মেয়েটাকে অন্য আলোয় দেখে সে। বেশিরভাগ মানুষই তাকে দেখলে ইট বা হাতের কাছে যা খুঁজে পায়, ছুঁড়ে মারে। কিন্তু এই মেয়েটা সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকে একা একা, জানালার ধারে। বাইরের শব্দগুলো অনুভবের চেষ্টা করে। তার একাকীত্ব কাকটাকেও পীড়া দেয় যেন।
“হ্যালো মিস,” মেয়েটার উদ্দেশ্যে বললো সে।
সাথে সাথে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার চেহারা। যেন প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে একটু উষ্ণ বাতাসের আবাহন ঘটেছে। “তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না!” পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা হলে যেভাবে কথা বলে সবাই, ওভাবেই কথাটা বললো। এতদিনে কাকটার সাথে তুমি করে কথা বলা শুরু করেছে। সে। “কতবার বলেছি নক করে ভেতরে ঢুকবে!”
মেয়েটার কথা বলার ভঙ্গি ভীষণ আনন্দিত করলো কাকটাকে। ডিম ফেটে বেরুবার পর থেকে আজ অবধি কখনো এরকম অনুভূতি হয়নি। তার মা কখনো তাকে গান গেয়ে শোনায়নি, কেবল কেঁচো ধরে এনে খাওয়াতো। ভাইবোনগুলোও গতানুগতিক পাখিদের মতনই ছিল। জীবন বলতে খাওয়া আর ঘুম তাদের।
সারাজীবন যে সিনেমাগুলো দেখেছে সেখান থেকেই নানারকম গল্প মেয়েটাকে শোনাতে কাকটা। শুধু এই গল্পগুলোর ব্যাপারেই কথা বলতে তারা। নিজের পরিচয় ইচ্ছে করেই গোপন করেছে, সেটার ফলাফল হয়তো ভালো হবে না। বরং বানিয়ে বলেছে অনেক কিছু।
একদিন মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলো সে, “আচ্ছা মিস, আপনার চোখগুলো কোথায় গেল?”
“ছোট বেলার এক দুর্ঘটনায় চোখ দুটো হারিয়েছি,” যথাসম্ভব নিস্পৃহ কণ্ঠে বলে মেয়েটা। “এক রবিবারে বাবা-মা’র সাথে চার্চে গিয়েছিলাম। চার্চটার জানালায় খুব সুন্দর নকশা করা ছিল, পুরোটা সময় সেদিকেই তাকিয়ে ছিলাম আমি, চোখ বড় বড় করে। আর সেটাই ছিল জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। আচমকা জানালার বিশাল কাঁচটা ভেঙে যায়। কিভাবে ভাঙলো তা জানা যায়নি, হয়তো কেউ পাথর ছুঁড়ে মেরেছিল। এক মুহূর্ত আগেই ভাবছিলাম যে জানালাটা কত সুন্দর, আর পরমুহূর্তে ঝরঝর ভেঙে পড়ে গোটা জানালা।”
মেয়েটার কথা শুনে সিনেমা হলের প্রজেক্টরের আলোয় ভেসে বেড়ানো ধূলিকণাগুলোর কথা মনে পড়ে গেল কাকটার।
“দু’টো ধারালো কাঁচের টুকরো বিঁধে যায় আমার দুই চোখে,” মেয়েটা বলে। “বাম চোখে নীল কাঁচ আর ডান চোখে লাল। দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হয় আমাকে, কিন্তু ততক্ষণে আর কিছু করার ছিল না। রক্তপাত বন্ধ করতে আমার দুটো চোখই তুলে ফেলতে হয়। আমার দেখা শেষ দৃশ্যটা ছিল, অজস্র রঙিন কাঁচ বৃষ্টির মত ঝরে পড়ছে। খুবই সুন্দর একটা দৃশ্য।”
কেউ একজন কড়া নাড়লো দরজায়।
“মিস,” কাকটা বললো, “আমার সাথে কথা বলার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। এখন আমাকে আসতে হবে।”
মেয়েটার আপত্তি সত্ত্বেও দ্রুত জানালা গলে বাইরে বেরিয়ে এলো সে।
খুব বেশিদূরে অবশ্য গেল না। জানালার পাশের ডালটায় বসে রইলো। কিছু দেখা না গেলেও ভেতরের শব্দ শোনা যায় এখান থেকে।
কেউ একজন দরজা খুলে প্রবেশ করেছে ভেতরে। “আমি ভাবলাম কারো সাথে কথা বলছিলে তুমি। কেউ এসেছিল?”
কণ্ঠস্বর শুনে মনে হচ্ছে মেয়েটার মা এসেছে।
না দেখলেও কাকটা বুঝতে পারল যে জবাবে কিছু একটা বানিয়ে বলতে বেগ পেতে হচ্ছে মেয়েটাকে। যেরকম অদ্ভুত আনাগোনা তার, এরকমটাই তো হবার কথা। মেয়েটা জানেও না যে সে আসলে কি।
ডানা ঝাঁপটে গাছটা থেকে নেমে পড়লো সে। কিছুক্ষণের মধ্যে বেশ উঁচুতে উঠে গেল। ওপরে অন্তহীন নীল আকাশ আর নিচে ধূসর যান্ত্রিক শহর।
ওকে সব কিছু দেখাতে চাই আমি। আজকের আগে কাকটা বুঝতে পারেনি যে মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলেছে সে।
চোখ দুটো কিভাবে হারিয়েছে সেটা এমন ভঙ্গিতে বলেছে মেয়েটা যেন জীবনের প্রতি আগ্রহই হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু কাকটা যখন সিনেমায় দেখা চমৎকার সব দৃশ্যের বর্ণনা দেয়, একটা প্রশান্তির ভাব ফুটে ওঠে তার চেহারায়। চোখ থাকলে বলা যেত স্বপ্নাতুর দৃষ্টি ভর করছে চোখে। “আমিও দেখতে চাই”, মনে মনে নিশ্চয়ই বলে মেয়েটা।
“আমার স্বপ্নগুলো সব অন্ধকার এখন,” একবার বলেছিল মেয়েটা। এরপরই প্রসঙ্গ বদলে নিজের কষ্ট গোপনের চেষ্টা করে। নিজের প্রিয় বিষয়গুলো কথা বলতে থাকে।
“আপনার কি অন্ধকার ভয় লাগে?” জিজ্ঞেস করে কাকটা।
কিছুক্ষণ ভাবে মেয়েটা, এরপর আলতো মাথা নাড়ে।
মেঘের নিচ দিয়ে উড়ে চলে কাকটা। কোনভাবে যদি তার দৃষ্টিতে আবার রঙ ফিরিয়ে দিতে পারতাম! দরকার হলে পুরো দুনিয়া চষে ফেলবো, রক্তে রাঙিয়ে দেব পথঘাট! তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল সে, শহরের অসংখ্য চোখ থেকে দু’একটা নিয়ে এলে কোন ক্ষতি হবে না।
.
২
একটা বেকারির ছাদে নেমে এলো কাকটা। আশপাশে নজর বুলাতে লাগলো সতর্ক চোখে। বেকারির পেছনে একটা সবুজ গাছ। ডালগুলো এমন ভাবে বেড়েছে ওটার যেন কোন বডিবিল্ডার নিজের মাসল দেখাচ্ছে। বেকারি মালিক টায়ার দিয়ে বানানো একটা দোলনা ঝুলিয়ে দিয়েছে ডাল থেকে। তার পাঁচ বছর বয়সী ছেলেটা মনে সুখে দোল খায় সেখানে। বর্তমানে অবশ্য ছেলেটাকে উল্টো হয়ে ঝুলতে দেখা যাচ্ছে।
বেকারির ছাদে বসে ছেলেটাকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলো কাকটা। ভেতর থেকে ছেলেটার মায়ের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো কিছুক্ষণ পর, “এখন ঘুমোনোর সময় তোমার! ভেতরে এসো তাড়াতাড়ি।”