মাথা নাড়লাম জবাবে।
আমরা ভেতরে ঢোকার আগমুহূর্ত অবধি হইচই হচ্ছিল গোটা ক্লাসে। কিন্তু আমাকে দেখেই পিনপতন নীরবতা নেমে এলো। সবার চোখ আমার ওপর। রুমের মাঝে খালি একটা ডেস্কের দিকে নির্দেশ করলেন মিঃ ইওয়াতা। সেটায় গিয়ে বসলাম আমি।
আমার অবস্থাটা ক্লাসের অন্য সবাইকে ব্যাখ্যা করলেন টিচার। দুর্ঘটনার কারণে কিরকম অসুবিধার মধ্যে পড়েছি সেটাও বললেন। কিন্তু সবাই যে ইতোমধ্যেই জানে তা বুঝতে অসুবিধে হলো না।
হোমরুম পিরিয়ড শেষ হবার পরপরই আমাকে ঘিরে ধরলো সহপাঠীরা। তাদের একজনের চেহারাও চিনতে পারছি না। কিন্তু আমার সাথে এমন ভঙ্গিতে কথা বলছে যেন অনেকদিনের চেনা। তাদের নামটাও জানি না, কিন্তু তারা আমার সম্পর্কে এমন সব কথা জানে যেগুলো আমি নিজেও শুনিনি কখনো।
“নামি!” একজন বললো। “তোমাকে নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো আমাদের!”
“ঠিক আছে তো?” আরেকজন জিজ্ঞেস করে।
কি বলবো ভেবে উঠতে পারলাম না, তাই চুপ থাকলাম। তাদের উৎসাহ হতাশায় পর্যদুস্ত হতে খুব বেশি সময় লাগলো না।
“তুমি মজার মজার কথা বলছো না কেন? হাসছো না কেন, নামি?”
“চেহারা এত গোমড়া করে রেখেছো কেন?”
আমি দুঃখিত। সরি।
আমার সামনের ডেস্কে বসে থাকা মেয়েটা বললো, “তোমার কি আসলেও কিছু মনে নেই?”
না, কিছু মনে নেই।
“সমস্যা নেই, তোমাকে সব বলবো আমি। সবসময় তোমার হোমওয়ার্ক নকল করেছি, সেটার প্রতিদান বলতে পারো। কি হলো? ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন আমার দিকে?”
তোমার নাম তো জানি না।
“মানে? আমি তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড!”
সরি।
“আচ্ছা, বাদ দাও। আমি ইউরি কাতসুরা। মাথায় গেঁথে নাও, ঠিক আছে?”
ধন্যবাদ।
আমাকে আমার ব্যাপারে বললো সে। যে মেয়েটার কথা শুনলাম তাকে মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন একজন। ইউরি বললো যে চমৎকার একজন মেয়ে ছিলাম আমি। কথার ধরণ শুনেই বোঝা যাচ্ছিল যে আমার ভক্ত ইউরি।
“তুমি ছিলে সবকিছুর মধ্যমণি। যখন হাসতে, সবাই নির্ভার অনুভব করতো। মিঃ কামাতার কথা মনে আছে? ঐ হতচ্ছাড়া ইংরেজি টিচারটা?”
মাথা ঝাঁকালাম।
“ইংরেজিতে একটা তর্কে তাকে হারিয়ে দিয়েছিলে তুমি! সবাই খুব খুশি হয়েছিল লোকটাকে হেনস্তা হতে দেখে।”
সেদিন অন্যান্য ক্লাসগুলোও করলাম, কিন্তু বুঝলাম না কিছুই। আমার টিচাররা সবাই উজ্জ্বল দৃষ্টিতে বারবার তাকাচ্ছিল আমার দিকে। বলছিল কত ভালো ছাত্রী ছিলাম আমি। বেশ কয়েকটা প্রশ্নের সমাধান করতে দেয়া হলো, একটাও পারলাম না। তাদের বিড়বিড় করতে শুনলাম, “এটাও ভুলে গেছে।”
ট্রেনে চেপে বাড়ি ফিরলাম। সাথে করে আনা চিরকুটগুলো দেখে দেখে স্টেশন আর রাস্তা মিলিয়ে নিতে হচ্ছে। কিছুই মনে নেই যে।
*
আমার নানা বেঁচে আছেন। মার কাছে শুনেছি অবসর গ্রহণের আগে একটা বড় কোম্পানির মহাপরিচালক ছিলেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই তাই বেশ জানাশোনা আছে।
আমাকে খুবই আদর করতেন নানা। দুর্ঘটনায় চোখ হারানোয় সবচেয়ে বেশি কষ্ট তিনিই পেয়েছেন। একদিন বাবাকে নানার সাথে ফোনে কথা বলতে শুনলাম। আমাকে দেখে কর্ডলেসটা নামিয়ে বাবা বললো, “নামি, নানা বলেছে তোমার বাম চোখের জন্যে খুব তাড়াতাড়ি কিছু করবেন। জাতীয় চক্ষু সংস্থায় তার পরিচিত কয়েকজন আছে।”
বাম চোখ ফিরে পেলে আমার চেহারা আবার আগের মত হয়ে যাবে। বাবার মতে অপটিক নার্ভও সেরে উঠতে পারে। ফলে আবারো দেখতে পাবো হয়তো।
*
“নামি, তুমি কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে। আরো বেশি কথা বলা উচিৎ তোমার।”
স্কুলে সবাই আমাকে এই কথাটা বলে। যতই দিন যায়, আমার সাথে কথা বলার মত সহপাঠীর সংখ্যাও কমতে থাকে।
একজন আমাকে গতদিন দেখা কোন একটা টিভি শো’র ব্যাপারে বিস্তারিত বলা শুরু করলো। অন্য একটা মেয়ে এসে তার হাত ধরে দূরে টেনে নিয়ে ফিসফির করে কিছু বলার সাথে তার চেহারার অভিব্যক্তি বদলে গেল। ফিসফিস করে বললেও আমার শুনতে অসুবিধে হলো না যে কি বলছে মেয়েটা।
‘নামি এখন আর আগের নামি নেই।”
ইউরি বাদে এখন আর কেউ আমার সাথে কথা বলে না। তবে তার উৎসাহের কমতি নেই। একের পর এক অতীতের গল্প করেই চলে। সেই গল্পে যে শুধু আমিই থাকি, তা নয়। এমন অনেকের কথাই বলে, যাদের চিনি না। হয়তো একসময় চিনতাম। দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে এখন সাধারণভাবে শ্বাস ফেললেই অবাক হয়ে যাই মাঝে মাঝে। আমার দিকে তাকিয়ে যে নামিকে দেখার চেষ্টা করে ইউরি, সে হারিয়ে গেছে।
শুধু ইউরি নয়, আমার টিচারদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এখনও পুরনো আমিকে খুঁজে বেড়ায় তারা। যখনই কোন প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানাতে ব্যর্থ হই, মুখটা গোমড়া করে ফেলেন। চেহারা দেখেই বোঝা যায় যে ভীষণ হতাশ হয়েছেন।
“আগের নামি সবকিছু করতে পারতো,” একদিন ইউরি বলে। “সব।”
আসলেই?
“খুবই কিউট ছিল ও। মানে, তোমার চেহারাও একই। কিন্তু কি যেন একটা নেই। এমনকি তোমার সাথে কথা বলতেও আগের মত ভালো লাগে না। মনে হয় যেন বাতাসের সাথে কথা বলছি।”
আমি দুঃখিত।
*
সবাই বর্তমান নিভৃতচারী আমি আর আগের হাস্যোজ্বল, সব কাজে পারদর্শী নামিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন চোখে দেখে।
দুর্ঘটনার পর চোখ খুলে মার চোখে যে উষ্ণতার ছায়া দেখেছিলাম, তা এই কয়দিনে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। বাবা বলে, আগে নাকি আমি আর মা সবসময় একসাথে থাকতাম। যেন দুই বোন।