তুমি ঠিক আছো? আমাকে জিজ্ঞেস করে সে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় দৃষ্টিতে তার দিকে মুখ ফেরাই তখন।
খুঁজেই পাচ্ছি না। অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছি। আমার বাম চোখটা এখানেই কোথাও পড়েছে…।
রক্ত ঝরছে আমার চোখের কোটর থেকে। সেই অবস্থাতেই জ্ঞান হারালাম।
যেখানে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি, সেখান থেকে কিছুটা দূরে খুঁজে পাওয়া যায় আমার চোখটা। কাদা আর তুষারে মাখামাখি, পথচারীদের পায়ের চাপে পিষ্ট হয়ে সেটাকে আর চোখ বলে মনে হচ্ছিল না।
কয়েক দিন ধরেই ভারি তুষারপাতে বিপর্যস্ত ছিল জনজীবন। বাধ্য হয়েই ছাতা মাথায় বাইরে বের হতে হচ্ছিল সবাইকে। আমিও ছিলাম তাদের মধ্যে। ফুটপাত দিয়ে হাঁটছি, এমন সময় একজনের ছাতার চোখা অংশটা ঢুকে যায় আমার চোখে। অপটিক নার্ভ থেকে ছিঁড়ে আসে চোখটা। অক্ষিকোটর থেকে পড়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে থাকে। উভ্রান্তের মত উপুড় হয়ে সেটা খুঁজতে শুরু করি আমি।
এগুলো সবই পরে রিপোর্টগুলো পড়ে জেনেছি। সরাসরি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে। আমার ব্যাগে থাকা স্কুলের পরিচয় পত্র থেকে নাম জানতে পারে হাসপাতালের স্টাফ-নামি শিরাকি।
আর এভাবেই, জানুয়ারির এক সকালে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলি আমি।
*
চোখ খুলে প্রথমে ঝাপসা দেখছিলাম সবকিছু। সাদা সিলিঙ আর সাদা দেয়ালের একটা ঘরে বিছানায় শুয়ে আছি আমি। গলা অবধি কম্বল টেনে দেয়া।
পাশেই এক ভদ্রমহিলা বসে পত্রিকা পড়ছেন। কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তবে কিছু বললাম না।
খানিকবাদে পত্রিকার পাতা ওল্টানোর ফাঁকে আমার দিকে তাকালেন ভদ্রমহিলা। সাথে সাথে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, হাতের পত্রিকাটা পড়ে গেল মেঝেতে। “নার্স! কাউকে ডাকুন। নামির জ্ঞান ফিরেছে!”
একজন নার্সকে সাথে দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করলেন ডাক্তার। আমাকে কিছু প্রশ্ন করে গেলেন একটানা। ভদ্রমহিলা এখনও পাশে আছেন, শুনছেন সবকিছু।
|||||||||| “কি সমস্যা, নামি?” জিজ্ঞেস করলেন মহিলা। “আশপাশে না তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে ডাক্তার সাহেবের কথা শোনো।”
হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওগুলোয় ব্যান্ডেজ করা। আমার বাম চোখের ওপরেও একটা ব্যান্ডেজ। চেষ্টা করলাম ব্যান্ডেজটা তুলে ফেলার, কিন্তু ডাক্তার এবং নার্স দু’জনেই বাধা দিল এতে।
ঘাড় কাত করে আমার দিকে তাকালেন মহিলা, “নামি?”
নামি যে একটা নাম সেটা বুঝতে পারছি, কিন্তু কার নাম তা জানি না। সেটাই বললাম ওনাদের উদ্দেশ্যে।
“তোমার নাম নামি,” ডাক্তার বললো। “ওনাকে চিনতে পারছো?” পাশের মহিলাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো সে।
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ, এরপর মাথা ঝাঁকিয়ে না করে দিলাম।
“ইনি তোমার মা,” ডাক্তার বললো।
আবারও তাকালাম ভদ্রমহিলার দিকে। মুখে হাত চাপা দিয়ে রেখেছেন তিনি এখন।
ডাক্তার ব্যাখ্যা করে বললো যে আমার বাম চোখে আঘাত পেয়েছি এবং প্রচণ্ড শকে স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছি।
*
একটা গাড়িতে ভোলা হলো আমাকে। পেছনের সিটে মার পাশে বসেছি। সামনে ড্রাইভিং সিটে বসে আছে অচেনা একটা লোক। কিছুক্ষণ পর আমাকে তিনি বললেন যে তিনিই আমার বাবা।
বেশ কিছুক্ষণ ধরেই নানা বিষয়ে আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে যাচ্ছে মা, জবাবে কি বলি সেটা শোনার অপেক্ষায় আছে। কিন্তু কোন জবাব বেরুলো না আমার মুখ দিয়ে, কারণ সে যেসব বিষয়ে কথা বলছে, সবগুলোই আমার অচেনা, অজানা। হতাশ মনে হলো তাকে।
“একদম চুপচাপ হয়ে গেছো তুমি,” বাবা বললো।
আমাদের বাড়ি দেখতে কেমন, সেটাও বেমালুম ভুলে গেছি। দরজায় নামফলকে বড় করে লেখা ‘শিরাকি। আমাদের পারিবারিক পদবি। জুতো খুলে ভেতরের করিডোরে রাখলাম, কিন্তু সেখান থেকে কোথায় যাবো জানি না।
মা হাত ধরে প্রথমে লিভিং রুমে, এরপর রান্নাঘরে নিয়ে গেল আমাকে। “এখানকার কথা তো মনে আছে তোমার?”
মাথা ঝকালাম আমি।
দোতলায় আরেকটা রুমে আমাকে নিয়ে গেল মা। একটা পিয়ানো রাখা আছে একপাশে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে কোন মেয়ের রুম।
“এবার?” জিজ্ঞেস করলো মা।
রুমটা বেশ সুন্দর লাগছিল আমার কাছে, সেটাই বললাম। তখন মা বলল যে এটা আমার নিজের রুম। ছোটবেলা থেকে এখানেই থাকি।
খুব ক্লান্ত লাগছিল। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে পারবো কিনা জিজ্ঞেস করলাম।
“তোমার নিজের ঘর,” বললো মা। “যা ইচ্ছে করো।”
এতক্ষণে খেয়াল হলো যে কাঁদছে সে।
কিছুক্ষণ পর ছবির কয়েকটা অ্যালবাম আর বেশ কয়েকটা ট্রফি হাতে রুমে প্রবেশ করলো বাবা। প্রতিটা ট্রফি কোন না কোন পিয়ানো
প্রতিযোগিতায় জেতা।
“তোমার কি কিছুই মনে নেই?” জিজ্ঞেস করে সে।
মাথা ঝাঁকালাম আবারো।
অ্যালবামের ছবিতে দেখলাম ছোট্ট একটা মেয়ে হাতে স্কুপ নিয়ে তাকিয়ে আছে ক্যামেরার দিকে। দু’চোখ ভর্তি পানি।
“আমাকে কি ছোটবেলায় অনেক খেপাতো বন্ধুরা?” জিজ্ঞেস করলাম।
“এই মেয়েটা তোমার বান্ধবী ছিল। তুমি হচ্ছো ওর পেছনের জন, এই যে এটা। হাসছো মুখে হাত চাপা দিয়ে।”
এরপর আমাকে আরো কয়েকটা ছবি দেখালো বাবা। কিন্তু ওগুলোর কোনটা সম্পর্কেই কোন স্মৃতি নেই আমার। আমার নিজের বানানো একটা ফুলদানি নিয়ে আসলো সে, তবুও কিছু মনে পড়লো না। নিজের প্রিয় টেডি বিয়ারটার নামও ভুলে গেছি, যেটা মা আমাকে দিয়েছিল। এমনকি নিজের পছন্দের সিনেমার নামটাও!