কিন্তু ব্যাপারটা অদ্ভুতও লাগছিল। আমি জানি না ও কিভাবে হাসতে পারছিল। ও তো জানে যে আজকে ওকে মরতে হবে।
“একটু আগে যে চিৎকার শুনলাম, তোমার বোনের নাকি?”
“হ্যাঁ। আপনি ওর কথা শুনতে পেয়েছিলেন?”
“শুনতে পেয়েছি কিন্তু বুঝতে পারিনি কি বলছিল। তাই ভাবছিলাম তোমার বোন কিনা।”
তারপর মেয়েটা আমাকে তার বাসার কাহিনী বলল। সে বলল আমি নাকি দেখতে তার ভাগ্নের মত। এখানে বন্দি হওয়ার আগে ও একটা
অফিসে কাজ করত, ছুটির দিনে সিনেমা দেখতে যেত, ইত্যাদি।
“তুমি যখন বাইরে যেতে পারবে, আমি চাই তুমি এটা আমার পরিবারকে পৌঁছে দেবে।” ও গলা থেকে নেকলেস খুলে দ্রুত আমার গলায় পরিয়ে দিল। জিনিসটা একটা রুপার চেইন, সাথে ছোট্ট একটা ক্রুস। ওর কাছে কুসটা ছিল নিরাপত্তার প্রতীক। এখানে আসার পর প্রতিদিন ও ক্রুসটা মুঠোয় ধরে প্রার্থনা করত।
পুরোটা দিন মেয়েটার সাথে কাটালাম। আমরা একজন আরেকজনের বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। রুমের এক কোনায় পাশাপাশি দেয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে সারাদিন গল্প করলাম। সেই মুহূর্তগুলোতে সিলিঙের ম্লান বাটা দেয়ালে আমাদের বড় ছায়া ফেলছিল।
রুমের একমাত্র শব্দটা ছিল নালা দিয়ে কুলকুল করে পানি বয়ে যাওয়ার শব্দ। হঠাৎ আমার মনে পড়ল নালা দিয়ে যাওয়া আসার কারনে আমার শরীরের বাজে গন্ধের কথা। তখন আমি একটু সরে বসলাম।
“কি হল সরে যাচ্ছ কেন?” সে হেসে বলল। “আমি নিজেও তো কতদিন গোসল করিনি। আমার নাক আর কাজ করছে না। এখানে পুরোটা সময় আমি ভেবেছি যে কখনো যদি বের হতে পারি তাহলে সবার আগে একটা ভাল মত শাওয়ার নিব। আবার পরিস্কার হওয়ার জন্য ছটফট করছি আমি।”
আমাদের কথার মাঝে মাঝে সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিল। বিষয়টা আমার কাছে অদ্ভুত লাগছিল। “আজকে যদি তুমি মারা যাও, তাহলে কেন কাঁদছ না?” আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম। আমি নিশ্চিত আমার মুখে বিভ্রান্তিটা পরিস্কার ফুটে উঠেছিল।
সে এক মিনিট চিন্তা করে তারপর বলল, “কারন আমি ব্যাপারটাকে মেনে নিয়েছি।” ওকে দেখে মনে হচ্ছিল চার্চের সামনে রাখা কোন দেবীদের মূর্তির মত। একই সাথে দয়াশীল আবার একাকীও।
যাওয়ার সময় সে আমার হাত জড়িয়ে ধরল।
“খুব নরম,” সে বলল।
ছয়টা বাজার আগেই আমি রুমে ফিরে এলাম।
আপুকে যখন গলার নেকলেসের কাহিনী বললাম তখন ও শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরল।
তারপর আবার নালার পানি লাল হতে শুরু করল। একটু আগে আমার সাথে বসে থাকা মেয়েটার চোখ আর চুল ভেসে যেতে দেখলাম।
নালা দিয়ে ওর আঙুল ভেসে যাচ্ছিল। আস্তে করে দু হাত দিয়ে সেটা পানি থেকে তুললাম। এটা সেই হাতের আঙুল যা আমি চলে আসার আগে আমাকে আঁকড়ে ধরেছিল। আঙুলে সেই উষ্ণতার আর কোন কিছুই অবশিষ্ট নেই। জিনিসটা এখন স্রেফ এক টুকরো মাংস মাত্র।
আমার বুকের ভেতর নিদারুণ কষ্ট হতে লাগল। মাথার ভেতর সবকিছু যেন নালার পানির মত লাল বর্ণ ধারন করল। পুরো দুনিয়া লাল হয়ে, গরম হয়ে ফুটতে লাগল। ওই মুহূর্তে আর কোন কিছু চিন্তা করতে পারছিলাম না।
যখন খেয়াল হল তখন দেখলাম আমি আপুর বাহুর মধ্যে কাঁদছি। ও আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। নালার শক্ত পানিতে বারবার ভিজে আমার চুল সব শক্ত হয়ে গিয়েছিল।
“আমি বাসায় যেতে চাই,” আপু বলল। ওর কণ্ঠটা কেমন মিষ্টি শোনাল, এই ধূসর কংক্রিটের জায়গাটার সাথে একদম খাপ খাচ্ছিল না।
আমি শুধু উত্তরে মাথা ঝাঁকালাম।
পঞ্চম দিন : বুধবার
কেউ খুন করে। কেউ খুন হয়। এই সাতটা রুমকে ঘিরে চলা নিয়মগুলো একদম শর্তহীন। সাধারনত যে খুন করে সেই একমাত্র নিয়মগুলো জানে। আমরা যারা খুন হব তাদের কিছু জানার কথা নয়।
কিন্তু এইবার একটু ব্যতিক্রম হল।
যে লোক আমাদেরকে এখানে ধরে এনেছে সে আমাকে আর আমার বোনকে একই রুমে রেখেছে। আমি যেহেতু এখনও একটা বাচ্চা ছেলে, আমাকে হয়ত সে একজন পুরো মানুষ হিসেবে গোনায় ধরেনি। হয়ত আপুকেও সে অর্ধেক মানুষ হিসেবে ভেবেছিল। হাজার হোক ও একজন টিনেজার। হয়ত খুনি ভেবেছে আপু আর আমি মিলে একজন পুরো মানুষের সমান হই-ভাই বোনের একটা সেট।
কিন্তু আমি যেহেতু ছোট মানুষ, আমার পক্ষে নালা দিয়ে অন্য রুমগুলোতে যাওয়া সহজ ছিল। আর সেভাবেই আমরা খুনির বানানো খেলার নিয়মগুলো একটু বদলে দিতে পেরেছি। খুনির কোন ধারণা নেই যে আমরা যারা খুন হতে যাচ্ছি তারা তার খুনের ছক আন্দাজ করে জেনে ফেলেছি।
অবশ্য কোন উপায় নেই যে ছক একদম উলটে ফেলা যাবে। এখানের মৃত্যুর নিয়মগুলো হয়ত দেবতাদের নিজেদেরই তৈরি করা, কে জানে।
কিন্তু আপু আর আমি একটা প্ল্যানের কথা ভাবছি যা দিয়ে হয়ত আমরা এখান থেকে জান নিয়ে বের হতে পারব।
***
আমাদের চতুর্থ দিন শেষ। পঞ্চম দিন, বুধবার শুরু হয়েছে। দ্বিতীয় রুমের মানুষটা উধাও। তার জায়গায় নতুন একজন এসেছে।
সাত রুমের নিয়মগুলো এই প্যাটার্নে পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। আমরা জানি না এই পুনরাবৃত্তি কতদিন ধরে চলছে। কত মানুষের টুকরো টুকরো লাশ এই নালা দিয়ে ভেসে গিয়েছে।
আমি দেয়াল পার হয়ে গিয়ে সবার সাথে কথা বলতে পারি। স্বাভাবিকভাবে কেউই আনন্দে ছিল না। কিন্তু তারপরেও প্রতিবার আমি চলে আসার সময় তারা আমাকে আবার দেখতে চাইত। কেউই তাদের রুমে একা থাকতে চাইত না। কেউ চাইত না একাকী নিজের দুশ্চিন্তায় ডুবে যেতে বাধ্য হতে। সেভাবে কেউ বেঁচে থাকতে পারে না।