হঠাৎই নিজের শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেলাম। সুমিদা হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরার চেষ্টা করেও পারলো না। পাশের ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। কিন্তু তালা দেয়ার জন্যে নব খুঁজতে গিয়ে দেখি কোন নব নেই। জানালার দিকে এগিয়ে গেলাম। একটা পায়ে সবকিছু করতে হচ্ছে। অন্য পাটা সম্পূর্ণ অচল।
পেছনে দরজা খুলে গেল এই সময়। সুমিদা এসে পড়েছে আবারো। সে জানে যে পালাতে পারবো না আমি। শান্ত দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো কি করি।
জানালাটা খুলতে খুব বেশি বেগ পেতে হলো না। এটাও যদি শক্ত করে আটকানো থাকতো, তাহলে ভাঙার চেষ্টা করতে হতো আমাকে। চারকোনা জায়গাটা দিয়ে বাইরে মাথা গলিয়ে দিলাম। উপুড় হয়ে পড়লাম মাটিতে। এভাবে পড়ার কারণে ভেতর থেকে সমস্ত বাতাস বেরিয়ে গেল। তবে এখনও কোন ব্যথা অনুভব করতে পারছি না।
মাটিতে শুয়ে থাকা অবস্থায় বুঝতে পারলাম একটা প্ল্যান্টারের পাশে পড়েছি। আমার চোখের সামনেই তলকুঠুরির জানালা ঢেকে দেয়া নীল ইটের ছোট দেয়াল। এখানেই এসেছিল এক বছর আগে কাজুয়া। ঈশ্বর বোধহয় আজ আমার সাথে কৌতকে মেতে ওঠার পণ করেছেন।
কিছুক্ষণ পর সুমিদা বাইরে বেরিয়ে এলো জানালা দিয়ে।
উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই আমার। “এসব কেন করেন?” মাটি থেকেই জিজ্ঞেস করলাম তার উদ্দেশ্যে।
“জানি না,” সুমিদাকে দেখে মনে হচ্ছে এই প্রশ্নটার উত্তর কখনো খোঁজার চেষ্টা করেনি সে। “এমনটা না যে মানুষ মারতে ভালো লাগে আমার। কিন্তু তাদের মুখ বন্ধ করার জন্যে মারতে হয়।”
বুকে ভর দিয়ে সামনে এগোনোর চেষ্টা করলাম। আমার বাম হাতের আঙুলগুলোয় কোন সাড়া নেই। কিন্তু কনুই অবধি নাড়াতে পারছি। বাম পা দিয়ে মাটিতে ঠেলা দিয়ে সামনে এগোলাম কিছুটা। ডান পা কাজ করছে না।
মাটিতে এভাবে পড়ে থাকলে ঠান্ডা অনুভব করার কথা, কিন্তু সেরকম কিছু হলো না। শুধু ধুলোবালির অস্বস্তিকর উপস্থিতি টের পাচ্ছি। পেট থেকে নাড়ি বেড়িয়ে আছে সেটা না ভাবার চেষ্টা করলাম।
সুমিদা আমার পাশে পাশে হাঁটছে। আমার দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে, এটা বুঝতে পারছি।
“দু’মাস আগে কাজুয়া কি আসলেও দুর্ঘটনায় মারা গেছে?” মাটির দিক থেকে মাথা না তুলেই জিজ্ঞেস করলাম।
আমার মনে ক্ষীণ আশা যে যতক্ষণ এভাবে কথা বলবো, আমাকে মারবে না সুমিদা।
হাতে ভর দিয়ে আর মাথা উঁচু করে রাখা সম্ভব হলো না। মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়লাম।
“এমনভাবে সব সাজিয়েছি যেন দেখে মনে হয় দুর্ঘটনা।”
আমার পেট থেকে বের হয়ে থাকা লম্বা সরু জিনিসটায় পা রাখলো সুমিদা। সামনে এগোচ্ছি এখনও। এটা বুঝতে পারছি যে পেট থেকে এখনও বের হয়ে আসছে ওটা। শব্দও শুনতে পাচ্ছি।
“চোখে কাপড় বেঁধে হাত পা ভেঙে দেই প্রথমে। এরপর একটা ঢালের ওপর থেকে গাড়ির সামনে ছেড়ে দিইয়েছিলাম।”
সুমিদা বললো যে কাজুয়াকে ধাক্কা দেয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে চোখের কাপড়টা সরিয়ে নেয় সে। কাজয়া বুঝতে পারে না যে তার হাত পাগুলো কেন কাজ করছে না।
বাড়িটায় এক কোনায় পৌঁছে গেছি আমি। ভালো হাতটা দিয়ে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম সেখানকার দেয়াল।
আমার নাড়ি কত লম্বা? হাতে ভর দিয়েই এতদূর এসেছি। মাটিতে আমার দেহ ছেচড়ানোর দাগ। সুমিদা এখনও পা দিয়ে চেপে রেখেছে। আমার নাড়ির এক প্রান্ত।
এটুকু এসে সামনে এগোনো থামিয়ে দিলাম। খুব কসরত করে উঠে বসে দেয়ালে হেলান দিলাম। এরপর ধুলো আর চোখের পানিতে একাকার চেহারাটা সুমিদার দিকে ঘুরিয়ে বললাম, “এরকম একটা কাজ কেন করলেন?”
“কাজুয়ার স্মৃতি ফিরে আসতে শুরু করেছিল। একবারে না, ধীরে ধীরে।
সুমিদা তাহলে ভয় পেয়ে গেছিল যে কাজুয়ার সব মনে পড়ে যাবে। এজন্যেই তাকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়াটা জরুরি হয়ে পড়েছিল তার জন্যে।
আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সুমিদা। মাটিতে বসে থাকায় তাকে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি লম্বা দেখাচ্ছে। “যথেষ্ট হয়েছে, নাকি?” যেন কোন ছোট বাচ্চার সাথে কথা বলছে এমন ভঙ্গিতে বললো সে। “তোমার ভাগ্য খারাপ দেখে তলকুঠুরিটা খুঁজে পেয়েছে।”
নিচু হয়ে আমার গলায় হাত রাখলো সুমিদা। ওর মুখটা আমার মুখ থেকে একটু দূরে এখন।
“কোন কষ্ট হবে না। ঘাড় মটকানোয় দক্ষ হয়ে গেছি আমি।”
ধীরে ধীরে ডান হাতটা সরিয়ে আনছি। আমি যেখানে বসে আছি তার পাশেই একটা ড্রেন। ভেতরে শুকনো, মরা পাতা। জিনিসটা আগের জায়গাতেই আছে তাহলে।
“ভুল বললেন,” কান্না চেপে বললাম। “আমার ভাগ্য খারাপ না। আপনাকে খুঁজে পাবার কথা বলেই পেয়েছি।”
শরীরের শেষ শক্তিটুকু জড়ো করে জিনিসটা সুমিদার ভেতরে সেঁধিয়ে দিলাম। এক বছর ধরে এই মুহূর্তটারই অপেক্ষায় ছিল কাজুয়ার স্ক্রু ড্রাইভারটা।
.
১২
রূপকথার রচয়িতা
অচেতন ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেল মিকি। খুবে বেশি ব্যথা পায়নি বলেই মনে হচ্ছে।
তাকে মেরে ফেলবে নাকি তলকুঠুরিতে নিয়ে যাবে সেই সিদ্ধান্ত দ্রুত নিতে হবে মিকিকে।
এমন সময় গুঙিয়ে উঠলো ছেলেটা। এর আগেরদিন যখন মিকির বাসায় এসেছিল সে, চোখে ব্যান্ডেজ বাঁধা ছিল। এখন ব্যান্ডেজটা নেই।
এক চোখ হালকা খুললো ছেলেটা। বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকালো মিকির দিকে।
মিকি জানে যে এখান দিয়ে অন্য কেউ যাবার আগেই ছেলেটার ভবলীলা সাঙ্গ করে দিতে হবে তাকে। সেই কাজের প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন সময় কথা বলে উঠলো কাজুয়া, “আমি… আমি কোথায়?”