হিতামিকে নিশ্চয়ই আরো বেশি টেস্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হছে। কিন্তু পুলিশ আমাদেরকে সেদিন বাসা থেকে উদ্ধারের পর আর দেখা হয়নি কারো সাথে।
কথা শেষে তিনজন পুলিশ অফিসার চলে যাবার সময় জিজ্ঞেস করলাম যে হিতোমি কোথায়।
একজন জবাব দিল।
অন্য একটা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে হিতোমিকে। সেরে ওঠার পর বাবা-মা’র কাছে ফিরিয়ে দেয়া হবে তাকে।
“আর শিওজাকি?”
কিছুক্ষণের নীরবতার পরে অফিসারটা বলে যে মারা গেছে শিওজাকি। হাসপাতালে নিয়ে আসার পর এক সময় শ্বাস বন্ধ হয়ে যায় তার। একটা শিক তার হৃৎপিণ্ড ভেদ করে চলে গিয়েছিল।
লোকটা সত্যি বলেছে নাকি মিথ্যা তা যাচাই করার কোন উপায় নেই। তাকে ধন্যবাদ জানাই আমি।
আমাকে যখন তারা জিজ্ঞেস করেছিল যে তলকুঠুরিতে কাদের পেয়েছিলাম আমি, প্রতিবার একই উত্তর দিয়েছি। “হিতোমি আর মিঃ শিওজাকি।”
*
তিনদিন আগে :
সুমিদা মারা গেছে এই ব্যাপারে নিশ্চিত হবার পর আমার পেট থেকে বের য়ে আসা লম্বা জিনিসটা একত্রিত করে ময়লা মাখা অবস্থাতেই ভেতরে ঢুকিয়ে দেই। সেই মুহূর্তে ওটাই সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত মনে হয়েছিল।
কোন ব্যথা অনুভব করছিলাম না। আমার আহত বাম হাত, ডান পা বা পেটের কাছটায় কোন সাড়া নেই।
অনেকক্ষণ কসরতের পর কোনমতে উঠে দাঁড়াতে সক্ষম হই। ওরকম মুহূর্তে দাঁড়াবার শক্তি কিভাবে যোগাড় করেছিলাম কে জানে। সামনের : দরজা বা পেছনের দরজা দিয়ে ভেতরে যাওয়া সম্ভব না আমার পক্ষে। নিশ্চয়ই দু’টো দরজাই বন্ধ রাখার ব্যবস্থা নিয়েছে সুমিদা। অগত্যা জানালা দিয়েই ভেতরে ঢুকে পড়ি। মনে শুধু একটা কথাই ঘুরছে-সাহায্য দরকার।
পুলিশ আর অ্যাম্বুলেন্সে খবর দিয়ে তলকুঠুরিতে ফিরে যাই। আমার ডান পা’টা যে অকেজো হয়ে গেছে, সেটা ভুলে গিয়ে দুই পায়েই ভর দিয়ে সামনে এগোনোর চেষ্টা করি।
সুমিদা চলে গেলেও, তলকুঠুরির অন্ধকার দূর হয়নি। হিতোমি আর সেখানকার অন্যান্য অধিবাসীদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করলাম যে সুমিদা মারা গেছে।
“সেটাই ভেবেছিলাম,” ফিসফিসিয়ে বললো হিতোমি। “আমাকে তার কাছে নিয়ে যাও, প্লিজ।”
এমনভাবে কথাটা বলে সে যে আর কোন উপায় থাকে না আমার। সুমিদাকে দেখে কেঁদে ওঠে সে। যার দ্বারা নিজের এরকম ক্ষতি হয়েছে তার জন্যে যে কেউ কাঁদতে পারে সেটা হিতোমিকে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। বাইরে বেরুনোর জন্যে সামনের দরজায় পেছানো এক্সটেনশন কর্ডটা খুলতে হয়েছে আমাকে। অনেক সময় লাগলেও একসময় কাজটা করতে সক্ষম হই।
সুমিদার মৃতদেহ থেকে একটু দূরে দেয়ালের পাশে বসে ঘুমিয়ে পড়ি ক্লান্তিতে। কিছুক্ষণ পর একটা পুলিশের গাড়ির শব্দে ঘুম ভাঙে আমার। একজন অফিসার দৌড়ে আসে আমাদের দিকে। হিতোমিকে দেখা মাত্র চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে যায় তার।
“নিচে আরো তিনজন আছে, তার উদ্দেশ্যে বলি আমি।
ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আমার আর হিতোমির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর নীল বাড়িটায় প্রবেশ করে অফিসার। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এসে বলে যে ভেতরে কেবল একজনকে পেয়েছে সে।
“ওর আসলে ঠিক মনে নেই,” পাশ থেকে বলে হিতেমি।
ব্যাকআপ ইউনিটদের ডেকে পাঠানোর জন্যে গাড়ির দিকে দৌড় দেয় অফিসার।
“ওদের ব্যাপারটা কেউ না জানলেই ভালো, একবার চোখ টিপে বলে হিতোমি।
কিছুক্ষণ আগে দেখা দৃশ্যটা তাহলে স্বপ্ন ছিল না। আমি এতক্ষণ ভাবছিলাম যে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেছি।
দরজা খোলার শব্দ শুনতে পাই আমি। মনে হয় যেন বিশাল একটা জিনিস পাশ দিয়ে যাচ্ছে আমার। হালকা চোখ খুলে দেখি নিজেদের অনেকগুলো হাতের একটা দিয়ে হিতোমিকে আদর করছে শিনিচি-ইউকি। এরপর আশেপাশে একবার তাকিয়ে বনের ভেতরে উধাও হয়ে যায় তারা।
“ঐ দু’জনের কথাটা গোপন থাক,” হিতোমি বলে।
হাসি ফোটে আমার মুখে। সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়ি এরপর।
.
২
গোটা ঘটনাটা অপহরণ বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। অপহরণকারীর নাম মিকিও সুমিদা। খবরের কাগজ পড়ে জানতে পারি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি রূপকথার গল্প লেখতো সে।
সাওরি প্রায়ই আসে আমার সাথে দেখা করতে। সে যেহেতু নিজে গাড়ি চালাতে পারে না, কিমুরা অথবা কিয়োকো পৌঁছে দেয় তাকে। প্রতিবারই আমার জন্যে কমিক্স বা বই নিয়ে আসে। বাড়িটার ভেতরে ঠিক কি হয়েছিল, সেই কথা আমাকে জিজ্ঞেস করে না সে। নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে যে দুঃস্মৃতিটার কথা মনে করতে চাই না আমি।
খবরের কাগজে ছাপা হয় যে হিতোমিকে প্রথমে অপহরণ করে সুমিদা। ব্যাপারটা শিওজাকি জেনে ফেললে তাকে হত্যা করে সে। শিওঁজাকিকে খুঁজতে গিয়ে ঘটনার সাথে আমিও জড়িয়ে যাই।
একটা পত্রিকা থেকে জানতে পারি যে শান মিকি ছদ্মনামে রূপকথার গল্প লিখতো সুমিদা। ব্ল্যাক ফেয়ারি টেইল বইটা আসলে তার লেখা। নীল বাড়িটায় দু’বছর থাকে সে, এরপর অ্যাপার্টমেন্টটা ভাড়া নেয়।
সুমিদা কেন অন্যদের কষ্ট দিত এটা নিয়ে অনেক ভেবেছি। শেষ মুহর্ত পর্যন্ত তাকে দেখেছি আমি। কিন্তু সচরাচর বিকৃত মস্তিষ্কের খুনী বলতে যা বোঝায়, তার চাইতে একদম ভিন্ন স্বভাবের সে। বরং তার কৌতূহলী চোখে একজন বৈজ্ঞানিকের ছায়া খুঁজে পেয়েছিলাম। হয়তো জীবন কি, এটা জানাটাই মূল উদ্দেশ্য ছিল তার।