তাকে টেনে রাস্তার একপাশে নিয়ে এলো মিকি। কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলো। ছেলেটার শেষ স্মৃতি হচ্ছে একটা ক্যাফেতে বসে কফির অর্ডার দেয়া।
“আপনার নাম কি?” জিজ্ঞেস করলো ছেলেটা।
“সেটা না জানলেও চলবে।”
যেন স্বপ্ন দেখছে এমন ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো ছেলেটা।
এখনও হাতুড়িটা ধরে রেখেছে মিকি। ওটা ওপরে উঠালো সে। মাথায় জোরে একটা বাড়ি দিলেই মারা যাবে ছেলেটা।
ছেলেটা বারবার জ্ঞান হারাতে গিয়েও হারাচ্ছে না। “আমাকে… আমাকে মেলানকলি গ্রোভে পৌঁছে দিতে পারবেন?” কিছুক্ষণ পর ক্ষীণকণ্ঠে বললো সে।
মিকি সিদ্ধান্ত নিল ছেলেটাকে মারবে না সে। যদি আসলেও স্মৃতি হারিয়ে ফেলে তাহলে অযথা মারার কোন দরকার নেই। তাছাড়া সব প্রমাণ মুছে ফেলা সহজ হবে না। ছেলেটার মৃতদেহ রাস্তার পাশেই ফেলে রেখে যেতে হবে, অথবা বাড়িতে টেনে নিয়ে যেতে হবে। দুটোই বিরক্তিকর।
হাতুড়িটা পাশের ঝোপে ছুঁড়ে ফেলে ছেলেটাকে উঠিয়ে ক্যাফের দিকে রওনা হয়ে যায় সে। এর আগে কখনো ভেতরে না গেলেও বাইরে থেকে জায়গাটা দেখেছে মিকি।
মেলানকলি গ্রোভে পৌঁছুতে পৌঁছুতে রাত হয়ে যায়। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো অনেক দূরে দূরে। তাই ক্যাফেটাকে দেখে মনে হয় যেন শূন্যে ঝুলছে।
ওখানে পৌঁছানোর আগেই হুশ হারিয়ে ফেলে ছেলেটা। মিকি কাঁধে করে তাকে দরজার সামনে নিয়ে যায়।
“কাজুয়া!” বলে দৌড়ে আসে কাউন্টারের পেছনে বসে থাকা যুবতী।
একটা চেয়ারে তাকে বসিয়ে দেয় মিকি।
“আমি দুঃখিত যে আমার ভাইয়ের কারণে আপনাকে এত কষ্ট করতে হলো,” বারবার ওর উদ্দেশ্যে বলতে থাকে মেয়েটা।
মিকি তাকে বলে যে মাতাল হয়ে রাস্তায় পড়ে ছিল কাজুয়া। ভাইয়ের শরীর থেকে অ্যালকোহলের গন্ধ না পেলেও এ নিয়ে আর কথা বাড়ায়নি সাওরি।
“মাথায় ব্যথা পেয়েছে ও,” বলে সে। “ফুলে গেছে।”
মিকি বলে যে ক্যাফেতে আসার সময় রাস্তায় জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায় কাজুয়া। তখনই ব্যথা পেয়েছে।
আশপাশে তাকিয়ে অন্য কোন খদ্দের চোখে পড়েনা মিকির। সাওরি যে ক্যাফের মালিক না সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না তার। এত কম বয়সে এরকম একটা জায়গায় ক্যাফে খোলার কথা না কারো।
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে মিকি। পেছন থেকে তাকে ডাক দেয় যুবতী, কিন্তু না শোনার ভান করে সে।
অন্ধকার রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় অচেতন ছেলেটাকে নিয়ে ভাবতে থাকে সে। কাউন্টারের পেছনে বসে থাকা যুবতাঁকে নিয়েও ভাবে। ছোটবেলায় সিঁড়ি থেকে পড়ে মারা যায় মিকির এক বান্ধবী। যুবতীর চেহারাটা একদম তার মতন।
এসময় সে খেয়াল করে যে পকেটে থাকা জিনিসটা আনমনেই নাড়াচাড়া করছে এক হাতে-একটা সোনালি রঙের ঘড়ি। মিকির বাড়ির বাইরে ঘোরাফেরার সময় হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল বোধহয় ওটা।
থমকে দাঁড়ায় সে। এটা ফেরত দেয়ার কোন দরকার নেই।
কিন্তু কিছুক্ষণ পর তাকে দেখা যায় ক্যাফের ভেতরে ঢুকছে।
সে যতটুকু ভেবেছিল, তার চেয়েও বেশি খুশি হয় যুবতী ঘড়িটা দেখে। “এটা দেয়ার জন্যে এতদূর ফিরে এসেছেন! আপনার নাম কি?” আন্তরিক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে সে।
একদম ওর মতো চেহারা।
নিজের আসল নামটা বলে মিকি।
“আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, সুমিদা,” বলে ঘড়িটা নিচে নামিয়ে রাখে মেয়েটা।
মিকি বাইরে বেরুনোর জন্যে ঘুরে দাঁড়ানোয় তার হাত আঁকড়ে ধরে সে। “প্লিজ, এক কাপ কফি খেয়ে যান।”
না করতে পারে না সুমিদা।
৫. হাসপাতালে নেয়ার পর
পঞ্চম খণ্ড
১
হাসপাতালে নেয়ার তিনদিন পর আমার সাথে দেখা করার অনুমতি দেয়া হলো কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে।
সেদিন বিছানায় শুয়ে চুপচাপ আমার অতীত নিয়ে ভাবছিলাম। অতীত শব্দটা হয়তো ব্যবহার করাটা ঠিক হবে না। মাত্র আড়াই মাসের পুরনো স্মৃতিকে কি আর অতীত বলা যায়?
বাম চোখটা হারানোর পর ঠিক এরকমই একটা হাসপাতালে জ্ঞান ফিরেছিল আমার। সেই সময় মাথার ভেতরটা একদম ফাঁকা ছিল। তখন কি নিয়ে ভাবতাম কে জানে। হয়তো কিছু ভাবতামই না। ভাবার জন্যে কোন বিষয় তো দরকার, নাকি?
শুধু মনে আছে যে ভীষণ এক অস্থিরতা জেঁকে বসেছিল চিত্তে।
আমার কেবিনের দরজাটা খুলে গেল। এখন অবধি কয়েকজন ডাক্তার, নার্স আর পুলিশের লোক বাদে অন্য কাউকে দেখিনি। আজকে প্রথম অন্য কেউ দেখা করার অনুমতি পেয়েছে।
পরিচিত একটা মুখ দেখতে পেলাম বাইরে।
“এতদূর এসেছো তুমি?” বিছানায় শুয়েই বললাম।
মাথা নাড়লো মা। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে তার।
*
মা আসার আগেরদিন কয়েকজন পুলিশ অফিসার আসে আমার সাথে কথা বলতে।
তাদের বসার অনুরোধ করি আমি, কিন্তু কেউ কথাটা আমলেও নেয় না। বিছানায় উঠে বসার অনুমতি নেই আমার। আনুষ্ঠানিক কিছু ব্যাপারে আমার সাথে আলাপ করে তারা। জানায় যে সুমিদার ব্যাপারে কাউকে কিছু বলতে পারবো না। ঘটনাটা এতই অদ্ভুত যে টিভি আর খবরের কাগজের লোকেরা তোলপাড় শুরু করে দেবে।
তাদের কথা দেই যে কাউকে বলবো না।
আমার বাঁ চোখে দেখা কাজুয়ার স্মৃতিগুলোর ব্যাপারে কিছু জানাইনি তাদের।
ঐ নীল বাড়িটাতে আমার সাথে যা ঘটেছে তার ব্যাখ্যা নেই কারো কাছে। ডাক্তারদের আমি বারবার বলি যে সেখানে কোন প্রকার ব্যথা অনুভব করিনি আমি। কিন্তু প্রতিবারই ঘাড় কাত করে আমার কথা শুনে নতুন নতুন টেস্টের নির্দেশ দেয় তারা।