আমি ঘরে বসে পড়ছিলাম এসময় বাবা আসে।
“তোমাকে এর আগে কখনো টেবিলে বসে পড়তে দেখিনি,” বলে সে। “তবুও পরীক্ষায় কোনদিন কম নম্বর পাওনি।”
আমি যদি খুব পড়াশোনা করে পরীক্ষায় আগের মতন নম্বর পাই, মা কি আবারো আমাকে ভালোবাসবে?
“সেটা পরে দেখা যাবে,” বাবা অনিশ্চিত কণ্ঠে বলে। “এখন চোখ মোছছা তো মা, তোমাকে কাঁদতে দেখতে অভ্যস্ত নই একদমই।”
*
আমার চোখের অস্ত্রোপচারের আগেরদিন নানা এলেন দেখা করতে।
“নামি,” আমাকে দেখেই ডেকে উঠলেন। “একবার আমার জন্যে পিয়ানো বাজাবে? তোমার স্মৃতিশক্তি চলে গেলেও, মাসল মেমোরি থেকে পিয়ানো বাজাতে পারার কথা।”
আমাকে পিয়ানোর সামনে বসিয়ে দিলেন তিনি। বাবা, মা, নানু, মামা আর মামাতো ভাইবোনেরা-সবাই গোল হয়ে ঘিরে আছে আমাকে। একদৃষ্টিতে দেখছে, অপেক্ষা করছে পিয়ানোর সুরের মূর্ঘনায় হারিয়ে যাবার।
কিন্তু পিয়ানোর কি’গুলোতে কেবল হাতড়েই গেলাম, কোন সুর বেরুলো না। খুব তাড়াতাড়ি হতাশ হয়ে মাথা নামিয়ে নিল সবাই।
দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো নানার বুক চিড়ে।
লজ্জায় চেহারা লাল হয়ে গেছে আমার। কান ঝাঁঝাঁ করছে। মনে হচ্ছে। ছুটে পালাই।
আবারো পুরনো নামির গুণগান গাইতে শুরু করলো সবাই মিলে। সেই নামি কখনো হতাশ করেনি তাদের। আগে কেমন ছিলাম, এখন কিরকম আছি-ঘুরেফিরে এটা নিয়েই আলাপ হয়েছে সারাদিন। একটার পর একটা ভুল ধরে গেছে মা।
মাথা উঁচু করার শক্তিও যেন হারিয়েছি। অদৃশ্য হয়ে যেতে পারলে ভালো হতো। স্কুলে গেলেও একই অনুভূতি হয়। সবাই আগের নামির বন্ধু হতে চায়। এখনকার আমির কোন মূল্যই নেই কারো কাছে। এমনকি যারা করুণা করে এখনও কথা বলে আমার সাথে, তারাও আগের নামিকেই খুঁজে ফেরে।
পরদিন একটা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো আমাকে। এর আগে কখনো এই হাসপাতালটায় আসিনি। শহর থেকে কিছুটা দূরে জায়গাটা।
নানাকে জিজ্ঞেস করলাম যে কেন শহরের বড় হাসপাতালগুলোর একটায় নেয়া হয়নি আমাকে।
“তোমার নতুন চোখের বন্দোবস্ত করার জন্যে কিছু বিশেষ উপায় অবলম্বন করতে হয়েছে আমাকে। সেইজন্যেই এই ছোট হাসপাতালটায় আসতে হয়েছে। চিন্তা কোরো না, আসল ডাক্তারই দেখবে তোমাকে”
অস্ত্রোপচারের ঠিক আগে চোখটা দেখলাম একবার। একটা কাঁচের বয়ামের ভেতর থকথকে তরলে ভাসছে। মনে হচ্ছে যেন দেখছে আমাকে।
অ্যানেস্থেশিয়া দেয়া হলো আমাকে। অন্ধকারের গহীন নিরুদ্দেশে হারিয়ে গেলাম কিছুক্ষণের মধ্যে।
.
২
অন্য কারো চোখ প্রতিস্থাপিত হলো আমার বাম অক্ষিকোটরে। অপটিক নার্ভগুলোও ঠিকঠাক জোড়া লেগে গেল। অস্ত্রোপচারের পর তিনদিন বাম চোখের কাছে হাত নেয়াই নিষিদ্ধ। ব্যান্ডেজের ওপর দিয়ে হাত দেয়া যাবে না। ডাক্তার বারবার করে বলে দিয়েছেন সম্ভব হলে চোখের নাড়াচাড়াও যথাসম্ভব কম করতে হবে।
মাঝে মাঝে মনে হল যে আমার চেহারার বামপাশে কোন অনুভূতিই নেই। মাথাটা কিঞ্চিৎ হেলে আছে বামদিকে।
চারদিন পর চোখের ওপর থেকে ব্যান্ডেজ সরানো হলো। হাঁটাহাঁটি বা নড়াচড়া এখনও একদম নিষিদ্ধ। তবে অনুভূতি ফিরে আসতে শুরু করেছে বামপাশটায়। পঞ্চম দিনে পুরোপুরি অনুভব করতে পারলাম সবকিছু। বাম চোখে অদ্ভুত অনুভূতিটাও দূর হয়ে গেছে একদম।
“ব্যান্ডেজ খুলে ফেললেও, প্রথম প্রথম দেখতে হয়তো কিছুটা অসুবিধে হবে। নার্ভ ঠিকঠাক সাড়া দিতে কিছুটা সময় লাগতে পারে। তবে খুব শিঘ্রই তোমার শরীরের সাথে মানিয়ে নেবে প্রতিস্থাপিত চোখটা, তখন আশা রাখি দেখায় কোন সমস্যা থাকবে না। খবরদার! ভুলেও চোখ কচলাবে না।”
বাম চোখ খোলার পর মনে হলো যেন একটা ধূসর কাঁচের পেছন থেকে দেখছি আমি। সবকিছু বড্ড বেশি উজ্জ্বল মনে হচ্ছে। এখনও বোধহয় এত আলোর সাথে মানিয়ে নিতে পারেনি চোখটা।
আমার কেবিনের দেয়ালের একপাশে একটা ক্যালেন্ডার ঝুলছে। নিচের অর্ধেকে তারিখ আর ওপরের অর্ধেক জুড়ে একটা রঙিন ছবি। ছবিটায় খালি দোলনা দেখা যাচ্ছে।
ক্যালেন্ডারটা আমার বিছানার বিপরীত দিকে বলে সারাদিন মোটামুটি ওটার দিকেই তাকিয়ে থাকি। ব্যান্ডেজ খুলে ফেলার পর প্রথম কয়েকদিন অবশ্য পরিষ্কার দেখতে পেতাম না, সবকিছু ঝাপসা হয়ে যেত। কিন্তু দুদিন পর দোলনার শেকলগুলোও স্পষ্ট দেখতে পেলাম।
এক সপ্তাহ পর বাসায় ফেরার সময় হলো। মা এসেছে আমাকে বাসায় নিয়ে যাবার জন্যে। অস্ত্রোপচারের পর এই প্রথম হাসপাতালে এসেছে সে। নানা একবার এসেছিলেন, কিন্তু খুব বেশিক্ষণ থাকেননি। আসলে কথা বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তাই একরকম বিরক্ত হয়েই চলে গেছেন।
“তুমি কি বাম চোখ দিয়ে দেখতে পাও?” মা জিজ্ঞেস করলো। “দুর্ঘটনার পর তোমার চেহারাটাই বদলে গেছিল। আমার নামিকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না তোমার মধ্যে। এখন আবার আগের মত লাগছে। আশা করি আচার ব্যবহারেও পরিবর্তন আসবে।”
আয়নায় তাকানোর পর প্রথমবারের মতন খেয়াল করলাম যে আমার দু’চোখের রঙ মিলছে না। বাম চোখ পরিষ্কার বাদামি।
আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে একবার সন্তুষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো মা! “দেখতে অন্তত পুরনো নামির সাথে মিল আছে তোমার। খুব সুন্দর, বলে বুকের ওপর হাত ভাঁজ করে রাখলো সে। “এবার তাড়াতাড়ি স্মৃতি ফিরে আসুক ভোমার। মাঝে মাঝে তো মনে হয় তুমি বুঝি নামিই নও। এরকম হয়ে গেছ কেন, বলো তো? নিজের সন্তানকে চোখের সামনে স্মৃতি হারিয়ে ফেলতে দেখার চেয়ে ভয়ানক আর কিছু নেই কোন মা’র জন্যে।”