হয়তো তোমার কথাই ঠিক, সেলিম বললো, তার ক্রোধ কিছুটা প্রশমিত হয়েছে। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব, আমিতো অনেক দিন রাজসভা থেকে বিচ্ছিন্ন। ছিলাম?
সকলের মনে এই ধারণা সৃষ্টি করার চেষ্টা করো যে তুমি তাদের অতীতের ভুল ত্রুটি ভুলে যেতে প্রস্তুত।
এর জন্য যদি আমি আমার বাবার কিছু উপদেষ্টার পুত্রদের আমার নিজের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেই তাহলে কাজ হতে পারে, কি বলো?
সেটা করলে আমাদের দলে গুপ্তচর ঢুকে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং বিরোধও সৃষ্টি হতে পারে।
তা হয়তো ঠিক, কিন্তু বাস্তবতা হলো এই যে আমাদের লুকানোর কিছু নেই। এলাহাবাদ থেকে ফিরে আসার পর আমি তেমন কিছু কি করেছি? ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করা ছাড়া এবং বাবার প্রতিটি তুচ্ছ আদেশ উৎসাহের সঙ্গে পালন করা ছাড়া আমিতো আর কিছু করিনি। আমি আমার আবেগকে রুদ্ধ করে রেখেছি। দুই একটা ক্ষোভের কথা কেবল তোমার কাছে প্রকাশ করেছি যেমন বাবা এখনোও আমাকে তেমন কোনো ক্ষমতা দিচ্ছেন না বা সেনাবাহিনীর কোনো উচ্চ পদ প্রদান করছেন না।
তোমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আরো অধিক নিশ্চিত হওয়ার আগে বৃহৎ সেনাবাহিনীর দায় দায়িত্ব তোমাকে প্রদান না করার জন্য তোমার বাবাকে ক্ষমা করা যায়।
তার পক্ষে এমন আচরণ করাই স্বাভাবিক, আমি বুঝতে পারছি, সেলিম উত্তর দিলো, রাগ সরে গিয়ে এখন তার চেহারায় অস্পষ্ট হাসি ফুটে উঠেছে। তারপর ভ্রূজোড়া সামান্য কুচকে সে জিজ্ঞাসা করলো, তুমি নিশ্চয়ই মনে করো না বাবা আমাকে বঞ্চিত করে আমার পুত্রের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন?
সত্যি কথা বলতে কি, আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত নই…যদিও বর্তমানে তাঁর বয়স ষাট পেরিয়ে গেছে, তবুও এখনো তিনি একজন চতুর এবং জটিল মানুষই রয়ে গেছেন। এখন তিনি নিজের মনোভাব গোপন রেখে তার আশেপাশের মানুষদের উদ্দেশ্য এবং উদ্বেগ আঁচ করতে পারেন। সম্ভবত ইচ্ছা করেই তিনি খোসরুকে সামান্য মৌন সমর্থন প্রদান করছেন এটা ভেবে যে তুমি সেটা বুঝতে পারবে। তিনি হয়তো আশা করছেন এর ফলে তোমার উপর চাপ সৃষ্টি হবে এবং তুমি পরিশীলিত জীবন যাপনের ব্যাপারে আরো বেশি সতর্ক হয়ে উঠবে।
এ ধরনের ঠাণ্ডা ষড়যন্ত্র করাই তার স্বভাব, সেলিম আবার চিৎকার করে উঠলো। তিনি এখনোও আমার অনুভূতির প্রতি উদাসীন। খোসরু যখন জানতে পারবে তাকে উত্তরাধিকার প্রদানের বিষয়ে প্রস্তাব উঠেছে তখন তার মনে অবাস্তব আকাক্ষা সৃষ্টি হবে।
তাহলে তুমি এখন কি করবে?
বাইরে বাইরে আমি এমন ভাব দেখাবো যে আমি এই সব গুজবে কোনো গুরুত্ব দিচ্ছি না এবং দায়িত্বশীল সন্তানের মতো আচরণ করবো। কিন্তু গোপনে আমি আরো বেশি লোককে আমার দলে টানার চেষ্টা করবো এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে আমি ক্ষমতায় গেলে তাঁদের ব্যাপক ভাবে পুরস্কৃত করবো। সেই সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করবো যাতে প্রয়োজন দেখা দিলে পর্যাপ্ত সংখ্যক সেনাকর্তা এবং সশস্ত্র সৈন্য আমার স্বপক্ষে দাঁড়ায়। এ ব্যাপারে তোমার সাহায্য প্রয়োজন। তুমি আমার তুলনায় অনেক খোলামেলা ভাবে কথা বলতে পারো।
আপনি আমার সাহায্য পাবেন জাঁহাপনা।
এদিকে আমি চেষ্টা চালাবো খোসরুর মানসিকতা এবং আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে ধারণা পেতে…
*
সেলিম সময় নষ্ট না করে একদিন পরেই খোসরুর সঙ্গে নিজের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করলো। তীর ছোঁড়ার অনুশীলনের স্থানে পিতাপুত্র মিলিত হলো। তুমি আজ আমার সঙ্গে মিলিত হওয়ার আমি খুব খুশি হয়েছি, ধনুকে তীর পড়াতে পড়াতে সেলিম মন্তব্য করলো। তারপর খড়ের মনুষ্য আকৃতির লক্ষ্যবস্তুর দিকে সতর্কভাবে তাক করে তীর ছুড়লো। তীরটি লক্ষ্যবস্তুর বুকে বিদ্ধ হলো।
ভালো লক্ষ্যভেদ করেছো বাবা, খোসরু বললো, তারপর নিজের ধনুকে তীর পড়িয়ে ছুড়লো। খোসরুর তীরটি সেলিমের তীরটি থেকে এক ইঞ্চি দূরে বিদ্ধ হলো। তারপর ধনুক নামিয়ে মন্তব্য করলো, তোমার সঙ্গে সময় কাটাতে আমারও ভালো লাগে।
খুব ভালো। আমরা দীর্ঘ দিন পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেছি। আমি চাই না তুমি এমন ভাবো যে এলাহাবাদে এতোগুলি মাস অতিবাহিত করার সময় তোমার কথা আমার স্মরণ ছিলো না।
আমি এমনটা ভাবিনি।
আমি যা করেছি তা সাম্রাজ্যের মঙ্গলের জন্য এবং তোমাদের জন্য করেছি।
খোসরু একটি হতাশ হাসি প্রদান করলো। কিন্তু বর্তমানে সাম্রাজ্য শাসন করছেন আমার দাদা। আল্লাহর কৃপায় তিনি স্বর্গে গমন করে তার পুরষ্কার প্রাপ্তির আগে আরো দীর্ঘ সময় এভাবে শাসন করুন আমি এই কামনা করি। এই সময়ের মধ্যে আমাদের কার ভাগ্যে কি ঘটবে তা কে বলতে পারে। তুমি কি বোঝাতে চাইছো? সেলিম জিজ্ঞাসা করলো, তার গলার স্বর তীক্ষ্ম। শোনালো। সেই সঙ্গে ধনুক তুলে আবার সে তীর ছুড়লো।
আমি কেবল বোঝাতে চেয়েছি দাদার শাসনামলের বাকি সময়টায় কি ঘটবে তা আমাদের পক্ষে আগে থেকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। আমরা সকলেই মরণশীল। আমরা যদি বেঁচেও থাকি সময় আমাদেরকে ঠিকই বদলে দেবে এবং আমাদের সম্পর্কে অন্যদের ধারণাও পাল্টাবে। এবার খোসরু তীর ছুড়লো। তার ছোঁড়া তীরটি সেলিমের শেষের তীরটিকে দুভাগ করে খড়ের মানুষের দেহে ঢুকে গেলো। বিষয়টি কি কোনো দৈবদুর্ঘটনা নাকি কোনো অশুভ সংকেত? সেলিম ভাবলো। নিজে থেকেই তার মনে পড়ে গেলো সেই সুফি সাধকের সতর্কবাণী, তার পুত্রদের ব্যাপারে সতর্ক থাকার কথা। ধনুকে আরেকটি তীর পড়িয়ে সে ছুড়লো যেটা খড়ের মানুষের গলায় বিদ্ধ হলো। তোমার কথা ঠিক, আমাদের জীবন ঐশ্বরিক নির্দেশনায় চালিত হয়। কিন্তু আমাদেরকে প্রাকৃতিক নিয়মও মেনে চলতে হয় যেখানে পুত্ররা পিতার মৃত্যুর পর নিজেদের দায়িত্ব ও পদমর্যাদা অধিকার করে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। আমরা কেউই এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটুক তা আশা করি না।