দীর্ঘ একটা সময় অন্ধকারে থাকার পর হঠাৎ এই রঙিন দুনিয়ার হাতছানিতে আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠেছে মেয়েটা। কারাসুও খুব খুশি হলো মেয়েটাকে হাসতে দেখে।
“এত সুন্দর ছিল স্বপ্নটা!” বলে মেয়েটা। “আপনার দেয়া স্টপারটা কোটর থেকে খুলতে ইচ্ছে করছিল না। এমনকি জেগে ওঠার পরেও অনেকক্ষণ খুলিনি। ভাববেন না, কেউ দেখেনি। পায়ের শব্দ শুনেই তাড়াতাড়ি লুকিয়ে ফেলি। আমার বিছানার নিচে একটা কাঁচের বয়ামে রেখে দিয়েছি। কিন্তু একটু একাকী লাগলেই স্টপারটা কোটরে ঢুকিয়ে স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করি। প্রথমে শুধু ঘুমোনোর পরেই বেকারিটা দেখতে পেতাম। কিন্তু এখন দিনের বেলাতেও স্বপ্ন দেখি, দিবাস্বপ্ন।”
“মিস, আপনার জন্যে আরেকটা উপহার নিয়ে এসেছি আজকে।”
“আসলেই?”
কারাসু তাকে বললো যে এবারের উপহারটাও স্বপ্নে ভরপুর। আগ্রহের সাথে রক্তাক্ত চোখটা হাতে তুলে নিল মেয়েটা, এরপর বসিয়ে দিল বাম চোখের খালি কোটরে।
“দেখতে পাচ্ছি কারাসু! দেখতে পাচ্ছি,” বুকের কাছে হাত নিয়ে বলে মেয়েটা। যেন ঈশ্বরের দরবারে ধন্যবাদ জানাচ্ছে অপূর্ব দৃশ্যটার জন্যে। “মনে হচ্ছে কেউ যেন নীল রঙ্গে রাঙিয়ে দিয়েছে পৃথিবীটা। চারিদিকে শুধু রঙ আর রঙ। এই স্টপারটার নীল রঙ প্রবেশ করছে। আমার মনেও।”
এবারে কারাসু যে চোখটা নিয়ে এসেছে সেটা একজন বয়স্ক মহিলার। পাহাড়ি অঞ্চলে ফসলি ক্ষেত আর ফুলের বাগানে ঘেরা এক বাড়িতে বাস করে সে। মেয়েটা যখন কারাসুকে বলেছিল যে নীল রঙের ফুল ভালো লাগে তার, তখনই নীলের সমারোহ থেকে পরবর্তী চোখটা নিয়ে আসবে বলে মনস্থির করে সে।
তার পছন্দের সবকিছু তাকে দেখাতে চাই আমি। এমন কাউকে দরকার যে কিনা সবসময় নীল রঙের ফুলের দিকে তাকিয়ে থাকে।
শহরের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎই একটা নীল ফুলের বাগান চোখে পড়ে কারাসুর। সেই বাগানের মাঝে ছোট্ট একটা বাড়ি। আর বাড়ির ভেতরে বয়স্ক মহিলাটা বসে উল বুনে সারাদিন। প্রত্যেক নাতি নাতনীর জন্যে নিজ হাতে কিছু একটা বুনে দিতে ভালো লাগে তার।
একটা গাছে বসে প্রথমে ভেতরের দৃশ্যটা মনে গেঁথে নেয় কারাসু। চোখে চশমা পড়ে রকিং চেয়ারে বসে একমনে বুনে চলছিল মহিলা। জানালার কাছেই একটা ক্যানারি খাঁচার ভেতরে কিচিরমিচির করছে। কিছুক্ষণ পর চশমাটা খুলে পাশের টেবিলে নামিয়ে রাখে সে। দু’হাত দিয়ে নাকের গোড়ায় হাত বুলায় কিছুক্ষণ। এত লম্বা সময় ধরে একমনে কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল নিশ্চয়ই। অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে যায়।
যতটা সম্ভব নিঃশব্দে জানালা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে কারাসু। রকিং চেয়ারটার একপাশের হাতলে এসে বসে। তার ভারে কিছুটা নড়ে ওঠে চেয়ারটা, তবে মহিলার ঘুম ভাঙে না। কোন এক সুখস্বপ্ন দেখতে ব্যস্ত সে। খাঁচার ক্যানারি পাখিটা ডেকে উঠতে যাবে এমন সময় মহিলার চোখের পাতার নিচে ঠোঁট ঢুকিয়ে দে কারাসু…
“কি সুন্দর ফুলের বাগান!” মেয়েটার গলায় খুশির আমেজ। “এবারের স্বপ্নে আমি কাপড় বুনছি। এর আগে কখনো কিছু বুনিনি।”
আরো সুখী দেখতে চাই আমি তাকে আরো চোখ খুঁজে বের করবো। পুরো পৃথিবী দেখাবো। দুনিয়ার সব জায়গা থেকে চোখ এনে দেব! ওর খুশির জন্যে যে কোন কিছু করতে রাজি।
মেয়েটার চোখের আনন্দাশ্রু দেখে মনে মনে ওয়াদা করলো কারাসু, তার বিছানার নিচে রাখা কাঁচের বয়ামটা চোখে পূর্ণ করে দেব আমি। কানায় কানায় পূর্ণ।
১. সেদিনের ঘটনার বিস্তারিত
প্রথম খণ্ড
১
সেদিনের ঘটনার বিস্তারিত লোকেমুখে শুনেছি কেবল। আমার নিজের কিছু মনে নেই।
সকাল থেকেই পুরো আকাশ ধূসর করে তুষার ঝরছিল। লোক খুব বেশি বের হয়নি বাসা থেকে। যারা বের হয়েছে ছাতা মাথায় দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছুলেই যেন বাঁচে। তবে আমি যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম সেটায় মোটামুটি ভিড়ই বলা চলে।
সেই ভিড়ের মাঝে রাস্তার ওপর হাঁটুতে ভর দিয়ে তুষার হাতড়ে যাচ্ছি। মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি ওপরে আমার মুখটা। কিছু একটা খুঁজছি। পাশেই পড়ে আছে আমার ছাতাটা।
আশপাশে অনেকে থাকলেও কেউই আমার দিকে একবারের বেশি দু’বার তাকাচ্ছে না। আসলে কেউই ঝামেলায় জড়াতে চাচ্ছে না।
তবে কিছুক্ষণ পর এক ভদ্রলোকের বোধহয় আমার ওপর কিছুটা করুণা হলো। এক হাতে একটা ব্রিফকেস এবং আরেক হাতে ছাতা ধরে ছিল সে, অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিল খুব সম্ভবত। তুমি কি কিছু খুঁজছো, মা? জানতে চায় সে।
আমি বোধহয় শুনতে পাইনি তার কথা। কোন জবাব দেইনি।
চোখের কনটাক্ট লেন্স হারিয়ে গেছে? আমি খুঁজতে সাহায্য করবো?
খুঁজতে খুঁজতেই কান্নাভেজা কন্ঠে বললাম, লেন্স না, অন্য কিছু।
তখন লোকটা বুঝতে পারে যে আসলেও কোন সমস্যা হয়েছে আমার। হাতে কোন গ্লোভস না পরেই তুষার হাতড়ে যাচ্ছি। আঙুলগুলো অসাড় হয়ে পড়ছে ঠান্ডায়, কিন্তু আমার কোন প্রতিক্রিয়া নেই।
কতক্ষণ ধরে হাঁটু গেড়ে বসে আছি, জানি না। আমার পিঠেও তুষার জমতে শুরু করেছে। আশপাশের অবস্থা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথাই নেই, শুধু খুঁজে যাচ্ছি একমনে।
আমার কণ্ঠে ভয় আর উৎকণ্ঠা। কোথায় পড়লো?
এসময় লোকটার চোখে পড়লো আরেকটা ব্যাপার। আমার চারদিকের তুষার লাল হয়ে উঠেছে। রক্তের ফোঁটা সবখানে।