*
প্রথম প্রথম সাধারণ সব কাজ করতেও বাবা মাকে জিজ্ঞেস করে নিতে হতো আমাকে। জিনিসপত্র কোথায় কোনটা রাখা, কিছুই মনে নেই আমার। সবকিছুতেই অনুমতি চাইতাম। কিন্তু বাবা এক পর্যায়ে বলে যে এটার কোন দরকার নেই।
কিছু করতে গেলেই বিভ্রান্তি আমার সঙ্গী হয়। এক রাতে ওপরতলার বাতি জ্বালাতে গিয়ে বুঝতে পারি যে সুইচবোর্ড কোথায় সেটাও জানি না। এরপর যখন সুইচবোর্ড খুঁজে পেলাম, কোন সুইচটা জ্বালবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তাই বাধ্য হয়ে মাকে জিজ্ঞেস করতে যাই।
“এই যে এটা! কি জিজ্ঞেস করছো তুমি এসব!” চেঁচিয়ে ওঠে সে।
আমি দুঃখিত, মাথা নিচু করে বলি।
বাবার চাইতে মা-ই বেশি কষ্ট করছে আমার স্মৃতিশক্তি ফিরিয়ে আনার জন্যে। প্রতিদিনই দুর্ঘটনার আগে আমি কেমন ছিলাম, সে বিষয়ে বিস্তারিত বলেন। বেশিরভাগ গল্পই তার আর আমার একসাথে কাটানো কোন সময়ের স্মৃতিচারণা।
“মনে আছে একবার খুব বেশি ঠান্ডা লেগেছিল তোমার? অনেকদিন বিছানাতেই থাকতে হয়েছিল?”
মনে নেই।
“মনে আছে কিভাবে তোমার যত্ন নিয়েছিলাম? আপেল কেটে দিয়েছিলাম?”
দুঃখিত মনে নেই।
“কেন মনে নেই?”
“আমি জানি না। সরি।”
“এত সরি সরি বলছো কেন? কত হাসিখুশি একটা মেয়ে ছিলে। নার্সারিতে পড়ার সময় আমার সাথে বাজারে যেতে তুমি। ফেরার পথে সবসময় রুটির ব্যাগটা আমার জন্যে বয়ে আনতে। মনে আছে?”
আবারো মাথা ঝাঁকাই। মনে নেই।
“কাঁদছো কেন? এসব নিয়ে কাদার তো কিছু নেই।”
যখনই আমি কিছু করতে ভুলে যাই বা কিছু একটা মনে করতে পারি না, মা বিড়বিড় করে বলে, “নামি তো এরকম করতো না। নামি তো কিছু ভুলতো না।”
লম্বা একটা সময় বাড়িতেই থাকি আমি। কিন্তু ধীরে ধীরে বাইরে যাওয়া আসাও শুরু করি। কখনো কখনো প্রতিবেশীরা আমার সাথে কথা বলে।
একদিন রাতের খাবারের সময় বাবা আমাকে বলে, “গতকাল মিঃ সাইতোউ তোমাকে হ্যালো বলেছিল। তুমি কিছু বলোনি কেন জবাবে?”
তার চেহারা মনে করার চেষ্টা করলাম।
“লোকে তোমাকে নিয়ে নানারকম কথা বলা শুরু করেছে। তুমি নাকি কেবল তাদের চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকো। অন্তত বাউ তো করতে পারো।”
“খুবই লজ্জাস্কর একটা ব্যাপার,” মা বললো অসন্তুষ্ট চিত্তে। “হ্যাঁ, সবাই জানে যে দুর্ঘটনায় স্মৃতিশক্তি হারিয়েছো তুমি, সেটাও বিবেচনায় রাখা উচিৎ তাদের। কিন্তু লোকে তোমার প্রতিটি চালচলন খেয়াল করে, সুতরাং তোমারও সেভাবেই চলাফেরা করা উচিৎ। আশা করি খুব দ্রুত স্মৃতিশক্তি ফিরে পাবে। ততদিন অবধি পুরনো নামির মত ব্যবহারের চেষ্টাটুকু অন্তত করো।”
একদিন রাতে মা বাবাকে বলাবলা করতে শুনলামঃ
“একটু বেশিই কড়া ব্যবহার করছো তুমি ওর সাথে,” বাবা বলে মার উদ্দেশ্যে। “আমি আর নিতে পারছি না,” মা ফোঁপাতে ফোঁপাতে জবাব দেয়। “মাঝে মাঝে তো মনে হয়, ও আমাদের মেয়ে-ই না।”
*
আরেকদিন রাতের খাবার শেষে বাবা বলে, “তুমি তো পাবলিক স্কুলের ছাত্রী ছিলে। সহপাঠীদের চেহারা বোধহয় ভুলে গেছে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
“তোমার টিচারদের সাথে ফোনে কথা হয়েছে আমার। চাইলে যে কোন সময় ক্লাসে ফিরে যেতে পারো।
বাবা সিদ্ধান্ত নিল যে দু’দিন পর, সোমবার থেকে স্কুলে যাবো। একাদশ শ্রেণির ছাত্রী আমি।
রুমে গিয়ে স্কুলের ইউনিফর্ম গায়ে চাপালাম। বই আর নোটবুকগুলো খুলে চোখ বুলালাম কিছুক্ষণ। সব ভুলে গেছি।
বইগুলোয় কয়েক পাতা পরপর ছোট ছোট চিরকুট সেঁটে রেখেছিলাম আমি। কিন্তু এখন বড় অপরিচিত লাগছে সেগুলো, মনে হচ্ছে অন্য কেউ করেছে কাজগুলো।
সোমবার চলে এলো দেখতে দেখতে।
রুমে যে সাদা টোট ব্যাগটা ছিল, সেটাই স্কুলের খাতাবইগুলো ঢোকালাম। বাইরে পা রাখবো এমন সময় মা পেছন থেকে বলে উঠলো, “নামি সবসময় ওর ব্যাকপ্যাকটা কাঁধে নিয়ে স্কুলে যায়। তুমিও তাই করো।” এমনভাবে কথাগুলো বললো সে যেন আমি আর নামি পৃথক কোন সত্তা।
একবার ক্ষমাপ্রার্থনা করে দ্রুত উপরে উঠে ব্যাগ পাল্টে নিলাম।
স্কুলের ঠিকানা ভুলে গেছি, তাই বাবা চললো আমার সাথে।
অনেক বড় একটা স্কুল। সরাসরি স্কুলের অফিস রুমে নিয়ে এলো আমাকে বাবা। টিচাররা সারাদিন বাচ্চাদের কি পড়াবেন, সেগুলো ঠিকঠাক করছিলেন। বাবার সাথে তাল মেলানোর জন্যে দ্রুত পা চালাতে হলো আমাকে।
অফিসে আমার ক্লাস টিচার, মিঃ ইওয়াতার সাথে দেখা হলো।
“তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগছে,” বললেন তিনি, এরপরেই চুপ করে গেলেন কিছুক্ষণের জন্যে। “তোমার কাছে হয়তো স্কুলের প্রথম দিনের মত ঠেকছে,” যেন হঠাৎই মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বললেন।
তার উদ্দেশ্যে একবার বাউ করে বের হয়ে গেল বাবা। অফিসের অন্যান্য সব টিচার আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
“জানি এভাবে সবাই তাকিয়ে থাকায় অস্বস্তিবোধ করছো, আমার বাম চোখের ওপর যে ব্যান্ডেজটা আছে সেদিকে তাকিয়ে কথাটা বললেন মিঃ ইওয়াতা।
“সবার হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি তোমার কাছে। দুর্ঘটনায় স্মৃতিশক্তি হারিয়েছে, এটা সকলেই জানে।”
কিরকম ছাত্রী ছিলাম আমি, জিজ্ঞেস করি।
“তুখোড়। পড়াশোনা, খেলাধুলা সবখানেই দুর্দান্ত। ক্লাসের মধ্যমণি ছিলে তুমি। সুতরাং এত দুশ্চিন্তার কিছু নেই। চলো তাহলে, ক্লাস শুরু হয়ে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যে।”
তাকে অনুসরণ করে অফিস থেকে হলওয়েতে বেরিয়ে এলাম। হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে তার একদম পেছন পেছন হাঁটছি। একাদশ শ্রেণি, সেকশন ১ লেখা একটা ক্লাসরুমের বাইরে থামলেন তিনি। আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি ঠিক আছে তো?”