সাথে সাথে দোলনা থেকে নেমে ঘরের ভেতরে চলে গেল ছেলেটা।
যে ডাল থেকে দোলনাটা ঝুলছে সেটায় নেমে এলো কাকটা। ওখান থেকে বেকারির দোতলাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেখানে নিজের ঘরে ঢুকে বিছানায় উঠে পড়লো ছোট ছেলেটা।
বেশ, একে দিয়ে শুরু করা যাক তাহলে। সতর্কতা স্বরূপ ছেলেটার ঘুমিয়ে পড়া অবধি অপেক্ষা করলো সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নির্দিষ্ট ছন্দে উঠতে নামতে লাগলো ছেলেটার বুক।
নিঃশব্দে জানালা গলে ভেতরে ঢুকে পড়লো কাকটা। তাজা রুটির ঘ্রাণে ম ম করছে চারদিকে। ছেলেটা এখন গভীর ঘুমে, কাকটার অস্তিত্ব একবারের জন্যেও টের পেল না।
খুব সাবধানে, ছেলেটার ডান চোখ উপড়ে নিল কাকটা। সতর্ক থাকতে হয়েছে যেন তাড়াহুড়োয় উপহারটা নষ্ট না হয়ে যায়।
চমকে জেগে উঠলো ছেলেটা। বাম চোখে দিয়ে কাকটাকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলো তারস্বরে।
“মা! একটা কাক আমার চোখ খেয়ে ফেলছে!”
হন্তদন্ত হয়ে কাকটাকে ধরার চেষ্টা করলো সে এক হাত দিয়ে; তার মায়ের পদশব্দ শোনা যাচ্ছে সিঁড়িতে।
সুযোগ থাকতে থাকতে ডানা ঝাঁপটে ঘরটা থেকে বেরিয়ে পড়লো কাকটা। ঠোঁটে চোখটা চেপে ধরে অনেক উঁচুতে উঠে গেল কিছুক্ষণের মধ্যে। এবারে ম্যানশনটায় ফেরার পালা।
কিন্তু জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকে কাকটা দেখলো ডেস্কের ওপর মাথা দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে মেয়েটা।
কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল কাকটা। ঠোঁটের রক্তাক্ত চোখটা ঘরের মাঝে টেবিলটায় রাখলো প্রথমে, এরপর বললো, “মিস, আপনি কাঁদছেন কেন?”
কাঁপতে কাঁপতে তার দিকে তাকালো মেয়েটা। কণ্ঠস্বর শুনেই বুঝতে পেরেছে সে কোথায় আছে। আমি চাইনি যে তুমি আমাকে এই অবস্থায় দেখো।”
গাল বেয়ে পানি গড়াচ্ছে তার। দৃশ্যটা অনেকটা কাপ থেকে এক ফোঁটা কফি উপচে পড়ার মতন। কাকটার কাছে খুবই সুন্দর লাগলো দৃশ্যটা।
“আজকে আমার সাথে একটা ঘটনা ঘটেছে,” বলে মেয়েটা। “ঘরের মাঝে একটা টেবিল রাখা আছে, দেখেছো নিশ্চয়ই?”
কিছুক্ষণ আগে যে টেবিলটায় চোখটা নামিয়ে রেখেছে সেটার দিকে তাকালো কাকটা। “জ্বি।”
“ওটার ওপরে,” কান্নাভেজা কণ্ঠে বলে অন্ধ মেয়ে, “একটা ফুলদানিতে কিছু ফুল ছিল। আমি ভেবেছিলাম ফুলগুলো একদম তাজা, নীল রঙের।”
আসলে ফুলগুলোর রঙ লাল, বিবর্ণ হয়ে এসেছে।
“আমার মা মিথ্যা কথা বলেছে আমার সাথে।”
“আপনার কি নীল ফুল ভালো লাগে?”
মাথা নাড়ে মেয়েটা। “আমাকে সত্যিটা বললেই তো হতো। বাবা যখন একটু আগে ঘরে এসে বললল লাল ফুলগুলো তো মরে যাচ্ছে মা-তখন সত্যিটা জানতে পারি।”
মেয়েটার কাঁদার দৃশ্য শেলের মত বিধছে কাকটার বুকে।
“কাঁদবেন না, প্লিজ,” বলে সে। “আপনার জন্যে একটা উপহার এনেছি আজকে।”
“উপহার?”
চোখের পানি মুছে ফেলে মেয়েটা। এই ঘরের কোথায় কি আছে সব মুখস্থ তার। মাপা পদক্ষেপে টেবিলটার সামনে পৌঁছুলো সে। এরপর হাতড়াতে হাতড়াতে চোখটা পেয়ে গেল কিছুক্ষণের মধ্যে।
“এটা কি?”
“আপনার কি মনে হচ্ছে হাতে নিয়ে?”
চোখটার ওপর আঙুল বুলিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলো মেয়েটা।
“নরম। নরম আর গোল।”
“আপনার চোখের কোটরে ওটা রাখুন।”
কাঁপা কাঁপা হাতে চোখটা চেহারার কাছে নিয়ে এলো মেয়েটা। “ডান পাশে না বামে?” থেমে জিজ্ঞেস করলো।
“যেটায় ইচ্ছে।”
বাম কোটরে নরম চোখটা ঢুকিয়ে দিল মেয়েটা। সে যেহেতু কিছুই দেখতে পায় না, চোখটা উল্টোভাবে স্থান পেল কোটরে। তবে আটকে রইলো সেখানে, পড়লো না।
“কেমন লাগছে? জানতে চাইলো কাকটা।
“কেমন যেন… শান্ত লাগছে সবকিছু। কিন্তু এটা কি? মনে তো হচ্ছে একটা স্টপার।”
“এটার ব্যাপারে যেন আর কেউ না জানে। কাউকে বলতে পারবেন না যে আমি জিনিসটা এনে দিয়েছি আপনাকে। বাবা-মাকেও না। ওটা চোখে দিয়ে দয়া করে কারো সামনে যাবেন না। বিছানার নিচে লুকিয়ে রাখবেন। আশপাশে যখন কেউ থাকবে না বা কাঁদতে কাঁদতে হয়রান হয়ে গেলে চোখে দেবেন।”
মাথা নেড়ে একবাই হাই তুললো মেয়েটা। তার নতুন চোখটায় হাত বুলালো একবার; ফলে খানিকটা ঘুরে গেলো ওটা।
“ধন্যবাদ, কারাসু, কেন জানে না… হঠাৎই কাকটাকে এই নামে ডেকে উঠলো মেয়েটা। “আপনার উপহারের জন্যে আন্তরিক ধন্যবাদ। শুভরাত্রি।”
বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লো সে।
“শুভরাত্রি,” বলে জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেল কারাসু, নামটা মনে ধরেছে তার। এবারে দ্বিতীয় চোখটা খোঁজার সময় হয়েছে।
*
পরদিন সকালে নতুন একটা উপহার নিয়ে হাজির হলো সে। বাইরের ডালটায় বসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে প্রথমে। যখন নিশ্চিত মেয়েটা একা, জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো।
নতুন উপহারটা আগের জায়গায় রেখে দিল কারাসু। “হ্যালো, মিস।”
“তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম!” মেয়েটা বলে উচ্ছ্বসিত স্বরে। “গতরাতে একটা স্বপ্ন দেখেছি আমি! একটা আসল স্বপ্ন! সবকিছু দেখা যাচ্ছিল সেখানে। শেষ কবে রঙিন কিছু দেখেছিলাম ভুলেই গেছি। আর স্বপ্নটাও ছিল দারুণ। স্বপ্নে, একটা বেকারিতে নিজেকে আবিষ্কার করি আমি।”
চোখ বন্ধ করে স্বপ্নের বিস্তারিত বর্ণনা করে সে। কাকটার বুঝতে সমস্যা হয় না কোটর থেকে তার দেয়া চোখটা বের করে নিলেও স্মৃতিটা মগজে গেঁথে গেছে মেয়েটার।
“স্বপ্নে আমি একটা ছেলে। আমার বাবা আটা কাই করছিল আর মা কেক বানাচ্ছিল। খদ্দেররা সবাই ভেতরে এসে আমাকে একবার আদর করে দেয়। খুব খেলছিলাম। এরপরেই নিজেকে বেকারির বাইরের গাছটায় যে দোলনাটা আছে, সেটা থেকে উল্টোদিকে ঝুলন্ত অবস্থায় আবিষ্কার করি।”