করবে বাক্সটার জন্যে, অমনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করি।

একটা বাইন্ডারে স্বপ্নগুলোর বিবরণ রাখতে শুরু করলাম।

যে স্বত্তার রূপ ধরে স্বপ্নগুলো দেখি, তার বয়স খুব কম। বগির ছেলেটা পাথর ছুঁড়ে মেরেছিল তার দিকে। এই দৃশ্যের অর্থ বের করতে শার্লক হোমস হতে হবে না। অন্যেরা খেলায় নিতে চাচ্ছিল না বাচ্চাটাকে।

দৃশ্যটা প্রভাবিত করলো আমাকে। সচরাচর স্বপ্ন দেখার কিছুক্ষণের মধ্যেই মানুষ ভুলে যায়। কিন্তু এই স্বপ্নটা স্মৃতির মতো জমাট বেঁধে আছে আমার মস্তিষ্কের এক কোণে। স্বপ্নটার কথা ভাবলেই উদাস হয়ে যাই। বাস্তবে ঐ পরিত্যক্ত বগিটা কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না। অবশ্য আমার নিজের যেহেতু কোন স্মৃতি নেই, সব কিছুই নতুন ঠেকে।

স্মৃতির অভাব বোধ করি সারাক্ষণ। দুর্ঘটনায় জেগে ওঠার পর থেকে খুব বেশি স্মৃতি জমা হয়নি মস্তিষ্কের কোষগুলোতে। নিউরনগুলো যেন শুষ্ক মরুভূমি, খাঁ খাঁ করছে। স্মৃতি এমন একটা জিনিস যেটা মানুষকে নিজের অবস্থান বারবার মনে করিয়ে দেয়। আর সেই স্মৃতিই যদি না থাকে তাহলে নিজেকে ছিন্নমূল প্রতীয়মান হয় বারে বারে।

কিন্তু এই অদ্ভুত স্বপ্নগুলো সেই বিরান প্রান্তর থেকে উদ্ধার করেছে আমাকে। হৃদয়ে স্থান করে নিয়ে প্রশান্তির পরশ দিচ্ছে।

*

ট্রেন স্টেশনের স্বপ্নটা দেখেছি এক সপ্তাহ হতে চললো। আমার স্মৃতির জার্নাল ইতোমধ্যে বিশ পাতা ছাড়িয়ে গেছে। যেমনটা ধারণা করেছিলাম, আসলেও একটার পর একটা স্বপ্ন দেখে চলেছি।

বাক্স আর চাবির যে উপমাটা দিয়েছিলাম, সেটাও ঠিক প্রমাণিত হয়েছে। আমি যা দেখি সেগুলো থেকেই কোন কোন জিনিস চাবি হিসেবে কাজ করে। এমনকি টিভি বা খবরের কাগজের ছবিগুলো থেকেও স্বপ্ন দেখতে শুরু করি মাঝে মাঝে।

যে কোন কিছু বাঁ চোখের স্বপ্নের চাবি হতে পারে–একটা দুধের কার্টন কিংবা ছোট্ট কোন বিড়ালছানার চমকে যাওয়া মুখ। প্রতিবার যখন নির্দিষ্ট দৃশ্যটা দেখি, বাঁ চোখ গরম হতে শুরু করে। আমার নিজের ইচ্ছের ওপর কিছু নির্ভর করে না। যে কোন জায়গায়, যে কোন সময় শুরু হয়ে যেতে পারে। তবে দৃশ্যগুলো ছাড়া ছাড়া। একটায় হয়তো ভাঙা কাঁচের ওপর দাঁড়িয়ে আছি একা একা, অন্যটায় কোন কুকুর তাড়া করেছে আমাকে। আবার আরেক জায়গায় স্কুল মাঠে খেলছি। এরকম।

যতই দিন যাচ্ছে, স্বপ্নের সংখ্যাও বাড়ছে।

একদিন ক্লাসে আমার ডেস্কে বসে একমনে তাকিয়ে ছিলাম রাবারের দিকে। এ সময় গরম হতে শুরু করলো বাঁ চোখটা। আসন্ন স্বপ্নের উত্তেজনায় বুক ধড়ফড় করছে। হয়তো অদ্ভুত শোনাবে, কিন্তু স্বপ্নগুলোর দেখার অপেক্ষায় থাকি আমি। মনে হয় যেন পুরনো কোন পারিবারিক ছবির অ্যালবামের সন্ধান পেয়েছি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বপ্নটা দেখা শুরু করলাম বাঁ চোখে। চোখ বন্ধ করে নিলাম, যাতে পরিষ্কার দেখতে পাই। স্বপ্নে একটা ক্লাসরুমে বসে আছি। আশপাশে যে বাচ্চারা বসে আছে তাদের দেখে আন্দাজ করলাম এই স্বপ্নে আমার বয়স বারো-তেরো। প্রতিটা স্বপ্নেই বিভিন্ন বয়সে আবিষ্কার করেছি নিজেকে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পরীক্ষা শুরু। টিচার সবার ডেস্কে খাতা আর প্রশ্ন বিলি করছেন। স্বপ্নে একটা কাঠের পেন্সিল ধরে আছি আমি। একটা ছেলের হাত এটা, ইউনিফর্ম দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। নিজের নাম লিখলাম পরীক্ষার খাতায়। কাজুয়া ফুইয়ুতসুকি। এরপাশে হাইস্কুলের নাম।

পাশের বিশাল জানালাটা দিয়ে বাইরে তাকালাম একবার। মুষলধারে বৃষ্টি ঝরছে। তবে জানালার কাঁচে প্রতিফলিত ছেলেটার চেহারা মোটামুটি স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। এর আগে কখনো এই চেহারাটা দেখিনি, তবে বুঝতে অসুবিধে হলো না যে স্বপ্নে আমি এই ছেলেটার বাম চোখ দিয়েই সবকিছু দেখি।

এরপরেই মিলিয়ে গেল স্বপ্নটা।

কাজুয়া। নামটা আমার নোটবুকে টুকে নিলাম যাতে না ভুলে যাই। পরীক্ষার খাতায় লেখা হাইস্কুলটার নাম আর আজকের তারিখও লিখলাম। কাগজটা বাইন্ডারে ঢুকিয়ে দিলাম অবশেষে।

সেই রাতে টিভি দেখতে দেখতে বাঁ চোখে স্বপ্নগুলোর কথা ভাবতে লাগলাম।

বাবা এখনও ফেরেনি অফিস থেকে। মার আর আমি একা বাসায়। আমাদের মাঝে ঘনিষ্ঠতা কমছে দিনদিন। মাঝে মাঝে এমন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায় যেন অচেনা কাউকে দেখছে। কথা বলার সামনে নাম ধরেও ডাকে না। শুধু ‘তুমি-তুমি’ করে। সেদিক থেকেও আমাকে আগের নামির থেকে পৃথক করে রেখেছে সে।

রাতের খাবারের পর মনে হলো যে রুমে চলে চাই, কিন্তু মা’র সাথে লিভিং রুমে থেকে গেলাম। রাগ করতে পারে বেচারি। হয়তো আগের নামি’ হতে কখনোই পারবো না, কিন্তু তাকে সঙ্গ দিতে তো দোষ নেই।

টিভিতে হারানো ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটা বিশেষ অনুষ্ঠান দেখাচ্ছে। ডিসপ্লের নিচের দিকে ফ্লোটিং প্যানেলে একটা ফোন নম্বর ঘুরছে কিছুক্ষণ পরপর। কারো কাছে যদি কোন তথ্য থাকে, তাহলে সেই নম্বরে ফোন করে জানানো যাবে।

টেলিভিশন বা কোন অনুষ্ঠান সংক্রান্ত আমার সব স্মৃতি হারিয়ে গেছে। কয়েক মাস হারিয়ে যাওয়া একটা ছেলের ছবি দেখানো হচ্ছে টিভিতে। ক্লাসরুমের স্বপ্নটায় দেখা আমার স্বপ্ন সত্তার ছবিটা ভেসে উঠলো মনের পর্দায়।

স্বপ্নে আমি কাজুয়া নামের একটা ছেলে। তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই সবকিছু দেখি। কোন শব্দ শুনতে পাই না, কেবল ছবি। প্রতিটা স্বপ্নেই কাজুয়া যা দেখেছে বা করেছে, সেগুলো অনুভব করেছি। নির্দিষ্ট বিরতিতে অন্ধকার নেমে আসে দৃশ্যগুলোয়। অর্থাৎ চোখের পলক ফেলি তখন।

এমনটা কিন্তু নয় তৃতীয় কারো দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পুরো ঘটনাটা দেখছি। ঘটনা ঘটার সময়ে সেখানে উপস্থিত থাকি।

হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে গেল। কয়েকটা স্বপ্নে আশপাশের লোকজনের সাথে কথা বলি আমি, কিন্তু কিছু শুনতে পাই না। সুতরাং তারা কি নামে ডাকে আমাকে, সেটাও বোঝা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এখন যেহেতু কাজুয়া নামটা জানি, স্বপ্নগুলো আরো বেশি বাস্তব মনে হয়।

“টেবিল পরিষ্কার করে ফেলি, তুমি আরো দেখবে?” মা উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো এ সময়।

না।

একটা মেয়ের ছবি দেখাচ্ছে এখন টিভিতে। গ্রেড স্কুল বা মিডল স্কুলের ছাত্রী হতে পারে সে। ছবিতে বেশ কয়েকজন মেয়ের সাথে রান্না করতে দেখা যাচ্ছে তাকে। নিশ্চয়ই কোন সামার ক্যাম্পে। অন্যদের চেহারা অবশ্য ঝাপসা করে দেয়া হয়েছে।

হঠাই প্রচণ্ড গরম হয়ে উঠলো আমার বাঁ চোখ। প্রতিবার স্বপ্ন দেখার আগে এরকমটা হয়। তবে এবার উত্তাপের পরিমাণ অনেক বেশ। দপদপ করছে চোখটা।

এতটাই হতচকিত হয়ে পড়লাম যে কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না। চোখ বন্ধও করতে পারছি না। স্থানুর মত তাকিয়ে রইলাম টিভির মেয়েটার দিকে। আমার বাঁ চোখের টিভিটা চালু হয়ে গেল এসময়। দরদর করে ঘাম ছুটছে সারা শরীরে। মনে হচ্ছে খুব অশুভ কিছু একটা ঘটতে চলেছে। এবারে যা দেখবো, সেটা নিশ্চয়ই স্বপ্ন নয়। দুঃস্বপ্ন।

হঠাৎই টিভি স্ক্রিনটা কালো হয়ে গেল। মেয়েটার ছবিও নেই হয়ে গেল সেই সাথে। চোখ স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ফিরে এলো মুহূর্তে। কাঁপতে কাঁপতে মার দিকে তাকালাম। রিমোট কন্ট্রোল তার হাতে।

“টিভি চালু করে রাখবো?”

মাথা ঝাঁকিয়ে না করে দিলাম।

.

সাওরি আর ক্যাফের মালিক কথা বলছে। আমি-মানে কাজুয়া কাউন্টারে

হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কাউন্টারের পাশে একটা ফুলদানিতে কয়েকটা সাদা ফুল। সাওরি আমার দিকে ঘোরার সময় তার হাত লেগে ফুলদানিটা উলটে গেল। ভেতরের পানিতে ভেসে যাচ্ছে কাউন্টার।

স্বপ্নটা এখানেই শেষ। চোখ খুলে হাতের পত্রিকাটা বন্ধ করে রাখলাম। ব্যাগ থেকে একটা নোটবুকের পাতা বের করে স্বপ্নটা সম্পর্কে বিস্তারিত লিখতে শুরু করলাম।

স্বপ্ন দেখার তারিখ : মার্চ ১০

স্বপ্নে যাদের দেখা গেছে : সাওরি, ক্যাফের মালিক।

যেটা দেখে স্বপ্নের শুরু: নিজের ঘরে বসে পত্রিকা পড়ছিলাম। পত্রিকার একটা বিজ্ঞাপনের সাদা ফুলগুলো ট্রিগার হিসেবে কাজ করেছে।

স্বপ্নের বিষয়বস্তু : সাওরি কথা বলছিল ক্যাফের মালিকের সাথে। কাজ করতে করতে তার হাতে পুঁতে লেগে একটা ফুলদানি উলটে যায়। ফুলগুলো মাটিতে পড়ে যায়, কাউন্টারে ছড়িয়ে পড়ে পানি। আমার কফির কাপের নিচেও পানি এসে জমা হয়।

*

স্বপ্নতে যে ক্যাফেটা দেখেছি সেটার নাম মেলানকলি গ্রোভ। কাগজটা আমার বাইন্ডারে ঢুকিয়ে রাখলাম। এই জার্নালটায় নিয়মিত লিখছি দুই সপ্তাহ হতে চললো। এই চৌদ্দ দিনে চক্রবৃদ্ধি হারে মোটা হয়েছে জার্নালটা।

সাওরি হচ্ছে কাজুয়ার বড় বোন। ক্যাফেতে খণ্ডকালীন চাকরি করে সে।

বেশ কয়েকটা স্বপ্নে ঘুরেফিরে একই মানুষদের দেখি। কিন্তু কোন শব্দ শুনতে পারি না বলে তাদের নাম জানার কোন উপায় নেই। সাওরির নাম জেনেছি তার ঘরের বাইরের নামফলক দেখে।

সাওরিকে প্রায়ই দেখি আমি। সে আর কাজুয়া যে ভাইবোন, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।

কোন কোন স্বপ্নে তার বয়স একদম কম আবার কোনটায় রীতিমত পূর্ণবয়স্ক নারী। আমার দৃষ্টিকোণ ওপর নিচ হতে থাকে স্বপ্নের সাথে সাথে। কিন্তু আমাদের বয়স যা-ই হোক না কেন, প্রতিবার একই রকম আন্তরিক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায় সে। প্রথম স্বপ্নে দোলনায় যে মেয়েটাকে দেখেছিলাম, সে-ই সাওরি।

বয়সের সাথে তার চুলের দৈর্ঘ্য আর স্টাইলও পরিবর্তিত হয়। কখনো লম্বা, বেনি করা তো কখনো বব কাট। কিন্তু তার চেহারার একটা বৈশিষ্ট্য বলতে গেলে কখনোই বদলায় না। আজ অবধি যতবার তাকে দেখেছি প্রতিবারই বেচারার নাক একদম টকটকে লাল। সবসময় পানি ঝরে।

বাম চোখে প্রায় সময়েই নাক ঝরতে দেখি তাকে। পাশে টিস্যুর পাহাড় জমে যায় মাঝে মাঝে। শপিংয়ে যায় এক বাক্স টিস্যু নিয়ে। ক্যাফেতে খদ্দেরদের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে নাক ঝারে।

এই ব্যাপারটা বাদ দিলে তার চেহারা খুবই সুন্দর। কিন্তু দিনের বেশিরভাগ সময় নাক ঝরতে ঝারতে চলে যায় তার। অন্যরা তার দিকে তাকিয়ে কি ভাবছে এসব নিয়ে চিন্তা করার সময় কোথায়?

স্বপ্নে প্রায়ই একসাথে হাঁটতে বের হই আমরা। একসাথে কার্ড খেলি। একবার স্বপ্নে দুই ভাইবোনকে ঝগড়া করতে দেখি। দু’জনের চোখ দিয়েই পানি ঝরছে। নাকের পানি চোখের পানি মিশে একাকার অবস্থা সাওরির।

বেশিরভাগ স্বপ্নেই সাওরি আমার চেয়ে লম্বা, কিন্তু একবার একটা স্বপ্নে কাজুয়াকে লম্বা মনে হয়। অর্থাৎ বড় হয়ে গেছে সে, বোনকে ছাড়িয়ে গেছে। আমার নিজের চেয়েও লম্বা কাজুয়া। এমন একটা উচ্চতা থেকে পৃথিবীটাকে দেখি সেটা আগে কখনো সম্ভব হয়নি।

স্বপ্নের ঘটনাগুলো ঘুরেফিরে একই এলাকায় সংঘটিত হয়। আশপাশ দেখলেই বোঝা যায় সেটা। মনে হয় যেন কারো দৈনন্দিন জীবনের ভিডিও করে রাখা কিছু অংশ দেখছি। স্বপ্নগুলোকে আপন করে নেই আমি। এগুলো হচ্ছে স্মৃতি-অতীতের টুকরো অংশ। আমার নিজের যেহেতু কোন স্মৃতি নেই, এগুলোই সই।

*

স্বপ্ন দেখার তারিখ : মার্চ ১৩

স্বপ্নে যাদের দেখা গেছে : সাওরি, আমাদের বাবা-মা।

যেটা দেখে স্বপ্নের শুরু : বইয়ের শেলফের রাখা একটা কটন বাড।

স্বপ্নের বিষয়বস্তু : সাওরি আর আমি একে একে মার কোলে মাথা রাখছি (খুব সম্ভবত মিডল স্কুলে পড়ি দু’জনেই)। কটন বাড দিয়ে আমাদের কান পরিষ্কার করে দিচ্ছেন তিনি। সাওরির পালা আসলে একটু দূরে গিয়ে একটা ট্রাক দিয়ে খেলতে শুরু করি। সাওরি মাথা স্থির রাখতে পারছিল না কিছুতেই, বার বার হেসে মাথা সরিয়ে নিচ্ছিল। ওর সর্দিতে মা’র কোল ভিজে গেছে।

স্বপ্ন দেখার তারিখ : মার্চ ১৪

স্বপ্নে যাদের দেখা গেছে : আমার (কাজুয়া’র) বাবা, তার সহকর্মী।

যেটা দেখে স্বপ্নের শুরু : সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ট্রাক। স্বপ্নটা দেখতে শুরু করার কারণে রাস্তা পার হতে পারিনি আমি।

স্বপ্নের বিষয়বস্তু : হাতে মোটা গ্লোভস পড়ে একটা কাঠের মিলে কাজ করছিল বাবা। আমার দৃষ্টিকোণ বিবেচনায়, কাজুয়া তখন বেশ ছোট। বাবার পরনের কাপড়ে ছোপ ছোপ তেলের দাগ। ট্রাক ভর্তি মোটা মোটা গাছের গুঁড়ি। পাশে তার যে তরুণ সহকর্মী দাঁড়িয়ে আছে, তার পরনেও একই পোশাক। বাবার উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করলাম আমি, কিন্তু হাত উঠিয়ে আমাকে থামিয়ে দিল সে। মুখ নড়ে উঠলো একবার। যেন বলছে ‘এখানে এসো না। খুব বেশি বিপজ্জনক।’

স্বপ্ন দেখার তারিখ : মার্চ ১৫

স্বপ্নে যাদের দেখা গেছে : সাওরি, এক মাঝবয়সী দম্পতি।

যেটা দেখে স্বপ্নের শুরু বাবার ফেলে দেয়া একটা সিগারেটের মাথা।

স্বপ্নের বিষয়বস্তু : স্বপ্নে অচেনা একটা লোকের বাসায় এসেছি আমি আর সাওরি। লোকটা মাতাল। মহিলার হাত থেকে ট্রেটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল সে। বাটি আর গ্লাস উল্টে পড়লো মেঝেতে। সাওরি জড়সড় হয়ে বসে আছে।

*

সাওরি আর কাজুয়া ফুইয়ুতসুকির বসবাস এক পাহাড়ি এলাকায়। অনেকগুলো স্বপ্নেই পাহাড়ি রাস্তায় আবিষ্কার করি নিজেকে। পাশ দিয়ে নেমে গেছে গভীর খাদ।

বাবা-মা’কে নিয়ে চারজনের পরিবার সাওরির। একটা স্বপ্নেও তাদের দাদা-দাদি বা নানা-নানিকে দেখিনি। একটা নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণে পৌঁছুনোর পর স্বপ্নে কাজুয়ার বাবা-মাকেও আর দেখা যায় না। হয়তো অন্য কোথাও চলে যায় তারা।

স্বপ্নে দেখা দৃশ্যগুলোর খুঁটিনাটি টুকে রাখি। ভালো লাগে কাজটা করতে।

প্রায়ই বাবা-মা’র কোলে নিজেকে আবিষ্কার করি। এত ভালো লাগে তখন! উষ্ণতায় মন ছেয়ে যায়। সেই সাথে একরকম অপরাধবোধও কাজ করে। আমার নিজের বাবা-মা’র জন্যে কখনো এই অনুভূতিগুলো খেলা করেনি। তাদের ছেড়ে অন্য একজনের বাবা-মা’র প্রতি এই আন্তরিকতার প্রদর্শনী বিবেকের কাছে ঠিক মনে হয় না।

স্কুলে বা বাসায়, সবসময় একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি কাজ করে ভেতরে ভেতরে। কিন্তু স্বপ্নগুলো সেই অস্বস্তির হাত থেকে রেহাই দেয় আমাকে। যখন মনে হয় যে বাস্তবের চেয়ে স্বপ্নের দুনিয়াটাই বেশি টানে আমাকে, এক অচেনা বেদনায় ভরে ওঠে মন।

যখনই মা বা আমার কোন বন্ধু পুরনো নামির ব্যাপারে কথা বলে, খুবই খারাপ লাগে ভেতরে ভেতরে। মিঃ ইওয়াতা বা পূর্ব পরিচিত কেউ আমার সাথে কথা বলতে আসলে তাদের চোখের দিকে তাকাতে পারি না। তারাও যে আমার প্রতি হতাশ, এ কথা মনে হবার সাথে সাথে পা কাঁপতে শুরু করে। মনে হয় যেন ছুটে পালাই।

“নামি, আজকে ব্ল্যাকবোর্ড মোছার পালা তোমার।”

হ্যাঁ, মুছছি।

কোন সহপাঠীর সাথে এটুকু কথোপকথনেই হাঁপিয়ে উঠি। দিনের প্রতিটা মুহূর্ত কাটে ভয় আর উৎকণ্ঠায়। ঠিকমত কথা বলছি তো? হাসিটা ঠিক ছিল তো? ওদের অসন্তুষ্ট করার মত কিছু করিনি তো? যখনই পিয়ানোর দিকে তাকাই, পরিবারের অন্য সবার সামনে কিছুদিন আগের সেই ব্যর্থতার কথা মনে পড়ে যায়। মনে হয় চিৎকার করে কাঁদি। ছোটখাটো যে কোন কাজে ভয় লাগে।

জানি, এমনটা ভাবা ঠিক যুক্তিসঙ্গত না। তবুও এরকম ভাবনা এসেই যায় মনে। ইচ্ছে করে চিরদিনের জন্যে কাজুয়ার জগতে চলে যেতে।

আমার পক্ষে আর আগের নামি হওয়া সম্ভব নয়। যতই চেষ্টা করি না কেন, পিয়ানো বাজাতে বা পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে পারবো না। জোর করে টিচারদের পছন্দের পাত্রও হওয়া সম্ভব না।

একটা পর্যায়ে হালই ছেড়ে দিয়েছি।

শুধু এটাই না। দুর্ঘটনার পরে জ্ঞান ফিরে নিজেকে যে অবস্থায় আবিষ্কার করেছিলাম, তার চাইতে এখনকার আমির অনেক তফাৎ। শূন্য স্মৃতি নিয়ে পুনরায় জীবন শুরু করা কারো পক্ষে এই অল্প ক’দিনে এতগুলো স্মৃতি বহন করা সম্ভব নয়। উপরন্তু স্মৃতিগুলো এমন একজনের যে কিনা বড় হয়েছে পাহাড়ি অঞ্চলে। আর আমি যে এই শহরের বাইরে আগেও খুব একটা যাইনি এ কথা হলফ করে বলতে পারি।

কুকুর ভয় লাগে আমার। কামড় দেবে এই ভয়ে দূরে দূরে থাকি সবসময়। প্রথম প্রথম বুঝতাম না কেন এমনটা করি।

একদিন মা বলে, “আগে কুকুর কত পছন্দ করতে…”

কিছুদিন পর বুঝতে পারলাম যে বাম চোখে দেখা একটা স্বপ্নের কারণে কুকুর ভয় পাই আমি। আমার বাইরে একটা স্বপ্নের বর্ণনা অনেকটা এরকমঃ

স্বপ্ন দেখার তারিখ : ফেব্রুয়ারি ২৬

স্বপ্নে যাদের দেখা গেছে : একটা বড় কুকুর।

যেটা দেখে স্বপ্নের শুরু : স্কুল থেকে আসার পথে দেখি একটা কুকুরকে হাটাতে বের হয়েছে তার মনিব।

স্বপ্নের বিষয়বস্তু : একটা বড় কুকুর ধাওয়া করে আমাকে। ওটা আমার পায়ে কামড় বসাতে যাবে, এমন সময় স্বপ্নটা মিলিয়ে যায়।

*

তখন থেকেই কুকুরভীতি কাজ করা শুরু করে আমার ভেতরে কাজুয়ার ঘটনাগুলো আমার জীবনকেও প্রভাবিত করতে শুরু করেছে।

ক্লাসের মাঝে ইউরি আমাকে বলে, “মনে হয় যেন একদম অন্য কাউকে দেখছি। তুমি আর তুমি নেই। স্মৃতিশক্তি ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করো দ্রুত, নাহলে সবার পেছনে পড়ে যাবে।”

মাথা নাড়ি আমি। আসলেও সবকিছুতে পিছিয়ে পড়ছি। প্রতিটা মুহূর্তে আগের নামির সাথে এমনভাবে তুলনা করা হয় যে মরে যেতে ইচ্ছে করে। আমার পক্ষে তার প্রতিচ্ছবি হওয়া সম্ভব নয় কোনমতেই।

স্মৃতিশক্তি থাকাকালীন সময়ের একটা ভিডিও আমাকে দেখালো মা। অর্থাৎ পুরনো নামির একটা ভিডিও। তার ধারণা ছিল ভিডিওটা দেখে আমার ভেতরে সুপ্ত স্মৃতিগুলো জেগে উঠবে। বলা বাহুল্য, কাজ করেনি পদ্ধতিটা।

ভিডিওর শুরুতে খুব সুন্দর একটা ড্রেস পরে স্টেজে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে নামিকে। দর্শকদের উদ্দেশ্যে একবার বাউ করে পিয়ানোর সামনে নিপুণ ভঙ্গিতে বসে পড়লো সে। কিছুক্ষণের মধ্যে সুরের মূর্ঘনায় ভরে উঠলো গোটা অডিটোরিয়াম। খুবই সুন্দর একটা সুর। চোখ বন্ধ করে নিলাম। আমার কানের পর্দায় এসে সজোরে বাড়ি খাচ্ছে সুরের তরঙ্গগুলো। নামি আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে পিয়ানো বাজিয়েই চলেছে। অপূর্ব একটা দৃশ্য।

আরেকটা ভিডিওতে দেখা গেল নিজের জন্মদিনের পার্টিতে বন্ধুবান্ধব দ্বারা পরিবেষ্টিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে সে। পার্টিটা আমাদের লিভিং রুমে। অনবরত একে অপরের সাথে কথা বলেছে তারা। গত এক সপ্তাহে আমি যা বলেছি, দশ মিনিটের মধ্যে সে তার থেকে বেশি কথা বলে ফেললো। কথা বলে, গালে টোল ফেলে মুচকি মুচকি হাসে আর কিছুক্ষণ পরপর আশপাশের সবার উদ্দেশ্যে বাউ করে।

আনন্দের এক অদৃশ্য বলয় যেন ঘিরে রেখেছে তাকে। ভিডিওর মেয়েটার চেহারা অবিকল আমার মতন হতে পারে হয়তো, কিন্তু সে একদম ভিন্ন একজন মানুষ। নিজেকে নিকষ অন্ধকারে বন্দী মনে হলো আমার।

*

স্বপ্ন দেখার তারিখ : মার্চ ২১

স্বপ্নে যাদের দেখা গেছে। আমার বাবা মা। কাঠের মিলে কাজ করছে।

যেটা দেখে স্বপ্নের শুরু : হার্ডওয়্যার স্টোরের একটা করাত।

স্বপ্নের বিষয়বস্তু : দুর্ঘটনার কবলে পড়ে বাবা-মা।

হার্ডওয়্যার স্টোরে স্কুলের জন্যে একটা কম্পাস কিনতে যাই আমি। বিশাল দোকানটার ভেতরে অফিস সাপ্লাই সেকশন খুঁজতে খুঁজতে নিজেকে আবিষ্কার করি কনস্ট্রাকশন যন্ত্রপাতির সেকশনে।

সেখানেই একটা তাকে গোল একটা করাত রাখা। সেটা দেখা মাত্র আমার বাঁ চোখ গরম হতে শুরু করে। থেমে, করাতটার প্রতি মনোযোগ দেই আমি।

কারো স্পর্শ ব্যতিরেকেই ঘুরতে শুরু করে করাতটা। আমার ডান চোখে দেখা করাতটা আর বাম চোখে দেখা করাত দু’টোর সমাপতন ঘটায় এমনটা মনে হচ্ছে। স্বপ্নটা শুরু হচ্ছে। চোখ বন্ধ করে ফেললাম।

স্বপ্নে দেখলাম করাতটার আঘাতে কাঠের গুঁড়ি ছিটছে চারদিকে। সুন্দর করে দু’ভাগ হয়ে যাচ্ছে বড় বড় হোয়াইট বোর্ড। বাবার সাথে কাঠের মিলে এসেছি আমি আবার।

বরাবরের মতনই এই স্বপ্নটাও কেবলই ছবি। কিন্তু ছবিগুলো এতটাই বাস্তব যে মনে হচ্ছে কান পাতলেই শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাবো। সদ্য কাটা কাঠের গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা দিল।

সাধারণত বৈদ্যুতিক করাতের সাহায্যে কাঠ কাটে মিলের কর্মীরা। একটা কুঁড়ের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের কাজ দেখছি আমি। বড় বড় ট্রাকে করে বিশাল কাঠের গুঁড়িগুলো গাদাগাদি করে আনা হয়। ওগুলো নামানোর জন্যে আলাদা জায়গা আছে। আমার দৃষ্টিকোণের উচ্চতা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে কাজুয়ার বয়স বেশ কম এই স্বপ্নে।

কিছুক্ষণ পর দেখলাম আমার বাবা-মা একসাথে দাঁড়িয়ে আছে। মা প্রায়ই বাবার সাথে মিলে দেখা করার সময় আমাকে সাথে করে নিয়ে আসে।

একটা বড় ট্রাকের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে বাবা-মা। ট্রাকটার পেছনে বিশাল বিশাল সব গুঁড়ি দড়ি দিয়ে বাঁধা। আমার উদ্দেশ্যে একবার হাত নাড়লো বাবা। তাদের দিকে হাঁটা শুরু করলাম আমি।

এমন সময় কোন প্রকার সতর্কবার্তা ছাড়াই একটা গাছের গুঁড়ি ট্রাক থেকে গড়িয়ে মা-বাবার ওপর পড়ে গেল।

হার্ডওয়্যার স্টোরে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই চিৎকার করে উঠলাম। স্বপ্নটা থামিয়ে দিতে চাইছি, কিন্তু এগুলোর ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই আমার। চোখ কয়েকবার খুললাম আর বন্ধ করলাম। কিন্তু লাভ হলো না, আমার চোখের সামনেই মঞ্চায়িত হয়ে চলেছে দৃশ্যটা।

আমার স্বপ্ন সত্তা স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মিলের এক কোণে। আশপাশ থেকে কয়েকজন মিল কর্মি এসে আমাকে পেছনে সরিয়ে নিল। বিশাল গুঁড়িটার নিচে আটকে পড়া বাবা-মাকে দেখতে পাচ্ছি তখনও। দ্রুত গুঁড়িটা সরিয়ে নেয়া হলো, কিন্তু তাদের কেউই নড়াচড়া করছে না। নিথর পড়ে আছে প্রাণহীন পুতুলের মতন। এজন্যেই কাজুয়ার তুলনামূলক বয়স্ক সত্তার চোখ দিয়ে যে স্বপ্নগুলো দেখি, সেখানে তাদের কোন অস্তিত্ব নেই।

বাবার মাথা থেকে রক্ত ঝড়ছে। পা দু’টো বেঁকে গেছে অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে।

স্বপ্নটা শেষ হয়ে গেল। আবারো স্বাভাবিক দৃষ্টি ফিরে পেলাম বাঁ চোখে। হার্ডওয়্যার স্টোরটার মেঝেতে পড়ে আছি আমি। দোকানের এক কর্মী ছুটে আসছে আমার দিকে। চিৎকার শুনতে পেয়েছে সে।

*

মার্চের শেষদিকে ফলো-আপ টেস্টের জন্যে ছোট হাসপাতালটায় ফিরে এলাম আমি। এর আগেও বেশ কয়েকবার এসেছি কিন্তু মার্চ মাসে আজকেই প্রথম। আমি যেহেতু রাস্তাটা চিনে গিয়েছি তাই একা একাই বাসে চড়ে এসেছি। বাবা মা দুইজনই অবশ্য গাড়ি করে পৌঁছে দিতে চেয়েছিল।

হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে একবার চারপাশে তাকালাম। শহরতলীর বাইরে ছোট্ট একটা হাসপাতাল। আগে কখনো ব্যাপারটা নিয়ে ভাবিনি, কিন্তু কি যেন একটা কিলো আমার কাছে। একে তো বাইরে কোন সাইনবোর্ড নেই। দ্বিতীয়ত, প্রবেশপথের কাছে ঘন গাছগাছালির কারণে গেইটটা দেখাই যায় না। কেউ যদি আগে থেকে না জানে যে এখানে একটা হাসপাতাল আছে, তাহলে চোখেই পড়বে না।

ভেতরে প্রবেশ করে জুতো বদলে হাসপাতালের সবুজ স্লিপার পরে নিলাম। ছিঁড়ে যায়নি বা গর্তবিহীন একটা জোড়া খুঁজলাম কিছুক্ষণ, কিন্তু লাভ হলো না। সবগুলো একই। আমি বাদে ফলো-আপের জন্যে কেউ আসেনি। রিসিপশন ডেস্কে পাথরের মত মুখ করে বসে আছে এক নার্স। বয়স আন্দাজ করা সম্ভব না। শুধু ওয়েটিং রুমটাই না, পুরো হাসপাতালই নিভু নিভু আলোয় আলোকিত।

দোতলার কেবিনটায় থাকাকালীন সময়ে চোখে পড়েনি, কিন্তু এবারে সবকিছু অন্যরকম ঠেকছে। হয়তো আমার পরিবর্তনের ফলাফল এটা।

ডেস্কে বসে থাকা নার্স এক্সামিনেশন রুমে যাওয়ার ইশারা করলো আমাকে। একটা চেঞ্জিং স্ক্রিন, এক্সামিনেশন টেবিল, ডেস্ক আর চেয়ার রাখা রুমটায়।

গোঁফওয়ালা ডাক্তার ডেস্কের পেছনে বসে কিছু কাগজপত্র ঠিকঠাক করেছে। তার উদ্দেশ্যে বাউ করলাম একবার।

একবার আমাকে দেখে আবার হাতের কাগজটার দিকে দৃষ্টি ফিরে গেল তার।

“টেবিলটায় উঠে পড়ো,” বললো সে।

তার কথা অনুযায়ী টেবিলটায় শুয়ে পড়লাম। দৃষ্টি সিলিং বরাবর। ডান পাশে তাকাতেই দেয়ালে ঝোলানো একটা আয়না চোখে পড়লো। সেখানে আমার প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে।

অপারেশনের দিনের কথা ভাবলাম। এরকমই একটা টেবিলে শুয়ে ছিলাম আমি অপারেশন থিয়েটারে। সেখানেই প্রথম চোখটাকে দেখি, যেটা এখন শোভা পাচ্ছে আমার বাম অক্ষিকোটরে।

এর আগে সে জায়গায় একটা গর্ত ছিল কেবল। চোখটা প্রতিস্থাপনের পর আবারো পুরনো নামির চেহারা ফিরে পাই আমি। কিন্তু মিল বলতে ওটুকুই। আর কোন পরিবর্তন আসে না আমার ভেতরে। মা এখনো আগের মতনই হতাশ।

অপারেশনের পর সে বলেছিল, “এই তো আমার নামির আগের চেহারা।” একবার গালও টিপে দেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় রীতিমত চমকে উঠি। খুশিও হই ভেতরে ভেতরে। মা’কে এরকম হাসিখুশিই তো দেখতে চাই সবসময়।

কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায় আমাদের সম্পর্ক। যখনই কোন ভুল করে বসি, যেটা আগের নামি হলে করতো না, মা’র মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। এখন যেহেতু আমার চেহারা পুরনো নামির মত, তার হতাশার মাত্রা আরো বেড়েছে।

হাতের কাজ শেষ করে কাগজগুলো একপাশে সুন্দরমত গুছিয়ে রাখলেন ডাক্তার। আমাকে পরীক্ষা করা শুরু করবেন শিঘ্রই।

আয়নার দিকে তাকাতেই আবারো গরম হতে শুরু করলো আমার বাম। চোখ, আসন্ন স্বপ্নের ইঙ্গিত। আয়নার প্রতিবিম্বটা স্বপ্নের বাক্সের চাবি হিসেবে কাজ করছে এক্ষেত্রে। অপেক্ষা করতে লাগলাম, কিন্তু স্বপ্নের দেখা নেই। সাওরি বা কাজুয়ার সহপাঠীদের চেহারা ভেসে উঠলো না বামচোখে। এখনও সাদা সিলিংই দেখছি।

না! দ্রুত হয়ে উঠলো আমার স্পন্দন। কি যেন একটা ঠিক নেই। এরপরই বুঝলাম কিরকম অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখছি। আমি আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকলেও, আয়নায় আমার প্রতিবিম্বটা তাকিয়ে আছে ছাদের দিকে। নিজেকে আয়নায় এভাবে দেখার অনুভূতিটা ভাষায় প্রকাশ করার মতন না।

আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার চোখে পড়লো। বাঁ চোখের দৃষ্টিটা কিছুটা ঘোলাটে ঠেকছে। যেন পানির মধ্যে দিয়ে তাকিয়ে আছি কোথাও।

হঠাৎই পরিষ্কার হয়ে গেল সবকিছু। আসলে এক্সামিনেশন রুম না, অপারেশন থিয়েটারটা দেখছি আমি বাম চোখে। আর ওটা অপারেশনের আগমুহূর্তে অপারেটিং টেবিলে শুয়ে থাকা আমি।

বিভ্রান্ত হয়ে চোখ বন্ধ করে নিলাম। এবারে আরো পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি সবকিছু। এই দৃশ্যটা স্বপ্নের মত দেখছি কেন আমি? এটা তো কাজুয়ার দেখা কোন দৃশ্য নয়।

অপারেশনের আগের মুহূর্তে কি ঘটেছে তা মনে করার চেষ্টা করলাম। হ্যাঁ, আসলেই তো! একটা কাঁচের জারের ভেতরে তরলে ভাসছিল চোখটা। তরলের কারণেই ঘোলাটে দেখাচ্ছে সবকিছু।

এগুলো কোন স্বপ্ন নয়, এগুলো হচ্ছে চোখটার স্মৃতি। আমি আজ অবধি যে দৃশ্যগুলো দেখেছি সেগুলো কোন স্বপ্ন বা ভ্রম নয়। চোখটার স্মৃতি সবকিছু। রেটিনায় চিরদিনের জন্যে জমা হয়ে আছে স্মৃতিগুলো।

“তোমাকে এতক্ষণ অপেক্ষা করানোর জন্যে দুঃখিত। শুরু করি তাহলে?”

আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন ডাক্তার। মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে বসলাম আমি। বাঁ চোখে এখনও নিজেকে শুয়ে থাকতে দেখছি অপারেটিং টেবিলে। এতক্ষণ চেহারার ডানপাশটা দেখতে পাচ্ছিলাম কেবল, এখন বামদিকটাও পরিষ্কার। আর বাম চোখের জায়গায় একটা গর্ত।

.

বাম চোখ দিয়ে এতদিন আসলে কি দেখছিলাম সেটা পরিষ্কার হয়ে যাবার পর একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম যেন। ডাক্তার সাহেব বোধহয় কিছু প্রশ্ন করলেন আমাকে, কিন্তু কিভাবে সেগুলোর জবাব দিয়েছি জানি না। কিছুক্ষণ পর চেকআপ শেষে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলাম।

আসার পথে একটা বইয়ের দোকানে থেমে হাইস্কুল এন্ট্রান্স পরীক্ষার কয়েকটা বই খুঁজলাম। অবশেষে একটা বই পেলাম যেখানে দেশের সবগুলো স্কুলের নাম আছে। কাজুয়ার পরীক্ষার খাতায় লেখা স্কুলের নামটা খুঁজতে লাগলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে পেয়ে গেলাম যা খুঁজছি। কাজুয়ার স্কুলটার অস্তিত্ব আসলেও আছে।

বাম চোখে স্বপ্নটা দেখার আগে কখনো জানতাম না যে এই নামের কোন স্কুলের অস্তিত্ব আছে। আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে দৃশ্যগুলো সব কল্পনা, অন্য কোন জগতের স্বপ্ন কেবল। কিন্তু এই স্কুলটার অস্তিত্ব আসলেও আছে, আমার নিজের জগতেই।

আমার বাম চোখে দেখা সবগুলো দৃশ্য যদি কল্পনাই হয়ে থাকে, তাহলে এটার ব্যাখ্যা কি? কোথাও কি স্কুলটার নাম শুনেছিলাম, এরপর অবচেতন মনে সেটা নিয়ে ভাবার কারণে স্বপ্নেও দেখেছি? না, এটা বোধহয় সম্ভব না। বরং এতে আরো প্রমাণিত হয় যে বাম চোখে যা দেখেছি সেগুলো পুরোপুরি বাস্তব।

আমার বাম অক্ষিকোটরে প্রতিস্থাপিত হবার আগে চোখটা অন্য কারো ছিল। আমি যে দৃশ্যগুলো দেখেছি, সেগুলো আদতে কাজুয়ার নিজের অভিজ্ঞতা। “স্বপ্নের জার্নাল” নামটা আসলে ভুল দিয়েছি। বরং বাস্তব অভিজ্ঞতার জার্নাল’ নাম দিলেই বেশি মানাতো।

সত্যিটা জানার পর একইসাথে কয়েক ধরনের অনুভূতি কাজ করছে আমার ভেতরে। তবে সবচেয়ে বেশি কাজ করছে বিভ্রান্তি।

আমি এতদিন ভেবে এসেছি স্বপ্নে দেখা জগতটার কোন অস্তিত্ব নেই। ভাবতাম স্বপ্নের জগতে প্রবেশ করা মাত্র এক কাল্পনিক চরিত্রের রূপ নেই আমি-কাজুয়া ফুইয়ুতসুকি। স্বপ্নগুলোকে নিজের স্মৃতিতে যত্ন করে সংরক্ষণ করেছি। আর আমার স্মৃতির কুঠুরিগুলো একদম খালি হওয়াতে, এই স্মৃতিগুলোই আঁকড়ে ধরে রেখেছি প্রাণপণে। মনে হয় যেন সবগুলো আমার নিজের অভিজ্ঞতা। নিজেকে নামি কম কাজুয়া ভাবতাম বেশি।

কিন্তু কাজুয়া তো কাল্পনিক কেউ নয়। সাওরি কিংবা বাম চোখে দেখা অন্যান্য দৃশ্যগুলোরও বাস্তব অস্তিত্ব আছে নিশ্চয়ই। এ কারণেই বিভ্রান্তি জেঁকে বসেছে আমার চিত্তে। হঠাৎই ভীষণ ভয় লাগছে। যতক্ষণ এগুলোকে স্বপ্ন ভাবছিলাম, সাওরিকে সিনেমায় দেখা কোন চরিত্র মনে হচ্ছিল। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, এসব হচ্ছে অতীতে ঘটে যাওয়া বাস্তব ঘটনা। বাম চোখটা সেই ঘটনাগুলোর প্রত্যক্ষদর্শী।

তবে ভয় ছাড়াও আরেক ধরনের অনুভূতির অস্তিত্ব টের পাচ্ছি। আকাঙ্ক্ষা। ভেতরে ভেতরে আসলে আমিও চাইছি যাতে দৃশ্যগুলো বাস্তব হয়।

এতদিন স্বপ্নে যাদের দেখে এসেছি, তারা পরোক্ষভাবে আমাকে উৎসাহ যুগিয়েছে। আমার নিজের যেহেতু কোন স্মৃতি ছিল না, হতাশার মুহূর্তগুলোতে এই স্মৃতিগুলোর আশ্রয় নিয়েছি।

কিছুটা উত্তেজনা কাজ করছে ভেতরে ভেতরে।

আমি যে পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আছি, সাওরিও সেই একই পৃথিবীতে চলাফেরা করে। অথচ এতদিন কাল্পনিক মনে হতো সবকিছু। আমার মাথার ওপরে যে আকাশ, সাওরিও মাথা উঁচু করলে সেই আকাশই দেখতে পায়। হয়তো এ মুহূর্তে আমি যেদিকটায় তাকিয়ে আছি, সে-ও একই দিকে তাকিয়ে আছে।

বাম চোখে আমি কাজুয়ার জীবনের খণ্ড খণ্ড দৃশ্য দেখেছি। স্কুল, ট্রেন স্টেশন, কয়েক জায়গার নাম; আর স্বপ্নগুলোর যাবতীয় খুঁটিনাটি জার্নালে লিখে রেখেছি।

চেক-আপের পরদিন জার্নালটার সবকিছু আবারো মনোযোগ দিয়ে পড়লাম একে একে। কাজুয়া আর সাওরি দেশের কোন প্রান্তে থাকে, সেটা খুঁজে বের করতে খুব বেশি সময় লাগলো না।

আমার শহর থেকে বুলেট ট্রেনে চেপে যেতে আধ দিন সময় লাগবে। একটা অ্যাটলাসে জায়গাটার নাম খুঁজতে লাগলাম। একদম ছোট অক্ষরে লেখা নামটা প্রথমে এড়িয়ে গেলেও, একসময় ঠিকই পেয়ে গেলাম। সমুদ্র থেকে অনেকটা ভেতরে, পাহাড়ি একটা অঞ্চল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম পাতাটার দিকে।

কাজুয়ার বাম চোখ ঐ হাসপাতালে কি করে এলো সেটা জানতে হবে আমাকে। একমাত্র নানার কাছেই আসে সে উত্তর।

কর্ডলেস ফোনটা আমার ঘরে নিয়ে এলাম। কিন্তু কয়েকবার চেষ্টা করেও পুরো নম্বর ডায়াল করতে পারলাম না। সাহসে কুলোচ্ছে না আসলে। এর আগে কেবল একবার নানার সাথে একাকী কথা হয়েছে আমার। কি নিয়ে কথা বলেছিলাম, সেটাও ভুলে গেছি। তার প্রশ্নের উত্তর ঠিকমতো দিতে পারছিলাম না দেখে মনে মনে যে ভীষণ লজ্জিত বোধ করছিলাম-এটা মনে আছে শুধু।

অবশেষে সাহস করে ফোন দিয়েই দিলাম তাকে। কয়েকবার রিং হবার পর নানার কণ্ঠস্বর শোনা গেল অপর পাশ থেকে। আমার ফোন পেয়ে খুশিই মনে হলো তাকে। “তোমার চোখের কি অবস্থা? স্মৃতি ফিরে পেয়েছে নাকি?” তার প্রফুল্ল কণ্ঠস্বর কিছুটা শান্ত করলো আমাকে।

না, স্মৃতি ফিরে পাইনি। কিন্তু চোখ ঠিকঠাক।

কিছুক্ষণ এটাসেটা ব্যাপারে আলাপ করার পর আসলে প্রশ্নটা করলাম।

“চোখটা কোথা থেকে জোগাড় করেছি, সেটা জানতে চাও?” সাবধানী স্বরে জিজ্ঞেস করলেন তিনি। “নামি, এটা তোমার না জানলেও চলবে…”

নানা পরিষ্কার করে না বললেও এটা বুঝতে সমস্যা হলো না যে চোখটা ঠিক বৈধভাবে জোগাড় করা হয়নি।

মরণোত্তর চক্ষুদান কর্মসূচির আওতায় চক্ষুদাতা তার চোখ দুটো দান করে দেয়। একটা প্রতিষ্ঠান আছে যারা এসব চোখ সংরক্ষণ করে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন হাসপাতালে সরবরাহ করে।

আমার নানা তার প্রভাব খাঁটিয়ে সেই প্রতিষ্ঠানের একজনের মাধ্যমে চোখটার ব্যবস্থা করেছেন। দুর্ঘটনায় চোখ হারানো ব্যক্তির তালিকা অনেক লম্বা। অনেক সময় কয়েক বছর লেগে যায়। উপরন্তু যারা দু’চোখই হারিয়েছে, তাদের প্রাধান্য দেয়া হয়। নানা যদি বিশেষ ব্যবস্থা না নিতেন তাহলে এত তাড়াতাড়ি চোখটা পেতাম না আমি।

এই চোখটা আসলে অন্য একজনের জন্যে বরাদ্দ ছিল। ভীষণ অপরাধবোধ হলো আমার। মনে হচ্ছে যেন একজনের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছি।

“তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছো?” নানাভাই জিজ্ঞেস করলেন।

নাহ… তবে এরকম একটা কাজ না করলেই ভালো হতো। চোখটার সাথে কাজুয়ার স্মৃতিগুলোেও পেয়েছি। সেদিক দিয়ে চিন্তা করলে আমি সৌভাগ্যবান। তবুও… এটা অন্যায়।

হঠাৎই একটা বুদ্ধি মাথায় এলো এসময়। কর্ডলেসটা কানে চেপে বললাম, “একটা অনুরোধ আছে আমার…”

“তোমার জন্যে দুনিয়া হাজির। বলো শুধু…”

আমার নিজের কাছে আইডিয়াটা ভালোই মনে হচ্ছে। কিন্তু নানাভাই করে দিতে পারেন।

“মারা যাবার পর আমি আমার চোখ জোড়া দান করে দিতে চাই।”

কয়েক সেকেন্ড কিছু বললেন না নানাভাই। নিজেরই আফসোস হচ্ছিল আমার কথাটা এভাবে বলে ফেলায়।

কিন্তু পরমুহূর্তেই তার হাসি শুনতে পেলাম ফোনের ওপাশ থেকে।

“নিশ্চয়ই! আমি ব্যবস্থা নেব।”

রক্তিম হয়ে উঠলো আমার দুই গাল। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে।

ফোন রেখে দেয়ার পরেও আনন্দের অনুভূতিটা চলে গেল না। মনে মনে নানাভাইকে ধন্যবাদ দিতে লাগলাম বারবার।

*

কাজুয়া মারা গেছে। এটা শতভাগ সত্য কথা। নিশ্চয়ই মরণোত্তর চক্ষুদান ফর্মে সই করে গিয়েছিল সে। এজন্যেই তার মৃত্যুর পর চোখটা আমি পেয়েছি।

সেই চোখের মাধ্যমেই তার ছেলেবেলার স্মৃতিগুলো দেখেছি। সুখস্মৃতি, দুঃস্মৃতি-সব। তার বিভিন্ন অভিজ্ঞতা এমন ভাবে অনুভব করেছি যেন ওগুলো আমার নিজের অভিজ্ঞতা। এমনকি তার আবেগগুলোও মাঝে মাঝে ভর করেছে আমার ওপরে।

এটা ঠিক যে স্বপ্নগুলোয় কোন শব্দ থাকে না। শুধু ছবি। তবুও তার অনুভূতিগুলো ঠিকই আমার অংশ হয়ে গেছে। কাজুয়াকে ভীষণ পছন্দ আমার। তার চোখ দিয়ে পৃথিবীটাকে দেখতে ভালো লাগে। তাই যখন বুঝতে পারলাম যে সে মারা গেছে, খুবই মন খারাপ হলো।

বাবা-মা আর ছোট ভাইকে হারিয়ে সাওরির এখন কি অবস্থা? অ্যাটলাসটা খুলে যে পাতাটায় চিহ্ন একে রেখেছিলাম সেটা দেখতে লাগলাম। এর আগেও এই একই কাজ করেছি বহুবার। আর প্রতিবারই সময়ের খেই হারিয়ে ফেলেছি।

তার সাথে দেখা করতে চাই আমি। জানি না যে দেখা হলে কি বলবো, কিন্তু সামনা সামনি তার চেহারাটা তো দেখতে পাবো। ভাবনাটা জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে রইলো আমার বুকের ওপর।

বাম চোখে যা দেখছি সেগুলো স্বপ্ন নয়, স্মৃতি-এটা জানার পরেও দৃশ্যগুলো নিয়মিত দেখতে থাকলাম বাম চোখে। একদিনে পাঁচটাও দেখেছি একবার। প্রতিবারই আমার বামচোখটা গরম হয়ে ওঠে আর সিনেমার চাকাটা ঘুরতে শুরু করে। একজনের সাধারণ মানুষের জীবনকাহিনি দেখতে থাকি আমি।

তবে একই দৃশ্য দু’বার কখনো দেখিনি। খুবই মনোযোগ দিতে হয় এজন্যে। নতুবা খুঁটিনাটি অনেক তথ্য দৃষ্টি এড়িয়ে যাবে। সবকিছু যথাসম্ভব মগজে গেঁথে নেই।

স্বপ্নগুলো (এতদূর যখন স্বপ্ন বলেছি, তাই স্বপ্নই বলবো ওগুলোকে) কখনো ক্লান্ত করে না আমাকে। বরং তেষ্টা আরো বাড়িয়ে দেয়। যা যা সম্ভব জানার চেষ্টা করি ওগুলো থেকে। আর প্রতিটা স্বপ্নের সাথে কাজুয়া ও সাওরির প্রতি আমার ভালোলাগার মাত্রাটাও বাড়তে থাকে।

সেই সাথে বাবা-মা আর স্কুলের সহপাঠীদের সাথে দূরত্বটাও বেড়ে চলে প্রতিনিয়ত।

একদিন মা আমাকে জিজ্ঞেস করে, “সমস্যা কি তোমার? স্কুল থেকে ফোন দিয়েছিল। তুমি নাকি গত কয়েকদিন ধরে অনুপস্থিত।”

এই সময়গুলোতে কফিশপে বসে বই পড়ি আমি। মাঝে মাঝে লাইব্রেরিতে গিয়ে বসে থাকি। একদিন সারা বিকেল পার্কের পুকুরে হাঁসগুলোকে খাবার খাইয়ে কাটিয়েছি।

ভীষণ অপরাধবোধ হয় আমার। কিন্তু স্কুলে যেতে বড় বেশি ভয় কাজ করে। তা সত্ত্বেও স্কুলে চলে গিয়েছিলাম একদিন, কিন্তু গেটের কাছে যাওয়া মাত্র পা যেন একশো মণ ওজনের হয়ে যায়। এক পা-ও সামনে এগোতে পারি না।

আমি নিশ্চিত যে নামি কখনো এরকম কোন সমস্যাঁতেই পড়েনি। এক দৌড়ে ক্লাসরুমে ঢুকে গিয়ে সহপাঠীদের সাথে হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠতো সে। কিন্তু সেই ক্লাসরুমে আমার কোন জায়গা নেই। আমার কোনখানেই কোন জায়গা নেই।

“স্কুলে যাও না কেন তুমি?” মা জানতে চাইলো কড়া সুরে। “আগে না স্কুলে যেতে কত পছন্দ করতে?”

কথাগুলো শুনে ভেতরে ভেতরে মুষড়ে পড়লাম। মনে হচ্ছে যেন তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি, ব্যাপারটা পীড়া দিচ্ছে আমাকে।

মা নামিকে ভোলেনি। আমাকে সহ্যই হয় না তার। সে বোধহয় ভাবে যে বর্তমান আমিকে যদি আপন করে নেয়া হয়, তাহলে আগের নামির অস্তিত্ব চিরতরে মুছে যাবে।

“তোমার কি স্কুল ভালো লাগে না? আমার দিকে তাকিয়ে উত্তর দাও!”

মনে হচ্ছে কেউ যেন দু’হাতে চেপে ধরেছে আমার হৃদয়। তা সত্ত্বেও মনে সাহস জোগাড় করে মার চোখে চোখ রেখে বললাম, “আমি দুঃখিত যে স্কুলে না যাওয়ার ব্যাপারে আগে কিছু বলিনি।”

আমি ঠিকঠাকমতো পড়াশোনার চেষ্টা করেছি। পিয়ানো বাজানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোনটাই আর আগের মতন পারি না। এমনকি হাসার চেষ্টাও করেছি। যা-ই করি না কেন, সবকিছুতেই মনে হয় যেন ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছি। জানি সবাই আমাকে নিয়ে হতাশ। নিজেকে অপদার্থ মনে হয় থেকে থেকে।

কিন্তু ঘরের কাজে তোমাকে যতটা সম্ভব সাহায্য করি। তোমাকে ভালোবাসি আমি, মা। আশা করি তুমিও আমাকে আবার ভালোবাসবে।

কথাগুলো শুনে শীতল চোখে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো মা। এরপর একটা কথাও না বলে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। আমাদের মধ্যে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তা কখনো খুঁচবার নয়।

*

পরদিন নিজের ঘরটা গোছালাম আমি। ভেতরের আসবাবপত্রগুলোর জায়গা বদলালাম। টিভি আর বিছানা জানালার পাশে নিয়ে আসলাম; এমনকি নতুন পর্দাও কিনেছি। দেয়ালে যে পোস্টারগুলো ঝোলানো ছিল, সব নামিয়ে ফেললাম। আগের নামির সব চিহ্ন মুছে গেল ধীরে ধীরে।

হুটোপুটির শব্দ শুনে ভেতরে উঁকি দিল বাবা। বইয়ের শেলফের একটা খালি জায়গা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “ইয়োকিবোর কি হলো?”

ইয়োকিররা হচ্ছে একটা টেডি বিয়ার।

“ওটা আলমারিতে ঢুকিয়ে রেখেছি।”

“আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না! কখনো ভাবিনি যে এই দিন দেখতে হবে,” মাথা ঝাঁকিয়ে বললো সে। “এসব ভালো লাগছে না আমার।”

একবার মনে হলো যে ভুল করে ফেলেছি। পুরনো নামির মত করে আবার ঘরটা গুছিয়ে দেব নাকি সে চিন্তাও করতে লাগলাম।

আমতা আমতা করে জবাব দেয়ার চেষ্টা করছি এসময় বাবা আমার ডেস্ক থেকে বাইন্ডারটা উঠিয়ে নিল। পাতা উল্টিয়ে বললো, “এটা কি?”

ঐ বাইন্ডারটার ভেতরেই কাজুয়ার জীবনের বিস্তারিত লিখেছি আমি।

ভেতরে ভেতরে আঁতকে উঠলেও মুখটা স্বাভাবিক রেখে বললাম, “এটা হোমওয়ার্ক।”

সাথে সাথে আগ্রহ হারিয়ে বাইন্ডারটা আমাকে ফিরিয়ে দিল বাবা। ওটা হাতে পেয়ে কিছুটা সাহস পেলাম। স্মৃতিগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে মাথা উঁচু করে বললাম, “বাবা, এই ঘরটা আমি নতুন করে সাজাতে চাই। পুরনো নামির কোন জিনিসটা ভালো লাগতো, সেসব নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই।”

কিছুক্ষণ আমার বলা কথাগুলো নিয়ে ভাবলো বাবা। এরপর মাথা নেড়ে বললো, “সেটাই ভালো হবে বোধহয়।”

*

সেদিন বিকেলে লাইব্রেরিতে গেলাম কাজুয়ার মৃত্যুর ব্যাপারে কোন খবরের কাগজে কিছু ছাপা হয়েছে কিনা সেটা দেখতে।

সে কিভাবে মারা গেছে তা জানি না। এটাও জানি না যে কবে মারা গেছে। তাই অন্ধের মত খবরের কাগজ উল্টে কিছুই পেলাম না।

সিটি লাইব্রেরিতে গত তিন বছরের খবরের কাগজ জমিয়ে রাখা হয়। কিন্তু সেই পাতাগুলোয় ঠিক কি খুঁজবো তা তো জানি না। তাই বিশাল শেলফটার সামনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কবে মারা গেছে কাজুয়া? ভাবতে লাগলাম।

কেউ যদি চক্ষুদান ফরমে সই করে যায়, তবে তার মৃত্যুর পরপরই মৃতদেহ থেকে চোখজোড়া তুলে নেয়া হয়। আর সেই চোখগুলোর নতুন মালিক পেতেও খুব বেশি সময় লাগে না। সাধারণত কয়েক মাসের মধ্যেই প্রতিস্থাপিত করা হয়। তাই ঠিক করলাম যে আমার চোখের অপারেশনের আগের খবরের কাগজ থেকে দেখা শুরু করবো। কয়েক সপ্তাহ কিংবা কয়েক মাস আগের খবর দেখলেই হবে।

অপারেশন হয় ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখে। তার আগের দিন থেকে সাবধানে পাতা উলটে দেখে যেতে লাগলাম।

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতদের নাম এবং শোক সংবাদের কলামে যাদের নাম ছাপা হয়েছে ওগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। সবক্ষেত্রেই নামের পাশে একটা সংখ্যা দেয়া, মৃতের বয়স।

কাজুয়া যখন মারা যায় তখন তার বয়স কত হয়েছে তা ভাবার চেষ্টা করলাম। স্মৃতিগুলোতে সাওরির মুখের চামড়ায় ভাঁজ পড়তে দেখিনি কখনো, অর্থাৎ চোখটা তাকে বৃদ্ধ অবস্থায় দেখেনি। এমনকি সাওরিকে মাঝবয়সীও মনে হয়নি কোন স্মৃতিতে। এ থেকে ধারণা করা যায় তুলনামূলক কম বয়সেই মারা গেছে কাজুয়া।

স্মৃতিগুলোতে সাওরিকে সবচেয়ে বয়স্ক অবস্থায় যখন দেখেছি, তখনও তার বয়স খুব জোর পঁচিশের আশেপাশে হবে বলে মনে হয়েছে। আমার হিসেব ঠিক হলে কাজুয়া মারা গেছে বিশের কোঠায়।

দু’ঘণ্টা ধরে লাইব্রেরির খবরের কাগজগুলো ঘেটে চললাম। আমার চোখের ওপর চাপ পড়ছে একটানা ছোট ছোট লেখার কলামগুলো দেখার জন্যে। কিছুক্ষণের জন্যে বিরতি নিলাম একটু পর। একভাবে চিন্তা করলে আমি আমার বাম চোখটাকে নিজের মৃত্যুর খবর খুঁজতে বাধ্য করছি। আপাতদৃষ্টিতে নিষ্ঠুর একটা কাজ।

পাতা উল্টেই চললাম একের পর এক। কিন্তু কাজুয়া ফুইয়ুতসুকির নাম খুঁজে পেলাম না। এমনটাও হতে পারে যে ইতোমধ্যে যে খবরের কাগজগুলো দেখে ফেলেছি সেগুলোর কোনটায় তার নাম আছে, তবে সে সম্ভাবনা নিতান্তই কম। কাজুয়ার বসবাস ভিন্ন অঞ্চলে, সুতরাং এখানকার স্থানীয় পত্রিকায় তার নাম হয়তো ছাপাই হয়নি। অনিচ্ছাসত্ত্বেও হাল ছেড়ে দিলাম এক পর্যায়ে।

খবরের কাগজগুলো নিয়ে বুক শেলফে নির্ধারিত স্থানে গুছিয়ে রাখার জন্যে উঠলাম। একটা নির্দিষ্ট ক্রমানুযায়ী রাখা হয় ওগুলো, তাই জায়গাটা খুঁজে বের করতে হলে আগে।

এমন সময় চোখে পড়লো ছবিটা। শেলফে গাট্টি করে রাখা একটা খবরের কাগজের বান্ডিলে দৃষ্টি আটকে গেল। গত বছরের কাগজ এগুলো।

একটা হারানো বিজ্ঞপ্তি। পাশে নিখোঁজ মেয়েটার ছবি। প্রতিবেদনটা অবশ্য পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে না। নেহায়েত ভাগ্যের জোরে ছবিটা চোখে পড়েছে। খবরের কাগজটা বের করে আনলাম বান্ডিল থেকে বড় বড় অক্ষরে ‘চৌদ্দ বছরের কিশোরী নিখোঁজ’ লেখা। এর নিচে প্রতিবেদনের শুরুতে বলা হয়েছে- গতকাল, হিতোমি আইজাওয়া বান্ধবীর বাড়ি থেকে বের হয়ে আর বাসায় ফেরেনি…’

ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মনে হচ্ছে স্কুল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। কোথায় যেন দেখেছি আগে।

হঠাৎই গরম হয়ে উঠলো আমার বাম চোখ। দপদপ করছে। যেন যে কোন মুহূর্তে ফেটে পড়বে।

কিছুদিন আগে মা’র সাথে টিভি দেখার সময়ে একই অনুভূতি হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানেও নিখোঁজ ছেলেমেয়েদের সম্পর্কে কথা বলছিল সঞ্চালক।

আরে তাই তো! এই মেয়েটার ছবিই দেখেছিলাম টিভিতে। খবরের কাগজের ছবিটা থেকে চোখ সরাতে পারছি না কেন যেন।

বাম চোখের দপদপানি আরো বেড়েছে। মনে হচ্ছে যেন চোখের শিরার রক্তগুলো উল্টোদিকে প্রবাহিত হচ্ছে।

এই স্মৃতিটার সাথে ভয়ঙ্কর কোন কিছুর সম্পর্ক আছে। কি আবোল তাবোল ভাবছি। চোখ সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না।

একদম বাচ্চা বাচ্চা একটা চেহারা।

চোখ দুটো নড়ে উঠলো এ সময়।

স্বপ্নটা শুরু হয়েছে। স্মৃতির বাক্স খুলে একটার পর একটা ছবি ভেসে উঠতে শুরু করেছে মনে। এক্ষেত্রে হিতমির ছবিটা ট্রিগার হিসেবে কাজ করেছে। সবসময়ের মতোই, পুরো দৃশ্যটা দেখতে হবে আমাকে।

চোখ বন্ধ করে নিলাম। কাজুয়ার দেখা দৃশ্যগুলো আরো পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠলো।

একটা মেয়ের চেহারা দেখা যাচ্ছে কাজুয়া থেকে কিছুটা দূরে। হিতেমি। জানালার অপর পাশে মেঝেতে শুয়ে আছে সে। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। একবার চোখের পলক পড়লো মেয়েটার।

আশপাশে একবার তাকালো কাজুয়া। ঘন বনের ভেতরে একটা বাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে। পশ্চিমা নকশার বাড়িটা নীল ইটে তৈরি। কাজুয়া হয় কোন এক পাশে অথবা বাড়িটার পেছন দিকে দাঁড়ানো।

আবারো হিতোমি আইজাওয়ার দিকে দৃষ্টি ফেরালো সে। জানালাটা তার পায়ের কাছে, নিচের দিকে। নিশ্চয়ই কোন তলকুঠুরির জানালা। চারকোনা, ময়লা লেগে আছে চারপাশে। ঘরটা বেশ অন্ধকার হওয়াতে খুব বেশি কিছু দেখা যাচ্ছে না। কেবল বাইরের আলোতে মেয়েটার চেহারা কিছুটা আলোকিত হয়ে আছে।

মনে অবিশ্বাস নিয়ে স্বপ্নটা দেখে চলেছি আমি। নিখোঁজ মেয়েটা এরকম একটা তলকুঠুরিতে কি করছে? কাজুয়া তার দিকে তাকিয়ে আছে কেন?

প্রথমে বুঝে উঠতে পারলাম না যে কি ঘটছে। তবে দ্রুত একটা ভাবনা ভর করলো মাথায়। হয়তো হিতোমিকে অপহরণ করে তলকুঠুরিতে আটকে রেখেছে কেউ। আর সেটা যদি সত্যি হয়, তাহলে কাজুয়া ভয়ংকর একটা ব্যাপারের প্রত্যক্ষদর্শী।

নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইলাম লাইব্রেরিতে। নড়তেও পারছি না। এখন জানালার দিক থেকে চোখ সরিয়ে আশপাশের ঝোপঝাড়ে নজর রাখছে। কাজুয়া। মনে হচ্ছে যেন ওর নিঃশ্বাসের শব্দও শুনতে পাচ্ছি। সে নিশ্চয়ই ভয়ে ভয়ে আছে যে বাড়ির মালিকের চোখে পড়ে যাবে।

এই বাড়িটা যার, সে-ই কি হিতোমিকে বন্দী করে রেখেছে ভেতরে?

ঝোপগুলো থেকে বাড়ি অবধি সরু একটা নুড়ি বেছানো পথ। বাড়িটা দোতলা। চারদিকের গাছগুলোয় পাতার সমারোহ বেশ কম। অর্থাৎ শীতকাল।

কোন এক পর্যায়ে কাজুয়া পকেট থেকে একটা স্ক্রু ড্রাইভার বের করে এনেছে। হয়তো এতক্ষণ লুকিয়ে রেখেছিল ওটা। হাঁটুগেড়ে বসে জানালার চৌকাঠ পরীক্ষা করতে শুরু করলো সে।

মেয়েটাকে এখান থেকে উদ্ধার করতে এসেছে সে।

কিন্তু জানালাটা একটা দেয়ালের সাথে শক্ত করে আটকানো। খোলার মত স্কু নেই। আরেকবার সাবধানী চোখে আশপাশে নজর বুলিয়ে জানালা আর দেয়ালের মাঝে যে সরু জায়গাটা আছে সেখানে ক্রু ড্রাইভারটা প্রবেশ করালো সে। মনে হচ্ছে চাপ প্রয়োগ করে খোলার চেষ্টা করবে।

হঠাই থমকে গেল সে। কিছু একটা নজরে এসেছে। এক সেকেন্ড পর আমিও খেয়াল করলাম ব্যাপারটা।

হিতোমি আইজাওয়া মেঝে থেকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তবে তার চেহারার এক পাশ দেখা যাচ্ছে এখন কেবল। অন্য পাশটা ঠেস দিয়ে আছে মেঝের সাথে। তার পোশাকগুলোও অদ্ভুত। আসলে সেটাকে পোশাক বললেও ভুল হবে, বরং বস্তা বলা ভালো। এমনভাবে একটা বস্তায় ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে তাকে যে শুধুমাত্র চেহারাটাই দেখা যাচ্ছে। গলার কাছটায় বস্তাটা একটা দড়ি দিয়ে বাঁধা।

কিন্তু বস্তার আকৃতিটা কেমন যেন। হঠাই ভয়ঙ্কর একটা চিন্তা খেলে গেল আমার মাথায়। এতটাই ভয়ঙ্কর যে সেটা বাস্তব কিনা তা ভাবতেও আঁতকে উঠছি। অন্ধকারের কারণে প্রথম দিকে হিতোমির পুরো শরীর দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি যে বস্তাটায় একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষকে কোনভাবেই আটানো সম্ভব না। একবার মনে হলো পা দুটো ভাঁজ করে বুকের কাছে চেপে রেখেছে সে, কিন্তু সেটাও অসম্ভব। কারণ তেমনটা হলে ফুলে থাকতো বস্তাটা। আমার বাঁ চোখ দিয়ে যে মেয়েটাকে দেখছি তার, কেবল শরীরের ঊর্ধ্বাংশটুকুই আছে। এটা কিভাবে সম্ভব? চিন্তাটা প্রচণ্ড অস্বস্তিদায়ক।

একমাত্র তার হাত পা কেটে ফেলা হলেই এভাবে বস্তায় ঢুকিয়ে রাখা সম্ভব। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলাম।

এসময় ভীষণভাবে নড়ে উঠলো কাজুয়ার দেহ। হঠাৎই জানালাটার কাছ থেকে দৌড়ে পালালো সে। বাড়িটার এক পাশে গিয়ে আত্মগোপন করলো। নীল দেয়ালের সাথে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করছে যেন। এসময় একটা ছায়া দেখতে পেলাম দেয়ালের অন্যপাশটায়। কেউ একজন আসছে।

নিঃশ্বাস নেয়ার শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলেছি।

ধীরে ধীরে পেছনে এগোতে লাগলো কাজুয়া। হাতের ক্রু ড্রাইভারটা পকেটে ঢোকানোর জন্যে নিচের দিকে তাকাল একবার। এসময় দুর্ভাগ্যের সম্মুখীন হতে হলো তাকে। হাত থেকে ছুটে গেল জিনিসটা।

একটা কংক্রিটের তৈরি ড্রেনের ওপরে দাঁড়িয়ে ছিল সে। ড্রেনের ঢাকনাটা ভোলা, ভেতরে শুকনো পাতার ছড়াছড়ি। ক্রু ড্রাইভারটা যদি পাতাগুলোর ওপর পড়তো তাহলে কোন শব্দ হতো না। কিন্তু ভেতরে পড়ার আগে ওপরে কংক্রিটে একবার তো খেল ধাতব অংশটা। স্বপ্নগুলোয় কোন শব্দ শুনতে পাই না, বলেছি আগেই। তবুও আমার মাথায় যেন তারস্বরে বেজে উঠলো সাইরেন।

এবার ঝেরে দৌড় লাগাল কাজুয়া। পেছনের গাছ গাছালির জঙ্গল ফেলে ঢাল বেয়ে নামতে লাগলো। চারিদিকে শুকনো পাতা পড়ে আছে। সেগুলো মাড়িয়ে শব্দের তোয়াক্কা না করেই ছুটে চলেছে সে।

একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে দেখে নিল। এক ঝলকের সেই দৃষ্টিতে মনে হলো কেউ একজন পেছন পেছন ছুটছে। তার চেহারা বা উচ্চতা অবশ্য বোধগম্য হলো না। কিন্তু ধাওয়া করছে, সেটা নিশ্চিত।

শরীর রীতিমত কাঁপছে আমার এখন। শেলফটা ধরে ভারসাম্য রক্ষা করলাম।

গাছের ফাঁক ফোকর দিয়ে তীরবেগে ছুটছে কাজুয়া। মাটি থেকে বেরিয়ে থাকা শেকড়গুলো সাবধানে এড়িয়ে যাচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্যেও থামার জো নেই। বনটা যেন শেষই হচ্ছে না। একটা গাছ পেরুলেই, আরেকটা সামনে এসে পড়ছে। চিরকাল এরকমই চলবে মনে হলো।

কিন্তু কিছুক্ষণ পর দৃশ্যপট বদলে যেতে লাগলো। ছোট পাতাহীন গাছের বদলে এখন লম্বা লম্বা চিরহরিৎ গাছ চোখে পড়ছে। সেগুলোর ফাঁক দিয়ে দৌড়ে চললো সে।

এ সময় হঠাৎই বাম চোখের দৃষ্টিটা একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গেল। খাড়া ঢালে নিশ্চয়ই পা হড়কে গেছে কাজুয়ার। গড়িয়ে নিচে পড়তে লাগলো সে। চারদিকে পাতা আর ধুলোর ঝড় উঠেছে রীতিমত। হঠাই বন থেকে খালি জায়গায় বেরিয়ে এলো গড়তে গড়তে। উঠে দাঁড়ালো হাচড়ে পাঁচড়ে। পায়ের নিচে পিচঢালা রাস্তা এখন। সামনে তাকাতেই জমে গেল একদম। একটা সাদা গাড়ি এগিয়ে আসছে ভয়ানক গতিতে। সরে যাবার সময় নেই।

লাইব্রেরিতে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। বাম চোখের দপদপানি বেড়ে গিয়েছে আবারো।

কাজুয়াকে ধাক্কা দিয়েছে গাড়িটা। কত জোরে ধাক্কা দিয়েছে, সেটা ছবিগুলো দেখে বলা সম্ভব না। কিন্তু এ মুহূর্তে নিথর ভঙ্গিতে রাস্তায় পড়ে আছে সে। একটুও নড়ছে না। দৃষ্টি আকাশের দিকে।

চোখের উত্তাপ কমে এলো এসময়। ধীরে ধীরে স্বপ্নটা মিলিয়ে গেল। কিন্তু সংঘর্ষের ঠিক পরমুহূর্তে গাড়িটার পেছন দিকে গাছের আড়ালে কাউকে লুকিয়ে থাকতে দেখেছে কাজুয়া, এটা নিশ্চিত।

স্বপ্নটা শেষ হয়েছে অবশেষে। দু’চোখ দিয়ে পানি ঝরছে আমার। নিশ্চয়ই ধাক্কা লাগার পরমুহূর্তেই মারা যায় কাজুয়া। একটা গাড়ির সাথে সংঘর্ষে মৃত্য হয় তার। কিন্তু এটা সাধারণ কোন দুর্ঘটনা না।

হিতামিকে দেখেছিল কাজুয়া। আমার যদি ভুল না হয়, তাহলে হাত পা কেটে ফেলা হয়েছে মেয়েটার। কিন্তু টিভিতে যে ছবিটা দেখিয়েছে সেখানে একদম স্বাভাবিক ছিল সে।

কাজুয়া দেখেছে কোথায় আটকে রাখা হয়েছে মেয়েটাকে। তাকে বাঁচানোর চেষ্টাও করে, কিন্তু অপহরণকারীর কাছে ধরা পড়ে যায়।

নিষ্ফল এক ক্রোধে ফুঁসতে লাগলাম আমি। যে লোকটা হিতোমিকে অপহরণ করেছে, সে-ই এক প্রকার খুন করেছে কাজুয়াকে। কিন্তু সবাই নিশ্চয়ই ধরে নিয়েছে যে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে সে। এই ভাবনাটা রীতিমত অসহ্য ঠেকছে আমার কাছে।

সাওরির কি অবস্থা হয়েছিল খবরটা শোনার পর? কতগুলো স্বপ্নের অকালমৃত্যু ঘটেছে কাজুয়ার মৃত্যুর সাথে?

স্থানুর মত দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। স্বপ্নটা শেষ হবার পর আমার বাঁ চোখের দৃষ্টি আবার স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। এখন আমার শরীরেরই একটা অংশ ওটা। মনে হচ্ছে যেন কিছুক্ষণ আগে চোখটার গরম হয়ে ওঠা আমার কল্পনা বৈ কিছু নয়।

আমাকে যেতেই হবে জায়গাটায়। হিতোমি আইজাওয়াকে যেখানে বন্দি করে রাখা হয়েছে সেই বাড়িটা খুঁজে বের করতে হবে।

২. রূপকথার গল্পকার

দ্বিতীয় খণ্ড

রূপকথার গল্পকার

মিকি স্বপ্নে দেখলো যে আকাশ থেকে বৃষ্টির মতন মানুষ ঝরে পড়ছে।

একটা বড় বিল্ডিংয়ের ছাদে দাঁড়িয়ে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আছে সে। ঝরে পড়া মানুষগুলোকে একদম স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।

প্রত্যেকের পরনে কালো স্যুট। নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই একই পোশাক পরে আছে। আকাশ থেকে অনবরত পড়েই চলেছে একের পর এক। মেঘমুক্ত বেগুনি আকাশে ছোট ছোট তারার মত দেখাচ্ছে মানুষগুলোকে। ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। তবে কারো চোখে কোন ভয় নেই।

নিচের শহরের দিকে তাকালো মিকি। অসংখ্য দেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারদিকে। লাল রঙ্গে রাঙিয়ে দিয়েছে গোটা শহর। আশপাশের সবগুলো ছাদ ভরে উঠেছে দুমড়ে যাওয়া শরীরে। কিন্তু মিকি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে একটা দেহও পড়েনি।

ঘুম ভেঙে গেল মিকির। উপন্যাসটার খসড়া সম্পাদনা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কয়েকটা প্রিন্ট দেয়া কাগজ পড়ে আছে মাটিতে। ওগুলো তুলে নিল সে।

– “ঘুম ভেঙেছে তাহলে?” কাউচ থেকে মাথা বাঁকিয়ে বললো কিশোরী মেয়েটা। “প্রায় এক ঘণ্টা ধরে ঘুমিয়েছেন। বোর হচ্ছিলাম।”

কাগজগুলো টেবিলের ওপর গুছিয়ে রাখলো মিকি। টেবিলটা একটা অ্যান্টিক। অনেক বয়স, জটিল নকশা ভোলা গায়ে। গত ভাড়াটিয়ার রেখে যাওয়া জিনিস।

জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো সে। সূর্যাস্তের বেশি দেরি নেই। রক্তিম আকাশের নিচে সবুজ গাছগুলোকে কালো দেখাচ্ছে এখন। পর্দা টেনে দিল মিকি। এগুলোও তার নিজের নয়, আগের কারো। পর্দাগুলো পুরু হওয়াতে আলো প্রবেশের সুযোগই পায়না ফাঁক গলে।

“একটা গল্প বলুন না, কাউচে একবার নড়ে উঠে বললো মেয়েটা।

“ঐ কাক আর মেয়েটার গল্প না কিন্তু। চোখ উপড়ে নেয়ার কাহিনি শুনতে শুনতে বিরক্তি ধরে গেছে। অন্য কিছু বলুন।”

কিছুদিন আগে প্রকাশিত ‘চোখের স্মৃতি’ গল্পটার কথা বলছে মেয়েটা। অবসর সময়ে এটা তাকে পড়ে শোনায় মিকি।

“আপনার ছেলেবেলার কাহিনি বলুন না,” মেয়েটা কথা বলে উঠলো আবারো। “চমৎকার বুদ্ধি দিয়েছি না? আপনি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন অনেক দিন হতে চললো। কিন্তু এখনও আপনার সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানি না।” একটা মৃদু হাসি ফুটলো তার চেহারায়। “শান মিকি কি আপনার আসল নাম?”

মাথা ঝাঁকিয়ে না করে দিল সে। মিকি হচ্ছে তার ছদ্মনাম।

কাউচে বসে মেয়েটার মাথায় হাত রাখলো সে। তার চুলগুলো এলোমেলো করে দিল স্নেহের ভঙ্গিতে। এরপর অতীত রোমন্থন শুরু করলো।

*

ওর বাবা ছিল একজন ডাক্তার। বড় হাসপাতালের সার্জন। তাই ছেলেবেলার বেশির ভাগ সময় হাসপাতালেই কেটেছে। ওটাই ছিল তাদের বাড়ি।

ছেলেবেলার কথা বলতেই তাই প্রথমে তার বাড়িতে থাকা রোগীদের কথা মনে পড়ে যায় মিকির। হাসপাতালের করিডোরগুলোতে খেলনা গাড়ি আর প্লেন নিয়ে দৌড়ে বেড়াতে সে। কেবিনে শুয়ে কোকাতে থাকা নানা বয়সী লোকজন ছিল নিত্যদিনের দৃশ্য। কারো হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ করা আবার কারো পা প্লাস্টার করে স্ট্যান্ডের সাথে ঝোলানো। তাকে দেখলে সবসময় শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো রোগীরা।

গ্রেড স্কুলে থাকতে প্রতিবেশী কিছু ছেলের সাথে পোকামাকড় ধরতে যেত মিকি। তাদের বাড়ির পাশেই ছিল পরিত্যক্ত একটা জমি। সেটার মালিক কিছু না করেই দিনের পর দিন ফেলে রেখেছিল জায়গাটা। তাই আগাছাও জন্মেছিল মনের সুখে। সন্ধ্যাবেলা ঝিঁঝি পোকার ডাকে কান পাতা দায়। এছাড়াও গুবড়ে পোকা বা ঘাস ফড়িংয়ের কোন অভাব ছিল না। চতুর্থ শ্রেণিতে থাকতে তার এক বন্ধু নতুন খেলা আবিষ্কার করে। ঘাসফড়িং ধরে সেগুলোকে সুঁই দিয়ে গুতিয়ে গুতিয়ে হত্যা করা। একটা কাঠের বোর্ডে পোকাগুলোকে গেঁথে মিকিকে দেখায় তার বন্ধু। কিছুক্ষণ আগেই গাঁথা পোকাগুলোকে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে নিথর হয়ে যায়।

মিকি নিজেও খেলাটার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। একটা ঘাসফড়িং ধরে এনে বাসা থেকে নিয়ে পুঁইগুলো সেটার পেটে গেঁথে দেয়। কিন্তু ঘাসফড়িংটা মরে না।

ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবেই নেয় সে। ধরে নেয় যে ভাগ্যবশত সুঁই কোন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ভেদ না করেই ভেতরে ঢুকে গেছে। তাই পোকাটার গায়ে আরো তিনটা সুঁই ফোঁটায় সে।

একটা মাথায়, একটা গলায় আর একটা পেটে। তবুও নড়তেই থাকে ঘাসফড়িংটা। ছয়টা পা-ই এমনভাবে নাড়াচাড়া করছে যেন কিছুই হয়নি। মাথার ওপরের অ্যান্টেনা দুটোও নড়ছে ক্রমাগত-এদিকে শরীরের ভেতর থেকে থকথকে তরল বেরিয়ে এসেছে আগেই।

বারোতম পিনটা ফোঁটানোর পরে অবশেষে মারা গেল ঘাসফড়িংটা। তবে পুঁই আর পিনের ভিড়ে সেটাকে দেখা দায় এখন।

অন্য পোকাগুলোর ক্ষেত্রেও একই ফলাফল পেলো মিকি। একটা গুবড়ে পোকাকে দেয়ালে কয়েক বার ছুঁড়ে মারার পরেও মারা গেল না সেটা। পুরো শরীর ফেটে গেলেও মাথার শিং দু’টো ঠিকই নড়ছিল।

মিকি ধরে নেয় যে সব পোকামাকড় এরকমই হয়। একবার কেচি দিয়ে একটা ঘুঘুরে পোকাকে দু’ভাগ করে দিয়েছিল, আবার আরেকটা গুবড়ে পোকার মাথা ধড় থেকে আলাদা করে দেয়। কিন্তু প্রতিক্ষেত্রেই কিছুক্ষণ হাত পা ছোঁড়াছুড়ি করে পোকাগুলো। মরতেই চায় না। সব গোঁয়ারের দল, ভাবে সে।

কিন্তু এক পর্যায়ে মিকি বুঝতে পারে যে ব্যাপারটা ঠিক স্বাভাবিক নয়। অন্যান্য বাচ্চারা খুব সহজেই পোকাগুলোকে মেরে ফেলে। হয়তো আমি এমন পোকাগুলোকে ধরেছি যেগুলোর জীবনীশক্তি অন্যগুলোর চাইতে বেশি, নিজেকে প্রবোধ দেয় সে। কিন্তু তার হাতের দিকে তাকানো পরে মনে হয় কি যেন একটা ঠিক নেই।

আমার ভেতরে অদ্ভুত একটা ক্ষমতা আছে।

একবার মিকির বয়সী একটা মেয়ে ভর্তি হয়েছিল হাসপাতালে। খেলতে খেলতে তার ঘরে একদিন ভুল করে ঢুকে পড়ে সে। বন্ধুত্ব হয়ে যায় দু’জনের। প্রায়ই তার সাথে দেখা করতে আসততা মিকি।

ঘনিষ্ঠ বন্ধু খুব বেশি ছিল না মিকির। এমনকি তার সাথে পোকা ধরতে যারা, তারাও নতুন বন্ধু খুঁজে নিয়েছে। তাই প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে মেয়েটার সাথে কথা বলতে যেত সে।

মিকিকে দেখামাত্র উজ্জ্বল হয়ে উঠতো মেয়েটার চোখমুখ। নিজের ব্যান্ডেজ করা হাত দুটো মিকির উদ্দেশ্যে নাড়ে সে। অবশ্য তার দু’হাতই কনুইয়ের কাছে এসে শেষ হয়ে গেছে। রেললাইনের পাশে খেলতে গিয়ে ও দু’টো খোয়াতে হয়েছে তাকে।

“আমি শুধু দেখতে চেয়েছিলাম যে হাতের ওপর দিয়ে ট্রেন চলে গেলে কি হয়,” নিরাবেগ কণ্ঠে মিকিকে বলে মেয়েটা। “কিন্তু ওমা! ট্রেনের চাকা হাতের ওপর ওঠার পরেই অর্ধেকটুকু আলাদা হয়ে গেল!”

তার সাথে কথা বলতে ভালো লাগে মিকির। বাবা আর মা’র লেকচার থেকে বিভিন্ন গল্প বানিয়ে তাকে বলতো সে।

*

একদিন জরুরি বিভাগের সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল ওরা দু’জন, এমন সময় সংকটাপন্ন এক রোগীকে ভর্তি করা হয় সেখানে। অপারেশন থিয়েটারের বাইরে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দেয়ার চেষ্টা করে দু’জনই। লোকটা কতটা ব্যথা পেয়েছে, সেটা দেখাই উদ্দেশ্যে।

মিকির বাবা আর কয়েকজন নার্স তাড়াহুড়ো করে প্রস্তুতি নিয়ে প্রবেশ করে ভেতরে। সেসময় এক ফাঁকে রোগীকে দেখার সুযোগ পায় মিকি। কম বয়সী এক তরুণ, সারা শরীরে দৃশ্যমান কোন ক্ষত নেই।

কিন্তু অপারেশন চলাকালীন সময়ে মারা যায় সে।

“খুব খারাপ একটা জায়গায় ব্যথা পেয়েছিল, মিকির বাবা বলেন পরবর্তী সময়ে। সাইকেল থেকে পড়ে গিয়েছিল ছেলেটা।

“খারাপ জায়গা আবার কোনটা?” মিকির বান্ধবী জিজ্ঞেস করে। সেই জায়গাটা ঠিক থাকলে সবাই বেঁচে থাকবে?”

“কারো কি এমন ক্ষমতা থাকতে পারে যে সে কাউকে আহত করার সময় অবচেতন ভাবেই ঐ খারাপ জায়গাগুলো এড়িয়ে যায়?”

“কি জানি ভাই,” মেয়েটা হাত ভাঁজ করার ভঙ্গি করে জবাব দেয়। তবে তার হাত দুটো কনুইয়ের কাছাকাছি এসে শেষ হয়ে যাওয়ায় সে আর পুরোপুরি হাত ভাজ করতে পারবে না কখনোই।

*

এরপর মিকি ঘাসফড়িং ধরে এমনভাবে সেগুলোকে আহত করার চেষ্টা করে যাতে ওগুলো মারা যায়। প্রথমদিকে ধরা পোকাগুলো বেশ তাড়াতাড়ি মারা যেতে লাগলো। এই যেমন তাদের শরীরে বারো-চৌদ্দটা পিন ফুটালেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। কিন্তু পরবর্তীতে ধরা পোকাগুলো আরো বেশি সময় ধরে বেঁচে থাকলো।

তার ধরা একদল গুবড়ে পোকার নিচের অর্ধেকটুকু শরীর থেকে আলাদা করে দেয়ার কয়েক সপ্তাহ পরেও সেগুলো দিব্যি বেঁচে রইলো। এরপর ধুকে ধুকে মারা গেল কিছুদিনের মধ্যে। কিন্তু মাথা পিষে ফেললে বা কেটে ফেললে সাথে সাথেই মারা যায়।

একটা ব্যাঙ ব্যবচ্ছেদ করলো মিকি, একটা মাছ কেটে ভেতর থেকে সব কিছু বের করে পানিতে ছেড়ে দিল। কিছুক্ষণ এমন ভঙ্গিতে সাঁতার কাটলো ওগুলো যেন কিছুই হয়নি। ব্যাঙটার ক্ষতস্থান থেকে অবশ্য নাড়িভুড়ি বেরিয়ে এসে পানিতে ভাসছে লম্বা সুতোর মতন।

চারপেয়ে জন্তুদের ওপরেও পরীক্ষা করলো মিকি। একটা বিড়ালকে ফাঁদ পেতে ধরলো সে। এরপর হাসপাতালের পেছনে খালি জায়গাটায় নিয়ে মাঝামাঝি ছুরি দিয়ে কেটে অর্ধেক করে ফেললো। কিন্তু বিড়ালটা মরলো না। নিজের সম্পর্কে আরেকটা অদ্ভুত তথ্য আবিষ্কার করলো মিকি। সে যেসকল প্রাণীর অঙ্গহানি করে, তারা কোন প্রকার ব্যথা বা কষ্ট অনুভব করে না।

বিড়ালটা বুঝতেও পারেনি যে মিকি তাকে দু’ভাগ করে ফেলেছে। কিছুক্ষণ পর পেছনে পা চাটতে গিয়ে অসঙ্গতিটা চোখে পড়ে তার। খুব বেশি রক্তও ঝরেনি। ক্ষুধা আর তৃষ্ণার অনুভূতি বহাল তবিয়তে আছে। যে খাবারগুলো খায় সেগুলো একটু পরেই কাটা পেট দিয়ে বেরিয়ে আসে। তবে পরবর্তী এক সপ্তাহে তার শারীরিক ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে আসে এবং এক পর্যায়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

আরেকটা বিড়াল নিয়ে এসে পরীক্ষা করে মিকি। তবে এই বিড়ালটা বাঁচে দুই সপ্তাহ, কোন প্রকার খাবার বা পানীয় ছাড়াই।

বান্ধবীকে নিজের এই আবিষ্কারের কথা জানানোর জন্যে উদগ্রীব হয়ে ওঠে মিকি। হাসপাতাল থেকে চলে গিয়েছে সে কিছুদিন আগে। তবে বাসা খুব বেশি দূরে নয়। সাইকেলে করে যেতে আধঘণ্টার মত লাগে।

তার বাসার সামনে সাইকেলটা রেখে দরজায় কড়া নাড়লো মিকি। দরজা খুলে দেয় মেয়েটার মা। একরম নিস্পৃহ কণ্ঠেই পরবর্তী কথাগুলো বলেন তিনি। “গত পরশু দিন মারা গেছে ও। সিঁড়ির রেলিং বেয়ে নিচে নামতো সবসময়। কিন্তু আগে হাত ঠিক ছিল তাই ভারসাম্য রক্ষা করতে সমস্যা হতো না। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পরে ও প্রায়ই ভুলে যেত যে কনুইয়ের নিচ থেকে হাত দুটো আর নেই। তাই এবারে রেলিং বেয়ে নামতে শুরু করার পর হয়তো ভুলটা বুঝতে পারে…কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে যায়।

*

হাই স্কুলের তৃতীয় বর্ষে থাকার সময় প্রথম খুন করে মিকি।

বেশ ঠান্ডা পড়েছিল সেদিন। নিজের মোটর সাইকেলে চড়ে হাওয়া খেতে বেরিয়েছিল মিকি। কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য ছিল না মনে। প্রায়ই এরকম উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়াতো সে।

একটা পাহাড়ি পথ বেয়ে উপরে উঠছিল ঘুরে ঘুরে। এমন সময় রাস্তার পাশে বেশ চওড়া একটা খালি জায়গা চোখে পড়ে। দুটো গাড়ি পার্ক করা যাবে সেখানে। এমনকি দু’টা ভেন্ডিং মেশিনও ছিল।

সেখানে মোটর সাইকেল থামালো মিকি। আর কেউ ছিল না আশেপাশে। রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালে নিচের চমৎকার দৃশ্য মন ভরে উপভোগ করা যায়। তবে একটু সামনে এগোলেই মোটামুটি গভীর একটা খাদ। একটা সিঁড়ি নেমে গেছে দুই রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে।

কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে নিচের দৃশ্য দেখলো সে। ছাইরঙা মেঘগুলোর প্রভাবে আশপাশের সবকিছুর মধ্যেই এক ধরনের ধূসরতার ছাপ। হেমন্তের সবুজও কিছুটা মলিন হয়ে গেছে। এসময় একটা গাড়ি এসে থামলো সেখানে। ড্রাইভিং সিট থেকে এক তরুণী বের হয়ে এসে রেলিংয়ের ধারে দাঁড়ালো। একাই এসেছে সে। পরনে বিজনেস স্যুট, হাতে মাঝারি সাইজের একটা ম্যাপ।

“আমি শহরে যেতে চাইছি যত দ্রুত সম্ভব,” মিকির উদ্দেশ্যে বললো সে। “আপনি কি একটু পথ দেখিয়ে দিতে পারবেন?” এরপর মোটর সাইকেলটা দেখে মিকিকে জবাব দেয়ার সুযোগ না দিয়েই বলে ওঠে, “আপনার বাইকটা দারুণ। কিন্তু এরকম আবহাওয়ায় বাইক চালাতে অসুবিধে হয় না? ঠান্ডা একদমই ভালো লাগে না আমার,” একবার রেলিংয়ের ঠান্ডা হাতল ধরেই পিছিয়ে গেল সে।

কিন্তু বেশিদূর পেছাতে পারলো না। কিছু বুঝে ওঠার আগেই জোরে ধাক্কা দিয়ে তাকে নিচে ফেলে দিল মিকি। রেলিংটা বেশ নিচু হওয়াতে, চেষ্টা করেও সেটা আঁকড়ে ধরতে পারলো না তরুণী। ধাক্কা দেয়ার পর আশপাশে তাকিয়ে মিকি লক্ষ্য করলো যে কোন প্রত্যক্ষদর্শী আছে কিনা।

এরপর নিচে তাকিয়ে দেখলো কোথায় পড়েছে মেয়েটা। প্রথমে চোখে পড়লো না। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর খেয়াল করলো যে একটা বড় গাছের ছায়ায় পাথুরে পাহাড়টা থেকে কিছুটা দূরে নিথর পড়ে আছে তরুণীর দেহ। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে শুরু করলো সে।

এত ওপর থেকে নিচে পড়ার পরেও বেঁচে আছে মেয়েটা। হাত পাগুলো অবশ্য বিপজ্জনক ভঙ্গিতে বেঁকে আছে। চোখ আর মুখ থেকে রক্ত ঝরছে। হতভম্ব ভঙ্গিতে মিকিকে দেখছে সে। ম্যাপটা পড়ে আছে পাশেই। মিকি তুলে নিল সেটা।

একবার পেছনে তাকিয়ে ঢালটা দেখলো মিকি। নিচে একটা বেশ লম্বা পাথর। সেটাতেই নিশ্চয়ই মাথা ঠুকে গেছে মেয়েটার। অনেক ওপরে রুপালি রেলিংটা দেখা যাচ্ছে। চকচক করছে ক্ষীণ আলোতেও।

মেয়েটাকে টেনে বনের আরো ভেতরে নিয়ে এলো মিকি, যাতে ওপর থেকে কেউ কিছু দেখতে না পায়। তার ঠোঁট নড়ছিল গোটা সময়, কিন্তু কোন শব্দ শোনা যাচ্ছে না; গাছের একটা বড় ডাল এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে তার বুক, সে কারণেই বোধহয়। ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে রক্তাক্ত ফুসফুস দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। একটা মোটামুটি সাইজের গর্ত সেখানে এখন। স্পন্দনরত হৃৎপিণ্ডটাও দেখতে পেল মিকি।

অবশ্য তরুণীকে দেখে মনে হচ্ছে না যে সে কোন প্রকার শারীরিক কষ্ট অনুভব করছে। বরং একটা শূন্য দৃষ্টি তার চোখজোড়ায়। এত ওপর থেকে পড়ায় শরীরের সবগুলো হাড়ি ভেঙে যাবার কথা। তাই শুধু মুখ আর চোখই নাড়াতে পারছে কোনরকমে।

সম্মতি প্রকাশের জন্যে দু’বার আর অসম্মতি প্রকাশের জন্যে একবার চোখের পাতার নাড়াবার নির্দেশ দিল তাকে মিকি।

“বুঝতে পারছেন কি বলছি?”

দু’বার নড়লো চোখের পাতা। অর্থাৎ তার কানও কাজ করছে।

এরপর সে জিজ্ঞেস করলো যে কোন প্রকার ব্যথা অনুভব করছে কিনা।

একবার চোখের পলক পড়লো। করছে না।

সে ভয় পেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করলো মিকি। কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেয়েটা। এরপর ম্যাপটার দিকে ইশারা করলো চোখ দিয়ে।

তার সামনে ম্যাপটা খুলে শহরে পৌঁছবার দ্রুততম পথটা দেখিয়ে দিল মিকি। এরপর জিজ্ঞেস করলো কেবল এই উত্তরটাই জানার ছিল কিনা তার। দু’বার চোখের পলক পড়লো।

মেয়েটাকে বিদায় জানিয়ে উঠে পড়লো মিকি। ঘুরতে যাবে এসময় প্রবলভাবে কেঁপে উঠলো মেয়েটার চোখজোড়া। যেন তাকে জিজ্ঞেস করতে চাইছে, এখন কি হবে আমার?

মিকি আমলে নিল না প্রশ্নটা। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে মোটর সাইকেলে চেপে বসলো। মেয়েটার গাড়ির ইঞ্জিন এখনও চালু। প্যাসেঞ্জার সিটের জানালা দিয়ে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল সে। এরপর যা যা

স্পর্শ করেছে সবখান থেকে নিজের হাতের ছাপ মুছে ফেললো।

পরদিন আবারো জায়গাটায় এলো সে। গাড়িটা এখনও আগের মতনই আছে। নিচে মেয়েটাকে দেখতে গেল সে।

এখনও বেঁচে আছে তরুণী। মিকিকে দেখে স্বস্তির একটা হাসি ফুটলো তার মুখে।

মিকি জিজ্ঞেস করলো যে ঠিক আছে কিনা।

দুবার চোখের পলক পড়লো। ঠিক আছে।

তার বুকের গর্তের দিকে তাকালো মিকি। হৃৎপিণ্ডটা এখনও ধুকপুক করছে। ক্ষতস্থান দিয়ে রক্তপাত হয়নি বলতে গেলে।

একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করলো মিকি। এখনও সেভাবে জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়েনি, কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এখন তাপমাত্রা সবচেয়ে কম। কিন্তু মেয়েটা সেই ঠান্ডা অনুভবের কোন লক্ষণই দেখাচ্ছে না। তার চেহারা আর ঠোঁট ফ্যাকাসে হয়ে এসেছে কেবল, কিন্তু ফ্রস্টবাইটের অন্য কোন লক্ষণ নেই।

মিকি জিজ্ঞেস করলো যে তার ঠান্ডা লাগছে কিনা। কিছুক্ষণ ভেবে একবার চোখের পলক ফেললো মেয়েটা।

তার পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে নাম ঠিকানা জেনে নিল মিকি।

পরবর্তী তিনদিন সেখানে এসে মেয়েটার সাথে কথা বলে সে। প্রতিবারই চলে যাবার সময় একাকী একটা দৃষ্টি ভর করে মেয়েটার চেহারায় চতুর্থ দিন এসে গাড়িটাকে আর পেলো না মিকি।

সেদিন মিকিকে দেখে দীর্ঘ একটা সময় তাকিয়ে থাকলো মেয়েটা, যেন কিছু বলতে চায়। এরপর চোখ দিয়ে বুকের দিকে ইশারা করলো। কাছাকাছি গিয়ে উঁকি দিয়েই পেছনে সরে এলো মিকি। একটা সাপ আশ্রয় নিয়েছে মেয়েটার বুকের গর্তে। ওকে দেখে লাল জিহ্বা বের করে হিস হিস করলো কয়েকবার। এখনও নিশ্চয়ই উষ্ণ মেয়েটার দেহ। সেজন্যেই তার হৃৎপিণ্ডের ওপরে শীতনিদ্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে সাপটা।

সরীসৃপটাকে ভেতর থেকে বের করে আনলো মিকি। এরপর একটা ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে ফুটো করে দিল হৃৎপিণ্ডটা। যেন ঘুমে ঢলে পড়ছে, এমন ভঙ্গিতে বুজে আসলো মেয়েটার চোখ। শ্বাস নেয়া বন্ধ হয়ে গেল।

কয়েকদিন পর মেয়েটার মৃতদেহ আবিষ্কারের খবর ছাপা হলো স্থানীয় খবরের কাগজে।

সেদিন কেন মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিয়েছিল সেটা নিয়ে খুব বেশি ভাবেনি মিকি। পোকাগুলোর শরীরে যে কারণে পিন ফোঁটাতে, সেই কারণেই ধাক্কা দিয়েছিল হয়তো। সে ক্ষমতা আছে তার।

তাছাড়া ধাক্কা দেয়ার পর কি হয় সেটা জানার কৌতূহলও একটা ভূমিকা পালন করেছে।

*

মিকির কথা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা।

স্টাডিরুমের ডেস্কে রাখা ফোনটা বেজে উঠলো এসময়। উঠে গিয়ে রিসিভারটা কানে দিতেই ওপাশ থেকে তার সম্পাদকের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।

“আপনার পরবর্তী গল্পের জন্যে অপেক্ষা করছি।”

মিকির কাছে মনে হলো আসলে গল্প চাওয়ার জন্যে নয়, বরং সে বেঁচে আছে কিনা তা জানার জন্যে ফোন দিয়েছে লোকটা। এমন না যে ও কয়েকদিন পরপর গল্প দেয়। লেখালেখি তার মূল পেশা নয়, বরং শখের ঘোরেই রূপকথা লেখে। সম্পাদকের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করে তা-ও নয়। কোন গল্প লেখা শেষ হলে তখনই যোগাযোগ করে মাত্র।

দ্বাদশ শ্রেণিতে থাকার সময় তার লেখা একটা রূপকথা বেশ বড়সড় পুরষ্কার পায়। ছোটবেলায় তার বান্ধবীকে বলা গল্পগুলোর একটারই লিখিত রূপ ছিল সেটা।

তার লেখা প্রথম গল্পটা ছিল একটা কাক আর এক অন্ধ মেয়েকে নিয়ে। মেয়েটার জন্যে শহর থেকে চোখ যোগাড় করে আনতে কাকটা।

দ্বিতীয় গল্পটা এক ডাক্তারকে নিয়ে, যে রোগীদের পিঠে জিপার লাগিয়ে দেয় অপারেশনের সুবিধার্থে। এতে প্রতিবার কাটাছেঁড়া করতে হয় না। কিন্তু একবার ভুলবশত এক নার্স জিপারটা বন্ধ করতে ভুলে যায়, ফলে সেই রোগীর ভেতরের সবকিছু বাইরে বেরিয়ে আসে।

তার তৃতীয় কাজটার নাম ‘দ্য কালেক্টেড ব্ল্যাক ফেয়ারি টেইলস’। পাঠকমহলে বেশ ভালো সাড়া ফেলে বইটা। লেখক হবার ইচ্ছে কখনোই ছিল না তার। ভেবেছিল কয়েকটা গল্প লেখার পরই আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে, কিন্তু গল্পগুলো একের পর এক আসতেই থাকে।

“আমরা কি দেখা করে কথা বলতে পারি এবারে?”

জবাবে চুপ করে থাকলো মিকি। প্রকাশকদের সাথে খুব সহজে দেখা করে না সে। কোন সাক্ষাৎকার বা সাহিত্য আলোচনাতেও যায় না। রূপকথার গল্প লেখে সেগুলো যথাস্থানে পাঠিয়ে দেয়। খুব বেশি কাঁটাছেঁড়া ছাড়াই প্রকাশিত হয়ে যায়, বদলে প্রাপ্য সম্মানী পায় সে। এটুকুই।

অনেকেই বলাবলি করে যে শান মিকি নামে আসলে কোন লেখকের অস্তি ত্বই এই। এসবে তার কিছু যায় আসে না।

রিসিভার নামিয়ে রাখলো সে। কাউচের মেয়েটাকে কোলে তুলে নিয়ে স্টাডি থেকে বেরিয়ে গেল। ওজন খুব বেশি না মেয়েটার, বড়জোর দশ কেজি। প্রথমবার শহরে তার সাথে দেখা হয়েছিল মিকির। বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। নাম হিতামি আইজাওয়া।

মিকির মনে আছে, তলকুঠুরিতে প্রথমবার মেয়েটার চোখে বাঁধা কাপড়টা সরানোর পর সে বলে উঠেছিল, “ওগুলো ম্যানেকুইনের হাত পা না?”

অবশ্য তার নিজের হাত পাগুলোও যে যথাস্থানে নেই, সেটা খেয়াল করতে খুব বেশি দেরি হয়নি।

“ওগুলো…আমার?”

হাত আর পা দুটো শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্যে করাত ব্যবহার করেছে মিকি। কোন প্রকার চেতনানাশক ব্যবহার করেনি। তা সত্ত্বেও মেয়েটা টু শব্দ করেনি। এমনকি কাঁটার পর কোন ব্যান্ডেজও বাঁধতে হয়নি। খুব বেশি রক্ত ঝরেনি যে। তবে ক্ষতস্থানগুলো একদম তাজা ছিল তখন অবধি, টকটকে লাল।

হিতোমির পক্ষে আর স্বাভাবিক জামা-কাপড় পরা সম্ভব না। সেজন্যে একটা বস্তার ভেতরে তার গলা অবধি ঢুকিয়ে দিয়েছে মিকি। আরো বেশ কয়েকটা বস্তা বানিয়েছে সে। কোনটায় ফুলের নকশা আবার কোনটা ডোরাকাটা। তবে সেগুলো খুব একটা পছন্দ নয় হিতোমির।

“গলার কাছটায় খচখচ করে,” বলেছিল সে।

শেষে নীল রঙের কাপড় দিয়ে বানানো বস্তাটা বেছে নেয় হিতেমি। গলার কাছটায় বেশ প্রশস্ত ওটার, তাই অসুবিধে হয় না।

ঘুমন্ত কিশোরীকে নিচে নিয়ে এলো মিকি। বুকের কাছটায় ভেজা তার। মাঝে মাঝে মা-বাবার কথা মনে পড়লে কাঁদে মেয়েটা।

সিঁড়ির পেছনদিকে তলকুঠুরিতে যাবার প্রবেশপথ। দেয়ালের রঙ আর দরজার রঙ একই হওয়ায় আলাদা করা বেশ কষ্ট। এই পশ্চিমা নকশার বাড়িটা ভাড়া করার অন্যতম প্রধান কারণ নিচের তলকুঠুরিটা।

লাইটের সুইচ জ্বালিয়ে দিল মিকি। তলকুঠুরির দেয়ালগুলোয় প্লাস্টার

থাকায় লাল ইট দেখা যায়। প্রচণ্ড ঠান্ডা। রীতিমত বাষ্প বেরোয় নাক মুখ থেকে। আর ছাদ বেশ নিচু। তবে মাথা উঁচু করে হাঁটতে সমস্যা হয় না।

চারকোনা একটা জায়গা। টিমটিমে বাটার আলোয় অন্ধকার দূর তো হয়ই না, বরং আরো জমাট বাঁধে কোনার দিকগুলোতে। বেশ কয়েকটা শেলফ সারি সারি দাঁড় করানো। আগের ভাড়াটিয়া রেখে গেছে। সেগুলোতে এখন নানারকম যন্ত্রপাতি আর পুরনো জামা-কাপড় ঠাসা।

শেলফগুলোর একপাশে হিতোমির বিছানা। তাকে সন্তর্পণে সেখানে নামিয়ে রাখলো মিকি।

এসময় পেছনের শেলফ থেকে শিনিচি হিসামোতোর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, “শুনছো…।”

মুখ তুলে তাকালো মিকি। শেলফে দুটো বাক্সের মধ্যখানে শিনিচির চোখ দেখা যাচ্ছে। হিতামির দিকে তাকিয়ে আছে সে।

শেলফের অন্য পাশ থেকে বিশাল একটা দেহের নড়াচড়ার শব্দ কানে এলো। শিনিচির চোখ উধাও গেল ফাঁকটা থেকে। এখন ইউকি মোচিনাগার চোখ দেখা যাচ্ছে সেখানে।

“বুড়োটার কি যেন হয়েছে,” বলে সে। “একটু দেখো তো।”

তলকুঠুরির এক অধিবাসীর ডাকনাম ‘বুড়ো’। তার আসল নাম অবশ্য দাশি কানেদা। মাথা নাড়লো মিকি। ইউকির চোখও উধাও হয়ে গেল ফাঁকা জায়গাটা থেকে। একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ কানে এলো তার।

“ফাঁকা জায়গাটা অবধি চোখ নিয়ে যেতেও হাঁপিয়ে উঠি,” শেলফগুলোর পেছনের অন্ধকার থেকে বলে উঠলো ইউকি।

হিতোমির শরীরে একটা কম্বল টেনে দিল মিকি। যাদের সে কাটাছেঁড়া করে, তারা যে উত্তাপ বা শৈত্য অনুভব করে না, এটা জানা আছে তার। তবুও কাজটা করলো সে।

অনুভব যেমন করে না, অতিরিক্ত তাপ বা শীত তাদের দেহের ওপর কোন প্রভাব ফেলে না। ঠান্ডায় কখনো জমে যাবে না তাদের শরীর। ঠিক সেরকমই ক্ষুধা বা অসুখ-বিসুখ থেকেও সদা মুক্ত তারা। যাদের সে আহত করেছে, মৃত্যু তাদের ওপর করাল থাবা বসাতে পারে না সহজে। কোন অদৃশ্য ক্ষমতা দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়। মিকির ক্ষমতা।

অন্ধকারে গান গাইতে শুরু করলো ইউকি। ইংরেজি ভাষার একটা গান, সুরটা বেদনার। ইংরেজির টিচার ছিল সে, চমৎকার উচ্চারণ। তলকুঠুরিতে ভেসে বেড়াচ্ছে অপূর্ব সেই সুর।

ঘুমের মধ্যেই একবার গুঙিয়ে উঠলো হিতোমি। কি যেন বিড়বিড় করছে। তার মুখের কাছে কান নিয়ে গেল মিকি! দুটো শব্দ বাদে আর কিছু বুঝলো না।

“দাঁড়কাকটা উড়ছে…”

.

রিয়ারভিউ মিররের সাথে লাগানো চাবির রিংটা। তাই গাড়িটার প্রতিটা নাড়াচাড়ায় একই তালে নড়ছে।

“এখানে থাকে এমন কাউকে চেনো?” ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা তরুণ জিজ্ঞেস করলো।

বিচলিত ভঙ্গিতে মাথা কঁকালাম আমি। অচেনা একজনের গাড়িতে উঠে বসতে এমনিতেও অনেক সাহসের দরকার হয়েছে। কিন্তু আমার গন্তব্য যেখানে, সেখানে প্রতিদিন মাত্র দুটো বাস যায়। দুর্ভাগ্যবশত কায়েদি শহরের উদ্দেশ্যে দিনের দ্বিতীয় বাসটাও রওনা হয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। তাই অন্য কারো গাড়িতে লিফট নেয়া ছাড়া উপায় ছিল না।

চাবির রিংটা থেকে চোখ ঘুরিয়ে বাইরের ধূসর আকাশের দিকে তাকালাম। পাহাড় খুব কাছেই, পেঁচিয়ে উপরে উঠে গেছে রাস্তা। মৃত ঘাসে ছাওয়া ঢালগুলো দেখে মনটা কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে উঠলো।

সিডার গাছে ভর্তি একটা জায়গায় থামলাম আমরা। সামনে হলুদ সাদা ক্রসিং গেইট। রেলগাড়ি যাবে।

আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে লোকটা অনেকক্ষণ ধরে, কিন্তু ভয় পাচ্ছি। অপরিচিত কারো সাথে কিভাবে স্বাভাবিক হতে হয়, জানি না। .

সে যেহেতু আমাকে তার গাড়িতে করে গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছে, তাই এভাবে চুপ করে থাকাটাও ভদ্রতার মধ্যে পড়ে না। কি নিয়ে কথা বলবো ভাবতে লাগলাম। আমার তো বলার মত কোন গল্প নেই। স্মৃতিশক্তি হারিয়ে গেছে, তাই অতীতের কিছু যে বলবো তা সম্ভব নয়। আর গত কয়দিনে এমন কিছু ঘটেনি যেটা নিয়ে অপরিচিত কারো সাথে আলাপ করা যাবে। এখন সে যদি অতীত নিয়ে বেকায়দা কিছু জিজ্ঞেস করে বসে, জবাব দিতে পারবো না। তাছাড়া নেহায়েত দরকার না পড়লে কাউকে আমি দুর্ঘটনার কথাটা বলি না।

নতুন কারো সাথে দেখা হলে তারা আমার সম্পর্কে কিছু জানবে না। সেজন্যেই মাথায় যা আসবে সেটাই বানিয়ে বলবো ভেবে রেখেছি। কিন্তু বিভ্রান্তি আর দুশ্চিন্তার দরুণ মুখ খুললে এ মুহূর্তে না তোতলিয়ে কিছু বলতে পারবো না, তাই আপাতত কেবল মাথা নাড়ছি।

স্কুলে বসন্তের ছুটি এখন। অবশ্য পড়াশোনা নিয়ে ভাবনা চিন্তা আরো আগেই ছেড়ে দিয়েছি। গত শিক্ষাবর্ষ শেষ হবার পর একদিনও ক্লাসে যাইনি। তবে সেজন্যে মনে অপরাধবোধ কাজ করে ঠিকই।

তাই যে দিনগুলোতে আসলেই স্কুল বন্ধ থাকে, একটু ভারমুক্ত অনুভব করি ভেতরে ভেতরে। বাড়ি থেকে পালানোর সময় নিজেকে এই বলে প্রবোধ দিয়েছি যে, নতুন কোথাও গেলে কেউ অন্তত আমার দিকে চোখে। রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে তাকাবে না।

বাবা মার উদ্দেশ্যে একটা চিঠি রেখে এসেছি। সেখানে লেখা যে কয়েকদিন বাড়ির বাইরে থাকবো, প্রতিদিন একবার ফোন দিয়ে নিজের খোঁজখবর জানাবো।

কিছুদিন আগে নামির সঞ্চয়ের সব টাকা তুলে নিয়েছি ব্যাঙ্ক থেকে। নিজের নাম লেখা চেকটা নিয়ে গিয়েছিলাম ব্যাঙ্কে। আমার ডেস্ক ড্রয়ারের পেছনে লুকোনো ছিল ওটা। স্মৃতি হারাবার পূর্বে নিয়মিত টাকা জমাতাম আমি।

কিন্তু পিন নম্বরটা ভুলে গিয়েছিলাম। অন্যদের পিন নম্বর ভোলার সাথে আমার পিন নম্বর ভোলার কারণের অবশ্য বেজায় ফারাক। একবার ভাবলাম ব্যাঙ্কের কোন কর্মকর্তাকে আমার পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলবো। সাথে তো স্কুলের পরিচয়পত্র আছেই। কোন ঝামেলা হবার কথা না।

কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছিল যে আগের নামির টাকাগুলো আমার নিজের নয়। সুতরাং অন্য কারো টাকা নিয়ে ব্যাঙ্কের কারো সাথে কথা বলতে গেলে অনর্থক বাজে পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে। যদিও চিন্তাটা পুরোপুরি অমূলক, তবুও মন থেকে ঝেরে ফেলতে পারলাম না।

শেষমেষ সিদ্ধান্ত নেই যে এটিএম বুথ থেকে টাকা তোলার চেষ্টা করবো। পিন হিসেবে প্রথমে জন্মদিনের তারিখ পাঞ্চ করি। বাবার কাছ থেকে তারিখটা শুনে নিয়েছি আগেই।

১০২১।

কাজ হলো না। সিকিউরটি গার্ড চোর সন্দেহে পাকড়াও করবে আমাকে, এই ভয় কাজ করছিল মনে মনে।

মা’র জন্ম তারিখ পাঞ্চ করে দেখলাম এরপর।

০৭২৬।

ভাগ্য নেহায়েত ভালো বলতে হবে। কাজ করলো পিন কোডটা। মনে মনে প্রবল অপরাধবোধ নিয়েই নামির অ্যাকাউন্ট থেকে সব টাকা তুলে। নিলাম। এগুলো আমার নিজেরই টাকা, তবুও মনে হচ্ছে যেন চুরি করেছি।

বেরিয়ে পড়লাম কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে। সাথের ম্যাপ দেখে বোঝার চেষ্টা করলাম কোন রুট দিয়ে গেলে সবচেয়ে সুবিধা হবে। কাজুয়া যে শহরে থাকে সেটার নাম কায়েদি। খুব বেশি লোক থাকে বলে মনে হয় না। ম্যাপে এত ছোট করে জায়গাটার নাম লেখা যে প্রথমে চোখেই পড়েনি।

যাত্রার প্রস্তুতি নেয়ার দিনগুলোতেও একটার পর একটা স্বপ্ন দেখতেই থাকি। তবে সবগুলো স্বপ্নই কাজুয়ার ছেলেবেলা সম্পর্কিত। সেদিনের সেই ঘটনার মত আর কিছু দেখিনি। প্রতিবার তার চোখ দিয়ে সাওরি বা অন্য কাউকে দেখার পর কাঁদতে ইচ্ছে গলা ছেড়ে। স্বপ্নটা যতই আনন্দের হোক না কেন। কাজুয়া মৃত, কথাটা ভাবলে কিছু একটা দলা পাকিয়ে আসে গলার কাছটায়।

“এই ছোট্ট শহরটায় গিয়ে কি করবে?” ড্রাইভার জানতে চাইলে আগ্রহী কণ্ঠে।

“একজনের সাথে দেখা করতে হবে,” দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বললাম।

“তুমি না বললে কায়েদির কাউকে চেনো না?”

“আসলে… ব্যাপারটা…” কি বলবো খুঁজে পেলাম না।

গাড়ি যতই সামনে এগোচ্ছে, আশপাশের পরিবেশের সাথে বাম চোখে দেখা জায়গাটার পরিবেশের মিল খুঁজে পাচ্ছি। কাজুয়া আর সাওরির বাসস্থানেই যাচ্ছি। এ বিষয়ে আর কোন সন্দেহ নেই।

রাস্তার পাশের দেবদারু গাছ আর ট্রান্সমিশন টাওয়ারগুলো আগেও দেখেছি। কাজুয়ার চোখ দিয়ে। বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল। এখন বসন্ত চলছে। কিন্তু আশপাশের দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছে শীত। গাছগুলোর বেশির ভাগেরই পাতা নেই। গাড়ির জানালার ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা বাতাস ভেতরে ঢাকায় শরীর কেঁপে উঠছে কিছুক্ষণ পরপর। এই ঠান্ডায় বরফ পড়লেও অবাক হবো না।

একটা সিগন্যালে কিছুক্ষণের জন্যে থামলো গাড়ি। আশপাশে অবশ্য অন্য কোন গাড়ি নেই। বামপাশে পরিত্যক্ত কয়েকটা সাদা ট্রেইলার পড়ে আছে। ওগুলোর পেছনে ঘন বন। পরের সিগন্যালটায় বড় একটা সাইন চোখে পড়লো।

বাম চোখটা গরম হতে শুরু করেছে। এটা তো…

“গাড়িটা একটু থামাবেন?” মনে সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করলাম।

একটা সন্দেহ ভর করলো তরুণ ভদ্রলোকের চেহারায়। সবুজ বাতি জ্বলে উঠেছে কিছুক্ষণ আগে।

“কি হয়েছে?” জিজ্ঞেস করলো ড্রাইভার। “অ্যালার্জি?”

বাম চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। অনেকেই আগে এই একই প্রশ্ন করেছে আমাকে। চোখের পানি মুছে মাথা ঝাঁকালাম। “একটু বাইরে যেতে পারি?” জিজ্ঞেস করলাম। “এক্ষুনি ফিরবো।”

তার অনুমতির অপেক্ষা না করেই দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম। বাইরের বাতাস খুব বেশি ঠান্ডা। সেটাই স্বাভাবিক, এখানে তো আর হিটার নেই।

বিশাল সাইন বোর্ডটার নিচে এসে দাঁড়ালাম। দু’টো খুটির ওপর ঝোলানো ওটা। সাইনবোর্ডে খুব সুন্দর একটা ছবি। হয়তো কোন কোম্পানির পক্ষ থেকে এখানে লাগানো হয়েছিল, এখন অবশ্য কোম্পানির নামটা মুছে গেছে। কিছুক্ষণ ওটার নিচে হাঁটাচলা করলাম। কয়েকবার আঙুল দিয়ে টোকা দিলাম ধাতব খুটিগুলোয়। মুখে হাসি ফুটেছে কখন যেন।

ড্রাইভার লোকটা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তার সময় নষ্ট করা উচিৎ হচ্ছে না ভেবে আবারো ফিরে এলাম গাড়িতে।

“আমার পরিচিত একজন অনেক আগে খেলতে এখানটায়। তখন অবশ্য কেবল ঝোলানো হচ্ছে সাইনবোর্ডটা…”

বাম চোখের স্বপ্নে একজন লোককে সাইনবোর্ডের ছবিটা আঁকতে দেখেছিলাম। খেলতে খেলতে নীল রঙের কৌটাটা উল্টে দিয়েছিল কাজুয়া। চোখের উচ্চতা থেকে বোঝা যাচ্ছিল যে বয়স খুব একটা কমও না তখন তার। কিন্তু কৌটা উল্টে যাবার সাথে সাথে ঝেরে পালায় সেখান থেকে।

দৃশ্যটা মনের পর্দায় ভেসে ওঠায় না হেসে পারলাম না। একই সাথে দুঃখে ভারি হয়ে উঠলো হৃদয়টা।

গাড়ি চলতে শুরু করেছে আবার। ব্যাকপ্যাক থেকে বাইন্ডারটা বের করে স্বপ্নটা টুকে নিলাম। ভেতরে ভেতরে আনন্দ দানা বাধছে। সাইনবোর্ডটার সামনে দাঁড়ানোর পর থেকে কাজুয়ার জীবনকে অনেক বেশি বাস্তব মনে হচ্ছে এখন। আমি আর কাজুয়া যে সম্পূর্ণ ভিন্ন দু’টো সত্তা, এটা ভুলে যাই মাঝে মাঝে।

“কায়েদি পৌঁছে গেছি আমরা,” ড্রাইভার বললো।

গাড়ির জানালা দিয়ে যে দৃশ্যটা দেখতে পাচ্ছি, তাতে মন ভরে গেছে।

“তবে একটা জায়গায় একটু কাজ আছে আমার,” বললো সে। “সেখানে যদি আগে যাই, কোন সমস্যা হবে?”

“না,” ছোট করে বললাম। কায়েদিতে কোথায় যাবো, সেটা আসলে আমি নিজেও জানি না এখন পর্যন্ত। সাওরি আর কাজুয়ার শহরে যেতে হবে–এ কথাটাই মাথায় ঘুরছিল কেবল। এর বেশি এখনও কিছু ভাবিনি।

একটা থাকার জায়গা খুঁজে বের করতে হবে। সেখান থেকে সাওরির খোঁজ করবো। এখনও নিশ্চয়ই বেঁচে আছে সে। কাজুয়া খুব সম্ভবত দুই কি তিন মাস আগে মারা গেছে। সাওরি এখনও এখানেই থাকার কথা। এরপর খুঁজতে হবে নীল ইটের বাড়িটা।

অবশেষে কাজুয়ার শহরটা চোখে পড়লো আমার। ওটার মাঝ দিয়ে ধমনীর মত একেবেকে বেরিয়ে গেছে হাইওয়েটা। খুব বেশি যানবাহন চোখে পড়লো না। চারদিক মোটামুটি নিশ্চুপ।

জানালা দিয়ে কোন উঁচু দালান দেখতে পেলাম না। ছড়ানো ছিটানো কয়েকটা দোতলা বাড়ি আর দোকানপাট। ফাঁকা জায়গাগুলোতে মৃত ঘাস। ডাস্টবিনে ময়লা গুঁকছে একটা নেড়ি কুকুর।

সদ্য কাটা দেবদারু গাছ ভর্তি একটা ট্রাক চলে গেল উল্টো পাশের রাস্তা দিয়ে। ড্রাইভার লোকটার কাছে শুনলাম একটা আপেল খামার আছে পাহাড়ের ওপরে। সেটাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে শহরটা। অ্যালার্জি আছে এরকম কারো থাকার পক্ষে জায়গাটা সুবিধাজনক কিনা ভাবলাম মনে মনে। সাওরির হয়তো এই অ্যালার্জির কারণেই সবসময় নাক থেকে পানি ঝরে।

একটা সুপারমার্কেট চোখে পড়লো। ওখানে পর্যাপ্ত ক্রেতা সমাগম হয় কিনা কে জানে। এমনকি সামনের সাইনবোর্ডটাও মলিন। গলায় ভোয়ালে পেঁচিয়ে বয়স্ক এক লোক ছোট মিট্রিাক থেকে অ্যালকোহলের কেস নামিয়ে। যাচ্ছে।

প্রাণহীন শহরটার বাতাস আমার শহরের তুলনায় কিছুটা পাতলা। উচ্চতার কারণে এমন লাগছে বোধহয়। রাস্তার মার্কিংগুলো উঠে গেছে জায়গায় জায়গায়। কে বলবে যে এখান থেকে মাত্র বিশ মিনিটের দূরত্বে একটা রেল স্টেশন আছে?

গাড়ির মধ্যে কয়েকবার কথা বলে উঠতে গিয়েও চুপ করে গেলাম। বাঁ চোখের স্বপ্নে দেখা দোকানপাট, রাস্তা আর দৃশ্যপাট পেছনে ফেলে যাচ্ছি। এই শহরটাতেই থাকতো কাজুয়া। পরিচিত কিছু চোখে পড়লেই ড্রাইভার লোকটাকে গাড়ি থামাতে বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তাতে সে বিরক্ত হবে ভেবে করছি না। বরং জানালায় কপাল ঠেকিয়ে প্রাণভরে দেখে নিচ্ছি সবকিছু।

“শহর থেকে একটু বাইরে জায়গাটা,” লোকটা বললো এসময়। “একটা জিনিস পৌঁছে দেব।”

কিছুক্ষণের মধ্যে হাইওয়ে থেকে একটা পার্শ্বরাস্তায় নেমে গেল গাড়িটা। আশপাশে বাড়ির সংখ্যা তুলনামূলক কম এখন। এখানকার দৃশ্য আগের মত পরিচিত ঠেকছে না দেখে কিছুটা হতাশ হলাম। বিষণ্ণতা ভালো করে জেঁকে বসার আগেই গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলো লোকটা।

পেছনের সিট থেকে একটা বাক্স বের করে বললো, “কাজ শেষ করেই তোমাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেব।”

কিন্তু সেটার আর দরকার হবে না। গাড়ি থেকে বেরিয়ে সে যে বাড়িটায় প্রবেশ করেছে সেটার দিকে তাকালাম।

আসলে বাড়ি না বলে ক্যাফে বলাটাই বোধহয় ঠিক হবে। মাউন্টেইন লজের মত দেখতে। অনেকবার দেখেছি আগে।

মেলানকলি গ্রোভ।

সাওরি কাজ করে এখানে।

*

কাঠের দরজাটা খুলে ভেতরে পা রাখলাম। হিটারের আরামদায়ক উষ্ণতা সাদর আমন্ত্রণ জানালো। প্রবেশপথের বামদিকে কাউন্টার আর ডান দিকে কয়েকটা টেবিল। এসব আগেই দেখা আমার। কাঠের মেঝেতে নিজের প্রতিটা পদশব্দ কানে মধুর মত বাজছে যেন। কাউন্টারের সামনে পাতা টুলগুলোর একটায় বসলাম।

পেছন থেকে মালিক বের হয়ে এসে বললো, “স্বাগতম।

পালস দ্রুত হয়ে গেল আমার। এনাকে আগে বেশ কয়েকবার দেখেছি আমি। গাট্টাগোট্টা শরীর, নাকের নিচে পুরু গোঁফ। স্বপ্নে যেরকম বড়সড় দেখাত, বাস্তবেও সেরকমই দেখাচ্ছে। এরকম বিশাল শরীর নিয়ে কাউন্টারের পেছনে ছোট্ট জায়গাটায় কিভাবে সারাদিন বসে থাকে কে জানে।

“কোন সমস্যা?” আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো সে।

“না। মাফ করবেন,” বলে চোখ নামিয়েনিলাম।

ক্যাফের পরিচিত দশ্যে একবার নজর বুলালাম। সেই একই ফুলদানি, একই ফুল আর একই টেবিল চেয়ার। সোডিয়াম বাতির হলদেটে আলো। বাম চোখে এমনটাই দেখেছিলাম।

“এখনই অর্ডার করবেন?” জিজ্ঞেস করলো ক্যাফে মালিক।

দ্রুত মেনু খুলে প্রথম যেটা চোখে পড়লো সেটার নামই উচ্চারণ করলাম। “ক্যারামেল কফি, প্লিজ।”

ক্যাফের পেছনের দরজা দিয়ে আমাকে যে লোকটা এতদূর অবধি লিফট দিয়েছে সে প্রবেশ করলো এসময়। বড় বেশি কাকতালীয় ব্যাপারটা। মেলানকলি গ্রোভেই আসছিলো সে! মালিককে আগে থেকেই চেনে। হেসে হেসে কথা বলছে এখন। হয়তো শহরে আসার পথে তাকে কিছু মালপত্র নিয়ে আসার অনুরোধ করেছিল ক্যাফে মালিক। আশপাশে বারবার উঁকি দিচ্ছে ড্রাইভার লোকটা। বোধহয় কাউকে খুঁজছে।

দু’জন খদ্দের আছে ক্যাফেতে এ মুহূর্তে। ধূসর চুলের বয়স্ক এক মহিলা। বয়স ষাটের আশেপাশে। জানালার ধারে বসে আছে সামনে একটা বই আর কফির কাপ নিয়ে। দুর্বল হাতে একটা পৃষ্ঠা ওল্টালেন মহিলা। পরনের পোশাকগুলো বেশ দামি। কাছেপিঠেই থাকেন কিনা কে জানে। দেখে মনে হচ্ছে এখানে নিয়মিত আসেন।

আরেকজন খদ্দের বসে আছে একদম পেছনের দিকে। প্রথমে তাকে খেয়ালই করিনি ঠিকমতন। ওদিকটায় আলো কিছুটা কম। লোকটার পরনের পোশাক কালো হওয়ায় অন্ধকারে মিশে গেছেন প্রায়।

একটু পর ড্রাইভার লোকটা আমার কাছে এসে বললো যে কাজ শেষ তার।

“এখানেই থেকে যাবো আমি। লিফটের জন্যে ধন্যবাদ,” একটু ভেবে জবাব দিলাম।

বিদায় জানিয়ে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে গেল সে। আমার জন্যে তার চোখের দুশ্চিন্তাটুকু অবশ্য নজর এড়ালো না। বোধহয় ভাবছে এরকম একটা জায়গায় একা একা কি করব। দৃষ্টিটা আগেও দেখেছি বলে মনে হলো। হয়তো কোন একটা স্বপ্নে, এই ক্যাফেতেই। জার্নালটা এত মোটা যে সবগুলো ঘটনার কথা মনে না থাকাই স্বাভাবিক।

আমার ক্যারামেল কফি নিয়ে ফিরে এল ক্যাফে মালিক। “এই নিন মিস, কাপটা আমার সামনে নামিয়ে রেখে বললো সে।

আবারো চোখে কৌতূহল নিয়ে তাকালাম তার দিকে। এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে সে আমার সামনেই আছে।

কাজুয়া প্রায় সময়েই আসততা এই ক্যাফেতে। সাওরি এখানে কাজ করে, সেজন্যেই বোধহয়। এমনকি ক্যাফেটা প্রথম যখন খোলে, সেদিনও এখানে এসেছিল। তখন বোধহয় মিডল স্কুলে পড়তো সে। মালিক অবশ্য অন্য একজন ছিল তখন। কিছুটা বয়স্ক এক লোক।

বাসায় কফির কাপের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় একদিন বাঁ চোখটা গরম হয়ে উঠেছিল। সেদিন দেখেছিলাম দৃশ্যটা। সবকিছু একদম ঝ চকচকে ছিল তখন ক্যাফেটার। স্কুল বাদ দিয়ে এসেছিল কাজুয়া, ইউনিফর্ম পরেই। পেছনে বসে দেখছিল উদ্বোধনী দিনের ব্যস্ততা। ধূসরচুলো লোকটার চেহারা তখনই তার চোখে লম্বা সময়ের জন্যে অঙ্কিত হয়ে যায়।

সবকিছুরই অতীত আছে, ভাবলাম আমি। এই ক্যাফেটারও। হয়তো এখানে আমিই একমাত্র ব্যক্তি, যার কোন অতীত নেই।

খুব অদ্ভুত লাগছে। আমার ব্যাকপ্যাকে যে বাইন্ডারটা আছে সেখানে এই শহর আর শহরের লোকদের বিশদ বর্ণণা। কিন্তু বাস্তবে তাদের সম্পর্কে কিছুই জানি না। “এক্সকিউজ মি…” ক্যাফে মালিকের উদ্দেশ্যে এটুকু বলে চুপ করে গেলাম। বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। তাকে আমি আগে অনেকবার দেখেছি, কিন্তু সে তো আমাকে কোনদিন দেখিনি।

“কিছু বলবেন?” বয়সে তার চেয়ে আমি অনেক ছোট। তবুও আপনি করে বলছে লোকটা।

“এভাবে হঠাৎ জিজ্ঞেস করাটা হয়তো উচিৎ হচ্ছে না…” অনেকক্ষণ ধরেই একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে আমার মাথায়। “আপনার নামটা জানতে পারি কি?”

স্বপ্নগুলোয় যেহেতু কোন শব্দ নেই, ভদ্রলোকের নামটাও কখনো জানা হয়ে ওঠেনি। সেজন্যেই প্রশ্নটা করা।

স্বাভাবিক ভাবেই অবাক হয়ে গেল লোকটা। “কিমুরা… কিন্তু কেন…”

“ধ-ধন্যবাদ,” কোনমতে বললাম। গাল লাল হয়ে উঠছে আমার। অবশ্য মনে মনে কিছুটা ভালোও লাগছে। লোকটার নাম তাহলে কিমুরা।

কাউন্টারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে ভালো করে তাকালো কিমুরা। গতানুগতিক জাপানিজদের তুলনায় একটু বেশিই লম্বা সে। অনেকটা ভালুকের মতন। একটা হাসি ফুটেছে তার চেহারায়। সেই হাসি দেখে আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হবার যোগাড় হলো আমার। “আমার নাম কেন জানতে চাইছেন?”

এই প্রশ্নের যথাযথ কোন জবাব নেই আমার কাছে।

“না, মানে… এখানে আগেরবার যখন এসেছিলাম, তখন কেউ একজন আপনার নাম ধরে ডেকেছিল। সেটাই মনে করে চেষ্টা করছিলাম,.. তাই…” বাক্যটা শেষ করতে পারলাম না।

“এখানে আগে এসেছেন আপনি? কতদিন আগে?”

“দু’বছর,” এ মুহূর্ত দ্বিধার পর বললাম। বানোয়াট একটা কথা।

বুকের ওপর হাত ভাঁজ করে রেখে সন্দিহান চোখে আমার দিকে তাকালো কিমুরা। “মিথ্যে বলবেন না। সব কাস্টমারের চেহারা মনে থাকে আমার।”

“মিথ্যা বলছি না,” আতঙ্ক চেপে বললাম।

“তাই নাকি…” বলে কিছুক্ষণ ভাবলো কিমুরা। “এখানে একটা জিনিস অল্প কিছুদিন ধরে আনা হয়েছে। বলুন তো সেটা কি? অন্য সবকিছু দু’বছর আগে যেরকম ছিল, সেরকমই আছে।”

জানালার ধরে বসে থাকা বয়স্ক মহিলাটা উঠে দাঁড়ালো এসময়। “আহ… কিমুরা, থামো তো। আমিও তো এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারবো না।”

তিনি যে আমাদের কথা শুনছেন, তা আগে খেয়াল করিনি।

“আমাদের কথা শুনছিলেন আপনি, কিয়োকো?”

হাতের বইটা বন্ধ করে কড়া চোখে কিমুরার দিকে তাকালেন কিয়োকো।

“কিয়োকো ঠিকই বলেছেন। প্রশ্নটা বেশি কঠিন হয়ে…” কিমুরা বলতে শুরু করলো।

হাত উঠিয়ে মাঝপথেই থামিয়ে দিলাম তাকে। “আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো আমি।” দেয়ালে ঝোলানো একটা পেইন্টিংয়ের দিকে ইশারা করলাম। কালো বনের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা একটা হ্রদ দেখা যাচ্ছে ছবিটায়। অবাক হয়ে গেল কিমুরা। ঠিক উত্তরটাই দিয়েছি আমি।

ক্যাফের একদম পেছনে বসে থাকা লোকটা উঠে দাঁড়ালো এসময়। চেহারা বেশ সুন্দর তার, অন্ধকারে বসে থাকায় আগে বুঝতে পারিনি। লম্বা চুলগুলো কপাল অবধি নেমে এসেছে, চোখে পাতলা ফ্রেমের চশমা। এমন ভাবে হাঁটছে যে কোন শব্দই শুনতে পাচ্ছি না। কাউন্টারের সামনে এসে বিল মেটানোর জন্যে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করলো সে।

কিমুরা সাহেবের চক্ষু ছানাবড়া। বেচারা কল্পনাও করতে পারেনি যে আমি আসলেও ঠিকঠাক জবাবটা দিয়ে দিব। সুন্দরমত চেহারার লোকটার কাছ থেকে বিলের টাকা সংগ্রহ করার সময়েও বিড়বিড় করে কিসব বলতে লাগলো।

ক্যাফে ছেড়ে বেরিয়ে যাবার সময় আমার দিকে এক ঝলক তাকালো লোকটা। সে-ও হয়তো আমাদের কথোপকথন শুনছিল।

“যেই লোকটা মাত্র বের হয়ে গেল,” কিমুরা বললো। “সে-ই এঁকেছে ছবিটা। শিওজাকির নাম শুনেছেন?”

মাথা ঝাঁকালাম।

“তার সম্পর্কে কিছু মনে নেই?”

আমার যে কোন কিছু সম্পর্কেই মনে নেই, এটা বলতে গিয়েও বললাম না।

“থাকার জন্যে এরকম একটা জায়গা হঠাৎ কেন বেছে নিল সে, কে জানে। যাইহোক, আপনি এখানে কোন কাজে এসেছেন?”

কি বলবো ভাবতে লাগলাম। সত্যিটা বলে দেব? স্বপ্নে দেখেছি একটা মেয়েকে অপহরণ করা হয়েছে। হয়তো তার সাহায্যও পাবো।

কিন্তু আমার কথা কেন বিশ্বাস করবে? আমাকে তো চেনেও না ঠিকমতোবাম চোখ প্রতিস্থাপনের পর সেই চোখের পুরনো স্মৃতিগুলো থেকে এসব জেনেছি, এই কথাটা যে কারো কানে অদ্ভুত শোনাতে বাধ্য। বলা যায় না, হেসেও উঠতে পারে।

“একজনকে খুঁজছি আমি,” শেষমেষ বললাম। কথাটা পুরোপুরি মিথ্যাও না। সাওরি আর হিতোমি আইজাওয়া। এই দু’জনকে খুঁজছি। সেই সাথে খুনীকেও। “এখানে পার্টটাইম চাকরি করেন না একজন?”

“আপনিও সাওরির খোঁজে এসেছেন?” হাসি ফুটলো কিমুরার মুখে।

থমকে গেলাম তার উত্তর শুনে। এই প্রথম কেউ সাওরির নাম উচ্চারণ করলো আমার সামনে।

“আমিও খুঁজছি… মানে?”

“মেয়েটার শুভাকাক্ষীর সংখ্যা কম না। আপনাকে যে এখানে পৌঁছে দিল, সে প্রায়ই আসে তার সাথে দেখা করতে। একটু আগে যখন বললাম ঠান্ডার কারণে আজ আসতে পারেনি, সুরসুর করে বেরিয়ে গেল। ভেতরে ঢুকে প্রথমে কিছু একটা অর্ডার তো করতে পারতো।” একটা গালি দিল কিমুরা।

সাওরি আজকে আসেনি শুনে হতাশও হলাম আবার কিছুটা স্বস্তিও পেলাম। হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে কি বলতাম সেটা জানিনা, এখনও সে ব্যাপারে কিছু ভাবিনি।

তবে মেলানকলি গ্রোভেই কাজ করে সে, এটা এখন একদম নিশ্চিত। কাজুয়ার মৃত্যুর পর চাকরি ছেড়ে দেয়নি।

ক্যাফের ভেতরে মৃদু একটা সুর বাজছে স্পিকারে। এতটাই আস্তে যে মনে হয় অবচেতন মনে কিছু শুনছি। সামনে রাখা কাপটা তুলে নিয়ে কফিতে চুমুক দিলাম। কাজুয়া এখানে বসে এই কাপেই চুমুক দিয়েছিল কিনা কে জানে!

কাউন্টারের মাঝামাঝি সে যে সিটটায় বসততা সেটায় হাত বুলালাম।

উঠে দাঁড়িয়ে আরেকবার ভালোমতো মাথায় গেঁথে নিলাম ক্যাফের ভেতরকার সবকিছু। কেন যেন এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে বাস্তবেও দেখছি সবকিছু। কিমুরা আর কিয়োকো কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তবে তাদের দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে সিটে বসে আবারো চুমুক দিলাম কফিতে।

ক্যাফের পেছনের দরজা দিয়ে এসময় ভেতরে প্রবেশ করলো এক যুবতী। “ময়লা ফেলে দিয়েছি,” কিমুরার উদ্দেশ্যে বললো সে। সোয়েটারে একবার হাত মুছে আমার দিকে তাকালো। চুলগুলো পনিটেইল স্টাইলে বাঁধা। ঠান্ডার মধ্যে বাইরে থাকার কারণেই হয়তো তার গাল আর নাক কিছুটা লাল হয়ে আছে।

“ঐ লোকটাকে মিথ্যে বলেছিলাম আমি,” কিমুরা আমার দিকে তাকিয়ে বললো।

সদ্য ভেতরে প্রবেশ করা যুবতী কাউন্টারের পেছনে রাখা টিস্যু বক্স থেকে একটা টিস্যু বের করে নিয়ে সশব্দে নাক ঝরলো। আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছুটা লজ্জা পেলো মনে হয়। কিছু মনে করবেন না, ছোটবেলা থেকেই ঠান্ডার সমস্যা আমার।”

“সাওরি ফুইয়ুতসুকি…।”

ঘাড় কাত করে আমার দিকে তাকালো সে। যেন জিজ্ঞেস করতে চাইছে আমি কিভাবে তার নাম জানলাম।

“… আপনার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগছে,” বললাম। “আমি কাজুয়ার বন্ধু, আপনা আপনি কথাটা বেরিয়ে গেল মুখ দিয়ে।

কাজুয়ার নাম শোনার পর পুরো বদলে গেছে কিমুরা আর সাওরির মুখভঙ্গি।

সত্যিটা হচ্ছে, এর আগেও বহুবার দেখা হয়েছে আমাদের। আপনাকে অনেক দিন ধরে চিনি। মনে হয় যেন একদম ছোট থেকে একসাথে আছি।

বাইরে স্বাভাবিক থাকলাম। কিন্তু ভেতরে ভেতরে কাঁদছি।

.

“আমার বাসায় চলো তুমি,” সাওরি বললো আমার উদ্দেশ্যে। আমি কাজুয়ার বন্ধু এটা শোনার পর থেকেই ব্যবহার অন্যরকম হয়ে গেছে তার। তাকে খুলে বলেছি যে এখানে কোথাও থাকবো সেটা জানি না। হোটেল ভাড়া করার মত টাকা আছে আমার, কিন্তু কায়েদিতে হোটেল বলতে সেরকম কিছু নেই। তাই একরকম বাধ্য হয়েই সাওরির কথা মেনে নিতে হলো। সত্যি কথা বলতে, আমার ভেতরের একটা অংশ চাচ্ছিলো যাতে সে এরকম প্রস্তাব দেয়। কারণ বাসাটা নিজের চোখে দেখার খুব ইচ্ছে।

“ক্যাফে বন্ধ হওয়া অবধি অপেক্ষা করতে সমস্যা হবে?”

মাথা ঝাঁকালাম। কোন সমস্যা নেই। তাছাড়া খুব বেশি খদ্দের নেই, তাই আমার সাথে গল্প করেই সময় কাটাচ্ছে সে।

আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে জলজ্যান্ত সাওরি আমার চোখের সামনে বসে আছে। তার চেহারার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। মনে হচ্ছে হারিয়ে যাওয়া বোনের দেখা পেয়েছি অনেক বছর বাদে। সম্পূর্ণ অতীত বিহীন আমার জন্যে সে-ই সবচেয়ে কাছের আত্মীয়। তার সাথে যত স্মৃতি আছে, মা-বাবার সাথে তার ছিটেফোঁটাও নেই। অবশ্য স্মৃতিগুলো সব কাজুয়ার।

কিন্তু তার কাছে আমি সম্পূর্ণ অচেনা একজন ব্যক্তি। এ কথাটা ভুলে গেলে চলবে না।

কিয়োকো তার বিল মিটিয়ে চলে যাবার পর কিমুরা ঘোষণা করলো, “আজকের মত ক্যাফে বন্ধ করে দেই। আর কেউ আসবে বলে মনে হয় না। মেয়েটাকে নিয়ে বাড়ি চলে যাও তুমি। সে যেহেতু কাজুয়ার বন্ধু…”

তার কণ্ঠে সাওরির জন্যে উদ্বেগ টের পেলাম। কাজুয়ার মৃত্যু আসলেও অনেক কিছু ওলট পালট করে দিয়েছে তাদের জীবনে।

সাওরির সাথে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে এলাম কিছুক্ষণ পর। বাস্তবে এই প্রথম তার পাশাপাশি হাঁটছি, যদিও কাজুয়ার স্মৃতিতে এই কাজ অনেকবার করেছি। তাই খুব বেশি অপরিচিত ঠেকছে না দৃশ্যটা।

বাইরে বেশ ঠান্ডা। ক্যাফের আরামদায়ক উষ্ণতা পেছনে ফেলে আসায় এখন মনে হচ্ছে রীতিমত জমে যাবো। গাল লাল হয়ে গেছে, দেখে মনে হতে পারে কেউ সজোরে থাপ্পড় কষিয়েছে। ক্যাফের সাইনটা দেখে মনে হচ্ছে হাওয়ায় ভাসছে। একটা সিডার বনের মধ্যে দিয়ে সামনে এগিয়েছে রাস্তাটা।

“আমরা যেখানে যাচ্ছি, সেটা আসলে আমার মামার বাড়ি,” নাক টেনে বললো সাওরি।

বাবা মা মারা যাবার পর সাওরি আর কাজুয়া প্রতিবেশী এক লোকের বাসায় গিয়ে ওঠে। স্বপ্নে তাদের মধ্যকার সম্পর্কটা বুঝতে পারিনি।

“এখন আমি আর মামা একসাথেই থাকি।”

“আপনার মামী?”

“কাজুয়ার দুর্ঘটনার কিছুদিন আগে নিউমোনিয়ায় মারা যান তিনি।

এই স্মৃতিটা দেখিনি বাম চোখে। আসলে এখনও কাজুয়ার ব্যাপারে অনেক কিছু জানি না। বলা যায় তার পুরো জীবনের অভিজ্ঞতার খণ্ড খণ্ড চিত্র দেখেছি মাত্র।

চারিদিক চুপচাপ। বাড়িঘরের সংখ্যাও হাতে গোনা। সাওরি বলেছিল যে ক্যাফে থেকে বাড়িতে পৌঁছুতে পনেরো মিনিটের মত সময় লাগবে। ঠান্ডায় দাঁত ঠকঠক করছে আমার। রাস্তার দু’পাশে লম্বা লম্বা গাছ। কতগুলো পরিত্যক্ত গাড়ি চোখে পড়লো, মরিচার কারণে এখন আর আসল রঙ বোঝা যাচ্ছে না। অন্ধকারে অদ্ভুত দেখাচ্ছে।

একটা পাখির ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ কানে এলো। অন্ধকারের জন্যে বুঝতে পারলাম না যে কি পাখি। তবে অবয়ব দেখে মনে হচ্ছে একটা কাক। দেবদারু গাছগুলোর ওপর দিয়ে উড়ছে।

মেলানকলি গ্রোভে সাওরির সাথে হওয়া আমার প্রথম কথোপকথনের কথা ভাবলাম।

“কাজুয়া নেই এখানে,” বলে সে। এক মুহূর্তের জন্যে বড় অদ্ভুত লাগে কথাটা। তার কণ্ঠস্বর শুনে মনে হয় যেন কোন কাজে একটু আগে বাইরে গেছে কাজুয়া। তবে প্রচ্ছন্ন বেদনার সুরটা কান এড়ায় না।

“দুর্ঘটনার কথাটা জানি আমি।”

“ওহ…” বলে মাথা নিচু করে ফেলে সাওরি।

“ও মারা যাবার পর কি হয়েছে সেটা বলবেন, প্লিজ?”

তখন জানতে পারি যে কিভাবে ভাইয়ের মৃত্যুর সাথে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে সাওরি।

দু’মাস আগে রাস্তায় কাজুয়াকে ধাক্কা দেয় একটা গাড়ি। ড্রাইভার অ্যাম্বুলেন্সের জন্যে ফোন দেয়। কিন্তু কোন সাহায্য আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সে। সাওরি হাসপাতালে গিয়ে মৃতদেহ সনাক্ত করে। সে মুহূর্তে তার মনে কি চলছিল তা ভাবতেও খারাপ লাগে আমার। বাবা-মা’র মৃত্যুর পর কাজুয়াই ছিল তার সবকিছু।

দুর্ঘটনার তারিখটা জিজ্ঞেস করলাম সাওরিকে। আমার অপারেশনের ঠিক আগ দিয়েই। কায়েদি থেকে দশ মিনিটের দূরত্বে একটা পাহাড়ি রাস্তায় মারা যায় কাজুয়া।

নীল দেয়ালের বাড়িটা কাজুয়ার দুর্ঘটনাস্থল থেকে খুব বেশি দূরে হবার কথা না। পরোক্ষভাবে হিতোমির অপহরণকারীই খুন করেছে কাজুয়াকে।

তাকে খুঁজে বের করবো আমি। দুর্ঘটনার যেহেতু দু’মাস হয়েছে মাত্র, হিতোমি হয়তো বেঁচে আছে এখনো। স্থানীয় পত্রিকার খবর অনুযায়ী এক বছর আগে অপহরণ করা হয় তাকে। কিন্তু কাজুয়া তাকে দেখতে পায় দু মাস আগে। তার মৃত্যুর তারিখ শুনে নিশ্চিত হলাম ব্যপারটা। দশ মাসে যেহেতু মেয়েটাকে হত্যা করেনি অপহরণকারী, তার এখনও বেঁচে থাকার সম্ভাবনাই বেশি।

হুটহাট সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছু করা যাবে না। হিতোমিকে বাঁচাতে হলে আগে বাড়িটা খুঁজে বের করতে হবে। প্রমাণ যোগাড় করে পুলিশে খবর দিতে হবে এরপর।

সাওরির পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম যে পরদিনই অপহরণকারীর খোঁজে বের হবো। ভয় লাগছে ভীষণ। কাজটা কি করতে পারবো আমি?

সাওরির বাড়িটার সামনে চলে এলাম।

বাঁ চোখের স্বপ্নে সাওরি আর কাজুয়া প্রথম যেদিন এই বাড়িতে এসেছিল সেদিনকার ঘটনা দেখেছি আম। দরজার পাশে নামফলকে “ইশিনো’ লেখা মোটা হরফে। ওদের মা’র পরিবারের পদবি।

কাজুয়ার বয়স বেশ কম ছিল সেসময়। সাওরির হাত ধরে বাড়িটায় উপস্থিত হয় সে। তার অস্থিরতা স্বপ্নের মধ্যেও স্পর্শ করেছিল আমাকে। শক্ত করে বোনের হাত ধরে বাড়িটার দিকে তাকিয়েছিল অনেকক্ষণ।

সাওরি আমার, মানে কাজুয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে অভয় দেয়ার ভঙ্গিতে হাসে একবার। তার নিজের বয়সও কম ছিল তখন। মনে মনে নিশ্চয়ই উৎকণ্ঠিত ছিল সে-ও। তবুও ভাইকে ঠিকই সাহস যোগাচ্ছিল।

ইশিনোদের সাথে তাদের জীবনের নতুন অধ্যায়ের শুরুটা অবশ্য খারাপ ছিল না। বাচ্চাদের প্রতি সবসময় উদাসীন দৃষ্টিতে তাকাতেন মিঃ ইশিনো। বেশ কয়েকবার তাকে ট্রাক চালাতে দেখে ধরে নেই যে সেটাই তার পেশা। কাজুয়ার চোখের স্মৃতিগুলোয় কখনো হেসে কথা বলতে দেখিনি তাকে। মিসেস ইশিনোই খেয়াল রাখতেন সাওরি আর কাজুয়ার।

“এটাই আমার মামার বাড়ি,” সাওরি বললো। “কাজুয়াও এখানেই থাকতো।”

আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ভেতরে প্রবেশ করলো সে। হয়তো মিঃ ইশিনোর সাথে কথা বলবে।

অপেক্ষা করতে সমস্যা হচ্ছে না কোনও প্রবেশপথের কাছে গিয়ে বাড়িটার আশপাশে তাকালাম। ভেতরে ভেতরে চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। সেই একই মেইল বক্স, খবরের কাগজের স্ট্যান্ড, ছোট একটা গেট। খুবই সাধারণ একটা বাড়ি।

অপারেশনের পর যখন প্রথম নিজের বাড়িতে যাই, তখন এরকম কোন অনুভূতি কাজ করেনি ভেতরে। মনে হয়েছে সম্পূর্ণ অচেনা একটা জায়গায় যাচ্ছি। কিন্তু কাজুয়া আর সাওরির মামার বাসাকে সে তুলনায় আপন ঠেকছে।

এই বাড়ির অনেক স্মৃতি আছে আমার, মানে কাজুয়ার। তার চোখেই সব দেখা।

তার বাবা-মা বেঁচে থাকার সময়েও এই বাড়ির সামনে দিয়ে স্কুলে যেত। আবার হাইস্কুলে পড়ার সময় আর্কেডে ভিডিও গেইম খেলে দেরি করে যখন বাসায় ফিরতো, সাওরি বাইরে দাঁড়িয়ে রাগত ভঙ্গিতে অপেক্ষা করতো তার জন্যে।

“নামি, ভেতরে এসো,” দরজা থেকে বললো সাওরি। কোমড়ে হাত দিয়ে এই অবস্থান থেকেই কতবার ছোটভাইকে বকুনি দিতে দেখেছি

তাকে। “হাসছো কেন?” জানতে চাইলো সে।

মাথা ঝাঁকালাম কেবল জবাবে। ভেবেছিলাম অপরিচিত একটা বাসায় এসে খুব বিচলিত অনুভব করবো মনে মনে, কিন্তু সেরকম কিছু হলো না। সরু করিডোরটা পেরিয়ে একটা মোটামুটি সাইজের হলঘরে পৌঁছুলাম। হলঘরের পাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। বাঁ চোখের স্মৃতিগুলো থেকে জানি যে সিঁড়িটা বেশ খাড়া।

লিভিংরুমটা জাপানি ঐতিহ্যে সাজানো। মেঝেতে তাতামি ম্যাট বিছানো। কোতসু টেবিলটা ঘরের একদম মাঝখানে। ওটার আশপাশে কতগুলো খবরের কাগজ আর পত্রিকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা।

ট্র্যাকস্যুট পরিহিত ধূসর চুলের একজন লোক আমাকে দেখে বাউ করলো। “হ্যালো,” বললো সে। যা ভেবেছিলাম, তার চাইতে চড়া তার গলার স্বর। সামনা সামনি দেখার আগে এতদিন ভেবে এসেছি, তাকে দেখেই হয়তো ভয় পাবো। স্মৃতিগুলোতে সবময় স্ত্রীর সাথে উচ্চবাচ্য করতে দেখে এসেছি।

কিন্তু আমার সামনে এ মুহূর্তে যাকে দেখতে পাচ্ছি, তাকে সম্পূর্ণ অন্যরকম ঠেকছে। খুব একটা লম্বাও নয়। মুখে দুর্বল একটা হাসি শোভা পাচ্ছে। আমার বাম চোখের স্মৃতিগুলোতে তার বয়স কত ছিল? সাওরি আর কাজুয়ার মামি মারা যাবার পর বদলে গেছেন? বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাঁচার ইচ্ছেটাও চলে গেছে মনে হচ্ছে।

তবে এখনও নিয়মিত কাজ করেন আর সাওরির দেখাশোনা করেন তিনি-এটা শুনেছি সাওরির কাছ থেকে। এমনকি রান্নাও করেন দু’জনের জন্যে।

“এরকম অগোছালো অবস্থার জন্যে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি তোমার কাছ থেকে। তুমি করেই বললাম। খাওনি বোধহয় এখনও?”

আমাকে কোতসুর পাশে বসার অনুরোধ করলেন তিনি।

সাধারণত কোথাও গেলে নিজেকে বাড়তি ঝামেলা মনে হয় আমার; বড্ড অনুশোচনা হয় ভেতরে ভেতরে। হয়তো আগের নামির চাইতে নিজেকে ছোট করে দেখি সবসময়-একারণেই। কিন্তু এখানে সেরকম লাগছে না। আশপাশের সবকিছুই আগে দেখেছি। প্রতিবার যখন পরিচিত একটা দৃশ্য দেখি, বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে।

সাওরির জোরাজুরিতে ওদের সাথেই রাতের খাবার সারতে রাজি হতে হলো। সে রান্না করতে গেলে মামার সাথে কথা বলে সময় কাটালাম।

“কাজুয়ার কবর দেখতে এসেছো?” জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

“জ্বি… জানি অনেক দেরি করে ফেলেছি…।”

এখানে আসার পথে কারণ হিসেবে এই কথাটা বলবো বলে ঠিক করেছি।

“সাওরি তোমাকে নিয়ে যাবে সেখানে।”

রান্নাঘর থেকে সাওরির বাসন নাড়াচাড়ার শব্দ ভেসে এলো। একটা স্লাইডিং দরজা লিভিংরুম থেকে পৃথক করে রেখেছে রান্নাঘরটা।

“সাওরি আর কাজুয়ার কাছে আপনার ব্যাপারে অনেক শুনেছি, বললাম।

“তাই? কাজুয়া কিন্তু তোমার ব্যাপারে আমাদের কিছু বলেনি কখনো।”

“আসলে, সেটা…”

“তুমি এসেছো দেখে খুব খুশি হয়েছি,” মাথা নিচু করে বললেন তিনি। তার ব্যবহার একদম ভিন্ন ঠেকছে এখন। চোখের স্মৃতিতে যা দেখেছিলাম, সেগুলো মিলছে না। কাজুয়ার উদ্দেশ্যে কখনো হাসেননি। কিন্তু এখন যা বলছেন, সেগুলো মন থেকেই বলছেন বলে মনে হচ্ছে।

সাওরি আর তার মামার সাথে এক টেবিলে বসে খাবো, এটা কিছুদিন আগেও কল্পনাতে ছিল না। মিশ্র একটা অনুভূতি কাজ করছে ভেতরে ভেতরে।

আমাকে নিয়ে কি চলছে তাদের মনে? এভাবে হঠাৎ করে উদয় হওয়াতে বিরক্ত হয়েছে?

বিরক্ত হলেও সেটা প্রকাশ করছে না। খুব বেশি কথা হলো না রাতের খাবারের সময় মনে হচ্ছে টেবিলের মানুষগুলো একে অন্যের অস্তিত্বের কথা ভুলেই গেছে। তাই অন্য দু’জনের উপস্থিতি সত্ত্বেও একাকী লাগছে ভীষণ।

বাঁ চোখের স্মৃতিগুলোতে কিন্তু দেখেছিলাম রাতের খাবারের সময় বেশ হাসিখুশি থাকতে সবাই। হয়তো তখন মিসেস ইশিনো বেঁচে ছিলেন বলেই গোমড়া ভাবটা জমাটবাধার সময় পেতনা কারো মনে। মাঝে মাঝে একজন মানুষের উপস্থিতিই বদলে দিতে পারে আশপাশের পরিবেশ।

ইশিনোদের বাড়িতে এখন যে দুজন মানুষ থাকে তারা দুজনই অবসাদের ভারে ন্যুজ। ক্ষিধে মরে গেল আমার। সাওরি আর মিঃ। ইশিনোকে এভাবে চুপচাপ আপনমনে খাবার খেতে দেখতে খুব খারাপ লাগছে।

এই থকথকে নীরবতার মাঝেই জিজ্ঞেস করলাম যে মানুষ হিসেবে কাজুয়া কেমন ছিল।

“কাপুরুষ, ভীতু,” সাওরি বললো সাথে সাথে। “আর ভীষণ অলস। পড়াশোনায় মন ছিল না, খেলাধুলাও পারতো না তেমন একটা ভালো কোণ গুণই ছিল না আমার ভাইটার।”

হাই স্কুলের পড়াশোনা চুকে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় কাজুয়া, কিন্তু শেষ করতে পারে না। ক্লাসগুলো নাকি খুব বেশি কঠিন লাগতো তার কাছে। দুর্ঘটনার বছরটা মোটামুটি শুয়ে বসেই কাটিয়েছে।

“তবে মনটা খুব ভালো ছিল,” কিছুক্ষণ পর বললো সাওরি।

মাথা নাড়লাম। আসলে কাজুয়ার নিজের ব্যাপারে খুব কমই জানি আমি। কারণ বাঁ চোখের স্মৃতিগুলোতে সবসময় অন্যদের দেখতাম। কদাচিৎ আয়নার দিকে তাকালে তখন তার চেহারা দেখেছি কয়েকবার। তবে সেই খণ্ড খণ্ড স্মৃতিগুলো থেকেই এটুকু বুঝেছিলাম যে ছাত্র হিসেবে খুব একটা ভালো নয় কাজুয়া। বন্ধুবান্ধবের সংখ্যাও খুব বেশি ছিল না। স্মৃতিশক্তি হারাবার পূর্বে আমি যেরকম ছিলাম, তার ঠিক উল্টোটা ছিল সে।

বাথরুমে গেলাম। সেখানকার আয়নার দিকে তাকাতেই অদ্ভুত একটা চিন্তা খেলে গেল মাথায়। এই যে কাজুয়ার বাম চোখটা ভাগ্যগুণে এখনও বেঁচে আছে, সেটা কি আগের বাসাতে ফিরে নস্টালজিয়ায় ভুগছে? কাজুয়ার টুথব্রাশটা এখনও বেসিনের একপাশে রাখা। দুর্ঘটনার পরেও সাওরি সেটা সরিয়ে ফেলেনি। তবে ব্রাশটা যে আসলেও কাজুয়ার, সেটা কিন্তু কেউ আমাকে বলে দেয়নি। স্বপ্নেও দেখিনি। তবুও মনে হচ্ছে এটাই সত্যি।

লিভিং রুমে ফিরে আসার পর খেয়াল করলাম সাওরি আর তার মামা দু’জনই কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

“বাথরুমটা খুঁজে পেয়েছে তাহলে একাই!” সাওরি বললো। “বেশিরভাগ লোকই হারিয়ে যায় ওটা খুঁজতে খুঁজতে।”

*

গেস্ট রুমে থাকার বন্দোবস্ত করা হলো আমার। ক্লোজেট থেকে একটা তোষক বের করে দিয়েছে সাওরি। কিন্তু ঘুমোতে যাবার আগে একটা কাজ, করতেই হবে আমাকে। আমাকে ইতস্তত করতে দেখে সাওরি জিজ্ঞেস করলো যে কোন সমস্যা হয়েছে কিনা।

কাজুয়ার ঘরটা দেখতে চাই, সত্যটাই বললাম।

এক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে সাওরি, মলিন একটা হাসি ফুটলো তার চেহারায়।

বাম চোখের স্মৃতিতে ঘরটা যেরকম দেখেছিলাম, সেরকমই আছে।

“এখনও নিয়মিত পরিষ্কার করি আমি,” গোটা ঘরটায় আমাকে নজর বুলাতে দেখে বললো সাওরি। “কোন দরকার নেই, জানি। তবুও না করে পারি না।”

একটা বড় জিগস পাজল দেখলাম একপাশে। মোটরসাইকেলে বসা একটা ছেলের ছবি ওটায়। গরম হতে শুরু করলো আমার বাঁ চোখ। স্মৃতির ঢাকনা খুলতে খুব বেশি সময় লাগলো না।

“এই পাজলটার…” নিজের অজান্তেই কথা বলে উঠলাম।

“একটা অংশ হারিয়ে গিয়েছিল। খুব ঝগড়া হয়েছিল সেটা নিয়ে আপনাদের মধ্যে…।”

মাথা নাড়লো সাওরি। “ভ্যাকুয়াম ক্লিনারে পেয়েছিল হারানো টুকরোটা। ওকে না বলেই ঘরটা পরিষ্কার করতে ঢুকেছিলাম সেদিন”

এজন্যেই তাহলে ঝগড়া করছে দুই ভাইবোন, ভাবলাম। বাম চোখের স্মৃতিতে তরুণী সাওরিকে দেখছি কোমড়ে হাত দিয়ে কাজুয়ার সাথে তর্ক করতে। কিন্তু কোন শব্দ না শুনতে পাওয়ায় ঝগড়ার বিষয়বস্তু বুঝতে পারিনি।

টিস্যু বক্স থেকে একটা টিস্যু বের করে নিয়ে নাক ঝরলো সাওরি। ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে।

“আমার ভাই তোমার সাথে সবকিছু নিয়েই কথা বলতো, তাই না?”

পাজলের স্মৃতিটা শেষ হবার সাথে সাথে আরেকটা স্মৃতি ভেসে উঠলো বাম চোখের পর্দায়। এই বাড়িটায় স্মৃতির কোন শেষ নেই কাজুয়ার। বিশেষ করে এই ঘরের বইখাতা, টেবিল, ল্যাম্প থেকে শুরু করে জানালার শার্সি পর্যন্ত ট্রিগার হিসেবে কাজ করছে। কাজুয়ার স্মৃতিগুলো এখানে আরো ভালোমতো অনুভব করতে পারছি।

কাজুয়ার বিছানায় বসে আছে সাওরি।

“আমার ভাই যে মারা গেছে সেটা কার কাছে শুনেছো?”

তৎক্ষণাৎ কোন জবাব মুখে এলো না। কি বলবো? বিশ্বাসযোগ্য উত্তর হিসেবে কি বলা যায় সেটা ভাবছি, এ সময় সাওরি বললো, “পুলিশের ধারণা, কাজুয়ার মৃত্যু আত্মহত্যাও হতে পারে।

কি বলছে সাওরি এসব? আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম যে সবাই এটাকে সড়ক দুর্ঘটনা হিসেবে মেনে নিয়েছে, এর বেশি কিছু না।

“যে গাড়ির সাথে ধাক্কা লেগেছিল কাজুয়ার, সেটার ড্রাইভার বলেছে-হঠাৎ করেই নাকি লাফ দিয়ে তার গাড়ির সামনে এসে পড়ে সে। দুর্ঘটনার আগের কয়েকদিন বাসাতেও বড্ড অদ্ভুত আচরণ করছিল কাজুয়া। কিছু একটা ভেতরে ভেতরে খোঁচাচ্ছিল ওকে। আর কেউ না বুঝলেও আমি ঠিকই বুঝতে পারি। কোন কাজে মন বসাতে পারছিল না। কি যেন ভাবতে সারাদিন,” বলে আমার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো সারি। “ভেবেছিলাম তুমি হয়তো এ ব্যাপারে জানো…?”

তার জন্যে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো আমার। আমি জানি কাজুয়া কেন ওরকম অদ্ভুত আচরণ করছিল। হিতোমি আইজাওয়ার হদিস পেয়েছিল সে। ঘটনাস্থল থেকে পালানোর সময় গাড়ির সামনে পড়ে। এর আগের দিনগুলোতে নিশ্চয়ই ঘটনাটা নিয়ে দিনরাত ভাবছিল সে।

অপহৃত মেয়েটার ব্যাপারে কাউকে কিছু বলেনি। হয়তো সে-ও আমার মতন শক্ত কোন প্রমাণের অপেক্ষায় ছিল। নিশ্চিত হবার জন্যে নীল দেয়ালের বাড়িটায় উপস্থিত হয়েছিল যাতে পুলিশকে ঠিকঠাক সব তথ্য দিতে পারে।

“আত্মহত্যা করেনি কাজুয়া,” বললাম আমি।

আমার চোখের দিকে তাকালে সাওরি। এক মুহূর্তের জন্যে বিস্ময় ভর করলো তার চোখে, তবে দ্রুত কেটে গেল সেই বিস্ময় ভাব।

লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে প্রায় ফিসফিসে কণ্ঠে বললো, “জানি আমি… জানি। কিন্তু ওর মৃত্যুর পর একটুও কাঁদিনি। এমনকি এখনও…অতটা খারাপ লাগে না। অন্য সবাই তো কাঁদছিল, কিন্তু ওর নিজের বোন হয়ে… আমি ঠিক আছি কিভাবে?”

হাতে কিছু একটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে সাওরি। কাজুয়ার পছন্দের সোনালি হাতঘড়িটা। এক পাশের স্ট্র্যাপ ছেঁড়া ওটার।

আমাকে ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাওরি বললো, “ওর বিশতম জন্মদিনে এটা উপহার দিয়েছিলাম।”

এই তথ্যটা জানা ছিল না আমার, কিন্তু ঘড়িটা যে কাজুয়ার খুব প্রিয় সেটা জানতাম। স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে গেলেও সবসময় ঘড়িটা সাথে রাখতো সে।

“দুর্ঘটনায় নষ্ট হয়ে গেছে ঘড়িটা। ঠিক ওর মৃত্যুর সময়টায় কাটাগুলো আটকে যায়,” বলে ঘড়িটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলো সে। “তুমি নেবে এটা?”

মাথা ঝাঁকালাম। “আপনার কাছেই ভালো থাকবে জিনিসটা। কাজুয়াও সেটাই চাইতো নিশ্চয়ই।”

কাজুয়ার একটা স্মৃতিচিহ্ন ইতোমধ্যেই আমার কাছে, আর কিছুর দরকার নেই।

উঠে দাঁড়ালো সাওরি।

“কালকে কবরস্থানে যাবে?”

মাথা নাড়লাম। আসলেও যেতে চাই আমি।

কাজুয়ার ঘর থেকে বের হলাম দুজনে। নিচে নামার সময় সাওরি বললো, “একটু আগে তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে বড় অবাক হয়েছিলাম। একদম ওর চোখের মতন।”

*

শহরের বাইরে মা-বাবার কবরের পাশেই কবর দেয়া হয়েছে কাজুয়াকে। মিঃ ইশিনোর বাসা থেকে হেঁটে যেতে এক ঘণ্টা লাগে।

“যদি গাড়িতে যেতে চাও, তাহলে আমার এক বন্ধুকে বলতে পারি, সাওরি বললো। “ওর ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে।”

সাওরি গাড়ি চালায় না সাধারণত। বললাম যে হেঁটেই যাব।

একটা বিশাল পাহাড়ি উপত্যকায় শত শত কবরফলক। এরকম একটা দৃশ্যও যে মন জুড়িয়ে দিতে পারে, জানা ছিল না। হয়তো আশপাশের পরিবেশটাই এমন। এতগুলো কবরফলকের মাঝে কাজুয়ার কবর খুঁজে বের করা কষ্টসাধ্য।

ফুইয়ুতসুকিদের পারিবারিক কবরটা গোরস্থানের একদম শেষ প্রান্তে। সাওরি গিয়ে কবরের আশপাশ পরিষ্কার করলে প্রথমে। শুকনো পাতা সরিয়ে দিল।

হাত জড়ো করে একসাথে প্রার্থনা করলাম দু’জন। কাজুয়াকে একদম মন থেকে ধন্যবাদ দিলাম তার উপহারের জন্যে। আমাকে তোমার চোখটা দেয়ার জন্যে চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।

ওর স্মৃতিগুলোই যে আমার সুস্থভাবে বেঁচে থাকার পাথেয়, সেটাও বললাম। নতুবা বিষণ্ণতার আস্তাকুঁড়ে এতদিনে আমাকে ছুঁড়ে ফেলতো মহাকাল। অবসাদের চক্র ভেঙে বেরুতে পারতাম না। চোখ হারাবার পর নিজের স্মৃতি বলতে কিছুই তো ছিল না।

হার্ডওয়্যার স্টোরটায় দেখা সেই কষ্টের স্মৃতিটার কথা ভাবলাম। কাজুয়া আর সাওরির বাবা-মা মারা যান সেটায়।

ফেরার পথে নাক ঝরতে ঝরতে সাওরি বললো, “মা-বাবা’র ভাগ্য প্রচণ্ড খারাপ ছিল সেদিন। যে দড়িটা দিয়ে খুঁড়িগুলো বেঁধে রাখা হয়েছিল, সেটা ছিঁড়ে যায় হঠাৎই।”

মেলানকলি গ্রোভের উদ্দেশ্যে হাঁটছি আমরা। শহরের মাঝ দিয়ে একেবেকে যাওয়া হাইওয়েটা পেছনে ফেলে এলাম। কাজুয়ার চোখ দিয়ে দেখেছি, এরকম অনেকগুলো জায়গা বাস্তবেও দেখলাম।

“শুনেছি, কাজুয়া নাকি দুর্ঘটনাটা নিজের চোখে দেখেছিল,” বললাম।

থেমে, বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো সাওরি।

“কাজুয়া বলেছে তোমাকে এটা?”

এরকম প্রতিক্রিয়া আশা করি নি। মাথা নাড়লাম কেবল।

“সেদিন ওখানে যারা ছিল, তারাও একই কথা বলে। কিন্তু কাজুয়ার নিজের মনে ছিল না। বরং সবসময় বলতে যে কিছুই দেখেনি। আমার ধারণা, স্মৃতিটা এতটাই দুঃসহ যে, ইচ্ছেকৃতভাবে সেটা ভুলে যায় কাজুয়া।”

সাওরির কথায় আসলেও যুক্তি আছে। আমার নিজের সাথেও তো একই রকম ঘটনা ঘটেছে।

ব্যাপারটা কাজুয়ার মন ভুলে গেলেও, ছবিগুলো ঠিকই জমা ছিল চোখের স্মৃতিতে।

“নতুন এক কর্মচারির ভুলে দুর্ঘটনাটা হয়েছিল সেদিন। মাত্র কয়েকদিন আগেই মিলে কাজ নিয়েছিল ছেলেটা।

“ছেলে?”

“হ্যাঁ। হাইস্কুল থেকে পাশ করেই কাজে ঢুকে গিয়েছিল। দড়ি দিয়ে সে-ই বেঁধেছিল গাছগুলো। কিন্তু অভিজ্ঞতা না থাকায় ঠিকমতো গিঁট দিতে পারেনি…।”

কোন রাগ নেই সাওরির কণ্ঠে। বরং মনে হচ্ছে যে ছেলেটার প্রতি সহানুভূতি কাজ করছে তার।

গোরস্থান থেকে মেলানকলি গ্রোভে পৌঁছুতে এক ঘণ্টার মত লেগে গেল।

আশপাশের দোকানপাট, বাড়িঘর সবই আমার পরিচিত। কে বলবে যে এই প্রথম সামনাসামনি দেখছি ওগুলো? স্টেশনারি দোকান আর নুডলস শপগুলো এখনও একইরকম আছে।

একটা ক্যান্ডি শপ চোখে পড়লো। ভেতরটা বেশ অন্ধকার। জানালা দিয়ে ভেতরে সারি সারি ক্যান্ডির প্যাকেট দেখা যাচ্ছে। তবে সেই ব্যাগগুলোর ওপর ধুলো জমেছে মনে হলো।

“ভেতরে যাবে নাকি?” সাওরি জিজ্ঞেস করলো। “আগে কাজুয়া প্রায়ই এখানে আসতে এখানে।”

ভেতরে পা রাখতেই পেছন থেকে বেরিয়ে এলো এক মহিলা। পেছনের ঘরে টিভি দেখছিল সে।

“একটুও বদলাননি,” তার উদ্দেশ্যে হেসে বললো সাওরি। মহিলার মুখেও হাসি ফুটেছে, রীতিমত একটা বেড়ালের মত লাগছে এখন তাকে।

কাজুয়ার ছেলেবেলার স্মৃতিগুলোতে তার চেহারা যেমন দেখেছি, এখনও একদম সেরকমই দেখাচ্ছে।

একটা ললিপপ কিনে বেরিয়ে এলাম আমরা।

আবারো নাক ঝারলো সাওরি। টিস্যুটা ফেলে দিল মাটিতে।

“এভাবে রাস্তায় ফেলাটা কি ঠিক হলো?” জিজ্ঞেস করলাম।

“সবকিছু তো একসময় ধুলোতেই মিশে যাবে।”

ওর যুক্তিহীন কথাটা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলাম। আসলে প্রতিদিন এত বেশি পরিমাণে টিস্যুর প্রয়োজন হয় সাওরির যে ব্যবহৃত টিস্যুগুলো বাসায় বয়ে নেয়া সম্ভব না।

আশপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে এগোচ্ছি। পরিচিত কারো সাথে দেখা হলে তাদের উদ্দেশ্যে বাউ করছে সাওরি। আমার দিকে প্রশ্নাতুর চোখে তাকাচ্ছে সবাই। নিশ্চয়ই ভাবছে, এটা আবার কে?

মনে হচ্ছে যে এখানে অনেক লম্বা সময় ধরে আছি আমি। যেদিকেই তাকাই, পরিচিত দৃশ্য চোখে পড়ে। কিন্তু এখানকার অধিবাসীদের চাহনি মনে করিয়ে দেয় যে শহরটায় আমি একজন আগন্তুক।

আগন্তুক। কথাটা হৃদয়ে গেঁথে গেল আমার। ভুল করে এই জগতটায় পা দিয়ে ফেলেছি। আমি নামি, আবার নামি না। তাহলে আমি কে? কোথা থেকে এসেছি? প্রায়ই এই প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খায় আমার মাথায়।

আকাশে মেঘ জমেছে। সকাল থেকে সূর্যের দেখা নেই। যে কোন মুহূর্তে তুষারপাত শুরু হতে পারে বলে মনে হচ্ছে। পুরো শহরটা স্তব্ধ। ঠান্ডা বাতাস ছেড়েছে উত্তর দিক থেকে। খুব বেশি লোক নেই রাস্তায়। যারা আছে, তাদের মুখে হাসি নেই।

শহরটা মরে যাচ্ছে নাকি? ধীরে ধীরে মহাকালের ধূসরতায় অদৃশ্য হয়ে যাবে হয়তো।

মেলানকলি গ্রোভ থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে থেমে গেল সাওরি।

“একটু ঘুরপথে যাওয়া যাক আজকে,” বললো সে।

একটা পার্শ্বরাস্তা ধরে এগোতে লাগলাম আমরা। রাস্তা না বলে পাহাড়ি ঢালু পথ বলা ভালো। ঢাল বেয়ে যত ওপরে উঠতে লাগলাম, শহরটা নিচে নামতে লাগলো। রাস্তার এক পাশে সিডার বন, অন্য পাশে গার্ডরেইল। রেলিংগুলো থেকে কিছুটা দূরে আবারো সারি সারি গাছ।

কিছুদূর হাঁটার পর থেমে গেল সাওরি। নিচের পিচঢালা পথের দিকে তাকিয়ে আছে একমনে।

বুঝতে অসুবিধে হলো না, এখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে কাজুয়া।

সাওরির চেহারায় কোন অনুভূতি নেই। পথটার ঠিক কোন জায়গায় আটকে আছে তার চোখ সেটা বুঝতে পারলাম না। গতরাতেই সে আমাকে বলেছে যে কাজুয়ার মৃত্যুর পর একটুও কাঁদেনি। আশপাশের সবাই ভীষণ কষ্ট পেয়েছে, কিন্তু একমাত্র তার চোখ দিয়েই পানি ঝরেনি।

আমার ধারণা সাওরির হৃদয়ে এখন কেবলই শূন্যতা। বিশাল, অতলান্ত শূন্যতা। আসলে ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদের প্রাথমিক ধাক্কাটাই কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে।

দেখে মনে হচ্ছে যে কোন মুহূর্তে সাথে তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। কাঁধে হাত রাখলাম। অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালে সাওরি।

জানিনা কেন, আমার ভেতরেও একটা অচেনা কষ্ট বাসা বেঁধেছে। সেটা কাজুয়ার জন্যে, নাকি সাওরির জন্যে-তা ঈশ্বরই জানেন। আমার নিজের কষ্টেরও তো শেষ নেই। খুব বেশি নাটুকে শোনাচ্ছে বোধহয় কথাগুলো।

ওপরের পাহাড়ি এলাকাটার দিকে তাকালাম। ওখানেই কোথাও আছে সেই নীল বাড়িটা। যেখান থেকে সব ঘটনার শুরু।

চুপচাপ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রইলাম দু’জন। কারো মুখেই কোন সাড়া নেই। রাস্তার দু’পাশে লম্বা সিডার গাছগুলো নীরবে পাহারা দিয়ে যাচ্ছে কাজুয়ার মৃত্যুস্থল।

*

আমরা ক্যাফের সামনের দরজাটা খোলার সাথে সাথে একটা ঘণ্টা বেজে উঠলো। ভেতরের উষ্ণ বাতাস স্বাগতম জানালো আমাদের।

“হঠাৎ করে ঠান্ডা জায়গা থেকে গরম কোথাও আসলে নাক দিয়ে পানি ঝরা বেড়ে যায় আমার,” কিমুরার উদ্দেশ্যে বাউ করে বললো সাওরি।

“তাই নাকি?”

“হ্যাঁ, আপনার সাইনাসের সমস্যা থাকলে বুঝতেন।”

নাক ঝারলো সাওরি। ক্যাফের ভেতরে ময়লার বাক্সেই টিস্যুগুলো ফেলে সে।

আমাকে গতদিন যে লোকটা লিফট দিয়েছিল তাকে বসে থাকতে দেখলাম কাউন্টারের উল্টোদিকের চেয়ারে। এতক্ষণ ঝিমাচ্ছিল, কিন্তু সাওরিকে দেখামাত্র সোজা হয়ে বসলো। “সাওরি!” বলে হাত নাড়লো ওর উদ্দেশ্যে। চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

“ফিরেছো তাহলে,” পাল্টা হাত নেড়ে বললো সাওরি।

কিছুক্ষণ পর জানতে পারলাম তরুণ ড্রাইভারের নাম সুমিদা। কাজুয়ার বন্ধু ছিল সে।

তবে তাদের বন্ধুত্ব খুব বেশিদিনের না হওয়াতে বাঁ চোখে স্মৃতিগুলোয় সুমিদাকে দেখিনি তেমন একটা। কিছুক্ষণ পর অবশ্য দু’জনের আড্ডা দেয়ার একটা দৃশ্য ভেসে উঠলো চোখের পর্দায়।

এক বছর আগে দেখা হয়েছিল সুমিদা আর কাজুয়ার। মাতাল কাজুয়াকে ট্রেন স্টেশন থেকে মেলানকলি গ্রোভে নিয়ে এসেছিল সুমিদা। সেদিন বিকেলেই একটা পাবে প্রথম কথা বলেছিল তারা।

“ক্লাসের কি খবর?” সাওরি জিজ্ঞেস করলো তাকে।

“ছুটি এখন।”

চেহারা একদম লাল হয়ে উঠেছে সুমিদার। মনে কি চলছে তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।

“গতকাল আমাকে সাহায্য করার জন্যে ধন্যবাদ,” বললাম। সে কাজুয়ার বন্ধু ছিল শোনার পর আগের চাইতে আপন মনে হচ্ছে।

“কিমুরা আমাকে আপনার ব্যাপারে বলেছে,” আন্তরিক হেসে বলল সুমিদা।

একটা টেবিলে বসে সুমিদা আর সাওরিকে দূর থেকে আলাপ করতে দেখলাম।

কিমুরা এক গ্লাস দুধ নিয়ে এলো আমার টেবিলে। সেটা খাবার সাথে সাথে ভেতর থেকে হিমের শেষ অনুভূতিটুকুও বিদায় নিল।

কিছুক্ষণ আগের সাওরি আর এখনকার সাওরির মধ্যে অনেক পার্থক্য। হাসিমুখে সুমিদার সাথে কথা বলে চলেছে, যেন ভাইয়ের কথা ভুলেই গেছে। কিন্তু কাছের কারো মৃত্যু চাইলেই সহজে ভোলা যায় না। এখন সে যা করছে, তা হচ্ছে অভিনয়। ভালো থাকার অভিনয়।

শিওজাকিকে আজকে দেখলাম না ক্যাফেতে, কিন্তু কিয়োকো ঠিক আগের জায়গাটাতেই বসে আছে। চোখাচোখি হলে একবার হাসলো সে, আমাকে তার টেবিলটায় বসায় আমন্ত্রণ জানালো।

“তুমি কি সাওরির ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড?”

“জ্বি?”

“কিমুরা তো সেটাই বলছিল।”

ওহ! আমাকে তাহলে কাজুয়ার প্রেমিকা ধরে নিয়েছে সবাই।

তার চোখের দিকে তাকাতে পারলাম না। গাল লাল হয়ে উঠছে। চাই সেটা কেউ দেখুক।

“আমি কায়েদিতে এসেছি খুব বেশিদিন হয়নি,” কিয়োকো বললো। “তাই কাজুয়ার সাথে খুব বেশি মেশার সুযোগ পাইনি।

আমার বাঁ চোখে দেখা স্মৃতিগুলোর কোনটায় তাকে দেখেছি কিনা চিন্তা করলাম। এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। আসলে কাজুয়ার সাথে দেখা হয়েছে এরকম অনেকের চেহারাই ভুলে গেছি। শুধু কাছের কয়েকজনের চেহারা ভালোমতন মনে আছে। যেমন মিঃ ইশিনো, কিমুরা।

আমার হাতটা মুঠো করে ধরলো কিয়োকো। আঙুলের চামড়াগুলো কুঁচকে গেছে তার বয়সের ভারে। “জানি, ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েছে। তোমার বয়সী আমার একটা ছেলে ছিল।”

দুধের গ্লাসটা খালি হবার পরেও কিছুক্ষণ টেবিলে বসে থাকলাম। বিল মেটাতে গেলে হাত ঝাঁকিয়ে মানা করে দিল কিমুরা। “ক্যাফের পক্ষ থেকে ট্রিট ধরে নাও।”

“নামি,” সাওরি ডাক দিল এসময়। “কোথায় যাচ্ছো?”

“একটু হাঁটাহাঁটি করবো।”

“হারিয়ে যেও না।”

আমার জন্যে আসলেও চিন্তিত সে। হেসে মাথা নাড়লাম। সকাল বেলা মামার সামনে সাওরি আমাকে বলেছে যে যতদিন খুশি তাদের বাসায় থাকতে পারি।

বাইরে বেরোনোর সাথে সাথে ঠান্ডা বাতাসের ঝাঁপটা এসে লাগলো নাকে মুখে।

কাজুয়ার দুর্ঘটনাটা যেখানে হয়েছিল, সেদিকে রওনা হলাম। পথে তার কথা ভাবতে লাগলাম। বাঁ চোখের একটা স্মৃতিতে দেখেছিলাম বিশাল একটা খেলার মাঠে একা একা বসে কাঁদছে কাজুয়া। তবে দিনটা খুব সুন্দর ছিল।

কাজুয়াকে ভালোবাসি আমি। ওর দেখা দৃশ্যগুলো আলোকিত করে তুলেছে আমার মনের অন্ধকার কোণগুলোকে। আচ্ছা, একটা মানুষ তার জীবদ্দশায় কতগুলো দশ্য প্রত্যক্ষ করে?

অপহরণকারীকে যে করেই হোক খুঁজে বের করতে হবে আমার। তাকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে চাই। তার কারণে নিরীহ একটা মানুষের জীবন শেষ হয়ে গেছে, এর মূল্য চুকাতেই হবে।

দুর্ঘটনার জায়গাটা আশপাশের অন্য জায়গাগুলোর তুলনায় একটু বেশিই ঠান্ডা মনে হলো। আকাশ এখনও মেঘলা, বড় বড় সিডার গাছগুলোর ছায়ার কারণে অন্ধকার আরো জমাটবেঁধেছে। বনের ভেতর থেকে পাখির কিচিরমিচির শব্দ ভেসে আসছে একটানা।

শরীর কাঁপছে আমার। দু’মাস আগে কাজুয়া রাস্তার ওপরে যেখানে পড়ে যায়, এ মুহূর্তে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি আমি। বাঁ চোখের স্মৃতিতে দেখেছি যে অপহরণকারী লুকিয়ে ছিল গাছের পেছনে। কাজুয়ার মৃত্যুর দৃশ্যটা আড়াল থেকে উপভোগ করেছে সে।

রাস্তার পাশে রেলিং টপকে বনের ভেতরে পা রাখলাম। ভয় লাগছে, তবে পাত্তা দিলাম না। সিডার গাছের ঝরা পাতাগুলোর কারণে নিজের পদশব্দ শুনতে পাচ্ছি না। স্মৃতির স্বপ্নে ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে দেখেছিলাম কাজুয়াকে। যেদিক দিয়ে গড়িয়ে পড়েছে সে, সেই পথটা অনুসরণের চেষ্টা করলাম।

কিন্তু হাজার খুঁজেও নীল দেয়ালের বাড়িটা খুঁজে পেলাম না। সামনে কেবল সারি সারি সিডার গাছ আর জমাটবাঁধা সবুজ। ওগুলোর মাঝ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম।

ভেবেছিলাম হাঁটাহাঁটি করলে শরীর গরম হবে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ঠান্ডা আরো জাঁকিয়ে বসছে। এই সিডার বনের নৈঃশব্দ্য আমার শরীরের উষ্ণতা শুষে নিচ্ছে যেন।

জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে নিলাম। বাম পকেটে ডিম্পোজেবল ক্যামেরাটার অস্তিত্ব টের পাচ্ছি। কায়েদিতে আসার পূর্বে কিনেছি ক্যামেরাটা। অপহরণকারীর বাড়িটা খুঁজে পেলে ছবি তুলে রাখবো প্রমাণ হিসেবে। তলকুঠুরির জানালাটা দিয়ে হয়তো দেখতে পাবো হিতোমি আইজাওয়াকে।

এসব ভাবতে ভাবতেই থমকে যেতে বাধ্য হলাম। অপহরণকারীকে ধরার আমার পরিকল্পনা মাঠে মারা যেতে বসেছে। সামনে দশ ফুট লম্বা একটা কংক্রিটের দেয়াল। দেয়ালের ওপরে স্টিলের রেলিং। দেখে মনে হচ্ছে একটা পথ চলে গিয়েছে দেয়ালটার ওপর দিয়ে। যতদূর চোখ যাচ্ছে দুই দিকেই বিস্তৃত দেয়ালটা।

বিভ্রান্তি ভর করলো আমার চিত্তে। কাজুয়ার স্মৃতিতে তো দেখেছিলাম যে নীল বাড়িটা থেকে সরাসরি বনের ভেতরে প্রবেশ করেছিল সে। তখন তো এরকম কোন দেয়াল ছিল না। নতুবা ঢাল বেয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ে দেয়ালটার সাথে ধাক্কা লাগতো তার, রাস্তায় গিয়ে পড়তো না।

কোথায় আছি আমি?

রাজ্যের হতাশা নিয়ে দেয়ালটার পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। কোথাও কোথাও নিশ্চয়ই ওপরে ওঠার সিঁড়ির দেখা মিলবে।

এরকমটা তো হবার কথা ছিল না, হতাশ ভঙ্গিতে মাথা কঁকালাম। বাড়িটা উধাও হয়ে গেছে, সেই জায়গাই এই দশফুটি দেয়াল। এর ব্যাখ্যা কি?

আরো দশ মিনিট হাঁটার পর খেয়াল করলাম দেয়ালটার উচ্চতা কমছে। এক পর্যায়ে ভূমির সাথে সমতল হয়ে গেল।

বনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেছে দেয়ালের ওপরের পথটা। আমি যদি বেড়া না টপকে পিচঢালা পথটা বেয়ে সামনে এগোতাম, তাহলে এই দেয়ালটা চোখে পড়তো কিছুক্ষণ পর।

অপহরণকারীর বাড়ির হদিস হারিয়ে ফেলেছি আমি। পরিস্থিতি যে কতটা ঘোলাটে তা বোঝতে অভিজ্ঞ কারো দরকার হবে না। দৈব সাহায্য না পেলে হিতোমিকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে।

গাড়িটার সাথে যে স্থানে ধাক্কা লেগেছিল কাজুয়ার, সে জায়গাটা খুঁজে বের করতে পারলেই অপহরণকারীর বাসাটা পেয়ে যাবো, এমনটাই ভেবে এসেছি আমি। কিন্তু বিধি বাম। অন্য কোন পরিকল্পনাও নেই মাথায়। অগত্যা বনের ভেতরে ঘুরে বেড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ পেয়েও যেতে পারি, বলা যায় না।

অন্ধকার নেমে আসা অবধি ঘুরে বেড়ালাম। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার বাঁ চোখটা গরম হয়ে উঠেছে। একটা পুরনো ভেন্ডিং মেশিন দেখার পর কাজুয়ার ছোটবেলার স্মৃতি ভেসে উঠেছিল চোখের পর্দায়। কিন্তু অপহরণকারীর বাড়ি খুঁজে পাইনি। কাজুয়ার স্মৃতিগুলোতে যা যা দেখেছি, কায়েদিতে আসার পর সবকিছুই মিলে গেছে। তাহলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটার ক্ষেত্রে স্মৃতি কেন প্রতারণা করছে আমার সাথে?

.

হলওয়ে থেকে আগত পদশব্দে ঘুম ভেঙে গেল আমার। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। ঘরে এই বিছানাটা বাদে আর কিছু নেই। একপাশে আমার ব্যাকপ্যাকটা দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে রাখা।

চোখ কচলে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। লিভিং রুমে মিঃ ইশিনোর সাথে দেখা হলো।

“সুপ্রভাত, মিঃ ইশিনো,” বলেই লজ্জা পেয়ে গেলাম। এমনভাবে কথা বলছি যেন তিনি আমার নিজের পরিবারের সদস্য।

মিঃ ইশিনোও অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। “আমি তো ভেবেছি তুমি কাজুয়া। বিশেষ করে এটা গায়ে দেয়ার কারণে, আমার পরনের জ্যাকেটটার দিকে নির্দেশ করে বললেন তিনি। রাতে বেশি ঠান্ডা পড়ায় সাওরি এটা বের করে দিয়েছে আমাকে।

সাওরির তৈরি করা নাস্তা খেলাম আমরা। খাওয়া শেষে কাজের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলেন মিঃ ইশিনো।

কাঠুরেদের কাটা সিডার গাছ কাঠের মিল অবধি ট্রাকে করে পৌঁছে দেন তিনি। প্রতিদিন সকালে কাজের পোশাক পরে বাসা থেকে বের হন। রোজকার ব্যবহারে নরম হয়ে গেছে পোশাকগুলো।

তিনি গাড়ির দরজা খুলছেন এমন সময় পেছন থেকে ডাক দিলাম।

“একটা প্রশ্ন ছিল আমার,” বলে পকেট থেকে হিতোমির একটা ছবি বের করে তাকে দেখালাম। (লাইব্রেরির খবরের কাগজ থেকে অনুমতি না নিয়েই ছবিটা কেটে নিয়েছি)।

“এই মেয়েটাকে কখনো দেখেছেন আশেপাশে?”

ছবিটা এক ঝলক দেখে আমার দিকে তাকালেন তিনি। “ওকে খুঁজছে নাকি?”

“জ্বি।”

আবারো ছবিটার দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকালেন মিঃ ইশিনো। “নাহ, দেখিনি।”

সাওরিও একই কথা বললো। টিভি চালু করেই ঘরের কাজ করছে সে। নাস্তার বাসনগুলো ধুয়ে ফেলেছে ইতোমধ্যে। হিতোমির মত কাউকে নাকি কখনো দেখেনি।

“আজকে কি করবে?” আমাকে জিজ্ঞেস করলো সে।

“কাজুয়ার কাছে শহরের যে জায়গাগুলোর গল্প শুনেছি, সবগুলো ঘুরে দেখবো।”

“ঠিক আছে। যতদিন খুশি এখানে থাকতে পারবে, এটা তো বলেছিই আগে। তোমাকে বাইরের কেউ মনে হয় না, জানো? তুমি যেভাবে বাড়ির ভেতরে ঘুরে বেড়াও, হাঁটাচলা করো-সবকিছুর মধ্যে কাজুয়ার ছাপ খুঁজে পাই। এমনকি ভাত খাবার ভঙ্গিটাও একই।”

“আজকে কি ক্যাফেতে ডিউটি আছে আপনার?”

আলতো মাথা নেড়ে সিঙ্কের কল চালু করলো সাওরি।

“কাজুয়া মারা যাবার পর থেকে এই বাসা আর ক্যাফে ছাড়া আর কোথাও যাইনি। কিছু করিও না। সপ্তাহে একবার শুধু একটা বাসায় কফি ডেলিভারি করতে যাই, ব্যস। কিন্তু কায়েদির বাইরে বেরুই না।”

কাজ বন্ধ করে শূন্য দৃষ্টিতে সিঙ্কের দিকে তাকিয়ে আছে সে। লিভিং রুম থেকে টিভির শব্দ শোনা যাচ্ছে। প্রাত্যাহিক রাশিফল পড়ে শোনাচ্ছে এক উপস্থাপক। কল বন্ধ করে দ্রুত টিভির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সাওরি।

নাক ঝেরে বললো, “আহহা! কন্যারাশি লোকজনের জন্যে আজকের দিনটা খারাপ যাবে দেখছি।”

আমাকে বাসার একটা চাবি দিয়ে কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল সে। আমি যে সম্পূর্ণ অচেনা একজন মানুষ, সেটা নিয়ে কোন মাথাব্যথাই নেই। চাইলেই কিন্তু বাসার জিনিসপত্র চুরি করে পালিয়ে যেতে পারি।

কিছুদিন আগে লাইব্রেরিতে দেখা বাঁ চোখের স্বপ্নটার কথা ভাবলাম আবারো। হিতোমি আইজাওয়ার ছবি ট্রিগার হিসেবে কাজ করেছিল। স্বপ্নে কাজুয়াকে একটা গাড়ির সাথে ধাক্কা খেতে দেখি। দশদিন পেরিয়ে গেছে ইতোমধ্যে। ব্যাকপ্যাক থেকে বাইন্ডারটা বের করে সেই স্বপ্নের বর্ণনাগুলো পড়তে লাগলাম।

তলকুঠুরির জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল কাজুয়া। তখনই হিতোমিকে দেখে সে। এরপর আশপাশে নজর বুলিয়ে খেয়াল করে যে বাড়িটা নীল ইটে তৈরি।

তার বাঁ চোখ দিয়ে পুরো বাড়িটা দেখার সুযোগ হয়নি আমার। ছাদ কিংবা সামনের দিকটা কেমন দেখতে-সেটাও জানি না। কাজুয়া চেষ্টা করেছিল ক্রু ড্রাইভার দিয়ে জানালাটা খুলতে, কিন্তু কারো পদশব্দে সতর্ক হয়ে যায়। ধরা পড়ে গেছে বুঝতে পেরে দৌড় শুরু করে। পাশের বনটাতে ঢুকে যায় দ্রুত।

এখান থেকেই গোলমালের শুরু। আমি কালকে যে দেয়ালটা দেখেছি, সেটা কি পার হয় সে? জার্নালে এরকম কিছুর বর্ণনা নেই।

বাড়িটা থেকে সোজা বনের দিকে দৌড় দেয়। এক পর্যায়ে ঢাল বেয়ে নামার সময় হোঁচট খায়, একদম রাস্তার মাঝখানে গিয়ে পড়ে। সেখানেই সাদা গাড়িটা তো দেয় তাকে।

একটা ভিন সম্ভাবনা উঁকি দিল মাথায়। হয়তো অপহরণকারী কোন কারণে কাজুয়ার অচেতন দেহটা অন্য জায়গায় সরিয়ে নেয়। ফলে সবাই ভাবে যে দুর্ঘটনাটাও সেখানেই হয়েছে।

নাই, এটা অসম্ভব। নিজের গাধামোতে নিজেই বিরক্ত হলাম প্রচণ্ড। গাড়িচালক নিজে অ্যাম্বুলেন্স ডাক দেয়। সুতরাং অপহরণকারীর পক্ষে কাজুয়ার অচেতন দেই সরানোর মত সময় পাবার কথা না।

তাহলে কি কংক্রিটের দেয়ালটা পরে বানানো হয়েছে? সেটা হলেই। কেবল বলা যায় যে লাইব্রেরির স্বপ্নতে আমি যা দেখেছিলাম, তা ঠিক। এখানকার লোকজনকে জিজ্ঞেস করলেই অবশ্য জবাব পেয়ে যাবো।

মনে মনে প্রশ্নগুলো গুছিয়ে নিয়ে ক্যাফের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলাম। এই শহরে আমি যাদের চিনি, তারা সবাই ওখানেই আছে।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে, প্রায় দুপুর এখন। মেলানকলি গ্রোভেই লাঞ্চ সেরা নেয়া যাবে।

ক্যাফের ভেতরে বরাবরের মতনই আরামদায়ক উষ্ণতা। এক মুহূর্তের জন্যে অপহরণকারী কিংবা অন্য ব্যাপার সংক্রান্ত সব দুশ্চিন্তা দূর হয়ে গেল। মুখে হাসি নিয়ে কাউন্টারের উল্টোপাশে বসে পড়লাম।

কিমুরা একাই আছে আজকে। “সাওরি ডেলিভারি দিতে গেছে, বললো সে।

লাঞ্চের অর্ডার দিলাম আমি। খাবারের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে ক্যাফেতে সাজানো ছোট ছোট কাপপিরিচগুলো দেখতে লাগলাম। কোনটাতেই ধুলো জমেনি। কেউ কি প্রতিদিন পরিষ্কার করে ওগুলো? কিমুরার আঙুলগুলো তো মোটা মোটা। তার পক্ষে এত ছোট কাপ পরিষ্কার

করা কষ্টসাধ্যই হবার কথা। হয়তো সাওরিই করে।

“আমি নিজেই পরিষ্কার করি সবকিছু,” যেন আমার মনে কথা ধরতে পেরেই খানিকটা রূঢ় ভঙ্গিতে বললো কিমুরা। অর্ডার দেয়া খাবারগুলো একটা ট্রেতে করে নিয়ে এসেছে সে।

“কাজুয়ার দুর্ঘটনাটা যে রাস্তায় হয়, সেটার একটু সামনে একটা লম্বা দেয়াল আছে। ওটা কবে বানানো হয়েছে?” জিজ্ঞেস করলাম।

“অনেক আগে। তখন বোধহয় আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম।”

হতাশ ভঙ্গিতে হিতেমির ছবিটা দেখালাম তাকে। “এই মেয়েটাকে কখনো দেখেছেন?”

“পুলিশে চাকরি নিয়েছে নাকি?” ভ্রূ কুঁচকে কথাটা বলে ছবির দিকে তাকায় সে। “নাহ, দেখিনি।”

“বেশ… এখান থেকে কেউ কি হারিয়ে গেছে গত কয়েক মাসে?”

“একজন বয়স্ক লোক হারিয়ে যাবার কথা শুনেছিলাম। তার কোন আত্মীয় স্বজন নেই শহরে।”

হারিয়ে যাওয়া লোকটার নাম কানেদা। শহরের কাছেই থাকতো সে, কিন্তু অনেকদিন যাবত তাকে কেউ দেখেনি।

“লোকে খুব একটা পছন্দ করতো না কানেদাকে,” কিমুরা বললো। “কয়েকজন তার কাছে টাকাও পেতো। আমার ধারণা পাওনাদারদের ভয়ে পালিয়ে গেছে।”

এই কানেদা লোকটার সাথে আমি এখানে যা করতে এসেছি সেটার কোন সম্পর্ক নেই মনে হচ্ছে।

“আশেপাশে ইটের তৈরি কোন বাসা আছে নাকি?” (জাপানে বেশিরভাগ বাড়ি কাঠের তৈরি)।

“কিয়োকোর সাথে কথা হয়েছে না তোমার? সে ইটের বাসায় থাকে।”

“নীল ইটের তৈরি একটা বাসা খুঁজছি।”

“নীল ইট..” বলে গম্ভীর ভঙ্গিতে একবার মাথা নাড়লো সে। “সেটার ব্যাপারে জানতে পারি।”

হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে গেল আমার। এরকম উত্তর আশা করছিলাম না তার কাছ থেকে। “আসলেই? কোথায় ওটা? প্লিজ বলুন!” উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গেলাম সিট ছেড়ে।

আমাকে ঠান্ডা করার ভঙ্গিতে হাত নাড়লো সে।

“কি এমন আছে ঐ বাড়িতে?”

থমকে গেলাম। এই প্রশ্নের উত্তরে কি বলবো তা আসলেও ভাবিনি। “না মানে… একজনের কাছে শুনেছি বাড়িটার কথা। নীল ইটের তৈরি যেহেতু, সুন্দর নিশ্চয়ই অনেক। সেজন্যেই নিজের চোখে দেখতে চাই।”

“শিওজাকি এসে পড়বে দ্রুত। সবসময় এখানেই লাঞ্চ সারে সে। জায়গাটা তার চেনা। তুমি বললেই নিয়ে যাবে।”

দেয়ালে ঝোলানো শিওজাকির আঁকা ছবিটা দেখলাম। একটা টলটলা পানির হ্রদের ছবি। সেখানে প্রতিফলিত হয়েছে আশপাশের বন।

নীল ইটের বাড়িটা যে এভাবেও খুঁজে বের করতে পারি সেটা মাথায় আসেনি। শিওজাকি নাহয় আমাকে ওখানে নিয়ে যাবে, কিন্তু এরপর কি করবো?

না, সামনের দিক দিয়ে যাওয়া যাবে না। ঘুরে পেছন দিয়ে যেতে হবে যাতে অপহরণকারী লোকটার চোখে না পড়ি। তখন ছবি তুলে নিব প্রমাণ হিসেবে। বাড়ি পর্যন্ত গাড়ি করে গেলে, অপহরণকারী সন্দেহ করতে পারে।

আচ্ছা, সে যদি সন্দেহ করেও, তখন কি হবে? হিতোমি বেঁচে থাকলে তার জন্যে বিপদ হবে।

এসময় ক্যাফেতে প্রবেশ করলো শিওজাকি। আবারো পেছনের সেই অন্ধকার টেবিলটায় গিয়ে বসলো সে। এমনভাবে ওটার দিকে এগিয়ে গেল যেন অন্য টেবিলগুলো চোখেই পড়েনি।

একটা ট্রেতে করে তার লাঞ্চ সাজিয়ে নিয়ে গেল কিমুরা। শিওজাকি নাকি প্রতিদিন একই সময়ে ক্যাফেতে এসে একই জিনিস অর্ডার করে। তার খাবার বিশেষ ভাবে রান্না করে কিমুরা। শিওজাকি নিরামিষভোজী, মাংস খায় না।

খেয়াল করলাম যে কিমুরা আমার ব্যাপারে কথা বলছে শিওজাকির সাথে। একবার আমার দিকে তাকালোও সে। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে মাথা নামিয়ে নিতে বাধ্য হলাম।

“খাওয়া শেষ হলে তোমাকে ওখানে নিয়ে যাবে ও,” কিমুরা বললো একটু পর।

এক ঘন্টার মত সময় লাগবে শিওজাকির। তাই এই সময়টুকু ক্যাফেতে পত্রিকা পড়ে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম।

স্মৃতি হারিয়ে ফেলার পর থেকে বেশ কয়েকটা উপন্যাস পড়েছি। স্কুলে যাওয়া বন্ধ করার পর থেকে বইই আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। খুব বেশি বাছাবাছি করি না। হাতের কাছে যা পাই, সবই পড়ি। সেটা উপন্যাসও হতে পারে, আবার মাঙ্গা বা পত্রিকাও হতে পারে। যা-ই পড়ি, সব নতুন ঠেকে আমার কাছে।

স্মৃতি হারাবার আগে কি ধরনের বই পড়তাম। রোমান্টিক উপন্যাস? যেগুলো পড়ে চোখে পানি চলে আসততা। নাকি কবিতার বই?

সেই সুন্দর স্মৃতিগুলো হারিয়ে ফেলার জন্যে মনে মনে নিজেকেই দোষারোপ করি প্রায়ই। জানি যে আমার কোন দোষ নেই। তবুও, কিছুদিন আগে যখন নামির ঘরটা নিজের মত করে গোছালাম, অতীতের বেশ বড় একটা অংশ মুছে ফেলেছি।

এগুলো ভাবতে ভাবতে পত্রিকার পাতা উল্টে গেলাম। এরপর ঠিক করলাম একটা নতুন বই পড়বো। বইয়ের শেলফ ঘাটতে গিয়ে একটা অদ্ভুত বই চোখে পড়লো। বেশ পাতলা। রূপকথার গল্পের বই।

দ্য কালেক্টেড ব্ল্যাক ফেয়ারি টেইলস : ভলিউম ১। নিচে ছোট্ট করে লেখা চোখের স্মৃতি।

উল্টেপাল্টে দেখলাম যে প্রতি পাতায় গল্পের সাথে ছবি জুড়ে দেয়া হয়েছে। কালো ছবিগুলো এমনভাবে আঁকা হয়েছে যে দেখলে অস্বস্তি লাগে।

মাঝের দিকের ছবিতে একটা দাঁড়কাককে একটা বাচ্চার চোখ তুলে নিতে দেখা যাচ্ছে। গা শিরশিরে একটা অনুভূতি হলো, আরেকটু হলেই হাত থেকে পড়ে যাচ্ছিল বইটা। একবার ভাবলাম রেখে দেই, কিন্তু কেন যেন চোখ সরাতে পারছি না। যেন আমার ওপর মন্ত্র করেছে লেখক।

শুরু থেকে বইটা পড়বো বলে মনস্থির করলাম, এমন সময় লাঞ্চ শেষ করে উঠে দাঁড়ালো শিওজাকি। অগত্যা বইটা আবারো শেলফে রেখে দিতে হলো।

“চলুন তাহলে,” কালো রঙের কোটটা গায়ে চাপিয়ে বললো সে।

দুরুদুরু বুকে তার গাড়ির প্যাসেঞ্জার সিটে উঠে বসলাম। কিমুরা ক্যাফের বাইরে এসে হাত নেড়ে বিদায় দিল আমাকে। হাসি লেগে আছে তার মুখে, যেন সে এমন কিছু একটা জানে যেটা আমি জানি না। হেসে তার উদ্দেশ্যে পাল্টা হাত নাড়লাম আমি।

নিঃশব্দে চলতে শুরু করলো গাড়িটা। গাড়ি সম্পর্কে খুব একটা ধারণা নেই আমার, তবে এই গাড়িটা নিঃসন্দেহে দামী। চকচক করছে ভেতরটা, এয়ার ফ্রেশনারের গন্ধটাও দারুণ।

“শহর থেকে কিছু জিনিস কিনতে হবে আমাকে। থামলে আপনার অসুবিধে হবে?”

“না,” মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম।

“আপনি তাহলে কাজয়ার বন্ধু ছিলেন?”

“আপনি চিনতেন ওকে?”

“কয়েকবার দেখা হয়েছিল আর কি।”

“কায়েদিতে আপনি এসেছেন খুব বেশিদিন হয়নি বোধহয়?”

“গত বছর।”

ছবির ব্যাপারে কথা বলা শুরু করলো সে। গাড়ির মতনই, এই ব্যাপারেও আমি বিশেষ ‘অজ্ঞ। তাই শুধু হাঁ-হুঁ করে গেলাম। শিওজাকি কি বিখ্যাত কোন আঁকিয়ে নাকি?

ক্যাফেতে যে ছবিটা ঝুলছে সেটা বিদেশে থাকার সময় এঁকেছিল। “কেন যেন মনে হলো, মেলানকলি গ্রোভকেই দিয়ে দেই ছবিটা,” স্টিয়ারিং হুইল ধরে বললো সে।

ছবিটার দাম কত হতে পারে? এত জায়গা থাকতে কায়েদিতে কেন এলো সে? তাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু চুপ থাকলাম। খুব বেশি কথা বলার অভ্যাস নেই তার, সেটা স্পষ্ট। বিরক্ত হতে পারে।

একটা ফার্ম সাপ্লাই স্টোরের পার্কিং লটে গাড়ি থামালো সে।

খুব বেশি সময় নাকি লাগবে না, তাই গাড়িতেই রয়ে গেলাম আমি। হাতে মাথা রেখে জানালা দিয়ে সাইড মিররের দিকে তাকিয়ে আছি। কিছুক্ষণ পর শিওজাকি দোকান থেকে বেরিয়ে এসে সদ্য কেনা জিনিসগুলো ট্রাঙ্কে ঢুকিয়ে রাখলো।

“এবার তাহলে ঐ বাড়িটায় যাওয়া যাক,” ড্রাইভিং সিটে বসে বললো সে।

মাথা নাড়লাম। একটু নার্ভাস লাগছে।

অপহরণকারী আর হিতামি, দু’জনেই আছে সেখানে। বাড়িটা দেখা মাত্র গাড়ি থেকে নেমে যাবো। কোন রাস্তাটা দিয়ে যেতে হয় সেখানটায়, আপাতত সেটুকু জানাই যথেষ্ট আমার জন্যে।

কিছুক্ষণ পর শহরের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া হাইওয়েটায় উঠে পড়লাম। সেটা ধরে বেশ খানিকক্ষণ সামনে এগোনোর পর একটা পার্শ্ব রাস্তায় গাড়ি নামিয়ে দিল শিওজাকি। পাহাড়ি এলাকার দিকে এগিয়েছে। রাস্তাটা।

“কি কিনলেন?”

“গত ভূমিকম্পের পর আমার বাসার একটা দেয়ালে ফাটল ধরেছে। সেটাই ঠিক করার জিনিসপত্র কিনেছি,” রাস্তার দিক থেকে চোখ না সরিয়েই বললো সে।

ভূমিকম্পের ব্যাপারে কারো কাছে কিছু শুনিনি। শিওজাকি বললো, আমি আসার আগেরদিন নাকি কায়েদিতে ভূমিকম্প হয়েছে। দুর্ঘটনার পর থেকে আজ অবধি কোথাও ভূমিকম্প হতে দেখিনি আমি।

জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগলাম আনমনে। কিছুক্ষণ পর হঠাই আগে দেখেছি এরকম একটা দৃশ্য চোখে পড়লো।

“গাড়ি থামান।”

ব্রেক চেপে প্রশ্নাতুর চোখে আমার দিকে তাকালো শিওজাকি।

“একটা পার্ক!” বলে গাড়ি থেকে নেমে গেলাম আমি। রাস্তার পাশে খালি জায়গায় পরিত্যক্ত, পুরনো একটা পার্ক। বাইরে নোটিশ ঝুলছে-প্রবেশ নিষেধ। ভেতরে উঁচু আগাছা, খেলার সরঞ্জামগুলোতে মরিচা জমেছে। দোলনাটা অবশ্য এখনও বহাল তবিয়তে দাঁড়িয়ে আছে।

ক্যালেন্ডারের ছবিতে যে দোলনাটা দেখেছিলাম, এটাই সেই দোলনা! আমার দেখা কাজুয়ার প্রথম স্মৃতি।

দোলনাটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলাম। শিওজাকি পাশে এসে দাঁড়ালো।

“অনেক বছর আগে,” কৈফিয়তের সুরে বললাম। “কাজুয়া আর সাওরি এখানে নিয়মিত খেলাধুলা করতো,” দোলনাটা ঘিরে চক্কর দিলাম একটা। “কোন সন্দেহ নেই, এটাই সেই দোলনা।”

ভেতরে ভেতরে খুব ভালো লাগছে। কায়েদিতে আসার পর থেকে পরিচিত অনেক কিছু চোখে পড়েছে। কিন্তু এই দোলনাটা সাওরির হাসিমুখের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। প্রথম যে কোন কিছুরই বিশেষ মূল্য আছে।

মরিচা ধরা দোলনাটায় উঠে বসলাম। তখন মনে হলো যে শিওজাকি এতক্ষণ ধরে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। লজ্জা পেলাম কিছুটা। একটা ভদ্র মেয়ে এরকম আচরণ করবে না।

“আজকে খুব অদ্ভুত আচরণ করছেন আপনি,” শিওজাকি বলেই ফেললো।

আমার চোখের দিকে তাকালো সে। প্রথমে স্বাভাবিক দৃষ্টিতেই দেখছিল, কিন্তু হঠাৎই কিছু একটা চোখে পড়ায় জমে গেল যেন।

“কোন সমস্যা?” জিজ্ঞেস করলাম।

“তাহলে ভুল দেখিনি আগে। আপনার দুটো চোখের রঙ দু’রকম। ভালো করে না তাকালে অবশ্য বোঝা যাবে না…”

হেসে কথাটা উড়িয়ে দিলাম। সে যদি জানতে পারে যে আমার বাম চোখটা অস্ত্রোপচার করে বসানো হয়েছে, তাহলে অনর্থক ঝামেলার সৃষ্টি হবে। কিছুক্ষণ পর আবারো গাড়ি উঠে বসলাম আমরা। এখনও আমার চোখ নিয়েই ভাবছে সে, আমি নিশ্চিত। সব শিল্পীরাই এমন হয়। ভিন্নতা আকৃষ্ট করে তাদের। খুব একটা আমলে নিলাম না ব্যাপারটা।

কিছুক্ষণ পর একটা পরিচিত রাস্তা চোখে পড়লো আমার। দু’পাশে সিডার গাছ থাকাতে এই বিকেল বেলাতেও অন্ধকার লাগছে সবকিছু।

“এখানেই তো কাজুয়া…”

মাথা নেড়ে সায় দিল শিওজাকি। কাজুয়ার দুর্ঘটনাটা যেখানে হয়েছিল সেই রাস্তাটায় আছি আমরা এখন।

তাহলে নীল ইটের বাড়িটায় এখান দিয়েই যেতে হয়। স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। বাম চোখে দেখা সেই স্বপ্নটা পুরোপুরি ভুল নয়, কিছু তথ্যের এদিক সেদিক হয়েছে কেবল।

জায়গাটা পেছনে ফেলে সামনে এগোতে লাগলাম আমরা। একটা গাড়িতে বসে কাজুয়ার দুর্ঘটনাস্থলের ওপর দিয়ে যাওয়ার অনুভূতিটা খুব একটা সুখকর নয়। চোখ বন্ধ করে নিলাম। কেউ যেন বরফ ছেড়ে দিয়েছে আমার শিরদাঁড়া বরাবর।

সামনে একটা তীক্ষ্ণ মোড়। বাম দিকে মোচড় খেয়েছে রাস্তাটা। পাশেই গার্ডরেইল। আর গার্ডরেইল থেকে একটু সামনে বেশ গভীর খাদ। শুধু নিচ থেকে উঠে আসা লম্বা সিডার গাছ দেখা যাচ্ছে গার্ডরেইলের ফাঁক দিয়ে।

কিমুরাকে যে প্রশ্নটা করেছিলাম, সেটাই জিজ্ঞেস করলাম শিওজাকিকে।

“রাস্তাটা কবে বানানো হয়েছিল?”

“জানি না। আমি এসে এরকমই দেখেছি।”

একটা পার্শ্বরাস্তা পার করে আসলাম আমরা। এবারে ডানে মোড় নিল রাস্তাটা। কিছুক্ষণ পর গাড়ি থামিয়ে বাইরে দেখতে বললো আমাকে শিওজাকি। এমন একটা জায়গায় গাড়ি থামিয়েছে সে যে ঢালটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। সেই ঢালু জমিতে সারি সারি সিডার গাছ। তবে ওগুলোর ফাঁকে রংটা ঠিকই চোখে পড়ছে।

নীল রঙ। তবে আকাশি নীল নয়। একদম গাঢ় নীল। গোধূলিতে কিছুটা কালচে দেখাচ্ছে।

সিডার বনের অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে নীল বাড়িটা, যেটার খোঁজে এতদূর ছুটে এসেছি। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল। এখান থেকে অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না যে বাড়িটা ইটের তৈরি। কিন্তু স্বপ্নে যেরকম নিল রঙ দেখেছিলাম, সেরকমটাই দেখছি বর্তমানে।

অপহরণকারী ওখানেই আছে। হিতোমিকে লুকিয়ে রেখেছে সে। লোকটা কেমন তা ভাবলাম।

বাম চোখে হিতোমির শরীরের যে অবস্থা দেখেছিলাম তা মন থেকে দূর করার চেষ্টা করেও সফল হইনি। আমার ধারণা, হাত-পা কেটে ফেলা হয়েছে তার। কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব?

কাজটা যদি অপহরণকারীর হয়ে থাকে, তাহলে কতটা নিষ্ঠুর সে? “বাড়িটার ব্যাপারে কিছু জানেন?” শিওজাকিকে জিজ্ঞেস করলাম। সে যা জানে, খুলে বললো আমাকে। গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম।

“এই বাড়িটা যে আসলেও আছে, এটা জেনেই খুশি আমি,” বললাম।

“কাজুয়ার সাথে বাজি ধরেছিলাম একটা, বলেছিলাম বানিয়ে কথা বলছে।”

“চাইলে আপনাকে ক্যাফেতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারি আমি।”

মাথা ঝাঁকিয়ে না করে দিলাম। “অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। রাস্তা মনে আছে আমার। একাই ফিরে যেতে পারবো।”

তার উদ্দেশ্যে একবার বাউ করলাম। চোখে সংশয় নিয়ে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গেল শিওজাকি।

বাড়িটার ব্যাপারে সে আমাকে বলেছে-”কিমুরা বললো আপনি নাকি বাড়িটা খুঁজছেন, চা খেয়ে যান? আমিই থাকি ওখানে।”

*

শিওজাকির গাড়িটা দৃষ্টির আড়াল হয়ে যাওয়া অবধি পাশের দেবদারু বনে অপেক্ষা করলাম। এখনই বাড়িটায় যাওয়া ঠিক হবে না। সে ভেতরে গিয়ে আয়েশ করে বসার পর যাবো।

নীল বাড়িটায় শিওজাকি থাকেসে-ই অপহরণকারী। এতক্ষণ না জেনে তার গাড়িতে বসে ছিলাম আমি। কথাও বলেছি। ব্যাপারটা বিশ্বাসই হচ্ছে না আমার।

এজন্যেই ওভাবে হাসছিল কিমুরা। শিওজাকি যে নীল বাড়িটায় থাকে, এটা ভালো করেই জানতো সে। খুব রাগ লাগছে, কিন্তু কিমুরা যে নেহায়েত মজা করার জন্যেই কাজটা করেছে, সেটা জানি।

আধা ঘণ্টা পর বাড়িটার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম আমি। এই সময়টায় মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়েছি।

এই রাস্তাটায় গাড়ির সংখ্যা খুবই কম। প্রতি দশ মিনিটে একটা কিংবা দুটা। একটু পেছালেই কাজুয়ার সাথে সাদা গাড়িটার যেখানে সংঘর্ষ হয়েছিল, সেখানটায় পৌঁছে যাব। তার ভাগ্যটাই আসলে খারাপ ছিল সেদিন।

বাড়িটায় কি রাস্তার দিক থেকে যাবো নাকি বনের দিক থেকে, সেটা ভাবতে লাগলাম। কিন্তু রাস্তা ধরে সামনে এগোলে যদি হঠাৎ শিওজাকি ফিরে আসে, তখন বানিয়ে কিছু বলতে পারবো না। এর চেয়ে বনের মধ্যে দিয়ে যাওয়াই ভালো।

বেশ ঢালু জমি হওয়াতে খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। ধীরে ধীরে ওপর উঠছি। মরা পাতার কারণে পা পিছলে যাবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। কিছুটা ওপরে ওঠার পর সমতল হতে শুরু করলো জমি।

নীল বাড়িটার কাছাকাছি পৌঁছানোর পর, সিডার গাছ বাদেও অন্য এক ধরনের গাছ চোখে পড়লো। কাজুয়ার স্মৃতিতে এই গাছগুলোও দেখেছি। এরকম একটা গাছের শেকড়েই হোঁচট খেয়েছিল সে।

প্রচণ্ড ঠান্ডা। মুখ দিয়ে বাষ্প বেরুচ্ছে রীতিমত। একটা একটা করে গাছ গুণতে গুণতে এগোলাম। পঞ্চাশটা অবধি গোণার পর হাত ব্যথা হয়ে গেল।

হঠাৎ করেই নীল বাড়িটার সামনে আবিষ্কার করলাম নিজেকে। দোতলা একটা বাড়ি। যে রকমটা ভেবেছিলাম, নীল ইটে তৈরি সবকিছু। বাড়িটাকে দেখে মনে হচ্ছে গহীন বনে একটা দানো ঘাপটি মেরে আছে। শিকারের অপেক্ষা করছে। বাস্তবে বাড়িটার সামনে দাঁড়ানোর পর মনে হচ্ছে ওটাও তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বাড়ির দেয়ালগুলো যেন শ্বাস নিচ্ছে। যেকোন সময় হুঙ্কার ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে।

চোখ বন্ধ করে মনে সাহস যোগাতে লাগলাম। কাজুয়ার কথা ভাবলাম, হিতেমির কথা ভাবলাম।

পকেট থেকে ক্যামেরাটা বের করে নিয়েছি আগেই। গাছের আড়াল থেকে দেখে নিলাম আশেপাশে কেউ আছে নাকি। শিওজাকি বাদে অন্য কারো থাকার কথাও না আসলে।

ছায়ার মধ্যে দিয়ে এগোতে লাগলাম। একপাশের দেয়ালে গা ঘেঁষে দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ পর। দেয়ালটা স্পর্শ করার পর মনের মধ্যে সন্দেহের যে শেষ দানাটুকু ছিল, সেটাও উধাও হয়ে গেল। এই বাড়িটাই দেখেছিলাম আমি বাঁ চোখের স্বপ্নে। হাতে গ্লাভস থাকা সত্ত্বেও ঠান্ডা ঠিকই টের পেলাম। আমার আত্মশুদ্ধ কেঁপে উঠলো সেই ঠান্ডায়।

আকাশে এখনও ধূসর মেঘ।

দেয়াল ঘেঁষে সামনে এগোচ্ছি। চোখ নিচের দিকে। তলকুঠুরির জানালাটা এখানেই কোথাও হবে।

বাড়িটার চারদিকে ঘন গাছপালা। তবে দেয়াল আর বনের মাঝে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ফাঁকা জায়গা আছে, সেখান দিয়ে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ হেঁটে যেতে পারবে। পায়ের নিচে শক্ত মাটি এখন। কায়েদির অন্যান্য জায়গার মতন সেখানকার ঘাসগুলোও মরা।

শুধুমাত্র বাড়িটার সামনের দিকেই কোন গাছপালা নেই। আমার যেহেতু কারো চোখে পড়ার ইচ্ছে নেই, তাই সেদিকটা এড়িয়ে গেলাম।

যতদূর মনে আছে, তলকুঠুরিটা বাড়ির সামনের দিকে ছিল না। তাছাড়া কাজুয়া নিজেও দেয়ালের আড়ালে লুকিয়েছিল। জানালাটা দেয়ালের কোনা বরাবর কোথাও। আর কাজুয়া যেখান দিয়ে বনের উদ্দেশ্যে দৌড় দিয়েছিল, সেখানকার জমি ছিল ঢালু। সুতরাং জায়গাটা বাড়ির পেছনের দিকে হবার সম্ভাবনাই বেশি।

একটু পরেই বাম চোখে দেখা একটা জায়গা খুঁজে পেলাম। বাড়িটার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে। আশপাশের দৃশ্যগুলোও পরিচিত ঠেকছে এখান থেকে। তবে বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত হওয়াতে কিছু কিছু ব্যাপার বদলাতেও পারে।

তবুও তলকুঠুরির জানালাটা খুঁজে পেলাম না। বরং পায়ের নিচে ইটের তৈরি প্ল্যান্টার এখানে।

হয়তো এই প্ল্যান্টারটা পরে বানানো হয়েছে, জানালাটা ঢেকে দেয়ার জন্যে। দু’মাসে এরকম দেয়াল সহজেই বানানো যাবে। প্ল্যান্টারটা ভাঙলে অপর পাশের ইট জানালা দেখা যাবে নিশ্চিত।

জানালাটা ঢেকে দেয়া হয়েছে। তাই ক্যামেরা দিয়ে কোন কিছুর ছবিও তুলতে পারছি না।

খুবই হতাশ লাগতে লাগলো। তবে একদিনের জন্যে যথেষ্ট হয়েছে। বাড়ির চারপাশটা আরো ভালোমতন দেখতে হলে পরে আসতে হবে। এখন মানসিক আর শারীরিক, দুদিক দিয়েই ক্লান্ত আমি।

বাড়িটার পেছন দিকে উঁকি দিলাম। একটা কাঠের ছাউনি সেদিকে। দেয়ালের সাথে লাগানো। শিওজাকি বলছিল যে সাপ্লাই স্টোর থেকে দেয়াল ঠিক করার জিনিসপত্র কিনেছে। সেগুলো হয়তো ছাউনিতেই আছে।

ফেরার আগে ছাউনির ভেতরে উঁকি দিয়ে যাব বলে ঠিক করলাম।

এসময় দোতলা থেকে একটা জানালা খোলার শব্দ ভেসে এলো।

জমে গেলাম সাথে সাথে। তবে বোকার মত কিছু না করে দেয়ালের ছায়া মিশে যাওয়ার চেষ্টা করলাম সাবধানে। যে কোন মুহূর্তে মাথা বের করে বাইরে উঁকি দিতে পারে শিওজাকি।

ধীরে ধীরে ঢুকে গেলাম বনের ভেতরে। কিছুদুর আসার পর দৌড়াতে শুরু করলাম। হয়তো কাজুয়াও এই পথেই দৌড়িয়েছিল। পেছন থেকে শিওজাকির ছুটে আসার শব্দ কানে আসছে না। তবুও মনে হচ্ছে কেউ যেন ছায়ার মধ্যে পিছু নিয়েছে আমার।

অবশেষে ঢাল পার হয়ে বেরিয়ে এলাম খালি রাস্তাটায়। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো যেন। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে অঝোরে।

.

রূপকথার গল্পকার

হাতের পিষে ফেলা মাছিটার দিকে তাকালো মিকি। কাউচে বসে থাকা হিতোমিকে বিরক্ত করছিল হতচ্ছাড়া।

“খুবই রাগ হচ্ছিল,” বলে হিতোমি। “কিন্তু ওটাকে যে তাড়াবো, সে উপায় নেই।”

এমনটা নয় যে তার ক্ষতস্থানগুলো পচন ধরেছে, সেখানে মাছি ওড়াউড়ি করছে। মিকির সৃষ্ট ক্ষতস্থানগুলো কখনো পচে না। মাছিটা পাশ দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় হিতোমিকে দেখেছিল।

শেষবার বস্তাটার এক পাশে বসা মাত্র হাত চালিয়েছে মিকি। এখনও হাত পা ছোঁড়াছুড়ি করছে মাছিটা।

“আমি হলে তো খুবই বিরক্ত হতাম,” হিতোমি বললো। “একটা মাছিও মারতে পারেন না ঠিক মতন।”

মিকির এখন দু’টো কাজ করতে পারে। পুরোপুরি পিষে ফেলতে পারে মাছিটা অথবা এই অবস্থাতেই বাইরে ছুঁড়ে ফেলতে পারে। জানালার দিকে এগোলো সে।

“জীবিত অবস্থাতেই তাহলে ওটাকে খেতে শুরু করবে পিঁপড়াগুলো,” হিতোমি বললো।

জানালাটা খুলেই জমে গেল মিকি।

সাবধানে মাথা বের করে বাইরে দেখলো একবার।

“কেউ এসেছে নাকি?”

স্টাডিরুমটা বাসার পেছন দিকে। সেদিক থেকেই একটা শব্দ কানে এসেছে মিকির। কিন্তু কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না। হয়তো ভুল শুনেছে।

“জানতাম, কেউ না কেউ আসবে আমাকে উদ্ধার করতে। তারা নিশ্চয়ই ধরতে পেরেছে আপনিই অপহরণকারী।”

হিতামিকে রেখে স্টাডি থেকে বেরিয়ে গেল মিকি।

“কোথায় যাচ্ছেন?” জিজ্ঞেস করলো মেয়েটা। কিছুক্ষণ পর নিজের প্রশ্নের জবাব অবশ্য নিজেই দিল, “ওহ, বুড়োকে তো কবর দিতে হবে।”

কিছুক্ষণ আগেই তলকুঠুরিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে কানেদা।

হিতোমিকে বিছানায় নিয়ে যাচ্ছিল এসময় ইউকি বলে যে, “বুড়োর কিছু একটা হয়েছে।”

ততক্ষণে কানেদা মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে।

বেলচা হাতে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো মিকি। ইটের দেয়ালটার পাশ দিয়ে হেঁটে বাড়ির পেছন দিকে চলে এলো।

আশেপাশে তাকালো আরেকবার। দোতলা থেকে যে শব্দটা শুনেছিল, সেটার উৎস হতে পারে এমন কিছু চোখে পড়লো না।

চারদিকে কেবল গাছ আর গাছ। নিচু ডালগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে বনের ভেতরে পা দিল মিকি। কিছুদূর হাঁটার পর কানেদাকে কবর দেয়ার মত একটা জায়গা খুঁজে পেল। বেলচা দিয়ে মাটিতে খোঁচা দিল আলতোভাবে। ঠান্ডায় একদম জমে গেছে। তবে একটু বাড়তি শক্তি প্রয়োগ করতেই সুন্দর মত উঠে আসতে শুরু করলো মাটি।

.

*

কানেদার সাথে মিকির প্রথম দেখা হয় নতুন বাড়িটায় আসার কয়েকদিন পরে। এর দুই সপ্তাহ আগে শিনিচি আর ইউকিকে তলকুঠুরিতে নিয়ে আসে সে।

সেসময় প্রতিবেশীদের সাথে খুব একটা যোগাযোগ হয় না মিকির। বাড়িটা পাহাড়ের ওপরে হওয়াতে কেউ কষ্ট করে দেখা করতে আসেনি তার সাথে। তারও কারো সাথে যোগাযোগ করার ইচ্ছে নেই। এমনভাবে থাকে যাতে কেউ বুঝতে না পারে যে বাড়িটায় কেউ আছে।

তাই কানেদার বাড়ি যে পাশেই সেটা জানা হয়নি তার।

যেদিন প্রথম মিকির বাসায় আসে লোকটা, এমন ভঙ্গিতে তাকায় যেন অদ্ভুত কোন জানোয়ার দেখছে।

“এখানে কেউ থাকে সেটা জানতাম না তো,” বলে সে।

মিকি তাকে ভেতরে আসার আমন্ত্রণ জানায়। খানিকটা গাইগুই করে রাজি হয়ে যায় কানেদা।

“জুতো কি বাইরে রেখে আসবো? বাড়িটাকে দূর্গ মনে হচ্ছে।”

কানেদার শরীর বয়সের তুলনায় রোগাটে। জীর্ণ চেহারা, হাঁটে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। মিকি বাড়িটায় একা একা কিভাবে থাকে আর তার আয়ের উৎস কি, সেটা জানার বেশ আগ্রহ কানেদার মধ্যে।

বাইরে হঠাৎই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। বুড়ো লোকটাকে লিভিং রুমে বসিয়ে দ্রুত স্টাডিতে ছুটে গেল মিকি। খোলা জানালাটা বন্ধ করতে হবে।

এসময় নিচ থেকে একটা চিৎকার ভেসে এলো। মিকি দোতলায় আসার পর ফ্রিজে হাত দিয়েছিল কানেদা। সেখানে ডিম রাখার জায়গায় সাজানো সারি সারি কান আর আঙুল দেখে ভয় পেয়েছে সে। আগের বাড়িটা ছেড়ে আসার সময় এগুলো নিয়ে এসেছে মিকি।

*

কানেদা হাঁটুগেড়ে বসে আছে এমন অবস্থায় তার পেটে ছুরি বসিয়ে দিল মিকি। একটা পুরনো প্যাকিং টেপ দিয়ে বুড়োকে বেঁধে নিয়ে এলো বেইজমেন্টে।

পেট থেকে বেরিয়ে থাকা ছুরিটার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে কানেদা। “অদ্ভুত লাগছে,” বললো সে, চোখে আনন্দের ছটা। কাটা জায়গাটায় কোন ব্যথার অনুভূতি নেই কেন সেটা নিয়ে ভাবছে না।

বুড়োকে তলকুঠুরির একপাশের দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল মিকি। এরপর জিজ্ঞেস করলো সে বেঁচে থাকতে চায় কিনা।

যদি বাঁচতে না চাইতো তাহলে তখনই তার মাথাটা ধড় থেকে আলাদা করে দিত মুক্তি। এর আগের এক্সপেরিমেন্টগুলো থেকে দেখেছে যে মস্তিষ্ক এবং হৃদযন্ত্রের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলে মৃত্যু হয় তার শিকারদের। কিংবা বুড়োটা তার ক্ষত বুজে যাওয়া অবধি অপেক্ষা করতে পারে। মিকির কারণে সৃষ্ট ক্ষত বুজে গেলে জীবনিশক্তি ধীরে ধীরে কমতে থাকে। তখন ক্ষুধা অথবা বার্ধক্যের কারণে মৃত্যু হয় তাদের।

কানেদা বেঁচে থাকবে বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

তার পেটটা ফেড়ে ফেলে মিকি। চামড়া আর মাংশপেশি কেটে সরিয়ে নেয়ার পর ভেতরের পাজর আর অন্যান্য অঙ্গগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। এরপর থেকে আর একটা শব্দও করতে পারেনি বুড়ো লোকটা।

কানেদার পুরো শরীরের এই অবস্থা করে মিকি।

দেহের ভেতরের অংশ বাইরে এনে, বাইরের অংশটুকু ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। কানেদার হাত-পা এখন ভেতরের দিকে ঢোকানো, চামড়াসুদ্ধ। একটা একটা করে বুড়ো লোকটার হাড্ডিগুলো কেটে নিয়েছে মিকি, এরপর আগে যেরকম ছিল তার বিপরীতভাবে সাজিয়েছে। সেক্ষেত্রে ক্রু’র সাহায্য নিতে হয়েছে তাকে।

গোটা সময়টায় কানেদা একবারের জন্যেও জ্ঞান হারায়নি। রক্ত খুব কমই ঝরেছে। ইচ্ছেকৃতভাবেই শিরা বা ধমনীগুলো যাতে না কেটে যায়, সেদিকে খেয়াল রেখেছে মিকি। কানেদার ভেতরের অঙ্গগুলো বাইরে বের করে নেয়ার পরেও ঔজ্জ্বল্য হারায়নি সেগুলো। এমনকি শুকিয়েও যায়নি।

কিছুদিন পর দেখা গেল কানেদার গলার নিচ থেকে সবকিছু উল্টে ফেলা হয়েছে। কানেদার পক্ষে এখন আর নিজের শরীরের ভার বহন করা সম্ভব নয়। এজন্যে মাছ ধরার আংটা মাংসে বিধিয়ে তাকে সোজা করে রাখার ব্যবস্থা করেছে মিকি। কানেদার হাত আর পায়ের আঙুলগুলো শরীরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আছে। মাঝে মাঝে নড়ে ওঠে ওগুলো।

কানেদার চেতনা তখনও লোপ পায়নি। তার চোখ দেখেই মনে কি চলছে তা বুঝতে পারে মিকি। মাঝে মাঝে চোখের মণিগুলো নড়ে ওঠে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে। কখনো আবার চোখ দিয়ে পানি ঝরে। সেগুলোও আনন্দাশ্রু।

নিজের হাতের কাজের দিকে সন্তুষ্টচিত্তে তাকিয়ে থাকার সময় মিকি খেয়াল করে যে নাক বা মুখের কোন দরকার নেই কানেদার। মুখের চামড়া আড়াআড়িভাবে কেটে নিয়ে দলা পাকিয়ে মাথার পেছনে টানা দিয়ে রাখলো সে। কঙ্কালটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এখন। এর মধ্যে কেবল চোখটা ঠিক জায়গায় আছে। চোখের পাতা না থাকায় অক্ষিকোটরের চোখ দুটোকে বলের মত মনে হয়। তবে একটা ঝামেলা হচ্ছে কানেদার শরীরের নিচের অংশ সোজা করে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারলেও, মাথাটা কেবলই ঝুলে যাচ্ছিল। তাই তার কপাল বরাবর একটা পেরেক ঠুকে দিল মিকি। সে জানে যে মগজের ভেতর দিয়ে পেরেকটা চলে গেলেও মারা যাবে না কানেদা। হাতুড়ির প্রতিটা বাড়ির সাথে কেঁপে কেঁপে উঠছিল বুড়োর শরীর।

যথেষ্ট হয়েছে, ভাবলো মিকি। এবারে সুন্দর একটা শিল্পকর্ম দেখতে পাচ্ছে চোখের সামনে।

কানেদা চোখের পাতা ফেলতে না পারলেও তার চোখের আর্দ্রতা কমলো না। কথা না বললেও চোখের নাড়াচাড়ার মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করে কানেদা। দরকার মনে হলে আঙুলগুলোও নাড়ায়।

তবে কানেদার নতুন রূপের মধ্যে আগের জীর্ণ-শীর্ণ ভাবটা নেই। তার। অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো টকটকে লাল। হৃদযন্ত্রটা ঠিকই ধুকপুকাচ্ছে নিয়মিত বিরতিতে। কেটে ছিঁড়ে যাওয়া শিরা আর ধমনীগুলো যতটা সম্ভব ঠিক করে দিয়েছে মিকি।

পরে সে আবিষ্কার করে যে তার বাড়ি থেকে হাঁটা দূরত্বেই থাকত কানেদা।

*

গর্তটা খোঁড়া শেষ হলে বাড়িতে ফিরে আসে মিকি। কানেদার দেহটা কবর অবধি টেনে নিয়ে যেতে হবে তাকে।

ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ শুনে ওপরের দিকে তাকিয়ে একটা কালো রঙের পাখি দেখতে পেলো সে। মনে হচ্ছে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দাঁড়কাকটা।

বাড়ির পেছন দিকে একটা ছাউনি। আগের ভাড়াটিয়া তৈরি করেছিল ছাউনিটা। স্লাইডিং দরজাটা ঠিক মতো কাজ করে না, বেশ জোর খাটাতে হয়। ফ্রেমের কাঠ পচে যাওয়াতে এই অবস্থা।

দরজা খোলাতে রোদ খেলে গেল ভেতরে। কানেদার শরীরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যাচ্ছে। একটা ময়লার ব্যাগে করে তলকুঠুরি থেকে তাকে বয়ে এনে এখানে রেখেছে মিকি।

তলকুঠুরিতে ইঁদুরের কারণে মারা গেছে কানেদা। তার হৃৎপিণ্ডটা চাবিয়েছে ইচ্ছেমতন। শুনিচি আর ইউকি কিছু খেয়াল করার আগেই নিঃশ্বাস থেমে গিয়েছিল বুড়োর।

ময়লার ব্যাগটা টানতে টানতে ছাউনি থেকে বের করে আনলো মিকি। এসময় অচেনা একটা জিনিস চোখে পড়লো তার। কিছুটা দূরে ধুলোর ওপর পড়ে আছে।

ওটা উঠিয়ে নিল মিকি। তার নিজের না নিশ্চিত। কেউ একজন আসলেও এসেছিল এখানে। স্টাডি থেকে ভুল কিছু শোনেনি। নিজের ধারণার ওপর বরাবরই ভরসা আছে মিকির।

কেউ তাকে সন্দেহ করেছে, এমনটা প্রথম নয়। আগেও তার কার্যকলাপ সম্পর্কে জেনেছে কয়েকজন। ঘুরঘুর করেছে বাসার আশপাশে। তাদের আগন্তুক বলে ডাকে সে। অনাহুত আগন্তুক।

এর আগে অল্পবয়সী একটা ছেলে মোক ছোঁক শুরু করেছিল। সেবারেও এরকম অনুভূতি হয়েছিল, যেন কেউ নজর রাখছে তার ওপর।

আগন্তুক কি তার অপরাধের কোন প্রমাণ পেয়েছে? সেরকমটা হলেও ব্যবস্থা নেয়া যাবে। যেমনটা নিয়েছিল শেষ আগন্তুকের।

*

চোখের স্মৃতি

উপসংহার

একদিন জানালার পাশে বসে মেয়েটা বলে উঠলো, “আমার ভয় লাগছে…”

কারাসুর আনা নতুন স্টপার দু’টো শোভা পাচ্ছে তার দুই অক্ষিকোটরে। থেকে থেকে কেঁপে উঠছে সে। দুটো চোখই উল্টোভাবে ঢুকিয়েছে, কিন্তু তাতে দৃশ্যগুলো দেখতে কোন সমস্যা হচ্ছে না।

“ভয় কেন পাচ্ছেন, মিস?”

নতুন উপহার দুটো সরাসরি মেয়েটার হাতে দিয়েছে কারাসু।

“তোমার আনা স্টপারগুলো চোখে দিলেই স্বপ্নের মত দৃশ্য দেখতে শুরু করি। আমার জন্যে এই অভিজ্ঞতাগুলো অমূল্য। কিন্তু সবগুলো স্টপারের ক্ষেত্রেই শেষদিকে একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটে। কয়েকদিন আগে প্রথম খেয়াল করি সেটা।

“ভয়ঙ্কর ব্যাপার?”

মাথা নেড়ে সায় জানালো মেয়েটা। ঝাঁকুনিতে বাম চোখটা কোটর থেকে বেরিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। নিচু হয়ে সেটা তুলে কাঁচের বয়ামে রেখে দিল সে। আগের চোখগুলোও সেখানেই আছে। প্রায় ভরে গেছে বয়ামটা।

কারাসু আবারো জিজ্ঞেস করলো ভয়ানক জিনিসটা কি। কিন্তু জবাবে কেবল মাথা ঝাঁকানো মেয়েটা।

“জানি না আমি। কখনোই কয়েক সেকেন্ডের বেশি দেখতে পারিনি। দেখে মনে হয় একটা দানো, যেটাকে ভয় পাওয়া উচিৎ। কিন্তু…”

তার চেহারায় ভয় ছাপিয়ে একটা হাসি ফুটলো। “কিছু মনে করবে না। তোমার উপহারগুলো পেতে খুবই ভালো লাগে আমার। নতুবা এই অন্ধকারেই বাকি জীবনটা কাটাতে হতো। রঙ আর দেখতে পেতাম না। চিরকৃতজ্ঞ থাকবো তোমার কাছে।”

হাতটা সামনে বাড়িয়ে ধরলো মেয়েটা। কারাসু বুঝতে পারলো যে সে চাইছে কেউ তার হাতে হাত রাখুক। একটা সিনেমায় এরকম দৃশ্য দেখেছিল কারাসু। কিন্তু হাতটা কিছুটা উঁচুতে ধরেছে মেয়েটা। কারাসু যদি সত্যি সত্যি একজন মানুষ হতো, তাহলে তার মুখ বরাবর থাকতো ওটা।

“তুমি কি তোমার আসল নামটা আমাকে বলবে না? নাহলে বুঝবো কি করে যে তুমি সত্যি নাকি কল্পনা? কখনো তোমার হাতটাও ধরিনি…”

কারাসুর মনে হলো তার হৃদয়টা বুঝি ফেটেই যাবে। মেয়েটাকে কোনভাবেই স্পর্শ করতে দেয়া যাবে না তাকে। সে একটা পাখি। মেয়েটা যদি জানতে পারে এতদিন একটা কাক চোখ এনে দিয়েছে তাকে, তাহলে কষ্ট পাবে নিশ্চয়ই।

“দুঃখিত মিস, আপনার হাতটা ধরতে পারবো না। কয়েক বছর আগে বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর সময় একটা খুব খারাপ অসুখ হয় আমার। আপনাকে স্পর্শ করলে আপনিও অসুস্থ হয়ে যাবেন। অনবরত হেঁচকি উঠতে থাকবে।”

এটক বলে জানালা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো কারাস। মেয়েটা পেছনে কিছু একটা বলছিল, তবুও ডানা ঝাঁপটানো বন্ধ করলো না সে। তার ছোট্ট হৃদয়টা ছেয়ে উঠেছে বেদনায়। এই অনুভূতিগুলোর অর্থ ঠিক বুঝতে পারছে না সে।

মেয়েটাকে দেয়ার মত নতুন চোখের জন্যে শহরময় ঘুরে বেড়াতে শুরু করলো সে। ইদানীং খুব সাবধান থাকতে হয়। কাক দেখলেই এখন দূর দূর করে তাড়া করে সবাই। একটা কালো রঙের পাখি সুযোগ পেলেই চোখ উপড়ে নেয় এটা শহরবাসী জেনে গেছে। রাইফেল, গুলতি দিয়ে কাকদের আক্রমণ করে তারা। ছোট ছোট বাচ্চারা স্কুলে যাবার সময় চোখে হাত দিয়ে রাখে।

কারাসুর গায়েও গুলি লেগেছিল একবার। তবে যে গুলি করেছিল তার হাতের সই খুব একটা ভালো ছিল না, তাই বেঁচে গেছে। তখন থেকে অনেক উঁচুতে উড়ে বেড়ায় সে, যাতে নিচ থেকে দেখা না যায়। আর মেয়েটার জন্যে নতুন উপহারের খোঁজে দূর দূরান্তের শহর অবধি পাড়ি

চোখ তুলে নেয়ার জন্যে বেশ কয়েকটা কৌশলও আবিষ্কার করেছে সে। একদিন একটা আবাসিক এলাকায় উড়তে উড়তে একটা বাড়ির দেয়ালে ছোট ফুটো দেখতে পায়। যে কেউ চোখ রাখতে পারবে সেই ফুটোয়। দেয়ালটার পেছন দিকে গিয়ে অপেক্ষা করে সে। এরপর সামনে দিয়ে কেউ হেঁটে গেলে মানুষের কণ্ঠে বলে, “এই যে! শুনছেন? যাদু দেখতে চাইলে এই ফুটোয় চোখ রাখুন দ্রুত।”

যেই না কেউ তার ফাঁদে পা দিয়ে ফুটোয় চোখ রেখেছে, অমনি চোখা চঞ্চুর সাহায্যে সেটা উপড়ে নেয় কারাসু। এর এক ঘণ্টা পরে সেই চোখটা নিজের কোটরে রেখে হেসে ওঠে মেয়েটা। আর সেই হাসিটা অমূল্য।

লাঠির বাড়ি বা মার খেয়েও বারবার তাই মানুষের চোখের রক্তে ঠোঁট রাঙাতে কোন আপত্তি নেই কারাসুর।

উঁচ ডালে বা বাড়ির ছাদে বসে নিচ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষদের খেয়াল করে সে। এরপর সুযোগ বুঝেই আঘাত হানে। যেইমাত্র তার শিকার বিস্ময়ে চোখ বড় করে ফেলে, ঠোঁট দিয়ে উপড়ে নেয় সেটা।

একবার চোখ উপড়ে নেয়ার পরে শিকারের সাথে জাপটাজাপটির কারণে প্রায় অচেতন হয়ে পড়ে কারাসু। আরেকবার উপড়ে নেয়া চোখটা ঠোঁটেই পিষ্ট হয়ে যায়, সেটা আর মেয়েটাকে উপহার দিতে পারে না সে।

একদিন কারাসুর এনে দেয়া উপহার চোখে দিয়ে খুশিতে প্রায় লাফিয়ে ওঠে মেয়েটা। আসলে চোখটা যার ছিল, সে বিদেশ বিভুঁইয়ে ঘুরে বেরিয়েছে প্রচুর। তাই চোখের স্মৃতিতে অনেক কিছু দেখতে পায় সে।

ম্যানশনটা ছেড়ে আসার কিছুক্ষণ পর পাহাড়ের ওপরে ছোট একটা কবরস্থান চোখে পড়লো কারাসুর। আশপাশে কোন বাড়ি নেই। সূর্য মামা বিদায় নিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। চাঁদ মশাই গা ঝারা দিয়ে জেগে উঠেছে সেই সুযোগে। কবরফলকগুলো ভরিয়ে দিয়েছে সাদা আলোয়।

চাঁদের আলোয় একদিকে কবর খুঁড়ে যাচ্ছে গোরখোদক। একটা গাছের ওপরে বসে তার কাজ দেখতে লাগলো কারাসু। কাপড়ে মোড়া একটা মৃতদেহ রাখা আছে সদ্য খোঁড়া কবরটার পাশে। যে লোকটা মারা গেছে তাকে চেনে কারাসু। আজকেই তার চোখ উপড়ে নিয়েছিল। এরপর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে বেচারা।

কবর দেয়া শেষ হলে সেখান থেকে উড়ে গেল কারাসু। দিন দিন আরো সতর্ক হয়ে উঠছে লোকজন।

.

“একটা ভালো খবর আছে,” মেয়েটা বললো একদিন। “চোখের অপারেশন হবে আমার।”

এর আগে অনেক চেষ্টা করেও মেয়েটার চোখের আলো ফিরিয়ে দিতে পারেনি চিকিৎসকেরা। তবে নতুন একটা প্রযুক্তির কারণে এখন সেটা সম্ভব হলেও হতে পারে।

“দৃষ্টি ফিরে পেলে,” খুশি মনে বলে চলেছে মেয়েটা। “তোমাকে দেখতে পাবো।”

“শুনে খুবই খুশি হলাম, মিস,” কারাসু বললো।

তবে মনে মনে ভীষণ হতাশ সে। মেয়েটা দেখতে পাবার অর্থ হচ্ছে তার আসল পরিচয় ফাঁস হয়ে যাওয়া। যখন অন্ধ কিশোরী জানতে পাবে যে এতদিন ধরে কারাসু ‘উপহার’ নাম করে তাকে যা দিয়েছে, সেগুলো আসলে অন্য মানুষের চোখ, তখন তার মনে কি চলবে?

মেয়েটার মনের সুখের জন্যে যদি অন্য কেউ মারাও যায়, তাতে কারাসুর কিছু আসে যায় না। সে যা করছে, তা ঠিক নয়, এটা ভালো করেই জানে। তবুও কোন অনুশোচনা বা অনুতাপ বোধ নেই তার।

কিন্তু মেয়েটা সত্য কথা জানার পর কষ্ট পাবে, সন্দেহ নেই। অনেকে তার সাময়িক সুখের জন্যে মারাও গেছে, এটাও সুস্থ মস্তিষ্কের কেউই ভালো ভাবে নেবে না। তখন কারাসুকে ঘৃণা করবে সে। এটাই তার সবচেয়ে বড় ভয়।

আমাকে কি আসলেও মন থেকে ঘৃণা করবে সে? যদি পাখি না হয়ে মানুষ হতাম, ভাবলো কারাসু। তার সামনে আজকে আনা চোখটা জায়গামত ঢুকিয়ে দিল মেয়েটা। কিছুক্ষণ বাদেই চেঁচিয়ে উঠলো সে।

“কি সমস্যা, মিস?” অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো কারাসু।

“দানোটাকে দেখেছি আমি-প্রতিটা স্বপ্নের শেষে ভয়ঙ্কর যে জন্তুটাকে দেখতে পাই। কালো রঙের একটা দানা। যখনই ওটা উদয় হয়, স্বপ্নগুলো শেষ হয়ে যায়। তখন আমার মুখের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দানোটা। ভয়ঙ্কর একটা চেহারা,” কম্পিত কণ্ঠে বললো মেয়েটা। চেহারা ছাইবর্ণের হয়ে গেছে তার। স্ট্রবেরির মত ঠোঁটজোড়াও ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে।

দাঁড়কাকটার বুঝতে অসুবিধে হলো না যে কি দেখেছে সে। যে দানোটাকে ভয় পাচ্ছে সে, ওটা তো আসলে আমি!

এখন কি হবে? আর কিছুদিন বাদেই তো চোখের দৃষ্টি ফিরে পাবে সে। তখন কার সাথে কথা বলবো? অপারেশনটা না হলেই ভালো হতো।

কিন্তু এই কথাগুলো মেয়েটার সামনে উচ্চারণ করতে পারবে না কারাসু। সে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছে দৃষ্টি ফিরে পাবার জন্যে।

“অপারেশনটার কথা ভাবলেই ভয় লাগে,” মেয়েটা বললো। “তবে * আমি নিশ্চিত, এবারে কাজ হবেই। তোমাকে দেখতে পাবো খুব শিঘ্রই।”

কারাসুকে দেখতে পাবে এই ভাবনাটা মেয়েটার ভয় অনেকটাই দূর করে দেয়।

“আগামীকাল রাতে, দূরের একটা শহরে পাড়ি জমাতে হবে আমাকে অপারেশনের জন্যে। তাই সময়মত এসে পড়বে। যাওয়ার আগে তোমার সাথে কথা বলতে চাই আমি।

এটুকু শুনেই জানালা দিয়ে উড়াল দিল কারাসু। বিদায়ে সময় ঘনিয়ে এসেছে। কারাসুর ছোট্ট মস্তিষ্কটা ভরে আছে মেয়েটার স্মৃতিতে। এটাই তার প্রতিদিনের বেঁচে থাকার পাথেয়। গত ক’দিনে অনেকবার ভেবেছে যে দূরে কোথাও চলে যাবে, চিরদিনের জন্যে। কিন্তু প্রতিবারই ফিরে এসেছে। সে হঠাৎ উধাও হয়ে গেলে মন খারাপ হবে মেয়েটার। তার নিজেরও বড় খারাপ লাগবে।

খুব দ্রুত মেয়েটার চোখে অস্ত্রোপচার হবে শোনার পরেও আগের মতনই তার জন্যে উপহার খুঁজে বেড়ায় কারাসু। কিন্তু ইদানীং কাজটা বড় কঠিন হয়ে গেছে। সবাই খুবই সতর্ক থাকে। অনেকে তো চোখ বাঁচানোর জন্যে বিশেষ চশমাও ব্যবহার করে।

মানুষেরা তো আর একটা কাক থেকে অন্য কাককে আলাদা করতে পারে না। তাই অনেক নিরীহ কাক মারা পড়েছে তাদের হাতে। বুলেট ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে তাদের ছোট্ট বুক। এমনকি কারাসুর নিজের ভাইবোন আর বাবা-মাও সেই ভাগ্য বরণ করে নিয়েছে।

তাই কারো চোখ উপড়ে নেয়া এখন রীতিমত অসম্ভব একটা কাজ।

দেখতে দেখতে রাত শেষ হয়ে এলো। পূব দিকটা রক্তিম হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। মেয়েটা অস্ত্রোপচারের উদ্দেশ্যে রওনা হবে আজকেই। কিন্তু এখন অবধি তার জন্যে কোন উপহার যোগাড় করতে পারেনি কারাসু।

অস্ত্রোপচারের পরে কারাসুর উপহারের কোন মূল্য থাকবে না। দেখতে দেখতে অনেক দূরের একটা শহরে চলে এলো সে। ক্লান্তির কাছে নতি স্বীকার করেনি। একনাগাড়ে ডানা ঝাঁপটানোর কারণে ব্যথা করছে ও’দুটো।

তার মনে একটা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে। যে করেই হোক, শেষবারের মতন হাসি ফোঁটাতে হবে মেয়েটার চেহারায়। এরপর মারা যেতেও কোন দ্বিধা নেই কারাসুর।

কয়েকজন তোক পাথর ছুঁড়ে মারলো তার দিকে। বেশিরভাগই লক্ষ্য ভ্রষ্ট হলেও একটা পাথরের আঘাতে ঠোঁট ফেটে গেল কারাসুর। আরেকবার অসাবধানতার কারণে একটা লোক তার ডান পাখনাটা আঁকড়ে ধরলো। কোনমতে তার হাত থেকে ছাড়া পেলেও পালক ছিঁড়ে গেল। তবু চোখ খোঁজা থামালো না কারাসু। কিন্তু লাভ হচ্ছে না কিছুতেই।

কোনমতে আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে সে। একটু মনোযোগ বিঘ্নিত হলেই মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়বে।

অবশেষে কোন চোখ খুঁজে না পেয়ে তার নিজের চোখের কোণে পানি জমলো। এরকম ব্যর্থ জীবন জিইয়ে রাখার কোন অর্থ খুঁজে পাচ্ছে না সে।

সূর্য ডুবে গেছে, মেয়েটা আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে পড়বে। এসময় আগের দিনের কবরস্থানটা চোখে পড়লো কারাসুর। আজকেও একটা মৃতদেহ শুইয়ে রাখা হয়েছে একপাশে। কিছুক্ষণের মধ্যে মাটি চাপা দেয়া হবে। গোরখোদকের মাথার ওপরে চক্কর দিল কারা।

একটা বুদ্ধি এসেছে তার মাথায়।

কিছুটা দূর থেকে মানুষের ভাষায় চিৎকার করে উঠলো সে, “ঐদিকে দেখুন, একটা শেয়াল।”

বিস্মিত হয়ে হাতের কোদালটা নামিয়ে রেখে শব্দের উৎস খোঁজার চেষ্টা করতে লাগলো সে। কারাসু যেখানটায় লুকিয়ে আছে, সেদিকে হেঁটে এলো। এই সময়টারই তক্কে তক্কে ছিল কারাসু। নিঃশব্দে মৃতদেহটার পাশে উড়ে এসে বসলো সে।

ঠোঁটের সাহায্যে মৃতদেহের চেহারা থেকে চাদরটা সরালো। একজন বয়স্ক মহিলাকে দেখতে পেলো সে। দেখে মনে হচ্ছে ঘুমাচ্ছে। চেহারায় অনেকগুলো আঘাতের চিহ্ন। নাক-মুখ থেতলে গেছে। একপাশের চোখও নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু অন্য চোখটাকে দেখে মনে হচ্ছে ঠিকই আছে।

এক মুহূর্ত দেরি না করে মৃত মহিলার ভালো চোখটা উপড়ে নিয়ে উড়াল দিল কারাসু।

*

“ভেবেছিলাম, তুমি আর আসবেই না আজকে,” কারাসুর উদ্দেশ্যে বললো মেয়েটা। অপারেশনের উদ্দেশ্যে রওনা হবার জন্যে তৈরি সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়িতে উঠে পড়বে। “ফিরতে বেশ কিছুদিন সময় লাগবে আমার।”

সাথে করে আনা চোখটা মাঝের গোল টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখলো কারাসু। টেবিলের ওপরে ফুলদানির পাশে একটা কাঁচের বয়ামও রাখা আছে। ওটা সাথে করে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে মেয়েটার।

“আমি নিশ্চিত যে আপনার অস্ত্রোপচার সফল হবে। আমার পক্ষ থেকে নিরন্তর শুভকামনা।”

দুই গালে টোল পড়লো মেয়েটার। “ধন্যবাদ,” হাসিমুখে বললো সে।

“আপনার জন্যে শেষ একটা উপহার এনেছি। টেবিলে রাখা আছে।”

কারাসুর মনে হচ্ছে কেউ দু’হাতে চেপে ধরেছে তার হৃদযন্ত্র। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে। শেষবারের মতন জানালাটা দিয়ে উড়ে যাবার সময় কথাটা বলবে। আমি আর ফিরবো না, মিস।

এরপর আর কখনো তাকে নিয়ে ভাববে না কারাসু।

জানালার চৌকাঠে গিয়ে বসলো সে। “আমি আর…” কথাটা বলতে গিয়ে থেমে গেল মাঝপথেই। চিৎকার করে উঠেছে মেয়েটা।

লম্বা একটা সময় ধরে আর্তচিৎকারের পর দু’চোখ নখ দিয়ে আঁচড়ে রক্তাক্ত করে ফেললো অন্ধ কিশোরী। পরমুহূর্তে বমি করতে করতে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। হাত-পা মোচড়াচ্ছে সমানে। পরিপাটি করে বাঁধা। চুলগুলো আউলে গেছে পুরোপুরি। টেনে টেনে চুল ছিঁড়তে লাগলো কিছুক্ষণ পর।

চোখভর্তি কাঁচের বয়ামটা মাটিতে পড়ে ভেঙে গেল। মেঝেতে ছড়িয়ে পড়লো কারাসুর এতদিনের সংগ্রহকৃত চোখগুলো। কয়েকটা ইতোমধ্যে পচে গেছে, আবার কয়েকটা তুলনামূলক নতুন এবং তাজা।

মাটিতে নিথর হয়ে পড়ে আছে মেয়েটা। গাঁজলা ওঠা মুখটা হাঁ হয়ে আছে। কারাসু মেয়েটার পাশে এসে বুকে কান রাখলো। হৃৎস্পন্দন থেমে গেছে তার। ভয়ে বিকৃত ফ্যাকাসে মুখটা।

কারাসু জানতো না। জানতো না যে যার চোখ উপহার হিসেবে এনেছিল, সেই মহিলার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়েছে মৃত্যুর আগ অবধি। মানুষের আচরণের নিষ্ঠুর দিকগুলো প্রত্যক্ষ করেছে তার চোখটা। ফলে মেয়েটাকেও সাক্ষী হতে হয়েছে সেই নির্মম, নিষ্ঠুর অত্যাচারের।

মেয়েটার বুকে মাথা চেপে বসে রইলো কারাসু। এই প্রথম তার শরীর স্পর্শ করছে সে। তবে সেই স্পর্শের অনুভূতি যে শীতল হবে, তা আশা করেনি কখনো।

মেয়েটার মা তাকে ডাকতে এসে দেখলো মেঝেতে মরে পড়ে আছে সে। চারিদিকে অসংখ্যা চোখ। আর তার পাশে একটা দাঁড়কাকের মৃতদেহ।

একইসাথে মৃত্যুলোকের অভিযাত্রী হয়েছে তারা।

৩. মানুষের বল তৈরি

তৃতীয় খন্ড

রূপকথার গল্পকার

স্বপ্নে মিকি দেখছে যে মানুষের বল তৈরি করছে সে।

স্বপ্নটা এরকমঃ ছোট একটা রুমে অন্য একজনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে মিকি। রুমটায় আসবাব বলতে একটা আলমারি আর টেবিলের ওপর রাখা টিভি।

মিকির মুখোমুখি দাঁড়ানো ব্যক্তির হাতে বিশাল একটা ক্ষত।

সেই হাতটা ধরে ম্যাসাজ করতে শুরু করলো মিকি। অবাক হয়ে খেয়াল করলো যে লোকটার ত্বক অনেকটা কাদার মতন। মিকি লেপে দেয়া। মাত্র ক্ষতটা দূর হয়ে গেল। নিজেকে অনেকটা মাটির কুমোরের মতন মনে হলো তার। তাই কুমোর যেরকম তার সৃষ্ট কাজে মসৃণতা আনার চেষ্টা করে, মিকিও লোকটার দেহ থেকে সব অমসৃণতা দূর করে ফেলবে বলে ঠিক করলো।

প্রথমেই হাত দুটো একসাথে চেপে ধরলো। জোড়া লেগে গেলো ও’দুটো। এরপর রুটি বানানোর আগে আটা যেভাবে কাই করতে হয়, সেভাবে তার পুরো দেহটাই পিষতে শুরু করলো মিকি। পুরোটা সময় চোখ বড় বড় করে সবকিছু দেখলো লোকটা।

কিছুক্ষণ পর দেখা গেল মিকির সামনে কোমর সমান উচ্চতার একটা গোলক। তবে এখান সেখান থেকে বেরিয়ে থাকা কিছু চুল দেখে বোঝা যাবে যে গোলকটা একজন মানুষের তৈরি। সমতল পৃষ্ঠে একটা চোখ অবশ্য দেখা যাচ্ছে। মিকি যেদিকে যাচ্ছে, চোখটা সেদিকে অনুসরণ করছে তাকে।

বলে পরিণত হওয়ায় নড়াচড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে লোকটা। মিকি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেও সেটা দেখা ছাড়া আর কিছু করার রইলো na তার।

“আবারো ঘুমিয়ে পড়েছিলেন,” চমকে জেগে ওঠায় পর মিকির উদ্দেশ্যে বললো হিতোমি।

সময় কাটানোর জন্যে এতক্ষণ পেটের পেশিগুলো প্রসারিত আর সংকচিত করছিল সে। কাউচের স্প্রিংগুলোর ফলে তার ছোট্ট শরীরটা লাফাচ্ছিল ওপরে। এই ব্যাপারটা উপভোগ করে সে।

সামনে খোলা অসম্পূর্ণ খসড়ার পাতাগুলো সোজা করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় মিকি। আকাশ মেঘলা। তুষারপাত শুরু হবে শিঘ্রই। স্টোভে। আগুন জ্বালিয়ে এক কেতলি পানি চাপিয়ে দিল সে কফি বানানোর জন্যে।

‘কফিটা সুস্বাদু মনে হচ্ছে,” হিতোমি বললো। “স্টোভ জ্বালিয়ে রেখেছেন কেন? ঠান্ডা নেই তো।”

মিকি তাকে বুঝিয়ে বললো যে যাদের শরীরের সে ক্ষতের সৃষ্টি করে তারা তাপমাত্রার তারতম্য অনুভব করতে পারে না।

“আমার ক্ষতগুলো কি ঠিক হয়নি?”

মিকি বললো যে তার ক্ষতগুলো এখনও তাজা দেখাচ্ছে, যেন কিছুক্ষণ আগেই কেটে ফেলা হয়েছে হাত পা।

কফির কাপ হাতে নিয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো মিকি। কানেদাকে যেখানে পুঁতে ফেলেছে সেদিকে দৃষ্টি। একটা গাছেও পাতা নেই। যতদূর চোখ যায় কেবল সিডার আর দেবদারু গাছ।

“কারো আসার শব্দ পেয়েছেন নাকি?” হিতোমি জিজ্ঞেস করলো।

তাকাশি কানেদাকে উঠোনের পেছনে কবর দিয়েছে চার দিন হতে চললো। জানালার পাশ থেকে সরে এসে ডেস্কের ড্রয়ারটা খুললো মিকি। ভেতরে সেদিন ছাউনির পাশে পাওয়া জিনিসটা শোভা পাচ্ছে।

“আপনার ওপর নজর রাখছে কেউ। জিনিসটা সেটারই প্রমাণ। হঠাৎ করে বাড়ির পেছনে নিশ্চয়ই উদয় হয়নি ওটা।”

কিন্তু আমি তো কাউকে দেখলাম না। আসলেও কেউ আমাকে সন্দেহ করেছে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে।

ড্রয়ারের ভেতরে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো মিকি, কার হতে পারে এটা? চেনা কারো?

“এখন কি করবেন আপনি? মা’র সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করছে আমার। বাড়ি যেতে চাই,” ঘাড় ঘুরিয়ে মিকির দিকে তাকিয়ে বললো হিতোমি। তার লম্বা চুলগুলো চেহারা ঢেকে রেখেছে। পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করা উচিৎ আপনার। তারা নিশ্চয়ই মাফ করে দেবে আপনাকে।”

মিকি হিতোমিকে বলল যে আত্মসমর্পণ করার কোন ইচ্ছে নেই তার।

“তাহলে…” ভাঙা গলায় বললো হিতোমি। “আর কখনো বাড়িতে যেতে পারবো না আমি?”

তাকে একটা গল্প শোনানোর প্রস্তাব দিল মিকি।

“কিসের গল্প?”

তাক থেকে কয়েকটা বই নিয়ে এলো সে। এরমধ্যে তার নিজের লেখা বইও আছে।

“ওটা তো দ্য কালেক্টেড ব্ল্যাক ফেয়ারি টেইল, তাই না? আমাকে আগেই পড়ে শুনিয়েছেন গল্পগুলো। একটা গল্প পুরো শিনিচি আর ইউকির কাহিনির মত।”

“মানব গিটু’-গল্পটার কথা বলছে হিতেমি। একটা বিশাল দানো হাত দিয়ে চেপে কয়েকটা মানুষকে একীভূত করে ফেলে ওখানে।একীভূত অবস্থায় মানুষগুলোর হাত পা একে অপরের সাথে পেঁচিয়ে যায়। কিম্ভুত দেখায় তাদের। বাকিটা সময় সেই পেঁচানো অবস্থা থেকে নিজেদের ছোটানোর চেষ্টা করে তারা।

গল্পটা তলকুঠুরির শিনিচি হিসামোতো আর ইউকি মোচিনাগার ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয় হিতোমিকে।

“ভিন্ন একটা গল্প বলুন এবারে। ওই পেপারব্যাকটা থেকে। না, আপনার ডান হাতেরটা।”

যে বইটা দেখাচ্ছে হিতোমি, সেটা একটা পুরনো কল্পবিজ্ঞান কাহিনির সংকলন। নামগল্পটা তাকে পড়ে শোনালো মিকি। খুব বেশিক্ষণ সময় লাগলো না শেষ হতে।

“শেষটা একটু কষ্টের,” ফ্যাকাসে হয়ে গেছে হিতোমির চেহারা। সত্যি কথা বলতে গল্পের শেষ পরিচ্ছেদটা পছন্দ হয়নি তার একদমই।

“আপনি যদি গল্পটার নায়ক হতেন, তাহলে কি করতেন?” মিকিকে জিজ্ঞেস করলো সে।

দৃশ্যকল্পটা অনেকটা এরকম:

* একটা স্পেসশিপ চালাচ্ছে নায়ক।

* অন্য এক গ্রহ থেকে কার্গো বয়ে নিয়ে যাচ্ছে সে। কার্গোর উপাদান হচ্ছে ব্লাড সিরাম। সেগুলো তাড়াতাড়ি জায়গামত পৌঁছে না দিলে অনেক লোক মারা যাবে।

* বেশি পরিমাণ কার্গো পরিবহণের সুবিধার্থে জ্বালানির পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হয়েছে স্পেশ শিপটায়। শুধু ল্যান্ডিং আর গতি বাড়াতে যেটুকু জ্বালানি দরকার, সেটুকুই ভরা হয়েছে ট্যাঙ্কে।

* স্পেসশিপে বাড়তি কেউ থাকলে তাকে মহাকাশে ছুঁড়ে ফেলতে হবে, নতুবা স্পেসশিপের জ্বালানি দ্রুত ফুরিয়ে যাবে। ল্যান্ড করার আগেই মুখ থুবড়ে পড়বে স্পেসশিপটা। বাড়তি লোকটার ওজনের সমান ব্লাড সিরাম নষ্ট করা যাবে না।

এখানে প্রশ্ন হচ্ছে

* বাড়তি ব্যক্তিটা যদি ফুটফুটে বাচ্চা একটা মেয়ে হয়, তাহলে নায়ক কি তাকে মহাশূন্যে ছুঁড়ে দেবে?

* ফিরে যাওয়াও সম্ভব নয়, কারণ নায়কের জন্যে অনেকে অপেক্ষা করে আছে। মেয়েটাকে না ছুঁড়ে ফেললে ল্যান্ড করা সম্ভব নয়। গল্পটার মতনই, মেয়েটাকে বাঁচানোর কোন উপায় আছে?

হিতোমি চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলো।

মিকিও সমস্যাটা নিয়ে মাথা ঘামালো। এরপর বললো যে মেয়েটাকে বাঁচানোর একটা উপায় জানা আছে তার।

হিতোমির চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। “তাই নাকি? আসলেও তাকে বাঁচাতে পারবেন আপনি?”

মিকি বুঝিয়ে বললো যে স্পেসশিপটার ওজন যদি ঠিকঠাক থাকে, তাহলে আসলেও বাঁচানো সম্ভব। প্রথমে তাকে এমন কিছু খুঁজে বের করতে হবে, যেটার সাহায্যে, মেয়েটার হাত পা কেটে ফেলতে পারবে। হাড়ি কাটতে পারে, এরকম শক্ত হতে হবে জিনিসটাকে।

“স্পেসশিপে নিশ্চয়ই কুড়াল বা এ জাতীয় কিছু থাকবে না।”

মেয়েটার হাত পা কেটে ফেলে তার ওজন যতটা সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। কাটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো মহাশূন্যে ছুঁড়ে দেয়া হবে এরপর। এক্ষেত্রে মেয়েটার বয়স কম হওয়াতে নায়কের সুবিধাই হবে।

এরপর নিজের শরীর থেকে মেয়েটার ওজনের সমান অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কেটে ফেলে সেগুলোও মহাশূন্যে ছুঁড়ে দিতে হবে। তখন সহজেই স্পেসশিপটা তার গন্তব্যে ল্যান্ড করতে পারবে, জ্বালানিও নষ্ট হবে না।

“কিন্তু নিজের শরীরে কিভাবে কাটা ছেঁড়া করবেন আপনি?” হিতোমি বললো। “স্পেসশিপ চালাতে হলে তো হাত, পা সবই দরকার। তবে তার চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে যে মিকির প্রস্তাবটা পছন্দ হয়েছে। কিন্তু আরেকটা ব্যাপার ভুলে যাচ্ছেন, স্পেস শিপটায় চেতনা নাশক জাতীয় কিছু নেই। জ্ঞান থাকা অবস্থায় এরকমটা করা নিশ্চয়ই সম্ভব হবে না? ব্যথার কারণে স্পেসশিপটা চালাতেই পারবেন না। সুতরাং ইচ্ছে হলো আর হাত পা কেটে ফেললাম-এই চিন্তাভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। হাত-পা ছাড়া কেউ বাঁচতে পারে না,” বলে নিজের দিকে একবার তাকালো হিতোমি। “আমার কথা অবশ্য আলাদা।”

*

ঘুমন্ত হিতোমিকে তুলে তলকুঠুরিতে নিয়ে এলো মিকি। ঘরটা বেশ অন্ধকার, আর্দ্রতাও ওপরের তুলনায় বেশি। ইটের দেয়ালগুলো কালচে হয়ে গেছে।

তলকুঠুরির একপাশে অনেকগুলো বর্শি চোখে পড়বে। লাল মাংস লেগে আছে ওগুলোর সাথে। কানেদার স্মৃতিচিহ্ন। এগুলোও পচতে শুরু করবে কিছুদিনের মধ্যে।

হিতোমিকে বিছানায় নামিয়ে রাখলো মিকি। “মা…” বিড়বিড় করে বলছে মেয়েটা।

দরজার দিকে ঘুরতে যাবে এমন সময় শিনিচির কণ্ঠস্বর শোনা গেল, “ও কি আপনাকে নিজের পরিবারের ব্যাপারে কিছু বলেছে?”

তলকুঠুরিতে বেশ কয়েকটা তাক সারি সারি দাঁড় করানো। নিজেদের সবসময় ওগুলোর পেছনে অন্ধকারে লুকিয়ে রাখে শিনিচি আর ইউকি।

মিকি তাদের দিকে এগিয়ে গেল। শিনিচির মাথাটা দেখতে পাচ্ছে না ছায়ার কারণে, কিন্তু ইউকি ঘুমিয়ে আছে।

“তাকের ঐপাশ থেকে আমাদের সাথে কথা বলে ও,” বললো শিনিচি। “অতীতের ব্যাপারে কথা বলে। পরিবারের সদস্যদের সাথে ক্যাম্পিংয়ে যেত হিতোমি প্রায়ই। স্কুলে দৌড় প্রতিযোগিতায় সবসময় প্রথম হতো।”

হিতোমি প্রায়ই তলকুঠুরিতে শুয়ে শুয়ে অতীত রোমন্থন করে। নিজের প্রাত্যাহিক জীবনের স্মৃতিগুলো বড় পোড়ায় তাকে। হাত-পা গুলো একদম ঠিক ছিল তার, ছুটির দিনে ইচ্ছেমতন দেরি করে উঠতো, স্কুলের ডেস্কে বান্ধবীদের সাথে ফুটসি খেলতে।

স্মৃতিগুলোর কথা ভাবার সময় নিজের কাল্পনিক হাত পাগুলো আগের মতনই নাড়ায় হিতোমি।

একবার কাউচে বসে মিকির উদ্দেশ্যে সে বলেছিল, “বলুন দেখি আমি কি করছি?” কাঁধদু’টো ওপর নিচে নড়ছিল তার।

“বুঝতে পারছেন না? ডিম ভাজছি!”

কাল্পনিক হাতে একটা ফ্রাইং প্যান ধরে ছিল সে। মিকি বুঝতে পারল যে ফ্রাইং প্যানে ডিমটা ওল্টানোর চেষ্টা করছে হিমি।

“সবার ভালোবাসায় বড় হয়েছে হিতোমি,” শিনিচি বললো। “আপনি কি কখনো কারো ভালবাসা পেয়েছেন?”

মিকি বললো যে এই প্রশ্নের জবাব তার কাছে নেই।

“আমার সাথে আগে নিয়মিত কথা বলতেন আপনি। তখন একবার বলেছিলেন যে ছোটবেলায় এক বান্ধবী ছিল আপনার। তাকে কি ভালোবাসতেন?”

ঘাড় কাত করলো মিকি। শিনিচির চেহারায় নিঃসঙ্গতা ভর করেছে। “ওর কথা ভাবলে বড় কষ্ট হয় আমার। কি করবো বুঝে উঠতে পারি না। মাঝে মাঝে এত বেশি অসহায় লাগে যে মরে যেতে ইচ্ছে করে।

ইউকির প্রেমে পড়েছে সে। কিন্তু এ কথাটা ইছে করে গোপন করে রেখেছে এতদিন। মিকির সামনে ফিসফিসিয়ে সত্যটা কেন বললো, এর উত্তর তার জানা নেই। তবে ইউকি ঘুমিয়ে আছে বলেই কাজটা করেছে।

নিজের বিশাল দেহটা নাড়ালো শিনিচি। স্বাভাবিক ব্যক্তির তুলনায় অনেক বেশি লম্বা সে। তবে ইউকি সে তুলনায় খাটো। একই দেহের দু’পাশে দুটো মাথা। মিকির হাতের কাজ। তাদের জোড়া দিয়ে দিয়েছে সে। আগে সম্পূর্ণ আলাদা দু’জন মানুষ ছিল তারা।

“নিজের অদ্ভুত ক্ষমতা পরীক্ষা করে দেখার জন্যে আমাদের এই দশা করেছেন আপনি। সেজন্যে আপনাকে সাধুবাদ জানাবো নাকি অভিশাপ দেব বুঝতে পারছি না।”

জোরে গুঙিয়ে উঠলো শিনিচি।

দুটো আলাদা মানুষকে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করলে কি হবে?–এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্যে কাজটা করেছিল মিকি। প্রথমে শিনিচির ডান হাতটা কনুইয়ের নিচ থেকে কেটে ফেলেছে। ইউকির বাম হাতেরও একই অবস্থা করেছিল। এরপর তাদের পেশী আর রক্তনালীগুলো জুড়ে দিয়েছে সিন্থেটিক সুতোর সাহায্যে। সার্জারি সম্পর্কে খুব বেশি কিছু অবশ্য জানতো na মিকি, তার বাবার বইগুলো এ ব্যাপারে সাহায্য করেছিল তাকে। তার ক্ষমতাবলেই হয়তো, শিনিচি আর ইউকির শরীর জোড়া লেগে গেছে। তাদের রক্তের গ্রুপ এক কিনা, সেটা নিয়েও কখনো ভাবেনি মিকি। রক্তের গ্রুপ আলাদা হলেও এক্সপেরিমেন্টটার ফলাফল বদলাতো বলে মনে হয় না।

ধীরে ধীরে শিনিচি আর ইউকির পেশী আর স্নায়ু একীভূত হতে শুরু করে। তাদের শরীরের মধ্যকার সীমারেখা মিলিয়ে যাচ্ছে। দু’জনেরই আলাদা চেতনা আছে অবশ্য এখনও। একে অপরের অস্তিত্ব সম্পর্কে অবহিত তারা। জানে যে তাদের শরীরে কি হচ্ছে। তলকুঠুরিতেই প্রথমবার দেখা হয়েছিল দু’জনের। একজনকে এই বাড়িটার কাছে খুঁজে পেয়েছিল মিকি; অপরজন তার বই পড়ে একটা চিঠি লিখেছিল। সেই চিঠিতে আত্মহত্যার ইঙ্গিত থাকায় তাকে আমন্ত্রণ জানায় সে।

তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো কয়েকবার করে কেটে জোড়া দিয়েছে মিকি। বাড়তি জিনিসগুলো অবশ্য ফেলে দিতে হয়েছে। মিকি যাদের দেহে ক্ষত সৃষ্টি করে, তাদের শরীরে পচন ধরে না। কিন্তু কেটে ফেলা অঙ্গগুলোর কথায় সে কথা প্রযোজ্য না, কারণ হৃদয় এবং মস্তিষ্কের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ওগুলোর। পচতে শুরু করে স্বাভাবিকভাবেই।

কেটে জোড়া দেয়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো প্রথমে নড়াচড়া করতে পারতো না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে হাড়ির মতন প্রবৃদ্ধি তৈরি হয়েছে ওগুলোর ভেতরে। এক সময় মিকি আবিষ্কার করে যে সেগুলোও নাড়াতে পারছে শিনিচি বা ইউকি। প্রথমদিকে নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হলেও, এক সময় পুরোপুরি অঙ্গগুলো নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয় তারা। তবে এখন শিনিচি-ইউকির শরীরে যে হাত-পা গুলো দেখা যাচ্ছে সেগুলো হিতোমির। কোন এক অজ্ঞাত কারণবশত হিতোমির কাটা হাত পায়ে পচন ধরেনি। তাই সেগুলো শিনিচি ইউকির শরীরে জুড়ে দিয়েছে সে।

মিকি জিজ্ঞেস করেছিল যে হিতোমির হাত-পা নিয়ন্ত্রণ করে কে।  “জানি না,” ঘোরলাগা কণ্ঠে বলে ইউকি। “আমি করতে পারি বা শিনিচিও করতে পারে। এখন আর এসব আলাদাভাবে বুঝতে পারি না।”

শরীরের (আদৌ যদি মাংসের দলাটাকে শরীর বলা যায়) ওপর একক নিয়ন্ত্রণ নেই তাদের কারোরই। আর এটা নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথাও নেই।

“নিজেদের মধ্যে গল্প করি আমরা সারাক্ষণ,” শিনিচি বলে। “আগের নিঃসঙ্গতা আর একাকীতু নিয়ে।”

ছোটবেলায় বাবা-মা’কে হারায় শিনিচি। পরিবার পরিজন বলতে কেউ ছিল না। তাই ইউকির সার্বক্ষণিক উপস্থিতি উপভোগ করে সে। ইউকি একবার বেঁচে থাকার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিল। সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নিজেকে শেষ করে দেয়ার। কিন্তু এখন শিনিচির কারণে বেঁচে থাকার উৎসাহ ফিরে পেয়েছে সে।

“কিন্তু আপনি বড় নিষ্ঠুর,” অনুযোগের কণ্ঠে বলে মিকি। “আপনি যদি আমাদের ঘাড়দুটো আরেকটু কাছাকাছি নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতেন…”

দু’জনের মাথা দেহের দু’প্রান্তে। এসময় নড়ে উঠলো বিশাল দেহটা। “জেগে আছো নাকি? আমি তো ভেবেছিলাম ঘুমাচ্ছো।”

“এখনও বুঝতেই পারলাম না,” ছায়া থেকে উত্তর এলো।

“আমাদের শরীরের যা অবস্থা, কখনো বুঝতে পারবে বলে মনে হয় না।”

জোড়া শরীর নিয়ে কিভাবে আরামে ঘুমানো যায়, সেটা বোঝার চেষ্টা করছে দু’জনে।

শিনিচি মাথা উঁচু করলে, ইউকির গাল প্রায় মেঝের সাথে লেগে যায়। আর ইউকি নিজেকে সুবিধাজনক অবস্থানে আনলে শিনিচির দুর্বল হাতটাকে ভারী শরীরটা ভার বহন করতে হয়। দু’জনেই যাতে আরামে থাকতে পারে, সেই অবস্থানটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে তারা অনেকদিন ধরে। কিন্তু সেটা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। একজনকে অস্বস্তিদায়ক অবস্থান মেনে নিতেই হবে। এজন্যেই খুব সম্ভবত ‘মানব গিট্ট’ গল্পটার সাথে তাদের মিল খুঁজে পেয়েছে হিতোমি।

“আপনার ক্ষমতাটা যে কি,” মিকি কথা বলে ওঠে আবারো। “আমাদের অনেক আগেই মরে যাবার কথা ছিল। আপনি কারো শরীরে ক্ষত সৃষ্টি করা মাত্র, মৃত্যু দূরে পালিয়ে যায় তার থেকে। আমার ক্ষতস্থানগুলোতেও জীবনের অস্তিত্ব স্পষ্ট টের পাচ্ছি। জন্ম মৃত্যুর চক্র থেকে আমাদের রেহাই দিয়েছেন আপনি…”

ঘুরে দাঁড়ালো মিকি।

তলকুঠুরি ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় পেছনের কাঠ আর ইটগুলোর দিকে একবার তাকালো সে।

তলকুঠুরির দরজাটা বুজে দিতে হতে পারে। প্রয়োজনীয় মাল-মশলা আছে এখানে। যদি আগন্তুকের হদিস না পাই, এটাই করতেই হবে।

এর কিছুদিন পর কেউ একজন কড়া নাড়লো তার দরজায়।

.

শিওজাকিই অপরাধী, এটা একরকম নিশ্চিত আমি। কিন্তু সেটার কোন প্রমাণ নেই। পুলিশ ফোন দিতে গিয়ে থেমে গেছি বহুবার। প্রতিবারই রিসিভারটা উঠিয়ে একটু পরেই নামিয়ে রেখেছি। যদি আমাকে বলা হয় যে কিসের ভিত্তিতে তাকে দোষ দিচ্ছি, তখন কি বলবো? আমার দেয়া ব্যাখ্যাগুলো নিশ্চয়ই মনঃপুত হবে না তাদের।

এক সপ্তাহ যাবৎ শিওজাকির ব্যাপারে তথ্য জোগাড়ের চেষ্টা করছি। কিন্তু কাউকে যে তার ব্যাপারে সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করবো, সেটা সম্ভব না। তার মনোযোগ আকৃষ্ট হয়, এরকম কিছু করা যাবে না। একবার যদি বুঝে যায় যে তাকে সন্দেহ করি আমি, হিতোমির ক্ষতি হতে পারে।

একদিন মেলানকলি গ্রোভে সুমিদাকে বলতে শুনলাম, “শিওজাকির বিয়ে হয়েছিল আগে।” বরাবরের মতনই কাউন্টারের উল্টোদিকের সিটটায় বসে একদৃষ্টিতে সাওরিকে কাপে কফি ঢালতে দেখছে সে।

“সুমিদা, তোমার তো এই সময়ে ক্লাসে থাকার কথা, যেন কোন বাচ্চার সাথে কথা বলছে, এমন ভঙ্গিতে বললো সাওরি।

“আপনার কি মনে হয়? কোনটা বেশি জরুরি আমার জন্যে? ক্লাসে যাওয়া, নাকি এখানে আসা?।”

সুমিদা এরকম কিছু বললে কিমুরা সবসময় কাউন্টারে রাখা গোল ট্রেটা দিয়ে বাড়ি বসায় তার পিঠে। মজাচ্ছলেই কাজটা করে সে।

“শিওজাকি বিবাহিত?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।

জবাবে দেয়ালে ঝোলানো ছবিটা দেখালো সুমিদা। “ভালো করে খেয়াল করো। হ্রদটার তীরে একটা লাল বিন্দু দেখতে পাবে।”

ছবিটার কাছে চোখ নিয়ে গেলাম আমি। আসলেও একটা লাল রঙের বিন্দু দেখতে পাচ্ছি, আগে চোখে পড়েনি কোন রহস্যময় কারণে।

“আমার কাছে মনে হয়েছিল, বিন্দুটা কোন মহিলার আদলে আঁকা। শিওজাকিকে জিজ্ঞেস করায় সে বলে তার স্ত্রীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে বিন্দুটা দিয়েছে সেখানে।

পুরো চিত্রকর্মটার তুলনায় বিন্দুটা একদমই ছোট। কাছে চোখ না নিলে দেখতে পেতাম না। আমার কাছেও একটা মহিলার অবয়বের মত ঠেকছে বিন্দুটা। লাল রঙের পোশাক তার পরনে।

ঠিক সেই মুহূর্তে ছবিতে আঁকা হ্রদটা আর গাছগুলো উধাও হয়ে গেল। একদৃষ্টিতে লাল বিন্দুটার দিকে তাকিয়ে আছি আমি। এখন মনে হচ্ছে, ছবিটার বাকি অংশটুকু আঁকাই হয়ে মহিলাকে ঘিরে।

কাঁধ ঝাঁকালো সুমিদা। “সে আসলেও বিবাহিত কিনা জানি না। আমাকে যা বলেছিল সেটাই বললাম।”

শিওজাকির ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য কোন তথ্য নেই আমার কাছে। তার অতীত বা পরিবার-পরিজন সম্পর্কে কিছু জানি না। এই বাড়িটা হঠাৎ ভাড়া নিয়েছে কেন সে? কায়েদিতে তার পরিচিত কেউ আছে?

তদন্তের সময়টুকুতে মিঃ ইশিনোর বাসাতেই থাকলাম আমি। সাওরি আর তার সাথেই খাওয়া দাওয়া সারি। মাঝে মাঝে একইসাথে লিভিং রুমে বসে টিভি দেখি।

কখনো কখনো মনে হয় যে তাদের অনর্থক বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছি, আবার কখনো মনে হয় ইশিনোদের বাড়িতে কাজুয়ার জায়গা দখল করেছি আমি।

প্রতিদিন বাসায় একবার ফোন দেই। তাদের কাছে বেশ কয়েকবার ক্ষমা চেয়েছি এভাবে হুট করে চলে আসায়। যতই নিজেকে প্রবোধ দেই না কেন, কাজটা ঠিক করছি না।

“পুরনো নামি কখনো এভাবে বাড়ি থেকে চলে যেত না,” বলে তারা।

বাবা প্রায়ই খেই হারিয়ে ফেলে কথা বলার সময়। আর মার সাথে সম্পর্ক এখনও ঠিক হয়নি। দু’জনেই রিসিভার কানে চেপে চুপ করে থাকি। কিছুক্ষণ অবিচ্ছিন্ন নীরবতার পর বাবার দিকে ফোন এগিয়ে দেয় সে।

“তাড়াতাড়ি ফিরে এসো,” বাবা বলে। “একবার চেকআপের জন্যে হাসপাতালে যেতে হবে।”

শিওজাকির ব্যাপারে মাথা না ঘামালে সেই সময়টুকু সাওরিকে কাজে সাহায্য করার চেষ্টা করি। ক্যাফেতেও, বাসাতেও। অ্যাপ্রন পরে পাশাপাশি বসে অপেক্ষা করি কাস্টমারের জন্যে। বাসন ধুতে ধুতে এটাসেটা নিয়ে গল্পে মেতে উঠি।

একবার দু’হাত ভর্তি অপোয়া বাসন নিয়ে সাওরি বলে, “নাক দিয়ে পানি পড়ছে আমার!”

কিন্তু হাত খালি করে যে নাক মুছবে সেই উপায় নেই।

“এবার ঠিক আছে?” একটা টিস্যু নিয়ে তার নাক থেকে সর্দি মুছে ফেলে বলি। ছোট বাচ্চাদের মতন নাকি কণ্ঠে আমাকে ধন্যবাদ দিল সারি।

এক ঝড়ের রাতে দু’জন কার্ড খেলে কাটালাম। স্টোভ জ্বালিয়ে আর কোতসুর নিচে পা দিয়েও যখন শরীর গরম হলো না, মোটা কাপড় গায়ে চাপিয়ে জড়াজড়ি করে বসে রইলাম। বাইরে থেকে শোঁ শোঁ বাতাসের আওয়াজ ভেসে আসছিল। মনে হচ্ছিল আমি আর সাওরি বাদে আর কেউ নেই পৃথিবীতে।

উনো খেলার সময় কাজুয়ার ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞেস করলো সাওরি। আমার মুখ থেকে নিজের ভাই সম্পর্কে অজানা তথ্যগুলো জানতে চায় সে। কিন্তু কাজুয়ার প্রসঙ্গ উঠলেই, ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি আমি।

তখন হেসে ওঠে সাওরি। সত্যটা কি, সে ব্যাপারে ধারণাও নেই তার।

“জানো একবার খেলার সময় কার্ড খেতে শুরু করে কাজুয়া। একদম ছোট্ট ছিল তখন। সেবার প্রথমবারের মতন নিজেকে বড় বোন মনে হয়েছিল, কার্ড বেটে দেয়ার সময় বললো সে।

গল্পটা শুনে হেসে ওঠার সময় খেয়াল করলাম যে কাজুয়া আর সাওরির জন্যে এক ধরনের মমতা অনুভব করছি ভেতরে ভেতরে। মমতাটুকু এতই প্রগাঢ় যে রীতিমত কান্না পাচ্ছে। কি অদ্ভুত? হাসছি, সেই সাথে কাঁদতেও চাইছি।

“সাওরি, তোমাদের বাবা-মা’র শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের কথা মনে আছে?” কয়েকদিন আগে সাওরি জোর দিয়ে আমাকে বলেছে তাকে তুমি করে বলতে। “কাজুয়ার কাছে সেদিনের কথা শুনে একটু অবাকই হয়েছিলাম…”

স্মৃতিটা কিছুদিন আগে বাঁ চোখে দেখেছি আমি। কালো পোশাক পরে সবাই দাঁড়িয়ে ছিল সাওরি আর কাজুয়ার উল্টোদিকে। তবে ভিড়ের মধ্যে এক তরুণকে আলাদাভাবে চোখে পড়ে আমার। সাওরি আর কাজুয়ার দিকে এগিয়ে এসে মাথা নিচু করে কিছু কথা বলে সে। কথাগুলো শুনে চোখে পানি চলে আসে সাওরির। তরুণের চোখেও সেদিন ভর করে ছিল রাজ্যের বিষণ্ণতা।

তরুণ ছেলেটা কি বলেছিল ওদের উদ্দেশ্যে, সেটাই জানতে চাইলাম। সাওরি তাকে একবার জড়িয়ে ধরে কান্নার মাঝেই।

“এরকমটা করেছিলাম নাকি? আসলে ঠিক মনে নেই,” গালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে সে। “ঐ ছেলেটার গাফিলতির কারণেই বাবা-মা মারা যায়। দড়িতে ঠিকমতো গিট দিতে পারেনি…।”

সাওরি বউ কষ্ট লেগেছিল ছেলেটার জন্যে। বারবার নাকি কাজুয়া আর সাওরির কাছে ক্ষমা চাইছিলো। অন্য এক শহর থেকে কাজ করার জন্যে কায়েদিতে আসে সে। নিজের ব্যাপারে সব খুলে বলে ওদের।

“এগুলো তোমাদের কেন বলে সে?”

“হয়তো কারো সাথে কথা বলে মন হালকা করতে চাচ্ছিলো।”

এর দুই সপ্তাহ পরে গলায় ফাঁস নেয় ছেলেটা। সুইসাইড নোট লিখে রেখে যায় যে তার কারণে দু’জন ছেলেমেয়ে অনাথ হয়ে গেছে, এটা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিল না।

বিষণ্ণ কণ্ঠে আমার কাছে ছেলেটার গল্প করলো সাওরি।

*

হাতে সময় থাকলে বাঁ চোখের স্মৃতি ভর্তি বাইন্ডারটা ব্যাগে ঢুকিয়ে বেরিয়ে পড়ি শহর ভ্রমণে। ভারি জিনিসটা পিঠে নিয়ে হেঁটে বেড়ানোর সময় নিজেকে ভিক্ষু মনে হয়।

যে করেই হোক, খুব তাড়াতাড়ি শিওজাকির বিরুদ্ধে প্রমাণ যোগাড় করতে হবে আমাকে। কিন্তু সেটার জন্যে কাজুয়ার পদচিহ্ন অনুসরণ করা দরকার।

শহরময় হেঁটে বেড়ানোর সময় তার দেখা জিনিসগুলোই নিজের চোখে দেখি। তার অভিজ্ঞতাগুলোকে আরো আপন করে নেয়ার চেষ্টা করি। সেদিন কাজুয়ার প্রাইমারি স্কুলে যাওয়ার পর স্মৃতির স্রোতে বাঁধ ভেঙে যায়। একটার পর একটা ভেসে উঠতে থাকে বাঁ চোখে।

শহরের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া হাইওয়ের পাশেই একটা সুপারমার্কেট। আর সেটার পেছনে পরিত্যক্ত কিছু জমি। ছোটবেলায় নিভৃতে সময় কাটানোর জন্যে এখানে প্রায়ই আসততা কাজুয়া। আমিও তার মতন ঘাপটি মেরে বসে থাকি জায়গাটায়। নিজেকে কাজুয়া মনে হয় তখন।

সারি সারি বৈদ্যুতিক খুঁটি ভর্তি একটা রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় হঠাৎই থমকে দাঁড়াই। পাশেই খালি একটা পার্ক। কায়েদি শহরের অনেক মানুষের জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হচ্ছে কাঠ। একটা লোক পুরু পোশাক পরে গাছের গায়ে করাত চালাচ্ছিল। কাছে এগিয়ে যাই ভালো করে দেখার জন্যে। কিন্তু হাত নেড়ে আমাকে সেখান থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয় সে। যে কোন সময় বিপদ হতে পারে। কিছুক্ষণের মধ্যে গাছটা ভেঙে পড়ে নিচে।

বাইন্ডারটা বের করে সেটা পড়তে পড়তে রাস্তা দিয়ে হাঁটি। দেখে মনে হবে গাইডবুক হাতে কোন পর্যটক হেঁটে বেড়াচ্ছে।

এক হাত দিয়ে বইটা ধরে অন্য হাত দিয়ে স্মৃতিগুলোর পাতা ওল্টাতে থাকি। হাতে গ্লোভস থাকায় পাতা উল্টাতে একটু কষ্ট হচ্ছে অবশ্য। তবে এক হাতে ভারি বাইন্ডারটা ধরে থাকা আরো কষ্টসাধ্য।

ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে হাঁটছি তো হাঁটছিই। শহর থেকে কিছুটা দূরে একটা পরিত্যক্ত রেললাইন খুঁজে পেলাম। সেটার পাশ দিয়ে পাহাড়ের ওপরে উঠে গেছে একটা নুড়ি বিছানো পথ। রেললাইনগুলোয় মরিচা পড়ে লালচে রঙ ধারণ করেছে।

বাইন্ডারটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে রেললাইনের ওপরে উঠে পড়লাম। আগের নামি হলে হয়তো খুব সহজেই ভারসাম্য রক্ষা করে সামনে এগোতে পারতো। কিন্তু আমি বারবার হোঁচট খাচ্ছি।

পাহাড়ের ওপর থেকে নিচের ছোট্ট শহরটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কাজুয়ার দেখা শহরের দৃশ্যের সাথে এখনকার দৃশ্যে অবশ্য কিছু পার্থক্য আছে। নতুন কিছু বাড়ি বানানো হয়েছে, তৈরি হয়েছে নতুন রাস্তা। এ কারণেই জার্নালের বিবরণীর বাইরে কিছু বিল্ডিং চোখে পড়লো।

বাম চোখে এখনও পুরনো দৃশ্যটা দেখতে পাচ্ছি। এই চোখটা আসলে অতীতের একটা জলজ্যান্ত অংশ। শক্ত ক্যান্ডি যেরকম ধীরে ধীরে গলে যায়, ঠিক সেভাবে আমার অপটিক নার্ভে ধীরে ধীরে অতীতের দৃশ্য সরবরাহ করে চোখটা।

বনের ধারে গিয়ে শেষ হয়ে গেল রেললাইন। সামনে একটা প্লাটফর্ম। স্কুল থেকে ফেরার পথে একদিন এই প্লাটফর্মটাই দেখি স্বপ্নে। সেখানে অবশ্য পুরো সবুজ ছিল গাছগুলো, এখনকার মত পাতাবিহীন না। তবে বগিটা এখনও আগের মতনই আছে।

দৌড়ে গেলাম ওটার দিকে। ভেতরে ঢুকে পড়লাম কিছু না ভেবেই। এখন আর ঠান্ডা বাতাস আঘাত হানতে পারছে না আমার চোখেমুখে। বাইরের তুলনায় ভেতরে বেশ গরম। কিন্তু স্মৃতিতে যেরকম দেখেছিলাম তার চেয়ে খালি ঠেকলো বগিটা। সবকিছু সরিয়ে ফেলা হয়েছে, সিটগুলোও। এখন শুধু একটা ফাঁপা বাক্স বগিটা।

মনে আছে আমার, কাজুয়াকে এখানে খেলায় নিতে চাইনি অন্য বাচ্চাগুলো। একজন তো পাথর ছুঁড়ে মারে।

আমার বাঁ চোখের অনেক স্বপ্নেই একাকী সময় কাটাতে দেখি কাজুয়াকে। কিছু স্বপ্নে বন্ধুদের সাথে খেলা করতেও দেখেছি তাকে, কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই একা হাঁটতো।

হয়তো এটাই বাস্তবতা, জীবনের বেশিরভাগ সময়ই নির্জনেই কাটাই আমরা।

কাঠের মিলটাতে গেলাম এরপর। কাজুয়া আর সাওরির বাবা-মা যেখানটায় মারা গেছে, সেখানে ঢুকবো কিনা ভাবতে লাগলাম। একটা খাটো বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে জায়গাটুকু। সদ্য কাটা কাঠের গন্ধ নাকে এসে লাগলো। সাওরির কাছ থেকে নেয়া একটা স্কার্ফ দিয়ে নাক ঢেকে ভেতরে পা রাখলাম।

কিছুক্ষণ ঘোরাফেরার পর মিলের অফিসের দরজার দিকে চোখ পড়তেই থমকে গেলাম। পরিচিত একজন হাত নাড়ছে আমার উদ্দেশ্যে। সাওরি। দুজনেই দু’জনকে দেখে অবাক হয়েছি।

“এখানে খুব বেশি আসি না আমি,” বললো সে। “কিন্তু আজকে মা বাবার ব্যাপারে কিছু জিনিস জানতে ইচ্ছে করছিলো।” সাওরির বাবার কিছু সহকর্মী এখনও কাজ করে এখানে।

মেলানকলি গ্রোভের উদ্দেশ্যে পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করি আমরা। চুপ করে আছে সাওরি। হয়তো বাবা-মা বা কাজুয়াকে নিয়ে ভাবছে। কিংবা সেই বিষণ্ণ চেহারার তরুণকে নিয়েও ভাবতে পারে।

ক্যাফের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলাম। কিমুরা বাদেও অপরিচিত কয়েকজন কাস্টমার বসে আছে টেবিলে। খুব বেশি একটা লোক হয়না ক্যাফেটায়, কিন্তু মাঝে মাঝে অনেকেই একসাথে চলে আসে সময় কাটানোর জন্যে।

কাউন্টারে বসেই জমে গেলাম। মনে হচ্ছে হিটারটা হঠাৎ কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। দূরে অন্ধকার টেবিলটায় বসে আছে শিওজাকি। আশেপাশের কারো দিকে কোন খেয়াল নেই তার-অন্তত দেখে সেটাই মনে হচ্ছে।

বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল বরাবরের মতন। ঐ টেবিলটায় গিয়ে বসতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু ক্যাফেতে ঢুকেছি খুব বেশিক্ষণ হয়নি, এত তাড়াতাড়ি গেলে সন্দেহ করতে পারে। তাই চুপচাপ কাউন্টারের পাশেই বসে রইলাম।

“নামি?”

সাওরি যে আমার নাম ধরে ডাকছিল, সেটা এতক্ষণে খেয়াল করলাম। কোমরে অ্যাপনের ফিতেটা বেঁধে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “লাঞ্চ করেছো? কিছু লাগবে?”

বললাম যে খাইনি।

না চাইতেও বারবার দৃষ্টি চলে যাচ্ছে শিওজাকির দিকে। আমার লাঞ্চ শেষ হয়েছে কেবল, এসময় উঠে দাঁড়ালো সে। কাঠের মেঝেতে তার পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। কাউন্টারে বিল মেটানোর জন্যে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো হারামিটা।

চোখাচোখি হওয়াতে একবার ঝড়ের বেগে মাথা নাড়লাম কেবল। অপহৃত হিতোমি আর মৃত কাজুয়ার ছবি ভেসে উঠলো মনে। রাগে ফেটে পড়ছি, এটা ঠিক। কিন্তু সেই সাথে প্রচণ্ড ভয় আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছে আমাকে। নিজেকে ছোট্ট একটা অবলা প্রাণীর মত মনে হচ্ছে। সামনে থেকে দানোটার চলে যাওয়ার অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

শিওজাকি বের হয়ে গেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। পরক্ষণেই নিজের এহেন কাপুরুষতায় বিষিয়ে উঠলো মন।

কিয়োকো ক্যাফেতে এলো এসময়। হাতে একটা হার্ডকভার বই। আমাকে দেখে হাসলো সে আন্তরিক ভঙ্গিতে। নিজের প্রিয় সিটটায় বসে কফির অর্ডার দিল। “হাউজ ব্লেন্ড, প্লিজ।”

“নিশ্চয়ই…” সাওরিকে দেখে মনে হচ্ছে অনিচ্ছাস্বত্তে কথাটা বললো।

ততক্ষণে হাতের বইটা পড়া শুরু করেছে কিয়োকো।

*

একা একা বসে থাকলে সবসময় মৃত মানুষদের নিয়ে ভাবে সাওরি। কখনো নিজ থেকে একথা আমাকে বলেনি সে, কিন্তু সেটাই ধারণা আমার।

ব্যাখ্যা করছি, দাঁড়ান। ধরুন, লিভিং রুমের জানালার পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে আছে সাওরি। বাড়িটা একটা পাহাড়ি ঢালে তৈরি তাই নিচের রাস্তাটা পরিষ্কার দেখা যায়। এই মুহূর্তে সেখানে কেউ না থাকলেও সাওরি নিশ্চয়ই দেখছে কাজুয়া স্কুল থেকে ফিরে আসছে বা তার বাবা কাজে যাচ্ছে।

ওয়াশিং মেশিনের দিকেও একই দৃষ্টিতে তাকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি আমি। নিশ্চয়ই মা’র কথা ভাবছিলো সে তখন। অবশ্য ছোটবেলা থেকে মামার বাসায় বড় হয়নি সে। তবুও, আমার ধারণা মা’র কথাই ভাবছিল সাওরি।

এরকম সময়ে চাইলেও তার সাথে কথা বলতে পারি না। পেছন থেকে দেখলে ভীষণ দুঃখী মনে হয় তাকে। যে কারো মনে করুণার উদ্রেক ঘটাতে বাধ্য দৃশ্যটা।

বাম চোখে খণ্ড খণ্ড অতীতের চিত্র দেখি আমি। আর সাওরির জন্যে সবকিছুই হচ্ছে অতীতের বোমন্থন। হয়তো কথাটা ঠিকমতো বোঝাতে পারছি না। আমি যে রকম কাজুয়ার স্মৃতিগুলোর জন্যে অপেক্ষা করি, সাওরিও সে রকমভাবে মৃত মানুষদের নিয়ে ভাবে।

“দুই মাস হয়ে গেল,” রাতের খাবার শেষে বললো সাওরি। “তবুও আমার মনেই হচ্ছে না কাজুয়া চিরদিনের জন্যে হারিয়ে গেছে। এটার কারণ কি? হয়তো আমি কষ্টই পাইনি ওর মৃত্যুতে।”

সাওরির মামার বাসায় ফিরতে দেরি হয় ইদানীং। তাই আমরা দুজন খেয়ে নেই। টেলিভিশন বন্ধ থাকায় তার প্রতিটা শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।

কোতসুর ওপরে রাখা একটা কাপের দিকে তাকিয়ে আছি আমরা। কাজুয়া নিয়মিত ব্যবহার করতে কাপটা।

“হয়তো উল্টোটা ভাবছো তুমি। আসলে কাজুয়া যে চলে গেছে এটা মেনে নিতে পারোনি, তাই কষ্ট অনুভব করছো না ভেতরে ভেতরে।”

“তুমি খুবই অদ্ভুত, নামি।”

একবার ঘাড় কাত করলাম।

“তোমাকে দেখলে মনে হয় আমার ছোটভাইটা এখনও এখানে আছে আমার সাথে।

“তাই?”

“হ্যাঁ। যাইহোক, তুমি কি জানো যে কাজুয়ার বাম চোখটা অন্য একজনের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে?”

এই বিষয়ে আরো আগে থেকেই কথা বলার ইচ্ছা আমার।

“মৃত্যুর পর ওর একটা চোখ সংরক্ষণ করা হয়। এমনটাই চেয়েছিল কাজুয়া।”

“কেন?”

“দেড় বছর আগে চোখে একটা ফোঁড়া হয় ওর। সেটা কেটে ফেলার পর কিছুদিনের জন্যে চোখটা ব্যান্ডেজ করে দেয় ডাক্তার। তিনদিনের জন্যে এক চোখ অন্ধ হয়ে যায় কাজুয়ার।”

সাওরি বললো যে চক্ষু হাসপাতালে মরণোত্তর চক্ষুদানের একটা লিফলেট দেখে কাজুয়া। তখনই সিদ্ধান্তটা নিয়ে নেয় সে।

“চোখ দুটো খুবই সুন্দর ছিল আমার ভাইয়ের,” স্মৃতি রোমন্থনের ভঙ্গিতে বললো সাওরি। মাঝে মাঝে ভাবি, এখনও কত কিছু দেখা বাদ ছিল ওর।”

যেরকমটা বললাম একটু আগে, সুযোগ পেলেই মৃতদের নিয়ে ভাবতে শুরু করে সাওরি।

সুমিদা যখনই আন্তরিক ভঙ্গিতে অভ্যর্থনা জানায় সাওরিকে, হেসে উত্তর দেয় সে। প্রথমে এটাই দেখেছিলাম কেবল। কিন্তু পরে ভালোমতো খেয়াল করায় বুঝতে পারি, কথার মাঝে কাজুয়া যে চেয়ারটায় বসততা, সেটার দিকে তাকিয়ে থাকে সাওরি।

সময় বয়ে চলে। মহাকালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায় মানুষ। পরিত্যক্ত রাস্তা বা রেললাইন যেরকম অদৃশ্য হয়ে যায় শহর থেকে, মানুষের অস্তিত্বও মিলিয়ে যায়। চেনা পৃথিবীটাকে একটু অন্যরকম মনে হয় তখন। কিন্তু সাওরি এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া মানুষদের নিয়ে এমনভাবে চিন্তা করে, যেন সময় থেমে গেছে।

সাওরির থমকে যাওয়া জীবন এখন কাজুয়ার রেখে যাওয়া ভাঙা সোনালি ঘড়িটার মতন। কাটাগুলো আর ঘুরছে না।

তার মামার ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য।

আমি যে ঘরটায় ঘুমাই, তার উল্টোদিকে একটা বৌদ্ধ বেদি আছে। সেই বেদিতে কাজুয়া, সাওরির বাবা-মা আর মিসেস ইশিনোর ছবি রাখা।

একদিন সকালে গায়ে কম্বল জড়িয়ে শুয়ে আছি এসময় বাইরে থেকে শব্দ শুনতে পাই। দরজা খুলে দেখি সাওরির মামা বেদিটা ঠিকঠাক করছেন। এরপর হাত জোড় করে আমার দিকে তাকালেন তিনি, “তোমার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছি?”

মাথা ঝাঁকিয়ে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। পা ভাঁজ করে বসলাম বেদির সামনে।

“একবার আমার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছিলাম কোন কারণ ছাড়াই, দুর্বল কণ্ঠে বললেন মিঃ ইশিনো। “কেন যে একটুতেই রেগে যেতাম।”

তার স্ত্রীর ছবিটার দিকে তাকালাম। নিউমোনিয়ায় মারা গেছে সে।

এরপরেও বেশ কয়েকবার তাকে বেদিটার সামনে দেখেছি আমি। বেদনার্ত মানুষকে সান্ত্বনা দিয়ে আসলে খুব বেশি কিছু বলা যায় না, তাই মুখ বন্ধ রেখেছি প্রতিবারই।

মিঃ ইশিনোকে দেখে মনে হয় যেন অনুতাপ কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাকে।

একদিন ক্যাফের কাজে কিমুরাকে সাহায্য করি আমি। সাওরি কোথায় যেন গিয়েছে, তাই তার জায়গায় আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে ক্যাফে মালিক। অবশ্য খুব বেশি কিছু যে করেছি তা-ও না। একদমই অল্প কাস্টমার এসেছিল সেদিন। আমার একমাত্র দায়িত্ব হচ্ছে বসে বসে কিমুরার অভিযোগ শোনা।

কিছুক্ষণ পরে কিমুরা উধাও হয়ে গেল।

“সুমিদা, একটু এখানে বসুন,” বলে তার হাতে অ্যাপ্রনটা ধরিয়ে দেই আমি।

অবাক হয়ে যায় সে। “দাঁড়াও… মানে কি? এখানে কি করবো আমি?”

তার কথা আমলে না নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। ক্যাফের পেছনে ছিল কিমুরা। সে কি করছে তা বুঝতে কিছুটা সময় লাগলো আমার।

একসারিতে জুতো সাজিয়ে রাখা হয়েছে প্রায় ত্রিশটার মতন হবে। প্রত্যেকটাই ব্যবহৃত। সব ধরনের জুতো আছে সেখানে। বাচ্চাদের থেকে শুরু করে পূর্ণবয়স্ক মানুষ, সবার।

“এগুলো কি?”

“আমার বন্ধুর রেখে যাওয়া জুতো। ওর অদ্ভুত একটা স্বভাব ছিল। কখনো কোন জুতো বাইরে ফেলে দিত না। মারা গেছে কিছুদিন আগে। কিন্তু এই জুতোগুলো রয়ে গেছে।”

হাতে সময় পেলেই জুতোগুলো বাইরে নিয়ে এসে রোদে শুকোতে দেয় কিমুরা। শুধু গায়ে গতরেই না, মনটাও বড় মানুষটার।

“ব্যবহারের ক্রমানুযায়ী জুতোগুলো সাজাচ্ছি। বাম দিকেরগুলো ছোট বেলায় পড়তো। আর ডান দিকেরগুলো মৃত্যুর কয়েকদিন আগে পড়েছে। এই চামড়ার জোড়াটা দেখতে পাচ্ছো?” মাঝের দিকের একটা জুতো দেখিয়ে বললো সে। “আমাদের যখন প্রথম দেখা হয়, তখন পায়ে এটাই ছিল তার।

ডান পাশের আরেকটা জোড়ার দিকে কিছুক্ষণ পর নির্দেশ করে সে। “ক্যাফের উদ্বোধনের দিন এটা ছিল পরনে। তখন অবশ্য ক্যাফের : মালিকানা আমার ছিল না। আমার এক চাচা চালাতে।”

একটা মানুষের জীবন ইতিহাসের স্বাক্ষী এই জুতোগুলো।

একদম ডান দিকের জুতোটার দিকে বিমর্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কিমুরা। “এই জুতোটা খুলে রেখে রেলওয়ে ব্রিজ থেকে লাফিয়ে পড়ে। ওর বাসার দরজার বাইরে পাই এগুলো। রাতের অন্ধকারে খালি পায়ে ব্রিজ পর্যন্ত গিয়েছিল সে।

কিমুরার কথা বলা শেষ হলে ভেতরে গিয়ে ব্যাকপ্যাক থেকে বাইন্ডারটা বের করি। কিমুরার গল্পটা শুনে একটা অদ্ভুত স্মৃতির কথা মনে পড়ে গেছে।

“কি করছো?” কোমরে অ্যাপ্রন জড়ানো সুমিদা জিজ্ঞেস করে। কৌতূহলী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে সে। যা ভেবেছিলাম, তার চেয়ে ভালো মানিয়েছে তাকে ক্যাফের কর্মি হিসেবে।

“আমার গোপন ডাইরি এটা, কাউকে দেখাই না।”

ওর কাছ থেকে লুকিয়ে ভেতরের পাতায় উঁকি দেই।

প্রথমে ভাবলাম ভুল দেখছি। কিন্তু না, কিমুরা যে রাতের কথা বললো, সেদিনকার দৃশ্যটা দেখেছিল সে।

অন্ধকারে মিডল স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল সে। সাইকেলটা পাহাড়ি ঢাল বেয়ে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে আসছিল। তখন মিডল স্কুলে পড়তো সে, এটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারলাম সাইকেলটার কারণে।

ল্যাম্পপোস্টের আলোয় একটা লোককে বিপরীত দিকে হেঁটে যেতে দেখে সে। আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁটছিলো লোকটা। আশপাশের কোন কিছুর প্রতি মনোযোগ ছিল না।

তবে দৃশ্যটা আমার কাছে অদ্ভুত লাগে কারণ লোকটা খালি পায়ে হাঁটছিল।

*

কাজুয়ার অনুসন্ধানের শুরুটা যে কারণে হয়েছিল, সেই স্মৃতিটা দেখলাম একদিন!

সেদিন বাইরে বেরিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না শিওজাকির বাড়িতে যাবো কিনা। ঢাল বেয়ে বাড়িটার দিকে এগোচ্ছিলাম ঠিকই, কিন্তু বারবার থেমে যাচ্ছিলাম। এসময় কাজুয়ার দুর্ঘটনাটা যেখানে হয় সেই জায়গাটা চোখে পড়ে আমার পাশ দিয়েই কিয়োকোর বাড়িতে যাবার রাস্তা। এই রাস্তাটার দু’পাশেও সিডার গাছ ভর্তি। আশপাশের সব শব্দ শুষে নেয় গাছগুলো।

এসময় একটা গাড়ির শব্দ শুনতে পেলাম পেছন থেকে। শিওজাকি আসছে, এই ভয়ে জমে গেলাম রাস্তায়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম যে অন্য মডেলের একটা গাড়ি, চালকও ভিন্ন।

আমার সামনে গাড়ি থামিয়ে জানালা দিয়ে মাথা বের করলেন এক বয়স্ক ভদ্রলোক।

“এক্সকিউজ মি, আমি মনে হয় হারিয়ে গেছি। একটু সাহায্য করতে পারবে?”

তার গাড়িটার দিকে হেঁটে যাচ্ছি, এই সময়ে বাঁ চোখটা গরম হয়ে উঠলো। সিডার গাছের পাশে দাঁড়ানো গাড়িটা দেখে আমার মাথায় একটা স্মৃতির ছিপি খুলে গেছে। তবে এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি স্মৃতিগুলোর এরকম হঠাত আগমনে।

“আমি আসলে এদিকটা ঠিকমতো চিনি না,” লোকটার উদ্দেশ্যে বললাম। “দুঃখিত।”

বাম চোখে দেখছি সিডার গাছের পাশ দিয়ে একটা গাড়ির দিকে এগিয়ে চলেছে কাজুয়া। হয়তো আমি যে রাস্তাটায় দাঁড়িয়ে আছি, সেই রাস্ত টা ধরেই হাঁটছিল সে। গাড়িটা তার সামনে পার্ক করা। তবে আমার মত গাড়িটার কাছে না থেমে পাশ দিয়ে হেঁটে যায় সে।

যখনই ডান চোখে এমন কিছু দেখি যেটার সাথে আমার বাম চোখে দেখা দৃশ্যটা মিলছে না, ভারসাম্য হারিয়ে ফেলি। তাই এই অবস্থায় চোখ বন্ধ করে নেই। কিন্তু এ মুহূর্তে আমার সামনে অন্য একজন লোক থাকায় সেটা করা সম্ভব না।

“এই রাস্তাটা ধরে গেলে…পরের প্রিফেকচারটায় পৌঁছুতে পারবো তো?”

তার উদ্দেশ্যে মাথা নাড়ার সময় এমন একটা অনুভূতি হলো যে আর একটু হলেই হার্ট অ্যাটাক করতাম।

গাড়িটার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আয়নায় চোখ পড়ে কাজুয়ার। সেখানে সে দেখতে পায় যে পেছনের সিটে একটা মেয়ে ঘুমিয়ে আছে। মেয়েটার চেহারা এতবার দেখেছি আমি যে একদম মস্তিষ্কে গেঁথে গেছে। হিতোমি আইজাওয়া।

তবে দৃশ্যটা দেখে কাজুয়ার মনে কোন সন্দেহ জাগেনি। চুপচাপ পাশ কাটিয়ে হেঁটে যায় সে। ড্রাইভিং সিটে কে বসে আছে সেদিকে তাকায় না, লাইসেন্স প্লেটটাও দেখে না।

এখানেই শেষ হয়ে গেল স্মৃতিটা।

সামনের লোকটা কি বলছে সেটা শোনা অনেক আগেই বাদ দিয়ে দিয়েছি আমি। আসলে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি বললেও অত্যুক্তি হবে না। হাল ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন বয়স্ক ভদ্রলোক।

ভাগ্যক্রমে হিতোমিকে গাড়িতে দেখে ফেলেছিল কাজুয়া। তখন অবশ্য জানতো না যে অপহরণ করা হয়েছে তাকে। স্মৃতিতে হিতোমির হাত পা’গুলো তো ঠিকই ছিল, তাই না? নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবো না।

পরে খবরে হিতোমিকে দেখালে সত্যটা বুঝতে পারে সে। সেটা কি অপহরণের পরপরই, নাকি দুই মাস আগে, জানার উপায় নেই। কিন্তু যখনই হোক, হিতোমিকে গাড়িটার পেছনের সিটে দেখার কথা মনে ছিল তার।

কাজুয়া কি জানতো যে গাড়িটা শিওজাকির? অবশ্য স্মৃতিতে যে গাড়িটা দেখেছি, সেটার সাথে শিওজাকির এখনকার গাড়ির মডেলের কোন মিল নেই। হয় নতুন গাড়ি কিনেছে, নতুবা দুইটা গাড়ি আছে তার।

এমনটাও হতে পারে যে শিওজাকির বাড়িতে যাবার রাস্তাটায় গাড়িটা দেখে কাজুয়া। এভাবেই হয়তো সে বুঝতে পারে যে নীল রঙের বাসাটায় থাকে অপহরণকারী।

শিওজাকির বাসায় যাওয়ার রাস্তাটা ভালোমতো খুঁটিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। ঠিক কোথায় দৃশ্যটা দেখেছিল সে, এটা হয়তো জানতে পারবো। কিন্তু এই এলাকার সবগুলো জায়গা একইরকম দেখতে। সবখানে একই চেহারার গাছ। শেষ পর্যন্ত হতাশ মনোরথে রওনা দিলাম মেলানকলি গ্রোভের উদ্দেশ্যে।

ফেরার পথে সাওরিকে দেখলাম কিয়োকোর বাসায় যাওয়ার রাস্তাটা থেকে বেরুতে। তাকে ডাক দিলাম আমি। “আজকে ডেলিভারি দেয়ার দিন,” আমাকে দেখে বিস্মিত স্বরে বললো সে।

*

একদিন ক্যাফের ভেতরেই ভুল করে কোট রেখে আসে শিওজাকি। ওটা পেছনের দিকের টেবিলের পাশে একটা চেয়ারে ঝুলন্ত অবস্থায় আবিষ্কার করে কিমুরা।

কিছুক্ষণ মনে মনে নিজের সাথে যুদ্ধের পর বললাম, “আমাকে দিন। ফেরত দিয়ে আসি।”

“তোমার কষ্ট করতে হবে না,” কিমুরা বললো। “কালকে তো সে আসবেই।”

কিন্তু এরকম একটা সুযোগ হাতছাড়া হতে দেয়া যাবে না। তার ফেলে যাওয়া জিনিস ফেরত দেয়ার ছুতোয় বাড়ির ভেতরটা দেখতে পারবো। কিছু সন্দেহও করবে না শিওজাকি।

আরো কিছুক্ষণ জোরাজুরির পর আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিল কিমুরা। সুমিদা এতক্ষণ ধরে আমাদের কথা শুনছিলো। আমাকে নীল বাড়িটা পর্যন্ত পৌঁছে প্রস্তাব দিল সে। রাজি হওয়ার কোন কারণ খুঁজে পেলাম নেই।

শিওজাকির বাড়ির ভেতরে গাড়ি চালিয়ে ঢুকে পড়লো সে। শিওজাকির কানে গাড়ির শব্দ যাচ্ছে কিনা সেটা নিয়ে মাথাব্যথার কোন দরকার নেই এবারে, তবুও বাড়িটার যতই কাছে গেলাম, ভয়ভয় করতে লাগলো ভেতরে।

শিওজাকির গাড়িটা সামনেই পার্ক করা। ওটার পাশে গাড়ি থামালো সুমিদা।

প্যাসেঞ্জার সিট থেকে বের হয়ে বাড়িটার দিকে তাকালাম। খুব একটা লম্বা না, এরকম নকশার বাড়ি আমাদের শহরে বেশ কয়েকটা দেখেছি আগে। তবে বাড়িটাকে ঘিরে রাখা পাতাবিহীন গাছগুলো অবশ্য নেই সেখানে।

বাড়িটার অবস্থান এমন জায়গায় যে সামনের দিকটায় বেশিরভাগ সময়েই ছায়ায় ঢাকা থাকে। নীল দেয়ালগুলো অনেকটাই কালো মনে হয় তাই দূর থেকে। বাইরেই যদি এরকম অন্ধকার হয়, না জানি ভেতরে কি অপেক্ষা করছে।

হিতোমি আইজাওয়া এই বাড়ির তলকুঠুরিতে বন্দী, সেখানে নিশ্চয়ই আরো বেশি অন্ধকার। কথাটা ভাবার সাথে সাথে কেঁপে উঠলো আমার শরীর।

“খুব বেশি সময় তো লাগবে না তোমার?” গাড়ি থেকে বের না হয়েই বললল সুমিদা। গাড়ির ভেতরকার আরামদায়ক উষ্ণতা ছেড়ে বের হবার ইচ্ছে নেই তার, বোঝাই যাচ্ছে।

কিন্তু সে আমার সাথে থাকলে আরো সাহস পাবো। তাই বললাম, “আমার সাথে আসুন।”

অন্য দিকে তাকিয়ে কথা না শোনার ভান করলো সুমিদা।

অগত্যা কোটটা দুহাতে চেপে ধরে একাই গেলাম আমি। গাড়িতে আসার পথে কোটটার পকেটগুলো হাতড়ে দেখেছি, কিছু নেই ভেতরে।

দুরুদুরু বুকে দরজাটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কালো কাঠের দরজায় সোনালি রঙের নব শোভা পাচ্ছে।

কড়া নাড়ার কিছুক্ষণ পর শিওজাকির পদশব্দ শোনা গেল ভেতর থেকে। দরজা খুলে পাতলা ফ্রেমের চশমার ওপাশ থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো সে।

কথা জড়িয়ে গেল আমার। তবুও কোনমতে বুঝিয়ে বললাম যে কেন এসেছি।

“ধন্যবাদ,” বলে পেছনে দাঁড়ানো গাড়িটার দিকে তাকালো সে। “ওটা সুমিদার গাড়ি না? সেও এসেছে তাহলে।”

কেউ সাথে থাকার জন্যে এর আগে কখনো এতটা স্বস্তিবোধ করিনি। হারামিটা এখন আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।

“এতদূর যখন এসেছোই, কফি খেয়ে যাও?”

মাথা নেড়ে সায় জানালাম তার প্রস্তাবে। গাড়ির কাছে ফিরে সুমিদাকে বললাম শিওজাকির কফি খাওয়ানোর কথা। ঘুম ঘুম চোখে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো সে।

ভেতরে গেলাম আমরা। পশ্চিমা নকশা অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে। বাড়িটা, আমাদের জুতোও খুলতে বললো না শিওজাকি।

দেয়াল এবং মেঝেতে খুব বেশি কারুকাজ নেই। সিলিং থেকে কোন ঝারবাতিও ঝুলতে দেখলাম না। বরং ভেতরটা একটা উপাসনালয় বা পুরনো আমলের স্কুলের মতনই সাদামাটা।

আমাকে আর সুমিদাকে লিভিংরুমে নিয়ে গেল শিওজাকি। ঘরের মাঝখানে একটা সোফা আর কফি টেবিল। পাশেই ছোট একটা বুক শেলফ। দেশি বিদেশি দামী দামী সব বই সাজিয়ে রাখা সেখানে।

পেছনের দেয়ালে কালো ফ্রেমে একটা ছবি ঝোলানো। সেটার ব্যাপারে শিওজাকিকে জিজ্ঞেস করায় বললো যে সে নিজেই এঁকেছে ছবিটা। এক বৃদ্ধ মহিলাকে আপেল ভর্তি ঝুড়ি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে সেখানে।

আমাদের জন্যে কফি নিয়ে এলো শিওজাকি।

রুমের আশপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম কাজুয়া কখনো এসেছে কিনা। তবে কোন দৃশ্যই আমার বাঁ চোখে কোন প্রকার উত্তাপের উদ্রেক ঘটালো না।

“এগুলো সবই অ্যান্টিক,” সোফায় হাত বুলিয়ে বললো সুমিদা। বসলে শরীর একদম দেবে যায় সোফাটায়। “আমি যে রুমটায় থাকি, সেখানে এরকম একটা কাউচ বোধহয় ঢোকানোও যাবে না।”

“এখানকার আসবাবের বেশিরভাগই আগের ভাড়াটিয়ার ফেলে যাওয়া।”

“সে কি এগুলো আগের ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে পেয়েছিল?” জিজ্ঞেস করলাম।

“বলতে পারবো না, তার সাথে দেখা হয়নি আমার,” মাথা কাত করে বললো শিওজাকি।

ছয় মাস আগে বাড়িটায় উঠেছে শিওজাকি। হিতোমি উধাও হয়েছে এক বছর আগে। তাকে কি এখানেই নিয়ে এসেছিল সে? হিসেব তো মিলছে না।

সুমিদা আর শিওজাকি কথা বলছে কি যেন একটা বিষয়ে। উঠে দাঁড়িয়ে বললাম যে বাথরুমে যাব আমি। শিওজাকি বলে দিল কোথায় সেটা।

এরকম একটা বাড়িতে নির্দেশনা ভুলে যাওয়াটা নিশ্চয়ই সন্দেহের চোখে দেখবে না কেউ। ভুল করে অন্য একটা ঘরের দরজা খুলে ফেলতেই পারি।

হলওয়ে ধরে সামনে এগিয়ে অন্য ঘরগুলোর দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দেয়া শুরু করলাম। লিভিং রুম থেকে আমাকে দেখতে পাচ্ছে না সুমিদা বা শিওজাকি। ঘরগুলো ভালোমতো খুঁজে দেখতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু ধরা পড়ে যাবার ভয়ে সেটা করতে পারছি না। একবার উঁকি দিয়েই দরজা ভিড়িয়ে দিচ্ছি। কয়েকটা ঘরে কোন আসবাব নেই। দেখে মনে হলো ছবি আকার স্টুডিও।

হিতামি এই বাড়িতেই কোথাও আছে, এই কথাটা মাথায় আসার সাথে সাথে হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে গেল। ঠিকমতন নিঃশ্বাসও নিতে পারছি না। তার এত কাছে এসেও বাঁচাতে পারছি না! এটা কোন কথা!

বাড়ির মাঝ বরাবর একটা সিঁড়ি। দোতলার হলওয়ের রেলিংটা দেখা যাচ্ছে নিচ থেকে। ওখানে কি আছে? উপরে গিয়ে যে দেখবো, সেই সাহস নেই। ধরা পড়ে গেলে নিশ্চিত সন্দেহ করবে শিওজাকি।

অন্য একটা ঘরের দরজা খুললাম আমি। খুব বেশি সময় নেই হাতে। আমাকে ফিরে যেতে হবে দ্রুত।

পেয়ে গেছি! মেয়েদের কাপড় ঝুলছে ভেতরে। একটা সবুজ ব্লাউজ আর কালো রঙের স্কার্ট। কার জিনিস এগুলো?

নিজেকেই প্রশ্নটা করেছি, এমন সময় পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেলাম। ঘুরে দাঁড়ালাম ভয়ে ভয়ে। শিওজাকি।

“আমার স্ত্রীর কাপড়গুলো এই ঘরটায় রেখে দিয়েছি।”

তার স্ত্রী মারা গেলেও কাপড়গুলো কাউকে দিয়ে দেয়ার কথা নাকি মাথায় আসেনি শিওজাকির।

“দুঃখিত… পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম, কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললাম। তার চোখের দিকেও তাকাতে পারছি না।

“নামি,” সুমিদা ডাক দিল। “চলো, যাওয়া যাক।

আমাদের পার্কিং লট অবধি এগিয়ে দিল শিওজাকি। নীল বাড়িটা থেকে বের হয়ে ঢালু রাস্তা ধরে নিচে নামতে শুরু করলো গাড়িটা।

“ওহ, ফিসফিসিয়ে বললাম আমি। “সে তো বলেছিল একটা ভাঙা দেয়াল ঠিক করবে। সেজন্যে জিনিসপত্রও কিনেছিল, কিন্তু…”

আমাকে তো এটাই বলেছিল শিওজাকি।

“ঠিক করবে? কি?” সামনের দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো সুমিদা।

তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে কিছুদিন আগে ভূমিকম্প হয়েছিল কিনা।

“হ্যাঁ, ছোটখাটো ভূমিকম্প।”

তাহলে আমাকে মিথ্যে বলেছে শিওজাকি, জিনিসগুলো কেনার অন্য উদ্দেশ্যে ছিল তার।

.

রূপকথার গল্পকার

গাড়িটা চলে যেতে দেখলো মিকি। সামনের দরজা বন্ধ করে তালা দিয়ে দোতলার স্টাডিরুমে চলে এলো দ্রুত।

“কথার আওয়াজ পেলাম,” কাউচ থেকে হিতোমি বললো। “বাসার আশেপাশে কয়েকদিন ধরে যে ঘুরঘুর করছে, সে-ই এসেছিল নাকি?”

কাঁধ ঝাঁকালো মিকি।

“কি হয়েছে বলুন না।”

বলতে গিয়েও থেমে গেল মিকি, অনর্থক ঝামেলা বাড়িয়ে কাজ নেই।

“আমি কিন্তু চাইলে চিৎকার করতে পারতাম। তবুও চুপ ছিলাম, আপনাকে বাঁচানোর জন্যে করেছি এটা ভাববেন না। আমি যদি কিছু বলতাম তাহলে আরো একজন লোককে মেরে ফেলতেন আপনি, তাই না?”

কিছু বললো না মিকি।

“ওহ না, আপনি তো কাউকে একেবারে মেরে ফেলতে পারেন না,” বক্তব্য শুধরে নিল হিতেমি।

মিকি তাকে বললো ইচ্ছে করলে যে কাউকে হত্যা করতে পারে সে। কেবল মাথাটা কেটে ফেলতে হবে।

“কিন্তু কেউ যদি এরকম একটা লাশ খুঁজে পায়, তাহলে তো বিপদ হবে।”

সেক্ষেত্রে ঘটনা এমন ভাবে সাজাবে মিকি, যাতে গোটা ব্যাপারটাই দুর্ঘটনা মনে হয়।

ধরুন কাউকে মেরে ফেলতে হবে মিকির। তাকে পাহাড়ের ওপর থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে কিংবা টুকরো টুকরো করে কাটলেও মরবে না। মিকির ভিক্টিমরা তার হাতের স্পর্শ আছে এরকম কোন উপায়ে কখনোই মারা যায় না। শরীরের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিলেও লাভ হয় না।

কিন্তু মিকি চাইলে সেই লোকটাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে ফেলতে পারে বা বেশি মদ খাইয়ে মাতাল করে তুলতে পারে। এরপর একটা চলন্ত গাড়ির সামনে ধাক্কা দিয়ে দিলেই কেল্লা ফতে। তখন মিকি না, গাড়ি চালকের কারণে মারা যাবে নোকটা। অনেকে আত্মহত্যাও ভাবতে পারে গোটা ব্যাপারটাকে।

“আপনি কি এই ব্যাপারে নিশ্চিত? আগে কখনো চেষ্টা করে দেখেছেন?”

মিকি জবাব দিল না। মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ বলে ধরে নিল হিতেমি।

নিচতলার কথোপকথনের কথা ভাবলো মিকি। যে আগন্তুকের অপেক্ষায় ছিল, আজকে বাসায় কি সে-ই এসেছিল? একদমই সাধারণ কথা বার্তা হয়েছে আমাদের… কিছু কি সন্দেহ করেছে।

যদি পরিস্থিতি খারাপের দিকে গড়ায়, তাহলে এই বাসাটা ছেড়ে দিতে হবে আমাকে।

[তবে তার আগে আগন্তুকের মুখটা চিরতরে বন্ধ করে দিতে পারে। ঠিকভাবে কাজটা করলে জায়গা বদলানোর প্রয়োজন হবে না।]

.

বাড়ি ফিরতে হবে আমাকে। বাবা বারবার বলছে ডাক্তারের কাছে যাবার কথা। আর দেরি করাটা উচিৎ হবে না।

সত্যি বলতে, আমার ঐখানে যাওয়ার তেমন একটা ইচ্ছে নেই। হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পর থেকে নিজের বাসায় কাটানো সময়ের খুব বেশি স্মৃতি নেই আমার মাথায়। যেগুলো আছে, সেগুলোও খুব সুখকর নয়। বরং কাজুয়ার স্মৃতিগুলো ভাবতেই বেশি ভালো লাগে। কায়েদি, সাওরি, মেলানকলি গ্রোভ।

সাওরিকে যখন বললাম যে বাড়ি ফিরে যাচ্ছি, মাথা নাড়লো সে। চেহারায় মন খারাপের ভাব স্পষ্ট।

“ঠিক কাজটাই করছে। তোমার বাবা-মা নিশ্চয়ই অপেক্ষা করে আছেন।”

“আমি কি ফিরে আসতে পারি?”

“কবে আসবে?”

“চারদিন পর।

একটু অবাক হলো সে আমার উত্তরে। “পরিবারের সাথে সময় কাটাতে একদমই ভালো লাগে না তোমার?”

যত দ্রুত সম্ভব কায়েদিতে ফিরে আসতে চাই আমি। এখনও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা তো করাই হয়নি। হিতোমিকে উদ্ধার করতে হবে। শিওজাকির বিরুদ্ধে প্রমাণ জড়ো করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি এখনও।

‘নামি… সাওরি বললো গম্ভীর কণ্ঠে। “তোমার পরিবারের ব্যাপারে কখনো কিছু বলোনি আমাকে। জানি আমার নাক গলানোটা ঠিক না এই ব্যাপারে, তবে তাদের সাথে তোমার সম্পর্কটা আসলে ঠিক কি কারণে এমন, সেটা নিয়ে ভেবেছি গত কয়েকদিনে। এভাবে হুট করে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসা মোটেও ভালো কোন কাজ নয়।”

“তুমি কি চাও না যে আমি ফিরে আসি?” ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

“অবশ্যই চাই। কিন্তু এটাও চাই যে তুমি তোমার বাবা-মা’র সাথে বসে ভালো করে একবার কথা বলো। এরপর যখন ইচ্ছে এসে পড়ো।”

সুমিদা ট্রেন স্টেশন অবধি পৌঁছে দিচ্ছে আমাকে। কায়েদিতে আসার প্রথম দিনের মতনই, জানালা দিয়ে ছোট্ট পাহাড়ি শহরটা দেখতে লাগলাম। সিডার গাছের সারি, বৈদ্যুতিক খুঁটি, ছোট ছোটব্রিজ, দূর পাহাড়ের উপত্যকা-সব পেছনে ফেলে এগোচ্ছি। কিছুক্ষণ পর স্টেশনের কাছাকাছি চলে এলাম। কাছেই একটা ইউনিভার্সিটি, হাসপাতাল আর কয়েকটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান।

“নামি, তুমি তো ফিরে আসবে?” স্টেশনের সামনে গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো সুমিদা। “আমাকে একটা ফোন দিয়ো। গাড়ি নিয়ে চলে আসবো স্টেশনে। তুমি চলে যাওয়াতে সাওরি আবার একা হয়ে পড়বে। ক্যাফেতে তোমার উপস্থিতি সবকিছু স্বাভাবিক করে দিয়েছিল। কাজুয়া থাকার সময় এরকম লাগতো, জানো?।”

“সবকিছু স্বাভাবিক করে দিয়েছিল? এভাবে কেউ কথা বলে? আপনি যে মাঝে মাঝে কিসব বলেন…।”

“মানে ঐ তো আর কি… কাজুয়ার অভাব অনেকটাই পূরণ করে দিয়েছিলে তুমি।”

তাকে সাওরির ভাইয়ের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করাতে বললো, মারা যাবার এক বছর আগে বন্ধুত্ব হয়েছিল দু’জনের।

দুর্ঘটনার ঠিক এক বছর আগে, মাতাল কাজুয়াকে ক্যাফেতে নিয়ে এসেছিলাম আমি। হুশ একদমই ছিল না বেচারার।”

“শুনেছি গল্পটা। সেদিনই তো সাওরির সাথে প্রথম দেখা হয় আপনার।”

“হ্যাঁ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, স্বাভাবিক হবার পরে আমাকে আর চিনতে পারে না কাজুয়া,” হেসে বলে সুমিদা। এরপর বেশ কয়েকবার একসাথে ড্রিঙ্ক করেছি, সিনেমা দেখতে গেছি-এসব আর কি।

একদিন নাকি দুজন মিলে হাঁটতে হাঁটতে দূরের একটা সবুজ পাহাড়ি অঞ্চলে চলে গিয়েছিল। সেদিন ক্লাস ফাঁকি দেয় সুমিদা আর কাজুয়া ততদিনে ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সেখানে গিয়ে সবুজ ঘাসের ওপর শুয়ে ছিল তারা।

“দুই আহাম্মক আমরা,” সুমিদা বললো। “আসল কাজ না করে সারাদিন টোটো করতাম।”

“আমার তো মনে হচ্ছে দু’জনে ভালোই সময় কাটাতেন।”

কাজুয়ার সাথে সুমিদার সময় কাটানোর গল্পটা ভালো লাগলো আমার। গ্রীষ্মের দিনগুলোতে এভাবে উদ্দেশ্যহীনের মত সময় কাটাতে ভালই লাগবে।

“ওকে আপন করে নেয়ার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ,” বললাম।

গাড়ি থেকে নেমে সুমিদাকে বিদায় জানিয়ে স্টেশনে ঢুকে পড়লাম।

কালো রঙের চাবির রিংটা এখনও ঝুলছে গাড়ির ভেতরে। ওটার সাথে লাগানো কালো পাখিটা ক্যাফের সেই বইটার কথা মনে করিয়ে দিল আমাকে। একটা কাক মানুষের চোখ উপড়ে নিচ্ছে! ছবিগুলো ভীষণ অস্বস্তি দায়ক। ঠিক করলাম পরেরবার ফিরে এসে বইটা পড়বো।

*

বুলেট ট্রেনে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগলো।

বাসার কাছের স্টেশনটায় যখন পৌঁছালাম, সন্ধ্যা নেমে গেছে। লোকজনের ভিড় ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এলাম। পশ্চিমের আকাশে এখনও লালচে আভা। গোধূলির আলোয় স্টেশনের পাশের দোকানগুলো দেখে মনে হচ্ছে আকাশ থেকে রংধনু নেমে এসেছে।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাসার দিকে হেঁটে যাচ্ছি। সাওরি তো তখন বললো কথাটা, কিন্তু আসলেও বাবা-মা’র সামনে কিছু বলতে পারবো কিনা কে জানে। কয়েকবার মনে হলো ঘুরে স্টেশনের দিকে রওনা দেই।

কিন্তু বাবাকে ইতোমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছি ফেরার কথা।

শিরাকি-নামফলকের বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। পরিচিত দৃশ্যটাও অপরিচিত ঠেকছে এখন। কলিংবেলে চাপ দিতে মা দরজা খুলে দিল। আমাকে দেখে মুখ থেকে হাসিটা মুছে গেল তার। কি বলবে বুঝতে পারছে না যেন।

“এসেছি আমি,” কিছুক্ষণ পর বললাম।

অন্য দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো মা।

কি করবো জানি না। কি বলবো জানি না। কান্না চেপে মা’র পেছন পেছন গেলাম

মাকে আমি ঘৃণা করি না, কিন্তু সে আমাকে ঘৃণা করে। কিছু একটা বলা উচিৎ আমার। তবুও ভয় ভয় লাগছে। কি এমন বলবো? পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে ভাবতে লাগলাম-আমি যদি কথা বলি, সে কি না শোনার ভান করবে?

“এসেছো তাহলে,” বাবা লিভিং রুম থেকে বললো।

“ওভাবে হুট করে চলে গিয়েছিলাম দেখে দুঃখিত।

মিশ্র একটা অনুভূতি খেলা করছে বাবার চেহারায়, কিন্তু পুরনো কথা ভুলে যেতে বললো সে।

তিনজন মিলে রাতের খাবার সারতে বসলাম। প্রথম দিকে আমি আর মা দুজনই চুপ থাকলাম।

পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক করার জন্যে বাবা মাঝে মাঝে এটা সেটা বলছে। হা-হুঁ করে জবাব দিচ্ছি আমি। বেচারার জন্যে খারাপই লাগছে আমার।

“কোথায় ছিলে এতদিন?” জিজ্ঞেস করলো বাবা। কায়েদির কথা– ফোনে জানাইনি তাকে। শুধু বলেছি অন্য একটা শহরে আছি।

“এক বন্ধুর বাড়িতে। পাহাড়ি এলাকায়।”

সাওরি, মেলানকলি গ্রোভ, কিমুরা আর সুমিদার ব্যাপারে সবকিছু খুলে বললাম তাদের। বললাম যে কিভাবে সাওরির সাথে কার্ড খেলেছি, সুমিদা একটু উল্টোপাল্টা কিছু বললেই কিমুরা গাট্টি বসায় তার মাথায়। কথাগুলো বলার সময় মুখে আপনা থেকেই একটা হাসি ভর করলো। এই মানুষগুলোকে নিয়ে চাইলে সারাদিন কথা বলতে পারবো।

কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম হাতে গাল দিয়ে একমনে আমার কথা শুনে যাচ্ছে বাবা।

“অনেকদিন পর এভাবে কথা বলতে শুনছি তোমাকে। পুরনো হাসিটা আবার ফিরে এসেছে।”

কিন্তু মা যে এসব কথা শুনে বিরক্ত সেটা তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। উঠে দাঁড়িয়ে এঁটো বাসনগুলো পরিষ্কার করতে শুরু করলো সে।

সেদিন রাতে নিচ থেকে বাবা-মা’র কথা কাটাকাটির আওয়াজ শুনতে পেয়ে নেমে এলাম চুপিচুপি। আমাকে নিয়ে ঝগড়া করছে দু’জন। নামি আর ঐ মেয়েটা এই দুটো শব্দ শুনলাম বেশ কয়েকবার।

সিঁড়িতে বসে তাদের কথা শুনলাম অনেকক্ষণ। তবে ঝগড়ার বিষয়বস্তু কি সেটা বোঝার আগেই তর্ক থামিয়ে দিল তারা। বাতি নিভিয়ে দেয়ায় গোটা নিচতলায় এখন ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। সেই অন্ধকারের সঙ্গী হয়েছে নৈঃশব্দ্য।

সিঁড়িটা ঠান্ডা, তবুও বসে রইলাম। একটা কথা মাথায় ঘুরছে-বাবা মা আছে আমার।

এর আগ পর্যন্ত আমি ভাবতাম এই বাড়িতে যারা থাকে তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। হয়তো স্মৃতি হারিয়ে ফেলায় এমনটা মনে হয়েছিল। সাওরি যখন বললো বাবা-মার সাথে ভালো করে কথা বলতে, তখন মনে হয়েছিল বাবা-মা থাকাটা আসলেও জরুরি কিনা।

কিন্তু তারা দুজন আমাকে নিয়ে ঝগড়া করছে। আমার ব্যাপারে দু’জনেরই আলাদা আলাদা মতামত আছে। সেটা ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক তা বুঝতে পারিনি। তারা যে আমাকে নিয়ে চিন্তিত, সেটা আগেও বুঝতে পারতাম। কিন্তু সেই উপলব্ধিটা আমার মধ্যে কোন ভাবনার উদ্রেক করেনি। সব স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছি, তবুও আমিই তারই সন্তান। এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।

*

ডাক্তার সাহেব বললেন যে স্মৃতি একটা রহস্যময় ব্যাপার।

সেই হাসপাতালটায় এসেছি আবার ফলোআপের জন্যে। নস্টালজিক ভঙ্গিতে মাঝবয়সী ডাক্তারের সামনে বসে আছি এখন।

বুড়ো আঙুল দিয়ে আমার চোখের নিচে টেনে ধরে পরীক্ষা করছেন তিনি। ওপরে নিচে, ডানে বামে তাকাতে বলছেন। আপাতত সব ঠিকই আছে মনে হচ্ছে।

আমাকে কিছু প্রশ্ন করলেন তিনি, যেমন-”চোখে ব্যথা আছে নাকি?”

মাথা ঝাঁকিয়ে না করে দিলাম।

“আগের কিছু মনে পড়েছে?”

“এখনও না।”

“আচ্ছা। যে কোন সময়ে একেবারে ফিরে আসতে পার, কিংবা ধীরে ধীরে মনে পড়বে সবকিছু।”

তার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। সত্যি বলতে স্মৃতি ফিরে আসার ব্যাপারে চিন্তা করা বন্ধ করে দিয়েছি আগেই।

“আমাদের মস্তিষ্ক খুবই জটিল একটা যন্ত্র,” বললেন তিনি। তার দেখা অন্য এক রোগীর ব্যাপারে গল্প করলেন আমার সাথে।

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছিল লোকটা। বিগত দশ বছরের সবকিছু মুছে যায় মস্তিষ্ক থেকে। সম্পূর্ণ নতুনভাবে জীবনযাপন শুরু করেছিল সে। দু’বছর পর একদিন হঠাৎ আস্তে আস্তে ফিরে আসতে শুরু করে স্মৃতিগুলো।

“মাঝে মাঝে একসাথে ফিরে আসে সব স্মৃতি। আবার কখনো নির্দিষ্ট বিরতিতে এক এক করে ফেরে। কেউ কেউ অবশ্য স্মৃতি একদমই ফিরে পায় না। এরকম নজিরও আছে। কিন্তু তোমার বয়স কম। অতীতের কথাগুলো মনে পড়তেও পারে।”

স্মৃতি ফিরে পাবার ব্যাপারে ভাবলাম। আবারো আগের নামি হয়ে যাবো আমি। কিন্তু সেটা তো চাই না?

পুরনো আমিকে ভিডিওটেইপে দেখেছি। আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে পিয়ানো বাজাচ্ছিল সে। কিবোর্ডের ওপর দিয়ে আঙুলগুলো উড়ে চলছিল যেন। নতুন আমি কি কখনো ওরকম কিছু করতে পারবে?

যদি স্মৃতি ফিরে পাই, তাহলে এখনকার আমির কি হবে? ডাক্তার সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম কথাটা।

“সেটা বলা মুশকিল।”

চেহারায় অস্বস্তি নিয়ে একবার গোঁফে হাত বুলালেন তিনি। স্মৃতি ফিরে পেলে আবারো আগের মতন হয় যাবো ঠিকই, কিন্তু এখনকার সবকিছু মনে থাকবে। এটা শোনার পর কিছুটা স্বস্তি পেলাম। আমি চাই না কাজুয়ার স্মৃতিগুলো মুছে যাক।

“আচ্ছা এমন কি হতে পারে যে, আমার দু’টো সত্তার দৃষ্টিভঙ্গি দু’রকম। মানে স্মৃতি ফিরে পাবার আগে পরের কথা বলছি।”

“এরকমটা হতে শুনেছি।”

অন্য একজন রোগীর ব্যাপারে আমাকে খুলে বললেন তিনি। স্মৃতি হারাবার আগে সবকিছু ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে লোকটা, কিন্তু স্মৃতি হারাবার পর একদম নেতিবাচক হয়ে যায় তার আচার-আচরণ। একসময় যখন স্মৃতি ফিরে আসে, আবারো আগের মত ব্যবহার করা শুরু করে সে।

“অ্যামনেশিয়ার রোগীরা স্মৃতিবিহীন অবস্থায় যে সময়টুকু কাটায়, তাদের পুরো জীবনের সময়কাল তুলনায় সেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুব অল্প। স্মৃতি ফিরে এলে মধ্যবর্তী সময়টুকু মনে হয়ে একটা লম্বা স্বপ্ন।”

হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার গোটা পথে এই কথাটা নিয়েই ভাবলাম কেবল।

স্মৃতি ফিরে এলে আমার কি হবে? সবাই আগের মতন পছন্দ করতে শুরু করবে আমাকে, আগের মতন পড়াশোনা আর খেলাধুলায় ভালো করবো। কিন্তু এই আপদগ্রস্ত আমার কি হবে তখন?

আগের নামি কি কখনো রাস্তা দিয়ে মাথা নিচু করে হেঁটে যাবার সময় একাকীত্ব অনুভব করতো? কখনো কি বীতস্পৃহ দৃষ্টিতে তাকাতো আয়নায় নিজের দিকে? যাদের সবাই ভালোবাসে, তাদের প্রতি কি ঈর্ষা কাজ করতো তার মনে?”

ঐ নামির আছে সতেরো বছরের ইতিহাস। কিন্তু আমার স্মৃতিগুলোর বয়স মাত্র দুই মাস। স্মৃতি ফিরে এলে, এই কথাগুলো যে ভাবছে, তাকে কি বড় ঠুনকো চরিত্রের কেউ মনে হবে? গোটা সময়টাই একটা স্বপ্ন

অপারেশনের পরে অনেকটা সময় কোন স্বপ্ন দেখিনি। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে ঘুমিয়ে পড়লে সাওরি আর কায়েদি শহরের অন্যদের দেখি স্বপ্নে। একটা স্বপ্নে নীল রঙের একটা গাড়ির সাথে জোরে ধাক্কা লাগে আমার চোখ খোলার পরেও মনে হয় পাহাড়ি ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছি। অভিজ্ঞতাটা একদম বাস্তব। পরের কয়েকটা দিন রাস্তা দিয়ে চলার সময় কেবলই মনে হয় যে এই বুঝি নীল গাড়িটা এসে ধাক্কা দিবে আমাকে।

কিন্তু বেশিরভাগ স্বপ্নই ঘুম ভেঙে জেগে ওঠার পর আর মনে থাকে না। স্মৃতি ফিরে পেলে কি এখনকার আমিকে একেবারে ভুলে যাবো?

আগের নামিকে অচেনা এক সত্তা মনে হয় এখন। তবে এটা যে ভ্রান্ত একটা ধারণা, তা-ও জানি।

*

ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে কাটাতে লাগলাম পরের কয়েকটা দিন। বাজে অভিজ্ঞতাগুলোই ঘুরে ফিরে আসছে মনে। চাইলেও মাথা থেকে বিদায় করতে পারছি না ওগুলো।

মার সাথে আমার সম্পর্কের আরো অবনতি হয়েছে। কেউই কারো সাথে কথা বলার চেষ্টা করি না। আসলে কি বলবো সেটা জানি না। আমি নিশ্চিত, মা’র ক্ষেত্রেও এই একই কথা প্রযোজ্য।

এ মুহূর্তে মা রাতের খাবার বানাচ্ছে। পেছনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি আমি। এই দৃশ্য আগেও অনেকবার দেখেছি নিশ্চয়ই, তবুও একদম নতুন মনে হচ্ছে।

মা খুব বেশি লম্বা না। ছিপছিপে, দোহারা গড়ন। চুল ধূসর হতে শুরু করেছে। ছুরি দিয়ে একমনে গাজর কেটে চলেছে সে। ছুরির নড়াচড়ার তালে কাঁধও নড়ছে।

তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ইচ্ছে করে চোখ ঘুরিয়ে নিল মা!

“মা, তুমি তো আমাকে অনেক ভালোবাসতে। আর সেই কারণেই এখন এত ঘৃণা করো। সেটাই স্বাভাবিক, এখন তো আর আগের মত কিছু করতে পারি না আমি, স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছি…”

জবাব দিল না সে। সমস্যা নেই, ভাবলাম।

“ডাক্তার সাহেব বলেছেন আমার স্মৃতি ফিরে পাবার ভালো সম্ভাবনা আছে। তিনি অবশ্য চোখের ডাক্তার, কিন্তু এমন অনেককেই চেনেন যাদের অ্যামনেশিয়া সেরে উঠেছে কয়েক বছর পর। আবারো আগের মতন হয়ে যাবো তখন।”

কিন্তু আমি চাই এখনকার নামিকে ভালোবাসো তুমি। এটা ঠিক যে আগের মত সবকিছুতে আর দক্ষ নই আমি। তবুও, এখনকার এই চিন্তাভঙ্গিটা কি এতই ফেলনা? স্মৃতি ফিরে পেলে হয়তো এসব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানোর কথা ভেবে হাসবো। কিন্তু এখনকার আমিকে নিয়ে আমি যথেষ্ট গর্বিত। প্রথম দিকে খুব খারাপ লাগতো, এখন আর লাগে না। আমি চাই তুমি বর্তমান নামিকেও মেনে নাও।

“কালকে আবারো বন্ধুর বাসায় যাবো আমি কয়েকদিনের জন্যে।”

বলে দৌড়ে ওপরতলায় আমার ঘরে চলে আসলাম।

পরদিন খুব ভোরে কাউকে কিছু বলে বেরিয়ে গেলাম বাসা থেকে।

*

স্টেশন থেকে ফোন দিলাম সুমিদাকে।

“তাড়াতাড়িই ফিরলে দেখছি,” আমি গাড়িতে ওঠার পর বললো সে।

“এখানে কিছু কাজ এখনও বাকি আছে। সাওরির কি খবর?”

“ইদানিং বড় চুপচাপ হয়ে গেছে ও,” বললো সুমিদা। গাড়ি চালানোর ফাঁকে ফাঁকে কাজুয়ার ব্যাপারে আমার সাথে গল্প করলো সে। কাজুয়া সম্পর্কে নতুন যে কোন তথ্য লুফে নেই আমি। সুমিদা এখন যে অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংটায় থাকে, সেটার সামনে থামলাম আমরা। ডিভিআরের রেকর্ডিং চালু করে আসতে ভুলে গেছে সে। বিল্ডিংটার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করায় সে বললো গত এক বছর ধরে এখানে থাকছে। আগে অনেক দূরে থাকত বিধায় ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করতে অসুবিধে হতো। তাই চলে এসেছে এই নতুন অ্যাপার্টমেন্টে।

গাড়িতে বসেই সুমিদার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম আমি। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে ইঞ্জিন চালু করে রিয়ারভিউ মিররে অ্যাপার্টমেন্টটা দেখে সে বললো, “কাজুয়া প্রায়ই আসততা এখানে।”

“তাই নাকি? রাতে থাকতো?”

“সাওরি যখন বাসা থেকে বের দিয়েছিল ওকে, তখন কয়েকদিন ছিল,” হেসে বললো সুমিদা।

“কি কারণে বের করে দিয়েছিল সেটা শুনতে ভালোই লাগবে আমার, খুব বেশি আগ্রহ না দেখিয়ে বললাম। ভেতরে ভেতরে কৌতূহলে ফেটে পড়ছি।

একবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সুমিদা। ইঞ্জিন চালু না করে কাজুয়ার ব্যাপারে কথা বলতে শুরু করলো সে।

মিডল স্কুলে থাকার সময় খুব একটা খারাপ ছাত্র ছিল না কাজুয়া। কিন্তু হাইস্কুলে ওঠার পর রেজাল্ট খারাপ হতে থাকে। সেসময় অবশ্য সুমিদা চিনতো না তাকে; এসবই কাজুয়ার কাছে শুনেছে।

কোনমতে হাইস্কুল থেকে পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় কাজুয়া। সুমিদা যেখানে পড়ে সেখানে না, অন্য একটা প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু পড়াশোনার প্রতি মন উঠে যায় তার।

“ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। সারাদিন বাসায় বসে থাকতো।”

জীবনের প্রতি কোন দায়বদ্ধতা অনুভব করতে না কাজুয়া। ক্লাস বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর থেকে সময় যেন একদম থেমে যায় তার। বন্ধুদের সাথে দেখা সাক্ষাতও বন্ধ করে দেয়। সুমিদার সাথে যখন পরিচয় হয় তার, সবাই যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। একা একা কায়েদিতে ঘুরে বেড়াতো কাজুয়া। কখনো পাহাড়ে চড়তো, কখনো পার্কে গিয়ে বসে থাকতো, কখনো পুরনো স্কুলে গিয়ে টিচারদের সাথে কথা বলতো।

“সন্ন্যাসী বনে গেছিল রীতিমত,” সুমিদার কণ্ঠের আবেগটুকু বুঝতে অসুবিধে হলো না আমার।

সাওরি কাজুয়ার এরকম ছন্নছাড়া জীবনের প্রতি বিরক্ত হয়ে উঠলে সুমিদার অ্যাপার্টমেন্টে এসে পড়েসে।

গাড়িতে করে কায়েদি ফিরে যাবার পথে কেবল কাজুয়াকে নিয়েই ভাবলাম। সুমিদা অবশ্য কথা বলার চেষ্টা করলো কয়েকবার, কিন্তু আমার প্রাণহীন উত্তরে দমে গেল কিছুক্ষণ পর। আমাকে আর বিরক্ত করলো না।

কায়েদির এক অলস গ্রীষ্মের দিনে একা একা হেঁটে বেড়াচ্ছে কাজুয়া-এই দৃশ্যটা কল্পনা করার চেষ্টা করলাম। লম্বা ঘাসের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় হাত বাড়িয়ে সবুজটুকু মুঠোবন্দি করার চেষ্টা করছে। একটা পাখি কাজুরার পায়ের শব্দ পেয়ে উড়ে গেলে সেটার দিকে একমনে তাকিয়ে থাকলো সে কিছুক্ষণ। হাঁটার সময় শুকনো বাতাস মুখে এসে লাগলে সেই অনুভূতিটাও উপভোগ করছে। নিজে নিজেই কথা বলছে হয়তো।

সাইড ভিউ মিররে আমার বাম চোখটা দেখতে পাচ্ছি।

কাজুয়াকে ভালোবাসি আমি। এতদিন চেষ্টা করছিলাম তার প্রতি আমার অনুভূতিটা ঠিক কি ধরনের সেটা নিয়ে না ভাবার। খুব কাছের কারো প্রতি সাধারণত এরকম স্নেহ কাজ করে মানুষের। এর থেকে বেশি কিছু হলে আমি নিজেই কষ্ট পাবো। মারা গেছে কাজুয়।

তার প্রতি শুধু এই অনুভূতিটুকুই যে কাজ করে, তা নয়। বরং নিজেকে মাঝে মাঝে কাজুয়া ভাবি আমি। মনে হয় যেন তার আত্মা ভর করেছে আমার শরীরে। এরকমটা মনে হওয়ার কারণ যে তার স্মৃতিগুলো, এটা জানি। কিন্তু আমার আসল পরিচয় কি, এটা যখন নিজেকে জিজ্ঞেস করি, কোন যুক্তিযুক্ত উত্তর খুঁজে পাই না।

কে আমি? নামির কোন স্মৃতি নেই আমার মধ্যে। কিন্তু কাজুয়ার স্মৃতিগুলোর কারণে নিজেকে তো আর কাজুয়া দাবি করতে পারি না। এই যে তার হয়ে প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে কায়েদিতে ফিরে এসেছি, এটা কি আসলেও ঠিক হচ্ছে? নাকি প্রকৃতি ইচ্ছেকৃতভাবে এরকম একটা পরিস্থিতিতে ফেলেছে আমাকে, ভিন্ন কোন উদ্দেশ্যে?

কিছুক্ষণের মধ্যেই কায়েদিতে ঢুকে পড়লাম আমরা। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। পুরোটা দিন রাস্তাতেই কাটলো আজকে।

মেলানকলি গ্রোভ দেখতে পেলাম আবারো। ভেতরে নিশ্চয়ই বিশালদেহী কিমুরা আর বিমর্ষ সাওরি পথ চেয়ে আছে কাস্টমারের অপেক্ষায়।

“এসে পড়েছে!” আমাকে দেখে হেসে বললো সাওরি।

মনে হল যেন কেঁদেই ফেলবো। আমার স্মৃতি ফিরে এলেও এই মুহূর্তটা কখনো ভুলতে চাই না।

“নামি, বাবা-মা’র সাথে কথা বলেছে তো?” সাওরি জিজ্ঞেস করলো। “হ্যাঁ, বলেছি খানিকটা,” অস্পষ্টভাবে বললাম।

“স্কুল শুরু হয়ে যাবে না? এখন এখানে থাকলে অসুবিধে হবে না তো কোন?”

“একটু অসুবিধে হতে পারে। তবে সেটা নিয়ে আপাতত ভাবছি না।”

“আসলে স্কুলে যাওয়ার কোন ইচ্ছেই নেই তোমার, কাউন্টারের ওপর গালে হাত রেখে বললো সে।

কিছু না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম।

“আমার কাছ থেকে কিছু লুকোতে পারো না তুমি!” এবারে হেসে উঠলো সাওরি। সাথে সাথে মন খারাপ ভাবটা দূর হয়ে গেল আমার।

তার সাথে কথা বলার প্রতিটা মুহূর্তে কেবল মনে হতে লাগলো যে এই স্মৃতিগুলো একসময় ভুলে যাবো। পুরনো নামি কি এই কথাগুলো চিন্তা করে মনে মনে খুশি হয়ে উঠবে কখনোর।

না, স্মৃতিগুলো কখনো ভুলবো না আমি। আগের স্মৃতি আদৌ ফিরে আসবে কিনা জানি না, কিন্তু সাওরি বা কায়েদির কাউকে কখনো ভুলবো না। তবে তাদের প্রতি আমার অনুভূতিগুলো বদলে যেতে পারে। সেটাই আমার সবচেয়ে বড় ভয়।

মিঃ ইশিনোর বাড়িতে ফিরে রাতের খাবার শেষ করে সাওরিকে বললাম যে অনেকদিন ধরেই স্কুলে যাই না আমি। মার সাথেও সম্পর্কটা ভালো যাচ্ছে না। তবে এসবের কারণটা কি, তা চেপে গেলাম।

“সময়ের সাথে ঠিক হয়ে যাবে সবকিছু,” আমাকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললো সাওরি। “সময় সবকিছু ভুলিয়ে দেয়, কথাটা শোনোনি?”

“হয়তো আমার কথাই ভুলে গেছে সময়।”

আমি যে অ্যামনেশিয়ায় ভুগছি, এটা সাওরিকে বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সেটা সম্ভব না। তখন সে বুঝতে পারবে যে কাজুয়ার সাথে বন্ধুত্বের ব্যাপারে আমি যা বলেছি, তার পুরোটাই মিথ্যে।

একদিন সবকিছু খুলে বলবো তাকে। এখানে আসার সত্যিকার কারণটাও বলবো।

*

সেই রাতে দাঁত ব্রাশ করার সময় সামনের দরজা খোলার শব্দ কানে এলো আমার। কুলি করে মুখ মুছে দ্রুত নেমে এলাম নিচে। মিঃ ইশিনোর পুরনো জুতোটা নেই দরজার পাশে। ঝাপসা কাঁচের দরজার অন্যপাশে তার অবয়বটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে অবশ্য।

কোনকিছু না ভেবেই শুভরাত্রি বলার জন্যে দরজা খুললাম।

সিঁড়ির ওপরে বসে আছেন তিনি। কাঁধ দুটো ঝুঁকে আছে। কাজুয়ার বাম চোখে তাকে যেরকম দেখেছিলাম, তার চাইতে একদমই ভিন্নরকম লাগছে এখন। মনে হচ্ছে যেন বাঁচার ইচ্ছেটা হারিয়ে ফেলেছেন।

দরজা খোলার শব্দে পেছনে তাকিয়ে আমাকে দেখে একটা দুর্বল হাসি ফুটলো তার মুখে। “হ্যালো,” আলতো মাথা নেড়ে বললেন।

“ঘুমোতে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম আপনি কি করছেন দেখে যাই,” বললাম।

জবাবে কি বলবেন সেটা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলেন মিঃ ইশিনো। “আমার স্ত্রীর কথা ভাবছিলাম, কিছুক্ষণ পর বললেন ক্ষীণ কণ্ঠে।

গেটের সামনের দিকটায় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তিনি। ওখানটাতেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন মিসেস ইশিনো।

“সরি, আপনাকে বিরক্ত করাটা উচিৎ হয়নি আমার…”

মনে হচ্ছে যেন কেঁদে ফেলবো।

“সমস্যা নেই। ওর কথা সবসময়ই ভাবি আমি।”

বাইরে বেশ ঠান্ডা। রাতের অন্ধকার দিনের উত্তাপটুকু শুষে নিয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে এখনো আরো বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার ইচ্ছে তার। হয়তো অবচেতন মনে নিজেকে এভাবেই শাস্তি দিচ্ছে সে। স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার কারণে এখনও অনুতাপ কাজ করে তার ভেতরে।

এটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমার নাক গলানোর কোন অধিকার নেই।

তবুও সরে যেতে পারলাম না দরজা থেকে। তার পিঠের দিকে তাকিয়ে বললাম, “আপনার স্ত্রীর সম্পর্কে আমাকে অনেক কিছু বলেছে কাজুয়া।”

আসলে তাকে বাম চোখে দেখেছি আমি।

এক রাতে মিঃ ইশিনো মাতাল হয়ে লিভিং রুমেই ঘুমিয়ে পড়েন। তার স্ত্রী পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন চেহারায় উদ্বিগ্ন ভাব নিয়ে। কিছুক্ষণ পর একটা কম্বল নিয়ে এসে তার গায়ে চাপিয়ে দেন।

একদমই সাধারণ একটা দৃশ্য।

কিন্তু তার চেহারায় স্বামীর জন্যে যে অনুভূতিটা খেলা করছিল, তা মোটেও সাধারণ কিছু ছিল না।

মিঃ ইশিনোকে সেটাই বললাম।

“আমি নিশ্চিত আপনার ওপর কোন ক্ষোভ ছিল না তার, কাজুয়া এমনটাই বলেছিল।”

চুপ রইলেন মিঃ ইশিনো।

ভেতরে যাওয়ার জন্যে ঘুরে দাঁড়ালাম।

“ধন্যবাদ,” আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন।

ঘরে এসে কম্বলের নিচে ঢুকে পড়লাম। তিনি আসলে জানতেন। জানতেন যে তার মৃত্যুর পর এরকম দশা হবে মিঃ ইশিনোর। তাই কখনো পাল্টা রাগ দেখাননি। এটাই হয়তো ভালোবাসা।

এটা কি কাকতালীয় যে মামীর সাথে এতটা সময় কাটানোর পরও এই স্মৃতিটাই মনে রেখেছে কাজুয়া। মনে হয় না। ওটা যে সাধারণ কোন মুহূর্ত ছিল না এটা কাজুয়া বুঝতে পেরেছিল।

*

আমি জানি হিতোমি ঐ নীল বাড়িটাতেই আছে। কিন্তু শিওজাকির বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ যোগাড় করতে না পারা অবধি কিছু করা সম্ভব নয়।

ক্যাফেতে তার সাথে কথা হয়েছে আমার। “কয়েকদিন আপনাকে দেখিনি এখানে। শুনেছিলাম বাড়ি ফিরে গেছেন।”

“হ্যাঁ,” জবাব দেই শান্ত কণ্ঠে। কিন্তু ভেতরে ভতরে তার মুন্ডুপাত করছিলাম।

তার কারণেই মারা গেছে কাজুয়া। প্রচণ্ড রাগ লাগে আমার। তা সত্ত্বেও নিজেকে সামলাই, যাতে উল্টোপাল্টা কিছু না করে ফেলি।

কথা না বাড়িয়ে নিজের পছন্দের টেবিলটার দিকে চলে যায় শিওজাকি। সে বসার পর কিছুটা শান্ত হই, আসলে তার প্রতি এখনও একটা ভয় কাজ করে আমার মনে।

মাঝে মাঝে সন্ধ্যা অবধি মেলানকলি গ্রোভেই থাকি। ক্যাফে বন্ধ হওয়া অবধি অপেক্ষা করি। এরপর সাওরির সাথে একসাথে গল্প করতে করতে বাড়ি ফিরি। তার মামার বাড়িতে যাওয়ার পথে একটা বনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় আমাকে। সাওরি বলে যে ছোট থেকেই এই পথে যাতায়ত আছে তার, কোন ভয় নেই। তবুও কেমন যেন অদ্ভুত একটা অনুভূতি কাজ করে ভূতুড়ে গাছগুলর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়।

আজকেও সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে ক্যাফে বন্ধ হওয়া পর্যন্ত থাকবে। তাই হাতে কিছুটা সময় আছে। বইয়ের শেলফে ‘চোখের স্মৃতি’ নামের রূপকথার বইটা চোখে পড়লো এসময়। ভেতরের ছবিগুলো খুবই অস্বস্তিকর। ওটাই তুলে নিলাম পড়ার জন্যে।

কাউন্টারে বসে পড়তে শুরু করলাম। রূপকথার বই হলেও ভেতরে এমন কিছু ছবি আছে যেগুলো বাচ্চাদের উপযোগী নয়। দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল বইটা। লেখকের লেখার হাত বেশ ভালো। বইটা বন্ধ করার পরেও একটা কাককে ঠোঁটে রক্তাক্ত চোখ নিয়ে ঘুরতে দেখলাম মনের পর্দায়।

কাকটা চায়নি যে মেয়েটা তার খারাপ কাজগুলো সম্পর্কে জানুক। সে যে মানুষ নয় এটাও জানাতে চায়নি। ব্যাপারটা পীড়া দিয়েছে তাকে। আর শেষটা…

“আমি জানতাম যে গল্পের শেষটা ভালো হবে না,” সাওরির উদ্দেশ্যে বললাম। কিন্তু মেয়েটার বাবা-মা’র কি দশা হয়েছিল চিন্তা করো।”’

কাউন্টারের পেছনে বসে বইটা সম্পর্কে আমার কি ধারণা সেটা শোনার জন্যে অপেক্ষা করছিল সে। “আমিও এটাই ভেবেছিলাম।”

“বইটা কি কিমুরার খুব পছন্দ? সেজন্যেই রেখে দিয়েছে শেলফে?”

“মনে হয় না এটা তার বই। একদিন হঠাৎই শেলফটায় পায়।”

আরেকবার পাতাগুলো ওল্টালাম। একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করলাম এবারের ছবিতে প্রথম যে ছেলেটার চোখ তুলে নেয় কারাসু, সেই ছেলেটা রাগত ভঙ্গিতে হাত নাড়তে থাকে তার উদ্দেশ্যে। কিন্তু চোখ হারাবার পর তো ব্যথায় কাতরানোর কথা তার। মনে হয় যেন শারীরিক কষ্টের ব্যাপারটা ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

প্রচ্ছদে লেখকের নাম লেখা-শান মিকি।

*

সাওরি আর আমি হেঁটে বাড়ি ফিরছি। ঠান্ডায় কাঁপছি দু’জনই। সাধারণত এ সময় কথা বলি আমরা, কিন্তু আজকে একদম চুপচাপ সে। মনে পড়লো যে সুমিদা বলেছিল ইদানীং সবসময় মুখ গোমড়া করে রাখে সাওরি।

“কি ভাবছো?”

“ইয়ে মানে…” সাওরি বললো। “কিয়োকোর কথা।”

“কিয়োকো?” কণ্ঠের বিস্ময় গোপন করতে পারলাম না। মনে আছে একবার তোমার সাথে কিয়োকোর বাসা থেকে ফেরার পথে দেখা হয়েছিলা আমার?”

“আসলে সেদিন তার সাথে কথা বলতে গিয়েছিলাম আমি,” সাওরি বললো। কি নিয়ে কথা বলতে গিয়েছিল জিজ্ঞেস করায় চুপ করে থাকলো সে, শুধু একবার হাসলো দুর্বল ভঙ্গিতে।

আবারো চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম দুজনে।

“কাজুয়া যখন চোখ দান করে দেয়ার কথা বলেছিল, তুমি কি আপত্তি করেছিলে?”

“খুব বেশি না। আসলে ব্যাপারটাকে অতটা গুরুত্ব দেইনি তখন।”

“কেন?”

“কারণ ওর নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমার কোন কিছু চাপিয়ে দেয়ার কোন অধিকার নেই। তাছাড়া ওর চোখটা এখনও অন্য কারো শরীরে বেঁচে আছে, এটা ভালো না?”

মরণোত্তর চক্ষুদানের জন্যে একটা ফর্ম পূরণ করতে হয়। সেখানে অভিভাবকের সই দরকার। কাজুয়ার ফর্মটায় সাওরি সই করে। ব্যাপারটা নিয়ে সাওরিকে কথা বলতে শুনে ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠলাম।

ওরা দু’জন যদি কাজটা না করতো, তাহলে আমার কি হতো? অন্তত কায়েদিতে আসতাম না। এই সুন্দর মুহূর্তগুলো উপভোগ করতে পারতাম না। একসময় হয়তো স্মৃতি ফিরে পেতাম। কিন্তু নিজেকে ভুলতে না চাওয়ার যে অনুভূতিটা, সেটার স্বরূপও কখনো জানতাম না।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে কাজুয়ার ফর্মটা পূরণ করার স্মৃতি দেখিনি আমি বাম চোখে। এসময় হঠাৎই বুঝতে পারলাম যে কেন দেখিনি।

“যখন কাজুয়া ফর্মটা পূরণ করছিল, তার চোখে কি ব্যান্ডেজ ছিল?”

“এটা জানতে চাইছো কেন?” কৌতূহলী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো সাওরি। “তিন দিন ব্যান্ডেজ ছিল ওর চোখে, হ্যাঁ।”

“ডান চোখে না বাম চোখে?”

“বাম চোখে, আগেও বলেছিলাম না?”

আমার চেহারায় যে চোখটা প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে সেটা ব্যান্ডেজে ঢাকা ছিল তখন। অনন্তকাল অপেক্ষা করলেও তাই সেই স্মৃতিগুলো দেখতে পাবো না কখনো। কারণ বাম চোখটা সেই মুহূর্তটুকু প্রত্যক্ষই করেনি কখনো।

এসময় একটা সম্ভাবনার কথা মাথায় এলো। বাম চোখে দৃশ্যটা দেখতে পারেনি তখন ব্যান্ডেজের কারণে। হয়তো হিতোমিকে তলকুঠুরিতে দেখার পর পালানোর সময়েও এই ধরনের কিছু হয়েছিল। বাম চোখে ব্যথা পেয়েছিল। তাই আমি ঐ পাথুরে দেয়ালটা দেখতে পাইনি স্মৃতিতে।

ব্যথা পেয়ে বাম চোখটা যদি বন্ধ হয়ে যেত, গোটা দৃশ্যটাই তো অন্ধকার হবার কথা। কিন্তু লাইব্রেরিতে সেদিন হঠাৎ এরকম একটা স্মৃতির প্রদর্শনীতে চমকে গিয়েছিলাম ভীষণ। হয়তো এই অল্প সময়ের বিরতিটা খেয়ালই করিনি।

এখন একদম শতভাগ নিশ্চিত আমি।

হিতোমি শিওজাকির বাড়িতেই আছে। আমার ধারণাই ঠিক।

কিছুক্ষণ দ্বিধাবোধের পর মিঃ ইশিনোর ফোনটা চেয়ে নিলাম পুলিশকে ফোন দেয়ার জন্যে। কর্ডলেস ফোন হওয়াতে দূরে গিয়ে কথা বললেও সমস্যা নেই। সাওরি বা তার মামা যদি শুনতে পারে আমি কি বলছি, তাহলে পরিস্থিতি অনর্থক ঘোলাটে হবে। তারা ভেবেছে বাবা-মা’র সাথে কথা বলবো আমি।

যা করছি ঠিক করছি, নিজেকে অভয় দিয়ে তিন ডিজিটের নম্বরটায় ফোন দিলাম। ১-১-০। এতদিন ভেবে এসেছি পুলিশে ফোন দিয়ে কোন লাভ নেই। কিন্তু চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি?

এক মাঝবয়সী লোকের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো অন্য পাশ থেকে। পুলিশের কাজের সুবিধার্থে আমার কথা রেকর্ড করা হবে বলে জানালো

প্রথমে হিতোমি আইজাওয়াকে চেনে কিনা সে এটা জিজ্ঞেস করলাম। “আপনি কি… জানেন কার কথা বলছি?”

জানে না সে।

“এক বছর আগে হারিয়ে যায় সে।”

এরপর বললাম যে অপহরণ করা হয়েছে তাকে।

জবাবে কেবল প্রাণহীন কণ্ঠে “ওহ” বললো অফিসার। এর জবাবে আমি চুপ থাকলে কিছুক্ষণ পর যোগ করলো, আমরা তদন্ত করে দেখবো ব্যাপারটা। আপনাকে ফোন করে জানাবো। এটাই তো আপনার নম্বর?”

কিছু বললাম না তৎক্ষণাৎ। এটা মিঃ ইশিনোর নম্বর। যদি পুলিশ ফোন করার পর সাওরি ধরে, আমার সম্পর্কে কি ভাববে? সত্যটা তখন স্বীকার করতে হবে আমাকে। সবকিছু খুলে বলতে হতে পারে। সবাই ধরে নেবে যে আমি মিথ্যুক।

“আমাকে কি বলতেই হবে?”

সাথে সাথে কথা বলার ধরণ পাল্টে গেল অফিসারের।

নিজের পরিচয় না দেয়াতে সে ভাবছে আমি বোধহয় ফাজলামো করার জন্যে ফোন দিয়েছি। বারবার বললাম যে সেরকম কোন উদ্দেশ্য নেই আমার, কিন্তু লাইন কেটে দিল সে।

পরদিন নতুন সংকল্প নিয়ে মেলানকলি গ্রোভে পা রাখলাম আমি।

শিওজাকি প্রতিদিন দুপুর একটার সময় আসে ক্যাফেতে। ততক্ষণ অবধি কিয়োকোর সাথে কথা বললাম।

আমাদের কথোপকথনের মাঝামাঝি এক পর্যায়ে সে বললো, “সাওরি যে কাজুয়াকে নিয়ে কি ভাবে সেটাই চিন্তা করি মাঝে মাঝে।

এখনও ভাইয়ের মৃত্যু মন থেকে মেনে নিতে পারেনি সাওরি। মনে মনে এই কথাটা ভাবলেও মুখে বলতে পারলাম না।

“আমার ধারণা সবসময় তাকে নিয়েই চিন্তা করে মেয়েটা,” কিয়োকো বললো।

তাকে কাজুয়ার সোনালি হাতঘড়িটার কথা বললাম। সাওরি যে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রেখে দিয়েছে সেটা, তাও জানালাম।

“ঘড়ি?”

“দুর্ঘটনায় ভেঙে যায় ঘড়িটা। ঠিক দুর্ঘটনার সময়টাতেই থেমে গেছে কাটাগুলো।”

এর আগের দিন বাসায় ফেরার সময় সাওরির বলা কথাটা মনে পড়লো। কিয়োকোর সাথে কি বিষয়ে কথা বলতে গিয়েছিল সে? জানতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু এভাবে জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না।

একটা বেজে গেল দেখতে দেখতে। ঠিক তখনই দরজার ঘণ্টার শব্দটা শুনতে পেলাম। একজন কাস্টমার এসেছে।

প্রতিদিনের মত আজকেও কালো কোটটা পরনে শিওজাকির। ধীরে সুস্থে হেঁটে নিজের টেবিলটায় গিয়ে বসলো।

মাথা নিচু করে সাহস জোগালাম মনে মনে। ভয় লাগছে ভীষণ। কিন্তু পুলিশের লোকেরা যেহেতু ধরে নিয়েছে আমি ফাজলামো করছি, এখন আর অন্য কোন উপায় নেই।

“কোন সমস্যা?” জিজ্ঞেস করলো কিয়োকো।

“নাহ, কিছু না,” মৃদু হেসে বলে উঠে পড়লাম।

শিওজাকির সামনে এসে দাঁড়ালাম একটু পর। পকেট থেকে একটা পুরনো খবর কাগজ বের করে তার চোখের সামনে ধরলাম। হিতোমি আইজাওয়ার স্কুলের ছবিটা আছে সেখানে।

“শিওজাকি,” ডাক দিলাম।

মুখ উঠিয়ে আমার দিকে তাকালো সে। “হ্যালো।”

আমার হাত কাঁপছে। এখন আর ফিরে যাবার সময় নেই। “একটা প্রশ্ন ছিল আপনার কাছে। এই মেয়েটাকে খুঁজছি আমি। তাকে চেনেন?”

গলার কাঁপুনিটা চেষ্টা করেও লুকোতে পারলাম না। আমার কাছ থেকে কাটা খবরের কাগজটা নিল শিওজাকি। সেসময় আমার হাত স্পর্শ করলো তার হাত। ভীষণ ঠান্ডা। কেঁপে উঠলো আমার গোটা শরীর; সেটা ভয়ে নাকি ঠান্ডায় তা বলতে পারবো না।

কিছুক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকলো সে। এরপর আমার দিকে চোখ ফেরালো।

“নাহ, আগে কখনো দেখিনি,” ছবিটা ফিরিয়ে দিয়ে বললো শিওজাকি।

এরপর আমাদের মধ্যে আর কোন কথা হয়নি। তার কাছ থেকে এরকম প্রতিক্রিয়াই অবশ্য আশা করেছিলাম। কিন্তু ছবিটা দেখার পর ভেতরে ভেতরে নিশ্চয়ই ঝড় বইতে শুরু করেছে তার।

নিশ্চয়ই ভাবছে আমি কেন হিতোমির খোঁজ করছি। তাকেই বা কেন জিজ্ঞেস করলাম। আমার মুখ বন্ধ করার জন্যে এখন কিছু একটা নিশ্চয়ই করবে সে। সেটা আজ হোক বা কাল।

আমি চাইছি যে করুক।

একমাত্র তখনই গোটা পৃথিবীর কাছে তার মুখোশটা খুলে দিতে পারবো।

৪. সুযোগের অপেক্ষায়

চতুর্থ খণ্ড

-রূপকথার গল্পকার

“সুযোগের অপেক্ষায় আছেন আপনি, তাই না?” সোফা থেকে জিজ্ঞেস করলো হিতোমি। “নাকি এই মুহূর্তে কাউকে হত্যা করা বা এইখানে নিয়ে আসাটা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে?”

মিকি সবকিছু গোছাচ্ছে। এই বাড়িটায় আসার সময় খুব বেশি জিনিস অবশ্য সাথে আনেনি। তাই গোছানোর মতনও সেরকম কিছু নেই। কিছু কাপড়চোপড় আর বই। তবে সে ব্যস্ত অন্য একটা কাজে।

“আমি বাইরে থেকে ঘুরে আসতে চাইলে গাড়িতে করে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন আপনি। তখন নিশ্চয়ই কেউ দেখেছে, হিতোমি বললো। “নতুন গাড়ি কিনলেই দায় এড়াতে পারবেন না।”

মৃদু হাসছে হিতোমি। তার সরু চোখ জোড়া আরো সরু দেখায় হাসলে। হাত-পা বিহীন মেয়েটাকে পুতুলের মত লাগছে এখন।

তাকে সেখানে রেখে তলকুঠুরিতে নেমে এলো মিকি। এই ঘরটা বাদে বাকি ঘরগুলোর ব্যবস্থা করে ফেলেছে সে। ভেতরে পা দিতেই ইউকির গানের শব্দ কান এলো। সেই ইংরেজি গানটাই গাচ্ছে সে। ঘরের অন্ধকার কোণ থেকে ছড়িয়ে পড়ছে বেদনার সুরটা। প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ইটের দেয়ালে।

ঘরের কোনায় রাখা ইটগুলো সিঁড়ির গোড়ায় নিয়ে এলো মিকি। সবগুলো ইট সরাতে বেশ কসরত করতে হলো।

ইউকির গান বন্ধ হয়ে গেলো হঠাৎ।

“কি করবেন?” অন্ধকার থেকেই জিজ্ঞেস করলো সে। এরপরেই গুঙিয়ে উঠলো। “আমার গোড়ালিতে একটা চোখা পাথরের খোঁচা লাগছে!”

“সরি,” মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে বললো শিনিচি। তাদের বিশাল দেহটা নড়ে ওঠার শব্দ কানে এলো মিকির।

বাড়ি ছেড়ে দেয়ার কথা বললো সে।

“ওহ আচ্ছা, শিনিচি বললো মাথা নেড়ে। “তাহলে বিদায়ের সময় এসে গেছে?”

“মানে?” পাশ থেকে ইউকি জিজ্ঞেস করলো।

“তোমাকে পরে বুঝিয়ে বলবো।”

তলকুঠুরি থেকে বেরিয়ে দোতলার স্টাডিতে চলে এলো মিকি। হিতোমি এখানেই আছে। তাকে দেখেই মন খারাপ হয়ে গেল মেয়েটার।

“আমাকে যেহেতু সাথে করে নিয়ে যাচ্ছেন না, নিশ্চয়ই মেরে ফেলবেন বা এমন কোথাও রেখে যাবেন, যেখানে কেউ কোনদিন আর আমার খোঁজ পাবেন না। শেষবারের মতন সূর্যটা দেখতে চাই।”

মিকি তাকে উঠিয়ে নিল দু’হাতে। মেয়েটার ওজন কম হওয়াতে এই কাজে কোন কষ্টই হয় না তার। বাতাসে দুলছে লম্বা চুলগুলো।

“আপনি ধরা পড়লে আদালতে আমি বলবো যে কখনো আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেন নি।

তাকে জানালার পাশে শুইয়ে দিল মিকি।

.

শিওজাকিকে হিতমির ছবিটা দেখানোর পর থেকে ভয়ে ভয়ে কাটতে লাগলো আমার সময়। যে কোন মুহূর্তে আঘাত হানতে পারে সে, ভাবি আমি।

ক্যাফের রান্নাঘরে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায় এরকম জিনিসের অভাব নেই। নানা আকৃতির পাঁচটা ছুরি ঝুলছে একপাশে। এগুলো ইচ্ছে করলেই সরিয়ে ফেলা যাবে। কিন্তু নিতে ইচ্ছে করছে না আমার। কোটের পকেটে সবসময় একটা ছুরি লুকিয়ে রাখা বাড়তি ঝামেলা। তাছাড়া সে যদি আমাকে অতর্কিতে পেছন থেকে আক্রমণ করে, তখন পকেটের ছুরি দিয়ে কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না।

শেষমেশ তাই কাপবোর্ড থেকে ছোট্ট ভাঁজ করা যায় এরকম একটা ছুরি নিলাম। জানিনা এটা আদৌ কোন কাজে আসবে কিনা, তবুও মনকে শান্ত রাখার জন্যে এই সতর্কতাটুকু অবলম্বন করতেই হবে।

সাওরি আর তার মামার উদ্দেশ্যে একটা চিঠি লিখেছি। আমার যদি কিছু হয়, তখন নিশ্চয়ই জিনিসপত্র খুঁজে দেখবে তারা। তখন চিঠি পড়ে জানতে পারবে কেন কায়েদিতে এসেছি আমি। হঠাৎ করে উধাওই বা হলাম কেন।

আমি উধাও হয়ে গেলে পুলিশের লোকদের কাজে নামতেই হবে। শিওজাকির ব্যাপারে চিঠিতে বিস্তারিত লিখেছি। সে যদি আমাকে আক্রমণ করে, তাহলে জিত আমারই হবে।

প্রতিদিন সকালে ওঠার পর মনে হয় যে তখনও কি করে বেঁচে আছি আমি। বাড়িতে বা বাইরে একা থাকার সময় সামান্যতম শব্দেও চমকে উঠি। ভয়ে ভয়ে তাকাই সবদিকে। হৃৎস্পন্দন কখনো স্বাভাবিক হয়নি সেদিনের পর থেকে।

কিন্তু শিওজাকির দেখা নেই। বরং মেলানকলি গ্রোভে আসাই থামিয়ে দিয়েছে সে।

*

সবকিছুরই একটা ইতি আছে। কিন্তু এই ব্যাপারটার ইতি কিরকম হবে তা জানি না। খুব সুখকর কিছু হবার সম্ভাবনা নেই।

তিন দিন হতে চললো শিওজাকিকে হিতোমির ছবি দেখিয়েছি আমি।

আমার অনুসন্ধানের শেষ দিন এসে গেছে।

*

প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়েছে আজকে সকাল সকাল। ঘুম থেকে উঠে মনে হলো হাত পা রীতিমত জমে বরফ হয়ে আছে। কম্বলের নিচেই গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকলাম অনেকক্ষণ। ভালো লাগছে এভাবে শুয়ে থাকতে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার হৃত্যন্ত্রের ধুকপুকানি দ্রুত হয়ে গেল। এর আগে একদিন অনুসন্ধানের শেষদিন নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম। সেদিনও সকালবেলা এরকম ঠান্ডা পড়েছিল। তাহলে আজকেই কি সেই দিন? হতে পারে।

কাজুয়া আর সাওরির কথা ভেবে বিছানা থেকে উঠে পড়লাম।

“আগে কখনো এপ্রিলে এত ঠান্ডা পড়তে দেখিনি,” সাওরির মামা বললেন মুখ গোমড়া করে। জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে কাজের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। তাকে বিদায় জানিয়ে ক্যাফের দিকে রওনা হলাম আমি আর সাওরি।

আমার আর সাওরির একসাথে হাঁটার সময় যদি হঠাৎ শিওজাকি এসে উপস্থিত হয়, তখন কি করবো জানি না। বিনা কারণে ঝামেলায় পড়ে যাবে সাওরি। সেজন্যেই গত দুই দিনে তার থেকে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করেছি যতটা সম্ভব।

কিন্তু তিন দিনেও যেহেতু শিওজাকির দেখা নেই, খুব বেশি সতর্কতা আর অবলম্বন করছি না। যদিও সকালবেলার চিন্তাটা মাথায় ঘুরছে। তবে একসাথে হেঁটে যাওয়ার সময় কোন সমস্যা হবে না আশা করছি।

“বসন্তের ছুটি শেষ হয়ে যাবে শিঘ্রই,” সাওরি বললো আমার উদ্দেশ্যে। অনবরত নাক টানছে সে। কথা বললে বাষ্প বেরুচ্ছে মুখ থেকে।

“হ্যাঁ,” বললাম আমি। “নতুন শিক্ষাবর্ষ বোধহয় পরশু থেকে শুরু হবে।”

“তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার জন্যে পড়া শুরু করবে এখন থেকে?”

ওরিয়েন্টশন অনুষ্ঠানে যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই আমার। এখানকার কাজ শেষ না করে বাড়ি ফিরতে চাই না।

“আরো কয়েকটা দিন এখানে থাকবো।”

চোখে অস্বস্তি নিয়ে আমার দিকে তাকালো সাওরি।

ক্যাফেতে বেশ বড় একটা হিটার আছে। নির্লজ্জের মত সেটার সবচেয়ে কাছের চেয়ারটায় বসে আবারো চোখের স্মৃতি বইটা পড়লাম।

ঘড়িতে বারোটা বেজে গেলেও কোন কাস্টমার আসেনি সকাল থেকে। দুপুরের একটু আগ দিয়ে সাওরি বেরিয়ে গেল। হিটারের কাছে বসে শিওজাকিকে নিয়ে ভাবছি এসময় অ্যাপ্রন খুলে আমার দিকে এগিয়ে এসে বলে, “একটু কিয়োকোর বাসায় যাচ্ছি। কিমুরাকে বলে দিও।”

মাথা নাড়লাম। কিমুরা এ মুহূর্তে রান্নাঘরে। সাওরি বেরিয়ে গেলে তার সাথে কথা বলতে গেলাম।

“কিন্তু আজকে তো কিছু ডেলিভারি দেয়ার কথা না,” গোঁফে তা দিয়ে বললো কিমুরা।

শিওজাকি সবসময় একটার দিকে মেলানকলি গ্রোভে আসে। কিন্তু আজকেও যখন এলো না সে, স্বস্তি আর দুশ্চিন্তা জেঁকে বসলো আমার চিত্তে। খুবই অস্থির লাগছে ভেতরে ভেতরে। সে কি করছে বা কোথায় আছে এ ব্যাপারে কিছু জানি না। হয়তো ইতিমধ্যেই পালিয়ে গেছে।

“শিওজাকিও দেখি এখন আর আসে না,” গোমড়া মুখে বললো কিমুরা। “হলোটা কি তার?” আসলেও চিন্তিত মনে হচ্ছে তাকে।

“ছুটিতে যাবার ব্যাপারেও তো কিছু বলেনি,” মুখে স্ট্র নিয়েই বললো সুমিদা পাশ থেকে। তার সামনের কমলার জুসের গ্লাসটায় বরফ বাদে কিছু নেই।

সাওরি যাবার এক ঘণ্টা পর উদয় হয়েছে সে। তার সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যেই এসেছিল নিশ্চয়ই। যখন বললাম বাইরে গেছে, মুখটা ফাটা বেলুনের মত চুপসে গিয়েছিল বেচারার।

শিওজাকির পালিয়ে যাওয়া নিয়ে ভাবতে লাগলাম।

যদি পালিয়েই যায়, তাহলে তার বাসায় এখন কি আছে? সেখানে গেলে কি কোন প্রমাণ পাওয়া যাবে? হিতোমিকে আটকে রাখার কোন আলামত?

প্রথমে যে জিনিসটার কথা মাথায় এলো সেটা হচ্ছে কাপড় চোপড়। এর আগে ঐ বাসায় মেয়েদের কাপড় দেখেছি আমি। কিন্তু হিতোমিকে তো কাজুয়া হাত-পা বিহীন অবস্থায় একটা বস্তার ভেতরে দেখেছিল। সেক্ষেত্রে স্বাভাবিক কাপড় তার গায়ে হবার কথা না।

হয়তো আমি যেগুলো দেখেছিলা, সেগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় পড়তো সে?]।

আরেকটা ব্যাপার মাথায় এলো। শিওজাকি নিশ্চয়ই পালিয়ে যাওয়ার আগে তলকুঠুরিটার একটা ব্যবস্থা নেবে? জানালাটা প্ল্যান্টার দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। সেরকম তলকুঠুরিতে যাওয়ার রাস্তাটাও চাইলে ইট দিয়ে বুজে দিতে পারে।

আর কি আলামত থাকতে পারে সেখানে? সে-ই যে অপহরণকারী এটা প্রমাণ করার জন্যে কি কি তথ্য বের করতে হবে আমাকে?

উঠে দাঁড়ালাম। নিজের বোকামিতে নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে ভীষণ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটাই তো ভুলে বসে আছি।

হিতোমি আইজাওয়াকে খুঁজে বের করতে হবে। কেউ যদি জানতে পারে যে বেঁচে আছে মেয়েটা, তখন সেটা শিওজাকির জন্যে বিপদ ডেকে আনবে। তাহলে এরকম পরিস্থিতিতে কি করা উচিৎ তার?

তাকে সাথে করে নিয়ে যেতে পারে অথবা এমন এক জায়গায় রেখে যেতে পারে যেখানে কেউ তাকে কোনদিন খুঁজে পাবে। হিতামিকে যে সহজেই হত্যা করতে পারে শিওজাকি, এই ভাবনাটা জোর করে মাথা থেকে দূরে রাখলাম।

এখনই শিওজাকির বাড়িতে যেতে হবে আমাকে।

*

“আমাকে এক জায়গায় নিয়ে যেতে হবে আপনাকে!”

সুমিদা অবাক চোখে আমার দিকে তাকালো। “কি? কোথায়?”

“চলুন প্লিজ!” অনুনয়ের স্বরে বললাম। “এখনই যেতে হবে আমাদের?”

কাউন্টারের পেছন থেকে কৌতুকপূর্ণ চোখে আমাদের দেখছে কিমুরা। “নিয়ে যাও তো,” সুমিদাকে নির্দেশ দিল সে। মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম তাকে।

সুমিদাকে একরকম ঠেলতে ঠেলতে বের করে নিয়ে এলাম ক্যাফে থেকে। বিল না মিটিয়েই বেরিয়ে এসেছে সে। তার হয়ে আমি পরে টাকা দিয়ে দিব।

বাইরে নিশ্চয়ই প্রচণ্ড ঠান্ডা, কিন্তু উত্তেজনার কারণে কিছু অনুভব করতে পারছি না। ক্যাফের পার্কিং লটে রাখা সমিদার গাডিটার প্যাসেঞ্জার সিটে লাফিয়ে উঠে পড়লাম।

“আগে একটু শান্ত হয়ে বোসো,” সুমিদা বললো। “টেনে টেনে আমার জামার হাতাটাই বড় করে দিয়েছে।”

“সরি,” লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বললাম। “কিন্তু তাড়া আছে আমার। দ্রুত শিওজাকির বাড়িতে চলুন।”

আবারো বিস্ময় ভর করলো সুমিদার চেহারায়। “কেন?”

“যেতে যেতে বলছি। দয়া করে ইঞ্জিন চালু করুন।”

চুপচাপ চাবি ঘুরিয়ে ইঞ্জিন চালু করে ফেললো সে। মেলানকলি গ্রোভ পেছনে ফেলে শিওজাকির নীল বাড়িটার দিকে ছুটে চললাম আমরা।

“এবার বলো। কেন যাচ্ছো ওখানে?”

হিতোমির ব্যাপারে তাকে কিছু বলবো কিনা সেটা নিয়ে দোটানায় ভুগছি। যুক্তি দিয়ে চিন্তা করলে, সুমিদাকে এসবে জড়ানোর কোন মানে হয় না। কিন্তু একেবারেই কিছু যদি না বলি, তাহলে খারাপ দেখাবে। শিওজাকি একটা মেয়েকে অপহরণ করেছে, এটা বলবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম।

“হয়তো আপনি শুনে খুব অবাক হবেন।”

“আজকে তোমার চেহারা দেখে যেরকম অবাক হয়েছি, এর বেশি বিস্মিত হবে বলে মনে হয় না।”

“আমার কথা মন দিয়ে শুনুন।”

“ঠিক আছে, কিছুক্ষণ পর শান্তস্বরে বললো সুমিদা। রাস্তার দিকে চোখ তার। মনে মনে স্বস্তিবোধ করছি, সুমিদাকে নিয়ে এসে ভালো হয়েছে।

তাকে হিতোমর ব্যাপারে অসবকিছু খুলে বললাম। এরপর বললাম যে এই মুহূর্তে হয়তো মেয়েটাকে শিওজাকির বাড়ির তলকুঠুরিতে আটকে রাখা হয়েছে। এর বেশি কিছু জানালাম না। আমার বাঁ চোখের ব্যাপারে কথা বললে সেটা হয়তো সে বিশ্বাসও করবে না।

“তিন দিন আগে শিওজাকিকে হিতোমির একটা ছবি দেখাই আমি।”

ব্যাখ্যা করে বললাম যে গত তিন ধরে শিওজাকির অপেক্ষা করছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে পালিয়ে গেছে সে।

সুমিদা চুপচাপ আমার কথা শুনছে। কথা শেষ হলে ক্ষীণকণ্ঠে বললো, “তাই বলে…শিওজাকি?” চেহারা একদম ফ্যাকাসে হয়ে গেছে বেচারার। “আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।”

“মিথ্যে বলছি না।”

“কিন্তু…”

পেঁচানো রাস্তাটা দিয়ে পাহাড়ের ওপরে উঠছি এখন আমরা। দু’পাশেই কেবল সিডার গাছ। কাজুয়া যেখানে মারা গিয়েছিল সেই জায়গটা পার করে আসলাম।

“আমার কথা আপনার না বিশ্বাস করলেও চলবে। আমিই ভেতর যাবো নাহয়, আপনি বাইরে অপেক্ষা করবেন। শিওজাকি হয়তো এখনও ভেতরেই আছে। যদি আমি না ফিরি, তাহলে পুলিশে খবর দেবেন।” ভয় পেয়েছি ঠিকই, কিন্তু হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলিনি।

“বিপদ হতে পারে নাকি?”

“না হলেই অবাক হবো। কিন্তু আমার কাছে একটা ছুরি আছে।”

আরো ফ্যাকাসে হয়ে গেল সুমিদার চেহারা।

“তবুও… তোমাকে একা যেতে দিতে পারি না আমি।”

কথাগুলো শুনে কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠলো মন।

কিয়োকোর বাড়িতে যাবার রাস্তাটা পেছনে ফেলে এলাম। অবশেষে নীল রঙের বাড়িটা দেখতে পাচ্ছি সামনে। ঘন মেঘের কারণে চারদিকে কেমন যেন ঘোলাটে অন্ধকার। বাড়িটা দেখার সাথে সাথে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল একটা স্রোত বয়ে গেল আমার।

“গাড়ি নিয়ে বেশি কাছে যাবার দরকার নেই,” বললাম। “সামনেই থেমে বাকিটা রাস্তা হেঁটে যাব আমরা।”

“কেন?”

“শিওজাকি যদি ভেতরে থেকে থাকে, তাহলে সতর্ক হয়ে যাবে।

ভেতরে প্রবেশ করার আগে আরেকবার বাড়ির চারদিকটা দেখে নিতে চাই আমি। কিছুদূর এগিয়ে গাড়ি বন্ধ করে দিল সুমিদা। আমার শরীর রীতিমত কাঁপছে এখন। চোখ বন্ধ করে মনে মনে প্রার্থনা করে নিলাম একবার।

কাজুয়া যখন হিতোমিকে বাঁচাতে এসেছিল, সে-ও নিশ্চয়ই ভয় পাচ্ছিল এরকম।

“তৈরি?” ক্ষীণস্বরে জিজ্ঞেস করলো সুমিদা। আগের চেয়েও ফ্যাকাসে লাগছে এখন তার চেহারা।

মাথা নেড়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম।

.

গেটের দু’পাশে আমার উচ্চতার দু’টা গেটপোস্ট। লোহার দরজাটা হা করে খোলা। মাথা নিচু করে ভেতরে ঢুকলাম আমি আর সুমিদা।

নুড়ি বেছানো পথে কিছুদূর এগোনো পর নীল দেয়াল চোখ পড়লো। আজকে কেন যেন আগের তুলনায় বড় লাগছে বাড়িটাকে। মনে হচ্ছে এক বিশাল দানো পেটভর্তি অন্ধকার নিয়ে ঘাপটি মেরে আছে। আমার আত্মশুদ্ধ কেঁপে উঠলো কথাটা ভেবে। যতই সাহসী কথাবার্তা বলি না কেন, বাড়িটা দেখলে সব সাহস দূরে পালায়। কেমন যেন অশুভ একটা ব্যাপার আছে বাড়িটাকে ঘিরে।

নীল হচ্ছে একাকীত্ব আর অন্ধকারের রঙ। নীল সমুদ্রের ভেতরটা একদম ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। সুতরাং সে অর্থে বলা যায় নীল আর ভেতরকার অন্ধকারের কোন পার্থক্য নেই। আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটাও সেটারই প্রমাণ।

বাইরে যেরকম অন্ধকার, অন্য কেউ হলে ভেতরে আলো জ্বালতো নিশ্চয়ই। কিন্তু জানালাগুলো ভেতরের অন্ধকারের পক্ষেই গান গাইছে। কেউ আছে বলে মনে হয় না।

শিওজাকির গাড়িটা অবশ্য আগের জায়গাতেই আছে।

“সে ভেতরে আছে নাকি বুঝতে পারছি না,” সুমিদার উদ্দেশ্যে বললাম। আমার নিজের কানেও নিজের কণ্ঠস্বরটা বড় খেলো শোনাচ্ছে।

“গাড়ি রেখেই পালিয়েছে হয়তো।”

গাছের আড়ালে আছি আমরা এখন। বনটা এতটাই নিশ্চুপ আমার কানের রক্তপ্রবাহের শব্দও শুনতে পাচ্ছি। মাঝে মাঝে দুই একটা পাখি উড়ে যাচ্ছে, শব্দ বলতে এটুকুই।

এই নিখাদ নৈঃশব্দের সাথে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি, এসময় একটা একাকী দাঁড়কাককে বসে থাকতে দেখলাম ছাদের ওপরে। চুপচাপ বসে আশেপাশে নজর রাখছে ওটা।

দুই দিক থেকে বাড়িটা চক্কর দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা।

“সুমিদা, আপনি ডানদিকে যান, আমি বামে যাচ্ছি।”

“যদি কিছু হয়, চিৎকার করবে,” চিন্তিত চেহারায় বললো সুমিদা। একটু পর উধাও হয়ে গেল ডানদিকে।

তার থেকে হঠাৎ আলাদা হবার পরই ঘাবড়ে গেলাম। সুমিদা নিজেও যে খুব বেশি শক্তিশালী, তা নয়। কিন্তু একা থাকার চেয়ে দু’জন থাকা উত্তম।

এভাবে ভয় পেলে চলবে না, নিজেকে বোঝালাম। কাজুয়া তো এখানে একাই এসেছিল। ভেতরে ঢোকার উদ্দেশ্যে ছিল তার, এজন্যেই স্কু ড্রাইভারটা নিয়ে এসেছিল পকেটে করে।

আমিও তার মত একই কাজটাই করছি। মৃত্যুর আগে যে অনুসন্ধানটা শুরু করেছিল সে, সেটা সফল করার দায়িত্ব এখন আমার।

চোখ বন্ধ করে দশ সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইলাম। ভেতরের বমি বমি ভাবটা কেটে গেল। চোখ খুলে বড় করে শ্বাস নিয়ে সন্তর্পণে সামনে এগোলাম। খেয়াল রাখছি যাতে শব্দ না হয়।

আমার উপস্থিতি কি টের পেয়ে গেছে শিওজাকি? ছাদ থেকে দাঁড়কাকটা উড়ে যাবার শব্দ কানে এলো।

.

-রূপকথার গল্পকার

মিকি স্টাডিতে। গোছগাছ মোটামুটি শেষ। এখন শুধু তলকুঠুরিটা বুজে দিয়ে পালাতে হবে। রিয়েল এস্টেটের লোকটার সাথে কথা বলে নেবে পরে, নতুন ভাড়াটিয়া পেতে অসুবিধে হবে না তার।

ডেস্ক, চেয়ার, পর্দা, ঘড়ি-এসব ফেলে যাবে সে। কেবল জরুরি আর ব্যক্তিগত কিছু জিনিস আলাদা করে প্যাক করেছে।

হঠাৎই একটা কথা মনে পড়ায় ডেস্কের ড্রয়ার খুললো মিকি। ভেতরের জিনিসটা বের করে দীর্ঘ একটা সময় তাকিয়ে থাকলো। আগন্তুক ফেলে গিয়েছিল এটা।

এসময় বাইরে থেকে পাখির ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ কানে এলো তার। অন্য সময় হলে পাত্তা দিত না। কিন্তু আর কিছুক্ষণের মধ্যে কেটে পড়বে সে, এই মুহূর্তে অসতর্ক হলে চলবে না।

জিনিসটা পকেটে চালান করে দিল মিকি। স্টাডির জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়লো না।

দোতলায় হলওয়েতে বেরিয়ে এলো সে। এখান থেকে নিচতলার সবকিছু স্পষ্ট দেখা যায়। হলওয়ের বাম দিকে একটা জানালা আছে। সেই জানালায় মাথা ঠেকিয়ে বাইরে উঁকি দিল। ইচ্ছে করেই জানালাটা খুললো না। বাইরে কেউ থাকলে সতর্ক হয়ে যেতে পারে। কিন্তু জানালা না খোলার কারণে ঠিক নিচটায় কি আছে তা দেখতে পাচ্ছে না।

তবুও জানালার কার্নিশ বরাবর দেয়ালটার কোণ দিয়ে একজনের কাঁধ দেখতে পেল এক মুহূর্তের জন্যে। দেয়ালের সাথে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আগন্তুক। নিশ্চয়ই আশপাশ ঘুরে দেখছে।

নিঃশব্দে নিচে নেমে এলো মিকি।

একগাদা ইট আর প্লাস্টার রাখা আছে সিঁড়ির গোড়ায়। তলকুঠুরি থেকে সেগুলো ধীরে ধীরে উপরে নিয়ে এসেছে সে। ভাগ্যিস হাতুড়িটাও এনেছিল। ওটার মাথায় মরিচা ধরলেও বেশ ওজন। যে কোন কিছু ভাঙতে পারবে জোরে আঘাত করলে।

.

আগন্তুকের মুখোমুখি হবার সময় হয়ে গেছে। দেয়ালে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি। এভাবে থাকলে ওপর থেকে দেখা যাবে নানিশ্চয়ই। দেয়ালটা একদম ঠান্ডা। মুখ দিয়ে সাদা বাষ্প বেরিয়েই মিলিয়ে যাচ্ছে।

এই বাড়িটা অন্য দশটা বাড়ির মত চারকোনা নয়। যেদিকে যেদিকে ঘর, সেখান দিয়ে সামনে বেরিয়ে এসেছে দেয়াল। ফলে বারবার ঘুরতে হচ্ছে গোলকধাঁধার মতন। প্রতিবার ঘোরার সময় মনে হয় এই বুঝি সামনে শিওজাকিকে দেখতে পাবো।

জানালাগুলো দিয়ে ভেতরে উঁকি দিচ্ছি। কিন্তু বেশিরভাগ ঘরেই পর্দা ভেজানো। শিওজাকি এখানে নেই তাহলে। ভেতরটা খালি কোন বাড়ির মতনই ফাঁকা লাগছে।

বেশ কয়েকটা প্ল্যান্টার আছে বাড়ির চারপাশে। অবশ্য কোনটাতেই ঘাস বাদে কিছু জন্মেনি। কয়েকটা মরা শেকড় দেখে বুঝলাম আগে হয়তো ছোট ছোট ঝোপ ছিল সেগুলোয়।

বাড়িটার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকটার সাথে আমার লাইব্রেরিতে দেখা স্মৃতিটার সবচেয়ে বেশি মিল। শেষবার এখানে এসে এ ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছিলাম। এর আগেরবার যেখানে থেমেছিলাম, এবারো সেখানে এসে দাঁড়িয়ে গেলাম। পা দিয়ে জোরে গুঁতো দিলাম প্ল্যান্টারের ইটে। নাহ, এভাবে সরানো যাবে না। সিমেন্ট দিয়ে আটকানো।

এই প্ল্যান্টারটা নিশ্চয়ই গত দুই মাসের মধ্যে কোন এক সময়ে বানানো হয়েছে তাড়াহুড়ো করে। খুঁজলে হয়তো দুর্বল জায়গা পেতাম, কিন্তু সেই সময় নেই।

এ নিয়ে ভাবা বাদ দিলাম। একই জায়গায় খুব বেশিক্ষণ থাকাটা নিরাপদ না।

বাড়ির পেছন দিকে আবারো চোখে পড়লো ছাউনিটা। এখনও আগের মতনই আছে। ছাউনিটার বয়স নিশ্চয়ই বাড়িটার বয়সের সমান। কাঠগুলো পচতে শুরু করেছে। একসময় বোধহয় সাদা রঙ ছিল বাইরে, এখন একদমই উঠে গেছে। বৃষ্টির ফোঁটার দাগ জায়গায় জায়গায়।

কিছু স্থানে বোর্ড উঠে আসছে। ভেতরের অন্ধকার দেখা যাচ্ছে সেদিক দিয়ে। ছাউনির দরজাটা ঠেলা দিলাম জোরে, কিন্তু এক চুলও নড়লো না

ওটা। আরেকবার সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে যাবার মত ফাঁকা জায়গা তৈরি করতে সক্ষম হলাম। ভেতরটা খালি।

এসময় জানালাটা চোখে পড়লো আমার। ছাউনির পেছনের দেয়াল বরাবর থাকায় বাইরে থেকে দেখা যায় না। এই জানালাটায় কোন পর্দা টাঙানো নেই। আসলে নেই বললে ভুল হবে, দুই পাশে সরিয়ে রাখাহয়েছে হয়তো। বাড়ির ভেতরটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

আশপাশে তাকিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিলাম যে একাই আছি আমি।

জানালাটা বেশ ওপরে। বাড়িটা ঢালের ধারে তৈরি করা হয়েছে বিধায় একেকটা জানালার উচ্চতা একেকরকম। একটা কাঠের বোর্ডে পাড়া দিয়ে কোনমতে উঁচু হয়ে ভেতরে তাকালাম।

.

-রূপকথার গল্পকার

সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে মিকি। ওপরতলা থেকে যাকে দেখেছে, সে বাড়ির পেছন দিকের দেয়াল ঘেঁষে সামনে এগোচ্ছে। সুতরাং মিকিকে চোখে পড়ার সম্ভাবনা নেই।

এই প্রথম যে কেউ ছোঁকছোঁক করতে এসেছে তা নয়। এর আগেও কয়েকবার এমনটা হয়েছে। আসলে কখনো নিজের অপরাধগুলো লুকোনোর সেরকম চেষ্টা করেনি সে।

এমনকি তার প্রথম খুনের পরেও কিছু করেনি। পাহাড়ের ওপর থেকে কেন মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল সেটার সদুত্তর এখনও দিতে পারবে না। এই কাজগুলোর পরিণতি কি হতে পারে, সেগুলো নিয়েও ভাবেনি কখনো। ধরা পড়লে কিছু আসে যায় না তার।

কিন্তু যদি ধরা না পড়ে থাকা যায়, তাহলে সেই চেষ্টা না করাটা বোকামি। আগন্তুকের মুখ চিরতরে বন্ধ করে দেয়ার সুযোগ পেলে, সেটাই করবে।

হাতুড়িটা শক্ত করে চেপে ধরে পা টিপে টিপে সামনে এগোলো সে। কিছুক্ষণ পর দেয়ালের অন্য পাশ থেকে একটা বের হয়ে থাকা কাপড়ের অংশ দেখতে পেল। আগন্তুকের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।

আগন্তুক অবশ্য এখনও টের পায়নি যে বাড়ির কর্তা তার পেছনে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। যতটা সম্ভব আস্তে শ্বাস টানার চেষ্টা করছে মিকি।

এরকমটাই হয় প্রতিবার। এ পর্যন্ত কতজন চেষ্টা করেছে এই বাড়িটার ভেতরে উঁকি দেয়ার?

আগের বাড়িটাতেও একইরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল। তবে সেবার আগন্তুক ছিল এক প্রতিবেশী গৃহিণী। মিকিকে বাইরে দেখে কিছু একটা সন্দেহ হয় তার। হয়তো প্রতিবেশীদের সাথে খুব একটা যোগাযোগ করি না দেখেই মহিলার মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। সেখানে থাকার সময় দুজনকে বাড়ির পেছনে কবর দিয়েছি। আমাকে কি দেখে ফেলেছিল? চাইলে তাকেও মারতে পারতাম। কিন্তু তেমনটা করলে তার পরিবারের লোকজন হৈচৈ করতে পারে দেখে আর কিছু করিনি। তাই ভিন্ন কোথাও চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। সে শক্ত কোন প্রমাণ যোগাড় করে ফেলার আগে উধাও হয়ে যাওয়াই ভালো।

তাই মিকি কায়েদিতে চলে আসে।

দেয়ালে গা ঘেঁষে আবারো আগন্তুকের দিকে তাকালো সে। প্রবল ঠান্ডায় মুখ দিয়ে শ্বাস বের হওয়া মাত্র জমে যাচ্ছে। আগন্তুক যে জানালাটা দিয়ে ভেতর দেখছে সেখানে কি আছে একবার ভাবলো মিকি।

সাথে সাথে হাতুড়িটা উঁচু করে ধরলো।

হিতোমি বলেছিল শেষবারের মতন সূর্য দেখতে চায়।

সে যদি এই অনুরোধটা না করতো তাহলে আগন্তুকের মুখ বন্ধ করতে হতো না তাকে। তলকুঠুরিটা বুজে দিয়ে পালিয়ে গেলেই হতো।

কিন্তু জানালার অন্যদিকে হিতোমিকে রেখে এসেছে সে বেশ খানিকক্ষণ আগে। নিজের হাতে।

আগন্তুক নিশ্চয়ই দেখে ফেলেছে তাকে। সেজন্যেই অস্ফুট একটা শব্দ বেরিয়ে এলো তার মুখ দিয়ে।

.

জানালার ওপাশে সেরকম কিছু চোখে পড়লো না। বড় বড় বই ভর্তি একটা বুকশেলফ। খুব সম্ভবত আর্ট বই। দেয়ালে কিছু পেইন্টিং ঝোলানো। আরেকপাশে না খোলা কার্টন। শিওজাকি স্টোর রুম হিসেবে ব্যবহার করে এই ঘরটা।

খুশি হবো নাকি হতাশ, বুঝলাম না। কাঠের বোর্ডটা থেকে নিচে নামলাম। শিওজাকি কি আসলেও চলে গেছে?

হঠাৎই একটা ছায়া দেখতে পেলাম চোখের কোণ দিয়ে। চিৎকার করতে যাবো এসময় খেয়াল করলাম ওটা সুমিদা। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো যেন।

“কিছু পেয়েছো?” জিজ্ঞেস করলো সে।

মাথা ঝাঁকিয়ে না করে দিলাম।

এবারে ভেতরে ঢুকবো দু’জন।

সামনের দরজা দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করলাম প্রথমে। তালা দেয়া। তবে সুমিদা আরেকটা দরজা দেখে এসেছে উত্তর পাশে। সেটার হ্যাঁন্ডেল ঘোরাতেই খুলে গেল দরজা।

ভেতরটা অন্ধকার। একে তো বাইরে মেঘলা, তার ওপর বাড়িটার উত্তর দিকে আছি আমরা এখন। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বাতি জ্বালবো কিনা ভাবছি, শিওজাকি না পালিয়ে থাকলে সতর্ক হয়ে যাবে। কিন্তু সুমিদা অতশত না ভেবে সুইচ অন করে দিল।

“সমস্যা নেই, ব্যাটা ভেগেছে মনে হয়।”

“আমাদের আরো সতর্ক হতে হবে,” বললাম। সুমিদা ফিরে আসায় আত্মবিশ্বাস খুঁজে পেয়েছি আবারো।

পেছনের দরজাটা দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকতে হয়। একটা পুরনো টিমটিমে বাতির আলোয় ফ্রিজের অবয়বটা বোঝা যাচ্ছে। আরেকপাশে কয়েকটা কেবিনেট। আশপাশ নীরব হওয়াতে ফ্রিজের গুঞ্জন শুনতে পাচ্ছি। তবে রান্নাঘরটা দেখে মনে হচ্ছে না খুব একটা ব্যবহৃত হয়।

সেখান থেকে বের হয়ে অন্য ঘরগুলোয় উঁকি দেয়া শুরু করলাম আমরা। কিন্তু কোথাও কেউ নেই।

একটা ঘর দেখে মনে হলো শিওজাকির স্টুডিও। অর্ধেক কাজ হওয়া কয়েকটা ছবি দাঁড়িয়ে আছে স্ট্যান্ডে। টেবিলের ওপর কাপে বিভিন্ন আকৃতির ব্রাশ।

আগেরবার এসে দেখা কাপড়গুলো এখনও একই জায়গাতেই আছে। পুরো ঘরটা জুড়েই আসলে মেয়েদের কাপড়ে ভর্তি। এগুলোর কোনটাই হিতোমির গায়ে লাগবে বলে মনে হয় না। মাঝবয়সী কোন মহিলার কাপড় এগুলো।

খালি বাথরুমটায় উঁকি দেয়ার পর সুমিদা ঘোষণা করলো, “কেউ নেই বাসায়।”

সুমিদা নার্ভাস হলেও তার চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে না। হিতোমি এখানে নেই বলেই ধারণা তার। শিওজাকিকেও বোধহয় এখন আর অপহরণকারী মনে হচ্ছে না। আমার মুখের ওপর কথাগুলো বলেনি অবশ্য, কিন্তু হাবভাবে বুঝতে পারছি।

মৃদু আলোয় আলোকিত হলওয়েগুলো ধরে হাঁটছি আমরা। তলকুঠুরিতে ঢোকার প্রবেশপথটা নিশ্চয়ই আশপাশেই কোথাও আছে, কিন্তু সেটা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না।

কিছুক্ষণ পর সুমিদা বললো, “চলো বের হয়ে যাই, নামি। হয়তো তোমার কোন ভুল হয়েছে।”

ভেতরে ভেতরে মুষড়ে পড়লাম। ভুল তো হবার কথা না। কিন্তু এ মুহূর্তে করার মত কিছু নেইও আসলে।

“দোতলাটা দেখা বাকি,” ক্ষীণ স্বরে বললাম।

“আমি যাবো না ওপরে,” কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সুমিদা।

একাই ওপরে উঠলাম। দোতলার হলওয়ে থেকে নিচতলাটা পুরোপুরি দেখা যায়। এখানেও কয়েকটা ঘর পাশাপাশি। একটা ঘর দেখে মনে হলো শিওজাকির বেডরুম। অন্য ঘরটায় বিশাল একটা কাঠের ডেস্ক। খুব সম্ভবত

স্টাডি রুম। আরো দমে গেলাম। কোথাও কিছু নেই।

কিছুক্ষণ আগে যখন সুমিদা বললো যে ওপরে আসবে না, ভেতরে ভেতরে রেগে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তার কথায় যুক্তি আছে।

এতক্ষণে ভয়টা অবশ্য কেটে গেছে। বাইরে থেকে দেখে শয়তানের বাসস্থান মনে হলেও, বাড়িটার ভেতরে অদ্ভুত কিছু নেই। বরং শিওজাকির আঁকা ছবিগুলো দেখে মনে হচ্ছে এরকম কারো অপহরণকারী হবার সম্ভাবনা একদমই ক্ষীণ। একটা ছবিতে প্রজাপতিকে তাড়া করছে একটা বাচ্চা কুকুর, অন্যটায় টিভি দেখছে কয়েকটা বাচ্চা।

তলকুঠুরিতে যাওয়ার কোন দরজা নেই কেন? অপহরণের আলামত বলা যায় এরকম কিছু খুঁজে পাচ্ছি না কেন? এই প্রশ্নগুলো মাথায় নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

হলওয়ের একদম কোনায় একটা জানালা চোখে পড়লো এ সময়। পর্দা ভেড়ানো থাকলে অবশ্য চোখে পড়তো না। এখান থেকে বাইরের বন দেখা যায়। কিছুটা দূরে পাহাড়ের ওপর আরেকটা বাড়ি। শিওজাকির বাড়িটার মতনই একই নকশার ওটা। তবে ইটগুলো লাল রঙের।

হয়তো ওটাই কিয়োকোর বাড়ি। কিমুরার কাছে শুনেছিলাম সে-ও ইটের তৈরি বাড়িতে থাকে।

এমনটা কি হতে পারে যে চোখে রঙিন সানগ্লাস পরে ছিল কাজুয়া সেদিন। তাই রংটা নীল মনে হয়েছে আমার কাছে?

পরক্ষণেই বাতিল করে দিলাম ভাবনাটা। এটা সম্ভব না। কিন্তু মন থেকে সন্দেহ পুরোপুরি দূর হলো না।

কাজুয়ার স্মৃতিতে তলকুঠুরির একটা জানালা দেখেছিলাম। কিন্তু এই বাড়িটার বাইরে একটা প্ল্যান্টার। তাছাড়া দুই মাসের মধ্যে তো প্ল্যান্টারে ঘাস জন্মে মরে যাবে না। তাহলে কি আমারই ভুল হয়েছে?

ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম কয়েক সেকেন্ড। কাজুয়া যদি সেদিন কিয়োকোর বাড়ীর তলকুঠুরি দেখে থাকে… তাহলে খুব বড়সড় ভুল করে ফেলেছি আমি।

রুম থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেলাম। নিচে নামার মত ধৈর্য নেই, তাই রেলিংয়ের ধারে গিয়ে সুমিদার নাম ধরে ডাক দিলাম। “সুমিদা!”

সিঁড়ির গোড়ায় হেঁটে এলো সে। “দেখা শেষ?”

“গাড়ি বের করুন! আমাদের কিয়োকোর বাড়িতে যেতে হবে!”

বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো সে।

“পরে বুঝিয়ে বলছি!”

আমার কথায় খুব একটা ভরসা পেয়েছে বলে মনে হলো না। তবে আর কিছু না বলে সামনের দরজার দিকে দৌড় দিল।

সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামার সময় ভাবলাম, কাজুয়া আসলে সেদিন কিয়োকোর বাড়িতেই গিয়েছিল। আর সেটা সত্যি হলে সাওরি বিপদে আছে। ওখানেই যাওয়ার কথা বলে বের হয়েছে সে।

শেষের কয়েকটা ধাপ লাফিয়ে নামলাম।

.

-রূপকথার গল্পকার

আগন্তুককে দেখে হিতোমির চেহাআর কি দশা হয়েছে সেটা ভাবছে মিকি। তার যে হাত পা কেটে ফেলা হয়েছে, এটা কি বুঝতে পারবে আগন্তক? যে কোন সুস্থ মানুষের তো ভয় পেয়ে যাবার কথা।

বাড়ি বসানোর জন্যে হাতুড়িটা ওপরে তুলেছে এ মুহূর্তে তার পকেটের চাবিগুলো শব্দ করে উঠলো। কান না পাতলে সেই শব্দ শুনতে পাবার কথা না কারো। কিন্তু এটুকু শব্দেই সতর্ক হয়ে গেল আগন্তুক। দৌড় দিল আশপাশে না তাকিয়ে।

মিকিকেও দৌড়াতে হবে এখন। আগন্তুকের মুখটা বন্ধ করতে হবে।

.

সামনের দরজার উদ্দেশ্যে দৌড় দিলাম আমি। সুমিদা নিশ্চয়ই গাড়ির ইঞ্জিন চালু করবে এখন। যত দ্রুত সম্ভব পৌঁছাতে হবে আমাকে।

এসময় এমন একটা শব্দ কানে এলো যেটা এখানে শুনতে পাবো সেই কল্পনাও করিনি।

কেউ গান গাচ্ছে।

সিঁড়ির নিচে ফিরে এলাম আবারো। একদম ক্ষীণ একটা আওয়াজ, তবে সেটা যে মেয়েকণ্ঠ তা বুঝতে অসুবিধে হলো না। ইংরেজিতে গান গাইছে।

হয়তো কোন একটা ঘরে রেডিও বা টেলিভিশন চলছে। দ্রুত কিয়োকোর বাড়িতে পৌঁছুতে হবে। মনে মনে এই কথা বললেও গানের উৎস না খুঁজে পাওয়া পর্যন্ত শান্তি পাবো না মনে।

অনেক হয়েছে। এবারে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে আমাকে। কাজুয়া সেদিন যে রঙ্গেরই সানগ্লাস পড়ে থাকুক না কেন, লাল ইট কখনো নীল দেখাবে না…

সিঁড়ি থেকে সামনে এগোলে গানের শব্দ কমে যায়। সিঁড়ির পেছন দিকে যে কেবিনেটটা আছে সেখান থেকে সবচেয়ে জোরে শোনা যাচ্ছে গানটা।

পুরনো কাঠের কেবিনেটটা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে দেয়াল থেকে। ওটার পাল্লায় কান রাখলাম। শুনে মনে হচ্ছে কেবিনেটের পেছন থেকে গানের শব্দটা আসছে।

কেউ আছে ওপাশে। কেবিনেটটা ইচ্ছেকৃতভাবে কিছু একটা লুকোনোর জন্যে ঝোলানো হয়েছে এখানে।

কেঁপে উঠলাম একবার। কিয়োকোর বাড়িতে যাবার ইচ্ছে মরে গেছে। কেবিনেটটার ভেতরে কিছু নেই। বহনের সুবিধার জন্যে ইচ্ছেকৃতভাবে খালি রাখা হয়েছে নিশ্চয়ই।

ওটা এতই হালকা যে আমি ধাক্কা দিতেই সরে গেল। পেছনের দেয়ালে একটা গর্ত। বাড়ির অন্য দেয়ালগুলোর মতনই এখানকার দেয়ালেও সাদা ওয়ালপেপার লাগানো হয়েছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু একটা জায়গায় উঠে গেছে। ওয়ালপেপার। একজন মানুষ ভেতরে অনায়াসে ঢুকতে পারবে গর্তটা গলে। প্লাস্টার ছাড়া ইটের গাঁথুনি কোনার দিকগুলোয়।

ইটের পেছনে দরজার চৌকাঠ চোখে পড়লো। হয়তো দরজাটা ঢাকার জন্যেই সামনের ইটগুলো অদক্ষ হাতে বসানো হয়েছে। পেছনে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে। সিলিং থেকে জ্বলছে কম ওয়াটের বাতি। দেখে মনে হচ্ছে একটা বিশাল দানো মুখ হা করে রেখেছে।

গানের শব্দ এখন আরো স্পষ্ট হয়েছে। টিভি বা রেডিও না, কেউ একজন গান গাইছে নিচে।

তলকুঠুরি। ভুল দেখিনি তাহলে।

খুব সাবধানে নিচে নামতে লাগলাম। এতটাই বিচলিত যে শ্বাস নিতেও ভুলে গেছি। বুকে কেউ হাতুড়ির বাড়ি বসাচ্ছে অনবরত।

সিঁড়ির দু-পাশে নগ্ন ইটের দেয়াল। ওখানে হাত রেখে নিচে নামছি। যাতে হুমড়ি খেয়ে না পড়ে যাই।

সিঁড়ির নিচে সঁতসেঁতে গন্ধ। আর্দ্রতা ওপরের থেকে অনেক বেশি। একবার মনে হলো দম বন্ধ হয়ে যাবে। টিমটিমে আলোটা ঘরের অন্ধকার দূর করতে পারছে না।

একটা ঘরে প্রবেশ করেছি, এখানেও মৃদু আলোর একটা বা ঝুলছে। সিলিং থেকে। একটু পর পর নিভছে-জ্বলছে সেটা, যে কোন সময় চিরতরে নিভে যাবে। কোনার দিকগুলোতে পৌঁছাচ্ছে না বাটার আলো। বরং অন্ধকার আরো গাঢ় করে তুলছে মনে হলো। পেছনের দিকে কয়েকটা শেলফের অবয়ব চোখে পড়লো।

আমার ঠিক সামনে বিশাল একটা কাঠের ডেস্ক। এই ডেস্কটা খুব সম্ভবত ওয়ার্কবেঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। হাতুড়ি, করাত জাতীয় কয়েকটা যন্ত্র পড়ে আছে এলোমেলো ভাবে। অন্য যন্ত্রপাতিগুলো পুরনো হলেও একটা হাতুড়ি একদম নতুন।

স্কালপেলও দেখতে পেলাম। শেষ এরকম কিছু দেখেছিলাম হাসপাতালে, আমার অপারেশনের সময়। মৃদু আলোয় চকচক করছে স্কালপেলের ফলাটা। ডেস্কের পুরো উপরিতল জুড়ে কালচে দাগ।

ওগুলো মানুষের রক্ত, এই ভাবনাটা জোর করে মাথা থেকে দূর করে দিলাম। তেলও হতে পারে, মনে মনে বললাম।

শেলফগুলোর সামনে কয়েকটা বাক্স ভর্তি পুরনো অব্যবহৃত জিনিসপত্র। হয়তো এখানে এমন কিছু জিনিস আছে যেগুলো বাড়িটা তৈরির সময় থেকে ছিল। একটা পুরনো আমলের পেন্ডুলাম ক্লক আর ধুলোভর্তি বেবি ক্যারিজ রাখা এক পাশে।

এখনও গানের আওয়াজ ভেসে আসছে ঘরটার পেছন দিক থেকে। ওদিকটায় বাল্বের আলো পৌঁছায় না। ইংরেজি কথাগুলো বুঝতে পারছি না, তবে গানটা যে কষ্টের সে সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই। মনে হচ্ছে যেন এই বাড়ির সমগ্র অন্ধকার একীভূত হয়ে গানটা গাইছে।

একবার গায়িকার উদ্দেশ্যে কিছু বলে উঠতে চাইলাম, কিন্তু কোন আওয়াজ বেরুলো না গলা দিয়ে। আরো কিছুক্ষণ সময় নিয়ে কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, “কেউ আছেন?”

অন্ধকার যেন গিলে নিল আমার কথাটা। নীরবতা নেমে এলো গোটা তলকুঠুরিতে।

এরপর এক নারীকণ্ঠ ভেসে এলো ঘরের পেছন দিক থেকে। “কে আপনি?” উৎকণ্ঠা মিশে আছে তার গলায়।

“তুমি নিশ্চয়ই হিতোমি আইজাওয়া,” কণ্ঠস্বরটা যেদিক থেকে আসছে সেদিকে এগিয়ে বললাম।

“ও হিতোমি না।”

একটা পিলারের পাশে থমকে গেলাম।

একটা তরুণের কণ্ঠ এটা। আগের জায়গা থেকেই আসছে।

“আমি শিনিচি হিসামোতো। একটু আগে ইউকি কথা বলেছে আপনার সাথে।”

এই প্রথম শুনলাম নাম দুটো মাথায় চিন্তার ঝড় বইতে শুরু করেছে। এতদিন তো ভেবে এসেছি তলকুঠুরিতে একাই আছে হিতোমি।

“হিতোমি কোথায়?”

“ও বোধহয় ঘুমাচ্ছে। একটু আস্তে কথা বলুন,” শিনিচি বললো।

দু’জনে ফিসফিস করছে তাকের অন্য পাশ থেকে। আমি তাদের দেখতে পাচ্ছি না অন্ধকারে, কিন্তু তারা নিশ্চয়ই আমাকে দেখতে পাচ্ছে।

প্রচণ্ড অদ্ভুত একটা অনুভূতি কাজ করছে আমার ভেতরে। চেষ্টা করেও সামনে এগোতে পারছি না। এই বাটার টিমটিমে আলোর বলয় ছেড়ে ইচ্ছে করছে না যেতে। অন্য দু’জন অন্ধকারে কেন লুকিয়ে আছে কে জানে। খারাপ কিছু ভাবনা মাথায় খেলে গেল, সেগুলো সত্যি না হলেই ভালো হবে।

“আপনি নিশ্চয়ই শিওজাকির বন্ধু নন?” ইউকি জিজ্ঞেস করলো। শিওজাকিকে নিয়ে কেন কথা বলছে সে, জানি না। আপনার কণ্ঠস্বর শুনে একবার নড়ে উঠেছে ও।”

“সে… এখানে?”

“আমাদের পাশেই আছে,” শিনিচি বললো। “কথা বলার মত দশায় নেই, কিন্তু আপনার গলা শুনে গুঙিয়ে উঠেছিল।

শিওজাকি এখানেই আছে। কথা বলার মত দশায় নেই। এটা কি কোন কৌতুকশালা নাকি ভাবতে লাগলাম।

এখনও চোখে পেছনের অন্ধকারটা পুরোপুরি সয়ে আসেনি, তাই তাদের দেখতে পাচ্ছি না। নিচু সিলিংয়ের কারণে দমবন্ধ লাগছে। আমার বোধহয় ক্লস্টোফোবিয়া আছে।

পাশে সিলিং থেকে কিছু জিনিস ঝুলছে। কয়েকটা মাছ ধরার বর্শি। ওগুলোর মাথায় শুকনো কিসব লেগে আছে।

“শিওজাকি কথা বলতে পারছে না কেন?” জিজ্ঞেস করলাম।

“দু’হাতে হাঁটু জড়িয়ে ধরে বসে আছে সে। পুরো শরীরে কয়েকটা শিক বিধাননা। একটা শিক বোধহয় ফুসফুস ফুটো করে বেরিয়ে গেছে। এখনও বেঁচে আছে অবশ্য।”

“সেটা কি করে সম্ভব?” কম্পিত স্বরে জিজ্ঞেস করলাম। বিশাল কিছু একটা নড়ে ওঠার শব্দ কানে এলো।

“সম্ভব। কারণটা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে,” অনিশ্চিত কণ্ঠে বললো শিনিচি। “দয়া করে আস্তে কথা বলুন।

এই সময় একটা তাক নড়ে উঠলো। যেন কিছু একটা ধাক্কা দিয়েছে সেটাকে। একটা বাক্স ওপর থেকে পড়ে গেল নিচে।

মুখে হাত দিয়ে পিছিয়ে এলাম।

তাকটা নড়ার ফলে বাল্বের আলো শিনিচি আর ইউকির ওপর গিয়ে পড়েলো এক মুহূর্তের জন্যে।

নিশ্চয়ই ভুল দেখেছি। মাথা খারাপ হয়ে গেছে আমার। নিজেকে প্রবোধ দিলাম।

“চেহারা এরকম করবেন না প্লিজ,” দুঃখী কণ্ঠে বললো ইউকি।

“আপনাকে দেখতে পাচ্ছি আমরা।

“কেন…” কথাটা শেষ করতে পারলাম না। কেউ যেন ভেতর থেকে সব শক্তি শুষে নিয়েছে আমার। এখান থেকে এখনও পালাইনি কারণ এক কদম পা ফেলার শক্তি নেই।

“আমাদের সার্জারি করা হয়েছে।”

“সার্জারি?”

“এখানকার সবাইকে ছোটখাটো সার্জারির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। ভালো সার্জারি। এরপর চিরতরে বন্দী করে রাখা হয়। তবে জেনে অবাক হবেন, কোন ব্যথা অনুভব করি না আমরা,” এটুকু বলে কিছুক্ষণ চুপ থাকলো ইউকি। “আপনিও কি তলকুঠুরির নতুন বাসিন্দা?”

তলকুঠুরির নতুন বাসিন্দা বলতে কি বোঝাচ্ছে? জানতে চাইছে যে আমাকেও অপহরণ করে আনা হয়েছে কিনা?

“আপনাদের উদ্ধার করতে এসেছি আমি,” অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বললাম। “হিতোমি কোথায়?”

আগে এখান থেকে বেড়াতে হবে আমাকে-এখনই। এখানে আর এক মুহূর্ত থাকলে পাগল হয়ে যাবো। এখানকার অস্ফুট আঁধারে দম বন্ধ হয়ে যাবে। ওপরে আলোর স্পর্শে হয়তো কিছুটা স্বস্তি ফিরে পাবো। তখন সাহায্য নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব ফিরে আসবো। শিনিচি আর ইউকির শরীর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

“হিতোমি বাচ্চাদের ক্যারিজটায় আছে। ওটাই ওর বিছানা,” শিনিচি বললো।

অন্ধকারের দিক থেকে মনোযোগ না সরিয়ে ক্যারিজটার দিকে এগোলাম। পুরনো, ছোট্ট একটা ক্যারিজ। কাপড়গুলো মলিন হয়ে গেছে। হাতলে ঝুল। ওপরে একটা কম্বল দিয়ে ঢাকা দেয়ায় ভেতরে কি আছে দেখতে পাচ্ছি না।

কান্নার দমকে কেঁপে উঠলো আমার শরীর। হিতোমিকে যখন অপহরণ করা হয় তখন তার বয়স ছিল চৌদ্দ। এখন তার বয়স পনেরো। কোন দক্ষ অ্যাক্রোব্যাটের পক্ষেও এটুকু জায়গায় পা ভাজ করে থাকা সম্ভব না।

কাঁপা কাঁপা হাতে কম্বলটা সরালাম।

ভেতরে একটা মেয়ে ঘুমোচ্ছে। তার শরীরটা এতই ঘোট যে একহাতে ভোলা যাবে। গাল দুটো ভয়ানক রকমের ফ্যাকাসে। শিরাগুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। লম্বা চুলগুলো অনেকদিন ধোয়া হয়নি।

চেহারায় আলো পড়ায় ঘুম ভেঙে গেল তার। ধীরে ধীরে চোখ খুললো। আমাকে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক একটা চাহনি ভর করলো চেহারায়। যেন স্বপ্ন দেখছে এমন ভঙ্গিতে হেসে উঠলো পরমুহূর্তে।

“হ্যালো,” বললো সে।

কেঁদে ফেললাম। একটা কাপড়ের ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে তার গলা থেকে শরীরের নিচের অংশটুকু।

“কে…” মিষ্টি কণ্ঠে বললো হিতোমি। “কে আপনি? আপনাকেও কি এখানে নিয়ে আসা হয়েছে?”

না। মাথা ঝাঁকালাম। বলতে ইচ্ছে করছে যে ওকে উদ্ধার করতে এসেছি, কিন্তু শব্দ বেরুচ্ছে না গলা দিয়ে।

“আপনাকেও কি গাড়িতে করে এখানে আনা হয়েছে? কালো পাখিটা দেখেছেন? এখনও স্বপ্নে মাঝে মাঝে দেখি ওটাকে।”

“হ্যাঁ, দেখেছি কাকটাকে। ছাদে বসে ছিল।”

“কি? আরে নাহ। আমি চাবির রিংয়ের কথা বলছি। গাড়ি চলার সময় দোল খায় ওটা।”

দোল খায়?

“তিনি অবশ্য নতুন একটা গাড়ি কেনার কথা বলেছিলেন। কিন্তু চাবির রিংটা তো খুবই পছন্দের ছিল তার। তাই ভেবেছি নতুন গাড়িতেও একই রিং ব্যবহার করবেন।”

হিতোমিকে রেখেই সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার জন্যে ঘুরলাম। কিন্তু কেউ একজন নেমে আসছে সেদিক দিয়ে। সুমিদা।

“তুমি এইখানে!” বললো সে। তার সামনে গিয়ে জোরে গাল বরাবর সর্বশক্তিতে থাপ্পড় কষিয়ে দিলাম।

“এসব আপনার কীর্তি!”

একবারের জন্যেও চোখের পলক পড়লো না তার। হিতোমি যে চাবির রিংটার কথা বলছে সেটা আমিও দেখেছি। সুমিদার গাড়িতে।

.

১০

রূপকথার গল্পকার

বনের ভেতর দিয়ে আগন্তুকের পেছন পেছন ছুটছে মিকি। কিছুদূর সামনে যেতেই দেবদারু গাছগুলো চোখে পড়লো।

হঠাৎই দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল আগন্তুক। পরক্ষণে তাকে ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে দেখলো সে। সামনেই একটা রাস্তা।

গাড়ির টায়ারের শব্দ কানে এলো। আগন্তুককে গুঁতো দিয়েছে গাড়িটা। একটা গাছের পেছন থেকে দৃশ্যটা দেখছে মিকি।

গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো ড্রাইভার। একজন মাঝবয়সী লোক। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলে যে কেউ আছে কিনা। এরপর গাড়িতে উঠে চলে গেল।

নিথর পড়ে আছে আগন্তুকের দেহটা।

.

১১

আমার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে হিতোমির দিকে এগোলো সুমিদা। ধীরে আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে নড়ছে সে। যেন একটা বিড়াল।

পাশে সরে দাঁড়ালাম আমি।

ক্যারিজটা একবার হাত দিয়ে দোলালো সুমিদা। “কেমন আছো?” হিতোমিকে জিজ্ঞেস করলো সে।

“মোটামুটি,” চোখ বন্ধ করে জবাব দিল মেয়েটা।

“শিওজাকি তাহলে অপহরণকারী না,” বললাম আমি।

বারবার মনে হচ্ছে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে সুমিদা। এখনও গোটা পরিস্থিতিটা পরিষ্কার না আমার কাছে। এসময় একটা কথা মনে হলো।

“আপনি জানতেন লাইটের সুইচটা কোথায়।”

অন্ধকারে অচেনা একটা বাড়িতে ঢুকেই সুইচ খুঁজে পেয়েছিল সুমিদা। এখন আর ব্যাপারটা কাকতালীয় মনে হচ্ছে না। বাড়িটা খুব ভালোমতন চেনা তার।

“কয়েকদিন আগে এখানে এসেছিলাম আমি, গত কয়েক মাসের মধ্যে প্রথমবারের মতন,” ক্যারিজ থেকে হাত না সরিয়েই বললো সুমিদা। ক্যাফেতে আমার সাথে যে স্বরে কথা বলে, এখনও সেভাবেই কথা বলছে সে। “তার আগে শিওজাকির কোটটা ফেরত দিতে এসেছিলাম আমরা দু’জন। ফেরার পথে কি বলেছিলে, মনে আছে?”

বলেছিলাম যে শিওজাকি দেয়াল ঠিক করার জিনিসপত্র কিনেছে। কিন্তু বাড়িটায় কোন ভাঙা দেয়াল চোখে পড়েনি আমার।

“আমিও সেটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু একটা দেয়ালে আসলেই ফাটল ধরেছিল। তলকুঠুরিটা লুকোনোর জন্যে আমার তৈরি করা দেয়ালটা। সেটা শিওজাকির চোখে পড়েছিল, কিন্তু সেটার সামনে কেবিনেট থাকায় খুব একটা মাথা ঘামায়নি।”

“কেবিনেট?”

মাথা নাড়লো সুমিদা। “দেয়ালটা লুকোনোর জন্যে আমি কেবিনেটটা আনি এখানে। শিওজাকি জানতোও না যে একটা তলকুঠুরি আছে এই বাড়িতে। কিন্তু ভূমিকম্পের কারণে দেয়ালটায় ফাটল ধরে। ইউকির গানের আওয়াজ শুনতে পায় সে। শিওজাকি নিজেই কথাটা বলেছিল আমাকে। ইউকির সাথে কথা হয়েছে তোমার?”

ঘরের পেছন দিকটায় নির্দেশ করলো সে।

“শিওজাকি তাহলে দেখে ফেলেছিল তলকুঠুরিটা?”

সুমিদা বললো যে দেয়ালটা ভেঙে ফেলার ইচ্ছে ছিল শিওজাকির। সেজন্যেই নতুন হাতুড়িটা কিনেছিল।

“সে যেহেতু সবকিছু জেনে ফেলে, তাই ঐ অবস্থা করেছেন…” ঘরের পেছন দিকে তাকালাম আবারো। কিছু দেখতে পাচ্ছি না ঠিকই, কিন্তু শিওজাকি যে সেখানে আছে, এটা জানি।

“শিওজাকি কে?” নিষ্পাপ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো হিতোমি।

“আমি চলে যাবার পর এই বাসাটায় ওঠে যে,” সুমিদা বললো। “যাকে কয়েকদিন আগে এখানে নিয়ে এসেছি।”

“ওহ শিক কাবাব লোকটা,” যেন মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বললো হিতোমি।

তলকুঠুরির সব নিয়ম কানুনই যেন ওপরের পৃথিবী থেকে ভিন্ন। জানি এখনও অজ্ঞান হয়ে যাইনি কেন। নিচু সিলিং আর গুমোট অন্ধকারের কারণে মাথা ঘুরাচ্ছে।

“তিন দিন আগে নিজের হাতে এক বছর আগে গড়া দেয়ালটা ভাঙ্গি আমি। ভাবিনি যে তুমি এখানে নিজ থেকেই আসবে।”

এটুকু বলে আমার দিকে এক পা এগোয় সুমিদা।

“কাছে আসবেন না!” চেঁচিয়ে উঠলাম বদ্ধ ঘরটায়।

থেমে গেল সে। “

আপনি এখানে থাকতেন?”

মাথা নেড়ে সুমিদা বললো যে এক বছর আগ অবধি এখানেই থাকতো সে। এই ঘরটাতেই হিতোমির হাত পা কেটে আলাদা করা হয়।

“চলে যাবার আগে ইট দিয়ে তলকুঠুরির জানালাটাও ঢেকে দেই।”

তলকুঠুরির জানালা।

“বাইরের প্ল্যান্টারটা আপনার তৈরি করা, তাই না?”

“অনেকগুলো আগে থেকেই ছিল। আমি কেবল একটা যোগ করেছি।”

আমি যে মরা গাছগুলো দেখেছি বাইরে ওগুলো অন্য কোথাও থেকে এনে ওখানে গেড়েছিল সুমিদা। এক বছরের ব্যবধানে মরে গেছে। সবগুলো।

কিন্তু বাঁ চোখের স্মৃতিতে তো দু’মাস আগে এই বাড়িতে উঁকি দিতে দেখি আমি কাজুয়াকে। তখন শিওজাকি এখানে থাকতো? হিসেব মিলছে না।

“আপনি বলেছিলেন যে এক বছর আগে কাজুয়ার সাথে পরিচয় হয়েছিল। সেটা সত্যি?।”

“ও একজন আগন্তুক ছিল।”

“আগন্তুক?”

“যারা আমার ব্যাপারে নাক গলাতে আসে তাদের এই নামেই ডাকি আমি। মিঃ হিসামোতোও আমার পুরনো বাড়িটার আশেপাশে ছোঁকছোঁক করতো।”

“কাজুয়াকে তলকুঠুরির জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিতে দেখেন আপনি?”

“হ্যাঁ, এক বছর আগে,” মাথা নেড়ে বলে সুমিদা।

মুখে হাত চাপা দিয়ে গুঙিয়ে উঠলাম। আমার বাঁ চোখে দেখা স্মৃতিটা তাহলে দুমাস না, এক বছর আগের।

স্মৃতিটায় দেখেছিলাম কাজুয়াকে একটা গাড়ি ধাক্কা দিয়েছে। আসলে তখনই মারা যায়নি সে। কিন্তু ড্রাইভার হয়তো ভাবে যে মারা গেছে, তাই পালিয়ে যায় সেখান থেকে। স্বপ্নগুলোয় কোন শব্দ শুনতে পাই না আমি, তাই বুঝতে পারিনি।

এ কারণেই ঐ দেয়ালের ব্যাপারটা আমাকে বিভ্রান্ত করে তুলেছিল। আসলে দু’টো সম্পূর্ণ ভিন্ন জায়গা।

আমার দিকে আরেক পা এগিয়ে এলো সুমিদা। মাথা ঝাঁকিয়ে পিছিয়ে গেলাম আমি।

“এক বছর আগে কাজুয়াকে জানালাটা দিয়ে উঁকি দিতে দেখি আমি। এর এক সপ্তাহ আগে থেকে আমার মনে হচ্ছিল যে কেউ একজন নজর রাখছে বাড়িটার ওপর। তুমি এখানে হিতোমির খোঁজে এসেছো কারণ কাজুয়া তোমাকে ওর কথা বলেছিল, তাই না?”

দু’চোখ হাত দিয়ে ঢেকে ফেললাম। তবুও তার কথাগুলো শুনতে পাচ্ছি।

“একটুর জন্যে আমার হাত ফসকে বেড়িয়ে যায় কাজুয়া। কিন্তু পালানোর সময় একটা গাড়ি গুতো দেয় তাকে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। কাপুরুষ ড্রাইভারটা সে মরে গেছে ভেবে পালিয়ে যায়।”

আরেক পা এগোলো সে।

“এরপরেই সমস্যার শুরু। তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না। জ্ঞান ফিরে পাবার পর সব ভুলে যায় কাজুয়া। আমাকে বা এই বাড়িটাকে চিনতে পারছিল না। আসলে কয়েক সপ্তাহের স্মৃতি মুছে গিয়েছিল তার মাথা থেকে।”

অ্যামনেশিয়া। এটাই একমাত্র ব্যাখ্যা। প্রচণ্ড ভয়ের কারণে ঠিকমতো কিছু ভাবতে পারছি না, কিন্তু এটুকু বুঝতে অসুবিধে হলো না।

“ওকে মারিনি আমি। এখানেও আনিনি।”

“কেন?”

“জানি না কেন, কিছুক্ষণ ভাবার পর বললো সুমিদা। “ঝুঁকি নিয়েছিলাম বলতে পারো।”

“এরপর আগন্তুককে ক্যাফেতে নিয়ে যান তিনি,” হিতোমি বললো প্রফুল্ল কণ্ঠে।

সাওরির সাথে সুমিদার দেখা হয় এক বছর আগে। সে ভেবেছিল মাতাল কাজুয়াকে মেলানকলি গ্রোভে নিয়ে এসেছে সুমিদা। কাজুয়ার আসলে হুশ ছিল না তখন। গোটা ব্যাপারটাই সাজানো।

এরপর কাজুয়ার সাথে বন্ধুর মত সময় কাটাতে শুরু করে সুমিদা।

আমার একদম কাছে চলে এসেছে সে। তার রোগাটে শরীরে খুব বেশি শক্তি ধরে বলে মনে হয় না। কিন্তু আমার মুখ বন্ধ করার জন্যে সেই শক্তিটুকুই যথেষ্ট।

দমবন্ধ করা নিস্তব্ধতা নেমে এলো তলকুঠুরিতে। শ্বাস নিতেও ভয় পাচ্ছি। সুমিদাকে ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে এখন। তার চেহারা কিন্তু ঠিকই আছে। তবে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন বিশ্লেষণ করছে কোন কিছু।

“ঐ ঘটনার পরেই এই বাড়িটা ছেড়ে দিয়ে স্টেশনের পাশের ঐ অ্যাপার্টমেন্টটায় গিয়ে উঠি। এর আগে তলকুঠুরিটার ব্যবস্থা করে ফেলি অবশ্য।”

সুমিদার কথা বলা শেষ হলেই কি আমার সময় ফুরিয়ে যাবে? হাত পা নাড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম যে আমার মধ্যে এখনও দৌড়ে পালানোর শক্তি অবশিষ্ট আছে কিনা।

“কিন্তু একটা ব্যাপার খুব বেশি অদ্ভুত,” বললাম আমি। “আপনি তো এক বছর ধরে এখানে নেই। তা সত্ত্বেও হিতোমিরা বেঁচে আছে কিভাবে?”

“ক্ষুধা বলে কিছু নেই ওদের। ক্ষতগুলো কখনো শুকাবে না। এরকমই থাকবে সারাজীবন। সময় থেমে গেছে এখানকার অধিবাসীদের। ইচ্ছেমতন গান গাইতে পারবে, কথা বলতে পারবে। তলকুঠুরির দরজার সামনে দেয়ালটা তোলার আগে একটা নতুন বাল্ব এনে এখানে লাগিয়ে দেই। আমি।

প্রায় নিভে যাওয়া বাটার দিকে একবার তাকালো সুমিদা।

“এভাবে কিছু না করে থাকা যায় নাকি,” হিতোমি বললো।

যা করার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই করতে হবে আমাকে। এরপরে আর সুযোগ পাবো না। ভেতরে ভেতরে প্রার্থনা করতে লাগলাম।

“আর সাওরি? তার ব্যাপারে কি মন্তব্য আপনার? ঘটনার পরেও নিয়মিত মেলানকলি গ্রোভে কেন যেতেন? তাকে মনে ধরেছিল?”

ও আমার দিকে তাকালো সে। প্রশ্নগুলোর জবাব দিল না। কিন্তু সেই মুহূর্তে তার ব্যাপারে নতুন একটা জিনিস জানতে পারলাম।

আমার আরো কাছে চলে এলো সুমিদা। প্রচণ্ড ভয় লাগছে। আর সেই ভয় থেকেই কাজটা করলাম। কাঁধ দিয়ে জোরে ধাক্কা দিলাম সুমিদাকে। ঘরের পেছন থেকে অনেকগুলো কণ্ঠ একসাথে কথা বলে উঠলো যেন।

এত জোরে ধাক্কা দিয়েছি যে আমি নিজেও তাল হারিয়ে ফেললাম।

কিন্তু সুমিদার অবস্থা সঙ্গিন। পেছনে ঝুলানো বৰ্শিগুলো তার জামায় পেঁচিয়ে গেছে।

দৌড় দিলাম। জানি যে খুব দ্রুত পিছু নিবে সে।

সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলাম। নামার সময় খুব বেশি ধাপ মনে হয়নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অনন্তকাল পেরিয়ে যাবার পরেও সিঁড়ির মাথায় পৌঁছতে পারবো না। তবে এক সময় ঠিকই বেরিয়ে এলাম বাইরে। হয়তো আমার কাছে কয়েক সেকেন্ডকেই অনেক বেশি লম্বা মনে হচ্ছিল ভেতরে।

সামনের দরজার উদ্দেশ্যে দৌড় দিলাম। বেশি সময় লাগলো না কালো দরজাটার সামনে পৌঁছুতে। ওটার নব ধরে মোচড় দিলাম। কিন্তু খুব বেশিদূর খুললো না দরজাটা। বারবার চেষ্টা করেও কোন লাভ হলো না। এসময় খেয়াল করলাম একটা এক্সটেনশন কর্ড পেঁচিয়ে রাখা হয়েছে নবের সাথে। অনেক সময় লাগবে এটা খুলতে।

সুমিদার কাজ।

পেছনের দরজাটার কথা মনে হলো এসময়। আবারও হলওয়ে ধরে ছুটে চললাম। সিঁড়ি পেরিয়ে একটু সামনে গিয়েছি এসময় কিছু একটায় পা বেঝে পড়ে গেলাম। সুমিদা যে আড়াল থেকে পা বাড়িয়ে দিয়েছে তা টের পাইনি। একটা ঘরের খোলা দরজার সাথে ধাক্কা খেলাম, কিন্তু কোন ব্যথা পেলাম না। যেন বালিশের সাথে ধাক্কা লেগেছে।

দৌড়াতে পারবো ভেবে উঠতে যাবো এসময় চোখে পড়লো ব্যাপারটা। আমার ডান পাটা ঘুরে গেছে বিপরীত দিকে। কিন্তু ব্যথার বদলে এক ধরনের আরামদায়ক উষ্ণতা অনুভব করছি সেখানে।

আমার শরীরে কি ঘটছে বুঝে উঠতে পারলাম না। ভয়ের কারণে বোধহয় সাময়িক ব্যথার অনুভূতি লোপ পেয়েছে।

সুমিদা দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। গালে কাটা দাগ। নিশ্চয়ই একটা বর্শি বিধে গেছিল সেখানে। পরনের জামাটাও কয়েক জায়গায় ছেঁড়া। হাচড়ে পাঁচড়ে নিজেকে ছাড়িয়ে এনেছে।

পকেট থেকে ছোট ছুরিটা বের করলাম। আমার হাত কাঁপছে। এত ছোট ছুরি দিয়ে কিছু হবে কিনা জানি না, কিন্তু এটা ছাড়া আর কোন অস্ত্র নেই আমার কাছে।

ছুরিটা খোলা মাত্র আমার হাতে জোরে লাথি কষালো সুমিদা। এবারেও কোন ব্যথা অনুভব করলাম না। মনে হলো কেউ আলতো করে সামনে থেকে সরিয়ে দিয়েছে হাতটা।

পড়ে যাওয়া ছুরিটা তুলে নিল সুমিদা। আমি বুঝছি যে পালানো উচিৎ কিন্তু নড়তে পারছি না।

এর পরের কয়েকটা মুহূর্তে কি ঘটলো ঠিক ধরতে পারলাম না। কিছুক্ষণ পর আবিষ্কার করলাম ছুরি ধরা হাতটা আমার পেটের কাছে ঠেসে রেখেছে সুমিদা। হাত দিয়ে তাকে সরাতে গিয়ে বুঝলাম হাতটা নড়ছে না। একদৃষ্টিতে আমার পেটের দিকে তাকিয়ে আছে সুমিদা। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে এবার আমিও তাকালাম। শার্টটা ছিঁড়ে গেছে। ছুরির ফলাটা ঢুকে আছে আমার পেটের ভেতরে। ক্ষতস্থানের চারিদিকে লাল রক্ত, তবে পরিমাণ খুব বেশি না।

একটা অদ্ভুত জিনিস ঝুলছে ক্ষতস্থান থেকে। দেখতে অনেকটা সদ্য জন্মানো বাচ্চাদের নাড়ির মতন।

সুমিদার হাতের দিকে তাকালাম। লাল হয়ে আছে ওদুটো। আমার পেটের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিল সে। নাড়িটা টেনে বের করার জন্যে বোধহয়।

সেই মুহূর্তে চিন্তা চেতনা লোপ পায়নি এর একমাত্র কারণ আমার মনে হচ্ছিল অন্য কারো পেটের দিকে তাকিয়ে আছি। পেট থেকে যে জিনিসটা বেরিয়ে আছে, সেটা অন্য কারো। ডান হাত দিয়ে নাড়িটা ধরলাম, এখনও উষ্ণ।

হাতের স্পর্শ পাওয়া মাত্র এক অবর্ণনীয় সুখে ছেয়ে উঠলো গোটা শরীর। তলকুঠুরির বাসিন্দারা কেন সুমিদাকে ভয় পায় না এটা পরিষ্কার এখন। মনে হচ্ছে যেন আরামদায়ক উষ্ণ পানিতে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছি।

দূর থেকে সুমিদার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।

পালাবার পথ নেই।

ক্ষতস্থান থেকে থকথকে কি যেন বেরিয়ে এলো। হাত সরিয়ে নিলাম দ্রুত। আমার ভেতরের একটা অংশ এই নিগূঢ় আনন্দের বিরোধীতা করছে অনেকক্ষণ যাবত।

হঠাৎই নিজের শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেলাম। সুমিদা হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরার চেষ্টা করেও পারলো না। পাশের ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। কিন্তু তালা দেয়ার জন্যে নব খুঁজতে গিয়ে দেখি কোন নব নেই। জানালার দিকে এগিয়ে গেলাম। একটা পায়ে সবকিছু করতে হচ্ছে। অন্য পাটা সম্পূর্ণ অচল।

পেছনে দরজা খুলে গেল এই সময়। সুমিদা এসে পড়েছে আবারো। সে জানে যে পালাতে পারবো না আমি। শান্ত দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো কি করি।

জানালাটা খুলতে খুব বেশি বেগ পেতে হলো না। এটাও যদি শক্ত করে আটকানো থাকতো, তাহলে ভাঙার চেষ্টা করতে হতো আমাকে। চারকোনা জায়গাটা দিয়ে বাইরে মাথা গলিয়ে দিলাম। উপুড় হয়ে পড়লাম মাটিতে। এভাবে পড়ার কারণে ভেতর থেকে সমস্ত বাতাস বেরিয়ে গেল। তবে এখনও কোন ব্যথা অনুভব করতে পারছি না।

মাটিতে শুয়ে থাকা অবস্থায় বুঝতে পারলাম একটা প্ল্যান্টারের পাশে পড়েছি। আমার চোখের সামনেই তলকুঠুরির জানালা ঢেকে দেয়া নীল ইটের ছোট দেয়াল। এখানেই এসেছিল এক বছর আগে কাজুয়া। ঈশ্বর বোধহয় আজ আমার সাথে কৌতকে মেতে ওঠার পণ করেছেন।

কিছুক্ষণ পর সুমিদা বাইরে বেরিয়ে এলো জানালা দিয়ে।

উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই আমার। “এসব কেন করেন?” মাটি থেকেই জিজ্ঞেস করলাম তার উদ্দেশ্যে।

“জানি না,” সুমিদাকে দেখে মনে হচ্ছে এই প্রশ্নটার উত্তর কখনো খোঁজার চেষ্টা করেনি সে। “এমনটা না যে মানুষ মারতে ভালো লাগে আমার। কিন্তু তাদের মুখ বন্ধ করার জন্যে মারতে হয়।”

বুকে ভর দিয়ে সামনে এগোনোর চেষ্টা করলাম। আমার বাম হাতের আঙুলগুলোয় কোন সাড়া নেই। কিন্তু কনুই অবধি নাড়াতে পারছি। বাম পা দিয়ে মাটিতে ঠেলা দিয়ে সামনে এগোলাম কিছুটা। ডান পা কাজ করছে না।

মাটিতে এভাবে পড়ে থাকলে ঠান্ডা অনুভব করার কথা, কিন্তু সেরকম কিছু হলো না। শুধু ধুলোবালির অস্বস্তিকর উপস্থিতি টের পাচ্ছি। পেট থেকে নাড়ি বেড়িয়ে আছে সেটা না ভাবার চেষ্টা করলাম।

সুমিদা আমার পাশে পাশে হাঁটছে। আমার দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে, এটা বুঝতে পারছি।

“দু’মাস আগে কাজুয়া কি আসলেও দুর্ঘটনায় মারা গেছে?” মাটির দিক থেকে মাথা না তুলেই জিজ্ঞেস করলাম।

আমার মনে ক্ষীণ আশা যে যতক্ষণ এভাবে কথা বলবো, আমাকে মারবে না সুমিদা।

হাতে ভর দিয়ে আর মাথা উঁচু করে রাখা সম্ভব হলো না। মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়লাম।

“এমনভাবে সব সাজিয়েছি যেন দেখে মনে হয় দুর্ঘটনা।”

আমার পেট থেকে বের হয়ে থাকা লম্বা সরু জিনিসটায় পা রাখলো সুমিদা। সামনে এগোচ্ছি এখনও। এটা বুঝতে পারছি যে পেট থেকে এখনও বের হয়ে আসছে ওটা। শব্দও শুনতে পাচ্ছি।

“চোখে কাপড় বেঁধে হাত পা ভেঙে দেই প্রথমে। এরপর একটা ঢালের ওপর থেকে গাড়ির সামনে ছেড়ে দিইয়েছিলাম।”

সুমিদা বললো যে কাজুয়াকে ধাক্কা দেয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে চোখের কাপড়টা সরিয়ে নেয় সে। কাজয়া বুঝতে পারে না যে তার হাত পাগুলো কেন কাজ করছে না।

বাড়িটায় এক কোনায় পৌঁছে গেছি আমি। ভালো হাতটা দিয়ে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম সেখানকার দেয়াল।

আমার নাড়ি কত লম্বা? হাতে ভর দিয়েই এতদূর এসেছি। মাটিতে আমার দেহ ছেচড়ানোর দাগ। সুমিদা এখনও পা দিয়ে চেপে রেখেছে। আমার নাড়ির এক প্রান্ত।

এটুকু এসে সামনে এগোনো থামিয়ে দিলাম। খুব কসরত করে উঠে বসে দেয়ালে হেলান দিলাম। এরপর ধুলো আর চোখের পানিতে একাকার চেহারাটা সুমিদার দিকে ঘুরিয়ে বললাম, “এরকম একটা কাজ কেন করলেন?”

“কাজুয়ার স্মৃতি ফিরে আসতে শুরু করেছিল। একবারে না, ধীরে ধীরে।

সুমিদা তাহলে ভয় পেয়ে গেছিল যে কাজুয়ার সব মনে পড়ে যাবে। এজন্যেই তাকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়াটা জরুরি হয়ে পড়েছিল তার জন্যে।

আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সুমিদা। মাটিতে বসে থাকায় তাকে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি লম্বা দেখাচ্ছে। “যথেষ্ট হয়েছে, নাকি?” যেন কোন ছোট বাচ্চার সাথে কথা বলছে এমন ভঙ্গিতে বললো সে। “তোমার ভাগ্য খারাপ দেখে তলকুঠুরিটা খুঁজে পেয়েছে।”

নিচু হয়ে আমার গলায় হাত রাখলো সুমিদা। ওর মুখটা আমার মুখ থেকে একটু দূরে এখন।

“কোন কষ্ট হবে না। ঘাড় মটকানোয় দক্ষ হয়ে গেছি আমি।”

ধীরে ধীরে ডান হাতটা সরিয়ে আনছি। আমি যেখানে বসে আছি তার পাশেই একটা ড্রেন। ভেতরে শুকনো, মরা পাতা। জিনিসটা আগের জায়গাতেই আছে তাহলে।

“ভুল বললেন,” কান্না চেপে বললাম। “আমার ভাগ্য খারাপ না। আপনাকে খুঁজে পাবার কথা বলেই পেয়েছি।”

শরীরের শেষ শক্তিটুকু জড়ো করে জিনিসটা সুমিদার ভেতরে সেঁধিয়ে দিলাম। এক বছর ধরে এই মুহূর্তটারই অপেক্ষায় ছিল কাজুয়ার স্ক্রু ড্রাইভারটা।

.

১২

রূপকথার রচয়িতা

অচেতন ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেল মিকি। খুবে বেশি ব্যথা পায়নি বলেই মনে হচ্ছে।

তাকে মেরে ফেলবে নাকি তলকুঠুরিতে নিয়ে যাবে সেই সিদ্ধান্ত দ্রুত নিতে হবে মিকিকে।

এমন সময় গুঙিয়ে উঠলো ছেলেটা। এর আগেরদিন যখন মিকির বাসায় এসেছিল সে, চোখে ব্যান্ডেজ বাঁধা ছিল। এখন ব্যান্ডেজটা নেই।

এক চোখ হালকা খুললো ছেলেটা। বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকালো মিকির দিকে।

মিকি জানে যে এখান দিয়ে অন্য কেউ যাবার আগেই ছেলেটার ভবলীলা সাঙ্গ করে দিতে হবে তাকে। সেই কাজের প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন সময় কথা বলে উঠলো কাজুয়া, “আমি… আমি কোথায়?”

তাকে টেনে রাস্তার একপাশে নিয়ে এলো মিকি। কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলো। ছেলেটার শেষ স্মৃতি হচ্ছে একটা ক্যাফেতে বসে কফির অর্ডার দেয়া।

“আপনার নাম কি?” জিজ্ঞেস করলো ছেলেটা।

“সেটা না জানলেও চলবে।”

যেন স্বপ্ন দেখছে এমন ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো ছেলেটা।

এখনও হাতুড়িটা ধরে রেখেছে মিকি। ওটা ওপরে উঠালো সে। মাথায় জোরে একটা বাড়ি দিলেই মারা যাবে ছেলেটা।

ছেলেটা বারবার জ্ঞান হারাতে গিয়েও হারাচ্ছে না। “আমাকে… আমাকে মেলানকলি গ্রোভে পৌঁছে দিতে পারবেন?” কিছুক্ষণ পর ক্ষীণকণ্ঠে বললো সে।

মিকি সিদ্ধান্ত নিল ছেলেটাকে মারবে না সে। যদি আসলেও স্মৃতি হারিয়ে ফেলে তাহলে অযথা মারার কোন দরকার নেই। তাছাড়া সব প্রমাণ মুছে ফেলা সহজ হবে না। ছেলেটার মৃতদেহ রাস্তার পাশেই ফেলে রেখে যেতে হবে, অথবা বাড়িতে টেনে নিয়ে যেতে হবে। দুটোই বিরক্তিকর।

হাতুড়িটা পাশের ঝোপে ছুঁড়ে ফেলে ছেলেটাকে উঠিয়ে ক্যাফের দিকে রওনা হয়ে যায় সে। এর আগে কখনো ভেতরে না গেলেও বাইরে থেকে জায়গাটা দেখেছে মিকি।

মেলানকলি গ্রোভে পৌঁছুতে পৌঁছুতে রাত হয়ে যায়। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো অনেক দূরে দূরে। তাই ক্যাফেটাকে দেখে মনে হয় যেন শূন্যে ঝুলছে।

ওখানে পৌঁছানোর আগেই হুশ হারিয়ে ফেলে ছেলেটা। মিকি কাঁধে করে তাকে দরজার সামনে নিয়ে যায়।

“কাজুয়া!” বলে দৌড়ে আসে কাউন্টারের পেছনে বসে থাকা যুবতী।

একটা চেয়ারে তাকে বসিয়ে দেয় মিকি।

“আমি দুঃখিত যে আমার ভাইয়ের কারণে আপনাকে এত কষ্ট করতে হলো,” বারবার ওর উদ্দেশ্যে বলতে থাকে মেয়েটা।

মিকি তাকে বলে যে মাতাল হয়ে রাস্তায় পড়ে ছিল কাজুয়া। ভাইয়ের শরীর থেকে অ্যালকোহলের গন্ধ না পেলেও এ নিয়ে আর কথা বাড়ায়নি সাওরি।

“মাথায় ব্যথা পেয়েছে ও,” বলে সে। “ফুলে গেছে।”

মিকি বলে যে ক্যাফেতে আসার সময় রাস্তায় জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায় কাজুয়া। তখনই ব্যথা পেয়েছে।

আশপাশে তাকিয়ে অন্য কোন খদ্দের চোখে পড়েনা মিকির। সাওরি যে ক্যাফের মালিক না সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না তার। এত কম বয়সে এরকম একটা জায়গায় ক্যাফে খোলার কথা না কারো।

কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে মিকি। পেছন থেকে তাকে ডাক দেয় যুবতী, কিন্তু না শোনার ভান করে সে।

অন্ধকার রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় অচেতন ছেলেটাকে নিয়ে ভাবতে থাকে সে। কাউন্টারের পেছনে বসে থাকা যুবতাঁকে নিয়েও ভাবে। ছোটবেলায় সিঁড়ি থেকে পড়ে মারা যায় মিকির এক বান্ধবী। যুবতীর চেহারাটা একদম তার মতন।

এসময় সে খেয়াল করে যে পকেটে থাকা জিনিসটা আনমনেই নাড়াচাড়া করছে এক হাতে-একটা সোনালি রঙের ঘড়ি। মিকির বাড়ির বাইরে ঘোরাফেরার সময় হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল বোধহয় ওটা।

থমকে দাঁড়ায় সে। এটা ফেরত দেয়ার কোন দরকার নেই।

কিন্তু কিছুক্ষণ পর তাকে দেখা যায় ক্যাফের ভেতরে ঢুকছে।

সে যতটুকু ভেবেছিল, তার চেয়েও বেশি খুশি হয় যুবতী ঘড়িটা দেখে। “এটা দেয়ার জন্যে এতদূর ফিরে এসেছেন! আপনার নাম কি?” আন্তরিক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে সে।

একদম ওর মতো চেহারা।

নিজের আসল নামটা বলে মিকি।

“আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, সুমিদা,” বলে ঘড়িটা নিচে নামিয়ে রাখে মেয়েটা।

মিকি বাইরে বেরুনোর জন্যে ঘুরে দাঁড়ানোয় তার হাত আঁকড়ে ধরে সে। “প্লিজ, এক কাপ কফি খেয়ে যান।”

না করতে পারে না সুমিদা।

৫. হাসপাতালে নেয়ার পর

পঞ্চম খণ্ড

হাসপাতালে নেয়ার তিনদিন পর আমার সাথে দেখা করার অনুমতি দেয়া হলো কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে।

সেদিন বিছানায় শুয়ে চুপচাপ আমার অতীত নিয়ে ভাবছিলাম। অতীত শব্দটা হয়তো ব্যবহার করাটা ঠিক হবে না। মাত্র আড়াই মাসের পুরনো স্মৃতিকে কি আর অতীত বলা যায়?

বাম চোখটা হারানোর পর ঠিক এরকমই একটা হাসপাতালে জ্ঞান ফিরেছিল আমার। সেই সময় মাথার ভেতরটা একদম ফাঁকা ছিল। তখন কি নিয়ে ভাবতাম কে জানে। হয়তো কিছু ভাবতামই না। ভাবার জন্যে কোন বিষয় তো দরকার, নাকি?

শুধু মনে আছে যে ভীষণ এক অস্থিরতা জেঁকে বসেছিল চিত্তে।

আমার কেবিনের দরজাটা খুলে গেল। এখন অবধি কয়েকজন ডাক্তার, নার্স আর পুলিশের লোক বাদে অন্য কাউকে দেখিনি। আজকে প্রথম অন্য কেউ দেখা করার অনুমতি পেয়েছে।

পরিচিত একটা মুখ দেখতে পেলাম বাইরে।

“এতদূর এসেছো তুমি?” বিছানায় শুয়েই বললাম।

মাথা নাড়লো মা। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে তার।

*

মা আসার আগেরদিন কয়েকজন পুলিশ অফিসার আসে আমার সাথে কথা বলতে।

তাদের বসার অনুরোধ করি আমি, কিন্তু কেউ কথাটা আমলেও নেয় না। বিছানায় উঠে বসার অনুমতি নেই আমার। আনুষ্ঠানিক কিছু ব্যাপারে আমার সাথে আলাপ করে তারা। জানায় যে সুমিদার ব্যাপারে কাউকে কিছু বলতে পারবো না। ঘটনাটা এতই অদ্ভুত যে টিভি আর খবরের কাগজের লোকেরা তোলপাড় শুরু করে দেবে।

তাদের কথা দেই যে কাউকে বলবো না।

আমার বাঁ চোখে দেখা কাজুয়ার স্মৃতিগুলোর ব্যাপারে কিছু জানাইনি তাদের।

ঐ নীল বাড়িটাতে আমার সাথে যা ঘটেছে তার ব্যাখ্যা নেই কারো কাছে। ডাক্তারদের আমি বারবার বলি যে সেখানে কোন প্রকার ব্যথা অনুভব করিনি আমি। কিন্তু প্রতিবারই ঘাড় কাত করে আমার কথা শুনে নতুন নতুন টেস্টের নির্দেশ দেয় তারা।

হিতামিকে নিশ্চয়ই আরো বেশি টেস্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হছে। কিন্তু পুলিশ আমাদেরকে সেদিন বাসা থেকে উদ্ধারের পর আর দেখা হয়নি কারো সাথে।

কথা শেষে তিনজন পুলিশ অফিসার চলে যাবার সময় জিজ্ঞেস করলাম যে হিতোমি কোথায়।

একজন জবাব দিল।

অন্য একটা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে হিতোমিকে। সেরে ওঠার পর বাবা-মা’র কাছে ফিরিয়ে দেয়া হবে তাকে।

“আর শিওজাকি?”

কিছুক্ষণের নীরবতার পরে অফিসারটা বলে যে মারা গেছে শিওজাকি। হাসপাতালে নিয়ে আসার পর এক সময় শ্বাস বন্ধ হয়ে যায় তার। একটা শিক তার হৃৎপিণ্ড ভেদ করে চলে গিয়েছিল।

লোকটা সত্যি বলেছে নাকি মিথ্যা তা যাচাই করার কোন উপায় নেই। তাকে ধন্যবাদ জানাই আমি।

আমাকে যখন তারা জিজ্ঞেস করেছিল যে তলকুঠুরিতে কাদের পেয়েছিলাম আমি, প্রতিবার একই উত্তর দিয়েছি। “হিতোমি আর মিঃ শিওজাকি।”

*

তিনদিন আগে :

সুমিদা মারা গেছে এই ব্যাপারে নিশ্চিত হবার পর আমার পেট থেকে বের য়ে আসা লম্বা জিনিসটা একত্রিত করে ময়লা মাখা অবস্থাতেই ভেতরে ঢুকিয়ে দেই। সেই মুহূর্তে ওটাই সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত মনে হয়েছিল।

কোন ব্যথা অনুভব করছিলাম না। আমার আহত বাম হাত, ডান পা বা পেটের কাছটায় কোন সাড়া নেই।

অনেকক্ষণ কসরতের পর কোনমতে উঠে দাঁড়াতে সক্ষম হই। ওরকম মুহূর্তে দাঁড়াবার শক্তি কিভাবে যোগাড় করেছিলাম কে জানে। সামনের : দরজা বা পেছনের দরজা দিয়ে ভেতরে যাওয়া সম্ভব না আমার পক্ষে। নিশ্চয়ই দু’টো দরজাই বন্ধ রাখার ব্যবস্থা নিয়েছে সুমিদা। অগত্যা জানালা দিয়েই ভেতরে ঢুকে পড়ি। মনে শুধু একটা কথাই ঘুরছে-সাহায্য দরকার।

পুলিশ আর অ্যাম্বুলেন্সে খবর দিয়ে তলকুঠুরিতে ফিরে যাই। আমার ডান পা’টা যে অকেজো হয়ে গেছে, সেটা ভুলে গিয়ে দুই পায়েই ভর দিয়ে সামনে এগোনোর চেষ্টা করি।

সুমিদা চলে গেলেও, তলকুঠুরির অন্ধকার দূর হয়নি। হিতোমি আর সেখানকার অন্যান্য অধিবাসীদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করলাম যে সুমিদা মারা গেছে।

“সেটাই ভেবেছিলাম,” ফিসফিসিয়ে বললো হিতোমি। “আমাকে তার কাছে নিয়ে যাও, প্লিজ।”

এমনভাবে কথাটা বলে সে যে আর কোন উপায় থাকে না আমার। সুমিদাকে দেখে কেঁদে ওঠে সে। যার দ্বারা নিজের এরকম ক্ষতি হয়েছে তার জন্যে যে কেউ কাঁদতে পারে সেটা হিতোমিকে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। বাইরে বেরুনোর জন্যে সামনের দরজায় পেছানো এক্সটেনশন কর্ডটা খুলতে হয়েছে আমাকে। অনেক সময় লাগলেও একসময় কাজটা করতে সক্ষম হই।

সুমিদার মৃতদেহ থেকে একটু দূরে দেয়ালের পাশে বসে ঘুমিয়ে পড়ি ক্লান্তিতে। কিছুক্ষণ পর একটা পুলিশের গাড়ির শব্দে ঘুম ভাঙে আমার। একজন অফিসার দৌড়ে আসে আমাদের দিকে। হিতোমিকে দেখা মাত্র চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে যায় তার।

“নিচে আরো তিনজন আছে, তার উদ্দেশ্যে বলি আমি।

ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আমার আর হিতোমির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর নীল বাড়িটায় প্রবেশ করে অফিসার। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এসে বলে যে ভেতরে কেবল একজনকে পেয়েছে সে।

“ওর আসলে ঠিক মনে নেই,” পাশ থেকে বলে হিতেমি।

ব্যাকআপ ইউনিটদের ডেকে পাঠানোর জন্যে গাড়ির দিকে দৌড় দেয় অফিসার।

“ওদের ব্যাপারটা কেউ না জানলেই ভালো, একবার চোখ টিপে বলে হিতোমি।

কিছুক্ষণ আগে দেখা দৃশ্যটা তাহলে স্বপ্ন ছিল না। আমি এতক্ষণ ভাবছিলাম যে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেছি।

দরজা খোলার শব্দ শুনতে পাই আমি। মনে হয় যেন বিশাল একটা জিনিস পাশ দিয়ে যাচ্ছে আমার। হালকা চোখ খুলে দেখি নিজেদের অনেকগুলো হাতের একটা দিয়ে হিতোমিকে আদর করছে শিনিচি-ইউকি। এরপর আশেপাশে একবার তাকিয়ে বনের ভেতরে উধাও হয়ে যায় তারা।

“ঐ দু’জনের কথাটা গোপন থাক,” হিতোমি বলে।

হাসি ফোটে আমার মুখে। সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়ি এরপর।

.

গোটা ঘটনাটা অপহরণ বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। অপহরণকারীর নাম মিকিও সুমিদা। খবরের কাগজ পড়ে জানতে পারি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি রূপকথার গল্প লেখতো সে।

সাওরি প্রায়ই আসে আমার সাথে দেখা করতে। সে যেহেতু নিজে গাড়ি চালাতে পারে না, কিমুরা অথবা কিয়োকো পৌঁছে দেয় তাকে। প্রতিবারই আমার জন্যে কমিক্স বা বই নিয়ে আসে। বাড়িটার ভেতরে ঠিক কি হয়েছিল, সেই কথা আমাকে জিজ্ঞেস করে না সে। নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে যে দুঃস্মৃতিটার কথা মনে করতে চাই না আমি।

খবরের কাগজে ছাপা হয় যে হিতোমিকে প্রথমে অপহরণ করে সুমিদা। ব্যাপারটা শিওজাকি জেনে ফেললে তাকে হত্যা করে সে। শিওঁজাকিকে খুঁজতে গিয়ে ঘটনার সাথে আমিও জড়িয়ে যাই।

একটা পত্রিকা থেকে জানতে পারি যে শান মিকি ছদ্মনামে রূপকথার গল্প লিখতো সুমিদা। ব্ল্যাক ফেয়ারি টেইল বইটা আসলে তার লেখা। নীল বাড়িটায় দু’বছর থাকে সে, এরপর অ্যাপার্টমেন্টটা ভাড়া নেয়।

সুমিদা কেন অন্যদের কষ্ট দিত এটা নিয়ে অনেক ভেবেছি। শেষ মুহর্ত পর্যন্ত তাকে দেখেছি আমি। কিন্তু সচরাচর বিকৃত মস্তিষ্কের খুনী বলতে যা বোঝায়, তার চাইতে একদম ভিন্ন স্বভাবের সে। বরং তার কৌতূহলী চোখে একজন বৈজ্ঞানিকের ছায়া খুঁজে পেয়েছিলাম। হয়তো জীবন কি, এটা জানাটাই মূল উদ্দেশ্য ছিল তার।

তার ক্ষমতাটা অভিশাপ নাকি আশীর্বাদ, এটা বলতে পারবো না।

একদিন সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন পড়ে জানতে পারি যে সুমিদার অ্যাপার্টমেন্টের আশপাশে তল্লাশি করে প্রমাণ পাওয়া গেছে যে লম্বা সময় ধরে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে এসেছে সে। এটা সত্য নাকি মিথ্যা, জানি না।

একদিন সাওরি আমাকে সুমিদাকে নিয়ে লেখা একটা প্রতিবেদন পড়তে দেখে ফেলে। চেহারায় একটা মন খারাপ ভাব ভর করে তার। মুখে অবশ্য কিছু বলে না, কিন্তু আমি নিশ্চিত যে সুমিদার কথা ভাবছিলো সে। এরপর থেকে আর তার সামনে সুমিদাকে নিয়ে লেখা কিছু পড়িনি।

সুমিদাই যে কাজুয়াকে হত্যা করেছে এই কথাটা শেষমেষ কাউকে বলা হয়নি। সাওরি এটা জানতে পারলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাবে। এর থেকে ব্যাপারটা একটা দুর্ঘটনাই ধরে নিক সে।

একদিন সাওরি আমার পাশে বসে আপেল কেটে দেয়ার সময় বলি, “কিয়োকোর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলে কেন?”

“গুরুত্বপূর্ণ কিছু না।”

“বলো না।”

“একদিন তার বাসায় ডেলিভারি দিতে গিয়ে একটা ছবি দেখি। ছবিটায় ছোট একটা ছেলে ছিল তার সাথে। ছেলেটার চেহারা খুবই পরিচিত ঠেকে আমার কাছে। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি যে ছেলেটার ভুলে বাবা-মা মারা যায়, কিয়োকো তারই মা।”

সাওরিকে কাজুয়ার চোখের ব্যাপারে কিছু বলিনি আমি। তবে একদিন বলবো, সবকিছু জানাবো তাকে। বিশ্বাস করবে কিনা এটা তার ব্যাপার।

.

পরের গ্রীষ্মে আমার পুরনো স্মৃতিগুলো ফিরে পেলাম। একদিন টিভি দেখার সময় হঠাৎই ছোটবেলার নামির চেহারা ভেসে ওঠে আমার মনের পর্দায়। প্রথমে কিছুই বুঝতে পারি না। পরে মা’র কাছে পুরো দৃশ্যটা বর্ণনার পর সে বলে যে এটা আমার ছোটবেলার একটা জন্মদিনের অনুষ্ঠানের স্মৃতি।

ধীরে ধীরে পড়াশোনায় উদ্যোম ফিরে আসে। খেলাধুলাতেও আগের মতন ভালো করতে থাকি।

সময় পেলেই কায়েদিতে যাই আমি। কিয়োকো, কিমুরা আর সাওরি আমার পথ চেয়ে থাকে। মিঃ ইশিনো প্রতিবার নিয়ে যান আমাকে স্টেশন থেকে। ওখানে গেলে কাজুয়ার কবরটা দেখে আসতে ভুলি না। আজকের এই আমির পেছনে তার অবদানই সবচেয়ে বেশি।

তবে আরেকজনকে ভুললে চলবে না। বাম চোখ হারানো,? নামি। তার দৃঢ় সংকল্পের কারণেই শেষ হয় অশুভ রূপকথার গল্পটা।

-শেষ-

Exit mobile version