বলটি মাটিতে ছুঁড়ে ফেলো, আকবর আদেশ দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে একজন পরিচারক লম্বা সাঁড়াশি দিয়ে বলটি ঝুড়ি থেকে তুলে ছুঁড়ে দিলো। আগেই আকবর সেদিকে ঘোড়া ছুটিয়েছেন এবং কাছে পৌঁছে তিনি জ্বলন্ত গোলকটিকে পোলোর ডাণ্ডা দিয়ে আঘাত করলেন। খেলা শুরু, তিনি চিৎকার করলেন। শীঘ্রই আধার ঘেরা নদীর তীরটিতে ঘোড়ার খুরের শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো এবং সেই সঙ্গে হাস্যরত মানুষের উল্লসিত চিৎকার। খেলা চললো ততক্ষণ পর্যন্ত যখন চাঁদ আকাশের অনেক উপরে পৌঁছে যমুনার কাদাজলকে তরল রূপায় পরিণত করলো।
সেদিন রাতে যখন হেকিম আকবরের আড়ষ্ট পেশীগুলি গরম তেল দিয়ে মালিশ করছিলো তখন আকবর চিন্তা করছিলেন কেনো তৈমুর একবারও যুদ্ধে পরাজিত হননি। তিনি অপ্রত্যাশিতভাবে আক্রমণ করতে পছন্দ করতেন- আঘাত এবং তারপর পলায়ন। এভাবেই তিনি সমগ্র এশিয়াতে তাঁর আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন, কোনো বস্তুগত বা মানুষের বাধা তা যতোই শক্তিশালী হোক, তার অগ্রগতিকে প্রতিহত করতে পারেনি। বরফে জমাট বাধা হিন্দুকুশ পর্বতের খাড়া ঢাল বেয়ে নামার সময় তিনি মানুষখেকো উপজাতিদের আক্রমণ এতো সহজে মোকাবেলা করেছেন যেনো তিনি তাঁর লোমশ পোষাকের গা থেকে মাছি তাড়িয়েছেন।
তৈমুরের যুদ্ধ কৌশলগুলি হয়তো রানা উদয় সিং এর মতো আধুনিক শক্রদের মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না যারা কামান দ্বারা সুসজ্জিত এবং মরুভূমিতে গড়ে তোলা উঁচু দেয়াল বিশিষ্ট দূর্গে অবস্থান করছে, আকবর ভাবলেন। কিন্তু তৈমুরের আত্মবিশ্বাস এবং লক্ষ থেকে বিচ্যুত না হওয়ার চূড়ান্ত প্রত্যয় দুশ বছর আগে যেমন ছিলো, এখনো তেমনি ভাবে কার্যকরী। যোদ্ধা পূর্বপুরুষের সমকক্ষ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা এমন দুরন্ত শক্তিতে আকবরের রক্তের শিরায় চঞ্চলতা সৃষ্টি করছিলো যে তিনি হেকিমের মালিশরত হাতের নিচে স্থির থাকতে পারছিলেন না। কিন্তু সেই দিন আর বেশি দূরে নয় যখন আগ্রা দূর্গের সিংহদ্বার থেকে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠবে এবং মোগল সৈন্যরা দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত রাজস্থানের ফ্যাকাশে কমলা বর্ণের মরুভূমি দিয়ে মেওয়ার এর দিকে যাত্রা করবে উদ্ধত রানাকে শায়েস্তা করার জন্য। আকবরের মা হামিদা তাঁর কাছে রাজস্থানের মরুভূমির এতো পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন যে তিনি আগ্রায় বসেই সেখানকার শুষ্ক বালুময় বাতাস এবং সেখানে বিচরণকারী ময়ূরের কর্কশ ডাকের আবহ অনুভব করছেন। রাজস্থান সম্পর্কে হামিদার এই সুগভীর জ্ঞান অস্বাভাবিক কিছু নয়। তিনি সেখানকার একটি ছোট মরুশহরে আকবরকে জন্ম দিয়েছেন যখন তিনি এবং হুমায়ুন রাজপুত রাজার ধাওয়ার মুখে আত্মগোপন করেছিলেন। ঐ রাজা শপথ নিয়েছিলো সে আকবরকে হামিদার গর্ভ থেকে জীবন্ত কেটে বের করে অজাত (এখনো যার জন্ম হয়নি) শিশুটিকে শের শাহ্ এর কাছে উপহার হিসেবে পাঠাবে। শের শাহ্ সেসময় হুমায়ূনকে সিংহাসন চ্যুত করেছিলো।
সেই রাজপুত রাজা এখন মৃত। কিন্তু উদয় সিংকে দমন করা এবং মেওয়ার এর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করা তখন সময়ের দাবি। আগ্রা থেকে দক্ষিণ দিকে যাওয়ার একমাত্র পথে মেওয়ার এর অবস্থান হওয়ায় কৌশলগত ভাবে এর গুরুত্ব অপরিসীম। কল্পনার চোখে আকবর দেখতে পেলেন তাঁর সৈন্যরা উদয় সিং এর রাজধানী চিত্তরগড় দূর্গের দরজা আঘাত করে ভেঙ্গে ফেলছে, যেখানে তার পরিবার আটশ বছর ধরে বসবাস করছে। রাজপুতদের নেতা উদয় সিংকে পরাজিত করতে পারলে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে তাঁকে সকলে ভয় পাবে এবং সম্মান করবে এবং আর কেউ তার বিরোধীতা করার সাহস পাবে না।
.
০৭. জাফরানী যোদ্ধা
ডিসেম্বরের এক মেঘশূন্য দিন। তখন ভোরবেলা, আকবর মেওয়ার এর রানার বিশাল দুর্গ-শহর চিত্তরগড়ের দিকে তাকিয়ে ছিলেন-তার পাশে আহমেদ খান দাঁড়িয়ে আছেন। দুর্গের বালুপাথরের দেয়াল তিন মাইলের বেশি দীর্ঘ। রাজস্থানের শুষ্ক মালভূমি থেকে খাড়া পাঁচশ ফুট উপরে পাথুরে দেয়াল নিয়ে বর্ধিত হয়ে আছে দুর্গের কাঠামো। দুর্গপ্রাচীরের ভিতর রয়েছে মন্দির, রাজপ্রাসাদ, বাড়িঘর, বাজার এবং সেনা শিবির।
ইতোমধ্যে ছয় সপ্তাহ ধরে দুর্গশহরটিকে অবরোধ করে রাখার পরও কোনো প্রতিক্রিয়া না হওয়ায় আকবর ভীষণ হতাশ হয়েছেন। প্রাথমিক ভাবে তিনি নিজেদের অগ্রগতিতে সন্তুষ্ট ছিলেন। তারা চিত্তরগড়কে সম্পূর্ণরূপে ঘিরে ফেলেছেন, শহরগামী খাদ্যসরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে এবং রাজপুতদের পাঠানো অনুসন্ধানী দলের সদস্যদের হয় বন্দী করা হয়েছে নয়তো হত্যা করা হয়েছে। বন্দীদের কাছ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও পাওয়া গেছে। একটি দশ বছর বয়সি হাড্ডিসার বালক তার দুই বড়ভাই সহ ধরা পড়েছে। তারা মরিয়া হয়ে দূর্গের বাইরের দিকের দেয়াল বেয়ে নেমে এসেছিলো খাদ্যের সন্ধানে। আকবরের সৈন্যরা বালকটিকে তার ভাইদের কাছ থেকে পৃথক করে ফেলে এবং সদ্য ঝলসানো ভেড়ার মাংসের লোভ দেখায়। অনেক মিষ্টি কথায় প্ররোচিত করার পর সে বলে, উদয় সিং নিজে প্রতিরোধকারী সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব প্রদান করছে না। জয় মাল এবং পাট্টি নামের দুইজন সেনাপতিকে সে এ দায়িত্বে নিযুক্ত করেছে। বালকটি আরো বলে, উদয় সিং আরাভাল্লি নামক পার্বত্য এলাকায় নিজের নামানুসারে উদয়পুর নামের একটি নতুন রাজধানী নির্মাণে ব্যস্ত আছে।